[প্রাক্তন আধারকে একটি কমেন্ট করার সময় ভাবলাম পোষ্টাকারেই দেই]

সীমান্তে নির্বিচারে মানুষ হত্যার সাথে আমাদের সংস্কৃতিরও এক বিশেষ দিক জড়িত আছে, ভারতের সংস্কৃতিও এমন কিছু উন্নত নয়। সেটা হল উর্দিওয়ালারা যা ইচ্ছে করতে পারে, বিশেষ করে গরীব লোকের ওপর, সরকার গা করবে না, বড়জোর কিছু মানবাধিকার সংস্থা কান্নাকাটি করবে। সোজা কথায় দুই দেশেই মানবাধিকারের স্বাভাবিক ধারা চরম ভাবে লঙ্ঘিত হয় নিত্যই, এবং তাতে সরকারগুলির, এমনকি কখনো বা আম জনতারও সায় থাকে। আমাদের দেশে এর চরম উদাহরন ক্রশফায়ার। ক্রশফায়ার প্রকল্প যে কোন মানবাধিকার সংস্থাই নিন্দা জানাবে কিন্তু সরকারের পূর্ন অনুমোদিত জনতার কাছে এই পদ্ধুতি বিপুল জনপ্রিয়। এই দিক উপেক্ষা করে কেবল গালাগালি কান্নাকাটি করলে কিংবা চটকদার মহাষড়যন্ত্র তত্ত্ব কল্পনার মিশেল ঘটিয়ে আমদানি করে অপূর্ব কথ্য ভাষায় রাজনৈতিক ফ্যান্টাসি রচনা সমস্যার সমাধান তো দূরের কথা মূলও বোঝা যাবে না।

আমার কথা খুব আঁতেলীয় কিছু নয়। অত্যন্ত বাস্তব। অন্ধ আবেগ, এক তরফা বিশ্লেষন থেকে একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তথ্য যুক্তি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কথা উঠেছে যে ‘গরু চোর’ কিংবা অবৈধ সীমান্ত অতিক্রমকারি হলেই তাদের কি গুলি করে হত্যা করা যায়? মানবাধিকারের স্বীকৃত ধারা, এমঙ্কি ভারতীয় স্বাভাবিক আইনের ধারাও বলে যে অবশ্যই যায় না। অন্যদিকে ভারতীয় আইন রক্ষকরা সরাসরিই বলে থাকেন যে তারা গরু চোরদের যায়গাতেই গুলি করে মারা জাষ্টিফাইড বলে মনে করেন। ভারতীয়দের গুল্লি মারি? ব্যাটারা নব্য সাম্রাবাজ্যবাদী, গরীব ছোট বাংলাদেশকে পাত্তা দেয় না? বর্বরের মত আচরন করে?

এবার হজম করার মত তথ্য হল যে এই গুলি করে নির্বিচারে ‘গরু চোর’ নিধনে আমাদের দেশের সীমান্তরক্ষীরাও প্রকাশ্যেই জাষ্টিফাইড বলে ঘোষনা করেন। কি বুঝলেন? সভ্য জগতের যাবতীয় কালা কানুন, মানবাধিকার মাড়িয়ে শুধুমাত্র গরু কিংবা আদম পাচারকে ভারত বাংলাদেশ দুই দেশের সীমান্ত রক্ষকরাই অন দ্যা স্পট গুলি করে হত্যা করার মত মহা অপরাধ বলে মনে করেন! বাংলাদেশ পক্ষ থেকে শুধুমাত্র সেসব ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ জানানো হয় যেখানে ভিক্টিম কথিত গরু চোর নয়, নিরীহ চাষী, কিংবা বিএসএফ সীমান্ত পেরিয়ে যখন মাস্তানি করে তখন। স্পেসিফিক্যালি বিএসএফ এর বেশ কিছু গুলি করে হত্যা করার ঘটনা আমাদের বিজিবি জাষ্টিফাইড রায় দেয়, হয়ত মিডিয়ায় সেসবই প্রকাশ হলে আমরা ভারতীয়রা কত বর্বর বলে কান্নাকাটি করি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট থেকেঃ (সূত্র নীচে আছে)

ভারতীয় সীমান্ত কর্তার ভাষ্য শুনুনঃ

During an official visit to Bangladesh in September 2010, Raman Srivastava, Director General of the BSF, responded to Bandgladesh’s complaints that the BSF were killing “innocent, unarmed” Bangladeshi civilians by saying: “We fire at criminals who violate the border norms. The deaths have occurred in Indian territory and mostly during night, so how can they be innocent?”

(বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারতীয় আইনানুযায়ীই শুধুমাত্র অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি এমনকি আদম/ গরু পাচারের জন্যও কাউকে গুলি করে হত্যা করা যায় না, ভারতীয় আইনেও গুলি করা কেবল মাত্র তখনই জাষ্টিফাইড যখন সীমান্তরক্ষীর নিজের প্রান বিপন্ন হয়)

এবার শুনে বাধিত হন আমাদের সীমান্তকর্তার বক্তব্যঃ

BDR chief Maj. Gen. Mainul Islam, explaining that there was a history of “people and cattle trafficking during darkness,” said of the killings: “We should not be worried about such incidents…. We have discussed the matter and will ensure that no innocent people will be killed.”

(সোজা কথা অনেকটা এমন যে আমাদের সীমান্তকর্তাও মানুষ কিংবা গরু পাচারকারিদের অন দ্যা স্পট গুলি করে মারা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামান না। ওনারা কেবল চিন্তা করেন একেবারেই নিরীহ লোকে গুলি খেলে তখন)।

The BDR raises serious concerns with the BSF only when cases of indiscriminate firing lead to the death of villagers not involved in smuggling

ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর অঘোষিত কার্ফু জারী হয়। আগে গুলি তারপর লাশের কাছে প্রশ্ন। সেখানে যাকেই অন্ধকারে পাওয়া যায় তাকেই বিনা প্রশ্নে গুলি করা হবে এটাই বিএসএফ এর নীতি, দুই দেশেরই স্থানীয় জনগন এটা জানে ও সে অনুযায়ীই সেখানকার জীবনযাত্রা চলে। রাতের আঁধারে শুধু গরু কিংবা আদম পাচারকারিই নয়, মাঝে মাঝে ফেলানিরাও সীমান্ত পাড়ি দেয়। যাদের কপাল ভাল তারা সফল ভাবে পাড়ি দিতে পারে, ফেলানির মত কপাল খারাপ হলে মারা পড়ে। কথা হল ট্রিগার ভারতীয় পক্ষ টানলেও এহেন হত্যার পেছনে কি আমাদের সীমান্ত রক্ষকদেরও দায় একেবারেই নেই তা কি বলা যায়? হিউম্যান রাইটসের মন্তব্যঃ

These comments suggest that officials of both governments believe that it is legal to use lethal force against those suspected of being engaged in smuggling or other illegal activities. This amounts to a de facto shoot-to-kill policy for smugglers, and violates both national and international standards on the right to life and the presumption of innocence which are applicable in India and Bangladesh.

বলাই বাহুল্য আপনি কোন রকম বিচার আচার দূরে থাক, তদন্ত ছাড়াই যায়গায় দেখামাত্র গুলি করা জাষ্টিফাইড বলে রায় দেবেন সেখানে বোনাফাইড গরু চোরের সাথে সাথে দুয়েকজন ফেলানিও মারা যাবে। এটা বুঝতে খুব সূক্ষ্ম বুদ্ধি কিংবা জটিল আলোচনার দরকার হয়? তারা মারা পড়ে মিডিয়া সেনসেশন হলে তখন উত্তপ্ত বক্তব্য দিয়ে দেশপ্রেমের পরকাষ্ঠা দেখাবেন?

হিউম্যান রাইটসের রিপোর্টটি পড়লে দেখা যায় যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ এর স্বেচ্ছাচারী নীতি শুধুমাত্র বাংলাদেশীদের জন্যই নয়, ভারতীয় নাগরিকদের জন্যও অনেকটা একইভাবেই প্রযোজ্য। বহু ভারতীয় নাগরিকও নির্মমভাবে এদের হাতে অত্যাচারিত এমনকি নিহতও হয়। হিউম্যান রাইটস এমন বহু ঘটনা ডকুমেন্ট করেছেন, তাতে অবোধ নিরীহ শিশুও আছে। নিহতের হার নিঃসন্দেহে ভারতীয়দের জন্য কম স্বাভাবিক কারনেই কারণ তাদের বাংলাদেশীদের মত সীমান্ত পাড়ি দিতে হয় না।

যেখানে আমাদের সীমান্ত কর্তারাও বিনা বিচারে যায়গায় দেখামাত্র গরু পাচারকারিদের হত্যা করা জাষ্টিফাইড রায় দেন সেখানে কিছুটা আত্মসমালোচনার দরকার পড়ে না?

যে কোন গুলি করে হত্যা করার ঘটনায় বিএসএফ এরও পুলিশ রিপোর্ট ফাইল করতে হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হল যে তাদের সেই রিপোর্টও হয় একেবারে গত বাধা, আরো বিস্ময়কর এ কারনে যে সেই রিপোর্টগুলি অনেকটাই ক্রশফায়ার ঘটনাগুলির পর আমাদের র‍্যাবের তরফ থেকে দেওয়া অফিশিয়াল ভাষ্যের মত। গরু পাচারকারিরা বিএসএফ বেচারাদের ঘিরে ফেলে……দা বটি নিয়ে আক্রমন করে……প্রানের মায়ায় বেচারাদের নিতান্তই বাধ্য হয়ে গুলি চালাতে হয়…

ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে সম্ভবত বিশ্বে সবচেয়ে বেশী মানুষ মারা যায়, আমাদের বিজিবির হাতেও হত্যার কিছু নজির থাকলেও মূল হত্যাকারী ভারতীয় বিএসএফ, এবং সেসব হত্যাকান্ড অধিকাংশই স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন তো বটেই এমনকি ভারতীয় আইনেরও লঙ্ঘন। তবুও কাজটি দিনের পর দিন চলছে, ভারত সরকার নিঃসন্দেহে জানে, সেখানকার কিছু মানবাধিকার সংস্থা এ নিয়ে বহুদিন সোচ্চার আছে, তাতে কোন ফল আসছে না। ফেলানির ব্যাপারটাও ব্যাপক ভাবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রথম এসেছে ভারতীয় দিক থেকেই। বোঝই যায় যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিএসএফ এর কিলিং স্প্রীতে পূর্ন মত আছে। তারা বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ ঠেকানো এতই গুরুত্বপূর্ন মনে করে যে তা ঠেকাতে এমনকি নিজেদের নিরীহ নাগরিকদেরও অত্যাচার এমনকি হত্যাকান্ড নিয়ে মোটেও বিচলিত নয়।

ভারত বাংলাদেশের সমস্যাগুলি অনেক জটিল, সমাধান নিঃসন্দেহে গালিগালাজ করে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোতে হবে না,আবেগের দরকার আছে। তবে আবেগ থেকে শক্তি তৈরী করে তা কার্যকরভাবে ব্যাবহার করতে হবে, নইলে শুধু আবেগের দাম কানাকড়িও নয়। সীমান্তে হত্যা নিয়ে আমার পূর্নাংগ লেখা লেখার সময় আপাতত নই, তবে মনে হল যে এই সম্পর্কিত অতি গুরুত্বপূর্ন একটি দিক সব সময় অবহেলিত থেকে যায় যা সকলের চিন্তা করা প্রয়োযন। এদিকটা উপেক্ষা করে এই সমস্যার গভীরে যাওয়া যায় না। এই কৌশলও মনে হয় অনেকটাই আমাদের ক্রশফায়ার কায়দায় সন্ত্রাস/অপরাধ দমনের সাথে সংগতিপূর্ন। ক্রশফায়ারে যেমন ১০টা সন্ত্রাসীর সাথে একজন নিরীহ মানুষ মারা যেতেই পারে…তখন চুক চুক চুক…করে দায় সারা যায় তেমনি সীমান্তে হত্যার ব্যাপারেও একই। মিডিয়া সেনসেশন কিছুদিন চললে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে, নন-লিথ্যাল অস্ত্র ব্যাবহার করা হবে জাতীয় ঘোষনা……

আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তেও মেক্সিকো থেকে প্রচুর ড্রাগ/মানব চোরাকারবারি,নিরীহ লোকেও উন্নত জীবনের আশায় প্রতিদিন অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেবার চেষ্টা করে, কেউ সফল হয়, অনেকেই হয় না। আমেরিকান পক্ষ একেবারেই নিজেদের ওপর হামলা শুরু না হলে কাউকে গুলি করে হত্যা করে না। এমনি অনেক বড় দালাল যাদের আগে থেকেই চিনে তাদেরও গুলি করে না, যদিও ইচ্ছে করলেই কাজটা তারা করতে পারে। আদম পাচারকারি দালালরা নিরীহ মেক্সিকানদের মরুভূমিতে ফেলে চলে গেলে বহু ঝামেলা হুজ্জত পুইয়ে আমেরিকান বর্ডার গার্ডরা তাদের উদ্ধার করে, চিকিতসা করে তারপর মেক্সিকো পাঠিয়ে দেয়। কাগজে কলমে ভারতের কাছ থেকেও এমন আচরনই আশা করার কথা, কিন্তু দেশটি ভারত, আমেরিকা নয় এটিই কথা। দুই দেশের সংস্কৃতি ভিন্ন। দেশের নাগরিকরাও সেভাবেই অভ্যস্ত। সে কারনেই আমেরিকা কানাডার মত দেশের একজন নাগরিকও বিএসএফ এর হাতে নিহত না হলেও তারা বিএসএফ কর্তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ভিসা দিতে অস্বীকার করতে পারে, আর ভারতীয় বিএসএফ কর্তা আমাদের দেশে বসেই হত্যা কারা পূর্ন জায়েয বলে সবক দিয়ে যেতে পারেন। আমাদের কর্তারাও তাতে একমত হন।

আমেরিকায় পুলিশের হাতে কেঊ অত্যাচারিত হয়ে হাত পা খোয়ালে তার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য খুলে যাবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। যেমন রডনি কিং পুলিশের পিটুনি খেয়ে কয়েক মিলিয়ন ডলার পায়, তার কোন অংগহানিও হয়নি। আর আমাদের দেশের লিমনকে পা খুইয়ে কারাগারে থাকতে হয়, পরিবারকে মুখোমুখি হতে হয় আইনী বে-আইনী নানান ঝামেলার। (কারাগারের সেলের ভেতর এক পা হারা লিমনের ছবি আমার দেখা জীবনের অন্যতম কুতসিত ছবি)। ফেলানি ঘটনা নিয়ে মানুষ যত সোচ্চার লিমনের ঘটনা নিয়ে লোকে এতটা সোচ্চার কেন হননি এর ব্যাখ্যা কি হতে পারে? আপনি লিমনদের ব্যাপারে মুখ বুঁজে থাকবেন আর অত্যাচারী পক্ষ বিদেশী হলে তখনই কেবল মানবাধিকার দেশপ্রেমের ঝান্ডা খুলে বসবেন? ক্রশফায়ার পদ্ধুতি সমর্থন দেবেন আর বিএসএফ এর বিনা প্রশ্নে গুলি করার প্রসংগে তীব্র নিন্দা জানাবেন? লিমনের মত দূর্ভাগ্য আর কারো হবে না এটা কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? কয়টা লেখা ব্লগে ফেসবুকে এসেছে এ নিয়ে? পাহাড়ে আমাদের উর্দিভাইদের নানান কেচ্ছাকাহিনী বাদই দিলাম। আমি যতটা বুঝি বিএসএফ এর দেখা মাত্র হত্যা নীতি দর্শনগত ভাবে ভারত সরকারের এক ধরনের ক্রশফায়ার নীতি যাতে এমনকি আমাদের সীমান্তরক্ষীদেরও সায় আছে। আফটার অল সংস্কৃতিভাবে দুই দেশই মানবাধিকার ফাধিকার এসবের তেমন মূল্য দেয় না।

যে কোন সংস্কারই নিজ ঘর থেকে শুরু করা উচিত নয় কি? নইলে রাতের বেলা চোরাকারবারি হত্যা জায়েয বলে একদিকে নীতি নিয়ে আরেক দিকে ফেলানিদের জন্য চোখের পানি ফেলাটা আমি ভন্ডামি কিংবা মূর্খতাই বলবো। বাংলাদেশের সীমান্তকর্তার যে উক্তি কোট করেছি তা ওনার নিজের এমনকি বাহিনীরও একার কোন কথা নয়, দেশের প্রচলিত সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। ভারতের উন্নত অর্থনীতির প্রতি গরীব বাংলাদেশীরা আকৃষ্ট হবেই, অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়িও তারা দেবে, দূঃখজনকভাবে এই ধরনের মানসিকতা যতদিন থাকবে ততদিন ফেলানির মত ঘটনা আরো ঘটবে।

সূত্রঃ

১।“Trigger Happy”