দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দয়ায় পাওয়া নয়
ছাত্র অবস্থায় আপনার কবিতা পড়ে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। সদ্য যুদ্ধ ফেরৎ কবি, আপনি ১৯৭১ এর বারুদের সৌরভ ছড়িয়ে লিখেছিলেন:

আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছো বিপ্লবের সামনে
আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছো ইতিহাসের সামনে
হাতে দিয়েছো স্টেনগান
আঙ্গুল ভর্তি ট্রিগার
এখন আমার আর ফেরার কোনো পথ নেই…

নব্বইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের কালে সামরিক জান্তা এরশাদের পুলিশ বাহিনী ছাত্র মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়েছিলো। ঘটনাস্থলেই ট্রাক চাপায় মারা গিয়েছিলেন ছাত্রকর্মী সেলিম-দেলোয়ার। আমাদের ইস্কুলের দেওয়ালে আন্দোলনকারীরা বেনামে চিকা মেরেছিলো: ট্রাক চাপা দিয়েছো, আন্দোলন থামেনি, ট্যাংক চাপা দিলেও আন্দোলন থামবে না। আর আপনি লিখেছিলেন, ‘লেফটেনেন্ট জেনারেলের ট্রাক!’

কবিতার বইটি সেই সময় বইমেলায় খুব চলেছিলো। পরে সেটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। আপনাকে জেলও খাটতে হয়। ১৯৮৬-৮৭ তে আমারদের সাংস্কৃতিক সম্মেলনে টিএসসি’র নীচতলার হলরুমটি ছিলো কানায় কানায় পূর্ণ। প্রয়াত লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন এর সভাপতি। তিনিই সম্মেলনের পোস্টারের মূল শ্লোগান লিখেছিলেন, এখনো মনে আছে। সেখানে লেখা ছিলো, শিল্প-সাহিত্য বিপ্লবকে দিক ভাষা, বিপ্লব শিল্প-সাহিত্যকে দেবে মুক্তি। সম্মেলনে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম আপনাকে। বক্তৃতার বদলে আপনি নিজেই হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে ছেঁড়া গলায় গান ধরেছিলেন, যুদ্ধ ফেরৎ স্বরচিত কবিতাকে সুর দিয়ে গানে বলেছিলেন,

এই নষ্ট শহরে, নাম না জানা যে কোনো মাস্তান…

বিনির্মাণকালে
পরে এইসব গান, কথামালা, আবৃত্তি অডিও ক্যাসেট বন্দীও হয়েছিলো, সেটিও আমাদের সংগ্রহে ছিলো দীর্ঘদিন। আর এই গানটিই দেখুন, কিছুদিন আগে ‘দলছুট’ সঞ্জিব চৌধুরী গেয়ে কি সুনামই কুড়িয়েছেন! নতুন করে গাওয়া গানে সবই আছে, কিন্তু আমাদের কিশোর বেলায় আপনার কণ্ঠে যে শোনা গানে যে বিপ্লব স্পৃহা খুঁজে পেয়েছিলাম, তার ঘাটতি তাতে ধরা পড়ে মারাত্নক। দ্রুত আমাদের ছাত্রত্ব ফুরাতে থাকে, আমরা বড়ো হতে থাকি নানান পাঠ-পর্যবেক্ষণে, এমনকি আপনার লেখার চিন্তনেও। সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজে’ সে সময় নিয়মিত আপনার কলাম পাঠ ও এ নিয়ে বিতর্ক জমিয়ে তোলা আমাদের বৈকালিক অভ্যাসে পরিনত হতে থাকে। ততদিনে আপনি বিদেশী টাকা ও পরামর্শে খুলেছেন, উন্নয়ন বিষয়ক নীরিক্ষা ও গবেষণা — উবিনীগ। ‘চিন্তা’ নামে আপনার সম্পাদিত অনিয়মত পত্রিকাটিও আমাদের আড্ডায় প্রাণ পায়। মনে আছে, দিনাজপুরে ইয়াসমিন নামে কিশোরীকে পুলিশের গণধর্ষন করে মেরে ফেললে সারা দিনাজপুরে অভূতপূর্ব জনবিক্ষোভ ঘটে। সারাদেশে এর বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। ‘চিন্তা’ সে সময় খুব সাহসের সঙ্গেই ইয়াসমিন সংখ্যা প্রকাশ করেছিলো। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’, ‘বিচিন্তা’ বা ‘খবরের কাগজ’ এ নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করতে সাহস পায়নি। এনজিও ঘেঁষা বলে আমাদের শ্রদ্ধা অনেকটাই টলে গেলেও আমরা তখনো আপনার মেধাবী লেখার ভক্তই ছিলাম।

মাঝে আপনি অগ্রসর লেখক আহমদ ছফার সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ছফাকে সেই প্রথম ও শেষবারের মতো ক্ষিপ্ত ও অশালীন ভাষায় আপনাকে পাল্টা আক্রমণ করে কলম ধরতে দেখি। আপনি নিয়মিত কলামে বলেছিলেন, এনজিওগুলো নাকি এদেশে সমাজ বিনির্মান করছে, যা রাষ্ট্র বিপ্লবকে এগিয়ে নিচ্ছে! আপনার এই নয়া তত্ত্বের বিরুদ্ধে ছফা খুব রূঢ় ভাষায় যা লিখলেন, ভদ্র করে বললে, তা দাঁড়ায় অনেকটা এরকম, গনিকার পুত্র হে, আপনি নিজে এনজিও ব্যবসা করছেন, করুন না, রাষ্ট্র বিপ্লবের অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন কেনো?

এ নিয়ে সেই সময় খুব হইচই হয়। আমরা আপনার সর্ম্পকে সেই প্রথম সতর্ক বার্তা পাই। ততদিনে আমরা প্রায় সকলেই অনেকটা কলম ঘষে সাংবাদিকতার কষ্টকর পেশায় নাম লিখিয়েছি। আমাদের কেউ কেউ ছফাকে সমর্থন করে সংবাদপত্রে পাঠ প্রতিক্রয়া লিখে থাকবে, আমরা এ-ও মনে করতে পারি।

পরে আপনি মেতে ওঠেন লালন-চিন্তনে। কবি, আপনি কবিতা উৎসবে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করলেন নতুন কথা: নবীর যুগ শেষ, এখন কবির যুগ শুরু। …আমরা নড়েচড়ে বসেছি, আপনার কথা, কবিতা ও লেখনীতে আমাদের চিন্তার যাচাই-বাছাই বেড়েছে, মুগ্ধতা আর নয়, তার মেয়াদ ফুরিয়েছিলো রাষ্ট্র বিপ্লবের সঙ্গা নির্ধারণের কালেই । এমনকি আপনার নয়া কৃষি আন্দোলন নামক জৈব কৃষি ব্যবস্থার ‘প্রবর্তন’ বা লালন সাঁই কেন্দ্রীক ‘নব প্রাণ’ আমাদের মনে দাগ কাটেনি। তখনও আমরা আপনাকে ঢেঁড়া চিহ্নের নীচেই রেখেছি, একেবারে বাতিল করিনি।

ব্রুটাস! তুমিও?
সবশেষ ২০০৫ সালের দিকে লাদেন-তালেবান উত্থানের কালে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট ঘেঁসে মোল্লার বড় বড় সমাবেশ করতে থাকে। সরকারি আস্কারায় প্রকাশ্যে ম্লোগান ওঠে: আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান! পাঁচ টাকায় লাদেনের একে-৪৭ সহ নূরানী চেহারার পোস্টার বিকায় বিস্তর। আপনি প্রেসক্লবের সেমিনারে সে সময় বয়ান করে বলেছিলেন, তালেবানরা সকলেই নাকি মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে আপনারা যে কারণে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন, তালেবানরা নাকি একই কারণে মুক্তিযুদ্ধ করছে। …

এ নিয়ে নানান মহলে আপনাকে তুলোধুনো করা হতে থাকে। আমরা তালাশ করে জানতে পাই, বিএনপি-জামাতী ঘুনপোকা বাসা বেঁধেছে আপনার করোটিতে। তারাই আপনাকে তখন চালিত করছে, তারাই আপনার মগজ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, ইসলামী বিপ্লবের মুখপত্র ইনকিলাবে কলাম লেখাচ্ছে। তালেবান সমর্থিত সভা-সেমিনারে কবিবর, আপনার ডাক পড়ছে নিয়মিত।… ইসলামী ব্যাংকের টাকায় করা দৈনিক ‘নয়া দিগন্তে’ কলামিস্ট হিসেবে আপনার কদর বাড়ে।

আমরা তরুণ সাংবাদিকরা গোপন দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে তালেবানী তত্ত্বের ফেরিওয়ালা কবি, আপনার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করি, ১৯৭১ এর রক্তের দায় থেকেই। আমরা জেদ করে বসি, আপনাকে প্রকাশ্যে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে, মাফ চাইতে হবে।…ডান, বাম, মধ্যপন্থী তাবৎ বাঘা সাংবাদিকরা আমাদের সমর্থন জানিয়ে যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেয়। …আমরা মনস্চক্ষে দেখতে পাই, ‘৭১ এর স্টেনগান নয়, লাদেনের একে-৪৭ তাক করে আপনি কুৎসিত দেঁতো হাসি হাসছেন। বেগুনি রঙের শয়তানি আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে আপনার চশমার কাঁচ ভেদ করে।…

না হে সাবেক কবি, ভুল মুক্তিযোদ্ধা, আপনি বক্তব্য ফিরিয়ে নেননি, মাফও চাননি। পাল্টা বিবৃতি দিয়ে পুরো ঘটনাই আপনি অস্বীকার করলেন। ধোঁয়াশা তৈরি করে দাবি করলেন, সংবাদপত্র নাকি আপনার বক্তব্য বিকৃত করে প্রকাশ করেছে। আদৌ আপনি ওই সেমিনারে তেমন কোনো বক্তব্যই দেননি!

ইনকিলাব-নয়া দিগন্তের কলাম চাপা পড়তে থাকে আমাদের সকলের সম্মিলিত ঘৃণার স্তম্ভের নীচে। কবিরাজ (অব.) রাইসু এক্সপ্রেসের ভক্তিবাদের সুতোয় বিডিনিউজের মতামত বিভাগে আপনি পুচ্ছ নেড়ে আবার প্রগতির ভেক ধরেন। দৈনিক আমার দেশ নামক নিউজপ্রিন্ট ও অক্ষরের অপচয় সরকার বন্ধ করতে চাইলে আপনি মতামত জানান এভাবে, এটি সরকারের ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ, বাক স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ — ইত্যাদি। আমাদের অনেকের কাছেও সে সময় এটিকে আওয়ামী বাড়িবাড়ি বলে মনে হয়। তবে আমরা এই তালেবানী দৈনিক ও আপনার ভাষ্য আদৌ আমলে নেই না; একে একরকম উপেক্ষাই করি। …

তোমারে বধিবে যে…
গণদাবিতে শাহবাগের মোহনায় গণজাগরণ-গণবিস্ফোরণে নতুন করে লেখা হতে থাকে অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আমরা প্রজন্ম ‘৭১ ব্লগার, ছাত্র, সাংবাদিক, শিক্ষক, জনতা এক-দুজন করে জড়ো হতে হতে জনসমূদ্রে পরিনত হই। আমাদের আহার, ঘুম, বিশ্রামের সময় থাকে না…বউ-বাচ্চা, বন্ধু-বান্ধব, বৃদ্ধ বাবা-মা’সহ আমরা সদলবলে জড়ো হতে থাকি। তখন ও এখনকার মুক্তিযোদ্ধারা ওঙ্কার দিয়ে বলে: বিচার চাই! বিচার চাই!

সারাদেশে, জেলায়, জেলায়, উপজেলায়, থানা শহরে, এবার বাংলায়, ওপার বাংলায়, পাহাড় ও সমতলে, দিকে দিকে, দশদিগন্তে জ্বলে ওঠে সব প্রাণ, ৪২ বছরের ঋণের শোধ চাই! সব হিস্যার অবসান চাই! লাল-সবুজ বাংলায় হায়নার পদচারণা আর নয়! …

শোন মৌলবাদের নাতি
তুমি যে ধর্মেরই হও,
আমি নিরপেক্ষতাবাদী
তুমি আমার বন্ধু নও।

[কবির সুমন]

ইতিহাসের অনিবার্য মিমাংসারকালে বাংলাদেশ যখন এই গুঢ় প্রশ্নের মুখোমুখি, দেশ মৌলবাদের লেজে মধ্যযুগে ফিরে যাবে, না প্রগতির পথে মুক্তির আলোয় হাঁটবে, তখন শেষ মরণ কামড় বসায় জামাত-শিবির। গলা কেটে ব্লগার খুন. জাতীয় মসজিদে হামলা, সাংবাদিকদের পিটিয়ে নাস্তানাবুদ, শহীদ মিনারে আগুন, পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, তাণ্ডবের পর তাণ্ডব। …

সবশেষ যুদ্ধাপরাধী বাঁচাতে জামাতি হরতালে সহিংসতায় পুলিশসহ নিহত হন প্রায় ৪০ জন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একে “১৯৭১ এর গণহত্যার সামিল” বলে আমাদের “গণহত্যা”র সঙ্গা শিক্ষা দেন। আমরা মেকাপ বিহীন ম্যাডামের সংবাদ সম্মেলনে যেনো বিএনপি’র জামাতে অবলুপ্তির ঘোষণাই শুনি। ম্যাডাম জিয়ার বয়ানে যেনো সেদিন গোলাম আজমই ১৯৭১ এর বর্বোরচিত “গণহত্যা”কে উপহাস করে দম্ভের সঙ্গে বলেন, “একাত্তরে আমরা ভুল করিনি!”

আর আমাদের আলোচ্য ফসিলাইজড কবি, এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধেরকালে আপনিও কি না খোলস ছেড়ে, মুখোশ নামিয়ে, ওই ট্রাশ দৈনিকেই কলাম লিখলেন একই সুরে, দাঁড়ালেন গণজাগরণের বিপক্ষে:

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে পুলিশ যেভাবে মানুষ হত্যা করেছে, তাকে ‘নির্বিচার গণহত্যা’ ছাড়া মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের দিক থেকে আর কিছুই বলা যায় না। বিক্ষোভ ও মিছিল দেখলেই গুলি করার নির্দেশ পালন করছে পুলিশ। মনে হচ্ছে বাংলাদেশে ‘হত্যার উত্সব’ চলছে। কাদের মোল্লার রায়ে কেন তাকে ফাঁসি দেয়া হলো না, এ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারির ছয় তারিখ থেকে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছে। দাবি করছে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার নয়; যেভাবেই হোক ফাঁসি দিতে হবে। ফাঁসির রায় ছাড়া শাহবাগ ঘরে ফিরবে না। আদালতের ওপর এ অন্যায় চাপ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এটা ঘটছে প্রকাশ্যে। পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় ক্ষমতার চাপ।

[লিংক]

বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
রাজনীতিকের ধমনী শিরায়
সুবিধাবাদের পাপ।
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ…

[রুদ্র মুহম্মাদ শহীদুল্লাহ]

এর চেয়ে অধিক বাক্যে আপনাকে ধীক্কার দিতে আর রুচি হয় না, হে আমাদের বালক বেলার স্বপ্নের কবি, ছিঃ!!