বাবাকে মনে পড়ে

অজয় রায়

 

গৌড়চন্দ্রিকা

আন্তর্জাতিক জগত বেশ কয়েক বছর ধরে জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে আন্তর্জাতিক বাবা দিবস হিসেবে অভিহিত করেছে। এ দিবসে ছেলেরা তাদের স্ব স্ব পিতৃদেবকে স্মরণ করছে, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছে, আর প্রীতি উপহার দিচ্ছে সাথে আশীর্বাদ কামনা করছে বিনয়ের সাথে। আর যেসব ভাগ্যবান সন্তানদের বাবারা আজও জীবিত আছেন তারা দিনটি উদযাপন করছে নানা ভাবে, নানা উৎসবের মধ্যদিয়ে। আর আমার মত ভাগ্যহীন সন্তানেরা, যাদের বাবারা জীবিত নেই তাঁরা এ দিনে বাবাকে স্মরণ করে স্মৃতি রোমন্থন করে, বাবা কেমন ছিলেন, কতটা  স্নেহ করতেন আর বকাবকিই বা কতটা করতেন, আর মনেপ্রাণে বাবাকে শ্রদ্ধা জানায়, মুসলিম হলে সন্তান বাবার কবর জিয়ারৎ করে। এৎদ সত্তেও আমার বলতে দ্বিধা নেই যে ‘বাবা-দিবস’ কিন্তু ‘মা-দিবসের’ মত সন্তানদের কাছে সমান জনপ্রিয়তা পায় নি।

 

আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুযায়ী এবছর ‘বাবা দিবস’ পড়েছে ১৬ই জুন (মাসের ৩য় রবিাবর) তারিখে (২০১৩)। ইচ্ছে ছিল এবারের বাবা-দিবসে আমার র্স্ব্গীয় পিতৃদেবকে নিয়ে দুচার কথা লিখে তাঁকে স্মরণ করব আর এর মধ্য দিয়েই তাঁর পাদপদ্মে শ্রদ্ধাঞ্জালি নিবেদন করব। লেখাটা মুক্তমনায় দেবার ইচ্ছে ছিল আসলে গতবছরের বাবা দিবসে, কিন্তু উটকো ঝামেলায় পড়ে লেখাটা আর শেষ করতে পারিনি তখন। বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলি, যদিও আমি জানি তাঁর পার্থিব বা অপার্থিব কোন অস্তিত্বই নেই এখন না ইহলোকে, না পরলোকে,  এবং আমার কথা তাঁর শোনার কোন প্রশ্নই আসে না, ‘তোমার অধম সন্তান এ দিনেও পিতার প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক কর্তব্যটুকুও পালন করতে পারল না।’ আর আমার সারা জীবনে এই ঘটেছে, ঠিক কাজটি ঠিক সময়ে আমার করা হয়ে ওঠেনি, বাবার শত তিরস্কার ও ভয় প্রদর্শন সত্তেও। তিরস্কারে যখন কাজ হয়না, বাবা তখন আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে -স্নেহমাখা মমতা-ভরা গলায় বলতেন ‘ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে না পারলে ‘মানুষ হওয়া যায় না, বড় হওয়া যায় না। তোমাকে তো মানুষ হতে হবে, অনেক বড় মানুষ।’ বাবার এ উপদেশ আমাকে সারা জীবন শুনতে হয়েছে। বাবা অনেক সময় বলতেন ‘সময় নিষ্ঠ ও নিয়ম নিষ্ঠ’ হতে। উদাহরণ দিতেন বিবেকানন্দ, জগদীশ বোস আর রবীন্দ্রনাথের কথা বলে, বলতেন ‘ওঁরা অনেক বড় হয়েছেন তাঁরা কর্তব্যনিষ্ঠ, নিয়মনিষ্ঠ ও সময়নিষ্ঠ ছিলেন বলেই, তোমকেও তো তেমনি বড় হতে হবে।’ তিনি আমাদের সময়ানুবর্তিতার কথা বলতেন। ছোটবেলায় এত ভারি ভারি কথা আমার মাথায় ঢুকতো না। তাঁকে ভয়ে ভয়ে শুধোতাম, ‘বাবা এগুলোর মানে কী?’ বাবা আমাকে আমার মতো করে বুঝাতেন, ‘এই ধরো, সুয্যিঠাকুর প্রতিদিন সকালে ওঠেন কেমন নিয়ম করে কোন তারতম্য হয় না, এটিই হলো নিয়ম নিষ্ঠ, যেমন প্রতিদিন আমি কোর্টে যাই সময়মতো, তুমি স্কুলে যাও একই সময় প্রতিদিন – এটি হলো সময়নিষ্ঠ। ‘আর তোমার অঙ্কের মাস্টারমশায় কেমন নিষ্ঠার সাথে ক্লাশে তোমদের অঙ্ক কষাণ, আর একেই বলে ‘কর্তব্যনিষ্ঠতা বা কর্তব্যপরায়নতা’ অর্থাৎ স্ব স্ব কাজ আন্তরিকতার সাথে সম্পাদনা করা কোন ফাঁকি-ফুকি না দিয়ে। কিন্তু এত কথার পরও, আমাকে বাবার অবাধ্য থাকতে হয়েছে চিরকাল, কোন কাজই আমার সময় মতো করা হতো না, আর তাই বাবার ভবিষ্যদ্বানী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে ‘জীবনে তোমাকে অনেক খেসারত দিতে হবে’, হ্যাঁ খেসারত দিতে হয়েছে – একবার নয়, বহুবার এবং সারাটা জীবন ভর।

 

বাবা যে দিকপাল ছিলেন, তা কিন্তু নয়, ছিলেন সুশিক্ষিত এবং স্বশিক্ষিত, কিন্তু ছিলেন এক ধরনের আদর্শবাদী সাধারন মানুষ। অন্তত তিনি আমাদের তাই সব সময় বলে এসেছেন। আমরা যখন একটু বড় হলাম অন্তত: বাবার চোখে, আমাদের প্রায়ই বলতেন, ‘আমি কোন বড় মানুষ নই, কাজেই আমার জীবন তোমাদের ওপর চাপাতে চাইনা, তোমরা তোমদের মত করে জীবন গড়ে তুলবে, আমি কেবল তোমাদের সাহায্য করতে চাই যথাসাধ্য, আর মানুষ হতে হবে সত্যিকার, বড় মানুষ।’

 

বাবার এই আদর্শ পুথিপড়া আদর্শ নয়, নানা মানুষকে দেখে, পরিবেশ থেকে শিখে নিজের জীবন বোধ ও নিজ-আদর্শ তৈরী করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই জীবনদর্শন তাঁর সন্তানরদের ওপর কখনও চাপিয়ে দেন নি। আমার দিব্যি মনে আছে আমার দাদা ১৯৫১ সালে রামকৃষ্ণ বেলুর মঠ কলেজ থেকে খুব ভাল রেজাল্ট করে বিজ্ঞানে মাধ্যমিক পাশ করে ভবিষ্যতে কী নিয়ে পড়বে – বাবার উপদেশ  চাইলে, বাবা তাকেই পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘তুমি কী করতে চাও?’ দাদা ইচ্ছে প্রকাশ করল যে সে বৈমানিক হতে চায়, তাই বিমান বাহিনীতে ঢোকার চেষ্টা করবে। বাবা মৃদু হেসে বললেন, ‘বেশ তো, সৈনিক হতে চাও। জাত পেশায় ঢুকতে চাও, আমরা তো ক্ষত্রিয় – সৈনিকের রক্ত আমাদের ধমনীতে।’ সেদিনই জানলাম বাবা এমনিতে জাত পাত না মানলেও ক্ষত্রিয়ত্বের অহংকার তাঁর মনের গোপনে বাসা বেঁধে রয়েছে (আমার যেটা ছিল না, এবং সেই ধরণের ধর্মীয় অহঙ্কার আমি পরিত্যাগ করেছিলাম অনেক আগেই)। বলতে বাধা নেই, বাবার অন্তরে একটি গরিমার স্থান ছিল ‘আর্যত্ব’, তিনি বলতেন ‘আমরা আর্য সন্তান, আর্য কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ধারক। আদিকালের প্রাচীন আর্যজাতি বেদ-উপনিষদ-বেদান্ত ভিত্তিক এক সভ্যতা সংস্কৃতি ও ধর্ম গড়ে তুলেছিলেন; বাবা বলতেন, ‘সেই ভিত্তির ওপর নানা জাতের, নানা ধর্মের মানুষের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ধর্ম-ঐতিহ্য-ইতিহাসের বিচিত্র ও বৈপরীত্যেও উপাদানকে বিরোধী প্রক্রিয়া ও সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আজকের ভারতীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে ভারতের মানুষ, যাকে বাবা বলতেন ‘উচ্চতর হিন্দু সংস্কৃতি’  – যেখানে স্থান পেয়েছে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের ও সকল জাতের মানুষ যারা এই সংস্কৃতি বিনির্মাণে অনবদ্য অবদান রেকেছে ইতিহাস ও কালের নানা পর্যায়ে ও পর্বে। বাবার এ সব কিছুর সাথে যে আমি একমত তা নই, কিন্তু দোষেগুণে মিলিয়ে সেটাই আমার বাবা, সেটাই বাস্তবতা।

 

মৃত্যুকালে বাবার শয্যাপার্শ্বে আমরা তিন ভাইয়ের কেউ উপস্থিত ছিলাম না। এ বেদনা আমাকে আজও পীড়া দেয়। যদিও মৃত্যুর কিছুদিন আগে অসুস্থ বাবাকে দেখতে গিয়েছিলাম, একটু ভাল দেখে ঢাকায় ফিরে আসি। ক্রন্দসী মা আমাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছিলেন না। বাবা তখন অন্তিম শয়ানে, কোমায় চলে গিয়েছেন। হাসপাতালের ডাক্তাররা বললেন এ অবস্থা কতদিন চলবে কিচ’্ই বলা যায় না, দীর্ঘদিনও হতে পারে, আবার যে কোন মুহূর্তে অঘটন ঘটে যেতে পারে। বাবাকে বাসায় প্রিয়জনদের সান্বিধ্যে নিয়ে যেতে আমাকে পরামর্শ দিলেন ডাক্তাররা। বস্তুত তাদের আর করার কিছু নেই। আমি তাদের নির্দেশে বাবাকে বাসায় রেখে সাত দিনের জন্য ঢাকায় ফিরলাম। কিয়তদিন পরেই পেলাম সেই মর্মান্তিক সংবাদ ‘বাবা আর নেই’। আমার পরম শ্রদ্ধেয় বাৎসল্য পরায়ণ এবং সাবালক কালে আমার পরম বন্ধু পিতৃদেব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ১৪ই জানুয়ারী (১৯৮৩) শুক্রবার সকাল ১০.০০ টায়, পুরাতন পঞ্জিকা অনুযায়ী বাংলা ১৩৮৯ সনের ২৯শে পৌষ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর, সেদিক থেকে অবশ্যই পরিণত। কিন্তু তাতক্ষণিক ভাবে আমার মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যে আমার মাথার ওপর ছায়াপ্রদায়ী সকল বিপদের রক্ষাকারী এই বটবৃক্ষটি অপসৃত হলো চিরকালের জন্য; সেই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় বোধ করেছিলাম, যদিও তখন আমার বয়স ৪৭ বছর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। শুধু ক্রন্দনরতা মা যখন আমাকে শুধোলেন, ‘বাবা আমার কী হবে, আমি বাঁচব কেমন কওে, কাকে নিয়ে?’ মাকে নিজ কন্যার মত জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলাম, ‘ভয় কি মা, আমি তো রয়েছি, তোমার বড় ছেলে রয়েছে, ছোট ছেলে রয়েছে, কন্যা-জামাতা রয়েছে। সব বিপদে-আপদে আমরা তোমাকে আগলে রাখব। এই আমি প্রতিজ্ঞা করছি মা, ‘আজ থেকে তোমার সকল দায় দায়িত্ব আমার।’ আর আমার পরম পরিতোষের বিষয় মাতা ঠাকুরানীর শেষদিন পর্যন্ত আমি এ দায়িত্ব সযত্নে পালন করে এসেছি। আমার জীবনের বড় অর্জন যে আমি মাতৃসেবা করতে পেরেছি। অবশ্য বাবার মৃত্যুর ২/১ দিন পরেই বড় ভাই চলে এসেছিলেন বাবার পারলৌকি শেষ কৃত্যাদি সম্পন্ন করতে। দাদা আসাতে মা খুব ভরসা পেয়েছিলেন।

 

বাবার বাল্যকাল ও শিক্ষা জীবন

বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই ও এক বোন। এর মধ্যে জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা এবং একমাত্র বোনটি অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। আমার পিতামহ অর্থাৎ বাবার পিতৃদেবের নাম ছিল ‘দুর্গাচরণ বা দুর্গানারায়ণ’, তিনি ছিলেন প্রতিপত্তিশালী ধনাঢ্য কৃষক ও অনেক জমির মালিক অনেকটা জার আমলের কৃষক ‘কুলক’ দের মত। আর করতেন শিক্ষকতা, দিনাজপুর শহরের উপকণ্ঠে একটি গ্রামের বিদ্যায়তনে। বাবারা কয়েক পুরুষ ধরে শান্ত ছোট মফস্বল শহর দিনাজপুরের অধিবাসী। তবে মার কাছে শুনেছি, বাবার বিয়ে হলে, পিতামহ গ্রামের বাড়ীতে চলে আসেন পাকাপোক্তভাবে – নব পুত্রবধূকে নিয়ে। বাবা শহররেই থাকতেন পেশাগত কারণে, তবে সপ্তাহান্তে গ্রামের বাড়ীতে চলে আসতেন দু’দিনের ছুটিতে (শনিবার ও রোববার)। বাবার অন্য ভাইদের মধ্যে বড়জন ছিলেন স্বর্ণালঙ্করের ভাল কারিগড় ও ছোটখাট ব্যবসায়ী, আর ছোট ভাই ছিলেন পুরোমাত্রায় জমি অন্ত প্রাণ, পরিবারের সকল কৃষিজমির তদারকি করতেন। ঠাকুরদাদা তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নির্ভার জীবন যাপন করতেন, আর বৈঠকখানার সামনের বারান্দায় চেয়ারে নানা ধরনের সুগন্ধি তামাক দিয়ে সাজান গড়গড়া টানতেন। তাঁর সার্বক্ষণিক দেখভাল করার জন্য একজন ভৃত্য নিযুক্ত ছিল, আর সর্বোবরি ছিলেন আমার মাতা ঠাকুরাণী। মা বলতেন আমার পিতামহের নাকি মাকে ছাড়া চলত না, প্রতিক্ষণেই মাকে ডাকতেন মায়ের নাম ধরে। বড় হলে মা’কে একদিন শুধিয়েছিলাম ‘বাবা, এতে হিংসে করতেন না, মাত্র তো দু’দিনের জন্য তোমার সান্বিধ্য পেতে আসতেন।’ মা লজ্জায় রক্তিম হয়ে জবাব দিতেন, ‘ মা-বাবা সম্পর্কে এসব কথা বলতে তোর দ্বিধা করে না।’, তার পর যোগ করতেন, ‘তোর ঠাকুর’দা খুব বিবেচক মানুষ ছিলেন।’

 

আমার পিতৃদেব জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ২২শে আশ্বিন, ১৩০৮ সালে। বর্তমান সংশোধিত বাংলা একাডেমী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটি হবে ৭ই অক্টোবর, ১৯০১ এডি। ১৪০৮’এ তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছিল, আমি খুব সাধারন ভাবে বাবাকে স্মরণ করেছিলাম বিনম্র চিত্তে পরম শ্রদ্ধাভরে। না, কোন জাকজমক আনুষ্ঠান আমরা করিনি।

দিনাজপুর শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি প্রাথমিক স্কুল থেকে বাবা মাইনর পাশ করেন (বর্তমানের ক্লাশ সিক্স) এবং জলপাইগুড়ি শহরের একটি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (ম্যাট্রিকুলেশন) পাশ করেন ১৯১৭ সালে ১৬ বছর বয়সে, ১ম বিভাগে। সে কালে ১৬ বছরের নীচে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়া যেত না। সে সময় জলপাইগুড়ি আর দিনাজপুর জেলা একই প্রশাসনিক একক হিসেবে বিবেচিত হত।

 

বাবার কলেজ জীবন

উত্তরবঙ্গে সেসময় উচ্চশিক্ষা লাভের দুটি কেন্দ্র ছিল, দুটিই নামকরা – একটি রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ, অন্যটি রংপুর কারমাইকেল কলেজ, বেসরকারী। লাল ইটের রঙ্গে তৈরী অনেকটা ইঙ্গ-মোগল স্থাপত্য শৈলিতে – চমৎকার সুদৃশ্য ভবন।  বাবা কারমাইকেলেই ভর্তি হলেন এফ.এ পড়তে, থাকতেন কলেজ হোস্টেলে। এর দু’বছর পরে (১৯১৯) এই কলেজ থেকে  ১ম বিভাগে এফ. এ পাশ করেছিলেন। এরপর ঐ কলেজ থেকেই সংস্কৃতে অনার্স সহ ডিস্টিন্কশন নিয়ে উচ্চতর দ্বিতীয় শ্রেণীতে বি.এ (অনার্স) ডিগ্রী লাভ করেন ১৯২১ সালে। কলেজে পড়ার সময় বাবা একটি কৌতুকর ঘটনার কথা একদিন আমাদের উল্লেখ করেছিলেন, এফ.এ ক্লাশে পড়ার সময়ে মাতার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধাদি অন্তে ক্লাশে উপস্থিত হলে প্রিন্সিপাল সাহেব বাবার নাম ও রোল নং ধরে ডাকছেন। বাবা তখন পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘ন্যাড়া-মাথায় সাদা পাগরী’ পরে উঠে দাড়ালে বাবার এই কিম্ভুৎ কিমাকার চেহারা ও পোষাক দেখে ক্লাশে হাস্যরোল উত্থিত হয়। হাস্যরোল থামলে প্রিন্সিপালের ঔৎসুক্যের দিৃষ্টির জবাবে বাবা ঘটনার বিবরণ দেন। প্রিন্সিপাল (বোধ হয় সাহেব ছিলেন) ক্লাশে জানালেন,  ‘Oh, you are Atulchundar! You have received a gold medal for the English essay you sent through my office for divisional competition. The medal has been sent to me from the divisional education department to hand over to you. Come to my office and receive it. Listen boys, Atul has brought honour for our college. Congratulation to you, young man. His English teacher told me that he has obtained the highest mark in English in the first year annual examination. Very good.’

 

আইনজীবী বাবা

 

বি.এ ডিগ্রী অর্জনের মধ্য দিয়েই ১৯২১ সালে বাবার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। অনেক পরে, কোন এক প্রসঙ্গে আমাদের বলেছিলেন যে কারমাইকেল কলেজে তখন সংস্কৃতে এম.এ পড়ার সুযোগ ছিল না। ‘তবে বাংলা পড়তে পারতাম, কিন্তু মন চায় নি, কি হবে বাংলা পড়ে – চাকুরী বাকরি পাওয়া দুস্কর। কোলকাতায় অবশ্য সংস্কৃতে এম. এ পড়া যেত, কিন্ত পরিবার অতদূরে যেতে দিতে রাজী হয় নি, তাছাড়া আর্থিক সমস্যতো ছিলই। বেশ ক’বছর শিক্ষকতা করলেন স্কুলে এখানে ওখানে, পড়িয়েছেন ইংরাজী, বাংলা, সংস্কৃত আর ভুগোল; সাথে পছন্দসই চাকুরী খুঁজছেন  – ডেপুটিগিরি, সরকারী অফিসের বড়সাহেব, রেজিস্ট্রি অফিসে ‘রেজিস্ট্রার’ ইত্যাদি পদের। একসময় দারোগাগিরির, আর ঠাকরগাঁওর এক জমিদারীর সহকারী ম্যানেজারের পদ, বস্তুত তা তহশীলদার, পেয়ে গেলেন কিন্তু কোনটাই বাবার পছন্দ হয় না। আসলে বাবার মনে ইচ্ছে ছিল ‘ল পড়ে বড় উকিল-ব্যারিস্টার হওয়া, দিনাজপুর শহরেই বেশ ক’জন নামজাদা উকিলের সুনাম ও পসার দেখে বাবা বেশ ইমপ্রেসড্ । সে সময় ওকালতি পেশা ছিল খুবই সম্মানজনক। বাবা স্থির করে ফেললেন তিনি উকিল হবেন; হ্যাঁ এ পেশাই তাকে নিতে হবে। কিন্তু কী উপায়ে ? সাহস করে একদিন দিনাজপুর শহরের নামকরা উকিল এবং কংগ্রেসের ১ম সারির নেতা যোগীন চক্রবর্তীর সাথে দেখা করলেন এবং নিজের অভিলাসের কথা জানালেন, পরিশেষে তাঁর উপদেশ ও সাহায্য কামনা করলেন। যোগীন বাবু বাবাকে খুব পছন্দ করলেন, ‘কিন্তু ইয়ংম্যান, উকিল হতে হলে তো তোমাকে বি.এল ডিগ্রী নিতে হবে কোলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ‘ল কলেজে পড়ে। যাও ‘ল পাশ করে এস, আমি তোমাকে আমার জুনিয়র করে নেব, কথা দিলাম। বাবা নিজের আর্থিক অসচ্ছলতার কথা তুললেন। ‘এ ব্যাপারে তো আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব না, বড় জোর দু’চারশ টাকা দিতে পারি, কিন্তু তাতে তো হবে না। ‘ল কোর্স দুবছরের কোলকাতায় পড়তে ও থাকতে অনেক টাকার দরকার হবে। তোমার বাবা ও পরিবার সহায়তা দেবে না?’ বাবা না বলাতে, বস্তুত ‘ল পড়ার জন্য বাবা চাইছিলেন না পিতাকে বিব্রত করতে। ‘হুম, ইয়ংম্যান বিয়ে করেছ?’ বাবা না বলাতে, তিনি বাবাকে আদেশ দিলেন ‘বাবার বাবাকে’ নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে যত শীঘ্র।

 

কয়েকদিন পরে সাক্ষাতের পর বাবাকে ঠাকুরদা অনুযোগের সুরে বললেন, ‘তুমি উকিল হতে চাও আমাকে বলো নি তো, কেন?’ বাবা মাথা নীচু করে বলেছিলেন আমতা আমতা করে, ‘অত খরচ কোলকাতায় গিয়ে পড়া এবং থাকা।’ উত্তর, ‘ব্যবস্থা হবে তুমি তৈরী হতে থাকো।’ পরে জেনেছিলেন যোগীন বাবু আমার ঠাকুরদাকে বলেছিলেন ‘আপনার ছেলে খুব মেধাবী, ওকে ওকালতি পড়াতে বাঁধা কোথায়। নিজে না পারলে ছেলের বিয়ে দিন, হবু বেয়াইর কাছে একটিই দাবী করুবন ছেলেকে কোলকাথায় ‘ল পড়ার আর্থিক সহায়তা দিতে।’  আমার সুপাত্র বাবার পাত্রী পেতে অসুবিধা হলো না, পুর্নিয়ার জমিদার পরিবারের মেয়ে আমার মার সাথে বিয়ের সব পাকা ব্যবস্থা হয়ে গেল; বাগদান অনুষ্ঠান হয়ে গেল, স্থির হলো বাবা কোলকাতায় ল-পড়া শেষ হলে বিয়ে হবে। বাবা মনের আনন্দে কোলকাতায় চলে গেলেন ‘ল পড়তে ১৯২৬ সালে, বিএল ডিগ্রী অর্জন করলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আইডিয়াল কলেজ হোস্টেলে থেকে, ১৯২৮ সালে। বাবা এই আইডিয়াল ল’ হোস্টেলের স্মৃতিচারণ মাঝে মাঝেই করতেন আমাদেও কাছে। দেড় বছর আলিপুরে একজন সিনিয়রের সাথে শিক্ষানবিশী শেষে ওকালতির সনদপত্র পেয়ে বছর তিনেক পড়ে পরিপূর্ণ উকিল হয়ে দিনাজপুরে ফিরে এলেন। জমিদার নন্দিনীর সাথে পরিণয়সুত্রে আবদ্ধ হলেন ১৯৩০ সালে, বাবার বয়স তখন ২৯ বছর। আর মা তখন অষ্টাদশী। একবছর শ্বশুরবাড়ী বাপের করে আর হানিমুন সেরে বাবা মাকে গ্রামের বাড়ীতে ঠাকুরদার সার্বক্ষণিক সেবিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে আমার পিতৃদেব আনুষ্ঠানিকভাবে দিনাজপুর শহরের সবচাইতে জাঁদরেল উকিল যোগীন চক্রবর্তীর জুনিয়র হিসেবে দিনাজপুর বাওে যোগ দিলেন ১৯৩১ সালে। এবং কয়েক বছরের মধ্যেই দক্ষ ও লব্ধ প্রতিষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে আবির্ভুত হলেন। খ্যাতনামা আইনজীবী হিসেবে বাবার সুনাম ও খ্যতি আমৃত্যু বলবৎ ছিল, তাঁর জুনিয়র সহকর্মীরা বাবাকে চিরকাল শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন এবং আদর্শ আইনজীবী হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। বাবা মূলত সিভিল কোর্টেই মামলা পরিচালনা করতেন, কদাচিৎ ক্রিমিনাল কোর্টে উপস্থিত হতেন।

 

আগেই বলেছি বাবা ইংরেজী, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় বেশ পণ্ডিত ছিলেন, একজন দক্ষ মুসাবিদকারী হিসেবে দিনাজপুর বারে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। বারের নামকরা উকিলরাও এমন কি আদালতের হাকিম ও পেশকাররাও এ ব্যাপারে বাবার সাহায্য নিতেন। বাবার আর একটি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল  তা হলো কোর্টে মামলায় মক্কেলের পক্ষে দক্ষতার সাথে যুক্তি প্রতিযুক্তির মাধ্যমে অপূর্ব বাচন শৈলীতে বক্তব্য উপস্থাপনে তাঁর জুরি মেলা ভার। কোর্টে আমি বাবার এই সওয়াল-জবাব অনেকবার দেখেছি আর চমৎকৃত হয়েছি। আদালতের বাইরেও নানা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বাবা ছিলেন সুবক্তা ও তেজময় ভাষণ প্রদনে দক্ষ, তাঁর ছিল স্পষ্ট  কণ্ঠস্বর ও যথাযথ শব্দচয়নের মাধ্যমে পরিস্কার উচ্চারণে অপূর্ব বাচনভঙ্গিতে তিনি তাঁর বক্তব্য উত্থাপন করতে পারতেন – শ্রোতাকে বিমোহিত করত।

 

বাবা : একজন সমাজ সচেতন ব্যক্তি

আগেই বলেছি বাবা এমন কোন দিকপাল ব্যক্তি ছিলেন না যার পরিচয়ের বৃত্ত জেলার সীমাকে অতিক্রম করে গিয়েছিল, তবে দিনাজপুর জেলায় দক্ষ আইনজীবী, সমাজ সেবক, জ্ঞান ও পা-িত্যের অধিকারী হয়ে তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তবে সমাজ দরদী ও সমাজ সেবক হিসেবে উত্তর বঙ্গে বিশেষ করে রংপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি জেলা সমুহেও তিনি মোটামুটি পরিচেত ছিলেন। বাবা সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও তিনি রাজনীতি সচতন ছিলেন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন যা তিনি মনে করতেন তাঁর দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি। উদাহরণ স্বরূপ মহাত্মা গান্ধীর ডাকে বিয়াল্লিশের ভারত-ছাড় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন যদিও তিনি কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। মা থেকে আমাদের পরিবারের সকল মহিলা সদস্য ‘চরকা আন্দোলনে’ সক্রিয় অংশ নেন। ছোট্ট আমিও তকলি দিয়ে সুতা কাটতাম। বাবা তুলো থেকে সুতাকাটার একটি ‘যান্ত্রিক তকলি’ উদ্ভাবন করেছিলেন। এর নাম ছিল ধনুস্Íকলি। দিনাজপুর শহরের প্রায় সব কংগ্রেস নেতাদের সাথে ব্যক্তি পর্যায়ে বাবার ছিল প্রীতির সম্পর্ক। এসব নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন খ্যাতনামা উকিল যোগীন্দ্র চক্রবর্তী, নিশিথ নাথ কুণ্ডু, প্রেমহরি বর্মণ প্রমুখ। বাবার এক বন্ধু ছিলেন সার্বক্ষণিক কংগ্রেস কর্মী ও নেতা, আমরা তাকে ‘বিভুতি কাকু’ বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন সকল বিপদে আপদে আমাদের পারিবারিক বন্ধু, মার খুব প্রিয় মানুষ। রংপুরের অধিবাসী জেলখাটা এক কংগ্রেস কর্মী কেমন করে যেন সেই আন্দোলনের সময় পরিবারের একজন সদস্যে পরিণত হলেন; আমরা তাকে রজনী’দা নামে ডাকতাম।

 

আর একটি উদাহরণ দেই। ১৯৪৫-৪৬ সালে তেভাগা আন্দোলন তখন তুঙ্গে – দিনাজপুর, রংপুরসহ উত্তর বঙ্গের ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ ও ‘ফসলের তিন ভাগে’র দাবী নিয়ে কৃষকদের আন্দোলন তখন সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ পেয়েছে কৃষক সমিতির নেতৃত্বে। দিনাজপুর অঞ্চলে নেতৃত্বে ছিলেন কৃষক নেতা উকিল হাজী দানেশ, বাবার সহকর্মী, কৃষক সমিতির নেতা, বাবার অতি  স্নেহভাজন তরুণ কম্উিনিস্ট রূপনারায়ণ রায়, আর গুরুদাস তালুকদার, যদিও তিনি রংপুরের আন্দোলনের নেতৃত্বেও ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা মণিকুন্তল সেনের সাথে। গুরুদাস তালুকদার ছিলেন বাবার বড়ভাইতুল্য শুভানুধ্যায়ী এবং আমাদের পারিবারক বন্ধু  – অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ; আমরা তাকে ‘জেঠু’ ডাকতাম। বাবার সিনিয়র দিনাজপুরের কমিউনিস্ট নেতা ও দিনাজপুর বারের একজন খ্যাতনামা আইনজীবী বরদা ভূষন চক্রবর্তীও ছিলেন এ আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতা। এ সময়ের আর একজন ব্যক্তির কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন পঞ্চগড় এলাকার কৃষক নেতা দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, যিনি ঐ এলাকায় কৃষকদের সংগঠিত করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। বস্তুত তিনি ছিলেন একজন বিত্তশালী জোতদার প্রচুর জমির মালিক, কিন্তু আন্দোলনের স্বার্থে তার সকল বিষয়াদি কৃষক সমিতিকে দান করেছিলেন। ‘ডিক্লাসিফিকেসনের এমন উদাহরণ খুব একটা দেখা যায় না। বাবা কমিউনিস্ট ছিলেন না কিন্ত তাঁর সমজদরদী মন ও কৃষকের প্রতি তাঁর সহানুভুতি তাঁকে এ আন্দোলনে টেনে আনে। তিনি কৃষকদের পক্ষ নিয়ে লড়াইতে নেমে পড়েছিলেন। সে সময় শত শত মানুষকে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীও ছিল, পুলিশ প্রতিদিন থানায় ধরে নিয়ে আসতো এবং মামলা ঠুকে দিয়ে কারাগারে অবরুদ্ধ করে রাখতো। দিনাজপুর সদর জেলখানায় তিল ধারনের স্থান ছিল না।

 

আমার দিব্যি মনে আছে বাবা এসব নির্যাতীত মানুষদের পক্ষে আদালতে লড়েছেন – জামিনে অনেককেই মুক্ত করেছেন; রূপনারায়ন রায় পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে গভীর রাতে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন শলা পরামর্শ করতে। আমাদের বাসাটি লঙ্গরখানায় পরিণত হয়। বাবার আর একটি সমাজিক দায়বোধ ছিল- তা হলো ক্ষত্রিয় জাতির আন্দোলন সম্পর্কিত। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে সারা ভারতে বিশেষ করে উত্তর ভারতে ও রাজস্থানে রাজামহারাজাদের উদ্যোগে ‘ক্ষত্রিয় আন্দোলন’ শুরু হয়, নানা জায়গায় ক্ষত্রিয় পুনর্মিলনী সভা অনুষ্ঠান হতে থাকে, এবং তাঁরা নিখিল ভারতীয় ‘ভারতীয় ক্ষত্রিয় সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোল উত্তরবঙ্গ ও কামরূপের ক্ষত্রিয়দের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। রংপুরের খ্যাতনামা উকিল ও সাহিত্যামোদী, রংগ্পুর সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ক্ষত্রিয় নেতা রায়সাহেব পঞ্চানন সরকারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘রঙ্গপুর ক্ষত্রিয় সমিতি’ উত্তরবঙ্গের ক্ষত্রিয় জাতির প্রতিভূ হিসেবে, ১৯১০ সালে ১লা মে তারিখে (বাংলা ১৩১৭, ১৮ই বৈশাখ)। শিগ্গরিই ‘রঙ্গপুর ক্ষত্রিয় সমিতি’র সাথে ‘ভারতীয় ক্ষত্রিয় সমিতি’র যোগাযোগ স্থাপিত হয়, এবং ‘ভারতীয় ক্ষত্রিয় সমিতি’ ‘রঙ্গপুর সমিতি’কে প্রচ্যদেশীয় ক্ষত্রিয় সমিতি রূপে স্বীকৃতি দেয়। বাবা এই সমিতির কাজের সাথে দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট ছিলেন নানা পদে অধিষ্ঠিত থেকে।

 

আর একটি ঘটনার কথা আমার মনে আছে, আমি তখন খুব ছোট; এবং এ ঘটনাটি থেকে বাবার সমাজসেবী ও মানবদরদী চরিত্রটি বেরিয়ে আসে। ১৯৪২ সালের কথা, সারা বাংলা তখন দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত। পিতৃদেব তখন কোলকাতায় ল’ইয়ার মেজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। দিনাজপুরে প্রচ- খ্যাদাভাবের কথা শুনে তিনি বেশ কিছুদিনের ছুটি নিয়ে দিনাজপুরের মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। সে সময়, অনেকেই বলে থাকেন, সারওয়ার্দি সরকার চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এই দুর্ভিক্ষ তৈরী করে। সরকারী হিসাব মতে সরকারী গুদামে চাল রয়েছে কিন্ত বাজার থেকে চাল উধাও। যে দিনাজপুর বাংলার শস্যভা-ার বলে পরিচিত সে জেলাতেও চাল নেই। দলে দলে বভুক্ষা পিড়ীত মানুষ গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসছে দুমুঠো ভাতের জন্য। বাবা কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়লেন। যে কোরেই হোক দরিদ্রনারায়ণের মুখে এক গ্রাস ‘অন্ন’ তুলে ধরতে হবে। বাবাসহ দিনাজপুরের জনদরদী নেতাদের সাথে ব্যাবসায়ী সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে মাড়োয়ারী ও কুণ্ডুদের, যাদের বড় বড় চালের আড়ৎ ছিল, বৈঠক হল। সাব্যস্ত হল নিরন্ন মানুষের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দিতে হবে। সারা শহরে বেশ কয়েকটি লঙ্গরখানা চালু হলো। আমাদের পাড়ায় হরিসভা-প্রাঙ্গণে বেশ একটি বড়সড় লঙ্গরখানা খোলা হলো বাবার সার্বিক পরিচালনায়। বাবা এরপর যে কাজটি করলেন তা হলো – মাকে ডেকে নির্দেশ দিলেন যে বাসায় পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রতিদিন যে চাল ডাল ও তরকারী রান্না হয় তা প্রতিদিন লঙ্গরখানায় পাঠানোর। এবং যতদিন না দুর্ভিক্ষ বন্ধ না হয়, বাড়ীতে চুলা জলবে না, প্রত্যেক সদস্য লঙ্গরখানায় খাবে। লঙ্গরখানায় চাল-ডাল-সবজি মিশ্রিত খিচুরী ও বেগুনভাজি পরিবেশন করা হতো। মা প্রতিদিন আমাদের জন্য লঙ্গরখানার খিচুরী নিয়ে আসতেন। আমার কাছে তা অতি উপাদেয় মনে হতো, আমরা ভাইবোনেরা কলরব করে খেতাম, – বাবার এই কা- দেখে মা নীরবে অশ্রু ফেলতেন। আমাদের লঙ্গরখানাটিতে সপ্তাহে তিন দিন গুড়োদুধ সরবরাহ করা হতো মা ও শিশুদের জন্যে। এছাড়া একটি ছোট ডাক্তর-বাহিনী ছিল যারা পেটখারাপ, আমাশা প্রভৃতির চিকিৎসা দিতেন।

 

এই শেষ নয়, বাবা চালের সরবরাহ যাতে লঙ্গরখানায় অব্যাহত থাকে, তিনি তার দলবল ও কর্মীবাহিনী নিয়ে গ্রামে গ্রামে বড় বড় জোতদারদের গোলা থেকে চাল সংগ্রহ করতেন। দিনাজপুরের প্রজাবৎসল জমীদার জগদীশনাথ দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে এগিয়ে আসেন – রাজবাড়ী ও আশেপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি লঙ্গরখানা ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। জমিদার বাবু বাবার লঙ্গরখানায় নিদ্দিষ্ট পরিমাণ চাল নিয়মিত সরবরাহ করেছেন।

 

এ সময়ের একটি দিনের কথা আমার শিশু মনে বেশ দাগ কেটেছিল যা আজও স্মরণ করলে আমার চোখ ভিজে ওঠে। তখনও আমাদের পাড়ার লঙ্গরখানা চালু হয় নি – প্রস্তুতি চলছে। বাসায় চাল বাড়ন্ত, বাজারেও চাল পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে মা বাবাকে একথা জানাতে বাবা সকালেই মাকে বলে চাল আনতে বেরিয়ে গেলেন। গ্রাম থেকে জ্যাঠা-প্রতিশ্রু চাল তখনও এসে পৌঁছায় নি। মা, বাবার জন্য অপেক্ষা করছেন আর করছেন, দুপুর গড়িয়ে গেল। খিদেয় আমরা কাতর হয়ে পড়েছি, বাবার পাত্তা নেই; মা উপায়ন্তর না দেখে ‘কাউনের’ শস্য দিয়ে দুধ দিয়ে পায়েসের মত কিছু খাইয়ে আমাদের ক্ষুধা নিবৃত্ত করলেন। বেলা প্রায় ৩টা, এমন সময় গ্রাম থেকে আমার এক পিশেমশায় হাজির, সঙ্গে ১০ সের চাল ও চারটি বড় মাগুর মাছ। মা হাতে যেন স্বর্গ পেলেন। মা তখনই ভাত রেধে গরম গরম পরিবেশন করলেন সঙ্গে চমৎকার মাগুর মাছের ঝোল। মনে হলো অমৃত সমান।  বাবা সন্ধ্যেবেলা ২০ সের চাল আর বেশ কিছু আনাজ সাথে নিয়ে মাতা-ঠাকুরানীর মুখোমুখি হলেন বিব্রতকর মুখ নিয়ে, আমতা আমতা করে বললেন, ‘মানে চাল পেতে বেশ দেরী হয়ে গেল। আর ওরা ছাড়লেন না খেতেই হলো, তাই এত দেরী।’ আসলে কাঞ্চন নদীর ওপারে বাবার এক পরিচিত বড় জোতদারের বাসায় গিয়েছিলেন লঙ্গরখানার জন্য চাল-ডালের জোগার করতে আর বাসার জন্য ‘আধমন চাল’ নিলেন, আরও দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাবা নেন নি।

ছোটবেলায় বাবা আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে গ্রামে চলে যেতেন, রাতের বেলায় খোল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আমাদেও বিভিন্ন তারকা ও তারকামণ্ডলী চেনাতেন। বাবার কাছথেকেই আমি সেই ছোট বেলাতেই ধ্রুবতারা, শুকতারা বা সন্ধ্যাতারা, সপ্তর্ষীমণ্ডল, লঘুসপ্তর্ষীমণ্ডল, কালপুরুষ ক্যাসিওপিয়া .. .. এদের চিনে ফেলেছিলাম। বাবা রাতের খাবারের পর খোলা আকাশের নীচে মাদুর পেতে বসতনে, আর আমরা ভাইবোনেরা তাঁকে ঘিরে বসতাম, বাবা আমাদের রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প শোনাতেন, এমন কি অভিনয় করেও দেখাতেন; কোনকোন দিন হাতের কাজ সেরে মা’ও আমাদের গল্পের এই বৈঠকে যোগ দিতেন। মার কাছে আমরা পুরাণ-পাচালী আর ঠাকুরমার ঝুলির গল্প শুনতাম। প্রায় সাড়ে ৯টা পর্যন্ত গল্পের বৈঠক চলত। এরপর বাবা গভীর রাত পর্যন্ত ওকালতির কাজ করতেন। কিন্তু প্রতিদিনই ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে প্রাত:ভ্রমনে বেরিয়ে পড়তেন। এই ছিলেন বাবা।

আগেই বলেছি যে তিনি ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন, কিন্তু গোঁড়া বা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। বাবার এক অকৃত্রিম বন্ধু ও সহপাঠী, ছিলেন মুসলিম। বাবার সাথে একই স্কুল থেকে এবং একই বছরে এন্ট্রান্স পাশ করেছিলেন, কিন্তু পরে আর পড়াশুনা চালাতে পারনে নি। কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট, পরিবারের ছিলেন বিশেষ বন্ধু। আমাদের বাসায় প্রায়ই আসতেন। আমরা তাঁকে ছোটবেলা ডাকতাম ‘সখিবাবা’ বলে। প্রতি পূজোতে মার জন্য শাড়ি, আর আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন জামা-কাপড় ও নানা উপহার। আমর বেশ ক’বার তাঁর গ্রামের বাড়ীতে গেছি রোজার ইদে নিমন্ত্রিত বিশেষ অতিথি হিসেবে। তিনি চমৎতার সুসজ্জিত গরুর গরুর গাড়ী পাঠিয়ে দিতেন ইদের দু’একদিন আগে। মা-বাবাসহ আমরা সখিবাবাবর বড়ীতে ৪-৫ দিন কাটিয়ে আসতাম, চমৎকার ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা নিয়ে। বাড়ীতে পৌঁছান মাত্র ‘সখিমা’ আমাদের প্রত্যেকের চিবুক ধরে চুমু খেতেন আর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতেন। মাকে অনেকক্ষণ ধরে বুকে জড়িয়ে রাখতেন, পরে হাত ধরে অন্দর মহলে নিয়ে যেতেন।

 

সন্তান বৎসল পিতা

প্রথম দিকে বাবা কিছুটা বিবেকান্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন বিশেষ করে তাঁর মানবিক  ও সাম্যবাদী দর্শনে এবং রামকৃষ্ণ মঠের সামাজিক কাজ কর্মের সাথে আজীবন সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পরে, চল্লিশের দশকের শেষ দিকে তিনি পাবনায় অনুকুল ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত সৎসঙ্গ আশ্রম ও সৎসঙ্গ আন্দোলনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পরেন। খুব সম্ভব ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে বাবা আনুষ্ঠাণিকভাবে ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের হাতে সৎসঙ্গে দীক্ষা নেন এবং সৎসঙ্গ অন্দোলনে নিজেকে বলা যায় আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। শিগ্গীরই তিনি দিনাজপুর জেলা পর্যায়ে একজন নেতৃত্বস্থানীয় সৎসঙ্গীতে পরিণত হন (ঋত্ত্বিক) এবং দিনাজপুর জেলার নানা স্থানে সৎসঙ্গ আশ্রম প্রতিষ্ঠায় অনবদ্য অবদান রাখেন। বাবার এই আচরণে মা ব্যথিত হতেন, কারণ এর ফলে বাবার ব্যবহারজীবী পেশায় প্রভাব পড়েছিল। বাবা তখন থেকেই মাছ-মাংসসহ সব ধরনের আমিষ খাদ্য বর্জন করে পুরোমাত্রায় নিরামিষ ভোজীতে পরিণত হলেন যে অভ্যাস তিনি আমৃত্যু অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। বিভুতি কাকু বাবাকে ঠাট্টা করে বলতেন, ‘তুমি শেষতক তৃণভোজী ছাগলে রূপান্তরিত হলে’। বাবা হাসতেন।

 

বাবা তাদের সন্তান-সন্ততিদের খুব ভালবাসতেন, তবে পড়াশুনারে ব্যাপারে ছাড় দিতেন না। দাদা এর জন্য বাবার হাতে বেশ মার খেতেন, অথচ দাদা খুব মেধাবী ছাত্র ও খেলাধুলায় চৌকস ছিলেন। আমার শরীর দুর্বল ও রোগাপটকা থাকায় বেশি মার খেতে হয় নি, মা প্রায় এসে তাঁর দুর্বল ছেলেকে রক্ষা করতেন, বাবা তো কন্যা অন্ত প্রাণ, ও কেন মার খাবে ? বাবা কিস্তু পুত্রদের কৃতিত্ত্বে খুব গৌরব বোধ করতেন। দাদা যেবার খড়গপুর আইআইটি থেকে খুব ভাল ফল করে বি.টেক (অনার্স) ডিগ্রী লাভ করল (১৯৫৫), পুত্রকে টেলিগ্রাম করে অভিনন্দন জানালেন বাবা, আমার বাবা। আর এরও কয়েক বছর পরে, রাশিয়া থেকে যখন দাদা ওয়েল ও ন্যচারাল গ্যাসের ওপর উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরলেন, সাথে রুশদেশী অপূর্ব সুন্দরী পুত্রবধূকে নিয়ে বাবার আনন্দ দেখে কে? পরদিন বাবা বার লাইব্রেরীতে পুত্রের কৃতিত্বে সহকর্মীদের আপ্যায়ন করেছিলেন। দাদা যখন ইণ্ডিয়ান অয়েল এণ্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশনে পাঞ্জাবে চাকুরী ফেলেন, বাবা ছুটে গিয়েছিলেন পাঞ্জাবে নববধূকে আশীর্বাদ করতে। আমার ম্যাট্রিকুলেশন পাশে বাবা আমাকে ‘শেফার্স’ ঝর্ণাকলম দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন – এই উক্তি কওে, ‘এখন থেকে দোয়ত-কলম পরিত্যাজ্য, এই পেন দিয়েই লিখবি। আমি আনন্দে আত্মহারা। আর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে ‘বি.এসসি’ (অনার্স) পাশ করলে বাবা চিঠি লিখলেন অভিনন্দন জানিয়ে, ইংরেজীতে। অবাক হয়ে দেখলাম আমার নামের শেষে লিখেছেন  – ‘B.Sc (Hons)’  । আমি আনন্দাপ্লুত। তারপর যখন ‘Ph.D’ ডিগ্রী পেলাম বিলেত থেকে, বাবা টিলিগ্রামে অভিনন্দন জানাল, ‘Hearty congratulation, my boy on your brilliant success ‘ । এমন না হলে বাবা।

তারপর, বাবা একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন অনন্ত লোকে, বলা যায় পরিণত বয়সে (৮২ বছর), ১৯৮৩ সালে ১৪ই জানুয়ারীতে (বাংলা ২৯শে পৌষ, ১৩৮৯)।

বাবা দিবসে তাঁকে স্মরণ করে জানাই বিনম্র প্রণতি ও শ্রদ্ধা