ফেলানী খাতুনের হত্যাকারি বি এস এফ জওয়ান অমিয় ঘোষ বেকসুর খালাস। ফেলানীকে কাঁটাতারের বেড়াতে গুলি করা আইনি না বেয়াইনী জানি না-কিন্ত তা অমানবিক। যে কোন সুস্থ মানুষ অমন হত্যাকান্ডের নিন্দা না করলে, তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। বিচারের নামে প্রহসণ প্রসবের কি দরকার ছিল তাও আমার ক্ষুদ্র খোপরির বাইরে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের মানুষ “ভারতের” বিরুদ্ধে ক্রদ্ধ এবং বিক্ষুব্ধ।

আমার লেখার নাভিসূত্র ফেলানী খাতুন না। ফেলানী আমার কাছে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না -তা ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের ফেলিওর ফলিডল। ছাপ্পান্নটি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশ আসে। এগুলি বাংলাদেশের প্রাণ ধমনী। সেখানে জল আসা ক্রমশ বন্ধ হয়ে বাংলাদেশের এক বিস্তীর্ন অঞ্চল আজ কৃষিবন্ধ্যা। বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের দায় ভারত অস্বীকার করতে পারে না । প্রশ্ন হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের আদৌ কি কোন ভবিষ্যত আছে?

এই সম্পর্কের ভবিষ্যত ঘুটঘুটে অন্ধকার।

বাংলাদেশ সম্পূর্ন ভারত বেষ্টিত। স্পেস এবং টাইমে। ইতিহাস থেকে ভূগোল -সব কিছুই এক নাড়িতে। ধর্মের ভিত্তিতে হঠাৎ করে একটা আলাদা দেশ তৈরী হল ভারত ভূখন্ডের ভেতরে। ফলে মূল সমস্যা হল এই যে, বাংলাদেশ ভারতের ওপর অনেক ব্যপারে নির্ভরশীল-কিন্ত ভারতের পার্লামেন্টে তাদের কোন ভোট নেই। ভারতের জন্য বাংলাদেশ যে সমস্যাগুলির সম্মুখীন- সেগুলি ভারতের জনগণ বা রাজনীতিবিদদের বোঝানোর জন্য কেও নেই!! বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের জনগণের অবজ্ঞা এবং নির্লিপ্ততা লজ্জার। আরো দুঃখের এই যে বাংলাদেশের দুই পার্টি এই সমস্যার মূলে যেতে ব্যর্থ।

বি এন পি ক্ষমতায় আসলে, তারা ভারত বিরোধিতা বজায় রাখতে এটাই চেয়ে এসেছে যে ভারত বাংলাদেশের প্রতি নির্লিপ্ত ব্যবহার করুক। তাতে বি এন পির ভোট ব্যাঙ্ক বাড়বে। আর বন্ধুদল আওয়ামী লিগ ক্ষমতায় আসলে ভাবে, দিল্লীর সাথে ভাল সম্পর্ক রাখলেই সব সমস্যার সমাধান হবে!

ভারতের কাছ থেকে দাবী দাওয়া আদায় করতে, আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা কোথায় সে ব্যাপারে আলোকপাত প্রয়োজন। বাংলাদেশে খুব সম্ভবত কোন “ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিউট” নেই। বিদেশনীতির মূল মন্ত্র হচ্ছে, বিদেশী প্রতিবেশী দেশের রাজনীতিতে নিজেদের দেশের প্রভাব রাখা। আমি ওয়াশিংটনে থাকি। এখানে, আমেরিকার প্রতিটি পলিটিক্যাল ইন্সটিউটে গবেষনার বিষয়-কিভাবে বাকী সব দেশের রাজনীতিতে আমেরিকা প্রভাব রাখতে পারে।

বাংলাদেশ ভারত বেষ্টিত। সুতরাং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ কিভাবে ভারতীয় রাজনীতিতে তারা নিজেদের প্রভাব রাখতে পারে। এর জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি কি কি করে? বাংলাদেশের কি করা উচিৎ?

(১) ভারতের গুরুত্বপূর্ন রাজনীতিবিদদের নির্বাচনী তহবিলে টাকা ঢালা-এটা বেয়াইনী-কিন্ত পৃথিবীর সব দেশের গণতন্ত্রে অন্য দেশের টাকা খাটে। বাস্তবতাকে অস্বীকার করা রাজনৈতিক মূর্খতা ।
(২) ভারতের মিডিয়াতে গুরুত্বপূর্ন সম্পাদক এবং সাংবাদিকদের কিনে নেওয়া। যারা ভারতের জন্য বাংলাদেশের দুর্দশার কথা ঢালাও ভাবে প্রচার করবে। সংবাদপত্র হচ্ছে বুদ্ধিজীবিদের বেশ্যাবৃত্তি।

এবার বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপুমনির কান্ডকারখানা দেখুন। দীপুমনি পররাষ্ট্রনীতি কি বোঝেন আমি জানি না। উনি অনেক দেশ ঘোরেন শুনেছি। কিন্ত যেটা আমি বুঝিনি-সেটা হচ্ছে উনি এতদিনেও কি করে মমতা ব্যানার্জির সাথে একটাও ঠিক ঠাক বৈঠক করে উঠতে পারলেন না ? ভারতের কাছ থেকে কিছু পেতে গেলে, মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ন ভারতীয় রাজনীতিবিদ। যেহেতু, প্রতিটা ইস্যুতেই পশ্চিম বঙ্গের স্বার্থহানির সম্ভাবনা থাকে -মমতা বেঁকে বসলে বাংলাদেশ কিছু পাবে না । এবং যে কারনে কিছু পাচ্ছেও না । তাকে হাত করা দরকার ছিল আগে । এফ ডি আই ইস্যুতে মমতা যখন বেঁকে বসেছিলেন- আমেরিকার স্বার্থ রাখতে হিলারী সরাসরি মমতার কাছে এসেছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সেটাই কাজ।দেশের স্বার্থে অন্যদেশের রাজনীতিবিদদের পটানো।

কিন্ত দিপুমনিকে আমার রাজনৈতিক শিশু বলে মনে হয়েছে। উনি ক্রমাগত মনমোহন এবং ভারতের বিদেশমন্ত্রীর সাথে দরবার করে সব কিছু ঠিক করতে গেছেন। ভারতের এই কোয়ালিশন এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক ঠিক করার ব্যাপারে যাদের ক্ষমতা শুন্য। ভারতের রাজনীতি নিয়ে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সাধারন জ্ঞানটুকু থাকবে না ?

১৯৮৯ সালের পর থেকে ভারতের রাজনীতি মোটেও দিল্লীকেন্দ্রিক না । বিজেপি বা কংগ্রেস কারুর কাছেই ২৭২ টি আসনের মেজরিটি নেই। সবাইকেই আঞ্চলিক দলগুলি নিয়ে চলতে হয়। এটাত সেই ইন্দিরা গান্ধীর সময় না যে উনি ৩৪০ টি আসনের মেজরিটি নিয়ে যা বলবেন তাই হবে। ভারতের রাজনীতিতে যে আঞ্চলিক দলগুলির ২০ টির বেশি আসন তোলার ক্ষমতা আছে-যেমন জয়ললিতা, মমতা, মুলায়েম, নীতিশ কুমার-এদের চটিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজের পায়ে বাংলাদেশের জন্য কুড়ুল মারবেন না । ভারতের রাজনীতি নিয়ে এই টুকু সামান্য জ্ঞান থাকলে দীপুমনি কাজ আদায়ের জন্য দিল্লীতে সময় না কাটিয়ে মমতার পেছনে সময় দিলে তিস্তা চুক্তি থেকে অনেক কিছুই আটকাতো না ।

রাজনীতি বাস্তবতার রণক্ষেত্র। এখানে ইউটোপিয়ান চিন্তার স্থান নেই। বাংলাদেশকে তার স্বার্থ বজায় রাখতে পররাষ্ট্রনীতিতে ইউটোপিয়ান চিন্তা ছেরে ( যে মোনু সিং বলে দিয়েছে তাই কাজ হয়ে যাবে!) , কৌশলী রাজনীতির আশ্রয় নিতে হবে।