মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থা এবং অবস্থান নিয়ে ধারাবাহিক
:line:

(৪)
আষাঢ় মাস পর্যন্ত বেশ একটু স্বস্তিতেই কাটানো গেল| ঢাকাতে যুদ্ধ শুরু হলো চৈত্রমাসের মাঝামাঝি| প্রথম দিকের মাসখানিক তো যুদ্ধের খবর গ্রামে আসতে আসতেই সময় কেটে গেছে| যদিও মুসলিম লিগের চেয়ারম্যান শওকত আলী্র নেতৃত্বে আশপাশের কয়েক গ্রামে পাকিস্তানরক্ষা কমিটি আর আলবদর গঠিত হয়েছে| যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে করণীয় ঠিক করতে করতেই বোশেখ মাসের শেষ| মাঝে মধ্যে শুধু শওকত চেয়ারম্যান হিন্দু পাড়ায় লোক পাঠিয়ে খবর নেয় মুক্তিবাহিনী গঠিত হচ্ছে কিনা?

পুরো এলাকা জুড়েই চাষাবাদের জমি| মাঝে মধ্যে কিছু জমিতে আমন কিংবা আউশ ধান; বাকী সব জমিতে পাটের চাষ| জৈষ্ঠ্য মাস শুরু হতেই পাট বড় হতে থাকে| ঘন বিস্তৃত পাট ক্ষেত এক গ্রামকে অন্য গ্রাম থেকে আলাদা করে রাখে| গ্রামের রাস্তা থেকে পাট ক্ষেতের ভিতর ঢুকে পড়লে কারও পক্ষে সম্ভব নয় খুঁজে বের করা| তাই মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা পাটের ভিতর দিয়ে অনায়াসে দিন দুপুরেই এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চলে যায়| পাট ক্ষেতের ভিতর বসেই অনেকে শলা পরামর্শ করে| কখনো কখনো রেডিও শোনে|
মানিকগঞ্জ মহুকুমা শহর| যোগাযোগ শুধু নৌকা আর পায়ে হাঁটার পথ| পার্শ্ববর্তী থানা দু’টোও এলাকা থেকে বেশ দূরে| তাই অনায়াসেই পাকিস্তানী মিলিটারী আসার খবর জানা যায়| তাছাড়া মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যেই সন্দেহভাজন মুসলিম লিগারদের পেছনে টিকটিকি লাগিয়ে রেখেছে|
শওকত চেয়ারম্যানই একমাত্র লোক যে মহুকুমা সদর থেকে পাকিস্তানী মিলিটারিদের ডেকে আনতে পারে, এ আশঙ্কা থেকেই একদিন বাড়িতে মিটিং হলো| শওকত চেয়ারম্যানকে ভয় দেখাতে হবে; যাতে করে পাকিস্তানী মিলিটারি আনার সাহস না পায়| মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত হলো যে করেই হোক উলাইল ইউনিয়ন বোর্ডের অফিসে দিনে দুপুরে একটি পটকা ফোঁটানো হবে| এতে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে| শওকত চেয়ারম্যান যেমন ভয় পাবে, ইদানিং সৃষ্টি হওয়া রাজাকারেরাও একটু দমে থাকবে|
উলাইল বোর্ড অফিসটি দৌলতপুর থানা সদর থেকে পাঁচ মাইল দূরে, একেবারে থানা সংযোগ সড়কের পাশে অবস্থিত| তিন দিকে সড়ক আর সামনের দিকে ফাঁকা মাঠ| বোর্ড অফিসের দক্ষিন দিকের প্রায় এক মাইল দূরের গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত সে ফাঁকা মাঠে আবাদি জমি| জৈষ্ঠ্য মাসের আধাআধি সময় পেরিয়ে গেছে| পাট গাছ বড় হয়ে প্রায় দেড়-দু’ মানুষ সমান লম্বা| তাই পাট ক্ষেতের ভিতর দিয়েই অপারেশন করতে হবে মিটিংয়ে সে রকমই সিদ্দ্বান্ত|
সেদিন বুধবার| চেয়ারম্যান তখন অফিসে| সাপ্তাহিক মিটিং বসেছে ইউনিয়ন বোর্ডে| মেম্বার আর মুসলিম লিগের চ্যালা চামুন্ডারা শওকত চেয়ারম্যানের চারপাশে বসে আছে| হঠাত বিকট শব্দে একটা পটকা ফুঁটলো| কিছুক্ষণ পর পর আরো কয়েকটি| মিটিং রুমের সামনে টুলের উপর বসে ছিল আনিচ চৌকিদার| লাঠি হাতে এদিক-ওদিক দৌঁড়োদুঁড়ি শুরু করে দিল আনিচ| শওকত চেয়ারম্যান সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করে ক্ষিতিশ মেম্বারকে বাইরে পাঠিয়ে ঘরের খিল আটকিয়ে দিল| ততক্ষণে মুখে গামছা জড়িয়ে কয়েক জন ছেলে সামনের পাটের ক্ষেতে নেমে গেছে| উঁচু সড়ক থেকে দেখা যাচ্ছে পাট গাছ ভেঙ্গে ভেঙ্গে ওরা দূরে চলে যাচ্ছে| আনিচ চৌকিদার লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে জোরে হাঁক দিচ্ছে, শালার মুক্তিবাহিনী, শালা মালাউনের বাচ্চা|
সন্ধ্যে বেলায় শওকত চেয়ারম্যান এলাকার কয়েকজনকে নিয়ে গ্রামে এলেন| বাড়ির উঠোনে কাঠের চেয়ার, বেঞ্চি আর চটের বস্তা পেতে সবাই বসেছে| চেয়ারম্যানের গলার সুর নরম| দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভয় পেয়েছেন| মিটিংয়ে সবাইকে তিনি আশ্বস্ত করলেন, এ এলাকায় পাকিস্তানী মিলিটারি আসবে না| কিন্তু মুক্তিবাহিনীকেও কথা দিতে হবে আর বোমাবাজি না করার|
সদ্য গঠিত মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার কমরেড হাকিম উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন| তিনি সম্মতি দিলেন| বললেন, শওকত ভাই, এ এলাকাটাতো আমাদের তাই না| আমরা খামোখা কেন বোমাবাজি করতে যাবো? কিন্তু আপনাকেও কথা দিতে হবে আশপাশের হিন্দু গ্রামগুলোতে যেন কোন অত্যাচার না হয়|
পাশ থেকে বাবা বললেন, ওপাশের পাড়া থেকে কালু নাকি রাত বিরেতে হিন্দুপাড়ায় এসে পাকিস্তানী মিলিটারির ভয় দেখায়| কাল রাতেই নাকি দিনেশকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দেয়ারও হুমকি দিয়েছে|
কমরেড হাকিম উদ্দিন বললেন, ওকে আজ থেকে সাবধান করে দেবেন শওকত ভাই| শেখ সা’বের ডাকে আমরা যুদ্ধ করছি| খালি হিন্দুরাই কি পাকিস্তানীদের তাড়াতে চায়? মুসলমানরা চায় না? আপনি চান না?
ব’লেই তিনি শওকত চেয়ারম্যানের দিকে তাকালেন| কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছেন চেয়ারম্যান|
কমান্ডার হাকিম উদ্দিন আবার বলা শুরু করলেন, হিন্দুদের দোষটা কোথায়? কালুর সাহস থাকে তো ওকে কলিয়ার মুসলিম পাড়ায় পাঠাবেন| ও যদি আর হিন্দুদের ভয়-ভীতি দেখায় সে দায়িত্ব কিন্তু আপনাকে নিতে হবে| এলাকায় এটা আর চলবে না| আপনি আজই কালুকে ডেকে সাবধান করে দেবেন|
কথাটি শওকত চেয়ারম্যানের ভাল লেগেছে বলে মনে হলো না| কিন্তু ভয় আর শঙ্কায় কিছু না বলেই মিটিং শেষ করলেন সে রাতের মতো|
সেদিনের মিটিংয়ের পর থেকে হিন্দু গ্রামগুলোতে মুসলিম লিগের লোকজনের আনাগোনা কমে গেল| কিন্তু সবার মধ্যে একটা চাপা ভয় ও আশঙ্কা তো থেকেই গেল| গ্রামে কিংবা বাড়িতে থাকলে একটু স্বস্তিতে থাকা যায়| কেউ হাট-বাজারে গেলে বাড়িতে না-ফেরা পর্যন্ত সবাই আতঙ্কে থাকে| কখন কাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে!
এ ভাবেই আষাঢ় মাস এসে গেল| চারিদিকে আউশ আর জলি ধান কাটার ধুম| সেবার নতুন জল একটু তাড়াতাড়িই চলে এলো| মাত্র দিন দুয়েকের ব্যবধানেই গ্রামগুলো যেন এক একটা দ্বীপ| মাত্র সপ্তাহ দু’য়েক আগেই মাঠ ভরা ছিল পাটে| এখন আর কোথাও পাট গাছ নেই| বড় বড় আঁটি বেধে পাট পচানোর কাজ চলছে| নতুন আসা বর্ষার জলে বড় বড় বাঁশের সাথে পাটের আঁটিগুলো আটকিয়ে কচুরিপানা কিংবা কলাগাছ দিয়ে পাট ডুবিয়ে রাখা হয়েছে জলের নিচে| মাসখানেক পরেই বাঁশের মাচা বানিয়ে জলের ওপরেই পাটের আঁশ ছাড়ানো হবে| তারপর আঁশ ও পাটখড়ি দু’টোই বাড়িতে কিংবা উঁচু সড়কে এনে রোদে শুকানো হবে| উঁচু সড়কের দুপাশ দিয়ে মাইলের পর মাইল বাঁশ টাংগিয়ে পাট খড়ি শুকানোর এক মনমুগ্ধকর দৃশ্য| সড়কের মাঝ দিয়ে শুধু সরু পায়ে চলার পথ|
বর্ষার জল আর্থিক স্বচ্ছলতা নিয়ে এলেও আরেক বিপদ নিয়ে এলো| নৌকা করে সহজেই গ্রামগুলোতে যাতায়াত করা যায়| লুকানোর জায়গাও আর থাকলো না বললেই চলে| হঠাত করে এক বিকেলে পাশের গ্রামে বাবার বন্ধু অমল কাকুদের বাড়িতে বিরাট এক ঘাসি নৌকা করে কিছু রাজাকার এসে লুটপাট করে চলে গেল| অমল কাকু তো আগেই ইন্ডিয়া চলে গেছেন| বাড়িতে দুই ভাই তখন থানা সদরের কাপড়ের দোকানে| বউ ছেলেমেয়ে আর মা বাড়িতে শুধু| পেছনের নিমাই বিল দিয়ে এক বড় ঘাসি নৌকা করে জনা দশেক লোক এসে বাড়ির সোনা-দানা-ধান-চাল নিয়ে ভেগে গেছে| যাওয়ার সময় নাকি শাসিয়ে গেছে এ কথা মুক্তিবাহিনীকে বললে থানা সদরের দোকান থেকে দুই ভাইকে পাকিস্তানী মিলিটারির কাছে ধরিয়ে দেবে|
সবাই তো থ| এলাকায় এ রকম একটা ঘটনার আঁচ আগে থেকে কেউ করেনি| বর্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীর অনেক ছেলেরা একটু উঁচু এলাকায় চলে গেছে| অনেকেই ট্রেনিংয়ের জন্য বর্ডার পাড়ি দিয়ে চলে গেছে ভারতে| বাবাসহ যারা তখনও এলাকায় তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই এ ঘটনা ঘটে গেল| এলাকার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হাকিম উদ্দিনও তখন এলাকা ছেড়ে ভারতে| মানিকগঞ্জ সদরে হালিম ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একটা গ্রুপ যুদ্ধ করছে| পাশের থানা ঘিওরেও কমাণ্ডার মনসুরসহ আরো কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয়| টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়| কিন্তু কেউ চারিদিকের থই থই জল পেরিয়ে এ বিল এলাকায় অপারেশনে আসছে না| তাছাড়া পাকিস্তানি মিলিটারিরা যে জলে ভয় পায় তখন সবাই এ সংবাদ জেনে গেছে| তাই বড় কোন অপারেশনের ঝুঁকি এ সমস্ত এলাকায় নেই জেনে মুক্তিবাহিনীর টার্গেট তখন থানা আর মহুকুমা শহর|
শওকত চেয়ারম্যানের প্রতিশ্রুতি আর কাজে আসবে না ভেবে আশপাশের হিন্দু গ্রামগুলোতে উতকন্ঠা| আর সে সুযোগেই কালু রাজাকারের বাড়বাড়ন্ত| দু’দিন পরেই পাশের আরেকটা হিন্দু বাড়ি লুট| অথচ মাস খানিক আগেই এলাকা ছিল একেবারে নিরাপদ| এখন মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামঘেঁষা পাড়াগুলো্তে রাত নামার আগেই এক অজানা আতঙ্ক নেমে আসে| অনেকে আবার যুবতী মেয়েদের আরো একটু ভিতরে হিন্দু এলাকার কোন আত্মীয় বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে| কিছুদিন পরেই শোনা গেল রাতের অন্ধকারে কয়েকটি পরিবার পালিয়ে ভারতে চলে গেছে| গুজব এমন সংক্রামক যে,তিলকে তাল করে ফেলে| সহসাই পাশাপাশি তিন-চারটে হিন্দু গ্রামে এক ভয়ের রাজত্ব চেপে বসলো|
অনেকদিন পরে বাড়িতে গোপন মিটিং| যে করেই হোক এর একটা সমাধান করতে হবে| সিদ্ধান্ত হলো এখনই কোন অপারেশনে যাওয়া যাবে না| শওকত চেয়ারম্যানের মাধ্যমেই সবাইকে আবারও আশ্বস্ত করতে হবে| ভারতে পালিয়ে যাওয়ার যে হিরিক পড়ে গেছে সেটা আগে বন্ধ করতে হবে| তারপর না হয় সু্যোগ বুঝে নতুন করে অপারেশন!

(৫)
আষাঢ় মাসেই আরও কয়েকটা হত্যাযজ্ঞ ঘটালো পাকিস্তানী মিলিটারি| ততদিনে মহুকুমা সদর থেকে থানা পর্যায়ে পাকিস্তানী মিলিটারি চলে এসেছে| সে সুযোগে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বারেরা ইউনিয়নে ইউনিয়নে শান্তি ও পাকিস্তান রক্ষার নামে পিস কমিটি গঠন করছে| শান্তি রক্ষা তো নাম মাত্র| পিস কমিটির সদস্যদের প্রধান কাজই হলো পাকিস্তানী মিলিটারির নামে হিন্দু এলাকায় ভয়ভীতি দেখিয়ে জমি-বাড়ি, টাকা-পয়সা লুটপাট করা|
ঘিওর থানা সদরের রথযাত্রা উতসব মানিকগঞ্জ মহুকুমায় খুব বিখ্যাত| ধামরাইয়ের পরেই ঘিওরের রথযাত্রা| এলাকায় প্রচলিত আছে যে, বালিয়াটির জমিদার ঢাকা জেলার সব এলাকা থেকে শতাধিক কাঠমিস্ত্রী ডেকে এনে এক বছরেরও অধিক সময় ধরে ধামরাইয়ের রথ তৈরী করান| ৬০ ফুট উঁচু, ৪৫ ফুট চওড়া তিন তলা বিশিষ্ট বিশাল এ রথে ৩২ টি বিশাল বিশাল কাঠের চাকা| দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার চতুর্কোণে সুসজ্জিত কামরা বা নবরত্ন| রথের সামনে ও চারপাশে কাঠে খুদাই করা হিন্দু দেব-দেবীর চিত্র| ধামরাইয়ের প্রায় সব রাস্তায় তখন এ রথ টানা হতো| আর ভক্তরা রাস্তার দুই দিকে দাঁড়িয়ে উলুধ্বনির সাথে সাথে বাতাসা-কলা-চাল ছিটিয়ে দিত|
ধামরাইয়ের রথ আগে ছিল বাঁশের তৈ্রী| কাঠের এই নতুন রথ উদ্বোধনের সময় বালিয়াটির জমিদার বাহাদূর এলাকার ব্রাহ্মণ ও আশপাশের জমিদারদের নিমন্ত্রণ করলেন| নিমন্ত্রণের ত্রুটির জন্য তেরশ্রীর জমিদার কালী নারায়ণ রায় চৌধুরী ক্ষুব্ধ হয়ে নিমন্ত্রণ প্রত্যাখান করলেন| পরের বছরই তেরশ্রীর কাছে ঘিওরের থানা সদরে আরেকটি জগন্নাথের রথ তৈ্রী করালেন| সীমিত অর্থের জন্য তিনি ধামরাইয়ের রথকে অতিক্রম করতে তো পারলেনই না; এমনকি ঘিওরের রথ উচ্চতা ও আয়তনে ধামরাইয়ের সমানও হলো না | কিন্তু তিনি ধামরাই রথ যাত্রার দিনেই ঘিওরের রথের চাকাও টানাতেন, যেন তার প্রজারা ধামরাই রথ দর্শণে না যেতে পারে|

সে বার রথ যাত্রার দিন সন্ধ্যাবেলায় পাকিস্তানী মিলিটারি ঘিওর বাজারের হিন্দুদের দোকান-পাটে হামলা করল| সাহা পট্টি পুড়িয়ে দিল| দূরদূরান্ত থেকে রথ যাত্রায় আগত পূন্যার্থীরা কোন রকমে পালিয়ে বাঁচল| কিন্তু পরের দিন ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে পাকিস্তানী মিলিটারি ও রাজাকারদের নৃশংসতার খবর জেনে সবাই শিহরিত| ঘিওরের সাহা পট্রিতে আগুন দিয়ে ফেরার পথে রাজাকার-আলবদরের লোকেরা নিতাই সাহাসহ আরও কয়েকজনকে ধরে পাকিস্তানী মিলিটারির হাতে তুলে দেয়| পরে থানার সামনে খালপাড়ে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দশজনকে হত্যা কর|
ঘিওর থানা সদর থেকে বিশ-পঁচিশটি পরিবার আশ্রয় নিল আমাদের বিল এলাকার গ্রামগুলোতে| সবাই তখন এক ভয়ানক আতঙ্কে| থানা সদরে পাকিস্তানী মিলিটারি আসবে এটা অনেকেই বিশ্বাস করেনি| তাই এক রকম স্বস্তির সাথেই সবাই বাস করছিল| শুধু রাজাকার ও শান্তিরক্ষা কমিটির লোকদের থেকে একটু সাবধানে চলা ফেরা| কিন্তু ঘিওরে পাকিস্তানী মিলিটারি এট্যাকের খবরে মুক্তিবাহিনীও হতচকিত হয়ে গেছে| ক্যাপ্টেন হালিম ও কমান্ডার মনসুরের নেতৃত্বে মানিকগঞ্জ সদরের উপকন্ঠে তরাঘাটে একটা ব্যর্থ অপারেশন হয়েছে| বাবা সবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন| কিন্তু কমাণ্ডার হাকিম উদ্দিন মানে হাকিম ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ নেই| যে সীমিত অস্ত্র ও স্বল্প প্রশিক্ষণ তাতে থানা সদরে পাকিস্তানী মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়| তাই শওকত চেয়ারম্যান ও রাজাকার কালুকে চোখে চোখে রাখাই এলাকার মুক্তিবাহিনীর কাজ|
একদিন সন্ধ্যায় বাবা ফিরলেন ইস্কুল থেকে| ক্লাশ নেই, ছাত্র ছাত্রীরাও কেউ ইস্কুলে যায় না| তবুও ইস্কুলে যাবার নাম করে বাবা তাঁর ইস্কুলে সদ্য নিয়োগ পাওয়া অনিল শিকদারকে নিয়ে নৌকা করে সকালে বের হোন| যদিও একজন মাইনে করে রাখা আছে সারা বর্ষাকালের জন্য| প্রতিদিন নৌকা চালিয়ে বাবাকে ইস্কুলে নিয়ে যাওয়াই তার কাজ|
মফস্বলে শিক্ষকতায় এক ধরণের বনেদিপনা থাকে| ইস্কুল কলেজের শিক্ষকেরা তাই কেউ নৌকা চালিয়ে কোথাও যান না| সমহু বিপদে পড়লেও না| একা একা কখনো কখনো নৌকা বাওয়া যায় কিন্তু কাউকে নৌকায় যাত্রী হিসেবে বসিয়ে নৌকা চালালে সেটা বিরাট এক অসম্মানজনক কাজ| কিন্তু এ যুদ্ধের দিনে জীবন বাঁচানোই আগে জরুরী| তাই অনিল শিকদারকে ডিংগি নৌকার পেছনের গলুইয়ে বৈঠা দিয়ে বসিয়ে বাবা সামনের গলুইয়ে আরেক বৈঠা নিয়ে প্রতিদিন সকালে বের হয়ে যান| পূর্বপাশে আমাদের গ্রাম লাগোয়া একটি গ্রাম| জুগিন্দা| শওকত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে মুসলিম লিগের শক্ত ঘাঁটি আগে থেকেই সে গ্রামটিতে|
জুগিন্দার পাশ দিয়েই একটি খাল চলে গিয়ে নিমাই বিলে পড়েছে| প্রায় আধা মাইল প্রস্থ নিমাই বিলটি পার হলেই আরেকটি গ্রাম| প্রায় চার পাঁচ হাজার লোকের বাস সেখানে| মুসলমান প্রধান এ গ্রামটিই মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি| এ গ্রামের পরেই তেরশ্রীর জমিদার বাড়ি| বাবার কর্ম ও আড্ডার স্থল সেখানেই|
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরেই থম থমে মেজাজ বাবার| ঘটনা বোঝা গেল আরেকটু রাত বাড়লে| বাড়ির সামনে বৈঠক ঘর| সেখানে গোল হয়ে বসে বিবিসি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শোনে প্রতিরাতে পাড়ার অনেকেই| সেই সাথে আকাশবাণীর সংবাদ দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় আর নীলিমা স্যান্নালের কন্ঠে| সেখানেই শলা-পরামর্শ হয়| সেদিন রাতে বিবিসি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনা বন্ধ| গলার স্বরও সবার নিচু|
অনিল মাস্টার শুরু করলেন, কালুর এত বড় সাহস, দাদাকে বলে, স্যার আর কতদিন এ দেশে থাকবেন? এবার ইন্ডিয়া কেটে পড়েন |
দাদা মানে বাবাকে ইন্ডিয়া যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কালু রাজাকার| বাবাও নাকি কালুকে আচ্ছা মতো ধমক দিয়ে শাসিয়ে এসেছেন| বলেছেন, তুই নিজের পথ দেখ কালু| আমার পথ তোকে বাতলে দিতে হবে না|
কালু রাজাকার নাকি রাগে গড় গড় করতে করতে চলে গেছে| সবার মনে আশঙ্কা কালু যে কোন অঘটন ঘটাতে পারে এ পাড়ায়| সমুহ বিপদের প্রস্তুতির জন্যই সেদিনে রাতে বসা| অনেকে পরামর্শ দিল পাড়ার বউদের ছেলেমেয়েসহ অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে|
কেউ কেউ মুক্তিবাহিনীর প্রতি হতাশ হয়ে বলল, আর এ দেশে থাকা যাবে না| চল আপাতত ইন্ডিয়া কিংবা কোন মুসলিম বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেই|
মন্টু পাশ থেকে বলে বসল, সব রঁসূনের গোড়া এক| কোন মুসলমানেরে বিশ্বাস করবো বলো| পাশের গ্রাম বহেরাতলির সবাইতো শেখ মুজিবের আওয়ামী লিগ করে| ওদের কিন্তু রাজাকারেরা কিছু বলে না| আমরা হিন্দুদেররই যত দোষ| দেশটা স্বাধীন হলে মনে হয় এ দেশে শুধু হিন্দুরাই থাকবো| ওরা মুসলমানেরা সব পাকিস্তানে চলে যাবে| কাকা, আপনি আর মুক্তিবাহিনী মুক্তিবাহিনী করবেন না তো? টিঁকিটি দেখছি না মুক্তিবাহিনীর| ব্যাটারা ইন্ডিয়া গেছে ট্রেনিং নিতে;এদিকে আমরা মরে ভুত হ্য়ে যাই তারপর ওনারা আসবেন| আমি আর ইউনিয়ন বোর্ডে পটকা-ফটকা ফাটাতে পারব না, কাকা| আমি বলে দিলাম স্পষ্ট করে|
সবাই বাবার দিকে তাকিয়ে| ভাবছিলেন বাবা মন্টুকে একটা জোরে ধমক লাগাবেন| বাবা চুপ করে থাকলেন| বললেন,কী করা যায় এখন? শওকত ভাই আসলে কোন কথাই রাখছেন না| কালু মনে হয় মিলিটারি না হলেও রাজাকার নিয়ে আসবে দু একদিনের মধ্যেই| রাতে রাতে গ্রামে পাহারা বসাতে হবে| মিলিটারি কিংবা রাজাকার আসলেও যেন কেউ কেউ পালিয়ে বাঁচতে পারে| আর আমি বহেরাতলিতে আমার যারা যারা ছাত্র আছে সবাইকে বলে রাখি, যদি ওরা কয়েকটা দিন আমাদের গ্রামে এসে থাকতে পারে|
অনিল মাষ্টার একটু ফোঁড়ন কাটল বাবার কথায়, ‘ শিয়ালের কাছে মুরগী জমা রাখার মতো কথা বললেন দাদা|
এটার মানে কী দাঁড়াল অনিল? বাবা বললেন|
রথ যাত্রার দিন ঘিওরের ম্যাসাকারের পর অখিল ঠাকুরের পরিবার নিরাপদ ভেবে মজিদ মাষ্টারের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল| দু’সপ্তাহ যেতেই মজিদ মাষ্টার ঘরে জোয়ান বউ আর ছেলে মেয়ে থাকতেও অখিল ঠাকুরের কলেজে পড়া বোনকে প্রথমে ইজ্জতহরণ করে পরে জোর করে বিয়ে করেছে, সে খবর জানেন?
মন্টু অনিলের কথায় একটু জোর পেল, অখিল ঠাকুরের বোনই শুধু বিয়ে করে নাই, অখিল ঠাকুরের বউ মাসহ পুরো পরিবারকে গরুর মাংশ খাইয়ে মুসলমান বানিয়েছে| কাকা, আর যাই করেন, ওই গরু-খাওয়া জাতকে দিয়ে আর বিশ্বাস নেই|
এবার বাবা ধমক লাগালেন মন্টুকে| ‘তোদের কথায় মনে হচ্ছে মুসলমান সবাই খারাপ, তাই না? সব মুসলমান খারাপ হলে শেখ মুজিবও খারাপ? কমান্ডার হাকিম ভাই, আফসার স্যার সবাই খারাপ? এই যে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করে মরে যাচ্ছে, ওদের কয়জন আর হিন্দু| সবাই তো মুসলমান| এবার বল ওদের সবাই খারাপ| সবাই মজিদ মাষ্টারের মতো বদমাইশ| কালুর মতো সবাই হলে তো এই চার মাসে হিন্দু পাড়া আর থাকতো না, সবাই মেরে কেটে লুট-পাট করে নিয়ে যেতো|
অনিল মাষ্টার মন্টুর কথায় সায় দিয়ে বললো, কিন্তু দাদা এই পুরো মানিকগঞ্জে শুনেছেন একটাও মুসলমান বাড়ি লুঠ হয়েছে? একটাও মুসলমানের দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে? একজন মুসলমানকেও পাকিস্তানী মিলিটারি বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে? মুক্তিযুদ্ধও করছে অধিকাংশ মুসলমান, দেশ স্বাধীন হলেও মুসলমানের দেশই তো হবে এটা| খামাখা আমাদের উপর অত্যাচার কেন? এরচেয়ে আমাদের ইন্ডিয়াতে সরকারী ভাবে পাঠিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়|
বাবা বললেন, অনিল তুমি শেষে যা বললে, এটাই তো পশ্চিম পাকিস্তান সরকার চাচ্ছে| সেই সাথে তাল মেলাচ্ছেন পূর্ব-পাকিস্তানের কিছু মুসলিম লিগার| শেখ মুজিব, আওয়ামী লিগ আর মস্কোপন্থী বামপার্টিগুলো পাকিস্তানের এ চক্রান্ত মানবে না বলেই তো এ যুদ্ধ| আমরা তো এদেশেরই মানুষ| ইন্ডিয়াতে যাব কোন দুঃখে? গেলে তো ৪৭’এর দেশ বিভাগের সময়েই যেতাম| দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না| আর সে জন্যই আমাদের মুক্তিবাহিনীর সাথে থাকতে হবে|
বাবার উচ্চকন্ঠে ভিতর বাড়ি থেকে মা, জেঠীমা সবাই বাইরের উঠোনে চলে এসেছে| মাকে দেখে বাবা বললেন, তুমি আবার উঠে এসেছো কেন? ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক|

আগের পর্বগুলোর লিঙ্কঃ

প্রথম পর্ব