শিগগিরই টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের। সরকার এখন নানান চাপে যুক্তরাষ্ট্রের আস্থা অর্জনের জন্য এই চুক্তি স্বাক্ষর করলে বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। এই চুক্তি নিয়ে চরম মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মজিনা এবং বাংলাদেশের মন্ত্রীরা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা গত ২৮ জুলাই এ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, টিকফা চুক্তি সই না করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে না। টিকফা চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে দরকষাকষিকে অস্বস্তিকর বিষয় উল্লেখ করে তিনি জানতে চান,এতে খারাপ কী আছে? আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না।
আবার গত পরশু বাণিজ্য মন্ত্রী বলেন, “ কেউ কেউ টিকফাকে বড় করে দেখে এবং ভয় পায়। বিষয়টি আসলে তা নয়। এটা বাণিজ্য বিষয়ে আলোচনার একটা সুযোগ তৈরি করবে”
তো মজিনা সাহেবের কাছে এই চুক্তিতে খারাপ কিছু নাই, আবার আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রীও জনগনের ভয় দূর করার তাগিদে বলেছেন এই চুক্তিতে ভয় পাওয়ার কিছু নাই, উভয়ের বক্তব্য কিন্তু এক ধরণের ভয়াবহতার ইঙ্গিত দেয়, তো আসুন দেখি এই চুক্তিতে খারাপ কিছু আছে কিনা কিংবা ভয় পাওয়ার মত কিছু আছে কিনা!
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মার্কিন আধিপত্য নিরঙ্কুশ হবে
এ চুক্তিতে উদার বাণিজ্যনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং মেধাসত্ত্ব আইনের বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে।
এ চুক্তির খসড়ায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশের বন্ধন সুদৃঢ় করার উল্লেখ থাকলেও চুক্তির বিভিন্ন প্রস্তাবনায় এবং অনুচ্ছেদে বাজার উন্মুক্তকরণ এবং সেবাখাতের ঢালাও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতগুলো বিশেষ করে সেবা খাতগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে।
চুক্তির ৫ এবং ১৯ নম্বর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য উদারনৈতিকনীতি গ্রহণ করবে। প্রস্তাবনা ৮ এ প্রাইভেট খাতের বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং অনুচ্ছেদ ৩ অনুযায়ী উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন’ প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল ও পরামর্শ সরবরাহ করবে। অনুচ্ছেদ ১-এ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু সার্ভিস সেক্টরের কথা উল্লেখ রয়েছে, ‘পণ্য’ উৎপাদনের বিষয়টি সংযুক্ত রাখা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করবে, তা শুধু সেবা খাতেই। তারা কোন পণ্য এ দেশে উৎপাদন করবে না। চুক্তির এসব ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিবে এবং বিদ্যমান শুল্ক এবং অশুল্ক বাধাগুলো দূর করতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশকে দেশীয় শিল্পের/কোম্পানির প্রতি সুবিধা প্রদানকারী বাণিজ্য সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ সংরক্ষণ নীতি প্রত্যাহার করতে হবে। টিকফা চুক্তিতে বলাই আছে, বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরিত ‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি’ অনুযায়ী মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির ওপর কোন কর আরোপ করতে পারবে না এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
এ চুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষাসহ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সেবাখাতে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশের জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেক্টরকে মার্কিন পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। ফলে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে দেশের সেবাখাতগুলো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাবে। এতে করে দেশীয় কোম্পানিগুলোর স্বার্থও বিঘ্নিত হবে। অবাধ মুনাফা অর্জনের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো সেবা ও পণ্যের দাম অত্যধিক বৃদ্ধি করবে। টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বন্দর প্রভৃতির ব্যবহার মূল্য বহুগুণ বেড়ে যাবে। সেবাখাতে বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর অবাধ ও বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করলে বাংলাদেশ তার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতির আওতায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষকে কম মূল্যে সেবাদানের যেসব কর্মসূচি নিয়ে থাকে তা সংকুচিত হবে অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে গরিব এবং সাধারণ মানুষের জীবনধারণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
চুক্তির ১৮ নম্বর প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা অনুসারে কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাসকরণ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে সুকৌশলে বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করে অনুন্নত দেশকে বাণিজ্য সুবিধা প্রদান থেকে বিরত রাকছে।
দোহা এজেন্ডা অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষিতে ৫% এর বেশি ভর্তুকি দিতে পারছে না অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কৃষিতে ১৯% এর বেশি ভর্তুকি দিয়ে তাদের কৃষি ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্যের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে দোহা নীতি অনুসারে আমেরিকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা। আমেরিকা ঠিকই বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিয়েছে তবে তাতে ওইসব পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাককে এর বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র নিজে কিন্তু বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করছে অথচ আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলোকে বাণিজ্য উদারনীতি গ্রহণে নানা চুক্তির মাধ্যমে বাধ্য করছে।
বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ার কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির মন ভুলানো আশ্বাস
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের দেশে বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়বে, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়বে আমাদের পণ্য রপ্তানিও। এশিয়ার দুটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি গণচীন এবং ভারত তার রপ্তানির যথাক্রমে ২১ এবং ১৯% পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করলেও তারা এ চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে প্রধান বাধা হচ্ছে শুল্ক বাধা। বর্তমানে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৫.৩% শুল্ক দিতে হয় অন্যদিকে চীনকে পরিশোধ করতে হয় মাত্র ৩%। তাহলে দেখা যাচ্ছে চীন টিফা চুক্তি স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম শুল্কে পণ্য রপ্তানি করতে পারছে। তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের লোভ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে কিন্তু টিকফা অ্যাগ্রিমেন্টে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোন নিশ্চয়তা রাখা হয়নি কারণ চুক্তির ১৪ নম্বর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় দেশ নিজ নিজ বাজারে পণ্য প্রবেশে নন ট্যারিফ বা অশুল্ক বাধা দূর করবে। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অশুল্ক বাধা খুব সামান্যই।
“যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে সেই অর্থে বাংলাদেশ জিএসপি বা শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। বরং প্রায় ৭৫ কোটি ডলার শুল্ক আমাদের কাছ থেকে পায় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বাংলাদেশের মোট রফতানি প্রায় ৪৮০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ পণ্য জিএসপি সুবিধা পায়। কাজেই দেশটি জিএসপি সুবিধা তুলে নিলেও কোনো অসুবিধা হবে না।” এই কথাগুলো বিজিএমএইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এর।কিন্তু এই জিএসপি সুবিধার কথা বলে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। এটা রীতিমত ধোঁকাবাজি !!
এল ডি সি’র নেতা হিসেবে বাংলাদেশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে
অনেক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞের মতে, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বাইরে স্বল্পোন্নত দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্যই আমেরিকা সহযোগিতামূলক উদ্যোগের ছদ্মাবরণে টিফা বা টিকফার মতো দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো করার চেষ্টা করছে। যদি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায় তবে আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক ফোরাম ডবিস্নউটিও এ আমেরিকা তার আধিপত্যবাদী বাণিজ্যনীতি বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে। এ লক্ষ্যেই পাকিস্তান, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ইরাক, উরুগুয়েসহ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই টিফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতা হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছে। বিশ্বব্যাপী পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিপরীতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য এসব ফোরামে বাংলাদেশ যাতে কোন ভূমিকা না রাখতে পারে সেজন্য বাংলাদেশকেও টিকফা চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে যুক্তরাষ্ট্র। কেননা টিকফা স্বাক্ষর হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া আর সম্ভব হবে না।
পেটেন্ট আইনের বাস্তবায়ন কৃষি, ওষুধ শিল্প, কম্পিউটার সফটওয়্যারসহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত হুমকির মুখে পড়বে
টিকফা চুক্তির অন্যতম দিক হচ্ছে মেধাসত্ত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন। এ আইনটি উন্নত দেশগুলোর মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করবে, যাতে দরিদ্র দেশগুলোর কাছ থেকে অবাধে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুণ্ঠনের আইনি বৈধতা পাওয়া যায়। উন্নত প্রযুক্তি এবং উৎপাদন পদ্ধতির অধিকারী হওয়ার পর তারা এ জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। এর মাধ্যমে তারা চায় যেন অবশিষ্ট বিশ্বপ্রযুক্তি ও উৎপাদনের জন্য তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পেটেন্ট আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের অনুপস্থিতির কারণে বহুজাতিক মার্কিন কোম্পানির অবাধ বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। টিফা চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই মেধাসত্ত্ব আইন মানতে বাধ্য করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে ২০১৬ সালের আগেই মেধাসত্ত্ব আইন মেনে চলতে হবে, কেননা চুক্তির ১৫ নম্বর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসত্ত্ব অধিকার (IPR) এবং অন্যান্য প্রচলিত মেধাসত্ত্ব আইনের যথাযথ এবং কার্যকরী রক্ষণাবেক্ষণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
দোহা ঘোষণা ২০০০ অনুযায়ী বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার আওতায় বাণিজ্যবিষয়ক মেধাসম্পদ স্বত্ব চুক্তি অনুসারে স্বল্পোন্নত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় এবং ২০১৬ পর্যন্ত ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাসত্ত্ববিষয়ক বিধিনিষেধ থেকে ছাড় পেয়েছে এবং এই সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পেটেন্ট করা ওষুধ উৎপাদন এবং রপ্তানি করতে পারছে। এমনকি প্রয়োজন হলে এ সময়সীমা আরও বাড়ানো হতে পারে। কিন্তু টিকফায় সে ধরনের কোন সুযোগ রাখা হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প, কম্পিউটার সফটওয়্যারসহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমেরিকার কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স খরচ বহন করতে গিয়ে অভূতপূর্ব লোকসানের কবলে পড়বে। ফলে বিভিন্ন পণ্য এবং প্রযুক্তির দাম অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যাবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই দেশকে সফটওয়্যার লাইসেন্স ফি বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। মেধাসত্ত্ব আইন কার্যকর হলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক ওষুধ তৈরি করতে পারবে না। আমাদের কয়েকগুণ বেশি দামে বিদেশি কোম্পানির পেটেন্ট করা ওষুধ খেতে হবে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে রপ্তানি সম্ভাবনা হারাবে। দরিদ্ররা ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাবে। আমাদের জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেননা দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজ দেশেই তাদের ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ফলে অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। তাছাড়া ওষুধের পেটেন্ট আগে দেয়া হতো সাত বছরের জন্য, এখন বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস আইনে তা আরও বাড়িয়ে ২০ বছর করা হয়েছে। অর্থাৎ আবিষ্কারক কোম্পানি সুদীর্ঘ ২০ বছর ধরে নিজের ইচ্ছামতো দামে ওষুধটির একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা লুট করবে। পেটেন্ট আইন বাস্তবায়ন আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
পেটেন্টের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এখন আর শুধু সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং ফল ফসল এবং গাছ-গাছড়ার ওপরও বিস্তৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট আইনে বলা আছে, ‘কোন কিছুর পেটেন্টের বেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অলিখিত উৎসের অনুসন্ধানের কোন বাধ্যবাধকতা নেই।’ এর মানে হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশের প্রচলিত উৎপাদন প্রণালি, জীববৈচিত্র্য, কৃষকদের নিজস্ব শস্যবীজ ইত্যাদি শুধুমাত্র প্রযুক্তি এবং অর্থের জোরে পেটেন্ট করে নিতে পারবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।
বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশের নিজস্ব জীববৈচিত্র্যের অনেক জীব-অণুজীব এবং উদ্ভিদ প্রজাতি এখন বহুজাতিক কোম্পানির পেটেন্টের দখলে। ভারত উপমহাদেশের শতাধিক গাছগাছড়া যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিসে রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। নিম, হলুদ, মসলা, থানকুনি, চিরতার রস, ট্রাইফোলিয়েট অরেঞ্জসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ফলদ এবং ওষুধি গাছ যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের কোম্পানির পেটেন্ট আগ্রাসনের শিকার হতে চলেছে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তাদের উন্নত জেনেরিক টেকনোলজির মাধ্যমে ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্ট নির্ণয় করে অন্য দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিজ সম্পদকে নিজের বলে পেটেন্ট করিয়ে নিচ্ছে। কৃষিতে পেটেন্ট বাস্তবায়ন হলে কৃষকদের শস্যবীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে। মেধাসত্ত্ব আইন অনুযায়ী রয়্যালিটি পাবে আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর ধ্বংস হবে দেশি প্রজাতি, পরিবেশ এবং কৃষি উৎপাদন কাঠামো। বীজ এবং কৃষি পণ্যের দাম অনেকগুণ বেড়ে যাবে বলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
এছাড়া টিকফার প্রস্তাবনায় মানবাধিকার, শ্রমের মান এবং শ্রমজীবীদের অধিকার ও পরিবেশগত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তার লক্ষ্য শ্রমজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয় বরং এগুলোকে নন-ট্যারিফ বাধা হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
অর্থাৎ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ এবং নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘি্নত হবে বিনিময়ে লাভের পরিমাণ হবে সামান্যই। তাই জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। দেশপ্রেমিক জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
লেখকঃ মাহমুদ যোবায়ের
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ দ্রোহের নীল প্রহর, ভূল জন্মে ভালোবাসা।
ভালো লাগলো আপনার বিশ্লেষণ। টিকফা চুক্তি ও কৃষির বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের কৃষি বিপ্লবের সম্ভাব্য রুপরেখা কি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আমেরিকা! গত ১০০ বছর ধরে এই দানবের চেহারা আরও দানবীয় হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। এরা সার্থের বাইরে কিছুই করে না।
আচ্ছা, আমেরিকাকে কি ধ্বংস করে দেয়া যায় না !! হা হা হা।
লেখা ভালো লাগল। জ্ঞান গর্ব লেখা। যার বুঝতে পারবেন তারা অসহায়, আর যারা পরে বুঝবেন = পাখি ততক্ষণে আমেরিকায় উড়াল দিছে… মোগো কিসমত-ই খারাপ।
অর্ধেক পড়েছি, তাতেই ছক্কা।
লেখনির ধরনটা চমৎকার।। তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোকে অর্থনৈতিকভাবে পুঁজিবাদী দেশগুলোর উপর নির্ভরশীলতা তৈরি করার কৌশল অনেকদিনের , টিকফা চুক্তি তার একটি নমুনা।। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া এইসব ফ্যাসিবাদী চুক্তি রুখে দেয়া সম্ভব নয়।।
শুধু রাজনৈতিক ভাবে সার্বভৌম হলেই ত হলো না, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব আসল। তার জন্য দরকার বিপুল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বোরখা আর দাঁড়ি যদি বাড়তে থাকে, বাংলাদেশ পঙ্গু রাষ্ট্র হয়েই থাকবে। সুতরাং বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন উন্নয়ন আগে দরকার।
আজকেই দেখলাম খবর, ভারতের ক্রেডিট রেটিং বি বি বি থেকে কমিয়ে দেবে এস্ন পি। এর মানে হলে, বিদেশী মুদ্রা ধার করার খরচ বাড়বে-ফলে, নিজেদের বাঁচতে, ভারত সরকারকে সরকারি ভর্তুকি কমাতে হবে। এছাড়া ভারতের হাতে উপায় ও নেই।
আমেরিকাতে ভর্তুকি একসময় দিত-ঘাটতি বাজেটের ফলে সেখানেও ভাল কোপ এসেছে। আরো আসবে।
ধণতানন্ত্রিক সিস্টেমে প্রতিটি অর্থর/বিনিয়োগের পেছনেই একাণ্টাবিলিটি থাকে। এটা না থাকলে, সম্পদের অপচয় হবে এবং উৎপাদন কমে যাবে। যার জন্য স্যোশালিস্ট সিস্টেম সম্পূর্ন ব্য্ররথ হয়েছে ঐতিহাসিক ভাবে।
ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমে বাঁচতে হলে, ক্যাপিটালিজমের রুল বুক ভেঙে ত কে বাঁচতে পারবে না। সেই রুল বুক নিসন্দেহে ভাল না-তা বড়লোক কে আরো বড়লোক, গরীবকে আরো গরীব করবে। কিন্ত বিকল্প ব্যবস্থা কি?
বিকল্পের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অমানবিক দিকটি না মানা ছারা উপায় নেই।
১. RMG সেক্টরকে ব্ল্যাকমেইল করে যুক্তরাষ্ট্র TICFA চুক্তি করতে চাপ দিচ্ছে। এটা একেবারে নগ্ন ভাবে ফুটে উঠছে। বাংলাদেশ সরকার নিজেদের কিছু হীন সিদ্ধান্তের জন্য নিজেরাই ফেঁসে গেছে এখন দেশের স্বার্থ বলি দিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে চেষ্টা করছে।
২. বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিভাগ মনে হয় পৃথিবীর সবচাইতে “বলদ” ফরেন সার্ভিস গুলোর মধ্য অন্যতম। শুধু এবং শুধুমাত্র একাডেমিক ফ্যাক্টর দিয়ে কিছু সবকিছু যে নির্ণয় করা যায়না এটা এই সার্ভিসের কর্মরত নিয়মিত ক্যাডারগন প্রমাণ করছেন। তার উপরে আছে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করে ডেপুটেশনে আসা সরকারের অন্যান্য বিভাগের ব্যক্তিরা, যাদের মাতব্বরির কারণে যা হওয়ার কথা তার থেকেও খারাপ। সবচাইতে ভয়াবহ যখন দেখা যায় “সরাসরি” “মৌসুমি গ্যাজেটেড” কর্মকর্তারা যারা সরাসরি প্রধান মন্ত্রীর নিজ অনুগ্রহে নিয়োগ পান। সরাসরি নন ক্যারিয়ার কর্মকর্তা অবশ্যই প্রয়োজন কেননা সব কাজ ক্যারিয়ার অফিসাররা আসলেই করতে পারেনা। কিন্তু এসব রাজনৈতিক নিয়োগ অবশ্যই যোগ্যও ব্যক্তিদের দেওয়া উচিত।
৩. রাষ্ট্রের শীর্ষ পদের “নিয়মিত” কাজ অনেক মানুষই করতে পারবে। কিন্তু এসব পদে নিয়োজিত ব্যক্তির পরীক্ষা তখনই আসে যখন “অনিয়মিত” মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছিলেন। বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিনও ক্রিটিকাল মুহূর্তে এমন ভুল করবেন বলে নিশ্চিত ধরা যায় (যদিনা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী বর্তমান রাষ্ট্রপতি কোন অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যায় না পরেন).
আপাত শান্তিকালীন সময়ে পররাষ্ট্র এবং অর্থমন্ত্রণালয় হল এমন দুটি মন্ত্রণালয় যেখানে নিয়মিত পরীক্ষা দিতে হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দিপু মনি কতটুকু সফল ?? “রুটিন কাজ” তথা ফাইল দেখা কিংবা বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে দেখা করা ইত্যাদিতে হয়ত ব্যর্থ নন; তবে তার মূল কাজ “কূটনীতি” তে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ একথা দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলা যায়।
৪. আপন ইচ্ছে মত দেশ চালানো সোজা করতে এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অনভিজ্ঞ ( যাদের কেউ কেউ সামান্য অভিজ্ঞও নন!!) ব্যক্তিদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করে দেশের যে কি পরিমাণ ক্ষতি করছেন এটা আসলে সময়ই জানান দেবে।
আম্রিকার পলিসি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই, শুধু আফসোস এই আম্রিকার হয়ে দালালি করতে সংখ্যায় কতিপয় (কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক ভাবে এরাই দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রন করে,) শুকর শাবকরা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিতে সর্বদা প্রস্তুত। অবশ্য এদের শ্রেনি চরিত্র দেখলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায়। হস্তপদপশ্চাৎদেশ চাটাচাটি করেই যারা ক্ষমতার স্বাদ পায় তাদের কাছে এর থেকে ভালো কিছু আশা করা রীতিমত অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে।
লেখার কয়েকটা লাইন আমি আবার এখানে উদ্ধৃত করতে চাইঃ
আমরা যতদিন না আম্রিকা আর বাঙালি আম্রিকানদের এই ধোকাবাজি বুঝতে না পারব ততদিন আমরা দর্শক আর ওরাই খেলোয়ার থেকে যাবে। হা হুতাশ করা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না।
@সাইফুল ইসলাম,
তার মানে, আপনি ধরে নিচ্ছেন, এই লেখার বিষয়বস্তুগুলো একেবারেই নতুন বা অনালোচিত বিষয়? বা, আমরা দর্শক আর ওরা খেলোয়ার —–এর মূল কারণ, আমরা আমেরিকার এই ধোঁকাগুলি ধরতে পারছি না?
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, সত্যিই আমরা বুদ্ধু, ধোঁকা বুঝি না, কিন্তু এখন তো বুঝলাম। তারপর? এখন কি করব আমরা??
আপনি দেখেছেন, মজিনা কতটা পাওয়ারফুল বাংলাদেশে? আমার তো মনে হয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে পাওয়ারফুল ম্যান, মজিনা! প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী নেত্রী তার কাছে কিছুই না!!! কিন্তু মজিনার এই পাওয়ারের পেছনের কারণ কি মনে হয়, আপনার? আমাদের আম্রিকার ধোঁকাবাজি বুঝতে পারার ব্যর্থতা???
@সাইফুল ভাই,
স্যরি! একটা প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিলাম, আচ্ছা, রানা প্লাজায় বিপদের আশংকা থাকার পরও অসহায় শ্রমিকগুলো কেন ঢুকতে বাধ্য হয়েছিল সেখানে বলতে পারেন? শ্রমিকেরা কি জানত না সেখানে বিপদ? বা, বিরোধী নেত্রী কেন আহবান জানিয়েছিলেন ওবামাকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে? না বুঝে? জলিল সাহেবের চায়ের টেবিলে কেন আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল? জলিল সাহেব আমেরিকার চাল বুঝতেন না??
”আমরা যতদিন না আম্রিকা আর বাঙালি আম্রিকানদের এই ধোকাবাজি বুঝতে না পারব ততদিন আমরা দর্শক আর ওরাই খেলোয়ার থেকে যাবে।” —- কথাটিকে যদি একটু চেঞ্চ করে ”আমরা যতদিন না নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারব, যতদিন নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়োল মারব স্বার্থান্ধ রাজনীতির তাবেদারি করে, ততদিন আমরা দর্শক আর ওরাই খেলোয়ার থেকে যাবে।”- এভাবে বলি, তাহলে কেমন হয়?
@কাজি মামুন,
আপনার প্রশ্ন অনেকগুলো দেখালেও মূলত দুটো।
প্রশ্ন একঃ
আম্রিকা(এখানে আম্রিকা একটা ভ্যারিয়েবল টাইপ জিনিস, আমার বলা আম্রিকা কোন দেশের “মানুষের” প্রতিনিধিত্ত্ব করে না, করে বৈশ্বিক পুঁজি এবং অবধারিতভাবেই পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রকে যেটা এখন আম্রিকা নিয়ন্ত্রন করছে।)র কলকাঠি নাড়াচাড়া কি মানুষ বোঝে কী না?
প্রশ্ন দুইঃ
শ্রমিকদের রানা প্লাজায় কাজ করতে কি বাধ্য করেছিল বা তারা কেনো ঢুকল বিপদ জেনেও।
আমি দুটোর উত্তর নিজে যা বুঝি দিচ্ছি বাকিটা বোঝার দায়িত্ব আপনার। যদিও এই দুটোর কথা বলতে স্বাভাবিকভাবেই আপনার অন্যান্য প্রশ্নগুলোর উত্তরও নোক্তা হিসেবে আসবে।
প্রথমেই বলে রাখি, আমার মন্তব্য পাঠে আপনার ভুল হয়েছে। কীভাবে? আম্রিকান পলিসি আমরা বুঝতে পারছি না, এই কথা বলে আমি এখানে আমরা বলতে কাদের বোঝাচ্ছি? আপনি এখানে আমরা মানে করেছেন সরকার। আপনার পাঠের ভুল এখানেই। অবশ্য এই ভুল আপনার নতুন নয়, আপনার সাথে আগেও আমার তর্ক হয়েছে আম্রিকান পলিসি নিয়ে, আপনি সাধারন জনগনের সাথে সরকারকে এক করে হিসাব করেছেন যার জন্য আম্রিকার সাম্রাজবাদী কর্মকান্ডের দোষ অবধারিতভাবেই চাপিয়েছেন আক্রান্ত দেশের উপরে।
এখানে আমরা কথাটা সরকার কথার প্রতিনিধিত্ত্ব করে না। এখানে আমরা মানে সাধারন জনগন, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, যারা ভাতের হিসেব করতে করতেই শেষ বয়সে পৌছে যায়। আবার এই আমরা মানে আপনি আমি পেটে ভাতওয়ালা মধ্যবিত্ত শ্রেনির দেশপ্রেমিক স্লোগান জপা সুবিধাবাদীরাও। আমাদের কাছে গর্বের বিষয় “ইনুস” সাবের নোবেল বিজয়। এই আমরা বুঝি না কেন ইনুস সাব নোবেল পেলেন। সুতরাং যদি সাধারনীকরন করে এককথায় বলি, এখানে আমরা মানে সরকার ছাড়া সবাই। আবার সরকারের কথাটাও আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, সরকার মানে শুধু হাসিনা খালেদা আর মন্ত্রীরাই না, বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে যারাই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বহিঃশক্তিকে জনগনের চোখের আড়ালে রাখতে চাচ্ছে তারাও এই সরকারের(মানে সরকার কথাটার) অংশ। যার জন্য আমি সরকার থেকে এখানে “ক্ষমতাবান” কথাটা বলতেই পছন্দ করব কারন প্রথমত “সরকার” ভাবনাটা মূলগতভাবে নঞর্থক নয় আর দ্বিতীয়ত শুধু সরকার বললে সামগ্রিক ছবিটা আমাদের ভাবনার দেয়ালে প্রতিফলিত হবে না।
তারমানে আমরা বুঝতে পারছি না বলতে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর বাইরের বেশিরভাগ জনগনের কথা বোঝাচ্ছি যারাই প্রকৃত ক্ষমতার দাবীদার এবং উৎস।
জনগনই যদি প্রকৃত ক্ষমতার উৎস হয় তাহলে জনগন কেন মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে বন্দি, কেন আম্রিকা দেশের “মজিনা”রা দেশের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ন স্থানে, গুরূত্বপূর্ন কাজে খোমা নিয়ে উপস্থিত থাকে? এটার আসল কারন বলা এই সল্পপরিসরে সম্ভব নয়। অন্য কোথাও হয়ত বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এক্কেবারে সাধারন জনতার দৃষ্টিতে আমরা কি দেখতে পাব? বাঙলাদেশের বা আমাদের মতন গরীব দেশগুলোর অর্থনীতি, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, এমন কি শিক্ষা নীতি আসলে কারা ঠিক করে? এই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে যদি একটা সচ্ছ ধারনা আনতে পারেন তাহলেই বুঝতে পারবেন কেন পত্রিকার সাংবাদিকরা মূর্খের মত মজিনার কাছে জিজ্ঞেস করে “বাঙলাদেশের বিভিন্ন কর্মকান্ডে আপনি সন্তুষ্ট কী না”, তাহলে বুঝবেন এই মজিনারা কেন একজন কাজি মামুনের থেকে বেশি গুরূত্বপূর্ন। ওয়াশিংটন পোস্টের কোন সাংবাদিক আম্রিকায় বাঙলাদেশের রাষ্ট্রদুতকে জিজ্ঞেস করবে ইরাক হামলায় আপনি খুশি কী না? বরঞ্চ আমরা দেখি ক্রিশ্চিয়ান আমানপৌর’রা আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে একটা মগবাজারের মাগীর মতন ব্যাবহার করে এবং আমরা দেশে বসে সেটাকে সাংবাদিকের সাহসিকতা, দক্ষতা বলে প্রশংসা করি!
দেশের নির্বাচন কারা নির্ধারন করে? মধ্যবিত্ত শ্রেনি এই উত্তরে আম্রিকা-ভারতের কথা মুখস্ত বলে গেলেও যখন বলা হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা দেশে সামরিক ঘাটি নির্মানের চেষ্টা করছে, বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি দেশের সার্বভৌমত্বের উপরে আঘাত, সোফা পরে হানা পরে টিফা এবং সবশেষ টিকফা যেটা নিয়ে আলোচনা করা পোস্টে আমরা এই বাতচিত করছি এগুলোর কথা তোলা তখন এই প্রশ্নগুলো সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে হয়ে যায় “ষড়যন্ত্র তত্ত্ব”। এগুলো যদি না বুঝি তাহলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের উপরে ছড়ি ঘোরাবে না তো কি চুম্বন করবে?
তাহলে এই ছড়ি ঘোরানো জিনিসটা তাহলে সবশেষে ক্ষতি করছে কার আর উপকার হচ্ছে কার?
ক্ষতি হচ্ছে দেশের জনগনের আর উপকার হচ্ছে যারা ছড়ি ঘোরাচ্ছে আর যাদের দিয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে তাদের। সুতরাং ঐ জলিল বা হাসিনা বা খালেদা এরা হচ্ছে ছড়ি ঘোরানো উইন্ডমিলের হেলপার। আর হেলপার তার হেল্পারি না জেনে করে না, জেনে বুঝে তার বেতনের জন্যই করে।
এইবার দ্বিতীয় প্রশ্নে আসি। শ্রমিকরা কেন ঝুকি থাকা সত্ত্বেও রানা প্লাজায় ঢুকল। যেই কারনে সংসদ ভবনের লেকের পাশে সন্ধ্যায় গেলে রক্তহাড়মাংসের যৌনপুতুল পাওয়া যায়, যেই কারনে সমাজে চোর, সন্ত্রাসীর সৃষ্টি হয়, ঠিক একই কারনে শ্রমিকরা ঝুকি আছে জানা সত্ত্বেও কারখানায় কাজ করতে গিয়েছিল। যদিও আমরা এই খবরও পেয়েছি যে তাদের জোর করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু মূল কারন পেট।
সবাই ১৭ দিন পরেও বেঁচে থাকা রেশমার জীবনীশক্তি দেখে মূর্ছা যাচ্ছেন তারা মূর্ছাই যাবেন,কারন এক বেলা ফেয়ার এন্ড লাভলী বা ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম না মাখলে যাদের গ্লামারে টানাটানি পড়ে তারা ১৭দিন বিস্কিট আর পানি খেয়ে বেঁচে থাকা কারো কথা শুনলে বিস্মিত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। বরঞ্চ এই খবরে কয়েকজন যে স্ট্রোক করে নাই এইত বেশি। এই রেশমারা আরো ১৭ দিন না খেয়ে থাকতে পারত, কারন তারা সবসময়েই আধপেটা খেয়ে মালিকের পুঁজিবৃদ্ধি করে যাচ্ছে। না খেয়ে থাকা ইজন’ট এ বিগ ডিল ফর দেম। এটাই তাদের নিয়তি করে দিয়েছে আমাদের সিস্টেম।
আরেকটা ব্যাপারে একটু বলি।
আম্লিগ আম্রিকার সাথে কোন কারনে বনাবনি না হওয়ায় মুখ ঝামটা মেরে রাশিয়ার সাথে একটা ১৪ হাজার কোটি টাকার চুক্তি করে এসেছে। সেই প্রেক্ষিতে কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা শুনলাম এফবিআই-এর একজন স্থায়ী প্রতিনিধি বাঙলাদেশে আসবে। যাই হউক, আসল কথা হল, একটা দালাল সরকার, একটা জনবিচ্ছিন্ন সরকার আম্রিকার মতন একটা জায়ান্টের সাথে বনাবনি না হওয়ায় মুখের উপরে দরজার কপাট লাগিয়ে দিলো(বলে রাখা ভালো এখানে দেশ প্রেমের কোন ব্যাপার স্যাপার নাই)। সেখানে জনগন যদি আম্লিগের সাথে থাকত তাহলে আম্রিকা এই দেশে কোন বাল কি ছিড়তে পারত বলে আপনি মনে করেন?
প্রতিপক্ষকে ছোট করে দেখতে নাই, তারপরেও বলা যায় একটা দেশের জনগন যখন একসাথে থাকে তখন দুনিয়ার কোন শক্তি নাই তাদের দাবায়ে রাখে। ভিয়েতনাম-আম্রিকার যুদ্ধ একটা জলজ্যান্ত উদাহরন। সুতরাং আমাদের না বোঝাটা অবশ্যই প্রধান কারন। আর এই “আমাদের” বলতে কাদের বুঝিয়েছি সেই কথা উপরে যেহেতু একবার উল্লেখ করেছি আবার পুনরাবৃত্তি করলাম না।
@সাইফুল ভাই,
এমন কোন ব্যবহার আছে, যা ‘মগবাজারের মাগীর’ জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে? তাহলে আমরা কেন এমন শব্দচয়ন করি? এখানে ‘আমরা’ বলতে আমি, আপনি, সবাই। কিন্তু কেন করি এমন শব্দের প্রয়োগ? উত্তরটা পাওয়া যাবে নিজের বাক্যাংশেঃ
হ্যা, আমরা সুবিধাবাদী বটে, নইলে ‘মগবাজারের মাগী’র জন্য আলাদ কোন ব্যবহার আমরা আবিষ্কার করতাম না! আজ যদি আমরা আমেরিকান মধ্যবিত্ত হতাম, তাহলে হয়ত বলতাম, আমানপৌরের কি দায় পড়েছে এত্ত এত্ত বিনয় দেখানোর?? দীর্ঘ মেয়াদে সবই মধ্যবিত্তের আবেগ, যার জন্ম সুবিধাজনক মধ্য-আসন থেকে!
আর আমরা বলতে আমাদের আমজনতাকেই বুঝিয়েছি, আপনি একজন রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করুন, দেখতে পাবেন, সেও বলবে, ”আম্রিকা আমাগো সব লইয়া যাইব, আমাগো তেল-গ্যাস সব হাতায় নিব!” তাহলে, আম জনতা জানে, মধ্যবিত্ত জানে, হাসিনা-খালেদাও জানে আম্রিকার সাম্রাজ্যবাদি ক্যারেক্টার। তবু আমরা জাগতে পারছি না কেন? না জানার বা বোঝার কারণে? মোটেও না! একমাত্র কারণঃ আমাদের প্রধান নেতাদের পকেটে পুরে রেখেছে কি আম্রিকা এম্নি এম্নি? আমাদের নেতারা আমাদের জাগতে দিচ্ছে না!! জাগা মানে, আম্রিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা! আমাদের নেতারা যদি সেইরাম হতেন, তাহলে আমরা জাগতে পারতাম। উদাহরণ চান?? দেখুন না, আম্রিকার নাকের ডগায় বসে চ্যাবেস কিভাবে ভেনিজুয়েলিয়ানদের জাগিয়ে তুললেন?
@কাজি মামুন,
উক্ত শব্দগুচ্ছ আমি আমানপৌরকে লক্ষ করে করিনি, করেছি হাসিনাকে লক্ষ করে। ভাড়া খাটানো যৌনপুতুলের সাথে একজন যেমন করে কর্তৃত্বের ভাষায় কথা বিনিময় করে সিএনএন-এর সাংবাদিকা হাসিনার সাথে একই টোনে কথা বলেছে।
তাই নাকি?!! আমার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ন উলটো। আমি অন্তত কোন রিকশাওয়ালার মুখে আম্রিকান পলিসি জানে এমন শুনি নাই। আপনি শুনতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে আমি সুখি হব।
চাবেজের ভেনিজুয়েলা আর হাসিনা খালেদার বাংলাদেশের পরিস্থিতি এক না। চাবেজ বাঙালদেশে জন্মগ্রহন করলেও আজকে উনি ভেনেজুয়েলার মতন জনগন জাগ্রত করতে পারতেন না কারন পরিস্থিতি আলাদা। নেতৃত্বের অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু নেতৃত্বই তো সব না। বাঙলাদেশের ইতিহাসে খুন কম ভালো নেতৃত্ব এসেছে তাও তো না, কিন্তু কাজ হল কই? তারা পরাজিত হয়েছে। ভুল কৌশল একটা কারন, আবার ক্ষমতার গদিসীনদের ক্ষমতাকেও এই ক্ষেত্রে ছোটো করে দেখার উপায় নাই। সবকিছু মিলিয়েই আর কী।
জনতার কাছে পৌছাতে না পারলে, সঠিক পরিস্থিতি তৈরী না হলে কোন জাগরনই সম্ভব না। হোক সে লেনিন, হোক সে চাবেজ, হোক সে মাও, হোক সে কাস্ত্রো, হোক সে চে, হোক সে মুজিব।
@সাইফুল ভাই,
জনতার কাছে পৌঁছতে না পারার ব্যর্থতা কার? কার দায় বেশী? নেতার নাকি জনতার?
মন্তব্য করতে চাইছিলাম না, হয়ত আপনার কাছে এখন এটি কূটতর্ক বলেই মনে হচ্ছে! যাইহোক, এটাই শেষ। বিতর্ক থেকে অনেক কিছু শেখাও তো যায়!