স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’ গ্রন্থটি আমাদের অনেকেরই পরিচিত। এর সঙ্গে পরিচয় না হওয়া সত্ত্বেও অবশ্য কেউ কেউ এই বইটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কি আছে এতে? আত্মার অস্তিত্বের ‘বৈজ্ঞানিক’ প্রমাণ! সব্বোনাশ! হাতে-কলমে নাকি? তা জানতাম না। কিন্তু ফেসবুকে এই বইয়ের পেজ-এ অজস্র লাইক। তাই, ধৈর্য ধরে পড়েই ফেললাম বইটা। স্বামী অভেদানন্দের বইটি পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, রসায়ন – সবকিছুই ছুঁয়ে গেছে। বইটি পড়তে পড়তে অনেক কিছুই জানলাম এবং ‘কুযুক্তি’ কাকে বলে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। ‘মরণের পারে’ বইটির বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে আত্মা নিয়ে কয়েক কথা বলে নেওয়া যাক।

আত্মা বিষয়টা বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্নভাবে এসেছে। এ নিয়ে সাংঘাতিক রকমের মতবিরোধ। ভাববাদী দর্শনই যেহেতু প্রতিটি উপাসনা-ধর্মের চালিকাশক্তি, তাই আত্মার প্রশ্নটা কোনো ধর্মই এড়িয়ে যায়নি। প্রকৃত বৌদ্ধদর্শনে অবশ্য আত্মার অস্তিত্ব কার্যত অস্বীকার করা হয়েছে। বস্তুবাদী ধারণা অনুযায়ী, বস্তুই জীবনের উপাদান। স্নায়ুকোষের ক্রিয়ায় মস্তিষ্ক সচল হয় বলেই আমরা ‘মন’ ব্যাপারটা বুঝতে পারি। বিপরীতে, ভাববাদী দর্শন বলে, কোনো ‘আধ্যাত্মিক’ অতিপ্রাকৃত শক্তিই প্রাণের সৃষ্টি করে। আত্মা দ্বারা বস্তুতে প্রাণ সঞ্চারিত হয়, দেহ একটি নশ্বর খোলক, আত্মাই প্রাণশক্তি – এই হল ‘আত্মা’-র মূল ভাববাদী ধারণা। এই ধারণাটিই বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ধর্মে ও লোকবিশ্বাসে পাওয়া যায়। বাইবেল অনুসারে, ঈশ্বর মাটি দিয়ে প্রথম মানুষ গড়লেন এবং তাঁর মধ্যে আত্মা প্রবেশ করিয়ে প্রাণের সঞ্চার করলেন। মিশর, ব্যবিলনের প্রাচীন শাস্ত্রমতে – কৃমি, মাছি, মৌমাছি প্রভৃতি সার ও ময়লা থেকে জন্মায়, নীলনদের কাদা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্মায় ব্যাং(১)। ভগবদ্গীতায় উদ্দেশ্যপূর্ণভাবেই আত্মা ও পুনর্জন্মের প্রচার করা হয়েছে। বৌদ্ধ ও লোকায়তরা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। মূলত বৌদ্ধ ও লোকায়ত প্রচারের হাত থেকে আস্তিকতাকে রক্ষা করতেই ভগবদগীতায় জাঁকিয়ে প্রচারিত হয়েছে পুনর্জন্মবাদ। বিষ্ণুপুরাণ, গরুড় পুরাণে ভিন্ন জীবদেহে পুনর্জন্মের প্রচার হয়েছে, আবার বায়ু পুরাণেও একই ব্যাপার দেখতে পাই। কর্মফল অনেক ক্ষেত্রেই এসব ধারণার মূল বিষয়। আত্মার অস্তিত্ব যেন তেন প্রকারেণ প্রচার করতেই হত, তা না করলে যে পুনর্জন্ম, কর্মফল, স্বর্গ-নরক, যাগযজ্ঞ – সবই বৃথা যায়! (২)

“শ্রীভগবান”-এর মুখনিঃসৃত একটি বহুল প্রচারিত বাণী(৩),

“বাসাংসি জীরণানি যথা বিহায়,
নবানি গ্রৃহ্নাতি নরোহপারাণি।
তথা শ্রীরাণি বিহায় জীর্ণা –
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।।”

অর্থাৎ, মানুষ যেমন জীর্ণ জামাকাপড় ছেড়ে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মাও তেমনি জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করে নতুন দেহে অধিষ্ঠিত হয়। শূদ্রদের ভুলিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে এই উক্তিটি ক্লাসিক।

আবার বৌদ্ধমতে আত্মা দেহেরই ধর্ম(property)। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধ ‘অনাত্মবাদ’-র প্রচারক ছিলেন। যদিও বুদ্ধের মতামত ঠিক বস্তুবাদী নয়, কিন্তু এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধী। এর ব্যখ্যায় বুদ্ধ বলেছেন(৪),

“যে আমার আত্মার অনুভব কর্তা, অনুভবের বিষয় এবং এখানে সেখানে ভালোমন্দ কর্মের ফলকে অনুভব করে, আমার সেই নিত্য = ধ্রুব = শ্বাশ্বত অপরিবর্তনশীল এবং অনন্তকাল পর্যন্ত ওরকমই থাকবে। ভিক্ষুগণ! এগুলি নিছকই বালখিল্যদের চিন্তাধারা।”

অন্য এক জায়গায় বুদ্ধ বলেছেন(৫ ও ৬),

“রূপ অনাত্মা, বেদনা অনাত্মা, সংজ্ঞা…সংস্কার…বিজ্ঞান প্রভৃতি সমস্ত ধর্মই অনাত্মা।”
“আত্মা কোনো নিত্য কুটস্থ বস্তু নয় বরং বিশেষ কারণে স্কন্ধের (বস্তু, মন) সহযোগে উৎপন্ন এক শক্তি, যা অন্য বাহ্য পদার্থের মত ক্ষণে ক্ষণে উৎপন্ন হচ্ছে এবং বিলীন হচ্ছে।”

স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণসৃষ্টির কল্পকথায় ঈশ্বর ও আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বোঝা যায়, যে মৃত্যুর পরে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্খাই মানুষের মনে আত্মাজাতীয় ভাবনার জন্ম দেয়। ভাববাদী দার্শনিকদের মধ্যে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে বিশপ সেন্ট ব্যাসিল ও প্রায় একই সময়ে সেন্ট অগাস্টিন ‘ঈশ্বর কর্তৃক জড়ে আত্মা প্রেরণের মাধ্যমে প্রাণসৃষ্টি’-র তত্ত্ব প্রচার করেন। খ্রীষ্টজন্মের পূর্বে, গ্রীক দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটল – উভয়েই আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করলেন। খ্রীষ্ট-পরবর্তী যুগে নব্য-প্লেটোবাদী দার্শনিক প্লটিনাস আত্মার অস্তিত্বের কথা জোর গলায় প্রচার করেছিলেন(৭)। আবার, মধ্যযুগের ধর্মগুরু টমাস আকুইনাসও আত্মার অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন। প্রগতিশীল মনীষী বারট্রান্ড রাসেলের মতে, “ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ চরমত্ব লাভ করেছে ব্যক্তি-আত্মার অমরত্বের ধারণা থেকে, যা ঘটনার ওপর নির্ভর করে অনন্ত আনন্দ অথবা অনন্ত দুঃখ ভোগ করে।” ধর্মের তুমুল প্রভাব সত্ত্বেও প্রাণ সম্পর্কে গবেষণায় একটি দুঃসাহসিক কাজ করলেন খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর বিজ্ঞানি আন্দ্রে ভেসালিয়াস। রোমান চার্চের অনুশাসনে সেসময়ে শব-ব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ ছিল। এই অনুশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভেসালিয়াস রাতের অন্ধকারে কবর থেকে শবদেহ তুলে আনলেন, পরীক্ষা করলেন। শবব্যবচ্ছেদ করে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে অনুসন্ধান করলেন। বস্তুবাদী অনুসন্ধানই আত্মার ধারণা নস্যাৎ করার পথ প্রস্তুত করে। এই পথে চলতে গিয়ে চার্চের কোপে পড়েন সমসাময়িক দার্শনিক লুসিলিও ভানিনি। ইনকুইজিশনের নির্দেশে তাঁকে পুড়িয়ে মারা হয়(৮)। এ তো গেল ইউরোপের কথা। খোদ পরাধীন ভারতেই এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল ১৮৫৬ সালে। তথাকথিত হিন্দুধর্মের কারোর সাহস ছিল না শবব্যবচ্ছেদ করার। বিজ্ঞান হোক আর যাই হোক, ধর্মান্ধতার কারণে ব্যাপারটাকে অপবিত্র বলেই মনে করা হত। এদিকে মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার জন্য শবব্যবচ্ছেন একান্ত জরুরি। এক সাহসী ও প্রগতিশীল ‘জাত হিন্দু’ ধর্মের তোয়াক্কা না করেই কাজটা করলেন। ডেভিড হেয়ার পর্যন্ত চিন্তিত ছিলেন – ধর্মীয় অনুশাসনের প্রভাব এড়িয়ে আদৌ ঐ যুবক এমন কাজ করতে পারবেন কিনা! মহাবিদ্রোহের সমসাময়িক এই প্রগতিশীল ঘটনাটির নায়ক মধুসূদন গুপ্ত, যিনি সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদের অধ্যাপক ছিলেন(৯)।

এখনো পর্যন্ত অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, আত্মাচিন্তার প্রাচীনতম উৎসটি হল নিয়ান্ডারথাল মানবসমাজ। নিয়ানডারথাল মানুষ ও আধুনিক মানুষ উভয়েই হোমো ইরেকটাস থেকে উদ্ভুত। কিন্তু, নিয়ানডারথালরা সম্ভবত বিবর্তনের গতি রুদ্ধ করা এক গলিতে গিয়ে পৌঁছেছিল এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনে হেরে গিয়ে বিলুপ্ত হয়েছিল, কিংবা আধুনিক মানুষের মধ্যেই মিশে গিয়েছিল। উল্লেখ্য, জিন ‘FOX P2’ এদের কোষে ছিল। মস্তিষ্কের আয়তন ছিল প্রায় ১৩০০ ঘনসেমি। তাই এদের সামাজিক আচরণ বেশ উন্নত ছিল। এরা মৃতদেহ মাটিতে কবর দিত। শানিদার গুহায় একটি নিয়ানডারথাল মৃতদেহের পাশে কিছু ঔষধি গাছের অংশ পাওয়া গেছে। সঙ্গে ছিল বাইসনের হাড়। এসব জিনিস প্রাকৃতিক কারণেও কবরে এসে থাকতে পারে, আবার মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যেও হতে পারে। কেউ কেউ ধারণা করেন, ওসব জিনিস আত্মার জন্য। কিন্তু এ বিষয়টি একেবারেই প্রতিষ্ঠিত নয়। ভবানীপ্রসাদ সাহু তাঁর ‘ভূত ভগবান বনাম ডঃ কোভুর’ বইতে এ বিষয়ে বলেছেন, “প্রাণীর প্রাণধারণের মত একটি অত্যদ্ভুত ঘটনার উপযুক্ত ব্যখ্যা না পেয়ে মানুষ প্রাচীনকালে(এখন থেকে প্রায় ৬০০০০ বছর আগেকার নিয়ারনডারথাল মানুষ) এই আত্মাকেই প্রাণের কারণ হিসেবে কল্পনা করে নিয়েছে।” মনে রাখা দরকার – এটি একটি অনুমান। ‘আত্মাচিন্তা’-র উদ্ভবের কারণ এটাই, কিন্তু নিয়ানডারথালদের আত্মাচিন্তার ব্যাপারটা এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়।

অদ্বৈতবাদী ধারণার ব্যখ্যা দিতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ আত্মার প্রসঙ্গ তুলেছেন। আবার ‘জনপ্রিয়-বিজ্ঞান’ লেখক প্রশান্ত প্রামাণিক ‘কিরলিয়ান এফেক্ট’-কে আত্মার প্রমাণ হিসেবে প্রচার করেছেন। আত্মা নিয়ে আগেও অনেক আলোচনা হয়েছে, মুক্তমনা লেখকদের সেইসব প্রবন্ধ একটু ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। তাই আমার উদ্দেশ্য আত্মা বিষয়ক স্রেফ কয়েকটি মূল ধারণা নিয়ে আলোচনা করা, যেগুলি ‘মরণের পারে’তে বলা হয়েছে। স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’ বইটি বহুল প্রচারিত, পঠিত এবং ‘সমাদৃত’। ফেসবুকে এই বইটির পেজ-এ ‘লাইক’-এর বহর তাজ্জব হওয়ার মত। আত্মা নিয়ে যেসব ‘যুক্তি’ বিশ্বাসীরা তুলে ধরেন, ‘মরণের পারে’ বইটিকে সেগুলোর-ই একটা কালেকশন বলা যেতে পারে। তাই, এই বইটির মূল দাবিগুলোকেই পর্যালোচনা করলাম। উল্লেখ্য, বইটিতে ‘বৈজ্ঞানিক আলোচনা’ করা হয়েছে বলেই অনেকে মনে করেন।

দেখা যাক, অভেদানন্দ কি ‘যুক্তি’ দেখিয়েছেন।

“আত্মার সৃষ্টির কারণের এই যে উত্তর, অর্থাৎ দেহ থেকেই আত্মার সৃষ্টি হয়-এই ধরনের যে উত্তর, কার্য থেকেই কারণের সৃষ্টি হয়-সেই রকমেরই উত্তর। প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা প্রশ্নের প্রবাহই তাতে চলতে থাকে এ যেন ঘোড়ার আগে গাড়ীকে রাখা।” (১০)

নাহ! বস্তুবাদী হিসেবে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস-ই করি না। কিন্তু, এই অংশ থেকে এটুকু বুঝতে পারি যে স্বামী অভেদানন্দ বলতে চেয়েছেন যে দেহ থেকে আত্মার সৃষ্টি হয় না। কিন্তু, তাহলে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসে – জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে কি করে? আত্মা তো দেহ থেকে তৈরি হচ্ছে না, তাহলে আত্মা কি নতুন করে জন্মাচ্ছে? তাও তো নয় ! কারণ, বেদান্তের মতটাও তুলে ধরেছেন অভেদানন্দ,

“বেদান্তের মতে, আত্মার জন্ম নেই, আত্মা শাশ্বত অমর, এর যেরূপ ইচ্ছা সেরূপ দেহ নিতে পারে।”(১১)

বইটির প্রতিটি অংশে স্বামী অভেদানন্দ বেদান্তের মতকেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। জনসংখ্যা বেড়ে চলাটা এই ‘আত্মা-তত্ত্ব’ দিয়ে কিভাবে ব্যাখ্যা কওরা যায়, সেটা বোঝানোর ঝামেলায় তিনি যাননি। ‘মরণের পারে’ বইটির অপর একটি মারাত্মক ত্রুটি হল, বইটিতে বিভিন্ন ধরনের মানসিক ভ্রমের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেই ভুল ব্যাখ্যাগুলি অবশ্যই আত্মার অস্তিত্বের উদাহরণ হিসেবে। বইটির ৩২তম পৃষ্ঠায় রয়েছে,

“অনেক ঝানু নাস্তিক ও বস্তুবাদী কখনো কখনো নির্জন কক্ষে কৌচে বা আরাম-কেদারায় বিশ্রামকালে তাঁদের দ্বিতীয় একটি সত্তাকে প্রত্যক্ষ্য করেছেন। এমনও হয়েছে যে, এইসব দ্বিতীয় সত্তাকে কথা কইতে, চলতে ও অন্যান্য কাজ করতে দেখা গেছে। তবে কেমন ক’রে বোঝা যাবে এইসব ব্যাপার? ভারতে যোগীদের দ্বিতীয় সত্তার আবির্ভাবের কথা শোনা যায়। কেউ কেউ এগুলিকে দৃষ্টিভ্রান্তি বলতে চেয়েছেন। কিন্তু পরখ ক’রে দেখার পরও এগুলির অস্তিত্ব নেই, তা তো বলা যাবে না।”(১২)

স্বামী অভেদানন্দ না জানলেও আজ আমরা জানি যে ভ্রম শুধুমাত্র দৃষ্টিরই হয় না, অন্যান্য অনুভূতির-ও হয়। দ্বিতীয় সত্তাকে প্রত্যক্ষ করার ব্যাপারটিতে যেহেতু কোনো প্রমাণ নেই, তাই কথাগুলোকে সত্যি হিসেবে ধরে নিয়ে বলতে পারি, ঐ প্রত্যক্ষ্যকারীদের হয়েছিল ভিসুয়াল-অডিটরি হ্যালুসিনেশন। বিষয়টা কেমন যেন অবাস্তব শোনালেও এটাই বাস্তব, অলৌকিকের মুখে চুনকালি মাখানো কঠিন বাস্তব। অনুপস্থিত কোনো কিছুর প্রত্যক্ষ্য অনুভূতি(দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ ইত্যাদি বিভিন্ন অনুভূতি, কখনো কখনো স্পর্শানুভূতি) পাওয়া-ই ‘হ্যালুসিনেশন’। কোনো বিষয়ে অত্যাধিক বিশ্বাস রাখলে কিংবা অবচেতন মনে সেই বিষয়টি কোনোভাবে প্রাধান্য পেলে কিছু ক্ষেত্রে সেই বিষয়টিকে দেখা-শোনা যেতে পারে, অথচ বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই। এটা হয় মূলত একটি বিশেষ বিষয়ের (বিশেষত অলীক কিংবা আপাত অলৌকিক) উপর ধারণাতীত গুরুত্ব দেওয়ার জন্য(সঙ্গে কখনো কখনো থাকে কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যা, সব ক্ষেত্রে নয়)। Peduncular hallucinosis-এর ক্ষেত্রে তো পুরোপুরি অলীক ব্যক্তিকে দেখতে পাওয়া যায়, তার সাথে কথা বলা যায়। একাজ যে করছে, সে বাস্তব আর অলীকের মধ্যে কোনো পার্থক্যই করতে পারে না, তার মনে হয় পুরোটাই আদতে ঘটছে, অন্য যে কোনো যে কোনো ঘটনার মতোই। এই অনুভূতি বেশ কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়, সুতরাং গোটা ব্যাপারটা বোঝা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। যত বস্তুবাদীই হোন না কেন, অবচেতন মনের সৌজন্যে হ্যালুসিনেশন ঘটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধরুন আপনি মধ্যরাত্রে লেখালেখি শেষ করে কাগজপত্র তুলে উঠতে যাচ্ছেন। একাকীত্ব বোধ করছিলেন, ভাবছিলেন যে আপনার বন্ধু ঐ মুহূর্তে সঙ্গে থাকলে ভাল হত। এমন সময় দেখলেন যে আপনার বন্ধু পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
এমন ঘটনাই হল হ্যালুসিনেশন। এবার স্বামী অভেদানন্দের ‘অলৌকিক’ উদাহরণটি দেখুন।

“ধরুন, রাতের বেলা কোনো লোক ভেতর থেকে তালা বন্ধ ক’রে ঘরের মধ্যে বসে আছেন; তিনি কোন দরকারী বিষয়ে কি গণিতের তত্ত্বচিন্তায় ব্যাপৃত। এমন সময় তিনি যদি দেখেন, ঠিক তাঁরই মতো একটি লোক চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর কিছু লিখছেন, আর সেই লেখায় যদি তাঁরই বহুচিন্তিত সমস্যার সমাধান থাকে, তাহলে এ ব্যাপারটি কি বলতে হবে? এটিকে কি বুদ্ধিভ্রান্তি বলা যাবে?”(১৩)

বুদ্ধিভ্রান্তি বলা যাবে কিনা জানি না, অনুভূতিভ্রান্তি অবশ্যই বলা যাবে। এ’জিনিস অলৌকিক-ও নয়, অস্বাভাবিক-ও নয়। নিজের অস্তিত্ব বা জটিল কাজ নিয়ে ধারণাতীত চিন্তা করলেও এমন হ্যালুসিনেশন ঘটতে পারে। এরপর ‘Occam’s Razor’। অভেদানন্দ বলেছেন,

“কোন-কোন লোক মৃত্যুর অব্যবহিত পরে বন্ধুকে দেখা দিয়েছেন এমন প্রামাণিক দৃষ্টান্তও আছে।”(১৪)

হ্যালুসিনেশনের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। অভেদানন্দ রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন ক্যারিংটন ও মীডর প্রণীত ‘Death, Its Causes & Phenomena’। এই বইটিতে রয়েছে (১৫),

“From the accounts we have read it is evident that the departing spirit sometimes retains full possession of its faculties, though it is probable that this only happens on occasion, and that, in a large number of cases, probably the majority, the shock and Avrench of death produces a sort of temporary suspension of consciousness, just as a shock or accident would in this world.”

এরপর বেশ খানিকক্ষণ বিভিন্ন প্রত্যক্ষ্যদরশীর বিবরণ।

“When the English Society for Psychical Research began its pioneer work, in 1882, it had no notion that such a preponderance of coincidences would be found, all merging towards the moment of death ; but the investigators soon found that such manifestations far outweighed all others in number and in character ; and, within the first five years of the Society’s work (besides all the cases printed in the Proceedings and Journal of the Society), it was enabled to publish two bulky volumes, bearing entirely on this question of death coincidences, entitled Phantasms of the Living. In these volumes were printed some 702 coincidental cases—in which an apparition of the dying person had been seen by others at a distance, or some other sensory, motor, or emotional effect had been noticed — coincidental with the death of the subject whose figure was seen.”

এই বইটির সঙ্গে একটি বিষয়ের তুলনা টানা যায় – ‘ইউ এফ ও’ দেখার বিবরণ। সারা বিশ্বে ইউএফও বিষয়ে কয়েক হাজার ‘গবেষণামূলক’ বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো প্রত্যক্ষ্যদরশীদের বিবরণে ঠাসা। প্রমাণ হিসেবে রয়েছে আরো সব বইয়ের রেফারেন্স আর কিছু সরকারি দলিলের ভুল ব্যাখ্যা। হাজার চেষ্টা করেও কেউ খুঁজে বার করতে পারবেন না, আদৌ সেসব ঘটনা কেউ দেখেছে কিনা। অতিরঞ্জন ঘাঁটতে গিয়ে শেষ অবধি দেখা গ্যাছে, অধিকাংশ ইউ এফ ও’-ই হয় ‘Lenticular Cloud’ কিংবা অন্য গ্রহ, না হয় ‘ওয়েদার বেলুন’। এইসব তথাকথিত ‘প্রমাণ’গুলোকে প্রমাণ করার দায়িত্ব তাঁর, যিনি এই ঘটনাগুলোকে উপস্থাপন করছেন। এ প্রসঙ্গে অনেকে বলেন, “সবার বেলায় খালি হ্যালুসিনেশন নিশ্চয়ই হবে না। প্রমাণ করতে পারবে যে ঐ প্রত্যক্ষ্যদরশীরা সত্যিই আত্মা দেখেনি?”

উত্তরে জানাই, আমি একদিন পাড়ার মাঠে রামগরুড়ের ছানা দেখেছি। একা ফিরছিলাম, মাঠের ওদিকটায় কেউ ছিল না। হঠাৎ দেখি দুটো রামগরুড়ের ছানা খেলে বেড়াচ্ছে। আমি বেগতিক দেখে কেটে পড়লাম। কেউ প্রমাণ করতে পারবেন যে আমি সেদিন রামগরুড় দেখিনি? এখন না হয় কেউ দেখতে পাচ্ছেন না মাঠে, কিন্তু সেদিন যে ছিল না– এ’কথা কেউ প্রমাণ করে দিতে পারবেন? আসলে এটা প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই। দাবির গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করার দায়িত্ব আসলে দাবিদারের। David Kusche একসময় বলেছিলেন, “Say I claim that a parrot has been kidnapped to teach aliens human language and I challenge you to prove that is not true. You can even use Einstein’s Theory of Relativity if you like. There is simply no way to prove such a claim untrue. The burden of proof should be on the people who make these statements, to show where they got their information from, to see if their conclusions and interpretations are valid, and if they have left anything out.” কথাটা খন্ডন করার যুক্তি এখনো পর্যন্ত কেউ দিতে পারেন নি। যুক্তি ছাড়া কোনো কিছু বিশ্বাস করব কি’না, সেটা আমাদেরই ঠিক করতে হবে।
আজকাল যুক্তিবাদী সংগঠনগুলির সদস্যরা অনেক আপাত অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে মানুষকে সচেতন করেন। তেমনই একটি আপাত অলৌকিক ঘটনাকে দিব্যি আত্মার অস্তিত্ব প্রচারে কাজে লাগিয়েছেন অভেদানন্দ।

“কেউ কেউ ইচ্ছাশক্তির দ্বারা হৃদস্পন্দন বন্ধ করতে পারে। আমেরিকায় একজন হিন্দুযোগসাধকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, তিনি ইচ্ছাশক্তির দ্বারা হৃদকম্পন বন্ধ করলে চিকিৎসকেরা তাঁকে পরীক্ষা করে দেখতেন সত্যই তাঁর ফুসফুসের ক্রিয়া থাকত না। চিকিৎসকেরা হতভম্ব হয়ে যেতেন এবং এরকম কিভাবে সম্ভব হ’তে পারে, সে-সম্বন্ধে সেই হিন্দুযোগীকে নানারকম প্রশ্ন করতেন। আসলে এটা সম্ভব, কেননা হৃদস্পন্দন-ও মানুষের ইচ্ছার আজ্ঞাবহ, মানুষমাত্রেই তার ইন্দ্রিয়ের কাজগুলোকে ইচ্ছানুসারে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। তবে আধুনিক জড়বিজ্ঞান এসবের কোন উত্তর দিতে পারে না – কেমন করে তা হতে পারে।” (১৬)

প্রথমেই বলি, ‘হৃদস্পন্দন’ ইচ্ছানুসারে ‘বন্ধ’ করা যায়(যদি সেটাকে আদৌ ‘বন্ধ করা’ বলা হয়)। কিন্তু তার জন্য এমন কোনো বিষয়ের প্রয়োজন হয় না, যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান করতে পারে না। অভেদানন্দ বিজ্ঞানের সাফল্য মানতে চান বা না চান(এমনও হতে পারে, তাঁর সময়ে ব্যাখ্যা নিয়ে বিশেষ চর্চা হয়নি), বিজ্ঞান খুব স্পষ্টভাবেই এ’ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারে। প্রথমে ফুসফুসকে যতটা সম্ভব বায়ুপূর্ণ করা হয় এবং বুকে ও আবডোমেনে চাপের মাধ্যমে সেই বায়ুকে ধরে রাখা হয়। এর ফলে একটা ‘air cushion’ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে ডাক্তাররা স্টেথোস্কোপ দিয়েও হৃদস্পন্দন পাবেন না। এই চমৎকার ব্যাখ্যাটি করেছেন যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ বাসব প্রেমানন্দ (Science versus Miracles বইটি দ্রষ্টব্য)। এই ব্যাখ্যাটি কিন্তু বিজ্ঞানের পথ ধরেই এসেছে।

এরপর, বেশ জোরের সঙ্গে অভেদানন্দ বলেছেন,

“ভয়, শোক প্রভৃতি থেকে যখন মরণ ঘটে তখন মনের শক্তিকে অস্বীকার করা যায় কেমন ক’রে? মনের বিভিন্ন অবস্থার প্রভাব দেহের ওপর যদি এমন হতে পারে তো মনকে সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তু বলে স্বীকা করতে বাঁধে কিসে? তা হ’লেই দেখা যাচ্ছে, উদার ও বিচক্ষণ বিজ্ঞানীরা দেহের মধ্যে মনকে সবচেয়ে বিস্ময়কর শক্তি ব’লে মনে করেন, গোঁড়া বস্তুবাদীদের মতো তাঁরা নন।”(১৭)

‘গোঁড়া বস্তুবাদী’ কথাটা নিয়ে এই মুহূর্তে তর্ক করব না। বরং এটা বলি যে বস্তুবাদীরা ‘মস্তিষ্ক’-কেই মনের স্রষ্টা হিসেবে মনে করে। তারা মনে করে, মন হল স্নায়ুকোষের ক্রিয়ার ফল। মস্তিষ্কের ধূসর বস্তুর উপর মনের অনেকগুলি দিক নির্ভর করে। স্নায়ুসন্ধি তৈরির মাধ্যমে মনের বিকাশ ঘটতে পারে। স্নায়ুকোষের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে, তথা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা শেষ ঘলে মনেরও অবলুপ্তি। মস্তিষ্কই যে মনের পরিচালক, তা দেখানোর জন্য একটা উদাহরণ টানব। উদাহরণটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য এবং অভেদানন্দের উদাহরণগুলির মতো রেফারেন্সবিহীন নয়।

১৮৪৮ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ফিনিয়াস গেজ রেলওয়ে ট্র্যাকে গ্যাংম্যানের কাজ করছিলেন। একটা বিস্ফোরণের সময় একটা লোহার রড তাঁর খুলি ফুঁড়ে ঢুকে যায়। অর্থাৎ মাথার উপর দিয়ে রডটি ঢুকে চোয়ালের নিচ দিয়ে বেরিয়ে থাকে(Boston Post, September 21, 1848)। এই অবস্থাতেই তাঁর চিকিৎসা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি বেঁচে যান (Harlow, 1848)। কিন্তু, মস্তিষ্কের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় তাঁর ব্যবহারে কিছু পরিবর্তন ঘটে যায়। এই পরিবর্তনের পরিমাণ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, কারণ তাঁর মস্তিষ্কের ‘right frontal lobe’ অক্ষত ছিল। কিন্তু, মনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যে মস্তিষ্ক-পরিচালিত, তা এই ঘটনায় প্রমাণিত বলা যায়।

আত্মার ছবি তোলা যায়? বা, তার ওজন জানা যায়? হ্যাঁ, যায় তো। মানে, অভেদানন্দ তো তেমনই বলেছেন দেখছি।

“কিন্তু মানুষের চৈতন্যময় আত্মা যখন মরণের পর দেহ ছেড়ে যায় তখন তাঁর সূক্ষ্মদেহের ফটোগ্রাফ বা আলোকচিত্র নেওয়া যায়। অত্যন্ত সূক্ষ্ম এক ধরনের যন্ত্রও আবিষ্কার হয়েছে – মরণের অব্যবহিত পরে সূক্ষ্মদেহকে ওজন করার জন্য। ঠিক মৃত্যুর [সময়ে দেহ থেকে একপ্রকার বাষ্পতুল্য পদার্থ নির্গত হয়ে যায় এবং তাকে ঐ আবিষ্কৃত সূক্ষ্ম যন্ত্রে মাপ ক’রে দেখা গেছে, তাঁর ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ।”(১৮)

অর্ধসত্য, কিংবা বলা যায়, ব্যাখ্যাটা ভুল। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তথ্যটাও ভুল। ম্যাসাচুসেটস-এর ডাক্তার ডানকান ম্যাকডুগল ১৯০১ সালে একটা অদ্ভুত পরীক্ষা করে বসলেন। তিনি একটা বৃদ্ধাশ্রমে ৬ জন টিবি-রোগাক্রান্ত মুমূর্ষু মানুষের ওজন নিলে, তাদের মৃত্যুর ঠিক আগে এবং ঠিক পরেই। তিনি দেখলেন, মৃত্যুর পর প্রত্যেকের ওজন গড়ে ২১ গ্রাম (১ আউন্সের চারভাগের তিনভাগ)। অন্য কিছু জীবের ক্ষেত্রেও একই পরীক্ষা চালানো হল। শেষ অবধি, ১৫টা কুকুরের দেহেও একই পরীক্ষা করলেন ম্যাকডুগল। এক্ষেত্রে ওজনের কোনো পরিবর্তন হল না। ম্যাকডুগল সিদ্ধান্ত নিলেন, কুকুরের আত্মা নেই। ১৯০৭ সালে Journal of the American Society for Psychical Research এবং American Medicine জার্নালে তিনি তাঁর পরীক্ষার রিপোর্ট পেশ করলেন।

দুঃখের কথা, তাঁর পরীক্ষাপদ্ধতি বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই বিজ্ঞানীমহলের ধারণা এবং ভবিষ্যতেও এই ঘটনা প্রমাণিত হয়নি। এই পরীক্ষাটির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। অন্তত ঐ ডাক্তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তাই এই পরীক্ষার ফলাফল বহুকাল পূর্বেই বাতিল হয়েছে। মজার ব্যাপার, American Medicine জার্নালে প্রকাশিত লেখায় ডানকান নিজেই জানিয়েছেন(১৯),

“I am aware that a large number of experiments would require to be made before the matter can be proved beyond any possibility of error, but if further and sufficient experimentation proves that there is a loss of substance occurring at death and not accounted for by known channels of loss, the establishment of such a truth cannot fail to be of the utmost importance.”

বারবারা ও ডেভিড মিক্কেলসন লিখেছেন, “MacDougall’s results were flawed because the methodology used to harvest them was suspect, the sample size far too small, and the ability to measure changes in weight imprecise. For this reason, credence should not be given to the idea his experiments proved something, let alone that they measured the weight of the soul as 21 grams. His postulations on this topic are a curiosity, but nothing more.”
গোটা ব্যাপারটাই স্রেফ গাঁজা। আজ তাই এ নিয়ে কেউ বিশেষ কথা বলে না। ‘মরণের পারে’-র প্রকাশকাল ১৩৬০ বঙ্গাব্দ। তাই এই বইতে এই ঘটনার উল্লেখ অস্বাভাবিক নয়। তবে এই ব্যাপারটা ‘পাবলিক খায়’, গল্পটাকে ভিত্তি করে ‘21 Grams’ নামের একটা ছবিও হয়েছে ২০০৩-এ।

আত্মাকে দেখেছিলেন অভেদানন্দ? কি বলছেন তিনি?

“মরণের সময় দেহ থেকে যে একপ্রকার সূক্ষ্ম-বাষ্পীয় পদার্থ নির্গত হয়ে যায় তা জ্যোতিষ্মান। ঐ জ্যোতিষ্মান পদার্থটির ফটোগ্রাফ বা ছবি তোলা হয়েছে এবং সুক্ষ্মদর্শীরা মরণের সময় দেহ থেকে ওটিকে বার হয়ে যেতেও দেখেছেন। তখন সারা দেহটি এক বিভাময় কুয়াশার পরিমন্ডলে আচ্ছন্ন হয়। একটি মেয়ের ঘটনার কথা আমার মনে আছে-কয়েক বছর আগে লস এঞ্জেলস-এ তাঁর ভাই মারা যায়। এ কথাটি আমি শুনেছি অবশ্য তার মা’র কাছ থেকে। ভাই যখন মারা যাচ্ছে মেয়েটি তখন তাঁর মত্যুশয্যায় বসে। সে ব’লে উঠলো তাঁর মাকেঃ ‘মা, মা, দেখ – ভাইয়ের দেহটার চারিদিকে কেমন একটি কুয়াশাময় জিনিস! কি ওটা?’ মা কিন্তু তাঁর কিছুই দেখতে পেল না। মেয়েটি বললোঃ ‘বাষ্পটা তাঁর বাইয়ের দেহ থেকেই বেরিয়ে এলো।’ বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টি ইউরোপে গবেষণার বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ঐ বস্তুটির নাম দিয়েছেন তাঁরা ‘এক্টোপ্লাজম’ বা ‘সূক্ষ্ম-বহিঃসত্তা’। এটি বাষ্পময় বস্তু এবং এর কোন একটি নির্দিষ্ট আকার নাই। একে দেখতে একখন্ড ছোট মেঘের মতো, কিন্তু যে-কোন একটি মূর্তি দব আকার এ নিতে পারে, আর তাই এর ছবিও তোলা যায়। কিন্তু আসলে যে এটি কি বস্তু তা তাঁরা বলতে পারেন না, অথচ এর কোন অস্তিত্বও অস্বীকার করতে পারেন না।”(২০)

না, বিজ্ঞানীরা যে বস্তুটিকে এক্টোপ্লাজম নাম দিয়েছেন, সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। বিজ্ঞানের পরিভাষা ‘এক্টোপ্লাজম’ হল জীবকোষের সাইটোপ্লাজম বহিরাবরণের অদানাদার (non-granulated) অংশ, কোনো ভুতুড়ে বাষ্প নয়। আর অভেদানন্দ যে ‘বাষ্পীয়’ পদার্থের অস্তিত্ব দাবি করেছেন, সেই (কাল্পনিক) বস্তুটির নাম ‘এক্টোপ্লাজম’ রাখাটা কোনো বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নয়। এই কীর্তি করেছিলেন চারলস রবার্ট রিচেট নামের এক ফরাসি বিজ্ঞানী (Glossary of Key Words Frequently Used in Parapsychology, Parapsychological Association)। যে মেয়েটির কথা বলা হয়েছে, তার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে হ্যালুসিনেশন হয়েছে। মানসিক চাপের চরম মুহূর্তে, বিশেষত প্রিয়জনের মত্যুর সময় এ ধরনের হ্যালুসিনেশন হওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং তা মানসিক বিকার নয়। পৌরাণিক যুগে সাধুরা প্রায়ই সোমরস সেবনের ফলে হ্যালুসিনেশনের শিকার হতেন এবং ‘সূক্ষ্মদেহ’-টেহ দেখতে পেতেন। এটা অবশ্য এ’যুগে হয় বিশেষ কিছু ড্রাগের মাধ্যমে। এই ড্রাগগুলোকে বলে ‘হ্যালুসিনোজেন’। খেয়ে অথবা শরীরে ইঞ্জেক্ট করে এই ড্রাগের সর্বনাশা ফলাফল দেখা যায়। সূক্ষ্মদেহ দেখার বিষয়টা কোনো বইতে পড়ে বা কোথাও থেকে শুনে সেটাকে নিজের অভিজ্ঞতা বলে চালানো মানুষ-ও আছেন। ধরা যাক আমার বন্ধু বললেন, তাঁর বাবা কারোর সূক্ষ্মদেহ দেখেছেন নিজের চোখে। সেক্ষেত্রে যদি সেটা হ্যালুসিনেশন বা অন্য কোনো কিছু দ্বারা ভ্রম না হয়, তাহলে অবশ্যই মিথ্যা। কিন্তু এটা বললেই সমস্যা! বন্ধু ক্ষেপে উঠবেন, “মানেটা কী? আমার বাবা মিথ্যে বলছে বলতে চাইছিস?” কখনো সেটা মা, কাকা, মামা, ছেলে। শিক্ষিত বন্ধুও অনেক সময় ভুলে যান যে প্রতিটি মিথ্যেবাদী-ই কারোর না কারোর ছেলে অথবা মা অথবা কাকা অথবা কোনো আত্মীয় হন। এখন পাঠককেই স্থির করতে হবে তিনি কোনটায় বিশ্বাস করবেন – প্রমাণবিহীন কোনো গল্পে (তা সে যত বড় ‘অবতার’-ই বলুন না কেন), নাকি হ্যালুসিনেশন-এর প্রমাণিত বিজ্ঞানসম্মত ধারণায়!

এক্টোপ্লাজমের অস্তিত্ব আছে কি নেই, সেটা দেখার আগে ‘মরণের পারে’ থেকে আরো দু’টো কথা পড়ে নিই।

“যেসব মিডিয়ামকে ভিত্তি ক’রে প্রেতাত্মারা মূর্তি পরিগ্রহ করে তাদের দেহ থেকে বেশী ক’রে ঐ এক্টোপ্লাজম ক্ষরিত হ’তে থাকে। আমি নিজে প্রেতাহ্বায়ক বৈঠকে ঐ ধরনের এক্টোপ্লাজম নির্গত হতে দেখেছি।”(২১)

কথাটা আজকের দিনে হাস্যকর শোনালেও অনেকেই যে এতে বিশ্বাস করেন, তা তো ফেসবুকে ‘লাইক’-এর বহর দেখেই টের পাই। অভেদানন্দ এক্টোপ্লাজম দেখার কথা বলেছেন। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে, এই ‘এক্টোপ্লাজম’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিডিয়ামের চালাকি। বিভিন্ন দ্রব্যের সাথে আলুর শ্বেতসার (potato starch) মিশিয়ে কিংবা ডিমের সাদা অংশ, জল, সামান্য মাখন, কাপড়ের অংশ ইত্যাদি দিয়ে ‘এক্টোপ্লাজম’ তৈরি করা হত। মিডিয়াম সেটা আংশিকভাবে গিলতেন, তারপর আবার বার করে আনতেন। ১৯৩১ সালে হ্যারি প্রাইস প্রমাণ করে দেন যে মিডিয়াম হেলেন ডানকান লোক ঠকানোর জন্য ‘cheesecloth’ (গজ-কাগজের মত, কটনের কাপড়) দিয়ে ‘এক্টোপ্লাজম’ বানাচ্ছেন। Phantasmagoria বইতে মেরিনা ওয়ারনার এ বিষয়টার বেশ স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন(২২), “Dissident sitters who wanted to expose the mediums as frauds would attend a séance and then snatch at the ectoplasmic phantoms and bear them away in triumph: another such spoil was given to Harry Price to analyse in 1931. Gleefully, he pronounced this sample cheesecloth, and Duncan a charlatan.”

অনেক ক্ষেত্রে ‘butter muslin’ দিয়েও ‘এক্টোপ্লাজম’ বানিয়ে বোকা বানানোর কান্ড চলেছে। মানুষের ছবির কাট-আউট বানিয়ে সেটা দিয়েও ‘বিদেহী-আত্মা’-র এক্টোপ্লাজম বানানোর কারসাজি একই সাথে ধরা পড়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আস্তে আস্তে ‘এক্টোপ্লাজম’-এর স্বরূপলোকের সামনে এসে পড়ে এবং এই ভাঁওতাবাজি লুপ্ত হয়ে যায়। অভেদানন্দের ব্যাখ্যাও তাই ভুল প্রমাণিত হয়। দর্শনবিদ সি. ব্রডের ব্যাখ্যায়(২৩), “Physical mediumship in general, and that which is concerned with ostensible materialization in particular, reeks with and stinks of fraud. Some ‘ectoplasm’ is known to have been butter-musUn ; much more of it may most reasonably be suspected of being composed of that or of some other equally homely material; and I know of no case where the evidence is good enough to build upon.”

এরপরের বিষয়টাই সবচেয়ে হাস্যকর(আগের দাবিগুলোকে যদি তাও কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ ধরি)। অদ্ভুত এই দাবিটি করেছেন অভেদানন্দ,

“আমাদের দেহের কোন অংশ যদি এক্স-রে বা রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে পরীক্ষা ক’রে দেখি, দেখব-হাতের বা দেহের অংশটি কুয়াশাময় পদার্থকণিকায় পরিপূর্ণ, অস্থির চারিদিকে যেন তারা ঝুলছে। সুতরাং যে দেহকে আমরা জড় পদার্থ বলি আসলে সেটা জড় নয়, তা মেঘের বা কুয়াশার মতো এক পদার্থবিশেষ।”(২৪)

এমন দাবি শুনে রামগরুড়ের ছানারাও হাসতে বাকি রাখবে বলে মনে হয় না। এক্স-রে-র ছবিতে আমরা যে আমরা যে কুয়াশার মত দেখতে অংশটা দেখতে পাই, তা আসলে আমাদের দেহের মাংশপেশী, চামড়া ও অন্যান্য উপাদানের জন্য হয়। এক্স-রে যখন আমাদের দেহে প্রবেশ করে, তখন তা মাংশপেশী ভেদ করে গেলেও অস্থি ভেদ করে যেতে পারে না। মাংশপেশী ও অন্যান্য উপাদানের ঘনত্ব বিভিন্ন, এদের কিছুটা অংশ ভেদ করে এক্স-রে যেতে পারে না। সেই অংশগুলোরে ছবিই আবঝাভাবে ধরা পড়ে, যেটা কুয়াশার মতো দেখতে লাগে। এ’কথা আজ প্রমাণিত সত্য, অভেদানন্দের মতের সমর্থকরা এ’কথা স্বীকার না করলেও সভ্যতার কিচ্ছু যায় আসে না – কারণ এই সত্যের কথা আজ শিশুরাও জানে।

আধুনিক বিবর্তনবাদ নিয়ে অভেদানন্দের বক্তব্য কী?

“পুনর্জন্মবাদ বিবর্তনবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং কার্য-কারণের নিয়ম বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়মের ওপর নির্ভরশীল।”(২৫)

‘বিবর্তনবাদ’ কথাটার মানে কী? জানি না। মুক্তমনা-র লেখক-লেখিকাদের আমার পরামর্শ – বিবর্তনবাদ ছেড়ে পুনর্জন্মবাদ নিয়ে লেখালিখি করুন। এও তো ‘বিজ্ঞান’!

তবে অভেদানন্দের বইতে এ জাতীয় তত্ত্ব খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। অভেদানন্দের বইতে হ্যালুশিনেশনেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘স্বয়ং শ্লেট-লিখন’ অধ্যায়ে তো অভেদানন্দ লিখেছেন, তিনি হাতে বৈদ্যুতিক স্পন্দন অনুভব করেছেন।(২৬)

আসলে ভাববাদের বেড়াজালে মানবমনকে বেঁধে রেখে শাসকশ্রেণির হাত শক্ত করতে আত্মা-জাতীয় কুসংস্কারের জুড়ী মেলা ভার। শোষিত মানুষের লড়াইকে যদি অবদমিত করতে হয়, তাহলে তো তাঁদের মনে গেঁথে দিতে হবে ‘অদৃষ্ট’, ‘ভাগ্য’, ‘আত্মা’, ‘পরলোক’-এর মত গুলগপ্পো। আর সেই গাঁথুনি যদি হয় বিজ্ঞানের-ই মোড়কে, তাহলে তো কথাই নেই! ‘তাগা-পৈতে-আংটি’-পরিহিত ‘মার্কসবাদী’ নেতারাও যে তাতে যোগ দেবেন, এতে আর আশ্চর্যের কি আছে! বিশ্বজুড়ে চলা যুক্তিবাদী আন্দোলনের প্রভাবে আজ একে একে ভাববাদের মুখোশ খুলে পড়ছে, প্রকাশ্যে আসছে এর কদর্য রূপ। অপবিজ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানের দ্বন্দ চলবেই, কিন্তু শোষকের অস্ত্র ‘ভাববাদ’ ক্রমশই ভোঁতা হয়ে যাবে। কিন্তু, তার চেয়েও মজার কথা কী জানেন?

‘মরণের পারে’ বইটির প্রথম পাতায় লেখা আছে – “মরণের পারে (বৈজ্ঞানিক আলোচনা)”!

তথ্যসূত্র :

১) অরিজিন অফ লাইফ – ওপারিন, হ্যালডেন, বার্নাল
২) ধর্মসংস্কার ও কুসংস্কার – কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
৩) ধর্মসংস্কার ও কুসংস্কার – কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
৪) বৌদ্ধ দর্শন – রাহুল সাংকৃত্যায়ন, পৃঃ ৩৭
৫) বৌদ্ধ দর্শন – রাহুল সাংকৃত্যায়ন, পৃঃ ৩৭
৬) বৌদ্ধ দর্শন – রাহুল সাংকৃত্যায়ন, পৃঃ ১২
৭) অরিজিন অফ লাইফ – ওপারিন, হ্যালডেন, বার্নাল
৮) বিবর্তনের পথে মানুষ – শঙ্কর চক্রবর্তী, পৃঃ ৯-১০
৯) মৌলবাদ ও বিজ্ঞান (নিবন্ধ সংকলন), পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ – দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রাচীন ভারতে শল্য চিকিৎসা’ প্রবন্ধ
১০) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ২৭
১১) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ৬২
১২) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ৩২
১৩) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ৩২-৩৩
১৪) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ২৭
১৫) Death, Its Causes & Phenomena – Page-382
১৬) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ৪৩
১৭) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ৪৬
১৮) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ৪৭-৪৮
১৯) Hypothesis Concerning Soul Substance Together with Experimental Evidence of The Existence of Such Substance
২০) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ৪৮
২১) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ৪৮
২২) Phantasmagoria – Marina Warner, Page-299
২৩) Lectures on psychical research, 1959 and 1960 – C. D. Broad
২৪) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ৫১
২৫) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ২৭
২৬) মরণের পারে – স্বামী অভেদানন্দ, পৃঃ ১৬৪-১৬৫