ভজন সরকার
(মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থা এবং অবস্থান নিয়ে ধারাবাহিক)
(১)
পড়ন্ত বেলায় বাবা কেন দেশ ত্যাগ করলেন আমি এখনও জানি না| শুনেছি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একবার ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন আমার মাতৃকুলের সবাইকে জানান দিতে যে, তিনি বেঁচে আছেন| পাকিস্তানী হানাদার কিংবা দেশীয় রাজাকারের হাতে তাঁর অপমৃত্যু হয়নি| এ কথা নাকি লোকমুখে সুদূর কলকাতাতেও চাওড় হয়ে গিয়েছিল যে, মানিকগঞ্জের এক অজ পাড়াগাঁয়ের বটগাছে পাকিস্তানী মিলিটারীরা এক জনকে ঝুলিয়ে রেখেছে| কালো কুঁচকুঁচে ছয় ফুট মানুষটির ক্ষতবিক্ষত দেহ প্রথমে গুলি করে ঝাঁঝরা করা হয়েছে| তারপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আরও বিভৎস্য করার চেষ্টা হলেও ঝুলিয়ে রাখা মানুষটিকে এলাকার সবাই চিনেছে| মৃত্যুর কথা যেমন হু হু বাতাসের বেগে চারিদিকে ছড়ায়, বাবার মৃত্যু সংবাদটিও তেমনি কলকাতা অব্দি ছড়িয়েছিল তখন|

এ মুক্তিযোদ্ধাটি নিজের জীবন বিপন্ন করে সদ্য জন্মনেয়া তার কন্যাসন্তানকে দেখতেই নাকি রাতের অন্ধকারে গ্রামে এসেছিলেন| যদিও তাঁর জানা ছিল পাকিস্তানী মিলিটারী ও তাদের সহযোদ্ধা আল-বদর আল-শামসের এলাকায় আনাগোনা| তবুও বড় এক অপারেশনের আগে সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া কন্যা সন্তানকে দেখার ইচ্ছে অবদমিত করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি| তাই বর্ষাকালের থই থই জল পেরিয়ে বিলাঞ্চলের গ্রামটিতে এসে তিনি নাকি তার কন্যা সন্তানটির দেখাও পেয়েছিলেন| মাত্র কয়েক সপ্তাহের শিশুটির মাথায় হাত রেখে তিনি বলেছিলেন, আর একটু পরে এলেই তো স্বাধীন একটি দেশে জন্ম নিতে পারতিস, পাকিস্তানে জন্ম নেবার কলঙ্ক মাথায় পড়ত না তোর|

এটা থেকে ধরে নেয়া যায়, নিহত মুক্তিযোদ্ধাটি আগষ্ট কিংবা সেপ্টেম্বর মাসের কোন এক রাতে তার সন্তানকে দেখতে এসেছিলেন| কন্যা সন্তানটিকে দেখার কিছুক্ষণ পরেই তিনি বাড়ি থেকে বের হন এবং বিলের শেষ মাথায় রাজাকার ও পাকিস্তানী মিলিটারির প্রতিরোধের মুখে পড়ে আহত হন | পরে মৃত্যুবরণ করেন| এ সংবাদটি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল তখন| আমার ছোট বোনটির জন্মও সে বছরই আগষ্ট মাসে| মায়ের সন্তান সম্ভাবার কথা কলকাতার সবাই জানতেন| তাই আনন্দবাজারের সংবাদটি পড়ে বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে আমার মামাবাড়ির সবাই নিশ্চিত হয়েছিলেন| আমার মায়ের আত্মীয়-স্বজনেরা গয়ায় গিয়ে নাকি পিন্ডিও দিয়ে এসেছিলেন বাবার আত্মার সদগতির উদ্দেশ্যে?

আমার দাদু পিন্ডির দক্ষিনা ফেরত না-চাইলেও বাবার জন্য ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসেই কৃঞ্চনগর জেলার চন্দননগরের এক প্রতিষ্টিত হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন| কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ্ব বাবার ধমনীতে তখন সদ্য-স্বাধীনতার রক্ত| বাবা নাকি আমার দাদুকে উল্টো প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আপনিই বরং ফিরে চলুন| ৬৫-তে দাংগার সময়ে ফেলে আসা পুরানো ঢাকার বনেদী পগজ হাইস্কুলের সেকেন্ড মাষ্টারের চাকুরীটাই আপনাকে ফেরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা যাবেখন?

“ঔদ্ধ্যত ব্যবহারই বটে ছোকড়ার|” স্বাধীনতার প্রায় তিন দশক পরে বুড়োর সাথে দেখা হলে তিনি কলকাতার বাড়িতে বসে আমাকে একথা বলেছিলেন| আমি অনেকবারের মতো এবারও বাবার দেশ প্রেমের চেতনায় গর্বিত হয়ে হেসেছিলাম| যদিও তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কিয়দংশমাত্র অবশিষ্ট ছিল|
সেবার বাবা কলকাতা থেকে অনেক কিছু এনেছিলেন বাড়ির সবার জন্য| আমার জন্য ছোট্ট এক জোড়া পিওর লেদারের জুতো| যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাস না- দেখা আমি যে আর ছোটটি নেই, মুক্তিযোদ্ধা বাবা সেকথা বেমালুম ভুলে ছিলেন| তাই ছোট পিওর লেদারের জুতো জোড়া আমার আর পড়া হয়নি কোনদিন| প্রথম পাওয়া বিদেশী জিনিস না -সওয়ার সে আক্ষেপ এখনও আমার আছে|
একেবারেই শিশুর মাপে বানানো সুন্দর জুতো জোড়া আমি সযত্নে রেখেছি অনেকদিন| বাবার ব্রাশ নিয়ে বাবার মতো করে পালিশ করে ঝকঝকে তকতকে করে জুতোর তাকে তুলে রেখেছি বহুদিন| জুতো জোড়া যেন তখন আমার কাছে না-দেখা কলকাতার প্রতিচ্ছবি| শিশু বয়সে শোনা মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য রোমাঞ্চকর কাহিনির মতোই ওই জুতো জোড়াও তখন আমার এক শিহরিত সম্পদ| বাবা যখন বলতেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন একটি দেশের কথা, আমি তখন ভাবতাম আমার জীবনের প্রথম পাওয়া সে জুতো জোড়ার কথা| যদিও অর্জণ আর পাওয়ার মধ্যে যে পার্থক্যটি আছে তা আমি তখনও বুঝিনি| দীর্ঘদিন পরে এসেও যে সঠিক বুঝেছি সেটাও বলা যাবে না|
কাকতালীয় ভাবেই ৭৫-এর পরে বাবার কেনা সে ছোট্ট জুতো জোড়া আমি আর খুঁজে পাইনি| না, কোথাও না! বাড়ির আনাচে কানাচে, উঠোনের খানাখন্দে, এমনকি মায়ের গয়নার বাক্সেও| কোথাও পাওয়া যায়নি এক মুক্তিযোদ্ধার কেনা ছোট্ট এক জোড়া জুতো, যার বেঠিক সাইজের জন্য তার শিশুসন্তানটির কোন মন খারাপ ছিল না সেদিন| অথচ অব্যবহ্রত সে জুতো জোড়া হারিয়ে যাওয়ার পর তার শোকেই যত রাজ্যের হাহাকার!

(২)
বাবা কলকাতায় গেলেন স্বাধীনতার কয়েক মাস পরে| তখন সবে মাত্র ভারতীয় কংগ্রেস মার্চ মাসের নির্বাচনে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে| জাতীয় কংগ্রেসনেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত এবং কেন্দ্রের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে| পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় যে পশ্চিমবংগের রাজনীতিতে তেমন সিদ্ধ হস্ত সেটা নয়| কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেস বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধী চাইছিলেন, তাঁর আস্থাভাজন কেউ রাজ্যের সংকট মোকাবেলা করুক| রাজনৈতিক সমাধানের চেয়ে প্রশাসনিক সমাধানের দিকেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জোর দিচ্ছিলেন বেশী| বিশেষত নকশাল আন্দোলন দমনের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই|
যদিও তখন জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি পশ্চিমবংগের বাঙালী বিশেষত দেশবিভাগের ফলে পূর্ব্বংগের উদ্বাস্তু বাঙালীদের মোহভংগ ঘটে গেছে| কিন্তু পাকিস্তানকে ভেংগে দু’টুকরো করে দিতে সহায়তা এবং দু’কোটি শরনার্থীদের সমস্যার সমাধানের আশায় আবারও কংগ্রেসকে ভোট দিলেন তারা| ফলে যে বামপন্থী কম্যুনিষ্ট বিশেষত সিপিআই এবং সিপিআইএম আস্তে আস্তে উদ্বাস্তু-অধ্যুষিত শহর ও শহরতলীতে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলছিল, সেখানেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জয়যুক্ত হলো সে বারের নির্বাচনে|
অথচ ৪৭’এর দেশবিভাগের ফলে পূর্ববংগ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের কংগ্রেসের প্রতি আনুগত্য থাকাই স্বাভাবিক ছিল| এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ৬০ দশকের শেষ অব্ধি সে আনুগত্য অটুটও ছিল যথারীতি| কিন্তু ৫০ থেকে ৬০ দশকে ক্রমান্বয়ে পূর্ববংগ থেকে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলো| এ উদ্বাস্তুদের একশো শতাংশ আবার হিন্দু| পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাংগা এবং বাঙালীদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানীদের চরম বৈষম্য উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বাড়িয়েই দিল দিনের পর দিন| ফলে পূর্ববংগে কংগ্রেসকে সমর্থন করলেও পশ্চিমবংগে উদ্বাস্তু হয়ে এসে অনেকেই দেখলেন কংগ্রেসের আচরণ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়| এ সুযোগই খুঁজছিল একদার অবিভক্ত কম্যুনিষ্ট পার্টি এবং পরবর্তীতে সিপিআইএম এবং প্রধানতঃ সিপিআই|
মূলতঃ কংগ্রেসের প্রতি মোহভংগ থেকে উদ্বাস্তু কলোনিগুলিতে গঠিত হলো ইউনাইটেড কাউন্সিল অব রিফিউজি কলোনিজ বা ইউ সি আর সি| ইউ সি আর সি-এর সাথে সংযুক্তদের অনেকেই পূর্ববংগ থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এবং রাজনৈতিক ভাবেও সচতন| অথচ উদ্বাস্তু হওয়ার ফলে তাদেরকে শ্রমিকশ্রেনীর মতো মানবেতর পেশা ও জীবন যাপন করতে হচ্ছে| ফলে এতদিন শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যে শক্ত অবস্থান গড়তে ব্যর্থ কম্যুনিষ্টরা উদ্বাস্তুদের মধ্যে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে শুরু করে দিল| ফলে ৬৭’র নির্বাচনে কংগ্রেস এ উদ্বাস্তু কলোনিগুলোতে ভাল ফলাফল করতে পারল না| অজয় মুখার্জীর নেতৃত্বে বাংলা কংগ্রেস ও কম্যুনিষ্টদের যুক্তফ্রন্ট স্বল্প সংখ্যক মেজরিটি নিয়ে সরকার গঠন করল| কিন্তু ৭২-এর নির্বাচনে ঘটল তার বিপরীত| আবার জাতীয় কংগ্রেস ক্ষমতায় এল মূলতঃ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে সদ্য জন্ম নেয়া বাংলাদেশকে সহায়তা দান, দু’কোটি শরনার্থী সমস্যার সমাধান এবং নকশাল আন্দোলনের প্রতি জনবিমুখতার কারণেই| যদিও সাংগঠনিকভাবে পশ্চিমবংগে জাতীয় কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্যের সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে|
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ তো বটেই, পশ্চিমবংগের অবস্থাও তখন খুব সংগীন| এ অবস্থাতেই উন্মুক্ত সীমান্ত দিয়ে বাবা কলকাতা এলেন| প্রথমে এসে উঠলেন কলকাতার উপকন্ঠ দমদম বারাসাত এলাকার একটু ভদ্রোচিত উদ্বাস্তু কলোনিতে| বাবার বাল্যবন্ধু অমল মন্ডল আগে থেকেই বাস করছিলেন সেখানে| পূর্ব পাকিস্তান থেকে ইতিহাসে মাষ্টার্স পাশ অমল কাকু ৬০-এর দশকের প্রথম দিকে ভাগ্যের সুপ্রসন্নতায় একটি কেরাণীর চাকুরী জুটিয়ে নিয়েছিলেন| দমদমের একটা উদ্বাস্তু কলোনির ঘরে বাস করছিলেন একা একা বেশ স্বচ্ছলভাবেই| সেই সাথে যুক্ত হয়েছিলেন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিকভাবেও কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের সাথে|
কিন্তু অমল কাকুর সবকিছু এলোমেলো করে দিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ| উদ্বাস্তু কলোনির এক কামরার ঘরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরনার্থী হয়ে উঠে পড়লো মাসহ দুই ভাই ও তাদের পরিবার|
বাবা যখন তাঁর বাল্যবন্ধু অমলের বাসায় ৭২-এর এপ্রিল মাসে বেড়াতে এলেন, তখনও অমল কাকুর দুই ভাই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেননি| যদিও বাংলাদেশের বয়স তখন ছয় মাস পেরিয়ে গেছে| ফেলে আসা ঘরবাড়ি-জমাজমি-ব্যবসাবানিজ্য ফিরে পাবার এক অজানা আশঙ্কায় অনেক শরনার্থী্র মতো তারা তখনও রয়ে গেছেন পশ্চিমবংগে| যুদ্ধবিধ্বস্ত ভুখন্ডে যোগাযোগের অব্যবস্থা তো ছিলই, সেই সাথে ছিল সম্বন্বয়হীন প্রশাসনিক উদ্যোগ| সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ছিল না শরনার্থীদের ফিরিয়ে এনে পূনর্বাসণের যথোপযুক্ত পরিকল্পনা ও ইচ্ছে| ফলে শরনার্থীদের অনেকেই নিজ উদ্যোগে ফিরে এসে প্রশাসনিক তেমন কোন সাহায্য সহায়তা পায়নি | অনেকেই ফিরে পায়নি যুদ্ধের সময় ফেলে যাওয়া সম্পদ-সম্পত্তিটুকুও| স্থানীয় রাজনৈতিক টাউটদের খপ্পরে পড়ে অনেকেই আবার আংশিক সম্পত্তি ফিরে পেয়েছেন; বাকী অর্ধেক চলে গেছে হঠাত গজিয়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে|
যুদ্ধের নয় মাসের অধিকাংশ সময়েই অনেকে নিশ্চুপ ছিল| অনেকে আবার ভারতে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের বাড়িঘর ও জমিজমা নিজেদের দখলে রেখেছিল এ ভরসায় যে তারা আর কখনো ফিরে আসবে না এদেশে| বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে আবার হিন্দু বাড়ি দখল করে প্রথমেই একটি মসজিদ প্রতিষ্টা করা হয়েছিল| যদিও মানিকগঞ্জে তেমনটি করা সম্ভব ছিল না| কারণ, ঢাকার উপকন্ঠে অবস্থানের জন্য মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর কাছে স্ট্যাটেজিক ভাবেই এ অঞ্চলটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ| তাছাড়া নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকারদের তেমন আনাগোনা দেখা যায়নি| এর ফলে দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া হিন্দুদের বাড়িঘর-ব্যবসাবানিজ্য অক্ষতই ছিল এ এলাকাতে|
এ রকম নানামুখী সংবাদে বিভ্রান্ত হয়ে অমল কাকুর ভাইয়েরা বাংলাদেশে ফিরে আসতে ভরসা পাচ্ছিলেন না তখনও| বাবার কাছে বিস্তারিত শুনে দু’দিন পরেই দুই ভাইকে পরিবারসহ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিলেন অমল কাকু| অনেকদিন পরে যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেল|
কলকাতা তখন এক ভয়ের শহর| সদ্য ক্ষমতায় বসা জাতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতা ও কর্মীরা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ করে নকশাল খতমে নেমেছে| অলিতে গলিতে পড়ে থাকছে লাশ| শ্রেনীশত্রু খতমের রাজনীতিওয়ালাদের থেতলানো লাশের ওপর দিয়ে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে ইন্দিরা কংগ্রেসের গনতন্ত্র পূনরুদ্ধারের অভিযান তখন চলছে পুরোদমে| এক সময়ের উদ্বাস্তু আক্রান্ত কলকাতা তখন এক লাশের শহর| অমল কাকু শরনার্থী ভাইদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে ছোটবেলার বন্ধুকে নিয়ে ত্রাসের শহর কলকাতা ঘুরে দেখাতে বের হলেন সেদিনই|
(৩)
বনগাঁ থেকে শিয়ালদাগামী ট্রেনগুলোর কামরা এক রকম ফাঁকাই থাকে| অথচ শিয়ালদা থেকে বনগাঁর ট্রেনগুলো বাংলাদেশ থেকে আগত শরনার্থীতে ঠাসা| ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্থণ করেছে| অথচ এখন এপ্রিলের প্রায় শেষ| এখনো শরনার্থীদের বাংলাদেশে ফিরে যাবার ঢল?
অমল কাকু ও বাবা বারাসাত থেকে প্রায় ফাঁকা কামরার একটা ট্রেনে চড়ে বসলেন| টিকেট কাটার ঝামেলা তেমন নেই| কারণ, শরনার্থীদের বিনেপয়সায় চলাচল করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যুদ্ধের প্রায় পুরো সময়টাতেই পশ্চিমবংগের রাজ্যপাল শাসিত সরকার| তাই বিনে পয়সার ট্রেন ভ্রমনের সময় সিগারেটে হালকা করে সুখটান দিলেন দুইবন্ধু| পা ছড়িয়ে দখল করে বসলেন একদিকের আসনগুলো| ততক্ষণে বারাসাত ছেড়ে পরের স্ট্রেশনের ট্রেন থেমেছে| উল্টো দিকের প্লাটফরমে উপচে পড়া মানুষের ভিড় দেখে সহসা অমল কাকু বলে উঠলেন, এ কয়দিন তো ব্যস্ততার কারণে তোকে দেশের কথা জিজ্ঞেস করাই হয়নি| মুক্তিযুদ্ধের কথা, কে কে বেঁচে আছে, কে মরে গেছে, কিছুই তো শোনা হলো না| যদিও অনেক কিছু কানে এসেছে, কিন্তু কতটুকু সত্যি কে জানে? এই ধর না তোর কথাই| একদিন তোর এক আত্মীয়ের সাথে কলকাতায় দেখা| সে তো বলল, তুই নাকি মরে গেছিস?
বাবা তখন প্ল্যাটফর্মের ওপার থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে বললেন, হ্যা আমি তো সেটা শুনেই দেখা করতে এলাম| আর যুদ্ধের কথা কি আর চলতি পথে বলা যাবে? আছি তো বেশ কিছুদিন, আস্তে আস্তে শোনাবো| আর এ দু’দিন তোর কাছে বেশ কিছু লোকের আনাগোনা দেখলাম| উদ্বাস্তুদের নিয়ে কিছু পোস্টার আর বইও দেখলাম|
হা তুই ঠিকই ধরেছিস| এখানে ইউনাইটেড কাউন্সিল অব রিফিউজি কলোনিজ বা ইউ সি আর সি নামে একটা সংগঠনের সাথে জড়িয়ে গেছি, অমল কাকু বললেন| দেখ না, বজ্জাত কংগ্রেস পূর্ববংগের উদ্বাস্তুদের সাথে কী আচরণ করছে সেই নেহেরুর সময় থেকেই| আসলে তো জানিস, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা ওরা তো আর্য| আর পূর্ববংগের আমরা কোথাকার কোন চাষাভূসা অনার্য দ্রাবিড়| আর বেটা নেহেরু তো ওদিকেরই লোক|
অমল কাকু ব্যাগ থেকে ইউ সি আর সি-র বই বের করে পাতার পর পাতা উল্টে একটি বড় চার্ট মেলে ধরলেন| বললেন, এই দেখ| পশ্চিম আর পূর্ব্বংগের উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসণের খতিয়ান| সংখ্যার হিসেবে পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুরা বেশি হলে কি হবে, পূনর্বাসনের দিক থেকে শতকরা দশ ভাগও এদিকে খরচ হয়নি| তারপর আবার এই পাকিস্তানযুদ্ধের শরনার্থী?
বাবার কাছে এ পরিসংখ্যানের প্রায় সবকিছুই অপরিচিত লাগলো| নিজের কাছে একটু বেক্ষ্যাপ্পাই মনে হলো অমলকে| তাছাড়া জহরলাল নেহেরু কিংবা কংগ্রেসের সম্বন্ধে এ সমস্ত নেতিবাচক কথার কোন মানে আছে বলেও মনে হলো না বাবার| নেহেরু-কন্যা ইন্দিরার সাহায্য ছাড়া কি বাংলাদেশ এতো সহজে স্বাধীন হতো? কোটি কোটি শরনার্থীদের ভরণপোষন ইন্দিরা গান্ধী আর কংগ্রেসের সাহায্য ছাড়া কি সম্ভব ছিল?
অমল কাকু বললেন, এই মাত্র তো দমদম ক্যান্টনমেন্ট ছাড়ালাম| এখন দুইদিকে দেখবি উদ্বাস্তুদের বস্তি| দেশভাগ হয়ে গেছে সেও আজ পঁচিশ বছর, অথচ কলকাতার যত কাছাকাছি যাবি পূর্ববংগের বাংগালদের বস্তির সংখ্যাও তত বাড়বে| শিয়ালদা তো আরেক পূর্বপাকিস্তান| প্রথমে দেখলে কেউ কেউ ভাববে কলকাতাটাই শালা বাংগাল বাটিদের দখলে চলে গেছে| হারামি ঘটিরা সব হিন্দিঘেঁষা বিছুদ্ধ কথা কয়| ছিয়ালদাতে দাদাদের টিকিটা দেখতে পাবি না|
অমলের কথায় বিদ্রুপ আর শ্লেষ, অথচ দেখ এই হারামি নকশালরা সমাজতন্ত্র মারাচ্ছে জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে হারামি জোতদারদের মেরে| এত পারিস কলকাতা এসে দে শালা এই বড় বড় বিল্ডিং ভেংগে, দখল করে নে হারামি সুদখোর মাড়োয়ারীদের ব্যবসা| দেখবি পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আসা কোটিখানিক বাংগাল গামছা খুলে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে নেমে পড়বে|
বাবা লক্ষ্য করলেন অমল শেষের কথাগুলো একটু নিঁচু গলায় বললেন| তারপর চারদিকে তাকিয়ে বাবার কানের কাছে ফিস ফিস গলায় বললেন, নকশালের খতমবাজগুলো নাকি কলকাতাতেও সিঁধিয়ে গেছে? দেখি শালারা রাইটার্স ওড়াতে পারে কিনা?
বাবা একটু ভড়কিয়ে গেলেন অমল কাকুর কথা শুনে| ইস্কুল জীবন থেকেই তো সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করতো অমল| ৬০-এর দশকে ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথেই যুক্ত থেকেছে| অমলের কাছ থেকেই বাবার প্রথম হাতেখঁড়ি বামপন্থি রাজনীতিতে| তারপর ইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করার পরেও গোপনে কম্যুনিষ্ট পার্টির সাথেই যুক্ত ছিলেন| নকশাল আন্দোলন যখন পশ্চিমবংগের উত্তরের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে গেল, বাবা তাঁর বামপন্থী বন্ধুদের সাথে সমান খুশী হয়েছিলেন| যদিও পশ্চিমবংগের কমিউনিষ্ট পার্টিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা শোনা যাচ্ছিল, তবু বাবা ভেবেছিলেন অমল হয়তো নকশাল আন্দোলনকেই সমর্থণ করছে| বন্ধু অমলের কথাতে বেশ হতাশ হলেন বাবা|
অমল হঠাত নিজে থেকে সাবধান হয়ে বললেন, চারদিকে কিন্তু খতমবাজদের খতম চলছে| কথা বার্তায় একটু সাবধান! আর পুলিশে ধরলে সোজা ঢাকাইয়া ভানু মাইরা দিবি| কাদার মধ্যে পা হান্দাইয়া দিবি.. যাচ্ছি খাচ্ছি বলে বিছুদ্ধ বাংলা কওনের কোন দরকার নাই, বুঝলি| তা’ইলে পুলিশ ভাববো, তুই শালা শরনার্থী, নকশাল না!
প্রায় শূন্যকামরা অট্টহাসিতে ভরিয়ে তুললেন দুই বন্ধু| অনেকক্ষণ পরে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন ট্রেন ততক্ষণে উল্টোডাংগা ছাড়িয়ে কলকাতার মধ্যে ঢুকে পড়েছে| অমল কাকু বললেন, আর একটু পরেই আমরা শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে যাব| (চলবে)