১.

অনেকদিন আগের ঘটনা।  মুক্তমনায় আফরোজা  আলম একটা লেখা  লিখেছিলেন। নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনূস ( নোবেল পুরষ্কার কি ছিনতাই সম্ভব?), এই নামে। এই লেখায়  আদিল মাহমুদ একটা মন্তব্য করেছিলেন। সেই মন্তব্যের অংশ বিশেষ  ছিল এরকম।

ওনার ক্ষেত্রে আমার কাছে যেটা আজব লাগে তা হচ্ছে যে উনি নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর পরই দেখা গেল হঠাত করেই উনি একজন মূর্তিমান ভিলেনে পরিনত হয়েছেন। এই মানসিকতার কারন কি? নোবেল প্রাইজ না পেলে মনে হয় না এভাবে তার বিরুদ্ধে প্রচারনা হত। এতে অবশ্যই আমার আপত্তি আছে।

এই লেখার নানান মন্তব্য নিয়ে আমি এমনিতেই একটু বিরক্ত ছিলাম। আদিল মাহমুদের এই  বক্তব্যের বিপরীতে আমি একটা  ঝাঁঝালো মন্তব্য করি। সেটা ছিল এরকম।

আপনি মনে হয় ইয়াজউদ্দীন নামের বিএনপির এক পাপেটের সময়কার দুঃসহ স্মৃতির কথা ভুলে গিয়েছেন। এই লোকের ষড়যন্ত্রে যখন দেশ বিপন্ন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চার উপদেষ্টা পদত্যাগ করছেন ইয়াজুর ষড়োযন্ত্রের প্রতিবাদে। যখন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে মানুষ, রাস্তায় রাস্তায় প্রাণ দিচ্ছে, তখন প্রফেসর ইউনুস খোকাবাবুর দেয়া নাগরিক সম্বর্ধনায় যোগ দিচ্ছে। বিদেশে যাবার আগে ইয়াজউদ্দীনকে বলে যাচ্ছে, আপনি যা করছেন ঠিক করছেন, আরো কঠোর হাতে সবকিছু দমন করুন।

এখানেই শেষ নয়, আর্মির ডান্ডা পেটা খেয়ে হঠাৎ করে একদিন ইয়াজউদ্দীন জাতির কাছে মাফটাফ চেয়ে পদত্যাগের পরে যে ছদ্ম সেনাশাসন এসেছিল তখন তিনি রাজনীতিবিদদের দুরাবস্থার সুযোগ নিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে নেমেছিলেন। রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন। যখন দেশে রাজনীতি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তখন তিনি বিনাবাধায় রাজনীতি করে গেছেন সেনা সমর্থনের সুযোগ নিয়ে।

তাঁর এই সব সুবিধাবাদী জনবিরোধী আচরণই তাঁর জনপ্রিয়তাকে ধ্বসে দিয়েছে। তিনি ভিলেনে পরিণত হয়েছেন নোবেল পাওয়ার ঈর্ষা থেকে নয়, বরং তাঁর এই সমস্ত সুবিধাবাদী কর্মকাণ্ড থেকে।

আর নোবেল পাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর হাস্যকর ছেলেমানুষী প্রতিক্রিয়াসমূহর কথা আর কী বলবো। আমার নিজেরই লজ্জা লাগতো নোবেল প্রাপ্তি পরবর্তী তাঁর প্রবল উচ্ছ্বাসময় বালসুলভ আচরণসমূহ দেখে। একজন নোবেলপ্রাপ্ত প্রবীন ব্যক্তি এই রকম ছাগলামি আচরণ করে কী করে?

প্রফেসর ইউনুস নোবেল পাবার পরপরই আনন্দে উদ্বেলিত আমি তাৎক্ষণিকভাবে একটা লেখা লিখেছিলাম মুক্তমনায়। আমি আমার কোনো লেখা নিয়েই পরে কখনো অনুতাপ করি না, কিন্তু এই একটা লেখা নিয়ে আমার প্রবল অনুতাপ রয়েছে অদ্যাবধি।

আমার  মন্তব্যের পরেই  মুক্তমনায়  নবাগত একজন আমার  ব্যবহৃত  ছাগলামি শব্দটাকে হাইলাইট করে আমাকে মুক্তমনার নীতিমালা কোট করে আমি প্রফেসর ইউনুসকে ছাগু ডেকে মুক্তমনার নীতিমালা ভেঙেছি বলে অভিযোগ জানায় একজন। এর প্রতিক্রিয়া হয় তীব্র। অনেকেই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন এই বলে যে, আমি ইউনুসকে ছাগু  বলি  নাই, তাঁর আচরণকে ছাগলামি বলেছি। আমি নিজেও বেশ  কড়া একটা উত্তর দেই তাঁকে।

 

ছাগল ছাগলামি করে না, ছাগলামি করে মানুষে। কেউ ছাগলামি আচরণ করছে বলা মানে তাকে ছাগল বলা না। তাহলেতো কেউ গাধামি করছে বললে তাকে আসলে আসল গাধা বলা হয়।

প্রফেসর ইউনুস নিঃসন্দেহে চার পা বিশিষ্ট, থুতনিতে ছাগলা দাঁড়িসমৃদ্ধ ছাগল নন। সেটা তাঁকে বলিও নি আমি। তবে, তিনি নোবেল পাবার অতি আনন্দে ছাগলামি আচরণ যে করেছেন তাতে কোনো সন্দেহই নেই। তাঁর আচরণ শুধু ছাগলামির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ভীমমরতিতে ধরা বাহত্তুরে বুড়োদের মত পাগলামির সীমাও অতিক্রম করে গিয়েছিল কোনো কোনো সময়ে। ইয়াজুর সময়ের গণবিরোধী আচরণ এবং সেনা সরকারের সময়ে পিছনের দরজা দিয়ে রাজমুকুট মাথায় পরার ধূর্তামি আচরণের কথা আর না হয় নাই বা বললাম।

কাউকে অভিযুক্ত করার আগে অভিযোগ করার মত যথার্থ মেরিট আছে কি না সেটা যাচাই-বাছাই করে নিলেই সবচেয়ে ভাল হয়।

অন্যদের সমালোচনা এবং আমার কঠোর আচরণে বেচারা বেশ ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে যায়। শেষে আমার সাথে সন্ধি করার জন্য  দশটা গোলাপ  উপহার দেয় আমাকে। তাঁকে বিশটা গোলা্প ফেরত দিতে বলে। কারণ আমি বলেছিলাম যে, কেউ একটা গোলাপ দিলে, আমি তাঁকে দুটো গোলাপ উপহার দেই আমি।  সেই  সাথে বিব্রত এবং  বিপর্যস্ত সে মুক্তমনা  ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।

 

এর মধ্যেই আমি জেনে গিয়েছি যে, এই মন্তব্যকারী একজন বাচ্চা ছেলে। আমার তীব্র অনুশোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। সেই অনুশোচনা থেকেই  শেষে আমি লিখি।

আপনি এরকম একটা বাচ্চা ছেলে জানলে হয়তো কোনো প্রতিক্রিয়াই জানাতাম না আমি। পুরোপুরি উপেক্ষা করতাম আপনার অভিযোগনামার। প্রফাইল পিকচার দেখে কারো বয়স আন্দাজ করাটা একটু মুশকিলই। এই মুক্তমনাতেইএকজন পূর্ণ বয়ষ্ক ব্যক্তি আছেন, যিনি তাঁর প্রফাইল পিকচারে বালকের ছবি ব্যবহার করেন।

আমার কঠোর পালটা প্রতিক্রিয়া দেখে যদি মুক্তমনা ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন, তবে খুবই দুঃখ পাবো। লড়াইয়ে আমি দয়ামায়াহীন নির্মম সত্যি, তবে তার চেয়েও বড় সত্যি মনে হয়, ভালবাসাতেও অনুপম আমি।

আমি গুণে গুণে ছেলেটাকে বিশটা বিকশিত গোলাপ উপহার দেই।

আমার মত একজন কঠোর মানুষের কাছ থেকে এতগুলো গোলাপ পাওয়া এই ছেলেটার নাম টেকি সাফি।

 

২.

টেকি সাফিকে আমি প্রথম দেখি তার নিজেরই পোস্ট করা বইমেলা সংক্রান্ত এই পোস্টে। এক মাথা চুলের রোগা লিকলিকে এক কিশোর। পাখা লাগবে না, এমনিতেই বাতাসে উড়ে যাবে। এতই বাচ্চা একটা ছেলে যে আমাদের মুক্তমনার হাফবুড়োদের  সাথে ঠিক একটা মানায় না। শুধু টেকি সাফি একা নয়, মুক্তমনায় বেশ কয়েকজন এরকম বাচ্চা ছেলে আছে। মুক্তমনার মডারেশনে এক সময় থাকার কারণে নানা উপায়ে সেই তথ্যগুলো জানা হয়ে গিয়েছিল  আমার। মুক্তমনায় আমি নানা জনের সাথে নানা তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া ফ্যাসাদে জড়িয়েছি। কিন্তু খুব সচেতনভাবে এই বাচ্চাগুলোকে এড়িয়ে গিয়েছি আমি। এরাই আমাদের ভবিষ্যত। আমাদের সামান্য একটু কঠোর আচরণে, সামান্য একটু সমালোচনাতেই এদের বিরাট নেতিবাচক পরিবর্তন  ঘটে যেতে পারে।

 

৩.

শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে  বিরাট আশাবাদ ছিল আমার। শুধু আমার নয়, আরো  বহু বহু  মানুষের ছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনই পরে কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। স্বতস্ফুর্ত একটা  আন্দোলন থেকে যাঁরা নেতা হয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যেই এসে গিয়েছে পুরোনো  সব নেতাদের বদ অভ্যাস। টেলিভিশনে চেহারা দেখানো, খবরের কাগজে  নাম উঠানোতেই এখন ব্যস্ত তাঁরা। এদিকে আন্দোলনের খরস্রোতা নদী যে গতি হারিয়ে বদ্ধ  জলাশয় হয়ে উঠছে, সেদিকে  কোনো খেয়ালই নেই। যে সব চাওয়া পাওয়া নিয়ে তীব্রতর হয়েছিল আন্দোলন, তরুণ তরুণীরা আশায় বুক বেঁধেছিল, সেগুলো এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই স্থবির আন্দোলনে এখন আর আস্থা রাখা দায় হয়ে পড়েছে।

এই স্থবির এবং  হতাশার সময়ে হঠাত করেই জ্বলে উঠেছে কয়েকজন তরুণ। এরা সবাই একাত্তরের বীর সেনানী শহীদ রুমি বীর বিক্রমের নামে গড়া শহীদ রুমি স্কোয়াডের সদস্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামাত শিবিরের নিষিদ্ধের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেছে। শুরুতে সাতজন ছিলেন। পরে আরো দুজন যোগ দেয়।

এই দুজনের একজন, একটা রোগাপটকা ছেলে। আমাদের টেকি সাফি।

গত  দুই দিন ধরে রাজাকার মুক্ত একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে শাহবাগের রাজপথে না খেয়ে পড়ে আছে এরা।

 

৪.

টেকি সাফির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু শফিউল জয়। এই ছেলেটাও মুক্তমনায় লেখে। শুধু লেখে বললে ভুল হবে, এই ছেলেটা যে মানের লেখা লেখে, তা আমি শুধু স্বপ্নেই লিখি। শফিউল জয় সাফির অনশন  নিয়ে মহা উদবিগ্ন। সাফি কতখানি সিরিয়াস হতে পারে কোনো বিষয়ে, তা জয়ের চেয়ে আর কেউ ভালো জানে না। জয় লিখেছে,

 

শাফিকে আমি চিনি। মরার আগ পর্যন্ত তার অনশন ভাঙার কথা না

সাফি  জানে কি না জানি না। রুমির ভালো নামও শাফিই ছিল। সেই ছেলেটাও একাত্তরে এরকমই ছিল। মরার আগে মরে নি সে।

৫.

একত্রিশ ঘন্টা অনশনের পর টেকি সাফি ফেসবুকে তার বক্তব্য দিয়েছে।

আমার ফোন নাই, ল্যাপটপ নাই…আপডেট জানাইতে পারি না।
আর জানানোর দরকারও নাই, মানুষ জেনে গেছে তাদের কী করণীয়..আমি মানুষ, আমার শারীরিক সীমাবদ্ধতা আছে। আমি আজকে সুস্থ আছি…অনশন চলতে থাকলে কালকে সুস্থ নাও থাকতে পারি। কিন্তু আমার তো আর ভয় নাই…আমার যতটুকু করার ছিলো, আমি সর্বোচ্চটা করার চেষ্টা করছি, বাকিটা জনতার উপর!
আমি হয়তো পড়ে যাব…সেখানে হাল ধরে দাঁড়িয়ে যাবে আরো দশজন!! আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে…বিভিন্ন পেশার মানুষ।

সারাদিন না খেয়ে থেকেও কষ্ট লাগে না…কষ্ট লাগলেও সেটা টের পাই না; কিন্তু তখন খুবই কষ্ট লাগে যখন দেখি যারা পারেন এই আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে তারা নানা ধরণের ভূল-ত্রুটি আবিস্কারে ব্যস্ত। শুধু ভুল-ত্রুটি নয়, অনেক সময় ডাহা মিথ্যা কথা বলারও চেষ্টা দেখা গেছে। ক্যানো ভাই? হয়তো আপনি একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করেন কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য তো একই তাই না? তাই আমাদের কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে আপনি আমাদেরকে জানান…এখন অনশনের ৪৩ ঘন্টা পার হয়ে গেছে, ব্যক্তিগতভাবে আমি এখানে আছি, ৩১ ঘন্টা প্রায়। শুধু খাওয়া নয়, এখানে ঘুমের পরিবেশও নাই…তবু কেউ যখন কথা বলতে আসছেন, আমরা খুব পরিস্কার করে বারবার আমাদের কথাগুলো পরিস্কার করে বলে যাচ্ছি।

আপনি আমাদের সাথে একমত না হইলেও অসুবিধা নাই…কিন্তু যেহেতু আমাদের উদ্দেশ্য এক, তাই প্লিজ আমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্থ কইর‍্যেন না।

সাফি একদিন আমাকে দশটা গোলাপ দিয়ে জোর করে কুড়িটা গোলাপ আদায় করে নিয়েছিল। আজ ওকে কিছু দিতে হবে না। ওর জন্য লক্ষকোটি গোলাপ হাতে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। রোগা লিকলিকে এই খেপাটে ছেলেটার জন্য বুকের মধ্যে অসীম ভালবাসা টের পাচ্ছি।

৬.

নেতা হলেই এক সময় সবাই কেমন যেন নেতিয়ে যায়। স্বার্থের বক্র টানেই হয়তো এমনটা ঘটে।  এরকম নেতানো নেতা দিয়ে কোনো আন্দোলনই তার গন্তব্যে পৌঁছায় না। শুরুর দিকে এরা আন্দোলনের গতি দিতে চেষ্টা করে, কিন্তু একটা সময় পরেগিয়ে নিজেরাই সেই  গতিতে ভীত হয়ে পড়ে। তখন আন্দোলনের পিঠে চড়ে এরা আন্দোলনের গতিতে রাশ পরানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে উঠে। এরকম সময়েই প্রয়োজন পড়ে সাহসী মানুষদের। শহীদ রুমি স্কোয়াডের ছেলেমেয়েগুলো সেই সাহসী মানুষেরই প্রতিচ্ছবি।

একবুক ভালবাসা রইলো শহীদ রুমি স্কোয়াডের  সকল সদস্যদের জন্যে।