আগের পর্ব এখানে ঃ পর্ব -1
(৩)

রোমান সেনেট – ২০০ খৃঃ পূঃ থেকে চতুর্থ শতাব্দিঃ
রোমের শাসনকে গণতন্ত্র না বলে অলিয়ার্গকি বলা ভাল। কিছু মুষ্টিমেয় পরিবার জন্মসূত্রে সেনেটর হওয়ার অধিকার পেত। ১২৪ খৃঃপূঃ গ্রীস এবং ক্যাথ্রিজ রোমের হাতে পদানত হয় । রোম হয়ে ওঠে ভূমধ্য সাগরের একচ্ছত্র অধিপতি। ফলে রোমের রাজনীতি গোটা পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ন্ত্রন করেছে প্রায় ছশতাব্দি ধরে।

রোম শাসন করতেন কনসাল-যিনি সেনেটের প্রধান হতেন। কনসাল প্রতিবছর নির্বাচিত হত। রোমান কনসাল বর্তমান কালের নিরিখে একাধারে প্রধান সেনাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী। অনেকটা আমেরিকান প্রেসিডেন্টের মতন ছিল তার ক্ষমতা । কনসাল পজিশনে জিততে গেলে শুধু ভাল রাজনীতিবিদ বা বক্তা হওয়া যথেষ্ট ছিল না । সফল মিলিটারি জেনারেল হওয়া ছিল প্রথম এবং মুখ্য যোগ্যতা।

কনসাল হওয়ার জন্য রোমান সেনেটররা লবিং করতেন। কিন্ত রোম তখন শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদি শক্তি। ফলে শুধু লবিং এ কিছু হত না। বাইরের একটা রাজ্য বা প্রদেশ মিলিটারি ক্যাম্পেইন করে জিততে না পারলে, কল্কে পেতেন না তারা। ফলে রোমের রাজনৈতিক অভিনয়টা গরীব দরদি ইমেজ বিল্ডিং এ ছিল না । রোমের রাজনৈতিক অভিনয়টা চলত কে কত ভাল মিলিটারি জেনারেল সেটাকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। যদিও লুয়াস মামিয়াস, জুলিয়াস সিজার এর মতন জেনারেলরা এবং মার্কাস অরেলিয়াস এর মতন সম্রাটরা গরীব দরদি নেতার অভিনয় ও খারাপ করেন নি।

রোমের সমগ্র ইতিহাসে রাজনৈতিক অভিনয়ের ভূমিকা বিশাল।

রোমের সেনেটররা আসতেন ধনী পরিবার থেকে। এই সব আলালের দুলালরা, ভাল সেনানায়ক হতে পারতেন না-সেটা বলায় বাহুল্য। জুলিয়াস সিজার অবশ্য ব্যতিক্রম। কিন্ত সেনানায়ক সেজে অভিনয় করতে গিয়ে, সেনেটররা রোমকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছেন বারংবার-যেটা রোমান সেনেটের ক্ষমতা ধ্বংসের একটা বড় কারন।

২১৭ খৃষ্ট্রপূর্বাব্দে ক্যাথ্রিজ সেনাপতি হ্যানিবাল, রোম শহরের প্রায় ২০ মাইলের মধ্যে ঢুকে পড়েন। ২১৮ খৃঃপূঃ ট্রিবিয়া এবং ২১৭ সালে লেক ট্রাসমিন হ্রদের যুদ্ধে হ্যানিবালের হাতে রোমানদের শোচনীয় পরাজয় হয়। দুটি যুদ্ধে রোমান সেনাবাহিনী প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। অবস্থা এমন -হ্যানিবাল রোমে ঢুকলে সবাই রোম ছেরে পালাবে। হ্যানিবাল কোন কারনে সেটা করেন নি। করলে পৃথিবীর ইতিহাসটাই বদলে যেত। কিন্ত এই দুই যুদ্ধে রোমানদের গোহারা হারার পেছনে মূল কারন ছিল সেনেটরদের মধ্যে যুদ্ধে “গ্লোরি” বা গরিমা অর্জন।

হ্যানিবাল সেকালের সেরা সেনাপতি। খুব স্বাভাবিক ভাবে, তাকে হারাতে রোমের দরকার ছিল সুদক্ষ জেনারেল। কিন্ত হ্যানিবালকে হারাতে পারলে অনেক গরিমা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা আসবে এই ভেবে ট্রিবিয়ার যুদ্ধে রোমান সেনেটর টিবেরিয়াস সেম্প্রোনাস হ্যানিবালকে সম্মুখ সমরে আহবান করলেন। টিবেরিয়াস সবে সিসিলিতে ছোটখাট যুদ্ধ জিতে কনসাল পদ জিতে ছিলেন। কিন্ত হ্যানিবালের স্ট্রাটেজির কাছে সম্পূর্ন হেরে যান ট্রিবিয়াতে। ৪০,০০০ রোমান সৈন্যদল সম্পূর্ন ধ্বংস হয়। পরে সেনেটে ট্রিবেরিয়াসের ইম্পিচমেন্ট হয় । সেনেটে তার বিরুদ্ধে প্রমানিত হয়, তিনি শুধু নিজের গরিমার উদ্দেশ্যে হ্যানিবালের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে নেমেছিলেন যেখানে অভিজ্ঞ সেনাপতিরা হ্যানিবালের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।

এই ঘটনা রোমের ইতিহাসে বারবার ঘটবে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে। যুদ্ধক্ষেত্র হবে উচ্চাকাঙ্খী সেনেটরদের সব থেকে বড় রঙ্গ মঞ্চ। যুদ্ধ তারা জানুক বা না জানুক সেনাপতি সেজে এমন সব উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেবে, যাতে রোমের অস্তিত্ব হবে সংকটাপন্ন। এই ব্যাপারে সব থেকে কুখ্যাত হচ্ছেন রোম সম্রাট ডমিশিয়ান। যিনি কোথাও কোন মিলিটারি অভিযানে গেলে, প্রথমেই রোমে একটি করে বিজয় দ্বার উত্তোলন করতেন। এমনটা করেছিলেন বৃটেন অভিযানে। বৃটেনে উনি কোন যুদ্ধ করেন নি-রোমান লিজিয়ন নিয়ে টাকা ছড়িয়ে আইসিনি এবং বারগেন্ডির আদিবাসিদের রাজাকে হাত করেছিলেন। রোমে ফিরে, সর্বত্র তার বৃটেন জয়গাথা ছড়িয়ে দেন। এই হচ্ছে সেই বৃটেন যাদের জুলিয়াস সিজার ও জব্দ করতে পারেন নি। অবশ্য, তার ধাপ্পাবাজি সহজেই ধরা পরেছিল। কিছুদিনের মধ্যে বৃটেনে রোমান শাসনের বিরুদ্ধে সর্বত্র বিদ্রোহ শুরু হয় এবং রোমানরা বুঝতে পারে বৃটেন জয় তখনো দূর অস্ত। ডমিশিয়ানের মৃত্যুর পর ঢপবাজির অভিযোগে তার সব বিজয়তোড়ন ভেঙে ফেলা হয়।

এর সাথে গরীব দরদি হয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের ট্রাডিশন ও সমান ভাবে ছিল রোমে। এটা মূলত তারাই করেছেন, যারা সেনেটের ক্ষমতা খর্ব করে স্বৈরাচারি শাসক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। বৈধতা হিসাবে জনগণের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা টাকা ছড়িয়ে, ট্যাক্স ব্রেক দিয়ে কিনেছেন।

জুলিয়াস সিজার-যিনি স্বৈরাচার কায়েম করার গুরুত্বপূর্ন ধাপ হিসাবে, গরীবদরদি কনসালের ভূমিকা নেন

এই চেষ্টা করে প্রথম সফল হন লুয়াস মামিয়াস। লুয়াসের পরিবার অতটা এরিস্ট্রোক্রাটিক ছিল না। ফলে সেনেটররা তাকে নীচু ফামিলির সন্তান হিসাবে বিদ্রুপ করত। লুয়াস নিজেও অধিকাংশ সেনেটরদের আলালের ঘরের দুলাল -অপদার্থ রাজনীতিবিদ বলে মনে করতেন। লুয়াস রোমের ইতিহাসে সব থেকে গুরুত্বপূর্ন মি্লিটারি জেনারেল। তার নেতৃত্বেই রোমানরা গ্রীস এবং ক্যাথ্রিজকে চিরতরে পরাজিত করে ইউরোপের সেরা মিলিটারি শক্তি হিসাবে উঠে আসে। শুধু তাই না লুয়াস একজন সফল প্রশাসক ও। কিন্ত সেনেট এবং গণতান্ত্রিক রঙ্গনাট্য তার পছন্দ ছিল না। মনে করতেন এইসব লুচ্চা নাটকের জন্য রোম একদিন উচ্ছন্নে যাবে। ফলে, সেনেটে ্যারা তার বিরোধি ছিল, তাদের এক এক করে গুপ্তহত্যা করান মামিয়াস। কিন্ত তাতে জনপ্রিয়তা কমে ্যেতে পারে দেখে, রোমের দরিদ্র শ্রেনীর মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করেন। তার দুটি ধাপ ছিল। প্রথমত স্পেন এবং গ্রীস থেকে আসা সম্পদের একটা অংশ তিনি গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। দ্বিতীয়ত গরীব রোমানদের সেনা বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেন। সেকালে রোমান সেনা বাহিনীতে কাজ করা মানে লুটপাটের দরজা খোলা। এর পূর্বে গরীব রোমানদের যাদের চাষের জমি নেই, তাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার অধিকার ছিল না । সেনেট মনে করত গরীবদের সেনাবাহিনীতে ঢোকালে তারা একদিন বিদ্রোহ করে এরিস্টক্রাসি ধ্বংস করবে। যেসব সেনেটর গরীবদের সেনাবাহিনীতে নেওয়ার বিরোধিতা করেছিল, তাদের সবাইকে হত্যা করেন লুয়াস। এই ভাবে সেনাবাহিনীর গরীব রিক্রুটদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা সাংঘাতিক বাড়িয়ে ছিলেন লুয়াস।

লুয়াসের এক শতাব্দির পর গরীব দরদির এই একই খেলা খুব সফল ভাবে খেলবেন প্রবাদ প্রতিম রোমান কনসাল জুলিয়াস সিজার। সিজার শুধু দক্ষ জেনারেল ই না-তুখোর বাগ্মীও। পম্পেই এর সাথে তার দ্বন্দ যখন তুঙ্গে-গৃহযুদ্ধের আসন্ন মূহুর্তপূর্বে রোমে ঢুকে গলে জেতা সম্পদের একাংশ দেদারসে জনগনের মধ্যে ছড়াতে থাকেন সিজার। পম্পেই তখন সেনাবাহিনী নিয়ে পালিয়েছেন। সিজারের উদ্দেশ্য ছিল পম্পেই এর সেনাবাহিনীর মনোবোল ভেঙ্গে দেওয়া। উনি দেখাতে চাইছিলেন রোমের জনতা তার সাথেই আছে। এর জন্য সিজার রোমে ছোট ছোট সভা করতেন এবং তার বক্তৃতাতে গরীবদের জন্য দরদ ফেটে পরত। এইভাবে গরীবদের পাশে দাঁড়ায় নি কোন কনসাল। ফলে রোমে সিজারের জনপ্রিয়তা দ্রুত তুঙ্গে ওঠে।

তবে পুরোটাই ছিল সিজারের রাজনৈতিক চাল। সেনেটে সিজারের প্রচুর শত্রু। তাদের দমন করতে দরিদ্রের মাসিয়ার ভূমিকায় অবতীর্ন হোন সিজার। সেনেটের ক্ষমতা খর্ব করে নিজেকে আজীবনের জন্য ডিক্টেটর ঘোষনা করলেন। সেনেটে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ হল না। কারন জনতা সিজারের পাশে। কিন্ত গোপনে গোপনে ব্রুটাসের মতন সেনেটররা সিজারকে হত্যা করার খেলায় নামলেন গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে।

অর্থাৎ দেখা গেছে, যখনই কারুর ডিক্টেটর হওয়ার সখ হয়েছে, তিনি সফল ভাবে ধণীদের বিরুদ্ধে গরীবদের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে, প্রথমে জনপ্রিয় হয়েছেন। এবং সেই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে বিরোধিদের নির্মম ভাবে হত্যা করেছেন। অর্থাৎ দরিদ্রপ্রীতি এদের কাছে ছিল স্বৈরচারি শাসনের সিঁড়ি। শুধু সিজার কেন- সাদ্দাম হুসেন, মুসোলিনি, হিটলার থেকে লিবিবার গদ্দাফি, জেনারেল জিয়া, সব স্বৈরাচারের এক ইতিহাস।এদের কেও রুলিং এরিস্টক্রাটিক ফ্যামিলি থেকে আসেন নি। ক্ষমতা দখলের জন্য এরিস্ট্রক্রাসির বিরুদ্ধে গরীবদের ক্ষোভ এরা সফল ভাবে কাজে লাগিয়েছেন। এরিস্টক্রাসির বিরুদ্ধে জেহাদ, গরীবদের প্রতি দরদটা এদের জীবনের সব থেকে বড় সফল রাজনৈতিক অভিনয়। নেপথ্যের আসল খেলাটা ছিল স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা।

সর্বহারাদের দিদি থেকে স্বৈরাচারী মমতা ব্যানার্জির উত্থান দেখলেই বোঝা যাবে প্লেটোর রিপাবলিকের ভূত আজো আমাদের ঘারে।

(4)
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র -তৃতীয় খৃষ্টপূর্বাব্দ

গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগে ভারতীয়রা লিখতে জানত না। হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার লিপি, আর্য্য সভ্যতাতে স্থান পায় নি। ফলে বুদ্ধের আগের ভারতের ইতিহাসের অধিকাংশটাই রূপকথা। ভারতের ইতিহাস ভাল করে আমরা জানতে পারি আলেক্সজান্ডারের আক্রমনের সময় থেকে। গ্রীক ঐতিহাসিকরা মূল সোর্স। এবং গ্রীকদের দেখা দেখি ভারতের রাজন্যবর্গ ও নিজেদের ইতিহাস লেখার জন্য লেখক নিয়োগ করার ট্র্যাডিশন চালু করে।

প্লেটোর যেমন রিপাবলিক, ভারতে তেমন চানক্যের অর্থশাস্ত্র। চানক্যর পূর্বনাম বিষ্ণুগুপ্ত। পেশায় তক্ষশীলায় রাজনীতির অধ্যাপক। তার ছাত্ররা ভারতের বিভিন্নরাজ্যে মন্ত্রী হিসাবে বিশেষ নাম করেছেন। সেই সময় মন্ত্রী হওয়ার জন্য তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির পাঠ নিতে গোটা ভারত থেকে ছাত্ররা আসত।

প্লেটো যেমন গণতন্ত্র দেখে যেতে পেরেছেন, এবং দেখেও এরিস্ট্রোক্রাসি বা দার্শনিক দয়াময় রাজার শাসনকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষনা করেছিলেন, চানক্য ও রাজনৈতিক ভাবে এই মত দর্শন করেছেন। এমন নয় গণতন্ত্র কি চানক্য জানতেন না। ভারতে ১৬ টি জনপদের অধিকাংশ তখনো গণরাজ্য বা গণতান্ত্রিক রাজ্য ছিল।

গণরাজ্যগুলির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভরসা রাখতে পারেন নি কৌটিল্য। প্লেটোর মতন অর্থশাস্ত্রের ও আদর্শ সিস্টেম দার্শনিক রাজা ( philosopher king )। প্রশ্ন উঠবে কেন? চন্দ্রগুপ্তকে সম্রাট বানাতে গণরাজ্যগুলির সাথে বহু বৈঠক করেছেন বিষ্ণুগুপ্ত-তার অনেক শিষ্য গণরাজ্যগুলির নেতৃত্বেও ছিল। তবে কেন অর্থশাস্ত্রে স্থান পায় নি গণরাজ্যগুলির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা?

এর একটা কারন অবশ্য এই যে চানক্য অর্থশাস্ত্র লিখেছিলেন, মূলত এক শক্তিশালী ভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যা গ্রীক বা পারসিক আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম। গণরাজ্যগুলির মধ্যে চুলোচুলি লাঠালাঠি এই পর্যায়ে ছিল-তাদের পক্ষে শক্তিশালী ভারতবর্ষের জন্ম দেওয়া সম্ভব না বলেই মনে করতেন চানক্য। এব্যাপারে প্লেটো বা সক্রেটিসের সাথে তার কোন বিরোধ নেই।

সুতরাং অর্থশাস্ত্রে রাজনীতির অভিনয়ের খেলাটা রাজাকেই খেলতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এরজন্য সব থেকে বেশি ভুক্তভোগী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য নিজে। পাটলিপুত্রে ক্ষমতা দখলের পর, চন্দ্রগুপ্তর কোন স্বাধীনতা ছিল না। চানক্যের অঙ্গুলি হেলনে তাকে ক্রমাগত ভাবী সম্রাট হিসাবে অভিনয় করতে হয়েছে।

ভারতীয় রাজনৈতিক দর্শনের জনক চানক্য-যিনি প্রথম ভারত বর্ষ নামে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন

ভারতের প্রথম সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত। কিন্ত মানুষ চন্দ্রগুপ্তকেও জানা দরকার। মাত্র ৪১ বছর বয়সে সাম্রাজ্য ত্যাগ করে জৈন ধর্মে দীক্ষা নেন। সন্ন্যাস নেওয়ার পর ভিক্ষুকের জীবন গ্রহণ করেন। সেই বছর প্রবল দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ভারতে। অধিকাংশ মানুষ অনাহারে প্রান হারাচ্ছিল। এই মহান সম্রাট জৈন ট্রাডিশন অনুসরন করে, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাথে সমব্যাথী হওয়ার জন্য, নিজেও ৩৬ দিনের অনশনে প্রান ত্যাগ করেন। তিনি মানুষ হিসাবেও মহান ছিলেন। ফলে চানক্যনীতি মেনে রাজনীতির অভিনয় -তার কাছে নীচুতা মনে হয়েছিল। মেনে নিতে পারেন নি। তবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গুরুবাক্য মেনেছেন। কিন্ত এই রাজনৈতিক অভিনয় নিয়ে গুরুর সাথে তীব্র বাদানুবাদ ও হয়েছে।

যেবছর পাটলিপুত্রে চন্দ্রগুপ্তের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল, চন্দ্রগুপ্ত আগের রাজা ধননন্দের অনেকগুলো বাজে খরচ বাদ দিতে চাইলেন। রাজকোষের অবস্থা যুদ্ধবিগ্রহ এবং ধননন্দের বিলাসে বেশ খারাপ অবস্থায়। চানক্যর অনুমতি না নিয়ে পাটলিপুত্রের বৈশালী উৎসব বন্ধের নির্দেশ দিলেন চন্দ্রগুপ্ত। এই উৎসবে রাজকোষ থেকে বিরাট খরচ করা হত নর্তকী গায়ক ইত্যাদিদের জন্য। রাজা মূলত জনসংযোগ করতেন প্রজাদের সাথে উৎসবের মাধ্যমে।

চানক্য জানতে পেরে ভর্ৎসনা করেছিলেন চন্দ্রগুপ্তকে। তার বক্তব্য ছিল রাজা কখনোই এই ধরনের জনসংযোগের সুযোগ হাতছারা করতে পারে না । উৎসবের চাকচিক্য না দেখালে, প্রজারা ভাববে রাজা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল। আর দুর্বলের প্রতি আনুগত্য অত সহজে আসে না । চন্দ্রগুপ্ত চেয়েছিলেন, উৎসবের পেছনে খরচ না করে চাষাবাদের সুবিধার জন্য কিছু খাল কাটাবেন। সেটা খরার সময়। কৃষকদের ভার লাঘব করতে চেয়েছিলেন। কিন্ত পালটি খেতে বাধ্য হন গুরুর নির্দেশে। অর্থাৎ চানক্যনীতিতে রাজনৈতিক অভিনয়ের স্থান প্রজাহিতৈশী কর্মের ওপরে।

তাহলে আর মমতাকে দোষ দিয়ে কি হবে? রাজ্যর রাজকোষ শুন্য। কিন্ত তিনি ধার করে একের পর এক উৎসবের আয়োজন করছেন । টলিঊডের গ্ল্যামার নিয়ে মচ্ছব অব্যাহত যখন কৃষক আত্মহত্যা বা চিটফান্ডের কবলে রাজ্যর লোক আত্মহত্যা করছে। কিন্ত তার সব রাজনৈতিক উৎসব চানক্যনীতিতে সিদ্ধ। রাজনীতিতে পি আর বা জনসংযোগ হচ্ছে সবার আগে। জনগণের চোখে ইমেজটা কি তৈরী হচ্ছে সেটাই লইয়ালিটি ফ্যাক্টরে মুখ্য।

বর্তমানে এটা মিডিয়ার যুগ। সরাসরি বা মিডলম্যান ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে টিভি এবং নিউজপেপার রাজনৈতিক নেতাদের ইমেজ তৈরী করে। যে মোদিকে আপনি বা আমি জানি টিভি এবং নিউজপেপারের মাধ্যমে,আসল মোদি তার থেকে আলাদা। এটা সব উচ্চ রাজনীতিবিদদের জন্য- সব দেশে সত্য। স্টেজের পেছনের এই খেলাটা সব থেকে ভাল জানেন সাংবাদিকরা। কিন্ত তারা নীরব। পি আর মহাভোজের উচ্ছিস্ট খেতে ব্যস্ত। বলতে গেলে এটাই তাদের ইনকাম। এই ভাবেই গণতন্ত্রে গড়ে উঠেছে সাংবাদিক, পুলিশ, প্রশাসক আর রাজনৈতিক নেতৃবিন্দের দুষ্টচক্র। সাংবাদিকরা এই রাজনৈতিক অভিনয়ের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ।

[চলবে]