কয়েকদিন আগে একটা স্ট্যাটাস দিই। স্ট্যাটাস ছিল এরকম—

ইংরেজরা এদেশের মুসলিমদের হাত থেকে শাসন নেয়। যেহেতু তারা মুসলিমদের কাছ থেকে শাসন ও ক্ষমতা নেয় সেহেতু তাদের প্রধান শত্রু ছিল মুসলিমরা। অন্যদিকে হিন্দুরা ব্রিটিশদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারী চাকরি নিতে শুরু করে। এই অঞ্চলের মানুষদের শিক্ষার জন্য ইংরেজ সরকার স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা শুরু করে। হিন্দুদের জন্য হিন্দু কলেজ আর মুসলিমদের জন্য মাদ্রাসা।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ঔপনিবেশিক শক্তির টিকিয়ে রাখার প্রধান শর্ত একশ্রেণিকে সবসময় গরীব ও দূর্বল করে রাখা। এই বঙ্গে জমিদার ছিল হিন্দুরা আর গরীব প্রজা ছিল মুসলিমরা। ব্রিটিশরা মুসলিমদের মাদ্রাসায় শিক্ষায় শিক্ষিত করা শুরু করে। এখানে একটা জিনিস মনে রাখা দরকার; মাদ্রাসা আর স্কুলের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু শব্দে অন্য আর কিছুতে নয়। আমরা দেখতে পাই হিন্দু কলেজ থেকে ডিরোজিও ধ্যান-ধারনায় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও দর্শনে উজ্জ্বীবিত ছাত্ররা বের হচ্ছে কারণ হিন্দু কলেজগুলোতে শুধু রামায়ন মহাভারত পড়ানো হতো না। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাকে ব্রিটিশ ও অবুঝ মুসলিমরা ধর্শীয় কোরান, হাদিসের বিদ্যালয়ে পরিণত করে। আবার কলকাতার মাদ্রাসায় হিন্দু ছেলেমেয়েরাও পড়ে কারণ ওখানে কোরান হাদিসের আলোকে পড়ানো হয় না বরং আধুনিক শিক্ষায় জ্ঞান দান করা হয়। ব্রিটিশদের থেকে বাঙালি মুসলিমদের মুক্তি ঘটলেও চিন্তায় চেতনায় ততটা মুক্তি ঘটানি বিশেষ করে ধর্মীয় ক্ষেত্রে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত রামায়নের কাহিনি নিয়ে “মেঘনাধ বধ” লিখতে পারলেও মুসলিম সমাজ কিন্তু আজো ধর্মী বিষয়ে কঠিন রক্ষণশীল অবস্থানে আছে। তাই যতদিন পর্যন্ত মাদ্রাস শিক্ষায় সংস্কার না আনতে পারব ততদিন আমাদের ধর্মীয় মৌলবাদীদের থেকে রক্ষা নেই কারণ ধর্মীয় মৌলবাদের বীজ রোপিত হয় ঐ মাদ্রাসাতেই।

স্ট্যাটাসটি এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল- বাঙলাদেশে একটি বৃহৎ অংশই মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত এবং তাদের বেশির ভাগই ইসলামির শাসনতত্র ও ইসলামিক আইন ও রাষ্ট্রের পক্ষে। অপ্রিয় হলেও সত্য কথা হল- আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ ও শিক্ষিত সমাজ ধর্মীয় অনুভূতির কারণে মাদ্রাসা শিক্ষার বিপক্ষে না এমনকি সংস্কারের পক্ষেও না। তার বাস্তবতা আমরা নিজেই দেখতে পাচ্ছি। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করণের উদ্দোগ নিলে ইসলাম ধ্বংস করার পায়তারা করে মাদ্রাসা সমাজ ও ধর্মীয় সমাজ মাঠে নেমে যায়। বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইসলামিক আন্দোলন দেশ ও সমাজের জন্য বিষ ফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। সরকার না পারছে গিলতে না পারছে বমি করে ফেলতে।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি নিশ্চিত করার দাবীতে ৫ ফেব্রুয়ারি তরুণ সমাজ শাহবাগ আন্দোলনে নামে। ঐ আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত শিবির নিষিদ্ধের দাবীর সাথে সাথে ধর্মীয় রাজনীতি বাতিলের দাবী জানাননো হয়। পরে অবশ্য ধর্মীয় রাজনীতি বাতিলের দাবীতে আন্দোলন কর্মীরা সরে আসে। তার কিছু দিন পরেই ব্লগার রাজিব হত্যার পরপরই শাহবাগ আন্দোলনকে নাস্তিকদের আন্দোলন হিসেবে আক্ষায়িত করা হয়। এবং এই কাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখে; আমারদেশ পত্রিকা। পত্রিকাটি ব্লগ ও ফেসবুকের বিভিন্ন নাস্তিকদের কমেন্ট ও লেখা হুবহু তুলে দেয়। এবং আশ্চার্যজনক হলেও সত্য এর পরপরই মানুষের মনে আন্দোলন নিয়ে একটা ঠাণ্ডা ভাব চলে আসে। এর পরপরই জামাত শিবিরের ছায়া সংগঠন হেফাজতে ইসলাম শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধীতা করে সরাসরি মাঠে নামে এবং নাস্তিক ব্লগারদের গ্রেফতারের দাবী করা হয়। এমনকি বিভিন্ন ইসলামিক অনলাইন পত্রিকা সহ বিভিন্ন পেইজ ও পত্রিকায় নাস্তিক ব্লগারদের লিস্ট প্রকাশ করা হয়। এবং হতাশা জনক হলেও সত্য সরকার মৌলবাদী গোষ্ঠীর সাথে সুরেসুর মিলিয়ে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে কথা দিয়েছে। এবং এর জন্য কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

বাঙালির সামনে এখন দুইটি বাঘ। একটি বাঘ ঘাড়ে কামড় দিয়ে আছে আরেকটি দূরে বসে আছে। জামাত-শিবির হল ঘাড়ে কামড় দেওয়া বাঘটি আর ইসলামিক দল গুলো হল দূরে বসে থাকা বাঘটি। অনেক ইসলামিক দল জামাতের সরাসরি বিরোধী হলেও তাদেরকে আমি একই শ্রেণিতে পরিমাপ করি। কারণ আদর্শিকগত ভাবে তাদের মধ্যে পার্থক্য খুব সামান্যই। কারণ জামাত-শিবির ও ইসলামিক দল গুলোর উদ্দেশ্য একটাই তা হল; দেশে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা। আমরা তালেবানদের সামাজিক চরিত্র ও কর্মকাণ্ড ভুলে যাই নি। তালেবানরা কীভাবে বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করল এবং জাকির নায়েকের মতন ধর্মব্যবসায়ী তার সার্পোটও করল। গততত্ত্বাবধায়কের আমলে বিমানবন্দর গোলচত্বরে মূর্তি ভাঙা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় ইসলামি মৌলবাদীদের ভয়ংকর রূপ আমরা দেখেছি।

গত ২৯শে মার্চ চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে ইসলামিক আন্দোলনের সমাবেশ হয়। ঐ সমাবেশে নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি না দিলে ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করা হবে চরমোনাই পীর হুশিয়ার উচ্চারণ করেন। সমাবেশে আ্ল্লাহ ও রাসুলের উপর বিশ্বাস সহ, আল্লাহ ও কোরান অবমাননাকারীদের জন্য শাস্তির বিধানের দাবী জানানো হয়।

ইতোমধ্যে ব্লাসফেমি আইন করা নিয়ে ইসলামিক দলগুলো বেশ উঠে পড়ে লেগেছে। গত নির্বাচনের আগে নিজামী ব্লাসফেমি আইন করবে বলে ঘোষণাও দিয়েছিলেন। ব্লাসফেমি আইন নিয়ে নতুন করে বলা কিছু নেই। পাকিস্তানে এমন জখন্য আইনটি কার্যকর আছে। এবং এই আইন করার পরিণতি আমরা ইতোমধ্যে খবরের কাগজেই দেখতে পাচ্ছি।

কোরান অবমাননা নিয়ে ১৯৯০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ডিসেম্বর ২২, ২০১২ তারিখে ‘দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকার সাথে সাথে অন্যান্য পত্রিকায় সংবাদটি আসে , উগ্র মুসলিম জনতা এক পুলিশ স্টেশনে হামলা চালিয়ে কোরান পুড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত এক ব্যক্তিকে পুলিশ হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। শুধু এখানেই শেষ নয় কয়েকদিন আগেও দুই মাতাল মারামারির এক পর্যায়ে ধর্ম নিয়ে গালাগালির জের ধরে পঞ্চাশ খ্রিস্টান পরিবারে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

কয়েকদিন আগে রামুতে যে জখন্য সাম্প্রদায়িক হামলা করা হয় তার পেছনে উগ্রধার্মিকদের অভিযোগ ছিল; কোরানের উপর পা রাখা একটা ছবি বড়ুয়া নামে এক ছেলের ফেসবুকে ট্যাগ করা হয়। এখানে হয়তো বলবেন এটা আগ থেকেই পরিকল্পনা করে করা হয়েছে। হ্যা সত্য তা পরিকল্পনা মাফিক-ই করা হয় কিন্তু পরিকল্পনার সাথে তারা জনগণের আবেগকেও ব্যবহার করে বৌদ্ধদের বাড়ি ও মন্দিতে আগুন দেয়।
http://imageshack.us/a/img689/8518/47989853584432310891411.jpg

এই লেখার লিখার সময় সংবাদ পেলাম-

৮৪ ব্লগারের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে
___________________________

ইসলাম ধর্ম ও মহানবী হজরত মোহাম্মদ সা. সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যকারী ব্লগার ও ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে নয়টি ব্লগের ৮৪ জনের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাইনউদ্দিন খন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, “অভিযোগ জানানোর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি ইমেইল ([email protected]) অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।

মইনউদ্দিন খন্দকার সাংবাদিকদের জানান, ইসলাম ধর্ম ও মহানবী সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যকরীদের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ চাওয়া হয়েছে আলেম সমাজের কাছে। ইতিমধ্যে এই কমিটির কাছে বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। এগুলো দ্রুত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠানো হবে অনুসন্ধানের জন্য। পরবর্তী সময়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।

তিনি বলেন, “নতুন খোলা ইমেইলে যে কেউ নির্দিষ্ট অভিযোগ জানাতে পারবেন। পাশাপাশি লেখাটিও এখানে পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে।”

এ সময় দৈনিক আল ইহসান পত্রিকার সম্পাদক আল্লামা মুহাম্মদ মাহবুব আলম আরিফ বলেন, “ব্লগারদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আসিফ মহিউদ্দিন। তার নেতৃত্বেই এসব চলছে।” তিনি বলেন, “বাকস্বাধীনতার নামে ইসলাম ধর্ম ও মহানবী হজরত মোহাম্মদ সা. সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যকারী নাস্তিকতারই নামান্তর। এদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। ভারতের কোনো ব্লগে বাংলাদেশীরা কোনো মন্তব্য করতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের ব্লগে ভারতীয়রা মন্তব্য করতে পারেন।”

তিনি অভিযোগ করেন বিটিআরসি তাদের কাজ করছে না। এ জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সরকারের নিজ উদ্যোগে একটি মামলা করার সুপারিশও করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেসব ব্লগারের তালিকা দেয়া হয়েছে তারা হলেন: আরিফুর রহমান, মনির হাসান, বৃত্তবন্ধি, সবাক, শয়তান, মনজুরুল হক, কখগ, রাসেল, নাস্তিকের ধর্মকতা, দূরের পাখি, আরিফুল হক তুইন, তিতি আনা, নাজিম উদ্দিন, আলমগীর কুমকুম, ফরহাদ ইদ্দন স্বপন, দুস্যবনহুর, ফারহানা আহমেদ, ঘনাদা, রাহান, অন্যকেউ, পাপী০০৭, হোরাস, প্রশ্নোত্তর, ভালমানুষ, ভন্ডপীর, বৈকুন্ঠ, সত্যান্বেষী, পড়–য়া, হাল্ক (সানাউল) বিপ্লব০০৭, রাস্তার ছেলে, ঘাতক, বিশাল বিডি, সাহোশি৬, লাইটহাউজ, মমতা জাহান, রাতমজুর, কৌশিক, মেঘদুত, স্বপ্নকথক, প্রায়পাস, আহমেদ মোস্তফা কামাল, লুকার, নুহান, সোজাকথা, ট্রানজিষ্টার, দিওয়ান, রিসাত, আমি এবং আধার, অরন্যদেব, কেল্টুদা, আমি রোধের ছেলে, ভিন্নচিন্তা, আউটসাইডার ও প্রণব আচার্য।

এছাড়া এ তালিকার বাইরে যেসব ব্লগারের নাম জমা দেয়া হয়েছে তারা হলেন: আসিফ মহিউদ্দিন, আবুল কাশেম, আলমগীর হোসেন, অন্য আজাদ, অনন্ত বীজয় দাস, আশীষ চ্যাটানজি, অভিজিত রায়, বিপ্লব কান্তিদে, দাড়িপাল্লা ধমা ধম, নিতাই ভট্রাচার্য, ইব্রহীম খলিল সবাগ, (সুমন সওদাগর) কৈশীক, আহমেদ, নুরনবী দুলাল, পারভেজ আলম, রাজিব হায়দার শোভন (থাবাবাবা), রতন (শন্যাসী, সৈকত চৌধুরী, শর্মী আমিন, সৌমিত্র মজুমদার (সৌম্য), আল্লামা শয়তান, (বিপ্লব) শুভজিদ ভৈৗমিক, সুমিত চৌধুরী, সৈকত বড়ুয়া, সুব্রত শুভ ও সুসান্ত দাস গুপ্ত।

নিচের ছবির সাথে বর্তমান ব্লগারদের অবস্থার মিল পাওয়া যায়।
http://imageshack.us/a/img829/652/55995146730308000870610.jpg

একদিনে জামাত শিবিরের নিষিদ্ধের দাবীতে শহীদ রুমী স্কয়ার্ডের সদস্যরা আমরণ অনশনের ডাক দিয়েছে অন্য দিকে নাস্তিকদের শান্তিক দাবীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরেও ডাক দিয়েছে ইসলামিক দলগুলো। অনশনকারীদের পাঁচজন ইতোমধ্যে অসুন্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে আবারো অনশনে যোগ দেয়। আমরা কী পারব আমাদের দাবী আদায় করতে, আমরা কী পারব জামাত-শিবির নিষিদ্ধ করতে নাকি মৌলবাদ রাজনীতি কাছে আমাদের পরজয় ঘটবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তবু্ আশা রাখি আমরা জয়ী হবোই। আমরা কী আমাদের সোনার বাঙলাদেশে আফগান করব নাকি এটাকে বাঙালির বাঙলাদেশ করব এটাই আমাদের কাছে প্রধান প্রশ্ন; পিছলানো বা সুশীল হওয়ার উপায় আমাদের আর নেই। রাষ্ট্র এখন কী মৌলবাদী শক্তির দিকে যাবে নাকি প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে থেকে সমাজকে এগিয়ে নেবে তা নির্ধারণ করার সময় এসেছে। একহয় মৌলবাদী শক্তি আপনি গ্রহণ করবেন না হয় গ্রগতিশীল শক্তির পক্ষে থাকবেন।