তৈমুরলেন সারানেভ এবং জওহঢ় সারানেভ। এই দুই ইসলামিক সন্ত্রাসবাদির কার্যকলাপে গত সপ্তাহে কার্যত অচল হয়ে গেল বস্টনের মতন শহর। মিডিয়াতে ঘুরে ফিরে সেই এক প্রশ্ন-ইসলাম এই ব্যাপারে কতটা দায়ি?

কেননা বড় ভাই এবং বস্টনের ম্যারাথন সন্ত্রাসবাদের মূলহোতা তৈমুর, আস্তে আস্তে গভীর ধর্মীয় ভাবাবেগে ভেসে, এই সন্ত্রাসবাদের কাজ করেছে-এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এটা ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের অঙ্গ। সেই নিয়েও সন্দেহ নেই। বিতর্ক এই নিয়ে যে এর জন্য ইসলাম নামক ধর্মের দায় কতটা?

হিন্দু, ইসলাম , খ্রীষ্ঠান সব ধর্মেই সন্ত্রাসবাদী আছে। নাস্তিক সন্ত্রাসবাদি ও আছে। কিন্ত বর্তমান পৃথিবীতে সন্ত্রাসবাদের ঘটনায় মুসলিমরা সব থেকে বেশি জড়িত এবং ইসলাম ধর্মশিক্ষা সব থেকে বেশি সন্ত্রাসবাদির জন্ম দিচ্ছে। এখানেই প্রশ্ন তোলা উচিত-এবং যে প্রশ্নের সন্ধান আমরা ৯/১১ থেকে করছি-এর পেছনে ইসলামিক শিক্ষা-কোরান বা প্রফেট মহম্মদের জীবনী কতটা অনুপ্রেরণা দিচ্ছে?

এই নিয়ে মুক্তমনা সহ অনেক ব্লগেই দিস্তার পর দিস্তা খরচ হয়েছে। অনেকেই কোরানকে মূল অভিযুক্ত করেছেন। আমি করছি না। শুধু এই কারনে যে ভগবদ গীতা কোরানের থেকে অনেক বেশি ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদে উস্কানি দেয়। শুধু ধর্মগ্রন্থের কারনে, মানুষ সন্ত্রাসবাদি হলে, হিন্দুরা সব থেকে বেশি সন্ত্রাসবাদি হত। কারন ভগবদ গীতা সম্পূর্ন ধর্মযুদ্ধের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সংখ্যাতত্ত্ব সেটা বলছে না। প্রতি এক কোটি লোকে মুসলিম সন্ত্রাসবাদির সংখ্যা হিন্দুদের থেকে অনেক বেশি। সুতরাং ধর্মগ্রন্থে কি লেখা আছে তা গুরুত্বপূর্ন না।

মহাভারতের যুদ্ধোত্ত্বর পর্বে যুধিষ্ঠিরের প্রতি কৃষ্ণের উপদেশ প্রাণিধানযোগ্য এবং এই ঘটনায় প্রাসঙ্গিক। সেটা হচ্ছে কোন আদর্শবাদ নিজে থেকে ভাল বা খারাপ হয় না। আদর্শবাদের প্রয়োগ এবং ধারকের ওপর নির্ভর করে আদর্শবাদ সমাজের উপকার না ক্ষতি করবে।

বরং আমাদের বিশ্লেষনের অভিমুখ হওয়া উচিৎ সমাজবিজ্ঞানের লেন্সে। আমাদের দেখা উচিৎ, আমেরিকার এই হোম গ্রোন টেররিস্টদের প্যাটার্নটা কি। কেন তারা আমেরিকান সমাজে গ্রহীত হওয়ার পরেও, আমেরিকাতে এত ভাল জীবন পাওয়ার পরেও আমেরিকার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে লিপ্ত হচ্ছে। কেন তারা এত আপাত নিরীহ ভাল চরিত্রের যুবক হওয়া সত্ত্বেও কট্টর মুসলমানে রূপান্তরিত হচ্ছে?

ধর্ম খারাপ না-কিন্ত কট্টঢ় ধার্মিক নিশ্চিত ভাবেই খারাপ। এখন এক্ষেত্রে একটা সস্তার তত্ত্ব হচ্ছে ইসলামে শক্ত “ইমান” এর ওপর জোর দেওয়া হয়। বা ইসলামের ধারনা গুলি টোটালটারিয়ান। বা ইসলাম একটা সম্পূর্ন জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনের দিশা দেখায়। এগুলো সব আপাত সত্য। কারন হিন্দু ধর্মও সম্পূর্ন। মহাভারতে যে সম্পূর্ন জীবন এবং রাজনৈতিক দর্শনের শিক্ষা আছে, তা ইসলামের থেকে অনেক বেশি বৃহৎ এবং সম্পূর্ন। এই ধরনের সম্পূর্ন পূর্নাঙ্গ জীবনের দর্শনের সন্ধান সিন্ট, কনফুসিয়াস বা জেন সহ অনেক দর্শনেই পাওয়া যাবে। এবং এই ধর্মগুলিও সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়েছে ইতিহাসের নানান সময়ে। সুতরাং ধর্মীয় উগ্রতা ইসলামের একার ভূষন না। আবার এটাও সত্য, বর্তমান সময়ে অন্যান্য ধর্মে উগ্রতা ক্রমে আসলেও ইসলামে সেটা ক্রমবর্ধমান।

ভাববাদি বিশ্লেষনে কাজ হবে না। আমাদের বস্তুবাদি চোখেই দেখতে হবে ইসলামের সমস্যা কোথায়। এখানে ইতিহাসের এবং অর্থনীতির ভূমিকা কি?

(১) প্রথমে আমেরিকার প্রসঙ্গে আসা যাক। মেজর নাদাল হোসেন, ফায়জাল ( নিউউয়ার্ক টাইমস্কোয়ার বোম্বিং) বা তৈমুরের মধ্যে একটা সাধারন থ্রেড আছে। এদের প্রত্যেকেই আমেরিকাতে নিসঃঙ্গ ছিলেন। দেখা যাচ্ছে এদের বৈবাহিক জীবন সুখের হয় নি। এটা ডিম না মুরগী আগের সমস্যা। এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই এদের রক্ষণশীল মনোভাবের সাথে কোন আমেরিকান মেয়েদের মানিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে এরা এদের ব্যার্থ ফ্যামিলি লাইফের জন্য পাশ্চাত্য জীবনকেই দায়ী করেছেন এবং ক্রমশ আরো কট্টর ইসলামিক জগতে ঢুকেছেন।

এই ধরনের ঘটনা রক্ষণশীল হিন্দুদের মধ্যেও দেখেছি। তারাও আমেরিকাতে এই সমস্যার জন্য আরো বেশি রক্ষণশীল হিন্দু ধর্মে ঝুঁকেছে। কিন্ত কোন হিন্দু তারজন্য আমেরিকাকে বম্বিং করার চেষ্টা করে নি। যেটা একমাত্র মুসলিমদের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে।

এর কারন কাষ্মীর, চেচেন ইত্যাদি বিচ্ছিন্নাবাদি আন্দোলনগুলি কট্টরপন্থি ইসলামিক সন্ত্রাসবাদিরা হাইজ্যাক করে নিয়েছে। ফলে কোন কট্টর মুসলমান যুবকের মনে, যে পৃথিবীটাকে দেখেনি বা চেনেই না-তাকে কব্জা করে সন্ত্রাসবাদি বানানোর একটা লজিস্টিক সাপ্লাই লাইন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং চেচেনিয়াতে আছে। ফলে তেল যেখানে আছে-সেখানে দেশলাই ছুঁড়লে আগুন ধরবেই।

(২) মুসলিম পরিবার গুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অজ্ঞান এবং অন্ধকারে ডুবে থাকা দেশগুলি থেকে আসছে-যেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা নেই। প্রতিটা ধর্মেই ভাল এবং খারাপ দিক আছে। যে সমাজ সেই খারাপদিকগুলির দিকদর্শনের সুযোগ দেবে না-সেই সমাজে কট্টরপন্থা স্বাভাবিক। বাংলাদেশে যেসব ব্লগার ইসলামের অন্ধকার দিকগুলি নিয়ে লেখা শুরু করেছিল, তাদের জেলে ভরা হল। ধর্ম বা রাজনৈতিক দর্শনের সমালোচনার পরিবেশ না তৈরী হলে, লিব্যারাল বা উদার সমাজ তৈরী হবে কি করে? আর উদার রাষ্ট্রে না জন্মালে, ধর্মের খারাপ দিকের সাথে পরিচয় না থাকলে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের খারাপদিকটা একজন উঠতি যুবক কি করে বুঝবে?

ইমানের দোহাই দিয়ে যেমন একজন হিন্দুকে গরুর মূত্র সেবন করানো যায়-ঠিক তেমন ই ইমানের চাপে একজন মুসলিমকে ধর্মসন্ত্রাসী বানানো সব থেকে সহজ কাজ। ধর্মের যে বাজে দিক থাকতে পারে সেটাই সে বোঝে না বা বুঝতে ভয় পায়।

(৩) তেলের অর্থনীতি এবং রাজনীতি এর জন্য আরো বেশি দায়ী। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের জন্য বা ঠান্ডা যুদ্ধের দিনে অধিকাংশ বিদেশী রাষ্ট্র, সেখানে গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদকে আসতে দেয় নি। ফলে সামন্ততান্ত্রিক থেকে ধণতান্ত্রিক সমাজের উত্তোরনের ব্যাপারটা মুসলিমদেশগুলিতে আটকে গেছে। পাকিস্তানের সাথে ভারতের তুলনা করলে এটা আরো ভাল বোঝা যাবে। পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র বানাতে সব থেকে বেশি বড় ভূমিকা ছিল আমেরিকার। এর ফলে পাকিস্তান শাসন করে ডজন খানেক পরিবার। সেখানে যে শ্রেনী সংগ্রাম আছে, তা জিহাদি সংগ্রামের রূপ নিয়েছে।

বাংলাদেশেও দেখা যাবে সেই এক সমস্যা। ঠিক ঠাক ভাবে ধনতান্ত্রিক সমাজের বিকাশ সেখানে হচ্ছে না। উদার গণতন্ত্র এবং ধনতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। ইসলামিক রাষ্ট্রগুলি ব্যার্থ-এর মূল কারন মুসলিম দেশগুলিতে রাজনৈতিক দলগুলির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আরো ভাল ইসলামিক রাষ্ট্র। অর্থাৎ ভাববাদি গ্যাঁজা সেবন করিয়ে, লোকের পকেট কাটা।

আধুনিক উৎপাদনশীল উদার রাষ্ট্র তারা চাইছে না। বিসমিল্লা ব্যাঙ্ক খুলে যদি লোকের ১২০০ কোটি টাকা মারা যায়, কাঁহাতক কে সৎ পথে ব্যবসা করবে? তার থেকে বিসমিল্লা আর ইসলামের নামে পার্টি চালনা করা ভাল। ইসলামিক দেশগুলি এই অন্ধকার পথেই হাঁটছে এবং মধ্যপ্রাচ্য সহ অনেক বিদেশী শক্তির মদত পাচ্ছে। কারন এই ভাবে দেশগুলি যদি ধর্মের আফিং এ মেতে থাকে, তাতে এদের শাসক শ্রেনীকে কন্ট্রোল করে, লুঠপাট করা সহজ কাজ।

ফলে ইসলামিক দেশগুলিতে খাদ্যদ্রব্যের সংকট তীব্র না হওয়া পর্যন্ত এই ধরনের ভাববাদি রাজনীতি চলতে থাকবে। একমাত্র পেটের আগুন, তাদের বস্তুবাদি রাজনীতির সন্ধান দিতে পারে। যদ্দিন এমন না হচ্ছে তদ্দিন মুসলিমদেশগুলি চালাবে বিসমিল্লার নামে পকেটকাটা চোরেরা। আর তাদের টেকাতে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ এবং শরিয়া হবে অপরিহার্য্য।