মৌলিক সংস্কার সুদূরপরাহত
মীজান রহমান
স্বৈরতান্ত্রিক অরাজকতা, না, গণতান্ত্রিক অরাজকতা?

সাধারণ মানুষের জীবনে এদুয়ের বাইরে বিকল্প খুব একটা থাকেও না আজকাল। নিরুপায় হয়ে কেউ বলে, আমাকে সামরিক শাসন দিন, বন্দুকের গুঁতো খেয়ে আমি চুপ করে থাকব—-তবু শান্তিতে থাকা যাবে। আবার কেউ বলে, না, আমি গণতন্ত্র চাই, শান্তি থাক বা না থাক। দরকার হলে শালাদের ভোট দিয়ে গদি থেকে নামাতে পারব।

দুঃখের বিষয়, সচরাচর তা’ও সম্ভব হয়না আজকাল। ভোট দিয়ে এক শালাকে সরিয়ে তারা আরেক শালাকে বসায় মাত্র। ওদিকে বন্দুকের নল দিয়ে চুপ করানো যত সহজ শান্তি স্থাপন তত নয়।

না, পশ্চিম বিশ্বের কথা বলছি না আমি, বলছি আমাদের হতভাগা মুসলমান দেশগুলোর কথা। সেই যে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সূর্য ডুবে গেল ইসলামিক জগতে তারপর থেকে তো ঘোর অন্ধকারের ভেতরেই আমরা কেবল হাতড়ে বেড়াচ্ছি। কেবলই অছিলা খুঁজছি কেমন করে নিজেদের দায়িত্বের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে অন্যের ওপর দোষ চাপানো যায়। পশ্চিম বিশ্ব যখন শূন্যযানে করে মহাকাশ ভ্রমণের যোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত, আমরা তখন কোমর বেঁধে রওয়ানা হয়েছি কোথায় শত্রু পাওয়া যায়। আমরা মহাকাশে যেতে না পারলেও ওদের যাওয়াটা যেন ঠেকাতে পারি। জানি সবাই তা নয়, কিন্তু যারা সেই কাতারে পড়ে তাদের তো বাধা দেবার চেষ্টা করছে না কেউ, বরং পেছন থেকে বাহবা দিয়ে যাচ্ছে।

মিশরের কথাই ধরুন। কিম্বা তিউনিশিয়া। বা ইয়েমেন। লিবিয়া। বাহরাইন। এখন সিরিয়া।

কোত্থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। ঠিক আছে, তিউনিশিয়া দিয়েই শুরু করা যাক, কারণ সেখান থেকেই তো ইসলামিক ইতিহাসের এই নতুন অধ্যায়ের শুরু। পশ্চিম বিশ্বে যার নামকরণ হয়েছে: এরাব স্প্রিং। আরবি বসন্ত। বাহ, কি সুন্দর নাম। মলয় বাতাস নবপল্লবিত পুষ্পকলির স্নিগ্ধ সুবাস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সাহারা থেকে সিরিয়ার শেষ প্রান্তে—-ভাবতেই অঙ্গ জুড়িয়ে যায়। মনে আছে দিনটা? ১৭ই ডিসেম্বর, ২,০১০ সাল। মোহম্মদ বোয়াজিজি নামক এক শিক্ষিত বেকার যুবক সমগ্র আরব জাতির যুবসম্প্রদায়ের যুগ যুগ ব্যাপী বন্ধ্যা জীবনের চরম হতাশা নিজের স্কন্ধে ধারণ করে প্রকাশ্য রাজপথে তার সমস্ত শরীরে তেল ঢেলে আত্মাহুতি দিয়েছিল। সেই জ্বলন্ত আত্মদান ক্ষিপ্ত শিখা হয়ে দান্তের ইনফার্নোর মত ছড়িয়ে পড়েছিল চতুর্দিকে। পরের দিন, ১৮ই ডিসেম্বর, তিউনিসিয়ার নগরে নগরে যুবক যুবতীরা দলে দলে, হাজারে হাজারে, বিক্ষোভের ঝাণ্ডা বহন করে দখল করে নেয় রাস্তাঘাট, অলিগলি। জন্ম নেয় দুটি সুন্দর শব্দ, একটি নতুন কবিতার কলি: আরবি বসন্ত! এবার তাদের দাবি কেবল ভাত-কাপড় আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নয়, এবারের দাবি আরো সুদূরপ্রসারী—-আমূল পরিবর্তন। গণতন্ত্র! হ্যাঁ, তারা আশু পতন কামনা করে দীর্ঘকালীন সামরিক স্বৈরতন্ত্রের। তারা নির্বাচিত সরকার চায়। সারা আরব মুলুকে যা কোনদিন কেউ কল্পনাতে স্থান দিতেও সাহস পায়নি। ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘ইসলাম’ যেন পরস্পরবিরোধী দুটি শব্দ যাদের একত্রীকরণের চিন্তাও একরকম দণ্ডনীয় অপরাধ। তিউনিসিয়ার তরুণদের মনে এই সুঃসাহসী স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছিল মোহম্মদ বোয়াজিজির চামড়াপোড়া দেহ। তার সাথে যোগ দিয়েছিল পশ্চিমের পণ্যবাজার থেকে আগত আধুনিক প্রযুক্তি—-সোশ্যাল মিডিয়া, আইফোন, স্মার্ট ফোন, টেক্সটিং, টুইটার। বুর্গিবা বুলাভার্ডের একমাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত তিউনিসিয়ার নতুন যুগের নতুন তরুণদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মঞ্চ। তাদের রোধ করার শক্তি তখন কারুরই ছিল না। সৈন্যবাহিনীর না, রাজনৈতিক নেতাদের না, গতানুগতিক সামাজিক মুরুব্বিদের না—-এ এক অদম্য শক্তি তখন।

১১ই জানুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসনে কায়েম হয়ে বসে থাকা স্বেচ্ছাচারী শাসক জিনেল আব্দিন বেন আলি অধোবদনে বহির্গত হয়ে আসেন রাজপ্রাসাদের সদরদরজা দিয়ে। তিউনিসিয়ার দীর্ঘকালীন একনায়কত্বের অবসান। গণতন্ত্রের বাতাস বইতে শুরু করেছে চারদিকে। সাজ সাজ রব দেশব্যাপী—-ভোটকেন্দ্র, আইনসভার সদস্য মনোনয়ন ও নির্বাচন, জনসাধারণ, ছোট বড় গরিব ধনী সর্বপ্রকার নাগরিক, লাইন করে দাঁড়ায় ভোটের জায়গাতে। সে এক তুমুল উত্তেজনা—–সারা মধ্যপ্রাচ্যে, ইসলাম শাসিত রাজ্যসমূহে যা কোনদিন দেখেনি কেউ। তারা মুসলিম বিশ্বের নতুন যুগের অগ্রদূত।

ভোট হয়ে গেল। মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ভাবেই।

কিন্তু। মুসলিম জগতের সেই চিরপরিচিত শত্রু: কিন্তু। কিন্তু সাধারণ মানুষ কি সত্যি সত্যি সংস্কার কামনা করেছিল, না, কেবলই সরকার পরিবর্তন? গণতন্ত্র তো শুধুমাত্র ভোটকেন্দ্রে গিয়ে একটা বাক্সের ভেতর টিপসই দেওয়া এক টুকরো কাগজ নয়, এর পেছনে অনেক অনেক উপাদান আছে যার জন্যে দীর্ঘদিনের সামাজিক-মানসিক-সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি দরকার। সে প্রস্তুতি কি তিউনিসিয়ার দেশবাসীর ছিল? নাকি ছিল বুর্গিবা বুলোভার্ডের সেই নতুন যুগের প্রযুক্তিমনা তরুণদের? আন্দোলন মানেই তো বিপ্লব নয়। আর সব বিপ্লবও সবসময় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে না দেশে। কোনও বড় আইডিয়া তাকে চালিত করতে হয়। এরাব স্প্রিঙ্গের পেছনে কি সেই ‘বড় আইডিয়া’র মদদ ছিল?

ভোটাধিক্যে জয়ী হলেন কারা? কোন আধুনিক শিক্ষাদীক্ষায় সুশিক্ষিত উচ্চমানের চিন্তাশীল দল, নাকি কোনও শ্রমিক-চাষির স্বার্থসেবী গণদরদী দল? না, কোনটাই না। জয়ী হয়েছিলেন একটি কট্টর ইসলামপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দল।

তিউনিসিয়ার মোট জনসংখ্যা ১ কোটি। প্রায় নব্বুই ভাগ লোকই আরব বংশোদ্ভূত। এবং তারা ভীষণ ধার্মিক। অনেকেই ‘সালাফি’ মতবাদে দীক্ষিত। আরবি ‘সালাফ’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ পূর্বপুরুষ। এর তাৎপর্য হল যে সালাফিরা এতই ধর্মনিষ্ঠ যে সেই প্রাচীন যুগের পূর্বপুরুষদের মত করেই তারা ধর্মকর্ম পালন করতে আগ্রহী—–যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর কোনরকম দায়বদ্ধতা তারা স্বীকার করে না, বোঝেও না হয়ত। অনেকটা আমেরিকার ‘কোয়েকার’ বা ‘আমিশ’দের মত। পেনসেলভিনিয়া অঞ্চলের আমিশরা তো এখনো ঘোড়াগাড়িতে করে চলাফেরা করে, মোমবাতি আর কেরোসিনের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাতের গৃহকার্য পালন করে। আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, এসব তাদের জন্যে হারাম। তিউনিসিয়ার সালাফিরাও অনেকটা ইসলাম ধর্মের আমিশ বললে অত্যুক্তি হবে না। মুস্কিল এই যে এই সাধারণভাবে অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় সালাফিদের মধ্যে আজকাল বেশ কিছু উগ্র মতবাদের আল-কায়েদার অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। এই অল্পসংখ্যক জঙ্গি ‘সালাফি’দের কারণেই তিউনিসিয়ার জাতীয় জীবনের অগ্রগতি বারবার প্রতিহত হয়ে যাচ্ছে।

তিউনিসিয়া দেশটি একসময় ফরাসীদের দখলে ছিল—-নামে ‘প্রটেক্টরেট’ হলেও কার্যত উপনিবেশ। সেই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে পূর্ণ মুক্তি তারা লাভ করে ১৯৫৬ সালে, মুখ্যত তাদের জনপ্রিয় নেতা হাবিব বুর্গিবার দক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে। তখন থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত গোটা দেশটাই ছিল বলতে গেলে বুর্গিবা যুগ। তিনি নিজে প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত ছিলেন অনেক বছর, তারপর যখন অন্য কেউ তাঁর স্থান দখল করেন তখনও হাবিব বুর্গিবা যা বলতেন সেভাবেই চলত দেশ। তাঁর মৃত্যুর পর নেতৃত্বের আসন দখল করেন বেন আলি, যার নাম উল্লেখ করা হল একটু আগে। তিনি অত্যাচারী নেতা ছিলেন তেমন অভিযোগ হয়ত কেউ করবে না, কিন্তু স্বৈরাচারী ছিলেন তো বটেই। দেশকে যথা সত্বর আধুনিকতার পথে চালিত করার জন্যে তিনি যে কোন পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত ছিলেন, ছলে-বলে-কৌশলে গোঁড়া সালাফিদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিয়ে, যা বিপুলভাবে সফল হয়েছিল বলে কোন তিউনিশিয়ানই হয়ত মানবেন না। বুর্গিবা এবং বেন আলি দুজনই খুব আধুনিকতাপন্থী নেতা ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁরা দেশের গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে নতুন যুগের সাথে পা রেখে চলার যোগ্য করে তোলার চেষ্টা বোধ হয় করেননি খুব একটা। ফলে আধুনিকতার নামে কিছু নতুন নতুন রাস্তাঘাট হয়েছে, দালানকোঠা উঠেছে পশ্চিমের মত করে, কিছু কিছু ছেলেমেয়েকে দেশবিদেশে পাঠিয়ে উচ্চ-শিক্ষাদানেরও চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু ব্যাপকভাবে দেশজোড়া একটা ইহজাগতিক চিন্তাধারা গড়ে তোলার প্রয়াস তারা হয়ত করেন নি। ফলে জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়ত হয়েছিল কিঞ্চিৎ, আধুনিক যন্ত্রপাতির সঙ্গেও পরিচয় ঘটেছিল প্রচুর, কিন্তু মনোজগতে কোনও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন আদৌ এসেছিল কিনা সন্দেহ। তাই তিউনিসিয়ার মধ্যযুগ যেমন কায়েম হয়ে ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী, তেমনি কায়েম থেকেছে ২০১০ সালের তথাকথিত ‘এরাব স্প্রিং’এর পরও। যার ফলস্বরূপই গণতান্রিক উপায়েই নির্বাচিত হয়ে এসেছে প্রচণ্ডরকম রক্ষণশীল এক ইসলামি দল।

সৌভাগ্যবশত তাদের নিরঙ্কুশ ভোটাধিক্য ছিল না। বেশ কিছু বামপন্থী দলও আইনসভাতে সিট দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। দুই পক্ষ তখন একসাথে মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু চরম ডানপন্থীর সঙ্গে আধুনিক মনোভাবাপন্ন বামপন্থীদের আঁতাত কি কখনও সফল হয়েছে? না, হওয়া সম্ভব? দুয়ের লক্ষ তো সম্পূর্ণ বিপরীত। একজন চায় পশ্চাতমুখি গতি, আরেকজন সম্মুখপন্থী। আমেরিকার আমিশ আর কোয়েকাররা কখনো কোন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন নি, কারণ খৃস্টধর্মে ধর্ম-আর-রাজনীতি-অবিভাজ্য, এরকম কোনও মতবাদ প্রচার হয়নি কখনো, যা হয়েছে আমাদের ইসলাম ধর্মে। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জীবনের প্রতিটি বিষয়, প্রতিমুহূর্তে, প্রতিটি কর্ম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ও অবিভাজ্য। এবং সে কারণেই একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের পক্ষে কখনোই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বা ‘সেক্যুলার’ হওয়া সম্ভব নয়, নেতারা যতই জোড়াতালি দিয়ে দুয়ের মিলন ঘটানোর চেষ্টা করুণ না কেন। এদের সম্পর্ক অনেকটা সাপে-নেউলের সম্পর্ক।

অবশ্যম্ভাবীভাবে অচিরেই দুই দলে সংঘর্ষ বেধে যায় তিউনিসিয়ায়। এবছরের প্রথমদিকে, ফেব্রুয়ারি মাসে, আততায়ীর হাতে নিহত হন সংসদের বিরোধীদলীয় সদস্য চোকরি বেলাইদ। একই সাথে খুন হন আটজন তিউনিশিয়ান সৈন্য। সেই মামলা ফায়সালা হতে না হতেই জুলাই মাসের ২৫ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন জাতীয় আইন পরিষদের আরো এক সদস্য মহম্মদ ব্রাহ্মি। এরকম খুনখারাবি আর কতকাল চলে তিউনিসিয়াতে কে জানে। দেশবাসী আন্দোলন করে গণতন্ত্র আদায় করেছে ঠিকই, কিন্তু শান্তি পায়নি, তার বদলে পেয়েছে গণতান্ত্রিক অরাজকতা।

এবার মিশরের প্রসঙ্গে আসা যাক। তাদের ইতিহাস তিউনিসিয়ার চাইতে অনেকটাই আলাদা। মিশরীয় সভ্যতা কিংবদন্তীয়। ইতিহাসের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর অন্যতম। গ্রীক পণ্ডিত ইউক্লিডের জ্যামিতির সঙ্গে পরিচিত নয় এমন মানুষ পৃথিবীজুড়ে কোথাও পাওয়া দুরূহ হলেও জ্যামিতি বিষয়টির উৎপত্তি কিন্তু মিশরে। গ্রীক মহাপুরুষরা যখন জ্যামিতি শিখতে শুরু করেছেন ততক্ষণে মিশরের পিরামিড নির্মাণের কাজ প্রায় সমাপ্ত। এই পিরামিড কেবল সেকালের স্থাপত্যশিল্পেরই এক অত্যাশ্চর্য নিদর্শন নয়, ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির ওপর এক অবিশ্বাস্য রকম দখলেরও পরিচায়ক। ফেরাও রাজপরিবারের সদস্যদের মমিকৃত শবদেহ সংরক্ষণ পদ্ধতি বর্তমান যুগের রসায়নশাস্ত্রের সিদ্ধ সাধকদেরও হতভম্ব করে ফেলে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সম্মানার্থে প্রতিষ্ঠিত আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরের বিশ্ববিখ্যাত লাইব্রেরি পৃথিবীর বৃহত্তম ও সেসময়কার শ্রেষ্ঠতম পাঠাগার। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি মিশরের নৃপতিদের বিশেষ আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা যথার্থই ঈর্ষণীয়।
কিন্তু সেটা বহুকাল আগেকার কথা। বর্তমান ইতিহাস ঠিক অতটা গৌরবমণ্ডিত কিনা সন্দেহ।

১৫১৭ সালে তুরস্কের অটোমান সুলতানের সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী দ্বারা পরাস্ত হয় মিশরের স্থানীয় মামলুক বাহিনী। ১৫২৭ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত প্রায় একটানা ৩৪০ বছর তুর্কিরা রাজত্ব করেন সেখানে (ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা যেমন রাজত্ব করেছিলেন দু’শ বছর)। শেষদিকের তিনটে বছর, ১৭৯৮ থেকে ১৮০১ পর্যন্ত, নেপোলিয়ানের আক্রমণের মুখে তাঁরা সাময়িকভাবে রাজ্যশাসনের ভার ফরাসীদের ওপর ছেড়ে দিলেও অচিরেই তা পুনরুদ্ধার করে নেপোলিয়ান ও তাঁর সেনাবাহিনীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার পর আরো ৮৬ বছর তাঁদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন বলবত থাকে। ১৮৮২ সালের সময় থেকে মিশর ও অটোমান শাসিত সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে প্রতীচ্য, বিশেষ করে, ব্রিটিশ হাওয়া বইতে শুরু করে। সারা বিশ্বজুড়ে তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জয়জয়কার—-একদিকে ভারতবর্ষ, অপরদিকে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড, এবং তার অনতিকাল পূর্বে ছিল সমগ্র উত্তর আমেরিকা। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাদের লোভাতুর দৃষ্টি নিপতিত হতে থাকে মিশর তথা উত্তর আফ্রিকার রাষ্ট্রসমূহের প্রতি। এই রাষ্ট্রগুলো বেশ কয়েক শতাব্দী ধরেই কোন-না-কোন বিদেশী শক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার ফলে সেখানে গণতন্ত্র দূরে থাক কোনরকম জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনাও ঠিক দানা বেঁধে উঠতে পারেনি, অন্তত ’সরকারি’ বৈধতার ছত্রছায়াতে। ১৮৮২ সাল থেকে মিশরে এক নয়, দুই বহিঃশক্তির ক্ষমতার লড়াইতে কুস্তির বস্তার মত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে হয়—-তুর্কি সাম্রাজ্যবাদ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। সম্ভবত ওই সময় থেকেই মিশরের প্রাচীন কপ্টিক খৃস্টান সম্প্রদায় ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতার ভাব অঙ্কুরিত হতে শুরু করে।

কথিত আছে যে মিশরের কপ্টিকরাই যিশুখ্রিস্টের প্রথম দিককার অনুবর্তীদের একেবারে প্রথম সারিতে। বলা হয় যে আদি ধর্মপ্রচারক সেন্ট মার্ক মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে খৃস্টান ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন ৩৩ খৃস্টাব্দে। সেটা আস্তে আস্তে মিশরের সর্বত্র, এমনকি উতর আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলেও বিস্তারিত হতে থাকে। স্থানীয় মূর্তি উপাসকরা তো বটেই, এমনকি অনেক ইহুদীরাও এই নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তর গ্রহণ করেন স্বেচ্ছায়। ইতোমধ্যে মতবাদ নিয়ে মূলধারার খৃস্টধর্মের সঙ্গে মিশরীয় কপ্ট ভাষাভাষী খৃস্টানদের একটা বিরোধ সৃষ্টি হয়ে যায়। যার ফলে তারা বিভক্ত হয়ে তাদেরই নিজস্ব একটি স্বতন্ত্র ধারার চার্চ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে, একজন কপ্টিক পোপ সহ। উদাহরণ স্বরূপ, সমসাময়িক কালে, আলেকজান্দ্রিয়াতে অবস্থিত কপ্টিক পোপ হলেন পোপ টোয়াড্রস ২, যিনি ভ্যাটিকানের রোমান ক্যাথলিক পোপ ফ্রান্সিস ১ এর শাসন মানতে বাধ্য নন। পোপ টোয়াড্রস কেবল মিশরেরই নয় সমগ্র উত্তর আফ্রিকায় যেখানে যেখানে সেন্ট মার্কের পথানুসারী কপ্টিক খৃস্টানরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন তাদের সকলেরই ধর্মগুরু। ৬৩৯ সালে যখন মক্কা-মদিনা থেকে আগত নতুন ধর্ম ইসলামের আবির্ভাব ঘটে খলিফা ওমরের সময়, তখন দেশব্যাপী রীতিমত একটা নতুন আন্দোলন শুরু হয়ে যায়—-মিশরীয়রা দলে দলে সে ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেন, মূর্তি উপাসকরাই শুধু নয়, বহু খৃস্টান আর ইহুদীগণও । এভাবেই যা ছিল একটা পুরোপুরি খৃস্টান-ইহুদী দেশ সেটা প্রায় রাতারাতি পরিণত হয়ে যায় একটি মুসলিম রাষ্ট্রে।

কিন্তু ইতিহাসের এতসব উথালপাতালের মাঝে কি কখনও কারো কল্পনাতে, বহু শতাব্দী পূর্বে সমুদ্রপারের দেশ গ্রীসে যে ‘গণতন্ত্র’ নামক একটি নতুন মতবাদ সৃষ্টি ও প্রচলন হয়েছিল, তা কি বিন্দুমাত্র স্থান পেয়েছিল? না, যতদূর জানা যায় ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে, তা হয়নি। ঠিক আমাদের দেশ, আদিম বাসভূমি ভারতবর্ষ, যেরকম গণতন্ত্রের মুখ দেখেনি কস্মিনকালেও। তার মানে এই দাঁড়ায় যে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দৃঢ়মূল হয়ে উঠতে যে দীর্ঘ সময়ব্যাপী একটা রাজনৈতিক-সামাজিক-মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়, সেই দীর্ঘ সময়ের বিলাসিতাটুকু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শাসিত রাষ্ট্রসমূহের কোনটিরই ভাগ্যে ঘটেনি। আমার ব্যক্তিগত মতে বর্তমান যুগের মিশর, তিউনিসিয়া বা আমার নিজেরই মাতৃভূমি বাংলাদেশে যে ‘গণতান্ত্রিক অরাজকতা’র ভয়াবহ দৃশ্য আমাদের দেখতে হচ্ছে প্রতিদিন, তার মূল কারণটিই সেখানে।

একটু প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়ার জন্যে পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এবার আমি মিশরের প্রসঙ্গে ফিরে যাব। ১৯১৫ সালে, অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালে, ব্রিটিশরা বাইরের তুর্কি মুখোশটি পরিত্যাগ করে পুরো দেশটাকে একটি ‘প্রটেক্টরেট’ হিসেবে ঘোষণা করে দেয়। এই মধুর শব্দটি—‘প্রটেক্টরেট’—-এর আক্ষরিক বাংলা হল ‘রক্ষিতা’। এবং আমার মতে এই একটি জায়গায় আক্ষরিক অর্থের সঙ্গে প্রকৃত অর্থ হুবহু মিলে যায়। ঠিক সাম্রাজ্য নয়, ভারতবর্ষের মত, আবার প্রয়োজনে রক্ত শোষণ করার অধিকারটুকুও বলবত থাকছে—বিশেষ করে সুয়েজ খাল, যা অর্থনীতির বিচারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধনরত্ন চলাচলের হৃদপিণ্ডস্বরূপ। আর কিছু গেলে তেমন ক্ষতি নেই, সুয়েজ গেলে সব গেল। অবশ্য ভবিষ্যতের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে ব্রিটিশ রাজ ১৯২২ সালে মিশরের ‘পূর্ণ’ স্বাধীনতা ঘোষণা করতে কার্পণ্য করেননি। তখন কি কোনরকম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আভাস দেখা দিয়েছিল দেশে? না, দেয় নি। দেশবাসীর মনে তখনও গণতন্ত্রের পিপাসা তৈরি হয়নি। পিপাসা যেটা ছিল যুগ যুগ ধরে, জনগণের না হলেও ভদ্রগণের, সেটা ছিল রাজতন্ত্র। ১৯২২ সালে মিশরের স্বর্ণখচিত সিংহাসনে মহাসমারোহে আসন গ্রহণ করেন এককালের প্রতিপত্তিশীল মোহম্মদ আলি বংশের এক সুযোগ্য উত্তরাধিকরি। তাঁদের রাজত্বকাল অব্যাহত থাকে ১৯৫২ সাল অবধি, ব্রিটিশ ‘বিগ ব্রাদার’ বা ‘বড় দাদা’র প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল না বলেই প্রধানত। ১৯৫২ সালে মোহম্মদ আলি বংশের সর্বশেষ ব্রিটিশভক্ত রাজা ছিলেন ফারুক। বেশ সুখশান্তিতেই কাটছিল তাঁর জীবন, কিন্তু বাধ সাধলো দুজন ‘অবাধ্য’ আর্মি অফিসার। একজনের নাম কর্নেল নেগিব, আরেকজন তাঁরই সহচর কর্নেল গামাল আব্দুল নাসের। দুটিতে মিলে রক্তপাতহীন সামরিক উত্থানের মধ্য দিয়ে ফারুককে ক্ষমতাচ্যুত এবং রাজ্যবহির্ভূত করে পূর্ণ সামরিক শাসন প্রবর্তন করেন। প্রথম দুটি বছর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব ছিল কর্নেল নেগিবের ওপর, যদিও তিনি হয়ত তাঁর বন্ধু কর্নেল নাসেরের মত দূরদৃষ্টি ও উচ্চাকাংখাসম্পন্ন নেতা ছিলেন না। যাই হোক, বছর দুয়েকের মাঝেই দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হতে শুরু করে, যার এক ফাঁকে নেগিবকে অপসারিত করে কর্নেল নাসের দেশশাসনের পূর্ণ ক্ষমতা তাঁর একার হাতে আয়ত করে নেন। সমগ্র মিশরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তখন একজন মধ্যবয়সী সামরিক অফিসার, যিনি একজন চরম সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন জাতির সামনে। মন মানসিকতায় তিনি ছিলেন পূর্ণোদ্যম সমাজতন্ত্রবাদী—-বলতে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের একনায়ক শাসনকর্তাদের মাঝে সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতে বিশ্বাসী নেতা। সেটা স্বভাবতই সেকালের পূর্ব-পশ্চিম ঠাণ্ডা-যুদ্ধের পরিবেশে সোভিয়েত পক্ষের প্রীতিভাজন হলেও পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স, এদের কাছে খুব সুখকর হয়নি। অনেকটা সেকারণেই তাঁর পরিকল্পিত আসোয়ান ড্যাম নির্মাণ প্রকল্পের আর্থিক সহায়তা ও ঋণদানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁরা মিশরকে তা প্রত্যাহার করেন পরবর্তীতে। সেই অপমানজনক ব্যবহারের প্রতিশোধ নেন তিনি সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে। তাঁর শত্রু তখন একটি নয়, অন্তত চারটে অত্যন্ত শক্তিশালী দেশ—–উপরোক্ত তিনটি এবং তাদেরই সমর্থনপুষ্ট ইহুদী রাষ্ট্র ইজরায়েল, কালে কালে যে-দেশটি পুরো মধ্যপ্রাচ্য তথা সারা বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা ও স্থিতিহীনতার পরিবেশে পরিণত হবার উৎস হয়ে ওঠে।

১৯৫৬ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইজরায়েল সুয়েজ খাল জাতীয়কৃত করার অপরাধে মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, যার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বীর নেতা কর্নেল নাসের পুরো খালটিকে আগাগোড়া সিমেন্ট ঢেলে আর জাহাজ ডুবিয়ে নৌ চলাচলের সম্পূর্ণ অযোগ্য করে তুলে। ওই যুদ্ধ অবশ্য বেশিদিন চলেনি—–ক্যানাডার তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী লেস্টার বি পিয়ার্সনের প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীর হস্তক্ষেপের কারণে উভয়পক্ষ যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নেয়। যুদ্ধের মীমাংসা পুরোপুরি না হলেও নাসের যেভাবে সাহসিকতার সঙ্গে বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মুখোমুখি হয়ে স্বদেশের সম্মানরক্ষা করেছিলেন তাতে তিনি মিশরসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের অবিসংবাদিত নেতাতে পরিণত হয়ে যান অতি অল্প সময়ের ভেতর। নেতা বললে বোধ হয় কমই বলা হয়, হিরো। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে তাঁর মত সাহসী ও আধুনিকমনা প্রগতিশীল নেতা আগে বা পরে জন্মায়নি।

কিন্তু বড় ‘হিরো’রাও সবসময় তাঁদের রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি বিষয়ে সুচিন্তিত ও সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না। সেরকম একটি সিদ্ধান্ত হয়ত ছিল ১৯৬৭ সালের মিশর-ইজরায়েল যুদ্ধ, যা সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসে ছয়-দিনের-যুদ্ধ বলে পরিচিত। মাত্র ছয়টি দিনের মাঝে প্যালেস্টাইনের সমগ্র পশ্চিম উপকূল, (ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক), আর গাজা, চলে গেল ইজরায়েলের দখলে। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে গড়ে-ওঠা একরত্তি রাষ্ট্র ইজরায়েল (যার আয়তন ছিল ১০,৪২৫ বর্গমাইল) মাত্র ছয় দিনের ব্যবধানে ফুলে-ফেঁপে আরো আড়াই হাজার বেড়ে গেল। সেই বুকভাঙ্গা পরাজয়ের পর কর্নেল নাসের সেই আগেকার তেজোদ্দীপ্ত নাসের থাকলেন না—-কেমন যেন মনমরা হয়ে গেলেন। তাঁর স্বাস্থ্যও আস্তে আস্তে ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। ১৯৭১ সালে এই মহান নেতার মহাপ্রয়াণ ঘটে। তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মিশরের শাসনভার গ্রহণ করেন আনোয়ার সাদাত নামক আরেক সেনাপতি। তাঁর রাজত্বকাল বজায় থাকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। তাঁর সময়কালের দুটি স্মরণীয় ঘটনা—-১৯৭৩ সালের তথাকথিত ইয়াম-কিপুর যুদ্ধ ইজরায়েলের সঙ্গে, যার ফলে গোলান হাইটসের দখল হারানো আরবপক্ষের, এবং পরবর্তীতে ইজরায়েলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের কামনাতে নাটকীয়ভাবে ইজরায়েলি সংসদ নেসেটে (১৯৭৭ সালের ২০শে নভেম্বর) দাঁড়িয়ে আরব-ইহুদী মৈত্রী ঘোষণা করা। সেই মৈত্রী প্রচেষ্টার প্রতিবাদে মিশরের উগ্রপন্থী মৌলবাদী দল ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ প্রকাশ্য ময়দানে, আততায়ীর গুলিতে, হত্যা করে আনোয়ার সাদাতকে, ১৯৮১ সালে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে শাসনদণ্ড গ্রহণ করেন আরো এক উচ্চাভিলাষী সেনাপতি: হুসনে মোবারক।

তাঁর শাসনকালের অবসান ঘটে ২,০১১তে, মিশরের তথাকথিত ‘আরব-স্প্রিং’এর সূত্র ধরে। কিন্তু তার আগে মুসলিম ব্রাদারহুডের একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া যাক।

১৯২৮ সালে মিশরের ইসমাইলিয়া শহরের হাসান-আল-বান্না নামক এক উগ্র মৌলবাদী স্কুল শিক্ষক সুয়েজ খালের কতিপয় শ্রমিককে সাথে করে একটি ইসলামিস্ট প্রতিষ্ঠান গঠন করেন ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ নাম দিয়ে। গোঁড়া থেকেই এর উদ্দেশ্য ছিল মিশরে শরিয়াভিত্তিক ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, জনগণ সেটা চাক বা না চাক—-অর্থাৎ ছলে-বলে-কৌশলে, যেভাবেই হোক। স্বভাবতই সেটা তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে খুব আমোদ বা প্রীতিকর বোধ হয়নি। ১৯৪৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ ফাহমি নোকার্সি মুসলিম ব্রাদারহুডকে বেআইনি ঘোষণা করে প্রতিষ্ঠানটিকে ভেঙ্গে নিশ্চিহ্ন করে দেবার চেষ্টা করেন। দুঃখের বিষয় যে নিশ্চিহ্ন হয়েছিলেন তিনি নিজেই, যার পরিণামে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দিয়েছিলেন ব্রাদারহুডের জনক হাসান-আল-বান্না স্বয়ং—সেই একই বৎসর, ১৯৪৮ সালে। ১৯৫৪ সালে তারা কর্নেল নাসেরকেও হত্যার চেষ্টা করে—–সফল হয়নি যদিও। ওই ব্যর্থ চেষ্টার নায়ক ছিলেন হাসান-আল-বান্নার যোগ্য উত্তরসূরি, সৈয়দ কুতুব নামক এক উচ্চশিক্ষিত, সুদর্শন ও জনপ্রিয় নেতা। সৈয়দ কুতুবকে গ্রেফতার করা হয় নাসেরের হত্যা-প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে—পরে তাঁকে ছেড়েও দেওয়া হয় যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে। ১৯৬৫ তিনি আবার গ্রেফতার হন। এবার আর ছাড়া পাওয়া হয়নি তাঁর। ১৯৬৬ সালের ২৯ শে আগস্ট মুসলিম ব্রাদারহুডের বুদ্ধিজীবী নেতা সৈয়দ কুতুব তাঁর ছয়জন সঙ্গী-সাথী সহ প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ব্রাদারহুডের ওপর সেনাবাহিনীর সেই হিংসাত্মক আচরণের প্রতিশোধই তারা নেয় ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাতকে নির্মমভাবে হত্যা করে, কয়েকশ’ সামরিক সদস্যের উপস্থিতিতে। তাদের শেকড় যে কত গভীরে চলে গেছে মিশরীয় সমাজের ভেতর, মাত্র কয়েক দশকের মাঝে, তা একটু ধীর মস্তিষ্কে ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে কেন দেশটি এখনও ‘গণতান্ত্রিক’ সমাজব্যবস্থার জন্য তৈরি নয়। তাদের উগ্র ধর্মান্ধতা ও ভিন্ন ধর্ম মতাবলম্বীদের প্রতি কতখানি বিদ্বেষভাবাপন্ন, তা টের পাওয়া যায় একটি ছোট্ট, প্রায়-বিস্মৃত ঘটনা থেকে—-১৯৯৭ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের সর্বোচ্চ পদের ধর্মগুরু মোস্তফা নাশের এমন মত প্রকাশ করেছিলেন যে ক্ষমতা লাভের পর তাদের উচিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিম সম্প্রদায় কপ্টিক খৃস্টানদের ওপর জিজিয়া কর ধার্য করা। জিজিয়া জিনিসটা মধ্যযুগের প্রায় প্রতিটি মুসলিম শাসিত দেশেই প্রচলিত ছিল, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতেও যে সেধরণের চিন্তাধারা কেউ পোষণ করতে পারে, এবং মিশরের মত একটি আপাত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে, তাতে সবারই চক্ষুন্মীলিত হবার কথা—-মুসলিম ব্রাদারহুডের সত্যিকার লক্ষটা কি। আমি বলছি না একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির ব্যক্তিগত মতই সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত মত, তবে এধরণের কথাবার্তা শুনতে পারাটাও তো ভীতিকর বর্তমান যুগে।

যাই হোক, তিউনিসিয়ার গণবিক্ষোভের বাতাস অচিরেই মিশরের দিকে বইতে শুরু করে। ২,০১১ সালের ২৫শে জানুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতা সামরিক বাহিনীর বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে আমূল পরিবর্তনের দাবিতে। তারা আর সইতে রাজি নয় সামরিক শাসনের অত্যাচার, যখন তখন যাকে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গায়েব করে দেয়া, সইতে রাজি নয় সামান্যতম প্রতিবাদের অপরাধে মানুষকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে কারারুদ্ধ করে রাখা, সইতে রাজি নয় নাগরিকদের ন্যুনতম বাক স্বাধীনতাটুকু অবলীলাক্রমে ছিনিয়ে নেওয়া। তারা সামরিক শাসনের পতন চায়, হুসনে মোবারকের পতন চায়, হাতকড়া পরাতে চায় তাঁর হাতে, বিচার চায় তাঁর দীর্ঘকালের অবিচার অনাচারের। এটা সাময়িক কোনও আন্দোলন নয়, পূর্ণ বিপ্লব। যার লক্ষ হল মুক্ত নির্বাচন, গণভোটের মাধ্যমে আইনসম্মতভাবে নির্বাচিত হয়ে আসা গণতান্ত্রিক সরকার, যারা মিশরকে নতুন যুগের আলোতে নিয়ে যাবে, নতুন আশার সঞ্চার করবে জনগণের প্রাণে। তারা গণতন্ত্রের বিকল্প কিছুতে বিশ্বাসী নয়।

ক্রমে সেই আন্দোলন সারা দেশব্যাপী দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। হুসনে মোবারক আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন ক্ষমতাচ্যুত না হতে। ঘোষণা দিয়েছিলেন যে আগামি সেপ্টেম্বরের পূর্বনির্ধারিত নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন না। কিন্তু জনগণের বুকে তখন ক্ষমতার স্বাদ এসে গেছে। তারা ওসব টালবাহানা শুনতে রাজি নয়। ‘তোমাকে এক্ষুণি সরে যেতে হবে’—তাতে কোনও যদি-কিন্তুর অবকাশ নেই। ততদিনে কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের জনতা এক সীমাহীন জনসমুদ্রতে পরিণত হয়েছে। সারা পৃথিবীর দৃষ্টি তখন তাহরির স্কোয়ারের ওপর। শত শত বিদেশী সাংবাদিক জড় হয়েছেন সেখানে—বিশ্বব্যাপী প্রতিটি সংবাদ মিডিয়াম প্রতি মুহূর্তে মিশরের খবর প্রচার করে যাচ্ছে। শেষে ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে হুসনে মোবারক নতশিরে ক্ষমতার দণ্ড হস্তান্তরিত করে দেন নির্বাচন-পূর্ব সময়কালীন এক অস্থায়ী সরকারের কাছে। সেই অস্থায়ী সরকারের প্রধান নিযুক্ত হলেন সামরিক বিভাগের প্রভাবশীল নেতা মোহম্মদ হুসেন তান্তাউই। তার সূত্র ধরে মিশরী বসন্তের প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হতে থাকল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। হুসনে মোবারক গ্রেফতার হলেন, তাঁর বিচার হল, এবং ২,০১২ সালের ২ জুন বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেন তাহরির স্কোয়ারের গুলিগালাজ জনিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে। পরে তিনি আপিল করে খালাশও পেয়ে গেলেন, যার প্রতিবাদে তরুণ ছাত্রছাত্রী আর শ্রমিক নেতারা আবার নেমে এলেন রাস্তায়।

অবশেষে ’১২ সালের ২৪ শে জুন দেশব্যাপী নির্বচনে স্বল্প ভোটাধিক্যে বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হলেন ইসলামিস্ট নেতা মোহম্মদ মরসি। আসলে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডেরই সদস্য ছিলেন, যদিও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, এবং অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থী বলেই পরিচিত সাধারণ মানুষের কাছে। কিন্তু শাসনক্ষমতা হাতে আসার পর থেকেই আস্তে আস্তে তাঁর সুস্পষ্ট ইসলামী রূপ প্রকাশ পেতে থাকে। প্রথমত জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা ছাড়াই শরিয়ামুখি সংবিধান প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়ত গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও গণতন্ত্রবিরোধী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করার যাবতীয় পন্থা অবলম্বন। আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ, বহির্বিশ্বের মুক্ত বা মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে নিত্য সংযুক্ত তরুণ প্রজন্মের জন্যে মর্সির ক্ষমতালাভ ছিল এক চরম ভাগ্যবিপর্যয়, এক নিষ্ঠুর বিড়ম্বনা। গণতন্ত্র নামক যে দুর্লভ বস্তুটির স্বপ্ন বুকে নিয়ে তারা হুসনে মোবারকের বন্দুকের গুলিতে হাসিমুখে প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়েছিল, এবং অনেকে দিয়েও ছিল, সেই স্বপ্নটাই যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। এবং পরম লজ্জা এবং দুঃখ যে, সেটা হল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই! অতএব মরসির ব্রাদারহুডপন্থী মতলব আঁচ করতে পেরে তারা আবারো আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়ে নেমে গেল সেই একই জায়গায়—-তাহরির স্কোয়ার। সমস্যা ছিল যে এবার তাদের সংগ্রামে যোগ দিতে এল না ব্রাদারহুডের সদস্যরা। বরং তারা নেমে গেল উলটো অভিযানে—-আধুনিকতাবাদী ছাত্রবিরোধী আন্দোলন। যারা মধ্যযুগের ধর্মীয় বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থাতেই আস্থাবান। সেখানেই বিড়ম্বনার শেষ নয়। মরসির পুলিস ও অন্যান্য রক্ষিবাহিনী এবার সেই মোবারকি কায়দার দমননীতিই প্রয়োগ করতে শুরু করেন তাঁর বিরোধীপক্ষের বিরুদ্ধে—-যদৃচ্ছ ধরপাকড়, গুলিগালাজ, অনর্থক লোকজনকে আটক করে নানাপ্রকার অত্যাচার চালানো, ইত্যাদি। মোবারকের সময় ছিল সামরিক শাসনের অরাজকতা। এবার মিশরের দেশবাসীরা দেখলেন গণতান্ত্রিক অরাজকতা কাকে বলে। এর সর্বশেষ বিড়ম্বনাটি এল সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে। মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্বের চিরপরিচিত ধারা অনুযায়ী মরসির নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক উত্থান চালিয়ে পুনরায় ক্ষমতা আদায় করে নেন জেনারেল আব্দেল ফাতাহ এল-সিসি, ’১৩ সালের ৩০ শে জুন। মিশর কয়েক হাজার বর্ষব্যাপী যে অন্ধকারে ছিল সেই অন্ধকারেই তাদের প্রত্যাবর্তন। মাঝখানে কেবল একটি রূপালি বেলার স্বপ্ন যা জন্ম নিয়েছিল নতুন প্রজন্মের গণসংযোগের সূত্র ধরে, এবং যার অকালমৃত্যু ঘটে গেল স্বাধীনতার চিরশত্রু মধ্যযুগীয় অন্ধবিশ্বাসের হাতে। এর থেকে তাদের কি মুক্তির পথ আছে কোনও? এই চক্রাকার বেড়ি কি তাদের চিরসঙ্গী হয়েই থাকবে? খুব ইচ্ছে হয় ভাবতে, নিশ্চয়ই, হবে না কেন? আজকে পশ্চিম বিশ্বের বাইরেও কত দেশ দৃপ্তপদে এগিয়ে চলেছে সম্মুখে—-চীন, ভারত, ব্রাজিল, কোরিয়া। ওরা পারবে না কেন? পারত, যদিনা তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া হত আধুনিক বিজ্ঞানের পথ থেকে, বিবর্তনের পথ থেকে, যুক্তি-প্রমাণের পথের ওপর বারবার দাঁড় করানো হত বিশ্বাসের দেয়াল। বিশেষ করে মস্তকের ওপর শানিত তরবারির মত যদিনা দাঁড় করিয়ে রাখা হত কতগুলো হলদে পাতার গ্রন্থ। যেখানে হলদে পাতার গ্রন্থই সর্বেসর্বা সেখানে কখনোই কোন মৌলিক সংস্কার সম্ভব নয়। এবং যেখানে মৌলিক সংস্কার সম্ভব নয় সেখানে সময় সময় মাঠে ময়দানে জনসমাগম হতে পারে, প্রচুর শ্লোগান হতে পারে কর্কশ কণ্ঠে, আন্দোলনও হতে পারে বিস্তর, গুলিগালাজ খুনখরাবি তা’ও সম্ভব, সরকার বদলাবে, রাজাউজির বদলাবে, কিন্তু তারপর যেই কি সেই—-সেই একই জিনিসের পুনরাগমন হবে, ভিন্ন পোশাকে মাত্র। সেখানে ইউরোপের মত এনলাইটেনমেন্ট আসবে না, আসতে পারে না। সেখানে পায়ের শিকল ভাংতে পারে, মনের শিকল ভাঙবে না কোনক্রমেই, কারণ যার ভেতরে সেই শিকল সে’ই চাইবে না ভাংতে—-সব ওই হলদে পাতার গ্রন্থখানির জন্য।

আমার কেবলই ভয়, আমার নিজের দেশটির ভাগ্যেও কি এই পরিণতি? রক্ত আর লজ্জার মূল্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার পরিণাম কি আরো রক্ত, আরো লজ্জা, আরো নতুন কোনও পরাধীনতা? ভয় হয় কারণ পথেঘাটে তো তারই লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি, দেশে-বিদেশে সর্বত্র। ধর্মান্ধতার শ্বাসরোধী পরিবেশ, যা কোনদিন ছিল না আমাদের সোনার বাংলায়, তারই হিংস্র থাবা যে দেখতে পাচ্ছি যেদিকে তাকাই সেদিকেই। এই পরিবেশ যত তীব্রতা পাবে ততই দূরবর্তী হবে গণতন্ত্র নামক সেই সুদূর স্বপ্নটি। মধ্যপ্রাচ্য যা কোনদিন পায়নি, আমরা তা পেয়েও হারাতে বসেছি। এর চেয়ে বিড়ম্বনা আর কি হতে পারে।

নিউইয়র্ক, ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২