উৎসর্গ
নিকোলাই গোগল

একদল জানোয়ার খুন করার খুব ইচ্ছে ছিলো আমার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে উঠলো না। আপনারা অনেকেই অবশ্য এদেরকে, এই জানোয়ার গুলোকে, মানুষ বলবেন। তার পিছনে অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কারন রয়েছে, কেননা এই জানোয়ার গুলো মানুষের মতই দেখতে। আমি কেন তাদেরকে খুন করে উঠতে পারলাম না আজ আপনাদেরকে সেই গল্প শোনাবো। তবে আগে-ভাগে কিছু কথা বলে রাখি। গল্প ঠিক কিভাবে বলতে হয় আমার তা জানা নেই। আমি আমার জীবনে কোনোদিন গল্প লিখিনি। আরা তাছাড়া আমার ভাষার জ্ঞান খুবই কম। আমার বানানের ঠিক-ঠিকানা নেই, শুদ্ধ আর সুন্দর বাক্য কিভাবে লিখতে হয় আমি জানিনা, আর বাঙলা ব্যাকরন তো আমি বুঝিই না। তবে আমি চেষ্টা করবো সুন্দরভাবে আমার গল্প আপনাদেরকে বলতে, তবে তা কিছুটা খাপছাড়া-খাপছাড়া হবে। অনেকদিন কিছু পড়িনি। স্কুলের থেকে যা মনে আছে তার ভিত্তিতে লিখে যাবো, তারপর যা হবার হবে। আশা করি আপনারা জেনে অবাক হবেন যে আমার মতো মানুষও দুনিয়ায় আছে। আসলে আমার মতো মানুষ আপনারা দেখেছেন, কিন্তু দু’দণ্ড সময় পাননি আমাদেরকে নিয়ে ভাবতে। কষ্ট করে আর ভাবতে হবে না, আমি চেষ্টা করবো আপনাদেরকে একটু নতুন কিছু দিতে।
উপরের কথা গুলো শোনার পরেও যেহেতু আপনাদের আগ্রহ আছে, সেহেতু আমি তাহলে শুরু করছি। যখন ছোটো ছিলাম তখন ভাবতাম যে যদি কখনো কোনো কঠিন রোগ হয়, আর বাঁচার যদি কোনো সম্ভাবনা না থাকে, তো কিছু খারাপ মানুষ মেরে মরবো। আমি বেশ কিছুদিন হলো এইডসে ভুগছি। কেনো আমার এই রোগ হয়েছে আমি সেই কথায় যেতে চাই না। আপনারা, যারা এখনও মানুষ আছেন, তারা জানেন যে কারো এই রোগ হওয়া মানেই সে খারাপ মানুষ না। অবশ্য আমি মানুষ ভালো না। আমি আপনাদেরকে আমার এই কাহিনী শুনিয়ে নিজেকে ভালো মানুষ সাজাতে চাইনা। আমার সে’রকম কোনো ইচ্ছে নেই। আমি আমার গল্প বলছি কারন কেনো যেন আমার বকবক করতে ইচ্ছে করছে আজ খুব। আমি যে কতটা খারাপ মানুষ তা বোঝার সময় আপনারা পাবেন, যথেষ্ট সময় পাবেন। মানুষ যখন মরার কাছাকাছি চলে আসে তখন মনে হয় তার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। সে মনে করে মরনাপন্ন মানুষের কথা অন্যরা মন দিয়ে শুনবে। আমার অবশ্য জানা নেই যে একজন মৃতপ্রায় মানুষের কথার কতটা মূল্য থাকতে পারে, বা কোন মুল্য থাকা উচিৎ কিনা। আমি আমার স্কুল জীবনে কোনোদিনও ঠিকমতো একটি রচনা লিখতে পারিনি, অথচ আজ লিখতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। ভালই লাগছে এক প্রকার বলা যায়। তবে ভালো লাগছে দেখেই যে হাজার হাজার শব্দ লিখে যাব তা না। আমি অতটা বেরসিক মানব না। তাড়াতাড়ি শেষ করবো বলে আশা করছি।
আমি আজ সকালে বাড়ির থেকে বের হওয়ার আগে এক টুকরো কাগজে বারোজন জানোয়ারের নাম লিখেছিলাম। আমাদের এই শহরটা আমার বিশ্বাস এদেরকে মারতে পারলে বেশ কিছুদিন ভালো থাকতো। আমি যেহেতু এদেরকে মারিনি, সেহেতু আমি তাদের নাম বলতে যাচ্ছিনা। আর এদেরকে আপনারা সবাই চেনেন। আমার কাছের থেকে শোনার কিছু নেই। এরা অনেকেই আপনাদের বাপ-চাচা, মামা-খালু, ভাই-শালা, বা এইসব সম্পর্কের সমান-সমান নারীদের মধ্যে যারা আছে। এদেরকে আপনারা খুব ভালো করেই চেনেন। এরা আমাদের সবার এলাকাই আর সবার জীবনেই আছে। যাহোক, আজ সকালে যখন বাড়ির থেকে বের হবো এমন সময় একটা গায়ে ঘা ভরা খোড়া কুকুর আমারে দেখেই কেই কেই করে উঠে। আর তাই পুরানো অনেক কথা মনে পড়ে যায়, যার কারনে একদল মানুষ খুন হওয়ার থেকে বেঁচে যায়। কুকুরের কেই-কেই করার সাথে মানুষ খুন হওয়ার কি সম্পর্ক? আছে রে ভাই, আছে রে বোন, আছে! সেই কাহিনিই তো শোনাবো।

এই যে চুরি-চামারি আর ধান্দাবাজি করে একটা তিনতলা বাড়ি বানিয়েছি তার পিছনেও আমার একটা জীবন ছিলো। চুরি চামারির আগে আমার পকেট ছিলো ভাগ্যহীন ভিখারির থালার মতো শূন্য। আমার বাপ কে ছিলো কে জানে। মা বলে সে একজন রিকশা চালক ছিলো, কিন্তু আমার মনে হয় আমার মা বেশ্যা ছিলো, আর তাই আমার যে বাপ কে ছিলো তা মারও জানার কথা না। আমার এমন মনে হওয়ার পিছনে অনেক কারন রয়েছে যা শুনে আপনাদের কোনো লাভ নেই। আমার কোনো কথা শুনেই আপনাদের কোনো লাভ নেই, তারপরও এই পর্যন্ত যখন এসেছেন আরো একটু এগুলে ক্ষতি কি-ই বা এমন হবে! আপনি ভালোই জানেন আপনার মতো এতো ভালো সময় নষ্ট করতে আর কেউ পারেনা। আপনারা সময় নষ্ট করতে ওস্তাদ। আমি তা জানি। আর সেটাই আমার ভরসা।
যা বলছিলাম। আমার তখন বয়স কতো আর হবে। ২২ কি ২৩। এর বেশি না। মালিকের রিকশাটা চুরি করে বেঁচে দেওয়ার পরে আমারে আর কেউ দিনচুক্তি রিকশা ভাড়া দিচ্ছিলো না। তাই বাধ্য হই কুকুর মারার কাজ নিতে। ভাগ্যক্রমে তখন ছিলো শীতকাল। এরকম একটা কাজ যে ছিলো তা আমার জানা ছিলোনা। মাঝে মাঝে অবশ্য আমি রাস্তার পাশে মরা কুকুর পড়ে থাকতে দেখেছি, কিন্তু আমি খেয়াল দিইনি। যাহোক, কুকুরের লাশ প্রতি ২০ টাকা। আমারে কাজটা দেয় আমাদের এলাকার লিয়াকত আলি। সে যাচ্ছিলো তার মেয়েরে দেখতে ফরিদপুর। আমারে বলে, “তুই শুধু মারবি আর গাদা দিবি। অন্যদের সাথে তোর কথা বলার দরকার নেই। শুধু বলবি আমার সাথে কথা বলতে যদি তাদের কিছু বলার থাকে। আমি ফিরে আসার পরে সব দেখবো।” আমি তাড়াতাড়ি একটা হিসেব করে ফেলি। দিনে যদি ২০ টা কুকুর মারতে পারি তো ৪০০ টাকা। ৪০ টাকা দিয়ে সন্ধ্যায় দু’টো মাগী লাগানো, আর ৬০ টাকায় এক বোতল মালের লোভ কে সামলাতে পারে? মা-রে ৫০ টাকা দিলেও হাতে থেকে যায় আরো ২৫০ টাকা, দিনপ্রতি। ৯০-এর শুরুর দিকে এটা ছিলো বিশাল টাকা। আমার মতো লোকেদের জন্য রাজকীয় ব্যাপার। আমি কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে যাই। টাকা, আর টাকা জমানোর দিকে আমার সব সময় একটা খেয়াল ছিলো। প্রচন্ড খেয়াল।
লিয়াকত আলি আমার মাথায় হাত রেখে বলে, “বাবা, কোনো কুকুর যেনো আধমরা অবস্থায় ফেলে রেখে আসিস নে। ওরা যতোক্ষন বেঁচে থাকে গালাগালি দেয়। অবলা জীব। ওদের গালাগালি লাইগে যাতি পারে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি এক ঘায়ে মারতে পারিস। তোরে অভিশাপ দেবার কোনো সুযোগ-ই দিবিনে। ঠিক আছে? বুঝলি তো? এক ঘায়ে শেষ।”

আমি মাথা নাড়ি। সে বোঝে যে আমি বুঝেছি।

সেই থেকে শুরু হয়ে যায় আমার কুকুর মারার জীবন। আমি আমার কাজে এতো পটূ হয়ে উঠি যে আমি পাঁচ বছর এই কাজ করি। পাঁচ বছরে আমি কুকুর মারি ৮৩৬৭ টা। কুকুর মেরে কামাই করি লাখ টাকার উপরে। আমার মতো আরো বেশ কিছু লোক ছিলো যারা কুকুর মারতো। আমার মনে হয় অন্যরা ভোরে ঘুমের থেকে উঠে একবার বউ লাগিয়ে নিতো। কারন অন্যরা আসতে আসতে আমি ২৫-৩০ টা ফেলে দিতাম। অন্যরা ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতো এক জায়গাই, আর আমি কুকুরের মতো ছুটে বেড়াতাম। অন্যরা এক জায়গায় কুকুর মারতো প্রতিদিন। কুকুর ওদের দেখলেই ভয়ে পালাতো দূর থেকে। আমি এক জায়গায় মারতাম ৬-৭ দিন পরপর। কুকুরেরা অন্যদের গায়ের গন্ধ পেতো দূর থেকে। আমি কসাই-এর কাছ থেকে রক্ত নিয়ে সারা গায়ে মেখে আসতাম, কাজেই আমার গন্ধ তারা ঠিক মতো পেতো না। আর যে কুকুর আমারে দেখতো আমি তারে না মেরে ছাড়তাম না। প্রথম সপ্তাহেই আমি কুকুর মারি ২৪৪ টা। আমার কাজের চার বছরের মাথায় শহর কুকুরহীন হয়ে পড়ে। আমি আশেপাশের গ্রামের থেকে গোপনে মরা কুকুর কিনতে শুরু করি, মাথা প্রতি পাঁচ টাকায়। কিন্তু তার পরের বছর ধরা পড়ে যাই। ঐ লিয়াকত আলিই আমারে ধরায়ে দেয়। শালার ছোটো মেয়েটা একদিন আমার কোলে উঠে চরম আদর খাচ্ছিলো দেখে চরম ক্ষেপে গিয়ে বুড়ো এই কাজ করে। আরে কোলে লাফ মেরে উঠলে সেই মাছ কি কেউ আর ছাড়ে? আমিও ছাড়িনি। আপনারাও ছাড়তেন না। আমি বাজি ধরে বলতে পারি। মাফ করবেন। অনেক সাহস দেখায়ে ফেললাম। মাফ করবেন।

তখন আমি কুকুর মারছি প্রথম প্রথম। একটা যুবক কুকুর, কুকুরের জগতে তার বয়স আমার মতোই হবে হয়তো, অন্য এক বুড়ো কুকুরের তাড়া খেয়ে আমার সামনে এসে পড়ে। আমি ঠপাত করে শালার মাথার ডান পাশে মারি এক বাড়ি। বাড়ি লাগার ঠিক আগে কুকুরটা আমার দিকে তাকায় এমন একভাবে যে আমার কলিজা কেঁদে ওঠে, কিন্তু তখন আমার লোহার মাথাওয়ালা মুগুর আর থামাতে পারে কে? এক বাড়িতে যা হওয়ার তাই হয়। কুকুরটার হলুদ ঘিলু ছিটকে বের হয়ে যায় অথচ তার শরীর তখনো দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্যু এসে যায় শরীর ধ্বসে পড়ার আগে। এমন দৃশ্য তার পরে আমি অনেক বার দেখেছি। কিন্তু ঐ প্রথম দৃশ্যটা আমার মনে এখনো লেগে আছে। ঐইদিন রাতে আমি আমার জীবনে প্রথম চার মাগি নি। সে কি খেলাই না খেলি। যাহোক সে কাহিনি বলে আপনাদের কাপড় নষ্ট করতে চাইনা। ওদেরকে আমার মনের কথা বললে, ওদের একজন বলে, “থাক আর বলার দরকার নেই। এদিকে কিন্তু ঠাকুর নরম মেরে যাচ্ছে।”

আমি সপাটে মেয়েটাকে একটা চড় মারি। চড় খেয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়। ঐদিন রাতে আমার তার জন্যেও খারাপ লাগে।
পরে, রাতে, মাল গেলার সময় এক বন্ধু বলে, “তুমি কিন্তু শালা মরেছো। তুমি ম্যাদা মারা কিছু কাজ আজ করেছো। এভাবে চললে কিন্তু তুমি শেষ হয়ে যাবা।”
“নাহ, আজ মনটা ভালো নেই।”
“শালা ফকিরের বাচ্চা, আমাদের আর মন কিরে? এসব কথা তুমি পাউ কোথার থেকে? ছয় ক্লাস পর্যন্ত পড়েছো তার শোনান দেও নাকি?”
“আরে বাদ দে। চল ডবল লাগায়ে আসি। আজ মনটা বেজায় খারাপ। চল ভালো করে আসি।”
“এইবার তুমি ভালো কথা একখান বলেছো। চলো যাই নতুন খুকিটারে একটু ঠাকুরে চড়ায়ে আসি। একটা খুকি এনেছে, কিন্তু টাকার জন্য পারছিলাম না। তুমি নিয়ে যাচ্ছো যখন টাকাটা দিয়ে দিয়ো। ঠাকুর খালি থাকলেই মন খারাপ থাকে বুঝলে। এটা মনে রাখবা। এটাই সব কিছুর মুলে। আমার কথা তোমার মনে আছে দেখে আমার ভালো লাগছে। চলো যাই।”
কুকুর মেরে মেরে, আমার নাম-ডাক ছড়ায়ে পড়ে। আমি দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই কুকুর মেরেছি। আমারে ডাকায়ে নিয়ে যেতো। ভালো খাওয়া আর ভালো টাকাও দিতো। আমিও যেতাম। দেশের বিভিন্ন এলাকার মাগিদের সাথে করার একটা ইচ্ছে আমার সব সময় ছিলো। আমি কুকুর মেরে তা মেটানোর সুযোগ পাই। আমি লিখছি আর ভাবছি যে ঐ কুকুরগুলো যদি আমারে নিয়ে লিখতে পারতো তো তারা কি লিখতো? কি বলতো? তাদের সে কাহিনি কেমন হতো? আমার সম্পর্কে তাদের কি কি বলার থাকতো? মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমি কুকুর খুব ভালোবাসি, মানে আমার একটি পোষা কুকুর ছিলো, মানে এখনও আছে। আমি কুকুর মারা টাকা দিয়ে আমার কুকুরটার জন্য ভোর বেলাই কসাইএর দোকান থেকে ছাট কিনে আনতাম, এখনও আনি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কুকুর মারতে মারতে আমার মাথা আওলাইয়া গেছে। এতো কুকুর মারলে কারো মাথা আওলাইয়া না যেয়ে পারে? মানে, আমরা, আমাদের মতো লোকেরা বলে যে আমাদের মতো লোকেদের দয়া-মায়া না থাকা খুব জরুরি। আমিও তাই মনে করি। আমি মনে মনে সারাদিন এই কথা জপি। কিছুটা শান্তি আসে আর কি।
কুকুর মেরে বাড়িতে এসেই আমি তিন ঘন্টা মতো ঘুম দিয়ে অন্য ধান্দায় যেতাম। টাকার আমার খুব দরকার ছিলো। টাকার কার না দরকার থাকে? আমি প্রতি রাতে হোটেলে খেতাম, আর মা-র জন্য বাড়িতে খাবার নিয়ে যেতাম। মারে বলতাম রান্না আর না করতে, কিন্তু আমার কথা সে কোনদিন শোনেনি। যাহোক একদিন রাতে, আমার কুকুর মারা জীবনের তিন নম্বর বছরে, অন্য সব রাতের মতো হোটেলে খাচ্ছি। এক পর্যায়ে মালিক এসে বললো, “ভাই আসেন। আমার অফিসে বসে খাবেন।”
আমি বললাম, “আপনিই এখানে বসেন। কিছু বলবেন?”
“এখানে বলা যাবেনা। ভিতরে আসেন।”
আমি তার পিছন পিছন থাল হাতে করে তার অফিসে গেলাম। যে আমার গোসের আর তরকারির বাটি বয়ে নিয়ে গেলো। ভিতরে ঢোকার সাথে সাথেই সে বললো, “আপনি তো ভাই আমাদের অনেক ক্ষতি করে দেচ্ছেন।”
“আমি? কিভাবে বলেনতো ফরিদ ভাই?”
“মানে আপনিও যখন আমার মতো অন্ধকার জগতের মানুষ আপনারে বলতে অসুবিধা নেই। আপনি যে আমার গোসের বাজারে আগুন লাগিয়ে দেছেন। মানে কুকুরের গোসতো আমার এখানে আমি চালাতাম। ধরেন ৩৫% গোস হলো কুকুরের। আর এদিকে আপনি তো টাউন খালি করে ফেলছেন। আমার আর আমাদের মতো লোকেদের কি হবে?”
“মানে আমার এই বাটিতে ৩৫% কুকুরের গোস?”
“হ্যাঁ।”
“বলেন কি?”
“আপনি অবাক হন কেনো? যাহোক, আপনারে আমি যে জন্য ডেকেছি তা হলো একটা মানুষ মেরে দিতে হবে।”
“ফরিদ ভাই, আমি মানুষ খুন করিনা পেটের টানে কুকুর মারি।”
“আহা আগের থেকে না করবেন না। আমি আপনারে মাথা প্রতি দু’লাখ করে দেবো।”
“দুই লাখ? মাথা প্রতি? তার মানে আমারে একজনের বেশি মারতে হবে?”
“ঠিক তাই। আপনি লাশ ফেলে দেবেন আর আমি আপনার হাতে দু’লাখ করে ফেলে দেবো। কথার হেরফের হবেনা।”
“ভেবে দেখি।”
“আগামীকাল জানাবেন। আর আমার এই হোটেল আজকের থেকে আপনার জন্য ফ্রি।”
আমি আর কোনোদিন ঐ হোটেলে যায়নি। কুকুর মারা আর মানুষ মারা আমার এক মনে হয়নি। কিন্তু এখন মনে হয় আমি ভুল করেছি। কুকুরা মারা ছেড়ে আমার মানুষ মারা শুরু করার দরকার ছিলো। মানুষ কুকুরের থেকে অনেক খারাপ এক জন্তু। আমার কাহিনি শুনেই তা হয়তো কিছুটা বুঝতে পারছেন। আমি যদি ৮৩৬৭ টি কুকুর না মেরে ৮৩৬৭ টি খারাপ মানুষ মারতাম তো আমাদের দেশটা একটু ভালো থাকতো হয়তো। কিন্তু আজ সকালে আমার চিন্তা পাল্টে গেছে। কেনো তা একটু পরে বলছি।
মাঝে মাঝে যে লোক কুকুর গুনতো সে আসতে দেরি করতো। তাই আমারে প্রায় আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। ভোর বেলায় কিছু ছেলেপেলে স্কুলে যেতো। আমি তাদের সামনে কুকুরের মাথা ফাটাতাম। ভয়ে চিৎকার করতে থাকা বাচ্চাদের দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। একবার এক ছেলে যাচ্ছে, আর আমি তার সামনেই ফাটালাম এক কুকুরের মাথা। কুকুরটা পনাৎ করে ঘুরে কেই কেই করতে করতে ছেলেটার পায়ের উপরে গিয়ে পড়ে। ছেলেটার জুতোই আর প্যান্টে রক্ত আর ঘিলু লেগে যায়। ছেলেটা মুতে দেয়, আর তার পরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কিছুদিন পর ছেলেটা মারা যায় বলে শোনা যায়। তারপরের থেকে আমি আর কোনদিন কারোরে ভয় দিইনি। আমার একটু খারাপ লেগেছিলো। এতো নরম বাচ্চা পৃথিবীতে বেঁচে থাকে কি করে? এদের মা-বাপ কারা? তারা তাদের বাচ্চাদেরকে এই দুনিয়ায় টিকে থাকার জন্য কি কিছুই শিখায় নি? আসলে কুকুর মারতে আমার খুব ভালো লাগতো না মনে হয়। এখন যখন চিন্তা করি আমার মনে পড়ে আমি কখনো কুকুরের চোখের দিকে তাকাতাম না। আর আমি কাজ করতাম ভোর রাতে অন্ধকারে মনে হয় ঐ জন্যই। আর শিতের যে সকালগুলোতে কুয়াশা থাকতো সে সকাল গুলো আমার খুব প্রিয় ছিলো। নিজেকে আল্লাহ-টাল্লাহ বলে মনে হতো। কুকুর ঘাপটি মেরে বসে আছে, আর আমি কুয়াশার থেকে যাদুর মতো বের হয়ে এসে দিতাম মাথায় এক বাড়ি, আর সব শেষ। অধিকাংশ সময়ে এক বাড়িতেই আমি কাজ শেষ করতাম। লাফঝাপ বা ছটফট করতে থাকা কুকুর দেখতে আমার ভালো লাগতো না। মনে মনে বলতাম, “আমাদের দয়ামায়া থাকতে নেই। আমাদের দয়ামায়া থাকতে নেই। আমাদের দয়ামায়া থাকতে নেই।” ভাবতাম আর দিতাম বাড়ি। তারপরও মাঝেমাঝেই দুই-তিন-চার বাড়ি দিতে হতো। বুড়ো কিছু কুকুর ছিলো শালারা এক বাড়িতে মরতোনা। আমার একবার এক গায়ে ঘা আলা বুড়ো কুকুর মারতে এগারো বাড়ি দিতে হয়েছিলো। এগারো বার বাড়ি দেবার আগে মনে মনে বলেছিলাম, “শালা বারো বাড়ি যদি দিতে হয় তো কুকুর মারার কাজ আজ ছেড়ে দেবো। আমি ছিলাম সেরা কুকুর ঘাতক। এগারো বাড়ির ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেই নিজেকে খুব লজ্জায় ফেলে দেয়। আমার মতো লোকের কেনো এগার বাড়ি লাগবে একটা কুকুর মারতে?” আর সবচেয়ে সহজে মরতো চ্যাংড়া কুকুরগুলো। তাদের ভাব ছিলো খুব ডাটের, কিন্তু একবাড়িতেই শেষ হয়ে যেতো। অন্যরা কুকুর মারার প্রাকটিস করতো বাড়িতে। শুনেছি তারা নাকি কলা গাছে বাড়ি দিয়ে দিয়ে প্রাকটিস করতো। আমার অবশ্য প্রাকটিসের দরকার পড়েনি কখনো। আমি শুরুর থেকেই কুকুর মারার ওস্তাদ ছিলাম। অনেকেই আমারে বলতো কুকুর মারার জন্যি নাকি আমার জন্ম হয়েছে। আমার খুব গর্ব হতো। তবে একবার এক কুকুরের মাথায় বাড়ী দিতেই একটা চোখ বের হয়ে এসে আমার উলের জামার সাথে লেগে যায়, বুক-পকেটের কাছাকাছি। চোখটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি হাত দিয়ে সরাতে গিয়েও পারিনা, আমার হাত উঠতে চায়না। আমি ঐদিনের পরে আর কোনোদিন কোনো কুকুর মারিনি। জানতাম আমাদের দয়ামায়া থাকতে নেই, কিন্তু আমার ভিতরে কিছু দয়ামায়া ছিলো। কিভাবে ছিলো কে জানে! এই কঠিন দুনিয়ায় আমার ভিতরে এই দূর্বলতা কিছুটা ছিলো, আর সেটাই সত্য। মরার আগে মিথ্যে বলে বা নিজেকে হিরো সাজায়ে কী লাভ?

আমি একটু বিস্তারিতো বলি আমি কিভাবে কুকুর মারতাম। আর তো বলার সুযোগ পাবোনা। তাই আমার জন্য আর একটু সময় নষ্ট করুন।
১। আমি আমার এই কাজটাকে দেখতাম রাতের কাজ হিসেবে। আমি রাত তিনটা তিরিশ মিনিটে শুরু করতাম, আর ছ’টা বাজার আগেই আমার কাজ শেষ হতো। আমার সবচেয়ে খারাপ লাগত কুকুর মারার পরে তাদের ঠ্যাং ধরে যখন টেনে নিয়ে যেতে হতো এক জায়গায় গাদা মারার জন্য। আমার সময় নষ্ট হতো এতে খুব। ওটা না করতে হলে আমি আরো বেশি কুকুর মারতে পারতাম। ১০,০০০ মারার আমার খুব ইচ্ছে ছিলো।

২। আমি আমার জীবনে কোনো দিন কাজ যেতে ফেল মারিনি। আমার কাজে আমি জীবনে কখনো ফাকি দিইনি। আমি কাজে যেতে জীবনে কোনোদিন দেরিও করিনি। এটা আমার মধ্যে ছিলো না। আমি ছিলাম কাজ পাগল এক মানুষ। আমি বাড়ির থেকে বের হওয়ার সময় একটা টার্গেট নিয়ে বের হতাম ঐ দিন কতটা মারবো তার টার্গেট।

৩। প্রতিটা কুকুর মারার সময় আমি আমার বাপের কথা মনে করতাম, আর দিতাম বাড়ি। রাগের ঠেলায় বাড়িগুলো যা হতো না! শালা এক বাপের উপরে ক্ষেপে হাজার হাজার কুকুর মেরেছি। অন্য কুকুর মারাদের আমার মতো বাপ ছিলো না বোধহয়, তাই তারা আমার মতো কুকুর মারতে পারেনি। আমিই ছিলাম শ্রেষ্ঠ। আমিই শ্রেষ্ঠ।

৪। কুকুর মারা একটা চর্চার ব্যাপার, যা দিনের পর দিন ধরে গড়ে ওঠে। এটা একটা নিশার ব্যাপার। একটা দায়িত্বের ব্যাপার। আমার এ-সবই ছিলো। আমার ছিলো তার কারন আমার মতো জায়গার থেকে যারা উঠে আসে, তাদের কিছুটা হিংস্র হতে হয়। তাদের কিছুটা অমানুষ হতে হয়। আর আমাদের মতো আমরা সবাই জানি যে আমাদের একমাত্র সম্বল আমাদের নির্দয় পরান। লাথি ঝাটা খেতে খতে আমি খুব ছোটবেলাই তা শিখে ফেলেছিলাম। কী আর করা?

৫। টাকার আমার দরকার ছিলো। উপরে উঠার আমার খুব ইচ্ছে ছিলো। আমি লাল পানি খেয়েছি অনেক, কিন্তু অন্য কোনো মাদক আমি ছুয়েও দেখিনি। আমি যাদেরকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলাম, তাদেরকে আমি মাদক কিনে দিয়েছি, আর তারা আনন্দে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি কুকুর মেরেছি উপরে উঠার জন্য। অন্য কিছু না। কেউ মানুষ খুন করে। কেউ রাজনীতি করে। কেউ ধর্মের ব্যাবসা করে। আমি শুধু কুকুর মেরেছি।

এবার একটু বলি কুকুরগুলো কীভাবে মরতো সেই সব কিছু কথা। গল্পের পূর্নতার জন্য মনে হয় এটা বলা প্রয়োজন। আপনারা গল্প পড়া মানুষ আপনারা আমার থেকে বুঝবেন বেশি হয়তো।

১। কোনো কোনো কুকুর বাড়ি খাওয়ার পরে পণ পণ করে ঘুরতে থাকতো। এই কুকুরগুলো কেই কেই করতে ভুলে যেতো। তারা কোনোও রকম শব্দ না করেই শেষ।

২। কিছু কুকুরের মাজা ভেঙে নিতাম আগে যদি ঠিক পজিশন মতো বাগে না পেতাম। তারপর মাথায় বাড়ি আর সব শেষ। এই কুকুরগুলো বেঁচে থাকার চেষ্টা করতো। সামনের দু’পা দিয়ে পিছনের অর্ধেক টেনে নিয়ে যেতো আর কেই কেই কেই করতো, পালাতে চেষ্টা করতো। ঠপাঠপ কিছু বাড়ি আর সব শেষ।

৩। কিছু কুকুরের মাথায় বাড়ি দেয়ার পরে ভন করে তারা একদিকে সরে গিয়ে ধপাৎ করে পড়ে যেতো। আর মরার আগ পর্যন্ত পিছনের দু’পা দিয়ে মাটি খুঁড়তো। মজার ব্যাপার হলো কিছু কুকুরেরা কুকুরের মরা দেখার জন্য দাড়িয়ে থাকতো। আমি অবাক হতাম। তবে মানুষও কিন্তু এমন করে বলে শুনেছি।

৪। বুড়ো কুকুর গুলো মরতে দেরি করতো। শরীর নাড়াতে পারতো না, কিন্তু মরতে চাইতো না সহজে। আর চ্যাংড়া কুকুরগুলো মরতো বাড়ি দেয়ার সাথে সাথে। আমি মনে হয় আগেই আপনাদেরকে এই কথা বলেছি। এর মধ্যে কি যেনো একটা আছে। এটা আমার মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিলো যা এখনও আছে।

৫। মাদি কুকুরগুলো মারার পরে বাচ্চাগুলো ছড়িয়ে পড়তো চারদিকে। আমি ওগুলোর দিকে কোনো খেয়াল দিতাম না। বাচ্চাগুলোর বেঁচে থাকার ইচ্ছে দেখতে আমার ভালো লাগতো। থাকুক কিছুদিন, তারপর তো যা তা-ই হবে। ধুকে-ধুকে না খেয়ে নাকের আর মুখের থেকে লালা ঝরতে ঝরতে মরা। এটা কে না জানে? তাই আমি তাদের দিকে খেয়াল দিতাম না।

একটা আজব গল্প বলি। গল্পের মধ্যে গল্প আরকি। আমার মনে আছে একবার এক বুড়ো ভিখারি আমারে বলে, “ভাইজান আপনি কুকুর মারা লোক না?”
“না।”
“না! আমি ভাইজান আপনারে চিনি। আপনি এই বানচোদ কুকুরগুলোরে মেরে আমাদের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছেন।”
“ক্ষতি? কিভাবে?”
“পাড়ার মাগীরাও তো আমাদের করেনা। আর তাছাড়া মাগি করার টাকাও তো আমাদের নেই। একবার করতে ২০ টাকা! চিন্তা করতে পারেন। এই কুকুরগুলো আমাদের করার জিনিস। আপনি আমাদের জিনিস গুলো মেরে ফেলছেন সব। আমাদের কি হবে?”
“কী?”

“আর মাইরেন না ভাইজান। বাচ্চা দেয়া মাদিগুলোরে মাইরেন না অন্তত। ওগুলোরে করে যা আরাম ভাই! একবার কইরে দেইখেন। আর পাড়ায় যাইতে মন চাইবেনা।”

ঐ লোকটার উপরে আমার মায়া হয়। তাকে আমার আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর আর সৎ মানুষ বলে মনে হয়। তাকে আমার ভালো লাগে। সে সত্যবাদি ছিলো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে আমাদের মায়া থাকতে নেই। আমি তারে সপাট করে একটা চড় মারি। সে মাটিতে পড়ে যায়। আরে মেরেই আমি ভেগে পড়ি। ঐ শালারে আমি আর কোনোদিন দেখিনি।

যাহোক বাড়ির থেকে বের হবো এমন সময় কেই-কেই করতে থাকা কুকুরটাকে দেখে আমার মনে পড়ে গেলো এইসব কথা। আরো কিছু বলার আগে আমি সংক্ষেপে আমার জীবনটাকে একটু দেখাতে চাই আপনাদের। আমাদের মতো মানুষদের জীবন আরকি!

১। জন্মের আগেঃ আগেই বলেছি আমার বাপের ঠিক নেই। মাদারচোদ বেঁচে আছে কিনা তারও ঠিক নেই। মা বলে আমরা নাকি ফরিদপুর থেকে যশোরে আসি। আমার তা বিশ্বাস হয় না। স্মৃতিতে এমন কিছু নেই যা আমার এই বিশ্বাসের বিপক্ষে যায়। অনেক কিছুই হতে পারে। হতে পারে আমার বাপ এই শহরের কোনো ধনী লোকের পোলা। হতে পারে কোনো শালা আমার মারে ধর্ষন করেছিলো। অনেক কিছুই হতে পারে। আমার যা যা মনে হয় তার যে কোনো একটি হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এ নিয়ে চিন্তা করে কোনো কুল-কিনরা পাওয়া যাবেনা।

২। ০-১২-এর মধ্যে ছোটখাটো চুরি-চামারি করেছি। আর ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। মা বাড়ি বাড়ি কাজ করতো, আর লোকের কাছের থেকে শুনেছি আমি যখন স্কুলে থাকতাম তখন নাকি অনেক বেটা লোকেরা আমাদের ঘরে আসতো আর যেতো। ১১ বছর বয়সে আমি বিড়ি ধরি। আমার প্রথম স্মৃতিতে একটা ট্রেন যাচ্ছে আর আমি লাইনের পাশে দুই কানের মধ্যে আঙুল গুজে দিয়ে বসে আছি। আমাদের বস্তি ট্রেন লাইনের প্রায় গা লাগিয়ে ছিলো। আমি তখন ২-৩ হবো।

৩। ১৩-২২-এর মধ্যে আমি মাদক বেঁচা কেনা করেছি কিছু। মানে ফেনসিডিল সাপ্লাই দিতাম বেনাপোল থেকে যশোরে। একদিন তিন বোতল মেরে দিয়ে আমি কাত হয়ে পড়ি। পুলিশে ধরে, আমার মা আমারে ছাড়ায়ে আনে। সবাই জানে সে কিভাবে আমারে ছাড়ায়ে আনে। আমিও জানি, কিন্তু আমি তার কাছে এ-ব্যাপারে কিছু কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি। তারপর বেশকিছু কাল রিক্সা চালাই। সেখানেও রিক্সা চুরি করে ধরা পড়ি। আপনারা তা তো জানেনই।

৪। ২৩-২৭-এ আমার কুকুর মেরে পেটের ও অন্যান্ন ক্ষুধা মিটায়। এ কাহিনি তো আপনারা শুনছেনই। আমার মা আমার ২৫ বছর বয়সের সময় মারা যান। আমি তার নামে একদিন কিছু একাটা করবো। আমার ইচ্ছে আছে। তবে তাড়াতাড়ি চিন্তা করে বের করতে হবে কি করবো। এইডস তো আর কাউকে মাফ করে না!

৫। ২৮-২৯-এর মধ্যে আমি কুকুর মারা টাকা দিয়ে প্রথমে ধানের ব্যাবসা করি। তারপর এক বন্ধুর সাথে পুরোনো সাইকেল বেচাকেনার ব্যাবসায় নামি। আর তাতে আমি লাল হয়ে যাই। এই বাজারে তিনতলা বাড়ি বানানো সোজা কথা না। আমি বিয়ে করিনি। একবার পাড়ার একজনকে বলেছিলাম, “তোরে আমি বিয়ে করবো। কিন্তু আমি বাচ্চা-কাচ্চা চাইনা।” সে বলে, “তাহলে হবে কি করে?” আমি বলি, “মাগি নরকে থাকিস আবার তার মধ্যে এক বাচ্চা এনে ফেলার খায়েস আসে কোথার থেকে? আসলেই তোরা খানকির জাত খানকি।” তারপর আর কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছে হয়নি। আর এখনতো মরার কাছাকাছি।

৬। মরার পরেঃ ব্যাবসা আর বাড়িটা কার জন্যে রেখে যাবো তা নিয়ে ভাবছি। একবার ভাবি এতিম খানায় দিয়ে যাবো। আবার ইচ্ছে হয়না। শেষ পর্যন্ত হয়তো দিয়ে যাবো। দেখি আরো একটু মরার কাছাকাছি যাওয়ার পর কি ইচ্ছে হয়! এখনো ভাবছি।

৭। মরার অনেক দিন পরেঃ আমার কথা কেউ জানবেও না, অথচ আমার জন্য কতো মানুষই না জলাতঙ্কের হাত থেকে বেঁচেছে। আমার নাম না জানুক আমার মার নামটা কিছুকাল থাকলেই হবে। মহিলা অনেক কষ্ট করেছেন এই নরকে। তার জন্য কিছু আমার করতেই হবে। করবো কিছু একটা।

যাহোক বাড়ির থেকে বের হওয়ার সময় আমার মনে হলো দুনিয়াটা একটা বিশাল নরক। আগেই আমি তা জানতাম, কিন্তু আবার মনে হলো। এখানে সবাই আমার মতোই টিকে থাকার চেষ্টায় আছে। এখানে কেও দোষী না। টিকে থাকতে কে না চায়? ভালো মানুষ যে নেই তা না। কিন্তু তারা কাজের না। তারা মিন-মিনে স্বভাবের মানুষ। তারা থাকা আর না থাকা একই কথা। তারা ব্যর্থ মানুষ। আমি ব্যর্থ হতে চাইনি। আমি নরককে মেনে নিতে চেয়েছি যতটা সম্ভব। যারা আমার থেকেও বেশি মেনে নিয়েছে তারা আমার থেকেও বেশি খারাপ মানুষ। নিজেই আমি এক খারাপ মানুষ, কাজেই অন্যদের দোষ দিয়ে কি লাভ? আমরা সবাই খারাপ। কেউ কম। কেউ বেশি। নরকে কে কিভাবে টিকে থাকবে তা তার নিজের ব্যাপার। আমি আবার কে সেই সব নিয়ে চিন্তা করার? চিন্তা করার থাকলে ভালো মানুষেরা করুক, যদি কেউ ভালো থাকে। তাছাড়া একজন খারাপ মানুষ হয়ে আর একজন খারাপ মানুষকে মারি কীভাবে? এটা প্রকৃতির বিরুদ্ধে হয়ে যায়। এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই আমার আর কাউকে খুন করতে ইচ্ছে হয় না। আর তাছাড়া ১২ জনকে মেরে এই শহর হয়তো তিনদিন ভালো রাখা যাবে বড় জোর, কিন্তু তারপর আবার যা তাই হবে। নরক নরকই থেকে যাবে। এই দুনিয়াটাই হলো নরক, আর সাবাই নরকের বাসিন্দা।
শেষে বলে যেতে চাই যে আমার নাম বা আমি কোথায় থাকি তা আপনাদের জানার কোন প্রয়োজন নেই। অবশ্য আমার শহরের অনেকেই আমারে একনামে চেনে। কিন্তু আমার যা বলার আমি তা বলে ফেলেছি। কাজেই আমারে মরার আগে খুজে বের করে জ্বালাবেন না। এটা আমার অনুরোধ। শুধু এটুকু বলতে পারি, অন্য সবার মতো আমিও এই নরকের একজন বাসিন্দা। এর বেশি কিছু না। অন্য সবার মতো যে পর্যন্ত পারি জীবন ঠেলে নিয়ে যাবো, আর নরকের সেবা করে যাবো। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন! কয় জনই বা ১০০ বছর বাঁচে! এই সামান্য জীবনে চরিত্র বেঁচে দিতে পারলেই তো ভালো মতো টিকে থাকা যায়। এটাই আসল কথা। আমরা সবাই তো তাই করছি কোনো না কোনো ভাবে। শুধু যাদের বুকের পাটা আছে, আমার মতো, তারা স্বীকার করে, আর অন্যরা দিন, মাস, আর বছর পার করে দেয় কোনো না কোনো ভাবে।
অন্য সবার মতো আমিও এই নরকের একজন স্বেচ্ছাসেবক।
১৯৯৭

লেখকের ই-মেইলঃ [email protected]