একটি সময় ছিলো, ঢাকাই সিনেমাতে একজন “পাগল” না থাকলে সিনেমাটি ঠিক জমতো না। ছকবাধা ছবিতে দারুণ আঘাত পেয়ে নায়ক বা নায়িকা “পাগল” হয়ে অসংলগ্ন আচরণ করেন। আবার আরেক মানসিক আঘাতে তারা ঠিক সময় মতো নিজে নিজেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। পুরো ছবি জুড়ে নানা দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্য দিয়ে দর্শক মনে যে চাপ সৃষ্টি হয়, এই সুস্থতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা দর্শককে চাপমুক্ত করে। একটি হাসিখুশী সুখি পরিবারের মহামিলন [গ্রুপছবি] মাথায় নিয়ে তিনি হয়তো গুনগুন করতে করতে বাসায় ফেরেন।
আবার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী চরিত্রের দৃশ্যায়নে উপেক্ষিত ঊন-মানুষেরা ঢাকাই ছবিতে “কমেডি” বা “হিউম্যান কারেক্টার” হিসেবে ঘুরে ঘুরে আসেন। “হাবা হাসমত” তো প্রায় একটি আইকনিক বিষয়!
সমাজ বাস্তবতায় মানসিক ভারসাম্যহীন, চলতি কথায় “পাগলেরা” বরাবরই দারুণ উপেক্ষিত, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বিনোদনের খোরাক এবং অনেকটাই নিষ্ঠুরতার শিকার।
সস্তা বিনোদনটিকে উপজীব্য করতে শেষমেষ দেশের প্রথম অনলাইন দৈনিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম- ও এখন একই পথে হন্টান শুরু করলো। সংবাদ বিস্ততায় জনপ্রিয় নিউজ পোর্টালটিও অবশেষে “অফপিক/হট আইটেম” হিসেবে সিজোফ্রেনিয়ার দুই বোন রিতা-মিতাকে নিয়ে সংবাদ [মিডিয়ার ভাষায় “স্টোরি”] ফেঁদে বসেছে! বগুড়ার একটি হোটেল কক্ষ থেকে তাদের উদ্ধার করা নিয়েই তাদের সংবাদ।
নৈতিকতার বিচারে “হোটেল থেকে খরিদ্দারসহ পতিতা” সংক্রান্ত সংবাদ অবশ্য তারা কখনোই প্রকাশ করে না। এরমানে হলো, শুধুমাত্র “পাগল” হওয়ার সুবাদেই তারা দুই নারী কিচ্ছাটিকে সচিত্র “সংবাদ” করে তুলেছে[ দেখুন: সংবাদটির লিংক।]
দুববছর আগে দেশের বেশ কয়েকটি দৈনিক বিদ্যুত মিত্রের “কুয়াশা”র রিতা-মিতা কিচ্ছা প্রকাশ করতে থাকায় নানা মহলে দারুণভাবে নিন্দার মুখোমুখি হয়। সে সময় অবশ্য বিডিনিউজ খুবভালো ভাবেই সংবাদটিকে “বর্জ “ করেছিল।
বিস্ময়করভাবে এখন এতোদিন পর বিডিনিউজ আবার তাদের “ফোকাস পয়েন্টে” আনায় শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকগুলো তাদেরই প্রদর্শিত পথে আবার এই “অফপিক/হট আইটেম” নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে [দেখুন: নমুনা -০১ এবং নমুনা-০২ ]।
”বিডিনিউজ প্রদর্শিত পথে” কথাটির যৌক্তিকতা অবশ্যই আছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে টানা চার বছর এই অনলাইন দৈনিকতে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানাই, সংবাদ মাধ্যমটি মিডিয়া জগতে যথেষ্ট প্রভাবশালী, পাঠক মহলে তো বটেই। বিডিনিউজ-এর একটি সংবাদ প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সাড়া ফেলে। তারাও ওই সংবাদটি যেন কোনও ভাবে “মিস” না করে, সে জন্য তৎপর হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এর গোপন দূরাভিসন্ধিটি কী? রাজনৈতিক সংকটসহ অন্যান্য গুরুতর বিষয় থেকে “পাগলে” বিনোদন দান? অথবা পাঠক ভাবজগতকে অন্যত্র ফেরানো চেষ্টা?
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, শেষোক্তটি হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশী। কারণ বিডিনিউজ প্রধান তৌফিক ইমরোজ খালিদী অনেকদিন ধরেই সরকারি কর্তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রনেরর কথা বলে আসছেন [দেখুন: বাংলা ব্লগের ওপর খড়গহস্ত বিটিআরসি]। কাজেই “স্পট লাইট” বিভাগে বক্স আইটেম হিসেবে বক্ষসুন্দরী লাস্যময়ী মডেল কন্যা-সংবাদের পাশাপাশি অফপিক/হট আইটেম রিতামিতা কিচ্ছার নেপথ্যে কোনও সুপ্তফনা থাকলে তা মোটেই অবাক হওয়ার বিষয় নয়।
এর নেপথ্য কারণ যা-ই হোক না কেনো, ঘটনাটিকে সংবাদ উপজীব্য করার বিষয়টি খুবই নিন্দনীয়, অমানবিক ও নারীর প্রতি চরম অপমান; এটি অপসাংবাদিকতা তো বটেই। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই।
সস্তায় পাবলিকরে মাঝে মধ্যে বিনোদন দেয় আর কি 😀
ভালো লিখেছেন। আমিও ঐ ধরনের সংবাদ প্রকাশের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। :-X
@তারিক,
আগামীতেও সঙ্গে থাকবেন বলে আশা করছি। অনেক ধন্যবাদ। (Y)
পাঠকেও তো এইসব সংবাদ ভালোই খায় 😕
@মহন,
বিপদটি সেখানেই। ঘুমের ভেতর অস্ত্রপচার। রাত সাবধান….
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
:-s (Y)
@Rashid Sarker,
অপসাংবাদিকতার আরেকটি নমুনা হিসেবে এই খবরটি দেখা যেতে পারে। যেখানে একজন টিভি সাংবাদিককে দুর্গতর কাঁধে চড়ে বন্যার খবর পরিবেশন করতে দেখা যায়। [লিংক]
নীচে নামতে নামতে আমরা সাংবাদিকরা কোন অতলে নেমে যাচ্ছি? সত্যিই বিষয়টি লজ্জার। :-Y
@বিপ্লব রহমান, ঘটনাটি আসলেই লজ্জার।
আপনি খুবই সুন্দরভাবে এই লেখায় অপসাংবাদিকতার বিভিন্ন নমুনা তুলে আনলেন । বৰ্তমান সময়ে এই ধরনের লেখা খুবই দরকার । আশাকরি, আপনার কাছ থেকে এই ধরনের লেখা আরো পাব । ভালো থাকবেন ।
@Rashid Sarker,
আপনাকে আবারো ধন্যবাদ। আগামীতেও সঙ্গে থাকার বিনীত অনুরোধ। চলুক। (Y)
বিডিনিউজের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আনা যায় কিন্তু এই সংবাদটিতে কি কারনে আপনি খেপেছেন বোঝা গেলো না। এই সংবাদটির অবশ্যই সংবাদমূল্য আছে।
প্রথমত: এই দুই বোনের সংবাদ প্রথম বারেই অনেকের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলো। এই ধরনের সংবাদ সচরাচর হয় না। এটা মানুষের বিকৃত মানসিকতা নয়, স্রেফ অন্যরকম ঘটনার প্রতি আগ্রহ থেকে।
দুই, এই দুই বোনের পরিনতি থেকে শিক্ষনীয় ব্যাপারও আছে। আমাদের সমাজে অনেক রকম মৌলবাদী, ধর্মীয়-কমুনিস্ট-রেসিস্ট, এদের মধ্য প্রকৃত সিজোফ্রেনিয়া জাতীয় মানসিক সমস্যা আছে। তাদের উল্টা-পাল্টা কথাকে না জানা পাব্লিক আধ্যাতিক উচ্চমার্গের কথা ভেবে আপ্লুত হয়ে যায়। এই দুই বোনের পরিনতি থেকে সিজোফ্রনিয়ার শুরু আর লক্ষন সম্পর্কে মানুষ কিছুটা হলেও সচেতন হয়েছে।
তিন, যতদূর জানতাম এই দুই বোন ঢাকায় একটি পুরো বাড়ীর মালিক। আমাদের সবারই অভিজ্ঞতা রয়েছে যে মানসিক সমস্যা গ্রস্থ, অথবা অপরিনত মানসিকতার মানুষেরা যদি বিপুল সম্পদের উত্তরাধিকারী হন তবে তাদের পেছনে সুযোগসন্ধানী লোকজন কেমন করে লেগে থাকে। এখন এই দুই বোনের কি অবস্থা চলছে এটার ফলোআপ জানা খুবই দরকারী। এটার সংবাদ মুল্য এবং নাগরিক দায়িত্ব দুই দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ন।
এই সংবাদটিকে যদি আপনি অপসাংবাদিকতা মনে করেন তবে বুঝতে হবে সংবাদিকের জব-ডেস্ক্রিপশন সম্পর্কে আপনার ধারনায় সমস্যা আছে।
@সফিক,
একদম ভুল বুঝেছেন, নয় তো কিছুই বোঝেননি। এটি নিছকই অপসাংবাদিকতার সমালোচনা। কোনও প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ নয়।
হয়তো আপনি লক্ষ্য করেননি, অপসাংবাদিকতা নিয়ে মুক্তমনায় আগেও লিখেছি। সেখানেও কেউ অভিযোগ তোলেননি, এইসব লেখা কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বা এমন কিছু। [লিংক]
এর পরেও স্পষ্ট জানাই, অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে বিডিনিউজ প্রথম পছন্দের। কারণ, এই সাইটটির সংবাদের বিশ্বততা ও চমৎকার উপস্থাপনা। তবে তার মানে এই নয় যে, বিডিনিউজের সব সংবাদই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য।
স্রেফ খোড়া যুক্তি। যা কিছু ”অনেকের মধ্যেই আগ্রহ” তৈরি করে বা পাঠককে “স্রেফ অন্যরকম ঘটনার প্রতি আগ্রহ” জাগায়, তা-ই সংবাদ হলে আর অপসাংবাদিকতা আর কাকে বলে? আপনার যুক্তিতেই এক সময় বেশ কিছু পত্রিকায় ধর্ষণের শিকার নারীর নামধাম ছবিসহ ধর্ষনের রগরগে বর্ণনা ছাপা হতো।
চটজলদি জনকণ্ঠের একটি লাল রঙা হেডলাইনের কথা মনে আসছে। পুরনো ওই সংবাদটির শিরোনাম ছিলো: ডেমরায় রাতভর ধর্ষণ! তখন এ নিয়ে সাংবাদিক মহলে জোর সমালোচনা হয়। সে সময়ও জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে ওই রকম পাঠক আগ্রহের কথা বলা হয়েছিলো। আপনার খোড়া যুক্তিটিকেই আমি চলতি নোটে “অফপিক/হট আইটেম” বলে উল্লেখ করেছি।
এই যুক্তিতেই যাকে সাদা বাংলায় বলে, পাগল কিচ্ছা পাবলিকে খায় ভালো!
সবচেয়ে বড়ো কথা, প্রাইভেসি মানুষের জন্মগত অধিকার। যত বড়ো মিডিয়াই হোক না কেন, এমনকি কোনও রাষ্ট্রকেই এই অধিকার কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। প্রাইভেসির ধারণা থেকে আমরা যে এখনো অনেক বছর পিছিয়ে আছি, রিতা-মিতা কাহিনী, তারই সর্বশেষ উদাহরণ।
বাহ! ”পাগল কিচ্ছা” থেকেও আপনি ”শিক্ষাণীয়” এবং “সচেতন” মূলক বিষয় আবিস্কার করেছেন দেখছি! এই সচেতনতার সৃষ্টির জন্য রিতা-মিতাকে জনসম্মুখে ছবিসহ বলি দিতে হবে কেন? বিডিনিউজ+অন্যসব গণমাধ্যমকে এই অধিকার কে দিয়েছে?
মনোরোগ এবং আপনার উল্লেখিত অন্য সব জাতীয় সমস্যা নিয়ে সমাজকে “সচেতন” করার জন্য সংবাদপত্রে স্বাস্থ্যপাতাসহ উপ-সম্পাদকীয় পাতা আছে। বিডিনিউজেও মতামত বিভাগ আছে। সেখানেও এসব বিষয়ে আরো বড় পরিসরে বিস্তারিত ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে। এ জন্য গল্পের গরুকে সংবাদে ভর করে গাছে তোলার দরকার পরে না।
আপনি দেখি সংবাদটির ফোকাস পয়েন্ট বাদ দিয়ে নেপথ্য সংবাদ নিয়ে মেতেছেন। যদিও আমারও তাই মত, নেপথ্য সংবাদটিই আসলে সংবাদ। অর্থাৎ দুইবোনের সম্পদ আত্নসাৎকারী চক্রকে চিহ্নিত করাই উচিত ছিলো সংবাদের ফোকাস পয়েন্ট। কিন্তু খুব ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখবেন, বিডিনিউজ, প্রথম আলো, যুগান্তরসহ অন্যসব গণমাধ্যমে সেটি ফোকাস হয়নি। ফলোআপ সংবাদেও তাদের সম্পদ বেহাত হওয়ার সম্ভাবনার [যদি থাকে] বিষেয়ে কিছুই বলা হয়নি। কারণ এবারও এই সংবাদটির ফোকাস পয়েন্ট শুধু রিতা-মিতা এবং তাদের বিবিধ ”পাগলামি!”
এটি একটি স্পষ্ট কুতর্ক এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ। এর মোক্ষম জবাব আমার প্রায় আড়াই দশকের পেশাগত সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকেই দিতে পারতাম। কিন্তু কুতর্ক বা পাল্টা ব্যক্তিগত আক্রমনে আমার আগ্রহ এবং রুচি কোনটিই নেই।
ভালো থাকুন। আপনাকে ধন্যবাদ।
(Y) বিপ্লব রহমান .
@Rashid Sarker,
আপনাকে ধন্যবাদ।
হলুদ সাংবাদিক তা বিষয়ে লেখা খুব কম দেখি, যদিও ইয়েলো জার্ণালিজম বাংলাদেশে খুব দেখা যায়। আর অপরাজনৈতিক সুবিধাবাদ যদি সাংবাদিক তার মোটিভেশন হয় তাহলে তার থেকে ঘৃণিত বস্তু আর কি আছে। আপনার অভিযোগের যথেষ্ট যুক্তি আছে। ধন্যবাদ লেখাটার জন্য।
@শাখা নির্ভানা,
ঠিকই বলেছেন, হলুদ সাংবাদিকতা বা অপসাংবাদিকতা নিয়ে খুব কমই লেখালেখি হয়। ব্লগ পোস্ট তো নয়ই। তবে এ বিষয়ে আগেও মুক্তমনায় একবার লিখেছিলম [দ্র. একেই বলে সাংবাদিকতা?]।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আমার ধারনা এই খবরটি প্রকাশের মাধ্যমে তারা পাঠকের অবসর সময় গুলোকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টায় থাকে। যাতে অনলাইন উপার্জন এবং জনপ্রিয়তা দুটোই সমান তালে চলে।
@বাউন্ডুলে বাতাস,
সব কিছুকে বাণিজ্যিকীকরণের কি অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা! ধীক্কার জানাই।
নোটটি পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। চলুক।