আমার সোনার শেকল চাই
মীজান রহমান

অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম আমি পর্দার দিকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একটি আঠারো বছরের ছেলে, সুস্থসবল, সুপুরুষ চেহারার যুবক, ঘটনাক্রমে একটা স্কুলের ক্লাসরুমে কিছু সমবয়সী ছেলেমেয়ের সঙ্গে বসা। ওরা সবাই কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত। কেউ টেক্সট মেসেজ পাঠাচ্ছে কাউকে, কেউ কোনও বই নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছে, কেউবা ব্যস্ত কারুর সঙ্গে কথা বলতে সেলফোনে। ওই ছেলেটিই কেবল হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে সব—-যেন কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। ঢুকবার কথাও নয়। তার কম্পিউটার নেই, সেলফোন নেই, টেক্সটিং কাকে বলে সে জানেনা। বড় কথা সে লেখাপড়া শেখেনি। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কম্পিউটারের পর্দায় কি দেখছে সে বুঝতে পারছে না—-ইংরেজি অক্ষরগুলো তার পরিচিত নয়। কেবল সে নয়, তার পরিবারের কেউ লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দল বেঁধে মুভিতে যাওয়ার সুযোগ পায়নি, রেস্টুরেন্টে গিয়ে কেন্টাকি চিকেন অর্ডার দেবার সুযোগ পায়নি, বা পায়নি বোতল খুলে একচুমুক বিয়ার খেয়ে নিতে আর সব ছেলেদের মত।

অনুমান করতে পারেন কোন্ দেশটির কথা বলছি?

তারপর দেখলাম একটা বড়সড় মাঠ। সেখানে অনেকগুলো বড় বড় গাছ—–ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশ। সেই ছায়ার নিচে বসে বেশ ক’টি পরিবার বৈকালিক আরামবিহারে নিমগ্ন। কতগুলো বাচ্চা ছেলে ছাড়া বয়স্ক পুরুষ একটিও নেই ধারেকাছে, মহিলারাই কেবল। এবং তাদের সবার পরণে প্রায় একই পোশাক। গোড়ালি-ছোঁয়া লম্বা কোর্তা, গলা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আদ্যোপান্ত আবৃত। লম্বা হাতার জামা। মাথায় একই রঙ্গের সুতির টুপি—–দেখে মনে হবে হাসপাতালের কিচেনে যারা সারাদিন রান্নাবান্না করে কাটায় তাদের মত। বড়জোর বড়লোকের বাড়ির ন্যানীদের মত। তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই কোলে একটা করে ছোট বাচ্চা। ঠিক যেন মুভিতে দেখা সপ্তদশ শতাব্দীর দৃশ্য কোনও। ‘গন উইথ দ্য উইণ্ড’ ছবিতে দেখেছিলাম। মহিলাগুলোকে বেশ হাসিখুশিই মনে হল। যেন কোনও চিন্তাভাবনা নেই সংসারে। খিল খিল করে হাসছেন ক্ষণে ক্ষণে। রংতামাসা করছেন একে অন্যের সঙ্গে। অথচ ওদের সম্পর্কটি রংতামাসা করার মত নয়—-সাধারণ বিচারে। একেকটি গাছের নিচে বসা একেকটি পরিবারের সবগুলো মহিলার স্বামী কিন্তু একজনই—-অর্থাৎ এরা পরস্পরের সতীন, কারু এক সতীন, কারোবা তিনচারজন। অথচ দেখে মনে হবে এতে কোন ক্ষেদ নেই তাদের। বরং এটিই যেন স্বাভাবিক নিয়ম—-এরকমই হওয়া উচিত! স্বয়ং সৃষ্টিকর্তারই বিধান সেটা। এই সমাজে বহুবিবাহ শুধু প্রচলিত প্রথাই নয়, এটা তাদের ধর্মবিশ্বাসেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। এবং এতে বয়সের তফাৎ কোনও বড়রকমের বাধা সৃষ্টি করে না। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর ভ্রাতুষ্পুত্রী বা ছোট বোনও অনায়াসে তার সতীনে পরিণত হতে পারে—এতে স্ত্রী বা তার বয়োকনিষ্ঠ আত্মীয়াটির কোনরকম আপত্তির অবকাশ থাকবে না, এবং সচরাচর থাকেও না। এমনই সুন্দর সৌহার্দ্যপূর্ণ জনগোষ্ঠী এটি। এই সমাজে প্রত্যেকের দৈনন্দিন জীবনের কর্তব্য সব পূর্বনির্ধারিত—–ছেলেরা সূর্য ওঠার আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্ষেতখামারে কায়িক পরিশ্রম করবে, এবং তার জন্যে নামমাত্র ভাতা পেলে পেতেও পারে, নতুবা নয়। আর মেয়েদের কাজ ঘরে,—- রান্নাবান্না, ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা, কাপড়চোপর ধোয়ামাজা করা, ঘরদুয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, তারপর স্বামী কাজ থেকে ফিরে এলে তার ফুটফরমাশ করা, এবং সবশেষে তার শয্যাসঙ্গী হওয়া। এগুলো সব ছককাটা। কাটছাট, সাফসুফাই। নির্ঝঞ্ঝাট। পরম শান্তিময় একটি সমাজ, কি বলেন?
বলুন তো দেখি জায়গাটা কোথায়।

এদের গল্প আরো শুনতে চান? এরা বাইরের জগতের কোনও আইনকানুন মানে না, বাইরের আচার আচরণ ধর্মকর্মের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই। এদের নিজস্ব এলাকাতে এরা পূর্ণমাত্রায় স্বাধীন, সার্বভৌম। সংসারে এমন কোনও শক্তি নেই যারা তাদের জীবনযাত্রার ওপর সামান্যতম প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, সে অধিকার তাদের আইনের আওতাতেই নাই। তাদের নিজস্ব আইন আদালত আছে, আছে নিজেদের পুলিশ বাহিনী, নিজেদের পৌরসভা, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা। অর্থাৎ পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি জনগোষ্ঠী। তাদের আদালতের প্রধান হাকিম, যার মুখের কথাই সেখানকার আইন ও ধর্ম, তিনি হলেন একটি পুরুষ (অবশ্যই পুরুষ) যাঁর বাণী কার্যত ঐশ্বরিক বিধান বলেই পরিগনিত হয় এখানে, সেই সর্বশক্তিমান ব্যক্তিটির অঙ্গুলিনির্দেশেই এদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি প্ল্যানপরিকল্পনা সংঘটিত হয়। এর অযথা হলে তৎক্ষাণাৎ দোষী ব্যক্তিটিকে সমাজচ্যুত করে তাকে বলতে গেলে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়, একটুকরা ময়লা কাগজের মত। সপরিবারে? উঁহু, পরিবার থাকবে যথাস্থানে। তার স্ত্রীকে দেওয়া হবে অন্য পুরুষের হাতে, ছেলেমেয়ে যাবে হয়ত ভিন্ন কোনও পরিবারে। এদের মোট জনসংখ্যা প্রায় চার হাজার। পুরো এলাকাটা শক্ত দেয়াল দিয়ে ঘেরা, এবং তার সীমানা পাহারা দেবার জন্যে চব্বিশঘন্টা বন্দুকধারী দারোয়ান মোতায়েন থাকে—–অনেকটা বার্লিন দেয়ালেরই মত। এবং সেরকমই ভয়াবহ। এরা ভিন্ন ভিন্ন কুটিরে বিভক্ত বটে, কিন্তু কার্যত একটিমাত্র বৃহৎ পরিবার। এবং সেই পরিবারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা একটিমাত্র পুরুষ, যাকে সবাই যমের মত ভয় পায়, যীশুর মত সম্মান করে, ঈশ্বরের চেয়েও বেশি ভক্তি করে। তিনি যদি মনে করেন কারো ঘরের বড়-হয়ে-ওঠা মেয়েটি বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে, তার বয়স যা’ই হোক, তেরো চোদ্দ পনেরো কিছু আসে যায় না, তাহলে তার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হয়ে যাবে। অনেকসময় তিনি নিজেই সেই পরিবারটিকে কন্যাদায়ের গুরুভার থেকে অব্যাহতি দিয়ে মেয়েটিকে তাঁর বিশাল অন্দরমহলের সদস্যপদ দান করেন (হয়ত তাঁর উদারচিত্ততার কারণেই)। মেয়ে যদি তেমন আকর্ষণীয় না হয়, বা তাঁর নিজের তেমন রুচি না হয়, তাহলে তিনিই নির্বাচন করে দেবেন মেয়ের বিয়ে হবে কোন্‌ ছেলের সাথে। এসব ব্যাপারে পিতামাতা বা পাত্রপাত্রীর অযথা হস্তক্ষেপ তিনি বরদাস্ত করেন না। এপাড়ার একটি পাতাও নড়ে না তাঁর অনুমতি ছাড়া। গাছের পাখিরাও বুঝি তাঁর অনুমতি নিয়েই কিচিরমিচির করে সারাদিন। এমনকি পুকুরের পানিও সম্ভবত ভয় পায় নড়াচড়া করতে তাঁর চোখের ইশারা ছাড়া। পুকুরের কথা উঠতে মনে পড়ে গেল একটা দৃশ্যের কথা। গোটা এলাকাটিতে একটাই জলাশয়—-যেখানে ছেলেমেয়েরা একসাথে গা ভেজায়, গোসল করে, ছোট বাচ্চারা হয়ত সাঁতারও কাটে ইচ্ছে হলে, মানে ‘প্রভু’র আপত্তি না থাকলে। এগুলো কোনও উল্লেখযোগ্য কিছু নয়, উল্লেখযোগ্য হল ওরা কি পোশাক পরে পানিতে নামে। পুরোপুরি আজানুলম্বিত পোশাক—-যাতে করে গায়ের একটুকরো মাংসও বাইরের লোকের চোখে না পড়ে। অর্থাৎ জলে-স্থলে সর্বত্র তাদের আদব কায়দা বজায় রাখতে হবে—-কড়া নিয়ম। এর ব্যতিক্রম হলে কোন দয়ামায়া দেখানো হবে না, সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন এমন সোনার দেশটি পৃথিবীর কোন অঞ্চলে। এশিয়ার কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চল? বা প্রশান্ত মহাসাগরের কোনও দূর দ্বীপান্তরের প্রাগৈতিহাসিক দুর্গমতায়? না, এটা নিশ্চয়ই আফ্রিকারই কোনও এক জায়গায়। বেশিদিনের কথা নয় যখন স্কুলের ভূগোলের পাঠ্যবইতে লেখা থাকত আফ্রিকা একটি অন্ধকার মহাদেশ। ‘ডার্ক কন্টিনেন্ট’। এধরণের কাল্ট তো সেখানেই থাকা স্বাভাবিক, তাই না?

না, তা নয়। আপনাদের কারুরই অনুমান ঠিক নয়। হিসেবে দারুণ ভুল করে ফেলেছেন। জায়গাটি আর কোথাও নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধিশীল জাতি বলে জোরগলায় দাবি করে যারা, সেই মহা শক্তিশালী, মহা পরাক্রান্ত দেশ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র।

জায়গাটির নাম কলরেডো সিটি, যদিও ষাট-সত্তর বছর আগে এর নাম ছিল শর্ট ক্রিক। এই নামবদলেরও একটা কেচ্ছা আছে। একটু পরে আসছি সে প্রসঙ্গে। এরিজোনা আর ইউটা, এ দুটি অংগরাজ্যের সীমানা ঘেঁষা এ-জায়গাটির আয়তন প্রায় ২৮ বর্গ কিলোমিটার। এর ধারেকাছে কোনও বড়সড় নগরবন্দর নেই, প্রায় ১৬০ মাইল ব্যাপী বিস্তৃত বিরান মরুভূমি, জনবসতি প্রায় ছিলনা বললেই চলে এককালে। সেখানেই বহুবিবাহবাদী এই আইনবহির্ভূত জনগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন হয় ১৯১৩ সালে, জ্যাকব লরিৎসেন নামক এক গো-ব্যবসায়ী দ্বারা। এই গোষ্ঠীটি মূলত ইউটা অঙ্গরাজ্যেরই বিখ্যাত মর্মন সম্প্রদায়ের একটি বিভক্ত শাখা। গোড়াতে মর্মন চার্চের প্রধান নেতা ব্রিঘাম ইয়াং ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা বহুবিবাহের ভিত্তিতেই মর্মন চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে। যার নামকরণ হয় Church of Jesus Christ of Latter-day Saints, সংক্ষেপে, LDS. ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় সরকার থেকে প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকে চার্চ নেতাদের ওপর বহুবিবাহপ্রথা রহিত করার জন্যে। চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত চার্চের সরকারি বিবৃতিতেই বহুবিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।

কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবার পাত্র ছিল না জন ডি লি নামক এক নরপিশাচ, যার বিরুদ্ধে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল পাশাপাশি দুটি অঙ্গরাজ্যে। একটি দুটি খুন নয়, মোট ১২০ জন নিরপরাধ পথযাত্রীর প্রাণহরণ করেছিল এই পাষাণ লোকটি শুধুমাত্র তারা ‘অবিশ্বাসী’, এই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে (অবিশ্বাসী আর ‘ইনফিডেল’ শব্দগুলো হালেও তো ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে, তাই না?)। প্রধানত আইনের চোখ এড়াবার জন্যেই জন লি সীমানা অতিক্রম করে এরিজোনার এই জনপ্রাণীহীন অঞ্চলটি বাছাই করে নেয় বসবাস স্থাপন করার বাসনায়। সঙ্গে তার দুই স্ত্রী। জীবিকা অর্জনের জন্যে সে গুদারা করে যাত্রী পারাপারের ব্যবসা শুরু করে দেয়। দুর্ভাগ্যবশত আইনের কবল থেকে বেশিদিন লুকিয়ে থাকা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। ১৮৭৭ সালে সে ধরা পড়ে পুলিশের হাতে এবং অনতিবিলম্বে তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়। মজার ব্যাপার যে সেই গুদারাঘাটটি এখনো ‘লি’র গুদারা নামেই পরিচিত।
যাই হোক, ১২০ টি নিরীহ পথিকের হত্যাকারী জন ডি লি প্রতিষ্ঠিত অঞ্চলটি শেষ পর্যন্ত LDS র এই দলভাঙ্গা গোষ্ঠীটির খুব পছন্দ হয়ে গেল। ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল তাদের নিজস্ব চার্চ। ভিন্ন নামে যদিও—-Fundamental Church of Jesus Christ of Latter-day Saints (FLDS).

বহুবিবাহের প্রশ্নে সারা দেশ একদিকে আর এই ক্ষুদ্র সম্প্রদায়টি তার উল্টোদিকে। শুধু যে দেশের আইনকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছিল তারা তাই নয়, জাতির বিবেককে, জাতির নৈতিক শক্তিকে, খর্ব করে দিচ্ছিল বাইরের পৃথিবীর কাছে। এরিজোনার গভর্ণর সিদ্ধান্ত নিলেন জাতির এই কলঙ্ককে সমূলে উৎপাটন করবেন যেমন করেই হোক। ১৯৫৩ সালে এক বিরাট পুলিশবাহিনী পাঠিয়ে দিলেন শর্ট ক্রিক এলাকাটিকে ঘেরাও করে চার্চের নেতাগুলোকে ধরে ধরে জেলে ঢোকানোর জন্যে। প্রাদেশিক সরকারের সশস্ত্র বাহিনীকে প্র্তিরোধ করার মত নিরাপত্তা শক্তি অবশ্যই ছিল না চার্চ নেতাদের। অতএব তাদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোন উপায় রইল না। সমস্যা দাঁড়িয়ে গেল বউবাচ্চাদের নিয়ে। বাড়ির পুরুষগুলো সব গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়াতে তাদের গোটা পরিবারগুলোই চোখের পলকে হয়ে গেল একেবারে নিরাশ্রয়, এতিম। ফলটা দাঁড়ালো এই যে পত্রপত্রিকায় যতটা ফলাও করে দেখানো হল দোষী পুরুষগুলোকে তার চেয়ে বেশি ফলাও করে দেখানো হল ওই অনাথ অসহায় শিশুগুলোকে। ওই পুরুষবিহীন পথে-বসা পরিবারগুলোকে। ফলে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি স্বভাবতই গভর্ণরের কাছ থেকে বিপরীত দিকে ঘুরে চলে গেল FLDS এর গৃহচ্যুত পরিবারগুলোর প্রতি। ভাগ্যের এই বিচিত্র বিবর্তন থেকে বেচারি গভর্ণর হাওয়ার্ড পাইল আর সেরে উঠতে পারেননি। শর্ট ক্রিকের ওই ঘটনা একাধারে ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বিজয় এবং সবচেয়ে বড় পরাজয়।

যাই হোক, এতসব হট্টগোলের মধ্যে চার্চ নেতারা ভাবলেন এলাকার নামটির খুব বদনাম হয়ে গেছে—-অতএব ইজ্জতরক্ষার খাতিরেই নাম বদলানো দরকার। বর্তমান নামটি সেই সিদ্ধান্তেরই ফলপ্রসূতে গৃহীত হয় ১৯৫৩ সালে।

FLDS এর বর্তমান কর্মকর্তা, যাকে একটু আগেই ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে ফেললাম আমি, তাঁর পোশাকি পদবি হলঃ President and Prophet, Seer and Revelator. অর্থাৎ তাঁর ওপরে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ নাই। তিনি নাকি দাবি করেন যে মহাপ্রভুর সঙ্গে তাঁর নিয়মিত আলাপ আলোচনা হয়। যেমন কোন অল্পবয়সী মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা উঠলে ঈশ্বর নিজে তাঁকে অনুমোদন দেন প্রায়সই (বেশ পরিচিত কেচ্ছা বলে মনে হচ্ছে কি?)। ওয়ারেন জেফসের বাবা ছিলেন রুলন জেফস। তাঁর স্ত্রীসংখ্যা ছিল ১৯ কি ২০। সন্তানসন্ততির সঠিক গণনা আমার কাছে নেই, তবে মেয়েসন্তানের সংখ্যা ৩১ জন, সেটা ইন্টারনেট থেকেই জানলাম। ওয়ারেন সাহেবের জন্ম ১৯৫৫ সালে, সুতরাং তাঁর বয়স এখন ৫৮তে দাঁড়ালো। বাপের সুযোগ্য পুত্র নিঃসন্দেহে। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম বয়ানই ছিল এইঃ খবরদার, আমার বাবার বিধবাদের ওপর কোন বাপের বেটা যেন দৃষ্টিপাত না করে। অর্থাৎ, উত্তরাধিকারসূত্রে ওঁরা তাঁরই একক সম্পত্তি। সে অনুসারে তাঁর সৎমাতাদের দুজন বাদে অন্য সবগুলোকেই তিনি বিয়ে করে ফেললেন। দড়ি খুলে বেরিয়ে পড়া দুটির মাঝে একজন পালিয়ে গেলেন সেই গোলামখানা থেকে, দ্বিতীয়জন পুলিশের দরজায় গিয়ে হাজির।

ওয়ারেন জেফসের মোট স্ত্রীসংখ্যার কোন হিসাব আছে কিনা তা’ও জানা নেই। তবে ২০১০ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বালবিবাহের অপরাধে, সেখবর সারা মহাদেশে কারুরই অজানা নয়। ঠিক কতজন অল্পবয়ষ্ক মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছেন সেটা কেউ হলপ করে বলতে পারবে না, তবে আদালতে বিচার এবং অপরাধ প্রমানিত হয়েছে দুটি বালিকাকে ঘরে তোলার জন্যে। প্রথমে বেশ কড়া শাস্তিই প্রদান করা হয়—-যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তারপর আপিলে সেটা কমিয়ে লঘুতর শাস্তি সাব্যস্ত হয়। যাই হোক, এতে করে কি তাঁর কোনও বড়রকমের ক্ষতি হয়েছে? না, হয়নি। তাঁর চেলাচামুণ্ডারা তাঁর অনুপস্থিতিতে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বহাল তবিয়তে। জেলের ভেতর থেকেই যেসব ‘বাণী’ প্রেরণ করেন তিনি তাঁর অনুগত সেবকরা তা’ই পরম ভক্তিভরে পালন করে। আগে যেমন কড়াকড়ি ছিল এখনো সেই একই কড়াকড়ি। বরং এখন আরো বেশি। জেলের বাইরে থাকাকালে রোজ রাতে একেকজন স্ত্রীর ঘরে একেকরাতে যাওয়ার সুযোগ ছিল তাঁর, জেলে যাওয়ার ফলে সেই সুখটা থেকে তিনি নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত। অতএব তাঁর মনে হল, সঙ্গত কারণেই, স্বয়ং ভগবান যে-জিনিসটা থেকে বঞ্চিত সেজিনিসটা তাঁর বান্দারা ভোগ করবে সে আবার কেমন কথা? ব্যস, সমন জারি হয়ে গেল কমুমিনিটিতে যে যৌনমিলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি তরুণ ছেলেমেয়েরা যেন ভুল করেও বিপরীত লিঙ্গের কারো প্রতি কামাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে। তাহলে গুরুতর শাস্তি দেওয়া হবে অপরাধীকে। তিনি জানতেন যে যৌনজীবন থেকে পুরুষগুলোকে দূরে থাকতে বলা বড় শক্ত জিনিস। তাই তিনি সমনের সাথে যোগ করে দিলেন এটুকু যে এই আদেশটি তাঁর নিজের নয়, স্বয়ং ঈশ্বরের কাছ থেকে স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত বাণী। শুধু তাই নয়। জেল থেকে তিনি আরো নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর জন্যে চার্চের খরচে ( অর্থাৎ অন্যদের শ্রমার্জিত পয়সায়) যেন একটা বিরাট বাড়ি তৈরি করা হয়, যাতে করে জেল থেকে বেরুবার পর তিনি সপরিবারে সেই বাড়িতেই উঠতে পারেন। ছবিতে দেখলাম সেই নির্মিত প্রাসাদের দৃশ্য। বাড়ি নয় রীতিমত অট্টালিকা—-রাজাবাদশাদের বাসযোগ্য প্রাসাদ।

এবার বুঝুন কোন্‌ কাতারের পয়গম্বর তিনি।

অথচ এসবের কোনও সহজ সমাধানও নেই। যত সদিচ্ছাই থাকুক সরকারের, এদেশের সংবিধান দ্বারাই তাদের হাত বাঁধা। সেই যে এক মন্ত্র আছে সংবিধানে—-কারও ধর্মচর্চার স্বাধীনতাতে হাত দেওয়া যাবে না, তাদের ওপর কোনও খাজনা বসানো যাবে না, তাদের বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না—-সেই জালে তো আটকে গেছে সব সরকারই। এই তথাকথিত ধর্মগুলোর কোন্‌টা ধর্ম আর কোন্‌টা অপধর্ম তার বিচার করবে কে? সে সাধ্যও তো নেই কারো—-না সরকার না কোনও নির্দলীয় সংস্থা না কোনও ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী। সবারই হাতে শেকল, কেবল ওয়ারেন জেফসদের মত অমানুষগুলো ছাড়া।

মর্মন সম্প্রদায় সম্বন্ধে একটা ভাসাভাসা জ্ঞান অনেকেরই আছে, মূলত গতবার যে আমেরিকার নির্বাচন হয়ে গেল, সে সুবাদে—-রিপাব্লকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী গভর্ণর মিট রমনি হলেন মর্মন বংশোদ্ভুত, যদিও FLDS এর হতভাগাগুলোর সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। সুতরাং আমার উপরোক্ত তথ্যগুলো হয়ত সম্পূর্ণ অপরিচিত নয় সবার কাছে। অপরিচিত হলেও মর্মন সম্প্রদায়টি মানবজাতির এমনই এক তুচ্ছ অংশ যে তাদের সম্বন্ধে জ্ঞানধারণ করতেই হবে এমন কোনও বিশেষ গরজ নিয়ে আমি শুরু করিনি লেখাটি। আমার মূল উদ্দেশ্য, এই ছোট ছোট কাহিনীগুলোকে উপলক্ষ করে মানবচরিত্রের একটা মৌলিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা। এটা কেন হয়? চরম ঘেন্না আর বিতৃষ্ণা সৃষ্টিকর একটা অমানুষিক রীতিনীতির প্রতি কিছু কিছু মানুষ কেন এমন তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে? কেন ওয়ারেন জেমসের মত হীনতার সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছানো একটি জীবকে অনুসরণ করার জন্যে লোকজন জীবনের সব সুখ স্বাছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে অন্ধের মত ছোটে? আমি তাদের ভেতরের ছবিটা দেখতে চাই, বুঝতে চাই। এই আকর্ষণ কি একটি চৌম্বিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির, না, ‘ধর্ম’ নামক একটি জাদুকরি শব্দের, যা শোনামাত্র কোন কোন মানুষ তার হিতাহিত জ্ঞান পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে? আমার অনুমান, উভয়ের। ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে জগতে আজ পর্যন্ত যতগুলো ঐহী পুরুষ অবতরণ করেছিলেন (দ্রষ্টব্য যে কোন নারী কখনও কোনও ধর্ম প্রচার করেননি), তাদের সকলেরই এই একটি জিনিস ছিলঃ ক্যারিজমা। যাকে আমি বলি চৌম্বিক ব্যক্তিত্ব। কথা দিয়ে মানুষের মন ভোলাতে হবে, তা নাহলে কেউ আপনার ধর্ম মানবে না।

অনেকের ধারণা ওয়ারেন জেফস জাতীয় ঘটনা কেবল অনুন্নত দেশের অশিক্ষিত গরিবদের মধ্যেই ঘটতে পারে, আমেরিকার মত অত্যুন্নত দেশে এগুলো খুবই অস্বাভাবিক ও অভাবনীয়। না, তা নয়। ধর্ম এমন এক জিনিস যা রঞ্জনরশ্মির মত মানুষের চামড়া ভেদ করে তার অন্তরের অন্তঃস্থলে গিয়ে পুরো জায়গাটা তমসাচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। এবং সেটা ঘটতে পারে যে কোনও দেশে যে কোনও পরিস্থিতিতে। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে ধনী দেশে ব্যাপকভাবে ঘটার সম্ভাবনা ততটা নয় যতটা গরিব দেশগুলোতে (ধর্মবিশ্বাসের মত দুষ্ট রোগজীবানুর জন্যে উৎকৃষ্ট জমিন হল দারিদ্র্য)। আমেরিকাতে FLDS জাতীয় ঘটনা আরো অনেক ঘটেছে, এমনকি তার চেয়েও অনেকগুণে লোমহর্ষক ও বিভীষিকাময়।

জোন্সটাউনের নাম শুনেছেন ? এ নামের একটি শহর আছে টেক্সাসে। সেটির কথা বলছি না আমি। বলছি গায়েনার ছোট একটা জায়গার কথা যার আসল নাম আদৌ ‘জোন্সটাউন’ ছিল না, জোনস সাহেবের নিজেরই চয়ন সেটা। এই ছোট জায়গাটি ছিল একটি বড়সড় আবাদি জমির মত, যেখানে জোনস এবং তার ভক্তদের চাষাবাদ করে জীবনধারন করার সুযোগ ছিল। এ এক লম্বা কাহিনী, রীতিমত রহস্যোপান্যাসের মত দম-বন্ধ-করে পড়ার মত কাহিনী। এর পরিণতিটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মোট ৯১৮ টি প্রাণ একই দিনে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সেকথায় আসছি একটু পরে।

মজার ব্যাপার যে জোনস লোকটা আসলে, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই, সম্পূর্ণ ‘বিধর্মী’ ছিলেন—-তাঁর শেষ মুহূর্তের স্বীকারোক্তিতেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে তিনি কৈশোর থেকেই বলতে গেলে নিরীশ্বরবাদী। লোকটার জন্ম ১৯৩১ সালে। বয়স যখন সতেরো কি আঠারো তখন থেকেই কমুনিস্ট মতবাদের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন—–তাঁর সেসময়কার হিরো ছিলেন চীনের কমুনিস্ট নেতা মাও সেতুং। তিনি নিয়মিতভাবে কমুনিস্টদের সভাসমিতিতে গিয়ে বক্তাদের বক্তৃতা শুনতেন। তাঁর নিজেরও যে একটা সুস্থরকমের উচ্চাকাংখা ছিল না তা নয়। তাঁর জন্মস্থান আমেরিকার একেবারে মধ্যবিন্দুতে—-ইণ্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে। নিজের দেশকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন বটে, কিন্তু সে-দেশটিকে পুঁজিবাদের শক্ত মুঠি থেকে মুক্ত করে একদিন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন হয়ত ছিল তাঁর মনে। সমস্যা ছিল সময়টা। একদিকে শত শত মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারাচ্ছে কোরিয়ান যুদ্ধে, আরেকদিকে ঘরের ভেতরে বাইরের শত্রু—-রোজেনবার্গ দম্পতির ফাঁসি হয়ে গেছে তখন রাশিয়ার গুপ্তচর হওয়ার অভিযোগে। সাথে সাথে বর্ণবাদ, যাকে তিনি প্রচণ্ডরকম ঘৃণা করতেন, সেটাও তখন তুঙ্গে। কালো চামড়া দেখামাত্র সাদাদের ছি ছি করে মুখ ফিরিয়ে রাখা, তাদের রেস্টুরেন্টে ঢুকতে না দেওয়া, বাথরুমে আলাদা জায়গা ব্যবহার করতে বাধ্য করা, এ সবই তাঁকে ভীষণভাবে বিচলিত করত। ভাবলেন এই পরিস্থিতিতে লোকগুলোকে সাম্যবাদের পথে আকৃষ্ট করার একটিমাত্র পথঃ তাদের ধর্মবিশ্বাসটিকেই কাজে লাগিয়ে ধর্মহীনতার পথে চালিত করা। তাঁর নিজের ভাষাতেইঃ “… have to infiltrate religion.” তখন থেকেই জিম জোনস হয়ে গেলেন চার্চের অত্যন্ত অনুগত সাধক।

এবং তখন থেকেই শুরু তাঁর জীবনের অত্যন্ত পরিকল্পিত অভিযান। গোড়াতেই হাত করে ফেললেন বেশ কিছু কৃষ্ণচর্ম ব্যক্তিদের—-তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ, তাদের হয়ে স্বজাতি শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে লড়াই করার চেষ্টা, হাসপাতালের ওয়ার্ডে গিয়ে কালো চামড়ার রুগীদের সেবাশুশ্রুষা করা, এভাবেই তিনি অর্জন করে নিলেন ওদের আস্থা ও আনুগত্য। আস্তে আস্তে গড়ে উঠল তাঁর স্বপ্নের প্রথম সোপান—-নিজস্ব একটি ‘চার্চ’। নাম দিলেন Peoples Temple—-গণমন্দির। সে চার্চের প্রথম সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। তারা এমনই ভক্ত হয়ে উঠল লোকটার যে নিজেকে ঈশ্বরের অবতার বলে দাবি করলেও হয়ত নির্দ্বিধায় তারা মেনে নিত সেটা।

এবং তাতেই সমস্যার সূত্রপাত। এই সাঁই সাঁই করে উপরে উঠে যাওয়া চৌম্বিক শক্তিসম্পন্ন পুরুষগুলোর সকলের পেছনেই একটা জিনিস প্রবলভাবে কাজ করেঃ ক্ষমতার মোহ। একটু ক্ষমতা পেলে তারা আরো পেতে চায়, এবং এ-চাওয়া একসময় সীমাপরিসীমা ছাড়িয়ে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। জিম জোন্সের বেলাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ক্ষমতার উত্তরণকালে একটা সময় হয়ত জোনস বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে তার জীবনে অসাধ্য বলে কিছু নেই। যখন ইচ্ছা তখনই যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়েই তিনি যা ইচ্ছা তা’ই করিয়ে নিতে পারবেন। কিছুটা সময় পর্যন্ত সেভাবেই চলছিল তাঁর জীবন। ইণ্ডিয়ানা থেকে দলবল নিয়ে চলে গেলেন ক্যালিফোর্নিয়ায়, যখনই টের পেলেন যে স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় তাঁর বিরুদ্ধে নানারকম চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়াতে ঘাঁটি স্থাপন করার পর কিছুদিন বেশ রমরমা ব্যবসাই চলছিল। রাজনৈতিক মহলের উপরতলার লোকেদের সঙ্গে নিত্যই চলছিল দহরম মহরম, গা মাখামাখি। এমনকি ক্যালিফোর্নিয়ার তৎকালীন গভর্ণর ব্রাউনের সঙ্গে গড়ে উঠল একপ্রকার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব। এতটাই প্রভাব প্রতিপত্তি তখন তাঁর যে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ওয়াল্টার মণ্ডেলের সাথে একসাথে ভ্রমণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল একই প্রাইভেট জেটে।

কিন্তু তারপরই একের পর এক গুজব ছড়াতে শুরু করে। তাঁর নিজেরই প্রতিষ্ঠিত চার্চের কিছু কিছু অসুখি সদস্য বাইরে বলাবলি শুরু করে দেয় যে জোনস সাহেব তাদেরই কোন একজনের স্ত্রীর সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন। কেবল তাই নয়। ড্রাগ সমস্যাও নাকি বেশ গুরুতর আকারে পৌঁছে গেছে। সত্যমিথ্যা যাই হোক, আস্তে আস্তে তাঁর ভাগ্যলক্ষীর কপালে তিলকফোঁটা দেখা দিতে আরম্ভ করে। সংবাদপত্রের লোকেরা তাঁকে নিয়ে নানারকম কথাবার্তা লিখতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সময় থাকতেই কেটে পড়া উচিত। ওদিকে তাঁর কমুনিজমপ্রীতির খবর তো লুকোনো ছিলনা কখনোই—-লুকোবার খুব একটা চেষ্টাও তিনি করেননি। যাই হোক, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে সদলবলে চলে গেলেন গায়েনার সেই জায়গাটিতে, যার নামকরণ হয়ে গেল তাঁর নিজের নামানুসারেঃ জোন্সটাউন।

১৯৭৭ সাল। ‘গণমন্দির’ এর বেশ কিছু সদস্য পালিয়ে চলে গেল আমেরিকায়। ‘পালানো’র প্রয়োজন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল এই কারণে যে তারা তাঁর দুর্ব্যবহার, তাঁর কঠোরতা, চার্চকে বন্দীশালার মত চব্বিশঘন্টা পাহারা দিয়ে রাখা যাতে কেউ পালাতে না পারে, তাঁর নারীঘটিত নানা কেলেঙ্কারি, এ সবকিছুই তাদের সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল। বিশেষ করে যখন এক মহিলা এসে কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করলেন যে তাঁর বাচ্চা ছেলেকে তারা আটকে রেখেছে, তখনই আমেরিকান সরকার সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে এর একটা সরেজমিনে তদন্ত হওয়া দরকার। সে অনুসারে কংগ্রেসম্যান লিও রায়ান সহ একটা তদন্তকারি দল পাঠানো হয় জোন্সটাউনে। তাঁরা সেখানে গেলেন বটে, কিন্তু অতিথির সমাদর পেলেন কি? না, পাননি। বরং জান বাঁচিয়ে পালাবার অবস্থায় তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে সুযোগ বুঝে আরো দুচারজন হাঁপিয়ে-ওঠা মানুষ, প্রধানত অপমানে অত্যাচারে তিক্ত হয়ে যাওয়া মেয়ে, যোগ দেবার চেষ্টা করে। তাদের পেছনে জোনস সাহেব পোষা কুকুরের মত লেলিয়ে দেন তাঁর বন্দুকধারী পাহারাদের। প্লেনে উঠার মুহূর্তেই শুরু হয়ে গেল গোলাগুলি। কংগ্রেসম্যান রায়ান অকুস্থলেই দেহত্যাগ করেন। সাথে আরো পাঁচজনকে প্রাণ হারাতে হয়। ইতোমধ্যে গির্জার অভ্যন্তরে সঙ্ঘটিত হতে থাকে আরেক অভাবনীয় দৃশ্য। জোনস আগেই সাবধান করে রেখেছিলেন তাঁর ভক্তদের যে তাঁর শত্রুরা একসময় হয়ত সশস্ত্র আক্রমণ চালাবে তাদের ওপর। তারা যেন ভয় না পায় তাতে। তাদের কোনও ভয় নেই, যতক্ষণ সম্মানের সাথে নিজেদের জীবন নিজেরাই সাঙ্গ করে দিতে প্রস্তুত থাকবে তারা। তারা সবাই একসাথে সহমরণ অবলম্বন করে আরোহন করবে উর্ধলোকের পবিত্রতম নিবাসে—-স্বয়ং ঈশ্বরের সান্নিধ্যে। এমন এক পৃথিবী সেটা যেটা তিনি এ জগতেই প্রতিষ্ঠা করতে দেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি, তারই পূর্ণ মাত্রায় পরিপূরণ হবে সেই পুন্যমার্গে আরোহন করবার পর। সুতরাং বাছারা, মৃত্যুকে যেন ভয় না পাও!

পরে দেখা গেল সেখানে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল সর্বমোট ৯১৮ জন মানুষকে, যার মাঝে ৩০৩ জন ছিল অবোধ শিশু। এদের অনেকেই শেষ মুহূর্তে পালানোর চেষ্টা করেও পারেনি, দরজাগুলো সব আঁট করে আটকে রাখা হয়েছিল, যাতে কেউ বাইরে গিয়ে জোন্সের নামে কোনও কুৎসা রটাতে না পারে।

এভাবেই শেষ হয় একটি করুণ কাহিনী, যেখানে একটি নাস্তিক সাম্যবাদী পাদ্রীর অপকর্মের শাস্তি কেবল তিনিই ভোগ করেননি, সাথে অনেকগুলো নিরপরাধ মানুষকেই অযথা প্রাণ দিতে হয়েছিল।
এই একটি উদাহরণই আমি জানি যেখানে একটি বিধর্মী মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করেছেন নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। তার সাথে মিছিমিছি প্রাণ হারিয়েছেন অনেকগুলো নির্দোষ মানুষ। যারা ‘ধর্ম’ শব্দটা উচ্চারিত হওয়ামাত্র দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ভেড়ার পালের মত উর্ধশ্বাসে ছুটতে শুরু করে তাদের কল্পিত ত্রাণকর্তার পেছনে।

আমি জানতে চাই কেন তারা ছোটে এভাবে।

খৃস্টান ধর্মে ‘Second coming of Jesus Christ’ বলে একটা কথা আছে। ইসলামে যেমন আছে ‘ইমাম মেহেদি’ নামক এক মহাপুরুষের আবির্ভাবের কাহিনী। ধর্মগ্রন্থের এই বাণীগুলো পৃথিবীর যাবতীয় ভণ্ড পীরেদের জন্য হয়েছে এক সোনার খনি। একটু জোব্বাজাব্বা পোশাক পরিচ্ছদ আর দাড়িমোছ দিয়ে চোখমুখ ভালো করে ঢেকে কোনও অচেনা জায়গায় গিয়ে নিজেকে সেই অনাগত সাধুপুরুষ বলে দাবি করলে আপনাকে থামায় কে। পীরদরবেশদের তো কোনও ‘চেকপয়েন্ট’ নাই।

টেক্সাসের ভিক্টর হুটফ ছিলেন এমনই এক ‘মহাপুরুষ’। অবশ্য তিনি নিজে বিশেষ সুবিধা করতে না পারলেও ১৯৫৬ সালে একটা স্বতন্ত্র ধর্মগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন যা একসময় হস্তান্তরিত হয় ভার্নন হাওয়েল নামক এক ‘চৌম্বিক’ শক্তিসম্পন্ন যুবকের হাতে, যে নিজেকে পৃথিবীর যাবতীয় পাপিষ্ঠের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে অনেক শিষ্য সাকরেদ সৃষ্টি করে ফেললেন অতি অল্প সময়ের ভেতর। তাঁর দলে এসে যোগ দেয় অনেক পরিবার, অনেক তরুণতরুণী, অনেক বৃদ্ধবৃদ্ধা। এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠলেন তিনি যে একসময় বোধ হয় নিজের ‘দৈবশক্তি’কে আসলেই দৈবপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। তারপর, ১৯৮৯ সালের ৫ই আগস্ট তিনি এক অদ্ভুত ভিডিও প্রচার করতে লেগে গেলেন তাঁর ভক্তদের মাঝে। এর নাম দিলেন ‘নিও লাইট’—নতুন আলো। তাতে নাকি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার কন্ঠ। ঈশ্বর তাকে আদেশ করছেন তার চার্চের সবগুলো স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে ‘ডেভিডের গৃহ’ নামক একটি পবিত্র ঘরানা তৈরি করে ফেলতে যার সদস্যরা হবে তারই ঔরসজাত ‘বিশুদ্ধ’ প্রাণী—-মহাপ্রভুর বিশেষ করুনাপ্রাপ্ত নিখুঁত প্রজন্ম। শুরু হয়ে গেল অন্যের স্ত্রীদের নিয়ে ‘বিশুদ্ধ’ প্রজন্ম উৎপাদনের অভাবনীয় প্রদর্শনী। তাদের স্বামীরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখলেন সেই অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা—-স্বয়ং ভগবান গ্রহণ করেছেন তার স্ত্রীকে। একটি ‘বিশুদ্ধ’ জাতি সৃষ্টি করবেন বলে। এর চেয়ে বড় ভাগ্য আর কি হতে পারে!

১৯৯০ সালে ভার্নন হাওয়েল নিজের নাম পরিবর্তন করে ডেভিড কোরেশ নাম গ্রহণ করলেন। পরে জানা গেল যে ইতোমধ্যে তার কীর্তিকাহিনীর খবর বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। পুরুষদের ব্যবহৃত স্ত্রীদের নিয়ে বেশিদিন তৃপ্তি পাওয়া যাবে না ভেবে তিনি আদেশ জারি করলেন যে প্রভুর ইচ্ছা মায়েরা তাদের সাবালিকা মেয়েগুলোকেও তার ‘বিশুদ্ধ’ জাতি উৎপাদনের লক্ষে সমর্পন করে দেয়। অনেকে ঠিক তা’ই করলেন বই কি। কেউ কেউ হয়ত করলেনও না। এই নেতিবাচক মেয়েগুলিই শেষ পর্যন্ত ‘ঈশ্বরের’ ‘বিশুদ্ধ’ প্রজন্ম সৃষ্টির পরিকল্পনা পণ্ড করে দেয়। কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ চলে যায় যে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা নিয়মিতভাবে সঙ্ঘটিত হয়ে চলেছে ট্যাকোর ব্র্যাঞ্চ ড্রাভিডিয়ান চার্চের অভ্যন্তরে। শিশুরা হচ্ছে নিপীড়িত, নারীরা লাঞ্ছিত, যৌনভাবে আক্রান্ত ও ধর্ষিত। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে অস্ত্রধারী নিরাপত্তা বাহিনী পাঠানো হয় ১৯৯৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী। সেই অবরোধ বলবৎ ছিল প্রায় দুমাস। ডেভিড কোরেশ কিছুতেই আত্মসমর্পণ করতে রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনী আগুনের গোলা ছুড়তে শুরু করে চার্চ বিল্ডিং লক্ষ করে। আশা ছিল এতে ক্ষয়ক্ষতি যা হবার বড়কর্তাদেরই হবে, ছেলেমেয়েরা বেঁচে যাবে। দুঃখের বিষয় তা হয়নি। কোরেশ এবং তার গুণ্ডাপাণ্ডারা একটি মানুষকেও পালাতে দেয়নি—নিজেদের সঙ্গে সবাইকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরতে বাধ্য করেছে। সেই অবিশ্বাস্য ট্র্যাজেডির পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৯৩ সালের ১৯শে এপ্রিল। ঐ ইতিহাস এখনো অনেকের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

আমার সেই একই প্রশ্ন। কিসের মোহে ঐ মানুষগুলো সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে একটা ভণ্ড লোকের চটুল কথায় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলল? ‘ধর্ম’ শব্দটা উচ্চারণ করা হয়েছিল বলে?

গত সপ্তাহে খবরের কাগজে পড়লাম টেনেসির এক শ্রমিকের কথা। ভাল একটা চাকরি ছিল তার—-হঠাৎ করে ছেড়ে দিয়েছেন। কেন? রাজস্ব বিভাগ থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলেন যার খামের ওপর লেখা ছিল একটা নাম্বারঃ ৬৬৬ ! বাইবেল অনুযায়ী একটা অপয়া নাম্বার—-“mark of the beast” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে একে। এই ‘বিস্ট’ কোনও সাধারণ বিস্ট নয়, একেবারে রোজ কেয়ামতের বিস্ট, যে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। আমরা যাকে বলি ‘খান-ই-দজ্জাল’। রাজস্ব বিভাগের ভাষ্য অনুযায়ী এটা আর কিছু না, চিঠির নাম্বার মাত্র—-কয়েক হাজার চিঠির মাঝে এটি ছিল ৬৬৬ তম চিঠি!

এবার বলুন বিশ্বাস আর বিস্টের মাঝে তফাৎটা কোথায়।

অটোয়া,
১১ই ফেব্রুয়ারী, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২