প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি প্রসঙ্গে
“প্রত্যেকটি বিষয়কে যতটা সম্ভব সহজ করাই উচিত – তবে তার চাইতে সহজ কোরো না” আইন্সটাইনের এই বক্তব্যের পেছনে হয়ত জ্ঞানতাত্ত্বিক কোন কারন ছিল। এই বক্তব্যকে ঘুরিয়ে বলতে গেলে বলা যায়, জ্ঞানের নতুন কোন শাখা যখন উন্মোচিত হয় তখন এর আগ পর্যন্ত গম্যতার বাইরে থাকা কোন “জটিল” বিষয় আমাদের সামনে “সহজ” হিসাবে উপস্থাপিত হতে শুরু করে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিবিদ এলিনর অস্ট্রম [১] প্রথম এবং একমাত্র নারী হিসাবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার গ্রহনের সময় যেই বক্তৃতা রাখেন তাতেও একই রকম মতের প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি দাবি করেন তাঁদের গবেষনায় দীর্ঘদিন ধরে নীতিনির্ধারকদের ভাষায় যেটা বিশৃংখলা (Chaos) হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসত সেটাই জ্ঞানবৃত্তিক চর্চার সুবাদে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রনে এসে গেল, তখন অবাক হবার কোন কারন থাকেনা। আমরা বুঝতে পারি জ্ঞানের একটি নতুন দিগন্ত খুলে গেছে। অর্থনীতির ভেতরে এরকম একটি শাখা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি। বলে রাখা ভাল প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিতে নিজস্ব জ্ঞানের শাখাগুলোকে বিচার বিশ্লেষণের রীতি কেবল অর্থনীতিতেই নয় বরং সমাজ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেই ক্রমেই বেশি করে গুরুত্ব পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপরা এবং যোগাযোগকে অনেক সহজ করে দিয়েছে — তৈরি করেছে তাদের মত বিনিময়ের কমন গ্রাউন্ড।

আবার প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে ফেরত আসা যাক, প্রশ্ন আসতে পারে অর্থনীতির এই শাখাটিকে আলাদা করে কীভাবে চেনা যাবে? এই প্রসঙ্গে ১৯৮৬ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল ইকনমিক সোসাইটির তৎকালীন সভাপতি ম্যাথিউসের বক্তৃতার অংশ [২] আমলে নেয়া যেতে পারে। তিনি দেখান যে নয়া প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি চারটি বিষয়কে বিবেচনা করে থাকেঃ (ক) আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত মালিকানা ব্যবস্থার (Property Right) নানা ধরন যাতে লেনদেন ব্যয় (Transaction Cost) নিহিত থাকে [৩] (খ) অর্থনৈতিক আচরন এবং কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে প্রচলিত বা গ্রহনযোগ্য রীতি বা নর্ম (গ) বিদ্যমান চুক্তিরগুলির বৈশিষ্ট্য (ঘ) নিয়ন্ত্রন ক্ষমতার বিন্যাস। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি নিয়ে অধুনা বিস্তর আলোচনা হলেও বিষয়টি নতুন নয়। প্রথমদিকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসঙ্গগুলো অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি আগ্রহ জাগাতে ব্যার্থ হয়। কিন্তু পরবর্তিতে অর্থনীতির এই শাখাটিতে এখন পর্যন্ত অনেক মহারথি অর্থনীতিবিদেরা তাদের গবেষনার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তবে নতুন করে সম্প্রতি এই বিষয়ে আগ্রহের যেই ধারা তৈরি হয়েছে সেটাকে অর্থনীতিবিদেরা নয়া প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি (New Institutional Economics) হিসাবে অভিহিত করছেন। নতুন ধারাটির সাফল্যের কারন হিসাবে কেনেথ এরো [৪] মনে করেন “নতুন ধারাটি প্রচলিত অর্থনীতির বিদ্যমান প্রশ্নগুলোর নতুন উত্তর দিচ্ছে এমন নয় বরং এটি নতুন ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। যেমন কেন বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বর্তমান রূপ পেল এবং অন্য কোন রূপ পেলনা? এধরনের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তারা অর্থনৈতিক ইতিহাসের শরণাপন্ন হচ্ছেন বটে কিন্তু তারা এই ক্ষেত্রে বেশ গভীর (ব্যস্টিক বিশ্লেষণ অর্থে) যুক্তি হাজির করেছে”।

যদিও প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি এই বিষয়ক চর্চার ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভাবে নতুন শাখা, কোন কোন বিবেচনায় উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশের ক্ষেত্রে এই শাখার আলোচিত বিষয়গুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা প্রথমত তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই উপনিবেশিক সূত্রেই তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পেয়ে এসেছে। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সেই সব প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট বিধি নিয়েই এই দেশগুলোকে আগাতে হয়েছে। ফলে দীর্ঘদিনের অভ্যাস বশত বুদ্ধিবৃত্তিক নির্ভরতা থেকে যায় সামগ্রিক সংস্কৃতিতে; কারন পুরোনো সেই প্রতিষ্ঠানের ভেতরগত রীতি নীতিই এই সব অঞ্চলের চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সম্ভাবনার মানদন্ড তৈরি করে রেখেছে। ফলে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে সামগ্রিক পরিমন্ডলকে বোঝার গুরুত্ব অনুভব করে আমি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিক জগতের সাথে সুপরিচিত একজন অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার আগ্রহ পোষন করতে থাকি। কেননা প্রচলিত অর্থনৈতিক সূচকগুলো অর্থনীতির খুবই খন্ডিত একটি চিত্র উপস্থাপন করে যেখান থেকে সেই দেশের অর্থনীতির নিজস্বতার দিকগুলো ভালভাবে বোঝা যায়না। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক প্রসঙ্গ আলোচনা করলে একটি দেশের সম্পর্কে বেশ বিস্তারিত চিত্র সামনে আসে। তাই সাক্ষাৎকারের প্রশ্নে প্রথমেই ডঃ আকবর আলী খানের কথা মনে আসে আমার। প্রথমত অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রী থাকার করার দরুন এই বিষয়ে তাঁর তৈরি হয়েছে গভীর বুতপত্তি। অন্যদিক মুজিবনগর সরকার থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন আমলাতন্ত্রের সাথে জড়িত থাকা ছারাও সর্বশেষ তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসাবেও কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। কাজেই বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক পরিমন্ডলকে একজন অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিতে দেখার বিস্তর সুযোগ তিনি পেয়েছেন। তাই তার সাথে কথা বলার এই ভাল সুযোগটি হাতছাড়া করলামনা। সমীহ জাগানো বা “হাম্বলিং” অভিজ্ঞতা বলতে যেটা বোঝায় তার ষোল আনাই পেয়েছি এই মহারথির সাক্ষাতকার নেবার সময়ে। মোটের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার একটি মোটা দাগের চিত্র এখান থেকে পাওয়া যাবে বলা যায়।

আকবার আলি খান (ছবিসূত্রঃ উইকিপিডিয়া)

মূল সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকার গ্রহনের তারিখঃ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ৪, ২০১৩

রিয়াজ উদ্দীনঃ সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির চর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি বিভাগ হিসাবে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। ব্যাষ্টিক এবং সামষ্টিক অর্থনীতির প্রথাবদ্ধ ছকের বাইরে গিয়ে অর্থনীতির ক্রিয়াকলাপ এবং খোলনলচে বোঝার উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক বিনিময় এবং কর্মকান্ডকে প্রাতিষ্ঠানের মাত্রায় এনে বিশ্লেষণ করার চর্চা মূলধারার সাথে পাল্লা দিচ্ছে বলা চলে।অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কারকে যদি অর্থনৈতিক গবেষণার গুরুত্বের মাপকাঠি ধরা হয়, সেই হিসাবেও গত দুই দশকে প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক ধারনার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব নজরে পড়ে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি বিষয়ক আলোচনা এবং সামগ্রিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায় প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে এই দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যত পথ পরিক্রমার মূল্যায়ন হওয়াটা জরুরী। আপনার অভিজ্ঞতা এবং লেখালেখি বিবেচনায় আনলে এই বিষয়ে আপনাকে একজন “অথরিটি” বলা চলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসাবেও আপনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব বিবেচনায় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি বিষয়টি আপনার সাথে আলোচনা করতে চাই। কাজেই প্রথমেই জানতে চাইব – প্রাতিষ্ঠানিক বিবেচনায় বিগত ৪২ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আকবর আলি খানঃ বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমার প্রথমেই ভারতের অর্থনীতি সম্বন্ধে জোয়ান রবিনসনের একটি উক্তি মনে পড়ছে। জোয়ান রবিনসন বলতেন “Whatever you say about India the opposite is equally true”। বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্বন্ধেও যেকোন মন্তব্যই আপনি রাখুননা কেন, সেটার উল্টাটাও অনেকাংশেই সত্য। অর্থাৎ বাংলাদেশের যেই বর্তমন অর্থনীতি এটা বৈপরিত্যে ভরা এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখেন তাহলে বাংলাদেশের যেই বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এটা ঠিক কোনো ধরনের অর্থনীতির তত্ত্বের সাথেই খাপ খায়না। বিশেষ করে যদি আমরা প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি প্রহেলিকা। প্রহেলিকা আমি বলছি এই জন্যে, যে এই ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেকগুলি ইতিবাচক অর্জন দেখা গেছে। যেমন ১৯৭৫ এর পরের তিন দশকে আমাদের মাথাপিছু আয় প্রকৃত হিসাবে দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিহাসে এই ধরনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এর আগে কখনো অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশের গড় আয়ু প্রত্যাশা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে মানব উন্নয়ন সূচকের দিক দিয়ে আমরা অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছি, শিক্ষার ব্যপারে আমরা অগ্রগতি অর্জন করেছি, এগুলো সবই অত্যন্ত ইতিবাচক অর্জন। কিন্তু একই সঙ্গে বাংলাদেশের যে সুশাসন ব্যবস্থা তাতে অতি দ্রুত অবনতি হয়েছে। এটা আমরা যেকোন সূচকের ভিত্তিতেই নির্ণয় করতে যাইনা কেন আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের যেই শাসন ব্যবস্থা সেখানে অবক্ষয় ঘটেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত অবনতি ঘটেছে। কাজেই এই বৈপরীত্যের কী ব্যাখ্যা সম্ভব? এই যে একই সাথে সুশাসনের অবক্ষয় হচ্ছে অন্যদিকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে, এমনকি সামাজিক সূচকেও অগ্রগতি হচ্ছে। এর কারন আমার মনে হয় দু’টি। একটি হচ্ছে কোন দেশ যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের অতি নিম্ন পর্যায়ে থাকে সেই ক্ষেত্রে তার উন্নয়নের সুযোগ এত বেশি যে সেখানে সুশাসনের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন সম্ভব হতে পারে। অর্থাৎ অতি নিম্ন পর্যায়ের দেশ যেগুলো সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুশাসন অপরিহার্য নয়। সুশাসন থাকলে ভাল হয়, কিন্তু সুশাসন না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে না এই ধরনের ধারনা করা ভুল। কিন্তু যখন একটি দেশ মধ্য আয়ের পর্যায়ে উন্নীত হয় তখন যদি সেখানে সুশাসন না থাকে তাহলে তার অর্থনীতির উপরে অনেক বেশি বিরূপ প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ যেহেতু গত তিরিশ চল্লিশ বছরে অর্থনীতির দিক থেকে অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে ছিল সে জন্য সুশাসনের অভাব আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে ততবড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাড়ায়নি। এটি একটি কারন। আরেকটি কারন হল, বাংলাদেশে সামগ্রিক ভাবে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়নি।

কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এই যে কিছু কিচু ক্ষেত্রে সামান্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, সেটাই কিন্তু আমাদের অর্থনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, একটি হল যে কৃষিক্ষেত্রে আমরা অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে এক কোটি টন খাদ্য শষ্য উৎপাদিত হয়েছে – এখন আমরা প্রায় সারে তিন কোটি টন ছুঁই ছুঁই করছি। এখন গত চল্লিশ বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন কিন্তু প্রায় তিনগুন বেড়ে গেছে। এর কারন হল বাংলাদেশের যেই দরিদ্র, অর্ধশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত কৃষকরা তারা কিন্তু একটি অসাধারন সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন এবং নতুন ধরনের ফসল নতুন প্রযুক্তিতে তারা উৎপাদন করে চলেছেন। আরেকটি বিষয় যেটা আমাদের ঘটেছে সেটি হল বিদেশে যে শ্রমিক যাচ্ছে, যদিও এখানে সরকারের ভূমিকা কম, কিন্তু এই দরজা খুলে যাওয়ার ফলে এটা আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য একটি বড় চাবিকাঠি হয়ে দাড়িয়েছে। এই মুহূর্তে যদি আপনি ধরেন তাহলে আমরা মোট বৈদেশিক সাহায্য দুই বিলিয়ন ডলারের মত পাই। তার মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের মত চলে যায় পুরোনো ঋণ শোধ করার জন্য। কাজেই নেট বৈদেশিক সাহায্য আমরা এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পেয়ে থাকি। কিন্তু আমরা সরকারি ভাবেই প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলায় প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ পেয়ে থাকি। আর অনানুষ্ঠানিক খাতে আরো কয়েক বিলিয়ন ডলার আসে। কাজেই এটা অর্থনীতির জন্য একটা বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। আর তিন নম্বর যেটা সেটা হল যে আমাদের দেশে বিশ্বায়নের সুফল হিসাবে আমরা পেয়েছি পোশাক শিল্পের প্রসার। এই পোশাক শিল্পে কিন্তু বাংলাদেশের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মেয়েরা এরা কিন্তু পোশাক শিল্পে একটা বড় বিপ্লব নিয়ে এসেছে। এরফলে দু’টো জিনিস ঘটেছে একটা হল যে বিশ্বায়নের ফলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ অনেক বেড়ে গেছে। আর বাংলাদেশে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজটা মুলত করেছেন গরীব মানুষেরা। সেই জন্যে পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় আমাদের অর্থনৈতিক অর্জন যাই হোক না কেন এতে কিন্তু উপকৃত হয়েছে গরীব মানুষেরা অপেক্ষাকৃত বেশি। এই জন্য আমাদের এই খানে যেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এর ফলে দারিদ্র হ্রাস সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আমরা এখন যেই পর্যায়ে চলে এসেছি তারপরে যদি আমাদের সামনে যেতে হয় তাহলে আমাদের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। আমি অন্যভাবে বলব, এইসব সত্ত্বেও আমি মনে করি দু’টি কারনে আমাদের দেশে সুশাসনের উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর জোর দিতে হবে। একটি কারন হল অতীতে যা ঘটেছে ভবিষ্যতে তা ঘটানো সম্ভব নাও হতে পারে। অর্থাৎ আমরা এখন মাথাপিছু আয়ের যেই পর্যায়ে এসেছি তার পরে সামনে যেতে হলে আমাদের যেই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এটাকে শক্তিশালী করতে হবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা যদি না করি তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। আর দুই নম্বর যে কারনে আমাদের সুশাসনের উপর জোর দিতে হবে, সুশাসন না থাকলে ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি গরীব মানুষের, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। সুতরাং যদি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে পরে গিয়ে ভবিষ্যতে দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি যদি হয় সেটার সুফল কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌছানো যাবে না। সুতরাং তখন এই ধরনের প্রবৃদ্ধি আমাদের জন্য অর্থবহ হবে না। আর আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে সুশাসন কিন্তু রাতারাতি প্রতিষ্ঠা করা যায়না। আমার ধারনা সুশাসনের ক্ষেত্রে অর্থবহ কোন অগ্রগতি অর্জনের জন্য কম পক্ষে দশ থেকে পনের বছর নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যেতে হবে। সুতরাং এটা যদি এখন আমরা শুরু না করি তাহলে আগামি দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রিয়াজ উদ্দীনঃ যেকোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা, ঝুঁকি এবং ব্যয় কমানোই সাধারন ভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য থাকে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর ঘন ঘন পরিবর্তন হলে অনিশ্চয়তা বাড়ে। আমাদের সরকারগুলো এই সব বিষয় তেমন বিবেচনায় আনেননা বলে অভিযোগ রয়েছে। সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশে নীতির বিষয়ে অস্থিতিশীলতাকে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিতে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? এছাড়া, বাজেট আসলেই আমরা দেখি সবাই কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন জানার জন্য কোথায় কোন কর বা শুল্কহার পরিবর্তিত হবে, কার তাতে কী সুবিধা হবে ইত্যাদি। যেন ঘন ঘন পরিবর্তনটাই এখানে এখানকার রীতি। সে সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
আকবর আলি খানঃ আমাদের অর্থনীতির একটা বড় সমস্যা হল যে এখানে অনিশ্চয়তার মাত্রা অনেক বেশি এবং অনিশ্চয়তার মাত্রা বেশি হবার কারন দু’টি। একটি হল রাজনৈতিক অস্থিরতা। ক’দিন পরপর যখনি দেখা যায় সে সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে তখনি পরবর্তি সরকার পুরাতন সরকারের যেই দায়দায়িত্ব এবং নীতিমালা সেগুলো গ্রহণ করতে চাননা এবং সেগুলো পরিবর্তন করতে চান। যখন বিনিয়োগকারিরাও জানেন যে এই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে সেখানে তারা কোন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করতে চাননা। আমাদের দেশে যেহেতু এখন পর্যন্ত সর্বদলিয় মতৈক্য অনেক বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেটাকে বলে বাই-পার্টিসান পলিসি (bipartisan policy)। সেই ধরনের ব্যবস্থা না থাকলে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হয়। এটা হল একটা সমস্যা। আরেকটা সমস্যা হল সরকার নিজেও কখনো একটা সুসামঞ্জস্য পূর্ণ নীতি অনুসরন করেননা। যদি রাজনৈতিক পরিবর্তন নাও হয়, একই সরকার একই বিষয়ে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে থাকেন। যখন যেরকম সুবিধা হয়, সেভাবে দেখতে থাকেন। এখন সরকার সল্পমেয়াদের লাভের কথা চিন্তা করতে পারেন অথবা দীর্ঘমেয়াদের লাভের কথা চিনতা করতে পারেন। স্বল্পমেয়াদে বিবেচনা করলে যখন যেভাবে সুবিধা হয় সেরকম সিদ্ধান্ত নেবার চাপ পড়ে থাকে। কিন্তু যদি আপনি দীর্ঘমেয়াদের দিক থেকে দেখেন তাহলে এই সল্পমেয়াদি লাভের কথা চিন্তা না করে আপনি যদি একই নীতি দীর্ঘদিন ধরে অনুসরন করেন এবং সেই নীতি সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন করেন তাহলে কিন্তু অর্থনীতির উপর আস্থা অনেক বেড়ে যাবে।

সুতরাং আমাদের দেশে একটি বড় সংকট হল আস্থার সংকট সেই আস্থা না থাকার ফলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। আর বাজেট সম্পর্কে আপনি যেটা বলেছেন এটা ঠিকই যে সরকারের যে নীতির অস্থিরতা এটা কিন্তু বাজেট প্রণয়নে অনেক সময়ে প্রতিফলিত হয়। বর্তমান সময়ে রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য দেখা যায়যে অনেকগুলি সল্পমেয়াদি ব্যবস্থা নেন যেটা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য পুর্ণ না। এই রকম ব্যবস্থা যদি নেওয়া হয় তখন কিন্তু যারা বিনিয়োগকারি তারা বুঝতে পারেননা যে সরকার শেষ পর্যন্ত কী করবেন। যেমন যদি কাস্টমস ডিউটি বা বৈদেশিক শুল্কের বিষয়টি ধরেন, সেখানে যদি সরকারের বিঘোষিত নীতি হয় যে তারা শুল্কের হার কমিয়ে আনবেন এবং প্রতিরক্ষণ হ্রাস করবেন তাহলে এটা কিন্তু অনেকটা সময় একই ভাবে চালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায় একবছরের বাজেটে সরকার হঠাৎ করে শুল্ক কমিয়ে দিলেন পরের বছরে রাজস্ব আয়ের জন্য আবার হঠাৎ করে শুল্ক বাড়িয়ে দিলেন – তো এই ধরনের যেই পরিবর্তন সেটা মোটেও অভিপ্রেত নয়। আর বাজেট ব্যবস্থাগুলির আরেকটি বড় সমস্যা আছে সেটা হল যে আমাদের এখানে যারা বিনিয়োগকারি আছেন তাদেরও ব্যবসা বান্ধব যে বাজেট সেটা সম্পর্কে যে ধারনা সেটা তাদের স্বার্থে দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হতে পারে কিন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক নয়। অনেক ব্যবসায়িরাই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা চেয়ে থাকেন বাজেটে, কিন্তু এর যে ফলাফল কী সেটা সম্বন্ধে তারা যথেষ্ট ওকিবহাল নন। যেমন ধরুন আপনি যদি ট্যাক্স হলিডে বাড়িয়ে দেন তাহলে যারা নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা করবে তারা উৎসাহিত হবে, কিন্তু যারা পুরানো শিল্পতে আছেন কর অবকাশ দিয়ে যেই গড় ক্ষতি হবে সেটা কিন্তু তাদের থেকে কর আদায় করে পোষানো হবে। সেই ক্ষেত্রে দেখা যাবে যারা ট্যাক্স হলিডে পায়নি তাদের বাস্তবিকপক্ষে কর বেশি দিতে হবে। এখন বিনিয়োগ বান্ধব কর ব্যবস্থা হল সেই ব্যবস্থা যেটা সামগ্রিক ভাবে করের হার হ্রাস করে। কিন্তু আমাদের ব্যবসায়িরা প্রত্যেকে তাদের নিজেদের স্বার্থগোষ্ঠীর জন্য যেই ব্যবস্থা সেটা তারা চান। সামগ্রিক ভাবে কর হ্রাস নিয়ে চিন্তিত নন। যেমন অনেক সময় ব্যবসায়িরা দাবি করেন যে সুদের হার কমানো হোক। এখন দেশে যদি মূল্যস্ফিতির হার বেশি থাকে তাহলে প্রকৃত সুদের হার বাড়াতে হবে এবং সেটা বাড়ালে সুদের হার বেশি হবে। এই ক্ষেত্রে যদি ব্যাংকগুলিকে কম সুদে ঋণ দিতে বাধ্য করা হয় এবং তাদের ক্ষতি হয় তাহলে তারা ঋণের প্রবাহ কমিয়ে দিবে। এর ফলে যেটা হবে যারা ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা থেকে ইতিমধ্যেই ঋণ নিয়েছে তারা কম সুদ দিতে পেরে লাভবান হবে, কিন্তু যারা নতুন ঋণ নিতে চান তারা কিন্তু ঋণের সুযোগ পাবে না, কারন ব্যাঙ্কগুলো আর্থিক লোকসান দিয়ে ঋণ দিতে চাইবে না। এই অবস্থাতে আমাদের ব্যবসা বানিজ্যকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর ওপর জোর না দিয়ে, জোর দিতে হবে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরে এবং ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাহলে অর্থনীতির ওপর একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখবে। কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় বাজেটে যে সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেগুলি বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর স্বার্থে নেয়া হয়, সামগ্রিক বিবেচনায় নেওয়া হয়না।

রিয়াজ উদ্দীনঃ যেকোন সমাজে পেশাজীবীরা কতটা দায়িত্ব এবং নৈতিকতার সাথে তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করতে পারছে সেটার ওপর সংশ্লিষ্ট পেশার সাথে জড়িত প্রাতিষ্ঠানগুলোর অখন্ডতা অনেকাংশে নির্ভর করে। আবার এর বিপরীতটাও সত্যি। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক অখন্ডতার ওপর নির্ভর করে পেশাগত দায়িত্ব পালনে পেশাদারিত্ব বজায় রাখা কতটা সহজ হবে। কাজেই বিদ্যমান ব্যবস্থায় দুর্বলতা যদি থেকে থাকে সেটা থেকে উত্তরণ কোথা থেকে শুরু হবে সেই একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।
আকবর আলি খানঃ পেশাজীবীদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। পেশাজীবীদের সবচেয়ে বড় গুন যেটি প্রয়োজন সেটা হল তাদের পেশাগত দক্ষতা এবং পেশাগত দক্ষতা যদি তাদের থাকে এবং তারা যদি যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন তাহলে তারা সমাজে ভূমিকা রাখতে পারেন। সেজন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেটা করা হয়েছে সেটা হল, পেশাজীবীদের পেশাগত দক্ষতা নিয়ন্ত্রনের দায়িত্ব তাদের সংগঠনের উপর দেয়া হয়ে থাকে। যেমন ডাক্তারদের সংগঠন ডাক্তারদের পেশাগত দক্ষতা নিয়ন্ত্রন করে। চাটার্ড একাউন্টেণ্ট দের সংগঠন তাদের পেশাগত দক্ষতা নিয়ন্ত্রন করে, ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষতা ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স নিয়ন্ত্রন করে। আমাদের দেশে আমরা কিন্তু মোটামুটি ভাবে সেই মডেলই অনুসরন করছি এবং আমাদের অনেকগুলি পেশাজীবী সংগঠন সরকার কর্তৃক স্বিকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কোন কোন পেশাগত সংগঠন তাদের দায়িত্ব ভালভাবে পালন করতে পারছেননা। যেমন একটি পেশাগত সংগঠন যার সম্বন্ধে প্রায়ই বিভিন্ন অভিযোগ শোনা যায়। যেমন বাংলাদেশে যারা আইনজীবী আছেন তারা অনেকেই সঠিক ভাবে কাজ করেননা। কিন্তু সঠিক ভাবে কাজ না করলে পেশাগত দিক থেকে ব্যবস্থাও গৃহীত হয়না, কারন তাদের সংগঠন তাদের দ্বারা নির্বাচিত। কাজেই তাদের নির্বাচিত সংগঠন তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেনা। এই নিয়ে আমি আনেক প্রাক্তন বিচারপতির সাথে আলোচনা করেছি, তারা মনে করেন এই দায়িত্ব বিচারপতিদের হাতে ন্যস্ত করা উচিত। যেমন পাকিস্তান আমলে লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স এক্টে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রনের দায়িত্ব বিচারকদের দেয়া হয়েছিল। তারপর আইয়ুব খানের আমলে বার কাউন্সিল এক্ট করে লিগাল প্র্যাকটিশনার্সদের ওপর বিচারকদের ক্ষমতা খর্ব করে দেয়া হয়েছে। আমি অনেক প্রাক্তন বিচারককেই দুঃখ প্রকাশ করতে দেখেছি যে এই ব্যবস্থাটি দেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য ভাল হয়নি।

সারা পৃথিবীতে এখন যেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে সেটি হল চার্টার্ড একাউন্টেণ্ট যারা, যারা একাউন্টিং এবং অডিট প্রফেশনে আছেন সেই অডিট প্রফেশনকে কিভাবে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রন করা যেতে পারে। এই ব্যপারে তাদের প্রতিষ্ঠানের ওপরই দায়িত্ব দেয়া ছিল। পরবর্তিকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যেসব বড় বড় কেলেঙ্কারি হয় সেসব কেলেংকারির ফলে সারবেনস অক্সলি এক্টের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় সরকারি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয় নিরীক্ষার পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রন করার জন্য। কিন্তু গত দশকের অভিজ্ঞতা থেকে যেটা দেখা যাচ্ছে, এতে কিন্তু হিসাব রক্ষণ ব্যবস্থার খুব বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। বর্তমানে বিশ্বে চারটি বড় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, এবং গত দশ বছরে যেসমস্ত কেলেংকারি আর্থিক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাতে দেখা যায় যে প্রায় প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানই কোন না কোন কেলেংকারির সাথে জড়িত রয়েছে। অন্যদিকে যেটা হয়েছে সেটা হল যে সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ফলে নিরীক্ষার ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে গেছে। এরফলে ব্যবসার জগতে অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা কিন্তু সারা বিশ্বে এর কোন সঠিক সমাধান পাইনি। বাংলাদেশে এখন বিতর্ক চলছে যে বাংলাদেশে এই হিসাব নিরীক্ষকদেরকে কি সরকার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের হাতে দেয়া হবে? না সেটা ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টেন্টের কাছে থাকবে? এই ব্যপারে অর্থমন্ত্রনালয় থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে তারা একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান করবে। তবে বাংলাদেশের ব্যপারে আমার যেটা মনে হয় আমাদের যেই ইন্সটিটিট অব চার্টার্ড একাউন্টেন্ট সেটা অত্যন্ত দুর্বল এবং বাংলাদেশের যে হিসাব রক্ষণ করার জন্য যেসমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের অনেক দুর্বলতা রয়েছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে নিয়ন্ত্রন যার হাতেই থাকে প্রতিটি পেশাতেই পেশাগত দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে এবং এই গুলো একদিনে করা সম্ভব হবে না। এগুলো পেশাজীবীদের নিজেদের, সংসদ এবং সরকার – এই তিন দিক থেকে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। বিষয়গুলি প্রতিনিয়ত পর্যালোচনা করা দরকার।

রিয়াজ উদ্দীনঃ আপনি আর্থিক নিরীক্ষার প্রসংগ আনলেন বলে একটা বইয়ের কথা মনে পড়ছে “The best Way to Rob a Bank is to Own one” যেখানে আমেরিকার সাম্প্রতিক মন্দার পেছনে অর্থখাতে স্বার্থের সংঘাত (Conflict of Interest)ব্যপারটি কিভাবে ভূমিকা রেখেছে সেটা দেখানো হয়েছে। “বাচা-মরার অর্থনীতি” নিবন্ধে আপনি চিকিৎসা পেশায় স্বার্থের সংঘাত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পেশাভেদে এই ধরনের স্বার্থের সংঘাত নানাধরনের রূপ নিতে পারে। এর সমাধান কী?

আকবর আলি খানঃ স্বার্থের সংঘাত প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হল যে কোন সাধারন সমাধান দেয়া সম্ভব নয়, কোন সিলভার বুলেট নাই। মনে রাখা দরকার সেটা হল–Eternal vigilance is the price of freedom – এগুলো সব সময়, প্রতিনিয়ত পরিবীক্ষণ এবং পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সমাজেরও করতে হবে, পেশাজীবীদের নিজেদেরও করতে হবে। আত্মজিজ্ঞাসা থাকতে হবে। এগুলো যদি আমরা ছেড়ে দেই তাহলে দেখা যাবে যেকোন যায়গায় ব্যর্থতা সারা অর্থনীতির উপরে তার প্রভাব পড়বে, গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করবে। কারন যতবেশি কারিগরী পরিবর্তন হচ্ছে ততই পেশাজীবীদের ভূমিকা আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে।

রিয়াজ উদ্দীনঃ স্বার্থের সংঘাতের প্রসঙ্গে নানা ভূমিকায় যারা থাকে তাদের মধ্যে যাদের শক্তি বেশি থাকে তারাই বেশি লাভবান হয়। আর যারা বাঁধা দেবে তারাতো সব সময় দুর্বল হয়। তাহলে কাঠামোগত ভাবেই যারা দুর্বল হবে তাদের স্বার্থ কিভাবে সংরক্ষিত হবে? এই সমস্যা থেকে বের হবার উপায় কী?
আকবর আলি খানঃ সেই জন্যেই তো সরকারের ভূমিকা। যেমন ধরুন স্টক মার্কেটের ভেতরে যেসব কাঠামো এবং আইন কানুন তৈরি করা হয়েছে সেগুলোর উদ্দেশ্যই হলো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিদের স্বার্থ নিশ্চিত করা। সেজন্য সরকারের ভূমিকা রয়েছে, আবার প্রতিষ্ঠানগুলিরও ভূমিকা রয়েছে আবার বিনিয়োগকারিদেরও ভূমিকা রয়েছে। আর এগুলো প্রতিনিয়ত পরিবীক্ষণ পর্যবেক্ষকণ করতে হবে। অসুবিধা যেটা হল যে পৃথিবীতো থেমে নেই। কাজেই আজকে আমরা যেই কাঠামো তৈরি করলাম এটা যে আগামী বিশ বছরের চাহিদা মিটাতে পারবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আমাদের কিন্তু প্রতিনিয়ত দেখতে হবে যে কাঠামোটা ঠিক মত কাজ করছে কিনা।

রিয়াজ উদ্দীনঃ বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়। অর্থনীতির গবেষণায় একটা মত রয়েছে দুর্নীতি যে কোন কোন ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা এবং জটিলতার নিরসন করে ইতিবাচক হতে পারে। তবে মতের বিপক্ষে অনেক মতামত এবং গবেষণার ফলও রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মাসেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে এই ধরনের যুক্তি ব্যবহার হয়েছে [৫] । আবার অর্থখাতে দুর্নীতিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই হয়েছে, যেটা কিছুক্ষন আগে কথায় উঠে এসেছে। এখন হলমার্কসহ বড় আকারের জালিয়াতি প্রসঙ্গে এই ধরনের যুক্তিগুলো ব্যবহার হচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে এটাকে নৈতিক সংকট বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে রয়েছে অর্থনৈতিক বিবেচনা। এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

আকবর আলি খানঃ এখানে আমি মনে করি আমরা অর্থনীতিবিদেরা একটা খুব খারাপ কাজ করেছি। সুশাসনের বিষয়টিকে আমরা একটি অর্থনৈতিক প্রশ্ন হিসাবেচিহ্নিত করেছি। বলা হচ্ছে যে অর্থনীতির জন্য সুশাসন প্রয়োজন। আসলে এটাতো অত্যন্ত গৌন বিষয়। সুশাসন প্রয়োজন মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য। সুশাসন প্রয়োজন আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য। কাজেই এই যে প্রয়োজনটা এটাকে ভুলে গিয়ে আমরা অর্থনীতির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি। অর্থনীতি প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হচ্ছে আপনি পক্ষে বিপক্ষে দু’দিকেই যুক্তি পাবেন। দু’দিকেই সাক্ষ্য পাবেন যেখানে দেখা যাবে যে দুর্নীতির ফলে সমস্যা হয়েছে আবার এমন ক্ষেত্রও আপনি পাবেন যে দুর্নীতির ক্ষেত্রে সমস্যা হয়নি। কিন্তু দুর্নীতির তিনটি বিষয় সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। একটি বিষয় হলো যে দুর্নীতির যেই কুফল এটা পড়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। কারন যারা বড় লোক তারা ঘুষ দেয় এবং ঘুষ খায়। সুতরাং তাদের কিন্তু কোন ক্ষতি হয়না। যারা গরীব মানুষ তারা কিন্তু ঘুষ দেয়, ঘুষ পায়না। কাজেই সমাজে যদি দুর্নীতি চলে তাহলে গরীব মানুষের উপরে সমস্যাটা দাঁড়ায়।

দুই নম্বর যেই বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি সমাজের মধ্যে প্রণোদনা কে ভেঙ্গে দেয়। কারন একটা সমাজ যদি চালাতে হয় তাহলে যারা ভাল কাজ করে তাদের পুরষ্কার দিতে হবে। আর যারা খারাপ কাজ করে তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে। এটা হল প্রশাসনের মৌলনীতি। হজরত আলী মিশরে যখন গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন, তখন তাকে তিনি একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠিতে উনি বলেছিলেন ইসলামী শাসনের মূল বিষয় কী? সেখানে তিনি এই কথাটাই বলেছেন, যারা খারাপ কাজ করে তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে আর যারা ভাল কাজ করে তাদেরকে পুরষ্কার দিতে হবে, নাহলে শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। আর ভগবতগীতায় গেলে পাবেন স্পষ্টভাষায় “দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন” এই কথা এই শব্দগুলো ব্যবহার করেই সেখানে বলা হয়েছে। এটা হল রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক দায়িত্ব। কাজেই যেখানেই দুর্নীতি হয় সেখানে কিন্তু দুষ্টু লোকেরা পুরষ্কার পায়। আর যারা ভাল লোক তারা সমস্যায় পড়ে। কাজেই এই অবস্থায় গোটা সমাজ ব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এরফলে সমাজে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়। আস্থাহীনতার সৃষ্টি হলে সেখানে বিভিন্ন ধরনের বিশৃংখলা দেখা দেয়। কাজেই কোন বছরে প্রবৃদ্ধি কী হল না হল সেটা বড় কথা নয়। সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির ওপর কিন্তু এটা অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করে, সামাজিক উশৃংখলার সৃষ্টি করে। আর তিন নম্বর বিষয় যেটি আমাদের মনে রাখতে হবে সেটি হল যে সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় আইন প্রয়োগ করার জন্য। কাজেই যদি আইন প্রয়োগ না করা হয় এবং যারা দুর্নিতি করে তাদের শাস্তি না দেয়া হয় তাহলে কিন্তু দেশের আইন শৃংখলা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। এই প্রেক্ষিতে বিষয়টিকে শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্ভবত আমাদের দেখা ঠিক হবে না। আমরা অর্থনিতিবিদেরা যেহেতু কেবল অর্থনীতি নিয়ে কথা বলি আমরা কিন্তু সুশাসন বিষয়টির যে একটা মৌলিক গুরুত্ব আছে সেটাকে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে এটাকে দুর্বল করার চেষ্টা করছি। এটা কিন্তু সঠিক নয়।

রিয়াজ উদ্দীনঃ এবারের প্রশ্নটি “উদ্ভাবন” প্রসঙ্গে। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিবিদ অলিভার উইলিয়ামসন বলে থাকেন পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে উদ্ভাবন হরহামেশাই হয়ে থাকে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ হলেও তুলনামূলকভাবে বিরল। বাংলাদেশেই ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবনের ঘটনা ঘটে গেছে। সেই ধারাতেই সামাজিক ব্যবসাকেও অনেকে সম্ভাবনাময় বলে ভাবছেন। সামাজিক ব্যবসাতে মুনাফা ছাড়াই সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে প্রণোদনা তৈরি হবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। ক্ষুদৃঋণের ক্ষেত্রে কাছাকাছি একটা ব্যবস্থা কাজ করেছে। এই ব্যপারটিকে সাধারনিকরন (generalization) সম্ভব হবে মনে করেন? কেননা দাবিটি সত্যি হলে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবন হিসাবে সামাজিক ব্যবসাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াবে এবং অর্থনীতির অনেক মৌলিক ধারনাই তে প্রশ্নের মুখে পড়বে। আপনি এই সম্ভাবনা সম্পর্কে কতটা আশাবাদি? যেকোন নতুন ধরনের প্রতিষ্ঠান বা কার্যবিধি যখন কেউ সামনে নিয়ে আসবে তখন বিদ্যমান আমলাতন্ত্রের বাঁধা ঠেলেই সেই ব্যবস্থাকে এগিয়ে যেতে হয়। গ্রামীন ব্যাঙ্কের ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক পরিমন্ডলকে আরো বেশি করে উদ্ভাবন বান্ধব করে তোলার কোন প্রয়োজন বা সাধারন উপায় কী ভাবা সম্ভব?

আকবর আলি খানঃ ডঃ ইউনুস অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেকগুলি নতুন বক্তব্য নিয়ে এসেছেন। মূলত তিনি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে যেই বক্তব্য তুলে ধরেছেন সেটি হল যে গরীব মানুষকে জামানত ছাড়া, বন্দক ছাড়া ঋণ দেয়া যায় এবং সেটাকা আদায় করা সম্ভব। এই ধারনা কিন্তু সত্তরের দশকে কেউ বিশ্বাস করতনা। এখন ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার সাফল্য নিয়ে আপনি যতই তর্ক বিতর্ক করুননা কেন, এই ধারনা কিন্তু এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন কিন্তু কোন বন্দক ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদেরকে ঋণ দেয়া হচ্ছে এবং বাংলাদেশে যেটা দেখা গেছে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা নিরানব্বই ভাগ পর্যন্ত টাকা ফেরত দেয়। আর বাংলাদেশের বড় ঋণ যারা নেয় তারা খুব অল্পসংখ্যক লোকই টাকা ফেরত দেয়। তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাই বলেন আর সামাজিক ব্যবসার কথাই বলেন, এগুলোর বিশেষ একটি অর্থনৈতিক পরিবেশের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। যেমন ধরেন যেই পরিবেশে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি শুরু হয়েছিল আজকে কিন্তু আমরা আরো অনেক দূর এগিয়ে গেছি, এবং তারপরেও হয়ত এখানে আরো অনেক অগ্রগতি সম্ভব।

এখন সামাজিক ব্যবসার বিষয়ে যদি আসেন তাহলে প্রথম প্রশ্ন হল যে সামাজিক ব্যবসার পুঁজি কোথা থেকে আসবে? সামাজিক ব্যবসার কথা ডঃ ইউনুস সত্তরের দশকে বলেননি কেন? এখন কেন বলছেন? এর কারন হল যে সত্তরের দশকে সামাজিক ব্যবসার পুঁজি পাওয়া সম্ভব ছিলনা। আজকে কিন্তু সামাজিক ব্যবসার পুঁজি পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। তার কারন হল গত দশকে পৃথিবীতে নন-প্রফিট অর্গানাইজেশানের সংখ্যা কিন্তু অনেক বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসা বানিজ্যে ফিলানথ্রফিক কন্ট্রিবিউশান অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আগে বড়লোক হতে অনেক সময় লাগত। এখন যেমন বিল গেটসের মত লোক পৃথিবীর সবচাইতে ধনী লোক হয়ে যাচ্ছে। এই যে এই ধরনের লোক গুলো এরা সত্যি সত্যি কিছু করতে চান দারিদ্র নিরসনের জন্য। সুতরাং প্রথম বিষয়টি হল যে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবন মূলক বিষয়গুলোতে বিনিয়োগের অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেই বিনিয়োগের অর্থ পাওয়ার জন্য ডঃ ইউনুস কিন্তু দান খয়রাতের কথা বলছেন না। তিনি ব্যবসার কথা বলছেন। কারন চ্যারিটি যেটা দান খয়রাত যেটা সেটা কিন্তু টাকা খরচ হয়ে গেলেই শেষ হয়ে যায়। আর ব্যবসায় গেলে পরে তাকে তার আয়ের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হবে। সুতরাং ডঃ ইউনুসের এই অনুমান সঠিক যে যদি ব্যবসার প্রস্তাব নিয়ে এই সমস্ত নন-প্রফিট অর্গানাইজেশানের কাছে যাওয়া হয় তাহলে অনেক অর্থায়ন পাওয়া সম্ভব। মুল সমস্যা হল এই প্রকল্প গুলি তৈরি করবে কে? এই প্রকল্প গুলি তৈরি করার ক্ষমতা কিন্তু গরীব মানুষের নাই। এটাও একটা সমস্যা। দুই নম্বর সমস্যা হল প্রকল্প গুলি চালু হলেই রাতারাতি সফল হয়ে যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আর তিন নম্বর সমস্যা হল উদ্ভাবন মূলক কর্মসূচি গ্রহণ করলে এর মধ্যে অনেক গুলি ব্যর্থও হয়ে যেতে পারে। সবগুলি যে সফল হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এই ক্ষেত্রে ডঃ ইউনুস যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন সেটা হল যে তিনি গ্রামীন ট্রাস্টের মত প্রতিষ্ঠান করেছেন। অনেক গুলি প্রতিষ্ঠান যদি একসাথে পরিচালনা করা হয়, এক যায়গায় লোকসান হলে পরে আরেক যায়গায় লাভ হতে পারে।

আর আরেকটা কাজ ডঃ ইউনুস সামাজিক ব্যবসার ব্যাপারে যেটা করেছেন তিনি শুধু বিদেশি অর্থ না, বিদেশি যে কারিগরি জ্ঞান সেটাও আনার ব্যবস্থা করেছেন। যেমন তিনি ড্যানোনের সাথে সহযোগিতায় শক্তি দই কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে ড্যানোন কিন্তু শুধু পুঁজি দিচ্ছে না। ড্যানোন সেখানে কারিগরি সহায়তাও প্রদান করছে। যেমন ভেওলিয়ার ওয়াটার সাপ্লাই যেটা তিনি যেমন করছেন সেখানেও কেবল পুঁজি নয় সেখানে যেই কারিগরি জ্ঞান সেটা কিন্তু ভেওলিয়ার কাছ থেকে আসছে। যেমন রেপেলেন্ট ট্রিটেড মস্কিউটো কার্টেন যেটা বিএএসএফ এর সাথে তিনি করছেন সেখানেও কিন্তু কারিগরি জ্ঞান এদের কাছ থেকে আসছে। কাজেই বিদেশ থেকে পুঁজি এবং কারিগরি জ্ঞান দু’টিও সামাজিক ব্যবসার কারনে আনা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে, মানে ঐ তিনটি সমস্যার কথা যেটা বললাম – একটা হল সঠিক প্রকল্প নির্বাচন কিভাবে করা হবে? দু’নম্বর হল প্রথম দিকে যদি লোকসান হয় সেই লোকসান কে মিটাবে? এখানে সম্ভবত যারা বাইরে থেকে বিনিয়োগ করতে আসবে তাদেরই সেটা বহন করতে হবে এবং তৃতীয়ত, যেগুলো একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাবে সেক্ষেত্রে কী হবে সেটা সম্বন্ধেও চিন্তাভাবনা করতে হবে। তবে এটার যেটা সমস্যা এই ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে দেশের সরকারের সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ সরকার এই সামাজিক ব্যবসার সম্বন্ধে অত্যন্ত অসহানুভূতিশীল। এই প্রতিকূল পরিবেশে এই উদ্যোগ এখানে কতদূর সফল হবে আমি জানিনা। এখন তিন চারটা ব্যবসা শুরু হয়েছে, আমরা দেখছি এখন এগুলো কিভাবে অগ্রগতি অর্জন করে। তবে ধারনা হিসাবে এটা কাজ করতে পারে, যতক্ষন পর্যন্ত আপনি বাইরে থেকে পুঁজি পাবেন এবং কারিগরি সহযোগিতা পাবেন।

রিয়াজ উদ্দীনঃ তার মানে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, উদ্ভাবন এবং বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে?
আকবর আলি খানঃ সরকারের ভূমিকা কেবল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নয়, আপনার বিনিয়োগ করতে হলে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়, ভূমির প্রয়োজন হয়, পানির প্রয়োজন হয় এরকম বহু অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকার যদি বলে এটা আমরা চাইনা তাহলে অসুবিধা হবে। আর উদ্ভাবন এবং বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সরকারের, বেসরকারি খাতের এবং বৈদেশিক খাতের ভূমিকা আছে। সেজন্য দেশেও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে এবং যারা বিনিয়োগ করবে তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। এখন বিশ্বায়নের যুগে যেটা করতে হবে সেটা হল যে এই যে বিভিন্ন ধরনের সূত্র থেক যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়া সম্ভব সেগুলো সমন্বিত করে কিভাবে দেশের মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন। আমরা সবচেয়ে বড় এবং আমরাই সবকিছু করতে পারি এই রকম হামবড়া মনোভাব নিয়ে বসে থাকলে বিশ্বায়নের যুগে আপনাকে পিছিয়ে যেতে হবে।

রিয়াজ উদ্দীনঃ যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে একটা কথা বলা হয় যে, যেকোন নাগরিক কোন একটা সমস্যায় পড়লে সমাধানের জন্য কার বা কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হবেসেটা বুঝতে নাগরিকের অসুবিধা হয়না। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক কার্যপরিধির সীমানা নিয়ে সংশয় থাকে। এই অবস্থা থেকে উত্তরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নয়নের কাজটি কে, কখন, কিভাবে করতে পারে?
আকবর আলি খানঃ দুটি বিষয় আছে, বাংলাদেশের সরকার অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত সরকার। কেন্দ্রীভূত হবার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য অফিসগুলোর কোন ক্ষমতা থাকে না, অথবা এরা সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পায় না। আর দুই নম্বর হল এখানে দুর্নীতি এত ব্যপক যে কোন ক্রমে যদি আপনার কাছ থেকে সুবিধা পাওয়া যায় তাহলে সেটা গ্রহণ করার চেষ্টা করবে। কাজেই এই অবস্থাতে প্রতিষ্ঠানগুলির কাজ করা অত্যন্ত শক্ত হবে এবং আমি মনে করিনা যে সরকারি খাত থেকে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এটার দুই ধরনের সমাধান হতে পারে। একটি হল বিনিয়োগ কারি দের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। যেমন বংলাদেশে চেম্বার অব কমার্সগুলি কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু কিছু কাজ করতে পেরেছে তাদের সার্থের মধ্যে। আরেকটি হল যে ধরনের উদ্ভাবনশীল বিনিয়োগকারিদের কথা বলছেন তাদের হয়ত এই মুহূর্তে চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হতে পারে। সেসবক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন এনজিও কাজ করতে পারে। করে উদ্যোক্তা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করে এগুলো সমাধান করার চেষ্টা করতে পারে। কারন সরকারি প্রতিষ্ঠানে গেলেই দীর্ঘসূত্রিতা হয়। আর এখন পর্যন্ত আমরা যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছি যেমন মানবাধিকার কমিশন এবং আমাদের তথ্য অধিকার কমিশন এগুলো কিন্তু খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে নি। এরাও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতই কাজ করছে। যেহেতু সরকারের মধ্যে অদক্ষতা দুর্নীতি এবং কেন্দ্রিভুত ব্যবস্থা রয়েছে সেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই কাজ হয়ত সঠিক ভাবে করা সম্ভব হবে না।

রিয়াজ উদ্দীনঃ অনেক ক্ষেত্রে বলা হয় প্রতিষ্ঠান নিজে থেকেই (endogenously) অনেক ক্ষেত্রে পূনর্বিন্যস্ত হয়। যেমন বলা হয় বিশ্বায়নের ফলে আভ্যন্তরীন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে, যেমনটা আপনি চেম্বার অব কমার্সের উদাহরন টেনে আপনি বললেন। আবার কখনো বাইরের শক্তির মাধ্যমেও (exogenously) সেটা হয়। আমাদের দেশে বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা কী বলে? সামনে আগানোর উপায় কী হবে?

আকবর আলি খানঃ আমার মনে হয় এই ব্যাপরে ডগমেটিক না হয়ে দুই ভাবেই এটা হতে পারে। এটাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনে ব্যবস্থা গৃহীত হবে এটা তৃণঅমূল পর্যায় থেকে হতে পারে আবার বাইরের চাপেও এটা পরিবর্তন হতে পারে। পরিবর্তন হওয়াটাই বড় কথা। কিভাবে হবে সেই ব্যপারে তাত্ত্বিক চুলচেরা বিশ্লেষণ করে খুব একটা লাভ হবে বলে আমি মনে করি না। এই ক্ষেত্রে দুই ধরনের উদাহরনই দেয়া সম্ভব।

মূল সাক্ষাতকার প্রথম প্রকাশঃ আলোকিত বাংলাদেশ, ২২ মে ২০১৩ (সূচনা সংখ্যা-৩)
আগে অন্যত্র প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও সাক্ষাতকারটির গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানেও জমা দিলাম।

পাদটীকা/সূত্রঃ
[১] এলিনর অস্ট্রমের নোবেল বক্তৃতাঃ http://www.nobelprize.org/mediaplayer/index.php?id=1223
[২] Matthews, R C O. (1986) “The Economics of Institutions and the Sources of Growth”, The Economic Journal, 96(384):903-918
[৩] লেনদেন ব্যয় (transaction cost) প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান – যেটা সাধারনত প্রথাবদ্ধ অর্থনীতিতে আলোচনা হয়না। এই বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিবিদ অলিভার উইলিয়ামসন এর গবেষনা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উইকির লিঙ্কঃ http://en.wikipedia.org/wiki/Transaction_cost
[৪] কেনেথ এরো আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিবিদ যিনি সোশাল চয়েস থিওরি বিষয়ক গবেষনার জন্য প্রসিদ্ধ। http://en.wikipedia.org/wiki/Kenneth_Arrow
[৫] এই প্রসঙ্গে ফারুক ওয়াসিফকে দেয়া বিনায়ক সেনের সাক্ষাতকারঃ http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-02-03/news/326168