— “ভাই, সরকার কী জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করবে না?”– বড় একটা দীর্ঘশ্বাস থেকে উচ্চারিত হলো ইভান নামের ছেলেটির মুখ থেকে।

২৬ শে মার্চ, সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশের দিন রাজপথে বসতে বসতে বললো, “আজ তো আল্টিমেটামের দিন শেষ!”

কী বলবো, প্রথমে বুঝে উঠতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
পরে বললাম : ভাইরে সরকার তো অন্য সমীকরণ নিয়ে ব্যস্ত। তাই এরকম দীর্ঘায়িত করছে আমাদের প্রাণের দাবি।

–“কী রকম সমীকরণ”

== “মূল কথা হচ্ছে ভোটের সমীকরণ। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে কার লাভ বলো তো?”

— “কেন, সরকারের!”

== “এটা আমাদের ভাবনা। লক্ষ-লক্ষ তরুণের ভাবনা। কিন্তু সরকার হয়তো ভাবছে অন্যরকম। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হলে লাভ বিএনপি’র। সরকারের দৃষ্টিতে ওই জামায়াত-শিবিরের ভোট কখনোই আওয়ামী লীগের ভাগে যাবে না। কিংবা ১৪ দলও পাবে না। এককভাবেই বিএনপি পাবে।

সাথে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে আরেকটি প্রোপাগাণ্ডা জোরদার হবে। বাংলাদেশে “ইসলাম” ধ্বংস করে ফেলেছে সরকার। জামায়াতি ইসলাম আর ধর্মীয় ইসলাম দুটোই যেন সমার্থক, দেখানোর চেষ্টা করবে জামায়াতসহ ছোটবড় অনেকগুলো পাকিস্তানপন্থী ইসলামি দল। কারণ জামায়াত তাদের কাছে বটবৃক্ষের মতো। কোনো কারণে যদি বটগাছ কাটা পড়ে তবে এই তৃণলতা বানের জলেই ভেসে যাবে। তাই জামায়াতের ছায়া তলে আশ্রয় নেয়া ছাড়া ওদের গতি নেই।”

— “কিন্তু জামায়াতের ভোট তো মাত্র ১-২%-এর মতো। এরপরও সরকার কেন এরকম ভাবছে?”

== “মূল কারণটাই ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতির হিসাবনিকাশ। আগামী ইলেকশনে কেমন করে জিতে আসা যায়, সেটাই সরকারের মাথা-ব্যাথা। একটা জিনিষ লক্ষ্য কর। জামায়াতের রাজনীতি আর বিএনপি’র রাজনীতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। যতই বিএনপি “মুক্তিযোদ্ধার দল” বলে নিজেদের দাবি করুক না কেন। আর জামায়াত মোট ভোটের হিসাবে ছোট দল হলেও আমাদের অন্য অনেক বড় দলের তুলনায়ও এর শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে শক্ত লবিং আছে। এসব তো আমরা জানিই।

এখন যদি নির্বাহী আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে, এর কর্মী, সমর্থক, ভোট ব্যাংকের বিশাল অংশ চলে যাবে বিএনপি’র পেটে। তারা যেনতেন উপায়েই চেষ্টা করবে বিএনপি’কে আগামী বছর ক্ষমতায় আনতে। যাতে করে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়ে শক্ত প্রতিশোধ নেয়া যায়। এর জন্য যত বড় আর্থিক ফান্ড প্রয়োজন পড়ে, জামায়াত খরচ করবে বিএনপি’র তলে। তখন বিএনপি’র লাভ এককভাবেই।

কিন্তু জামায়াত যদি আগামী ইলেকশন পর্যন্ত টিকে থাকে, তার মানে তার ভোটব্যাংকসহ অন্যান্য সাপোর্টারগুলোও বিএনপি থেকে কিছুটা আলাদা থাকবে। নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করবে। বিএনপি’র জন্য জানপ্রাণ ঢেলে দিবে না। তখন সরকারের জন্য সুবিধে। আফটার অল, আওয়ামী লীগ তার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপিকেই মনে করে। যদি জনতার চাপে পড়ে জামায়াত নিষিদ্ধ না হয়, তবে ইলেকশনের আগে পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট ভাঙার চেষ্টা হবে। হয়তো কোনো ধরনের আপষের খেলাও চলতে পারে।

আমাদের সরকারগুলো বিট্রিশ-উপনিবেশিক রাজনৈতিক ধারা থেকেই তো বেরিয়ে এসেছে। “ডিভাইড এন্ড রুল” পলিসি ছাড়া তারা কিছু বুঝতে পারে না। কিন্তু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে দিলে ভোটের মৌসুমে আওয়ামী লীগ এমন ফায়দা তো আর নিতে পারবে না। তার কাছে “ট্রাম্পকার্ড” একটা কমে যাবে!”– এতোক্ষণ বলে লম্বা একটা দম নিতে হলো এবার।

— “তাহলে এই যে সারা দেশজুড়ে গণজাগরণ মঞ্জের সাথে একাত্ম হয়ে লক্ষ লক্ষ তরুণ জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি জানালো, এর কী হবে?”–ক্ষোভ, আর দুঃখ যেন চোখমুখে ঢেউ খেলছে এবার ছেলেটির।

== “দেখ! আশাহত হওয়ার কিছু নেই। জয় আমাদের হবেই। আজ নয়তো কাল। তবে কথাটা হচ্ছে কী জানো, ৭১-এর আওয়ামী লীগ আর ২০১৩-এর আওয়ামী লীগ এক নয়। বিস্তর ফারাক। ৭১-এর আওয়ামী লীগের সেই আদর্শবাদী অবস্থান, ধর্মনিরপেক্ষতা, দেশাত্মবোধ, ত্যাগী মনমানসিকতা কোনোটাই আর তেমন অবশিষ্ট নেই আজকে এই দলে। এখানে বরং দুনীর্তি, লুটপাটতন্ত্র, খাইখাইতন্ত্র সবই ঝেঁকে বসেছে। তাই তো চারটি বছর একের পর এক দুনীর্তির পসরা সাজিয়ে এখন পঞ্চম বছরে এসে কোনো রকমে নির্বাচনী বৈতরনী পাড় হতে পারলেই যেন বাঁচে দলটি।

কিন্তু শাহবাগের আন্দোলন পুরোপুরি আদর্শবাদী অবস্থান থেকে তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য। এটা মানতেই হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধকরণ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম শর্ত। ৩০ লক্ষ শহীদের এই দেশে জামায়াত-শিবিরকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখনোই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। বরং ৩০ লক্ষ শহীদের প্রতি আমাদের প্রথম রাষ্ট্রীয় সম্মান হতে পারে রাজাকার আর নব্যরাজাকারদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেয়া।

এতোটা আদর্শবাদী অবস্থান ২০১৩-এর “আওয়ামী লীগ” ধারণ করে কী? আমরা তো কোনো ভোটের রাজনীতির “দাবার গুটি” হতে আসি নি। আমরা কাউকে নির্বাচনী বৈতরণী পার করিয়ে দিতে আসি নি। কেউ যদি এমনটাভাবে তবে অবশ্যই ভুল করবে। আমাদের দাবি একটাই। বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতি করতে পারবে না। এদেশে রাজনীতি হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোর। সরকারি দল, বিরোধী দল হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে। এটাই আমাদের সামান্য দাবি।

তবু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, শাহবাগ কিংবা সারা দেশের গণজাগরণ মঞ্চকে রাজনীতির ময়দানের “দাবার গুটি” বানানোর নানা চেষ্টা চলছে। আমাদের ঘোষিত ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর আড়াই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর ঋণ শোধের দাবির উপর যেমন কেউ কেউ কালিমা লেপন করতে চাচ্ছে তেমনি কেউ কেউ একে ব্যবহার করে নিজের এতোদিনের কলঙ্কিত ইমজেকে রিফাইন করার চেষ্টা করছে।”

— “তবে, জামায়াত কি কোনোদিনই নিষিদ্ধ হবে না?”

== “হতেই হবে। তুমি কী মাস কয়েক আগেও ভেবেছিলে, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট সংশোধন হতে পারে? জামায়াতকে “সংগঠন” হিসেবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে? কিন্তু দেখ, আজ পরিস্থিতি পাল্টেছে। যতই ষড়যন্ত্র হোক না কেন, জনতাই পারবে সরকারের “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি” অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে। আমাদের দেশে ঠেলা দিলে সবই সম্ভব…”

** দ্রষ্টব্য: ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে এই লেখাটি প্রথম দেয়া হয়েছিল।