না, নতুন ঘটনা নয়। তারপরও জন ডানের সেই কবিতার মতো বলতে হয়, মানুষ আসলে বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ নয়। মৃত্যুর সংবাদবাহী ঘণ্টাটা বাজে আমাদের সবার জন্যেই। আর এমনি অসহায় মানুষের ধূলিধূসরিত মৃতদেহ দেখলে আরো বেশি করে মনে পড়ে যায় আমরা একটা অমানুষের বস্তিতে বসবাস করি।

তৈরি পোশাক কারখানা বা আরএমজি নামের পোশাকি নামের পেছনে অনেক শোষণ, অনেক অবমাননা, অনেক বঞ্চনার চাপাপড়া পাহাড়। রেমিট্যান্স বাড়ে, রিজার্ভের সংখ্যা ফুলেফেঁপে ওঠে, সেসব দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে অর্থ মন্ত্রণালয় আর সান্ত্বনা পাই আমরা আমজনতা, যদিও জানি না সেটা আমাদের ঠিক কী কাজে আসছে।

ইন দ্য মিনটাইম, কাপড় কারখানার সেলাইশ্রমিকেরা কেউ গালি খেয়ে মরে, কেউ বিষ খেয়ে, কেউ আগুনে পুড়ে আর কেউ দালানের মহত্ত্বের নিচে চাপা পড়ে। মৃত্যুর তালিকা বাড়তে বাড়তে দাঁড়ায় কাগুজে পরিসংখ্যানে আর আমরা হয়তো শুকনো চামড়ার নিচে আরেকটু স্বস্তিতে শিউরে উঠি যে পোড়া বা ঝুলন্ত লাশ বা চাপাপড়া লাশের দৃশ্যমান অংশটা আমাদের নিজের বা প্রিয়জনদের কারোর নয়। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে কেউ ফেসবুকে বসি, কেউ অফিসের টেবিলে, কেউ খাবারের। এবং মনের ভেতরে আমরা কার্পেট দিয়ে প্রাণপণে ঢাকতে থাকি সেই অমোঘ উচ্চারণ, তুমিও হয়তো কাল…

প্রিয় স্বদেশ, তুমি খুব ভালো নেই এই বছরটায়, আমি জানি। তোমার রক্তাক্ত জ্বালামুখী যুগপ্রাচীন ক্ষতের বিচার হয় নি, কতদূর হবে জানা নেই। তোমার ক্ষতকারকদের দাপটে আমজনতা অস্থির। সরকার অন্যমনস্কভাবে গালের ব্রণ খুঁটছে, খিস্তি করে হুমকি দিয়ে উঠছে সাধারণ্যে আর মেঢ্রমাস্তানি দেখাচ্ছে মাঝেসাঝে কিবোর্ডসৈনিক ব্লগারদের গ্রেপ্তার করে। ধর্মপরায়ণ গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতার কল্পতরুর নাগাল পেলো বলে বেজায় লাফঝাঁপ খাচ্ছে। অস্থিরতা তোমার ঘর্মাক্ত মুখে, উদ্বেগ তোমার ছিন্ন বস্ত্রাবৃত বুকে। ভবিষ্যৎ বড্ড দুরুদুরু বুকে তোমার দরজার বাইরে পায়চারি করছে। হিংস্রতা আর হানাহানির অলঙ্কারগুলো তোমার গায়ে জোর করে কেটে চেপে বসছে। তুমি অসহায় ভাবে এদিক সেদিক চাইছো মুক্তি আর স্বস্তির আশায়, তোমার তরুণতর সন্তানেরাও ছটফট করছে তোমার কষ্টে, কিন্তু বৃথাই। কর্তাব্যক্তিরা তোমায় যেন বেশ্যার মতো ভাড়া খাটিয়েই তৃপ্ত। এইই দেখে যাচ্ছি আমরা সবাই যেন কোন ফ্রেডের নৃশংসতম অসহায় দুঃস্বপ্নে।

আজ যেটা হয়ে গেলো সাভারে, সেটা এক কথায় মানুষকে খুন করাই। খুন করাটা সব সময় প্রথাগত ঢঙে নিজের হাতে হতে হবে এমন কথা নেই। আগাথা ক্রিস্টির একটা উপন্যাসে খুনি ব্যবহার করেছিলো একটি সাইনবোর্ড, লিফটের সামনে বসিয়েছিলো সেটা: “এটা অচল।” শিকার কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে ওপরের তলায় উঠে হাঁফ আর প্রাণ-দুটোই ছেড়েছিলো।

তেমনি অননুমোদিত ভাবে বিশাল দালান খাড়া করে (পাঁচ তলার অনুমোদন নিয়ে আট তলা), ফাটল-ধরা দালানের বিন্দুমাত্র পরীক্ষা না করিয়ে, স্থানীয় প্রকৌশলীর চেতাবনিতে লেশমাত্র কর্ণপাত না-করে, “সামান্য প্লাস্টার খসে-পড়া এটা”, এমনটা বলে পুরো ব্যাপারটা লঘু করে, প্রশাসনকে কুক্ষিগত করে ও স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ করে “আপনারা তো সারা দেশের প্লাস্টার খসিয়ে দিয়েছেন” এমনটা বলে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ভবনের মালিক সাভার যুবলীগের পৌর কমিটির আহ্বায়ক সোহেল রানা কফিনটা তৈরি করেছেন আর গার্মেন্ট কারখানার মালপ্রেমী মালিকেরা আসাসোঁটা নিয়ে গরুছাগলের মতো শ্রমিকদের ঠেলেঠুলে কারখানার কবরখানায় ঢুকিয়ে কফিনে ঠুকেছেন শেষ পেরেকটা।

স্পেক্ট্রাম বস্ত্রকারখানায় এর আগে মাটিতে ঢুকে জ্যান্ত কবর হয়েছে অনেকের, তাজরীন গার্মেন্টে পুড়ে মরেছে ১১৩ জন, এমনি ভুলে-যাওয়া কতশত শ্রমিকদের লাশের পাহাড় উদাসীনতায় ঠেলে দিয়ে আমরা নতুনতর উত্তেজনায় আর আলোচনায় ভুগেছি। এতশত মানুষের মৃত্যুর পর কোন একটি অপরাধীর বিচার হয় নি, কোন একটি দায়ী মানুষ দাঁড়ায় নি কাঠগড়ায়, কারুকে ভোগ করতে হয় নি বাংলাদেশের দণ্ডবিধির কোন একটি ধারায় কোন একটি শাস্তি।

সুতরাং, আমরা নিঃসন্দেহে নির্জীব ভবিষ্যদ্বাণী করে যেতে পারি যে, এই অপরাধেরও বিচার হবে না, এই খুনেরও শাস্তি হবে না, এই মৃত্যুরও কোন প্রত্যাঘাত আসবে না। কাজেই কোন বিচার টিচার চাইবো না, কোন শাস্তির দাবির অন্যায় আবদার জানাবো না, সিস্টেমের কোন পরিবর্তনের আশা করবো না।

রাষ্ট্রপতি আজ শপথ নিয়েছেন, তাঁর ভালো হোক, দীর্ঘজীবী হোন তিনি। প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে ধন্যবাদ দিয়েছেন বিরোধী দলকে তিন ঘন্টা বাকি থাকতে হরতাল প্রথমে সাভারে, পরে ঢাকায়, পরে সারা দেশে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়ার জন্যে। নিঃসন্দেহে আমাদের গণতন্ত্রের জন্যে এটা আনন্দময় একটা আলোঘর বটে। বিরোধী দলনেতা ও ছাত্রলীগ নিজের সংগঠনের সদস্যদের রক্ত দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে, এটাও নিশ্চয় বিশালতর এক অর্জন। স্থানীয় প্রশাসন আহতদের তিন হাজার আর মৃতদের পরিবারকে কুড়ি হাজার করে দেয়ার কথা বলেছে। সেটাও তো কিছু পাওয়া হলো। এমনকি, বিজিএমইএও বিচার চেয়েছে, কারণ সম্ভবত তাদের কেউ নেই ওখানে বলে তাদের আশা। সবার ভালো হোক। তাদের কারোর কাছেই আমার আসলে কোন আশা নেই, কখনোই তেমন কিছু ছিলো না।

কিন্তু, আমি তাদের কাছে কিচ্ছুটি নয়, আমি শুধু আশা করি আমার তরুণতর প্রজন্মের কাছে, সাধারণ ঘামেভেজা, কালোকুলো শীর্ণকায়, মানুষের কাছে।

ফেসবুক ভাসিয়ে দেয় তারা রক্তের আহ্বানে, পাগলের মতো শেয়ার করতে থাকে দরকারি ফোন নম্বর, উদভ্রান্তের মতো তরুণ চিকিৎসকেরা আহতদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে, স্থানীয় লোকজন কাজ ফেলে আহতদের ধরাধরি করে বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের বিনেপয়সার রিকশায় তোলে, দম আটকে রিকশাওয়ালারা তাদের পৌঁছে দেয় এনাম হাসপাতালে, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের চত্বরে লাইন ধরে রক্ত দেয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে তারা ঘন্টা ধরে, পকেটের টাকা অকাতরে বিলিয়ে দেয় যেটা হয়তো তার রাতের খাবার বা সাধের জিনিস কেনার জন্যে রাখা ছিলো, এই তারুণ্য, এই মানুষের উষ্ণতা, প্রাণ দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর অদম্য আকাঙ্ক্ষা, মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর এই লোভনীয় দৃশ্য, মানুষের দুর্যোগে বুক দিয়ে পড়ার এই চিরপ্রার্থনীয় ল্যান্ডস্কেপ, এইতো আমার দেশ, এইতো আমার মানুষ, এইতো আমাদের বাংলাদেশের হৃদয়।

আমার চোখ দিয়ে অবিরল জল ঝরতে থাকে, সকালের অসহায়ত্বের, বুকফাটা কষ্টের কান্নাচাপা গলাব্যথার চাইতে এটা এতো অন্যরকম, এতো স্বর্গীয়, এতো মানবিক…

মানুষ জাগুক ফের, ফের জাগুক মানুষ। ভবিষ্যতের দেশ আর সময় দু’হাত বাড়িয়ে আছে। হয়তো দেশটা এক দিন সোনার মানুষে ভরে যাবে, হয়তো…