লিখেছেন: নাদিম আহমেদ

একটি উদার, সহনশীল আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা এমন একটি সমাজ বুঝি, যেখানে অনেক মত (pluralism), অনেক পথ থাকবে। অনেক বিশ্বাস ভাবনা থাকবে। নানান মতাদর্শের মানুষেরা পাশাপাশি সম অধিকার নিয়ে বসবাস করবেন এবং একে অন্যের প্রতি সহনশীল মনোভাব প্রকাশ করবেন। তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্র থকে নিজেদের মতাদর্শের চর্চা করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে নিজের মত অন্যের উপর চাপিয়ে দেবেন না। নিজের জীবনাদর্শ অনুযায়ী নিজের জীবন যাপন করবেন, কিন্তু অন্যকে সেটা করতে বাধ্য করতে পারবেন না।

যেহেতু নানা ধর্মের এবং নানা মত দর্শনের মানুষ একটি সমাজে বাস করে, সেহেতু তাদের চিন্তা ধারা, জীবন ধারন পদ্ধতি ও ভিন্ন। এখন অন্যের ধর্ম বা মত সম্পর্কে আমাদের অবস্থান কী হওয়া উচিত? অবশ্যই অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করা উচিত এবং তাদের প্রতি সহনশীল হওয়া উচিত। কারন আমরা সবাই শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাজে বাস করতে চাই। সমস্যা হয় তখনই যখন একজন মানুষ নিজের মত কেই নির্ভুল ও সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে এবং অপরের মত সম্পর্কে কিছু না জেনেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, অসম্মান করে।

কোন মতাদর্শই নির্ভুল এবং সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। এই বিশ্বাস আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। এর জন্য আমাদেরকে প্রত্যেকের কথা গুরুত্ত দিয়ে শুনতে হবে এবং যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে সমাজে তার গ্রহনযোগ্যতা যাচাই করতে হবে। অনুরূপ ভাবে আমার নিজের বিশ্বাসকে যখন অন্যরা যুক্তির কাঠগড়ায় দাড় করাবে, তখন তাদের যুক্তি গুলো ধৈর্য নিয়ে শুনতে হবে এবং নিজের বিচার বিবেচনা অনুযায়ী বিপরিত যুক্তি দাড় করাতে হবে। আমি যদি আমার বিশ্বাসের পক্ষে উপযুক্ত যুক্তি দিতে না পারি তাহলে আমার মতাদর্শের কী মূল্য থাকল?

গঠনমূলক সমালোচনা এবং কোন মতাদর্শের অবমাননা কখনো এক হতে পারে না। যেকোনো মত বা দর্শন সমালোচনার মাধ্যমেই উৎকর্ষতা এবং মানুষের মাঝে অধিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে সমর্থ হয়। যখন আপনি যুক্তি প্রদান সাপেক্ষে কোন মতাদর্শের ত্রুটি বা ক্ষতিকর দিক উপস্থাপন করবেন, তখন তাকে গঠনমূলক সমালোচনা বলা হবে। অপরদিকে কোন প্রকার যুক্তি, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ এবং গবেষণা ছাড়া যখন আপনি অনাবশ্যক ভাবে ভিন্নমতের বিষদগার করবেন তখন সেটাকে অশ্রদ্ধা বা অবমাননা বলা হবে। অগঠনমূলক ও অযৌক্তিক সমালোচনা সৃষ্টিশীল নয়। কেউ যখন নিজের মতকে শ্রেষ্ঠ প্রমানের জন্য ভিন্নমতকে অনাবশ্যক অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন তখন তিনি নিজের মতাদর্শের গ্রহণযোগ্যতাকেই বরং প্রশ্নবিদ্ধ করেন।

প্রত্যেকটা মতাদর্শেরই সমালোচনা দরকার রয়েছে। স্বাধীন দেশে স্বাধীন মানুষ যেকোনো মত বা দর্শন সম্পর্কে মত প্রকাশের অধিকার রাখে। সমালোচনা এবং স্বাধীন মত প্রকাশের মাধ্যমে কোন মত বা আদর্শের ত্রুটিযুক্ত বা সমাজের জন্য অনুপযোগী বিষয় সমূহ বের হয়ে আসে। কোন ব্যক্তি বা দর্শন সমালোচনার উর্দ্ধে থাকতে পারে না। যেকোনো মতাদর্শ তার ত্রুটিযুক্ত অংশ (যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর) বাদ দিয়ে সমাজ ও সময় উপযোগী করে মানব সমাজের প্রগতি ও বিকাশে ভুমিকা রাখতে পারে।

আর যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত কোন মতাদর্শের সমালোচনা করা হবে না, তখন সেটা একসময় সমাজের বিষফোড়ায় রূপ নেবে। যেহেতু তার ত্রুটি পূর্ণ অংশ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না, সেহেতু সুবিধা ভোগী স্বার্থান্বেষী মহল সেটাকে যথেচ্ছা নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করবে।

যখন কেউ সেই মতাদর্শের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে তখন তাকে অবমাননার অভিযোগ তুলে প্রতিহত করা হবে এবং সব রকম প্রশ্নের দ্বার রুদ্ধ করা হবে। এভাবে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে সমাজের উপর প্রশ্নহীন কোন মতবাদ চাপিয়ে দিয়ে সমাজের বিকাশের পথ বন্ধ করে দেবে স্বার্থান্বেষী শোষক গোষ্ঠী। একইসাথে ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষদেরকে অবজ্ঞা, অপমান করে সংখ্যালঘু আখ্যা দিয়ে সমাজ বিচ্ছিন্ন করা হবে। আর সমাজ সামনের দিকে না গিয়ে পশ্চাৎ মুখী যাত্রা করবে।

অগনতান্ত্রিক ও অসহনশীল সমাজে গঠনমূলক সমালোচনাকে ও অবমাননা বলে প্রচার করা হয়। এর পেছনে সুস্পষ্ট অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্য হল ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতিহত করা। এর জন্য মানুষের মনে বিশেষ ধরনের বায়বীয় অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়। চিন্তাহীন মানুষদেরকে হিপনোটাইজ করে গঠন মূলক সমালোচনাকে ও বিশেষ বায়বীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে বোঝানো হয়। আর এই আঘাতের প্রতি উত্তর সরূপ তাদেরকে লেলিয়ে দেওয়া হয় ভিন্ন মতের মানুষদের উপর। সৃষ্টি করা হয় বিভাজন। এসব বিভাজন এর উদ্দেশ্য মানুষ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে যেন সচেতন হতে না পারে।

তারা যুগ যুগ ধরে শোষিত নিগৃহীত, বঞ্চিত হয়। কিন্তু প্রকৃত শত্রু সেই শোষকদের কে চিনতে পারে না।

দর্শনগত ভাবে বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্ব সবসময়ই বিদ্যমান। যেমন হিন্দুদের মূর্তি পূজা মুসলিম দের কাছে হাস্যকর। আবার মুসলিমদের গরু কোরবানি হিন্দুদের নিকট অবমাননাকর। একজন ইসলামবিদ যখন নিজ ধর্ম দর্শন প্রচার করবেন তিনি তার বিশ্বাস অনুযায়ী তার ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন। তার জন্য তাকে তুলে ধরতে হবে অন্য ধর্মের অসাড়তা ও অযৌক্তিকতা গুলো। এক্ষেত্রে তিনি যদি বলেন প্রাণহীন মূর্তির পূজা করা যথেষ্ট অযৌক্তিক ও হাস্যকর। ইহা একটি ভ্রান্ত মতবাদ। তাহলে দর্শনগত দ্বন্দ্ব প্রকাশ পাবে। এটাকে কি সমালোচনা বলা হবে নাকি অবমাননা বলা হবে? তাকে আরও বলতে হবে যে ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল ধর্ম মিথ্যা। এটা তাকে তার মত প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই বলতে হবে। এটা কি তাহলে ধর্ম অবমাননা হবে না?

একইভাবে একজন খ্রিস্টান পাদ্রী যদি তার নিজস্ব যুক্তি দিয়ে দেখান যে ইসলামের নবী মিথ্যা এবং খ্রিস্ট ধর্মের নবীই একমাত্র সত্য, তাহলে কি ইসলামের নবীর অবমাননা হবে না? অথচ নিজ ধর্ম প্রচারের স্বার্থে তাকে কথা অবশ্যই বলতে হবে। এর জন্য কি ওই পাদ্রীর শাস্তি হওয়া উচিত?

একজন নাস্তিক যদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি দিয়ে বলেন যে, ঈশ্বরের অস্তিত্তের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি, সুতরাং ধর্ম গুলো মানুষের সৃষ্টি। মুসলিমরা যে বিশ্বাস করেন যে আকাশ থেকে নবীর কাছে বার্তা এসেছিল, বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তা হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। সুতরাং ইসলামের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এর জন্য কি ধর্ম অবমাননার শাস্তি দিতে হবে ? অথচ এই ভিত্তির উপরই নাস্তিক্যবাদ দাড়িয়ে আছে।

এখন আপনি যদি বলেন, যে এসব বলে ইসলাম ধর্ম অবমাননা করা হয়েছে, তার শাস্তি হওয়া উচিত, তাহলে তার সুস্পষ্ট অর্থ দাড়ায়, আপনি চান না আপনার মতাদর্শের কোন ত্রুটি প্রকাশ পাক। আপনি চান না অন্য কোন মত বিকশিত হোক। আপনি ভিন্নমত কে দমিয়ে রাখতে চান। আপনি ভিন্নমত কে ঘৃণা করতে পারেন, অসাড় ও হাস্যকর মনে করতে পারেন। কিন্তু অবমাননার অজুহাতে গায়ের জোরে কারো মুখ চেপে ধরতে পারেন না।

দার্শনিক দ্বন্দ্ব কে দর্শনের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যক্তি জীবনে নিয়ে এসে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করা হয়। বায়বীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে বিভাজন বিশৃঙ্খলা তৈরি করে এর ফায়দা নেয় সুবিধাবাদী, ধর্ম ব্যবসায়ী, নীতিহীন মানুষেরা। প্রত্যেকের নিজস্ব জীবন দর্শন অনুযায়ী চলার স্বাধীনতা রয়েছে, যতক্ষণ তা অন্যের কোন ক্ষতির কারন হয়ে না দাড়ায়।

সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মতের অবমাননা বা বায়বীয় অনুভূতিতে আঘাত বিষয় গুলোর বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। এগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে। অবমাননা যেহেতু ভিত্তিহীন সেহেতু এর জন্য শাস্তির দাবী ও অযৌক্তিক। কেউ আপনার ধর্মমতকে অযৌক্তিক ভাবে অসম্মান করলে আপনি তাকে ঘৃণা করতে পারেন, তার মতকে ও অবমাননা করতে পারেন বড়োজোর। কিন্তু এই লঘু অপরাধে কোন প্রকার রাষ্ট্রীয় শাস্তির দাবী করতে পারেন না।

যারা লেখনীর মাধ্যমে নিজের মত প্রকাশ করেছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের মতকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা। কোন প্রকার অশান্তি বা অরাজকতা সৃষ্টি নয়। কিন্তু কিছু লোক হীন স্বার্থে এসব লেখা কে ধর্মীয় অবমাননা হিসেবে প্রচার করেছে। এদের উদ্দেশ্য ছিল অশান্তি সৃষ্টি করা। তাহলে কে অপরাধী? কার শাস্তি হওয়া উচিত?