সন তারিখ মনে নাই।
সময়টা ছিল এক পড়ন্ত বিকাল।
আমি আমার মেডিকেল কলেজের লেকচার গ্যালারী আর লাশকাটা ঘরের মাঝামাঝি বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে ছিলাম। একজন শিক্ষকের জন্য এভাবে বসে থাকা শোভনীয় কিনা সে ভাবনা একবারো মাথায় আসেনি।
২৫ বছর আগে ফেলে আসা এ আমার পুরানো ক্যাম্পাস। এভাবে বসে এনাটমি বই হাতে পার করেছি কত বিকাল, সন্ধ্যা।
মনে হচ্ছিল আমি ফিরে এসিছি একান্ত আপন আঙিনায়, যেখানে প্রোথিত আছে আমার অনেক স্মৃতি, সু:খ, দু:খ, আনন্দ , বেদনা।
ক্যাম্পাসে বেড়ে উঠা সেই আমগাছ, বয়সের ভারে বিবর্ণ প্রায় আমার প্রিয় পাতাবাহার আর রক্তজবা এখনো আছে।

কলেজ জীবন শেষ হয়েছে দুই যুগ আগে।
আমার শেষ, কন্যার শুরু। এই কারণেই অনেকদিন পর আমার এখানে ফিরে আসার এক অপূর্ব সুযোগ।
এ এক অসম্ভব ভালোলাগার অনুভূতি।

“আসসালামু আলাইকুম”
আমি একটু চমকে উঠলাম।
হয়তো পুরানো কোন কর্মচারী বা স্টাফ, চেনার চেষ্টা করলাম।
চিনতে না পারার অস্বস্তিতে আমি যখন কিছুটা বিব্রত তখন আগন্তুকই প্রশ্ন করলো “ভাই আপনি কি এখানে চাকুরী করেন?”
যদিও আমি এখন আর এখানকার কেও নই তবুও হ্যা বোধক উত্তর দিয়ে ঘাড়টা নাড়ালাম।
লোকটার বয়স চল্লিশের ঘরে। হাতে ভাঁজ করা হলুদ খাম, পলিথিনে মোড়ানো। চোখ-মুখে ভ্রমণজনিত ক্লান্তির ছাপের মধ্যেও একটা আশার ঝলকানি।

একবার খামটির দিকে একবার আমার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করছে দেখে আমিই প্রশ্ন করলাম
“ভাই আপনি কাওকে খুজছেন?”
আগন্তুক না বোধক উত্তর দিয়ে যা বলল শুনে আমি হতবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।

“ভাইজান আমি এসেছি বগুড়া থেকে। এই খামে আমার সন্তানের নাড়ী(Umbilical Cord) আছে। আমি এটাকে এখানে পুতে রেখে যেতে চাই, কোন অসুবিধা আছে?”

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “বগুড়া থেকে আপনি সন্তানের নাড়ী নিয়ে এসেছেন এখানে, এতদূরে?”

“ভাই আমার ইচ্ছা সন্তান ডাক্তার হবে। আমার বিশ্বাস এই নাড়ীর টানেই একদিন সে এখানে আসবে, মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবে, ডাক্তার হবে, আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।”
নাড়ী পোতার অনুমতি দেওয়া না দেওয়ার আমি কেও না তবুও বললাম –
“ভাই আপনি যে গাছের নিচে ইচ্ছা নাড়ী পুতে রাখুন। আল্লাহ আপনার আশা পূর্ণ করুক।”

এরপর আমি অবাক বিষ্ময়ে দেখলাম একজন পিতা কি গভীর মমতায় রক্তজবা গাছের নীচে তার এক সাগর স্বপ্নের বীজ বপন করল। আমি জানিনা কেন আমার দু চোখ ক্ষণিকের জন্য ঝাপসা হয়েছিল।

কিছুক্ষণের জন্য আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই অতীতের ছাত্রজীবনে। আমি আবিষ্কার করলাম কত স্বপ্নের বীজ আমিও বপন করেছি ঐ পাতাবাহার আর রক্তজবার পাদদেশে। ঐ আমগাছের ছায়াতলে। আর তাই বুঝি আমার এত ভাললাগা আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের প্রতি।

নাড়ীর টানে ব্যাকুল হওয়া নতুন কিছু নয় ।
নগরবাসী তার ফেলে আসা শৈশবের গ্রামের টানে ব্যকুল হয় সবসময়।
প্রবাসী হৃদয়ও দেশের জন্য হাহাকার করে নিরন্তর।
দেশমাতৃকার টানে ৩০ লক্ষ জীবন দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ।
আমি সরাসরি দেখলাম নাড়ীর টানের এক অভূতপূর্ব, অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম ঐ স্নেহময়ী পিতাকে।

অনেক বছর পর।
আজ দেখি এদেশে জন্ম নেয়া কিছু মানুষের নাড়ীর টান ভীনদেশের প্রতি। চরম বিশ্বাসঘাতক আর অকৃতজ্ঞের মতো জননী জন্মভূমিকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে মতলববাজ, ধর্মব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ।
মনে প্রশ্ন জাগে কোথায় জন্ম তোমার হে অভাগা, কোথায় প্রোথিত তোমার নাড়ী হে অকৃতজ্ঞ। খুঁজে দেখ, খুঁজে নাও, নিজ ঠিকানা।
উপলব্ধীর চেতনায় ফিরে একবার নিজ আয়নায় মুখ দেখে নিজেকে প্রশ্ন করো “মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েছো, মানুষ হয়েছ কিনা।”।