শাহবাগে তারুণ্যের এ জাগরণ ছিল ঐতিহাসিকভাবে অপরিহার্য। সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি, সমাজের বিকাশ বৈজ্ঞানিক নিয়ম মেনেই চলে এবং এ বিকাশ সদা উর্ধ্বমুখী। অর্থ্যাৎ এর গতি গুণগতভাবে সামনের দিকে । কিন্তু সমাজের বিকাশ সরল রৈখিক নয়, আঁকা-বাঁকা বন্ধুর । কখনো কখনো তা থমকেও দাঁড়ায় কিংবা কিছুটা পশ্চাৎগামীও হয়, তবে তা সাময়িক ভাবে । চুড়ান্ত বিচারে সমাজের ক্রমবিকাশ অপ্রতিরোধ্য। এ প্রত্যয় বিশ্বজনীন (universal) । আবার সামগ্রিক ভাবে বিশ্ব মানব সমাজের জন্য এ প্রত্যয় যেমন সঠিক, তেমনি বিশ্বে বহুধাবিভক্ত মানবগোষ্ঠীর আলাদা আলাদা সমাজ ও সভ্যতার প্রশ্নেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। এ বৈজ্ঞানিক নিয়মেই বিশ্ব মানব সমাজ আজ নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে, শত সহস্র প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে বিকাশের এ উৎকর্ষতার যুগে এসে পৌছেছে, যাকে বলা হয়-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিল্পবের যুগ (the era of STR) । এখানেই কিন্তু তার অগ্রযাত্রার সমাপ্তি নহে। মানব সমাজ আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। সমাজ বিকাশের এ সূত্রানুসারে-কেউ পছন্দ করুক বা না করুক-বিশেষ কোন সময়ে বিকাশের অপহিার্য প্রয়োজনে সমাজে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার উদ্ভব ঘটে, যা বিকাশের প্রয়োজনে অপরিহার্যও বঠে।
আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগ চত্বরে আমাদের তরুণ প্রজন্মের যে অভূতপূর্বব জাগরণ, আপাতভাবে তা অপ্রত্যাশিত কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত মনে হলেও, সমাজ বিজ্ঞানের ধারায় তা ছিল তেমনি একটি অপরিহার্য ঘটনা। আমাদের একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধও ছিল সমাজ বিকাশের দিকে অপরিহার্য একটি অগ্রবর্তী ধাপ। সমাজ বিকাশের ধারায় বৈজ্ঞানিক ভাবে ঐতিহাসিক কোন ভ্রান্তি ঘটলে বিকশের প্রয়োজনে ইতিহাস তা আবার সংশোধন করে নেয়। যেমন বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশের দু’প্রান্তে অবস্থিত দু’টি ভূ-খণ্ডের সমন্বয়ে নিছক ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম তেমনি একটি ঐতিহাসিক ভূল, যা আমাদের একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাঙলার অভ্যূদয়ের মাধ্যমে সংশোধিত হয় এবং সে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জনগোষ্ঠী সমাজ প্রগতির দিকে এক ধাপ এগিয়ে যায়। দ্বাদশ শতাব্দীর রেনেঁসা মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সমাজে যে জাগরণের সৃষ্ঠি করেছিল, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তায়ও সে রকম একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল-যাকে রেনেঁসা বললে অত্যুক্তি হয় না। তাই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিপরীতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্রের ভাবনা, বৈষম্যহীন সমাজ ভাবনা থেকে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি মূল্যবোধ ও চেতনাগুলো রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে আমাদের সদ্য-স্বাধীন দেশের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। কিন্তু সে আধুনিক চেতনা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত সমাজ বিনির্মাণ করতে পারি নি। যে কোন কারণে বিকাশের প্রয়োজনীয় যে কোন উপাদানের ঘাটতি সমাজ বিকাশকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দিতে পারে। এ উপাদান যেমন হতে পারে অবকাঠামোগত, তেমনি হতে পারে উপরিকাঠামোগত। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিকাশ থমকে যাওয়ার ক্ষেত্রে উভয় উপাদান নানা মাত্রায় কাজ করেছে।
প্রথমতঃ স্বাধীনতার অব্যবহিত পর স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত আমাদের মূল্যবোধগুলোকে যথাযথভাবে লালন করার কোন উদ্যোগই আমরা গ্রহণ করি নি। স্বাধীনতার মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি ঘটলেও আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াই কিন্তু তখনো শেষ হয়নি, অথচ তাতেও আমরা যবনিকা টেনে দিলাম। কেবল মৌলনীতিমালা হিসাবে স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধগুলোকে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করার মধ্যেই আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করলাম। কিন্তু চেতনা বিকাশের যে সাংস্কৃতিক লড়াই, তা যে নিরন্তর এবং তাকে যে নিরবচ্ছিন্ন চালিয়ে যেতে হয়, সে বিষয়ে আমরা মোটেও সচেতন ছিলাম না। বরং উল্টাভাবে একাত্তুরে যাদের আমরা পরাজিত করেছি, রাজনীতির মাঠ থেকে তারা আপাতঃ অপসৃত হলেও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে তারা কখনো যতি টানে নি। ফলতঃ মুক্তিযুদ্ধের আবেগ যখন থিতিয়ে আসে, তখন আমজনগণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আকর্ষণও ফিকে হতে থাকে।
দ্বিতীয়তঃ ধারাবাহিক একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চুড়ান্ত পরিণতিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন, আমাদের জনগোষ্ঠীর মাঝে আর্থ-সামাজিক মুক্তির প্রচণ্ড আশাবাদ সৃষ্ঠি করে, যা স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে নানা কারণে আমরা পূরণ করতে ব্যর্থ হই।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মানুষ যে রকম অর্থনৈতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের স্বপ্ন দেখেছিল, নানা কারণে তা পূরণ না হওয়ায় সে স্বপ্ন-ভঙ্গের বেদনা তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়। এভাবে আমাদের সমাজ-মানস স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের পরিত্যক্ত মৌলবাদী চেতনা চাষের উর্ব্বর ভূমি হয়ে ওঠল। এহেন একটি প্রেক্ষাপটে ঘটে গেল ১৫ ই আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা।
বস্তুতঃ ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার যে পালাবদল ঘটল, তা একাত্তুরের পরাজিত শক্তিকে রাজনৈতিক মাঠে আবির্ভূত হওয়ার অর্গল খুলে দিল। পরিণামে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার চেতনা সিক্ত পথে এগিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হল না। ফলত: সমাজ বিকাশের যে অপরিহার্য ধারায় আমাদের সমাজ এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা থমকে গেল। এ স্থবিরতার সুযোগে পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ-মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ, ইত্যাকার ভাবাদর্শগুলো আবারো সমাজে মাথাছাড়া দিয়ে ওঠতে লাগল। তাকে প্রতিহত করার কোন সাংগঠনিক ও সচেতন উদ্যোগ আমাদের ছিল না। তবে বৈজ্ঞানিক বিকাশের সাথে সমাজের বস্তুগত যে বিকাশ ঘটে, তা অনিবার্যভাবে বিকাশ ঘটায় সামাজিক চেতনার। ফলশ্রুতিতে সামাজিক চেতনার সে স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ, তা ঐ সমস্ত অপচেতনাগুলোর বিকাশের পথে অনতিক্রম্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কারণ একটি তত্ত্ব, দর্শন কিংবা কোন সূত্র যদি ভুল হয়, একটি পর্যায়ে তার বিকাশ, বিস্তার বা ঠিকে থাকা আর সম্ভব হয় না। সঠিক তত্ত্ব, দর্শন বা সূত্র তাকে অপসৃত করবে। তাই আমাদের সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, সরকারীভাবে ইতিহাস বিকৃতি, অঢেল পেট্রোডলার বিনিয়োগ এবং ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহার করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাস করার নিরলস অপচেষ্টা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলতে পারে নি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। তবে তাকে রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। শাহবাগ চত্বরে আমাদের তারুণ্যের যে নব জাগরণ, মুক্তিযুদ্ধের সে অবরুদ্ধ চেতনার জ্বালাময়ী অগ্নুৎপাত বৈ কিছুই নহে। তাই স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পর আবারো ফিরে এসেছে সেই শ্লোগান-আমি কে, তুমি কে- বাঙালি, বাঙালি, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা। মসজিদ মন্দির গীর্জায়-রাজনীতির ঠাঁই নেই, জয় বাংলা ইত্যাদি ।
কিন্তু আমরা একাত্তুরের প্রজন্মের মত আজকের তরুণ প্রজন্ম যেন আমাদের ভুলের কোন পুণরাবৃত্তি না করে। পুরানো চেতনার পরিশীলিত ও সমকালীন যে সংস্করণ আজ তাদের অন্তর ঝুড়ে জেগে ওঠেছ, তার ভিত্তিতে আমাদের গোঠা সমাজকে গড়ে তুলতে হলে তাদের এ জাগরণকে একটি নিরবচ্ছিন্ন ও শিকড়-নাড়া সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপান্তর করতে হবে। আমাদের সমাজের কাঙ্ক্ষিত বিকাশকে আমরা আর স্বতঃস্ফূর্ত নিয়তি কিংবা বিবর্তনের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না । সচেতন উদ্যোগ ও কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে তাকে আমাদের এগিয়ে নিতে হবে।
কিন্তু কিভাবে?
সঠিক রোগ নির্ণয় যেমন সঠিক চিকিৎসার পূর্বশর্ত, ঠিক আজ আমাদের জাগ্রত তারুণ্যকে সর্বাগ্রে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার কারণ। বলাই বাহুল্য, আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা কারণ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, ধর্মান্ধ চিন্তা-চেতনা, কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতা, আমাদের ঐতিহ্য-ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক, সর্বোপরি আমাদের আত্মপরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি।
স্মর্তব্য যে, কোন সমাজের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা পরস্পর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা একটি আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মৌলিক বিষয় হলেও সে সংকট উত্তরণে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। (এক্ষেত্রে বিভ্রান্তি এড়াতে আমাদের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর ভিত্তি (infrastructure) ও উপরিকাঠামোর (superstructure) এর দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা মনে রাখতে হবে। কারণ অনেকে অবকাঠামো-উপরিকাঠামোর দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটি গুলিয়ে ফেলেন। আমাদের বুঝতে হবে যে, একটি আর্থ-সামাজিক কাঠামোর ভিত্তি বা অবকাঠামোর উপর যেমন ঐ সমাজের উপরিকাঠামো গড়ে ওঠে, আবার উপরি কাঠামোরও আছে আপেক্ষিক স্বাধীনতা-যা অবকাঠামোকে প্রভাবিত করে পরিবর্তনের আদর্শিক প্রেক্ষিত সৃষ্টি করে। সহজভাবে বললে, আমাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতা যেমন আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার মূল কারণ, তেমনি আমাদের এ পশ্চাৎপদ সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশই আবার আমাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতা থেকে উত্তরণের পথে প্রধান অন্তরায়।) এভাবে আর্থ-সামাজিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার এক দুষ্টচক্রে (vicious circle) আটকে গেছে দেশ ও জাতির উন্নয়ন অগ্রগতি। তাই কেবল রাজনৈতিক আন্দোলন-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন-আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ক্ষমতারোহণ এবং তৎপর একাত্তুরের স্বাধীনতা বিরোধীদের শারিরীক বা সাংগঠনিক ভাবে নির্মূলের মাধ্যমে এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না। এ বক্তব্যের যথার্থতা উপলব্ধি করতে হলে আমাদের বর্তমান সংকটের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে হবে।
আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার স্বরূপঃ
একটি জাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা হলো তার মূল্যবোধ, চিন্তা, চেতনা, যুক্তিবোধ, বিশ্বাস ইত্যাদি, যা আবার মূলতঃ নির্ভর করে জনগোষ্ঠীর শিক্ষার মানের উপর। সামগ্রিক অর্থে একটি সমাজের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রগতি নির্ভর করে সে সমাজের জনগোষ্ঠীর মনও মনীষিতার বিকাশের উপর। মন ও মনীষিতার বিকাশ নির্ভর করে জ্ঞান বিকাশের উপর। জ্ঞানার্জনে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এ জাতির পরম দুর্ভাগ্য হল, স্বাধীনতার দীর্ঘ চার দশক পরও আমাদের শিক্ষার হার-ন্যূনতম অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষসহ এখনো ষাট শতাংশ অতিক্রম করতে পারে নি । শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে প্রশ্নতো আছেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা চললেও তার সবকিছুই সীমাবদ্ধ থাকছে কেবল শিক্ষার পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে। শিক্ষার বিষয়বস্তু ও লক্ষ্য তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। তাই শিশুশিক্ষা থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত আমাদের শিক্ষা কারিকুলামের একটি বৃহৎ অংশ জুড়েই আছে ধর্মীয় শিক্ষা। শিক্ষার বিষয়কে-বিশেষভাবে বিজ্ঞান শিক্ষাকে কেবল একটি টেকনিক্যাল বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শিক্ষা নিজেকে আলোকিত করা নয়, নিছক জীবিকা অর্জনের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার উপায় মাত্র। এখানে শিক্ষার সাথে শিক্ষার দর্শনের কোন সংশ্রব নেই। তাই আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি-আমাদের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজগুলো থেকে প্রতি বছর ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ারদের সাথে দলে দলে হুজুরও বের হয়ে আসছে । তারা তাদের পরবর্তী কর্ম জীবনের বেশকিছু মূল্যবান সময় ব্যয় করে সাধারণ মানুষকে আল্লাহ ও ধর্মের পথে আহবান জানিয়ে। দেশ ও জাতির প্রতি যে ইহজাগতিক দায়িত্ববোধ, তা তাদের কাছে গৌণ। তারা কেবল পরকালের স্বর্গ অন্বেষণে উদগ্রীব। তারা তাদের পরলৌকিক মুক্তির জন্য যত উৎকন্ঠিত, সমাজের ইহজাগতিক সমস্যা নিয়ে ততোধিক নিস্পৃহ। অর্থাৎ আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার গলদটা এত গোড়ায় যে, বিজ্ঞান শিক্ষাও আমাদের ছেলে-মেয়েদের বিজ্ঞানমনস্ক করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ সত্যিকার বিজ্ঞানভিত্তিক কোন শিক্ষা কারিকুলাম আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে অনুসরণ করা হয় না। মূলধারার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যেখানে এ অবস্থা, সেখানে সমাজের তৃণমূলে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় মাদ্রাসা ও “কওমী মাদ্রাসা” এর নামে বেসরকারী এক অদ্ভুত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত, যেখানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখানোতো দূরের কথা, উল্টাভাবে আধুনিক শিক্ষার বিরুদ্ধে, সকল প্রকার আধুনিকতার বিরুদ্ধে, কার্য-কারণ ও যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে কোমলমতি ছেলেদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জীবনমুখী শিক্ষার পরিবর্তে সে সমস্ত মাদ্রাসায় অধিক গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হচ্ছে-জামা-কাপড় কীভাবে পড়া দোরস্ত হবে, শৌচাগারে ঢুকতে ও বের হতে কী দোয়া পড়তে হবে, কোন দিকে মুখ করে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে হবে, রুটির কোন পিট আগে খাবে, কীভাবে আক্দ হবে, কী কী কারণে বিবি তালাক দেওয়া যাবে, বিবির সাথে সহবাসের নিয়ম কী এবং তৎপর তৈয়ম্মুম কীভাবে করতে হবে, নারীদের পর্দাপুশিদা কী ভাবে নিশ্চিদ্র করে তাদের অন্তপুরবাসিনী করা যাবে, গোঁপ দাড়ির দৈর্ঘ্য কতটুকু জায়েজ-আধুনিক জীবনের প্রেক্ষিতে তুচ্ছাতিতুচ্ছ এবং একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইত্যাকার বিষয়সমূহ-যার ভিত্তি হচ্ছে মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ, পরলৌকিক চিন্তা ও নিয়তিবাদ। সর্বাপেক্ষা মারাত্মক যে ক্ষতিটা তারা করছে, তাহলো-গ্রামের গরীব মানুষের কোমলমতি সন্তানদের এমনভাবে মগজ ধোলাই করা হচ্ছে, যার ফলে বিশ্বে ঘটমান সকল ঘটনার জন্য কোন কার্য-কারণ ব্যতিরেকে তারা নিয়তি এবং একমাত্র নিয়তিকেই দায়ী করছে, এর বাইরে কোন কিছুই তারা ভাবতে পারে না। তাই আজ আমাদের সমাজের যে সকল দুর্দশা, এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে পর্যন্ত তারা আল্লাহের গজব বলে মনে করে। অতএব, তাদের মতে কোন দুর্যোগ কিংবা কোন সংকটের প্রতিকার কিংবা প্রতিরোধ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, যতক্ষণ না সৃষ্টিকর্তা চাইবেন। তাই সকল প্রকার বালা-মুসিবত কিংবা সংকট সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য কেবল কায়মানোবাক্যে প্রার্থণা করা ছাড়া তাদের কাছে কোন বিকল্প থাকে না। এ সমস্ত মাদ্রাসা-শিক্ষিত লোকেরা কিছূ দিন পূর্বে ঘটে যাওয়া “সুনামী”র মত প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগকেও আল্লাহের গজব বলে প্রকাশ্যে ফতোয়া দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো-আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তাদেরই ভাবধারার কেহ কেহ সুনামীর ফলে সৃষ্ট সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গচূড়ায় ছিটকে পড়া জলরাশিতে আরবী হরফে ’আল্লাহু’ শব্দ আবিস্কার করে বিভিন্ন ইসলামী ওয়েব-সাইটে তা প্রচারও করেছেন এবং বাংলাদেশে সর্বসাম্প্রতিক কালের শ্রেষ্ঠ কৌতুক- আদালতে দণ্ডিত কুখ্যাত যুদ্দাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মুখের ছবি চাঁদে দেখতে পাওয়ার সংবাদ সারাদেশে তারাই রটায়।
সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-আদর্শ ও দর্শনের অভাবে একইভাবে কলুষিত আজ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আজ জনগণের মুক্তির কোন দর্শন বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে নেই; যার অভাবে অবাধ লুঠপাট-দুর্নীতি আজ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। তাই যে কোন ভাবে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকা আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক আদর্শ। পেশী শক্তি ও কালটাকার জোরে নেতৃত্ব ঠিকিয়ে রাখা আজ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। জনগণের কল্যাণে রাজনীতি-জনগণের জন্য রাজনীতির বিপরীতে ব্যক্তিগত মোক্ষলাভ, স্বজনপ্রীতি-দলপ্রীতি-গোষ্ঠীপ্রীতি আজ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতার বিপরীতে পরিবারতন্ত্র-গোষ্ঠীতন্ত্র আজ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। মূল নেতা-নেত্রীদের তোষামোদি, মোসাহেবী আজ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনীতিবিদরা সমাজের মেধাবী, ত্যাগী ও প্রাগ্রসর প্রজন্ম-এসব আজ কল্প কথায় পরিণত হয়ে গেছে। জনগণের জন্য ত্যাগ-দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম-এসবের বিপরীতে পেশীশক্তি, কালটাকা ইত্যাদি হয়ে গেছে রাজনীতিতে টিকে থাকার, সাংসদ মন্ত্রী হওয়ার অব্যর্থ মহৌষধ। রাজনৈতিক সংস্কৃতির এহেন পঁচা ডোবায় জন্ম নিয়েছে মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদ ধ্যান-ধারণার অসংখ্য শৈবাল-ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, নিয়তিবাদ, মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ। হীন রাজনৈতিক স্বার্থে, ভোটের রাজনীতির কারণে, আমাদের রাজনীতিবিদরা-বিশেষভাবে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতারা-যারা ক্ষমতায় আছেন, ক্ষমতায় ছিলেন এবং ক্ষমতায় যাবেন, সে পশ্চাদপদ ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধের শিকড়ে জল সিঞ্চন করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। ব্যক্তিজীবনে তাদের সততা প্রশ্নবোধক হলেও এবং পারিবারিক জীবনে অত্যন্ত আধুনিক ও বিলাসবহুল জীবন যাপন করলেও, তাদের অনেকে রাজনৈতিক খেলার মাঠে-যেমন খুশী সাজো-এর মত ধর্মের আলখাল্লা পরে, মাথায় টুপি, মুখে দাঁড়ি, হাতে তসবিহ নিয়ে-এক এক জন পুরাদস্তুর মোল্লা-পুরোহিত-বুজর্গ সেজে বসে আছেন। ফি বছর হজ্জ করা, সভা-সমাবেশে ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বলা, তাদের অনেকেরই স্বভাব-ধর্ম হয়ে গেছে। আমরা জানি, একটি সমাজের শাসক শ্রেণীর মূল্যবোধই সমাজে প্রধান মূল্যবোধ হিসাবে বিরাজ করে। (The ruling ideas of a society are the ideas of ruling class)। তার সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়ে সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উপর। পরিণামে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার লতাগুল্ম-আগাছা জন্ম ও বিকাশের জন্য আমাদের সমাজের মানসভূমি অত্যন্ত উর্বর হয়ে আছে। সে সুযোগে সমাজের তৃণমূলের আমজনগণকে নিয়তিবাদ ও মৌলবাদে দীক্ষাদান সহজ হয়ে গেছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে। নির্মম ফলশ্রুতিতে, মৌলবাদের বিকাশ ও জঙ্গীবাদের ঊত্থান। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, সর্বোপরি সীমাহীন দারিদ্রের কারণে গ্রামের মানুষ এখনো তাবিজ-মাদুলী পানিপড়া দিয়ে রোগ মুক্তির স্বপ্ন দেখে। নিজেদের সকল দুর্ভোগের জন্য নিজেদের বদ-নসীব বা নিয়তিকে দায়ী বলেই মেনে নিচ্ছে। যার ফলে ভাগ্য পরিবর্তনের কোন আন্দোলনে তারা শরীক হয় না। ভাগ্য পরিবর্তনের আন্দোলনে শরীক হতে হলে তাকে অবশ্যই যুক্তিবাদী হতে হবে। কেবল যুক্তিবাদী মানুষই নিজেদেরকে পরিচালিত করতে পারে যে কোন বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে। অতএব দেখা যাচ্ছে, আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা আমাদের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক পশ্চাদৎপদতা কাটিয়ে ওঠার পথে দুর্লঙ্ঘ্য প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাতে করে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও পশ্চাদৎপদতার যে সংস্কৃতি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, তা থেকে জাতিকে মুক্ত না করলে আমাদের সার্বিক মুক্তি সুদূর পরাহত। কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে মানুষের সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। কারণ বিষয়টা আচরণগত নয়, মনোগত। আইন করে সমাজের মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, মানুষের ভাবনা, চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তা করতে গেলে বরং বুমেরাং হবার সম্ভাবনাই থাকে বেশী।
কী হবে সে কাঙ্ক্ষিত সাংস্কৃতিক-আন্দোলনের রূপরেখা (রণনীতি ও রণকৌশল):
উপরের আলোচনা থেকে আমরা উপলব্ধি করেছি যে, আমাদের সকল পশ্চাৎপদতার মূলে রয়েছে যেমন আমাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতা, তেমনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক পশ্চাদৎপদতা। এ দুটিই পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। সামগ্রিকভাবে এ আমাদের সাংস্কৃতিক সংকট। আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলো হল সংস্কৃতির বস্তুগত দিক, যার সমাধান করতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। কিন্তু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংকট হল আমাদের মনস্তাত্ত্বিক সংকট-আমাদের চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধের সংকট। এ সংকট থেকে উত্তরণে আমাদের প্রয়োজন চিন্তার মুক্তি। চিন্তার মুক্তির অপরিহার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে যুক্তিবাদ। কোন রাজনৈতিক আন্দোলন দিয়ে একটি দরিদ্র, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠীকে যুক্তিবাদী করা যাবে না-তার চিন্তার বন্দীত্ব ও বুদ্ধির আড়ষ্টতা ঘুচানো যাবে না। তার জন্য আমাদের লড়াই বা আন্দোলনের ক্ষেত্র হতে হবে আমাদের মানসভূমি এবং সেখানে লড়াই বা আন্দোলনের কৌশল ও হাতিয়ারও হবে ভিন্ন-মনস্তাত্ত্বিক। বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তি, অপদর্শনের বিরুদ্ধে সঠিক দর্শন, কুসংস্কার, বুজরুকি ও নিয়তিবাদের বিরুদ্ধে কার্য-কারণ অনুসন্ধান হবে এ মনস্তাত্ত্বিক লড়াই এর কৌশল ও হাতিয়ার। আমাদের বিদ্যমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পরিবেশের বেনিফিশিয়ারী বর্তমান শাসকগোষ্ঠীতো বটেই, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ঘাপটি মেরে থাকা বেনিয়ার দল, বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি যাদের সুযোগ করে দিচ্ছে বারংবার ক্ষমতায় যাওয়ার, শোষণ করার, আমজনগণকে ধোঁকা দিয়ে তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করার, তারাও বিদ্যমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে। ভেবে দেখতে হবে, রাজনীতিতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ বলে যে মোটা দাগের বিভাজন রেখা টেনেছি , সে বিভাজনে আমরা যাদেরকে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি মনে করি, তারাও কী উপরোল্লিখিত সামাজিক সাংস্কৃতিক রোগের উপসর্গগুলো থেকে মুক্ত? অবশ্যই না। একাত্তুরে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল বা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের অনেকেই আজ কেবল বিদ্যমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিতে আক্রান্ত নয় বরং তারাও নিছক রাজনৈতিক ফায়দার আশায় আমজনগণের এ পশ্চাৎপদ মূল্যবোধ লালন এবং তাতে জল সিঞ্চন করছেন। আমাদের যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা, তাতে আমরা অনেকেই শুধু আক্রান্ত নই, বরং তাকে আমরা লালন করছি জ্ঞাতসারে-অজ্ঞাতসারে, হীন রাজনৈতিক স্বার্থে-ভোটের রাজনীতির কারণে। রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়াও আমাদের অনেকের এ অবস্থানের আরেকটি কারণ হল, অজ্ঞতাপ্রসূত চিন্তার অস্বচ্ছতা ও বুদ্ধির আড়ষ্টতা। অতএব, এ সাংস্কৃতিক আন্দোলনটা শুরু হতে পারে প্রজন্ম চত্ত্বরে সমবেত আমাদের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে-দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কোন উপসর্গ যাদের এখনো আক্রান্ত করতে পারে নি-যার আশু লক্ষ্য হতে পারে নিন্মরূপ-
চিন্তার মুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ সৃষ্টি, সকল প্রকার কুসংস্কার-নিয়তিবাদ-অদৃষ্টবাদ-ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতির বিপরীতে মুক্ত-চিন্তা ও যুক্তিবাদের বিকাশ। সকল প্রকার চিন্তার মুক্তি ঘটাতে হলে বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় এ পরিবর্তন আনতে হলে অপরিহার্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। বেসরকারীভাবে আমাদের সচেতন ও প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন বেসরকারী ক্লাব, সংগঠন, সমিতি, পাঠচক্র গড়ে তুলে আমজনগণকে বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে পারেন-বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক চিন্তা চেতনা ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে। এ প্রচার-প্রচারণা চালানো যায় সঙ্গীতের মাধ্যমে-গ্রামে গ্রামে জনপ্রিয় লোক সঙ্গীত-কবিগান, পথনাটক-প্রহসন এর মাধ্যমে, আলোচনা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, মতবিনিময়, গ্রামের উঠতি তরুণ-তরুণীদের নিয়ে বিষয় ভিত্তিক পাঠচক্র আয়োজন করে। সে সকল পাঠচক্রে মানুষদের-বিশেষভাবে গ্রামের মানুষদের সচেতন করা যেতে পারে কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে -সাধু-সন্ত, ভিক্ষু-মোহন্ত, তান্ত্রিক-হুজুরদের তাবিজ-মাদুলী, পানি-পড়া, ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদি অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার অসারতা তুলে ধরে। তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার বুজরুকি ফাঁস করে দিয়ে। আলোচনা-মতবিনিময়-পাঠচক্রের মাধ্যমে আমাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাদপদতার মূল কারণ জনগণের সামনে তুলে ধরা, যাতে তারা বুঝতে পারে অদৃষ্ট বা নিয়তি নয়, বিদ্যমান শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা ও শাসকগোষ্ঠীর নিরন্তর শোষণ ও ব্যর্থতাই আমাদের দারিদ্রের মূল কারণ। এ পশ্চাদপদতা থেকে কোন অলৌকিক ক্ষমতাবলে মুক্তি পাওয়া যাবে না, মুক্তি পেতে হলে আমাদের বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হবে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধেও মানুষকে সচেতন করতে হবে-এ আধুনিক যুগে তার অসারতা ও অযৌক্তিকতা তুলে ধরে। কারন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তথা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা আজ আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করছে এবং আজকের যে জঙ্গীবাদের উত্থান, তাও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির করুণ পরিণতি। প্রজন্ম চত্ত্বরের এ অভূতপূর্ব লাগাতার, অহিংস এবং কর্মসূচীর নান্দনিক উদ্ভাবনের বৈশিষ্ঠ্যে মণ্ডিত আন্দোলনের তরুণ নায়কেরা, যাদের ধমনীতে শহীদের শোণিতধারা প্রবাহিত, তাদের পক্ষেই সম্ভব একাত্তুরের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একটি সাংস্কৃতিক যুদ্ধের সূচনা করা। এ আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে তারা আধুনিক ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে পারে, যে বিষয়ে ইতোমধ্যেই তারা দক্ষতা অর্জন করেছেন। তথ্যপ্রবাহ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে আধুনিক ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার ভূমিকা সর্বগ্রাসী। তাই একটি বিজ্ঞান-ভিত্তিক অনুষ্ঠানের টিভি চ্যানেল এক্ষেত্রে সুদুরপ্রসারী ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
এভাবে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংকটের নিরসন ছাড়া কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল, আমাদের বিদ্যমান পশ্চাৎপদতার এ অচলায়তন ভাঙ্গতে পারবে না। জাতি কেবল উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে নিক্ষিপ্ত হবে। হয়তো এক সময়ে আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখব, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি একটি মধ্যযুগীয় ধর্মীয় গোষ্ঠীর করায়ত্ব হয়ে গেছে। সে আশঙ্কা রুখতে প্রয়োজন একটি শিকড়-নাড়া সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং কালবিলম্ব না করেই। এর কোন বিকল্প নেই।
সমাজ প্রগতির প্রশ্নে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রাসঙ্গিকতা:
একাত্তুরে যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর নানা কারণে আমরা তাদের বিচারের মুখোমুখী করতে পারি নি। অথচ তাদের অপরাধ ছিল ভয়াবহ ধরণের। বিষয়টি কেবল আইনগত ও নীতিগত নয়, বরং আদর্শগতও । কারণ এ সকল যুদ্ধাপরাধীগণ যে দর্শনে বিশ্বাস করত এবং এখনো করে, তাহল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। কেবল ঐ সকল চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে তাদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাতে পারলেই তাদের যে অপবিশ্বাস তা সমাজ থেকে উবে যাবে না। তার জন্য অপরিহার্য একটি আপোষহীন মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, যা সম্ভব হবে একটি নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক লড়াই এর মাধ্যমে। তার পরও একাত্তুরে যারা এ অপবিশ্বাস ধারণ করে মানবতাবিরোধী যাবতীয় অপরাধ সংগঠিত করেছে, তাদের বিচার না করলে ভবিষ্যতে আমাদের সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার কোন নৈতিক ভিত্তি থাকবে না। সে কারণে স্বাধীনতার পর যত সময়ই অতিক্রান্ত হউক না কেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রাসঙ্গিকতা এতটুকু কমেনি। বরং সমাজ বিকাশের সূত্রানুসারে যথাসময়ে সে বিচার করতে না পারার ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন না করে কখনো এগুনো যাবে না। নির্মম সত্য হল- ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।