বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর প্রস্তাবিত সংশোধনী পাশ করা থেকে বিরত থাকুন ।

মাননীয় প্রধান মন্ত্রী,
এদেশের গরীব, মেহনতী, নিপিড়িত, বঞ্চিত শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষ থেকে আপনাকে শত কোটি সালাম।
আপনার নিশ্চয় স্মরণ আছে যে, বিগত নির্বাচনের পূর্বে আপনার দলের নির্বাচনী ইশতেহারে আপনি শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রদান করা সহ আই,এল,ও কনভেনশনের আলোকে একটি শ্রমিক-বান্ধব শ্রম আইন প্রণয়ন করার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু আপনার সরকারের চার বৎসরের বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও আপনি বা আপনার সরকার সে অঙ্গীকার পূরণে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি। বিগত ২০১০ ইং সালের এক সংশোধনীর মাধ্যমে শ্রমিকদের চাকুরীর বয়স সীমা ৬০ বৎসরে উন্নীত করা ছাড়া শ্রমিকদের পক্ষে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ইতর বিশেষ কোন পরিবর্তন করা হয় নি। এমন কি, ২০০৬ ইং সালের ১১ ই অক্টোবরে বর্তমান শ্রম আইন পাশ হলেও অদ্যাবধি উক্ত আইনের ৩৫১ ধারা মোতাবেক কোন বিধি (Rules) প্রণয়ন করা হয় নি। ফলত: আইনের যথাযথ প্রয়োগে নানা জঠিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া শ্রমিকদের পক্ষে ভারসাম্যহীন বর্তমান আইনও মালিক শ্রেণী তোড়াই খেয়ার করছেন। ফলত: সারকা গার্মেন্টস, কেটিএস গার্মেন্টস, হামীম, তাজরিন ফ্যাশন, স্মার্ট এক্সপোর্ট, এস্পেকট্রাম প্রভৃতি গার্মেন্টস জীবন্ত দগ্ধ হয়ে কিংবা ভবন ধ্বসে শত শত শ্রমিক জীবন দিলেও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল এ সমস্ত গার্মেন্টস মালিকদের বিরুদ্ধে মাননীয় সরকার বাহাদুর উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করেন নি। এমনকি এস্পেকট্রাম এর ঘটনার পর ২০০৫ ইং সালে ড. কামাল হোসেনের এক রীটের প্রেক্ষিতে মাননীয় হাইকোর্ট শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধান সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনা জারী করলেও কি সরকার, কি মালিক, কেউ কোন নির্দেশনা মানেন নি। অথচ বর্তমান শ্রম আইনের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৬১ ও ৬২ ধারায় ভবন ও যন্ত্রপাতির নিরাপত্তা ও অগ্নিকাণণ্ড সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বেরে সুস্পষ্ঠ বিধান রয়েছে, যা গার্মেন্টস মালিকেরা মানছেন না। নির্মম ফলশ্রুততে সর্বশেষ ২৪ এপ্রিল, ২০১৩ ইং এর রানা প্লাজার মহা বিপর্যয়-এক সাথে ৪টি গার্মেন্টস এর হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন বিপন্ন হওয়ার মত মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটল অবলীলায়। এটাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। আইনের ভাষায় এটা অপরাধজনক নরহত্যা (Culpable Homicide)।ইতিহাসের একটি জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড !
মাননীয়া প্রধান মন্ত্রী,
আপনি নিশ্চয় জানেন, এ সমস্ত গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকাংশ আমাদের হত দরিদ্র পরিবারেরই নারী সদস্য। তারা কারো মা, কারো কন্যা, কারো বোন, কারো জায়া-হয়ত কারো পরিবারের শেষ অবলম্বন। কিন্তু সর্বোপরি তারা মানুষ-এদেশের নাগরিক। আমাদের সংবিধানে যাদেরকে এদেশের মালিক বলা হয়েছে, তারাও সে মালকানার অংশীদার। তাদের কাছে তাদের জীবনের মূল্যও অন্য সকলের জীবনের মত অপরিসীম। জীবিকা নির্বাহের জন্য সামান্য মজুরীর একটি চাকুরী করতে তারা বাধ্য বলে তাদের জীবন এভাবে কেড়ে নেওয়া যায় না। নিক্ষেপ করা যায় না তাদের জ্বলন্ত অগ্নকুণ্ড কিংবা ভঙ্গুর দালানের কোন মৃত্যুকূপে । মৃত্যুর পর ম্লান বদনে তাদের শোকাভিভূতআত্মীয় স্বজনদের প্রদত্ত তথাকথিত ক্ষতিপূরণের যৎসামান্য টাকা তাদের জীবনের মূল্য হতে পারে না-বরং এটা তাদের জীবনের প্রতি মর্মান্তিক তামসা। তারা ভোট না দিলে আপনারা ক্ষমতার সোনালী মসনদে বসতে পারতেন না। তবে কেন তাদের জীবনের প্রতি এমন তাচ্ছিল্য। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সোল এজেন্সি কি কেবল তারাই নিয়েছে? কেবল তারা ঘাম ঝরাবে, রক্ত দেবে এবং জীবন দেবে, আর তার বিনিময়ে কিছু লোক যেনতেন ভাবে একটি গার্মেন্টস করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হবে, সাংসদ হবে, মন্ত্রী হবে, এ কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি। এত আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ হতে পারে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
অতি সম্প্রতি জাতীয় প্রচার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, শ্রমিকদের, বিশেষভাবে পোষাক শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির কথা ভেবে সরকার বিদ্যমান বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর কতিপয় সংশোধনী মন্ত্রী পরিষদের সভায় অনুমোদন করেছেন, যেগুলো আগামী সংসদ অধিবেশনে বিল আকারে উত্থাপিত হবে এবং সংসদ তা পাশ করবে। আমরা বিস্মিত,ক্ষুদ্ধ ! কারা এ সংশোধনীর খসড়া প্রণয়ন করল ? নিশ্চয় কতিপয় আমলা,যারা গণবিচ্ছিন্ন, মেহনতি মানুষদের প্রতি যাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই, নেই মমত্ব বোধও।
পত্রিকান্তরে আমরা যে সকল সংশোধনীর কথা জানতে পারি, তা আমাদের যারপরনাই উদ্বিগ্ন করেছে। কারণ যে সকল সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে এবং যেগুলো মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে মর্মে সকল জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত/প্রচারিত হয়েছে, সে সকল সংশোধনী বস্তুত: শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থার কোন গুণগত পরিবর্তনের বিপরীতে বর্তমানে বিদ্যমান আইনগত অধিকারকে আরো ক্ষুণ্ন করবে।
প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো আইনে পরিণত হলে প্রথমত: শ্রমিকেরা বিনা কারণে হয়রানিমূলক চাকুরীচ্যূতির শিকার হবে, চাকুরী শেষে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ ও গ্র্যাচুয়েটি থেকে বঞ্চিত হবে এবং নানা ভাবে মালিক শ্রেণীর নির্যাতনের শিকারে পরিণত হবে।
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অনূন্য ১২ বৎসর চাকুরী করার পর গ্র্যাচুয়েটির যে বিধানের কথা বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং ফলশ্রুতিতে কোন গার্মেন্টস শ্রমিক চাকুরীর শেষে গ্র্যাচুয়েটির সুবিধা পাবে না, কারণ ১২ বৎসর চাকুরী হওয়ার পূর্বেই তাদের চাকুরীচ্যূত করা হবে। অথচ বর্তমান শ্রম আইনের ২(১০) ধারায় প্রদত্ত সংজ্ঞায় গ্র্যাচুয়েটি অর্থ প্রতি পূর্ণ বছর অথবা ৬ মাসের অধিক চাকুরীর জন্য ৩০ দিনের মজুরীর কথা বলা আছে। এক বছর চাকুরী করার পর কোন শ্রমিক চাকুরীচ্যূত হলে সে কেন গ্র্যাচুয়েটি থেকে বঞ্চিত হবে-এটা ভেবে দেখা উচিত।
আনীত সংশোধনীর ফলে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে, বিশেষভাবে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার পথে কোন অনুকুল পরিবেশ তৈরী করবে না। বিস্ময়ের ব্যাপার হল,যেখানে বর্তমানে প্রচলিত আইনে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মুনাফার ৫% শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণের বিধান আছে-যা বস্তুত: ১৯৬৮ ইং সাল থেকে প্রচলিত, কিন্তু মালিকেরা তা কখনো মানেন নি, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে উক্ত আইনটি গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেলায় প্রযোজ্য নয় মর্মে বিধান করা হয়েছে, যা স্বাভাবিক ন্যায় বিচারের পরিপন্থী এবং কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কোম্পানীকে বিশেষ কাজের অজুহাতে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ঠিকাদার শ্রমিক নিয়োগের যে সুযোগ প্রদান করার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা কার্যকর হলে মালিকেরা শ্রমিকদের চাকুরীতে স্থায়ীকরণের বিপরীতে ঠিকাদারের মধ্যে তাদের উৎপাদন পরিচালনা করার সুযোগ নিবে, যা শ্রমিকদের চাকুরীতে স্থায়ীকরণের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ব্যতীতও আরো এমন কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা প্রচলিত শ্রম আইনের কোন কোন ধারার সাথে সাংঘর্ষিক।
মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী,
উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে বর্তমানে প্রস্তাবিত সংশোধনী সংসদে উত্থাপন ও পাশ না করে বর্তমান শ্রম আইনকে আরো শ্রমিক-বান্ধব ও আই,এল,ও, কনভেনশনের আলোকে যুগোপযোগী করে সংশোধন করার প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য সত্যিকার শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ প্রদানের জন্য আমরা এদেশের মেহনতি শ্রমিক শ্রেণীদের পক্ষ থেকে আপনার সমীপে আকুল আবেদন জানাচ্ছি। আশা করি বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিবেন- ইতি।