হরতাল পান্তা ভাত ব্লগার আর গনতন্ত্র
ছোটবেলায় আমাদের পাশের বাড়ির এক বউ তার স্বামীর সাথে ঝগড়া হলে না খেয়ে থাকত। আসলে ঝগড়া হলে না বলে মার খেলে বা তাকে পিটালে বলা প্রযোজ্য।কারণ আমাদের দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির অবস্থানের মত বউটির ঝগড়া করার ক্ষমতা ছিল না। অধিকার ছিল না। সাহস ছিল না। বউটিকে রাঁধতে হত। সবাইকে খাওয়াতে হত অথচ নিজে খেত না।তবে কীভাবে তার অভিমান ভাঙত তখন তা পর্যবেক্ষন করা হয়নি বা আমার এখন আর মনে নেই।

ঠিক নির্বাচনের আগে আমাদের জনগনের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেওয়ার মত বউটিও হয়ত অভিমান ভুলে যেত। সে একবার আত্মহত্যার প্রচেষ্টাও চালিয়েছিল। কয়েকদিন পরে আবার দেখি হাসিখুশিভাবে সংসার করছে। তখন আমার মনে হত বেহায়াপনা। আসলে তা ছিল দুর্বলের, অসহায়ের নিরুপায় ব্যক্তি ভাল থাকার প্রচেষ্টা।আমাদের জনগনের মত। বউটির স্বামী, শ্বশুর আর শাশুড়ির মতই জনগনের সাথে সরকার, বিরোধীদল, রাজনৈতিক দলসমূহ আর অরাজনৈতিক বলে দাবী করা ধর্মীয় দলগুলোর ব্যবহার।

আমার অবস্থাও আমার ছোটবেলায় দেখা বউটির মত। আমার দেশের জনগনের মত। হরতাল হলে আমি সকালে পান্তা ভাত খাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং ২ এপ্রিল ২০১৩/ ১৯চৈত্র ১৪১৯ খাওয়া শুরু করেছি। তবে দেশব্যপী হরতাল হলে। অর্থাৎ আমার জীবন যাত্রা ব্যাহত হলে আমি সকালে পান্তা ভাত খাচ্ছি। সাথে শুধু পেঁয়াজ, শুকনা মরিচ ভাজা ও লবণ দিয়ে।বহুদিন গনতান্তিক আবহে থেকে আমার দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সকালে নিরুপায় হয়ে পান্তা খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। মানুষের অনেক রকম জেদ থাকে, প্রতিবাদের ভাষা থাকে, প্রতিরোধের কৌশল থাকে, ক্ষোভ থাকে, শখের স্বপ্ন থাকে,স্বপ্নপুরণ না হওয়ার হতাশা থাকে। পান্তা খাওয়া আমার মত অক্ষমের প্রতিবাদের পথ। হতাশার বহিঃপ্রকাশ।বৃহত্তর অসহায় জনগোষ্ঠির সাথে একাত্ম হওয়ার নীরব,ব্যক্তিগত এবং নিরুপায় প্রয়াস।বোবার ভাষা। কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার প্রকাশ।

তবে ৫ ও ৬ এপ্রিল ২০১৩ এর হরতালে কিন্তু আমি পান্তা খাইনি। কারণ এতে আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তাছাড়া আমার জীবন যাত্রা এতে ব্যাহত হয়নি। আর সমর্থন শুধু আদর্শিক সমর্থন নয়। জরূরী প্রয়োজনে পথে বের হতে আতংকিত হইনি, কাছের লোকজন হরতালে বাইরে গেছে বলে উৎকন্ঠা ছিল না। তাদের হরতাল তারা করেছে। আমার প্রয়োজনীয় কাজ আমি করেছি। সাপ্তাহিক ছুটিতে যে সব কাজ করব বলে পরিকল্পনা ছিল সে সব কাজ করতে পেরেছি।

পান্তা ভাতের ধারণাটি মগজে কীভাবে এলো তা নিয়ে একটু বলা দরকার। চৈত্র মাস। সামনেই পহেলা বৈশাখ।আশেপাশের লোকজনের ইলিশ কিনে ডিপ ফ্রিজে রাখার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। একদিন বাঙালী ছিলাম রে প্রমানের সুযোগ কাজে লাগানোর তৎপরতা। তাদের মত আমিও পান্তা তো দূরে থাক ৩৬৪ দিন সকালবেলা ভাতই খাই না। বাংলাদেশের গরীব মানুষকে অপমান করতে, নিজের বাঙালিয়ানা জাহির করতে, বাঙালি সংস্কৃতির তথাকথিত বৈশিষ্ট্যকে সমুজ্জ্বল করতে একদিন পান্তা ভাত খাই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের শুধুমাত্র ভোটের সময় গনতন্ত্রের চর্চার মত। আমি পান্তা খেতাম বছরে একবার। আর রাজনৈতিক নেতারা গণতান্ত্রিক পন্থা মানেন পাঁচ বছরে একবার। কাজেই পান্তা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
তাছাড়া হরতালের আগেরদিন অফিসে লাঞ্চের সময় এক সহকর্মীর সাথে পহেলা বৈশাখ হরতাল ইত্যাদি প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। তখনই সিদ্ধান্ত নিতে আরও উদ্ধুদ্ধ হই যে আমি হরতালের দিন সকালে পান্তা ভাত খাব।

ব্লগার শব্দটি কি গালি না বুলি? অথবা গালি বা বুলির উর্ধ্বে অন্য কোন পরিচয়। যারা ‘ আমার কথা আমি বলব এবং আমার মত করেই বলব’ (নারীপক্ষ’র আদর্শিক অবস্থান) আদর্শের চর্চা করে? কিংবা নিজের পেশা ও জীবিকার পাশাপাশি দেশ ও জাতির তথা মানব কল্যাণের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করে? প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের এবং কতিপয় তথাকথিত কলমজীবীদের লেখা প্রিন্ট মিডিয়া সাগ্রহে প্রকাশ করলেও সবারটা সুযোগ পায় না। পত্রিকা মালিক ও সম্পাদকদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের মত প্রকাশের মাধ্যম খুঁজে নেওয়া গোষ্টিই কি ব্লগার? যাদের লেখা প্রকাশের মূহুর্তেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।যাদের লেখার পাঠকপ্রিয়তা সহজেই যাচাইযোগ্যও বটে। বা যখন যেভাবে আছে তখন সেভাবে থেকেই লেখা প্রকাশের এবং প্রগতিশীল ধারা বিকাশেরর চর্চা সহজ সুযোগ কাজে লাগানো গোষ্ঠিই কি ব্লগার? না কি অচলায়তনে আঘাত দেওয়ার মত চেতনা সমৃদ্ধ ও সীমানাবিহীন ভাবেই জোটবদ্ধ এক শক্তিশালী গোষ্ঠির নাম ব্লাগার ? যাদের কলমের ডগার কালি ফুরায় না তারাই কি ব্লগার?

হেফাজত ই ইসলাম সুঁই হয়ে রাস্তায় নেমে এখন তো কলেরা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তথাকথিত ব্লগার নাস্তিক ঢেকাতে ঢুকে ১৩ দফা দাবি।যারা মানে ছদ্মবেশী জামাত শিবিররা প্রকাশ্যে জামাত শিবির হতে একটু আধটু লজ্জা পাচ্ছিল তারা এখন ইসলামে দেখাশুনায় প্রকাশ্য। এসব দেখে পান্তাভাত খাওয়া ছাড়া অক্ষমের প্রতিবাদের আর পথ কোথায়।

নাস্তিকতা আর দেশপ্রম কি সাংঘর্ষিক? কোন নাস্তিকের দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের চেয়ে কি অলৌকিক শক্তিতে অবিশ্বাস প্রাধান্য পাওয়া উচিত? আমি কোন ধর্মে বিশ্বাস করি বা না করি এটা কি রাষ্ট্রের কাছে মুখ্য, না আমি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবন দিতে পারি এটা গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানের বিষয়। তথাকথিত অনেক ধর্মীয় নেতা রাষ্ট্রদ্রোহীর মত অপরাধ করেও ছাড় পেয়ে যাচ্ছে আর একজন তার প্রাত্যহিক জীবনে কোন অলৌকিক শক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা শিকার করল কি না তাদের খুঁজে বিচার করার দাবিতে হরতাল হচ্ছে।

ঈশ্বরপ্রেম না থাকলে তো দেশপ্রম আরও প্রবল হওয়ার কথা। কারণ নাস্তিককে তার চারপাশ, তার পরিবেষ্টনী, তার পরিবেশ, তার প্রতিবেশকে বাসযোগ্য, উপভোগ্য করার প্রচেষ্টা করতে হয়। তার চোখে মৃত্যুর পরের স্বর্গসুখে বিশ্বাস নেই বলে এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রাখার জন্য তার মধ্যে এক সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। অস্ট্রেলিয়াতে একজন ব্যক্তি নিজেকে নাস্তিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে ঘোষণা দিতে পারে। বলতে পারে আমি কোন অলৌকিক বা অপার্থিব কিছুর পেছনে ছুটছি না।
যে মাটি শরীরে মেখে বড় হওয়া সে মাটির ঋণ, সে মাটির প্রতি ভালবাসা, নিজস্ব সীমানার প্রতি মমত্ববোধের প্রকাশ করলেও নাস্তিক হবার তথাকথিত পাপ থেকে আমার দেশে মুক্তি নেই। আমি তাদের মুক্তি চাই। আমি মশিউর রহমান ওরফে বিপ্লব , রাসেল পারভেজ ,সুব্রত শুভ ও আসিফ মহিউদ্দীনের মুক্তি চাই।