প্রত্যয়দীপ্ত ডারউইন দিবস এবং ভালবাসা দিবস

এক ধরণের বিদ্রোহ ভালবাসা, এক ধরনের বিদ্রোহ হল দাবী

আজ  ডারউইন দিবস। আর সামনেই আসছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে, বা ভালবাসা দিবস।

ইচ্ছে ছিল এবারের ডারউইন দিবসটা খুব বড় করে করার। সেই মোতাবেক এগুচ্ছিলোও কাজ। পারভেজ আলম একদিন আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে বললেন, ডারউইন দিবসের প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করা যাক।

আমি বললাম তথাস্তু।

সেমিনার করা, কাকে কাকে বক্তৃতায় ডাকা যায়, দৈনিক পত্রিকাগুলোতে লেখা পাঠানো যায় কিনা, মুক্তমনায় পেইজ করা যায় কিনা  – এ নিয়ে  অনেক কথা হল। সৈকতও বলল, এবারের ডারউইন দিবস উদযাপনের ডাক দিতে হবে।

এইতো এক সপ্তাহ আগের কথা।

তারপর?

তারপর পদ্মা, মেঘনা যমুনার উপর দিয়ে বয়ে গেছে বহু জল, বহু তরঙ্গস্রোত।

কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষণার পর থেকেই উত্তাল হয়ে উঠলো রাজপথ। ফেসবুক হয়ে উঠল ম্যাসেজে ম্যাসেজে সয়লাব। ব্লগার এবং অন লাইন এক্টিভিস্টদের আহবানে সাড়া দিয়ে হাজারো মানুষ নামলো শাহবাগে। তারপর যতদিন গেছে গুণোত্তর হারে বেড়েছে মানুষের সংখ্যা।  মুক্তমনায় সাইফুল দিয়েছিলেন ডাক

শাফায়েতের মত ঘরকুনো ছেলেও লাগাতারভাবে পড়ে রয়েছে শাহবাগে (দেখুন এখানে কিংবা এখানে)।  লীনা, টেকি সাফি, শফিউল জয়, কে নাই সেখানে? মুক্তমনার সদস্যদের অনেকেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন শাহবাগে।

এ ভাবেই হল আমাদের ডারউইন দিবসের উদযাপন।  শ্রেষ্ঠ উদযাপন বলা যায় আমাদের।

শাহবাগের ঘটনা থেকে আমরা  কিছু জিনিস শিখলাম। নেতৃত্ব তৈরি করে তারপর বিপ্লব হয় না।  বিপ্লব থেকেই বেরিয়ে আসে সুযোগ্য নেতৃত্ব। ইমরান এইচ সরকার, আজাদ মাস্টার, মারুফ রসূল, পারভেজ, পিয়াল, আরিফ জেবতিক, মাহবুব   – যাদের আমি কেবল ফেসবুক বন্ধু হিসেবেই জানতাম, তারাই আজ  তৈরি করেছে নেতৃত্বের পথ। তাদের প্রত্যয়দীপ্ত মুখের দিকেই আজ সাড়া বাংলাদেশ তাকিয়ে। তাদের কেউ শাহবাগে ঘোষণাপত্র পাঠ করছেন, কেউ আজ সংসদে স্মারকলিপি দিচ্ছেন, কেউবা দিচ্ছেন পত্রিকায় সাক্ষাৎকার। অনেককেই দেয়া হচ্ছে প্রতি রাতেই একাত্তরটিভি, একুশে টিভিসহ নানা চ্যানেল থেকে সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব।

অনেকেই আবার সময়াভাবে ফিরেও দিচ্ছেন। এ এক নতুন বাংলাদেশ। কোন রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর মুখের দিকে না তাকিয়ে নিজেরাই গড়ে তুলেছে দুর্বার আন্দোলন, বদলে দিচ্ছে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি। এই মারুফ রসূল নামের ছেলেটির কথাই ধরুন। শনিবারের চিঠি নামে ব্লগ করে মুক্তমনা সহ অন্য অনেক ব্লগেই। তিনি তুলোধোনা করে দিলেন শওকত মাহমুদকে (ভিডিওটি অবশ্যই দ্রষ্টব্য):

https://www.facebook.com/photo.php?v=482029038512083

তারপর ধরুন অমি রহমান পিয়াল। সুযোগ্য জবাব দিলেন তাদের,  যারা বলেন ‘শাহবাগের ঘটনা নাকি সাজানো নাটক’।  বললেন, এটা যদি সাজানো নাটক হয়, তবে এরকম একটা নাটক অন্য কেউ করে দেখান না – যেখানে সব পেশার, সব ধরণের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ ঘটেছে। এমনকি মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যেও পানির বোতল নিক্ষেপ করা হয়েছে (এই ভিডিওটিও দেখা চাই)

https://www.facebook.com/photo.php?v=4975772085927

যাক, শুনলাম – দিগন্ত টিভির নেটওয়ার্ক নাকি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। বড় বড় অনেক সংস্থা দিগন্ত টিভি এড দিবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে।  জামাতী পত্রিকা দৈনিক আমার দেশে পত্রিকার সার্কুলেশন ১০ হাজারে নেমে গেছে।  কাদের এবং কামারুজ্জামানের প্রেসক্লাব সদস্যপদ বাতির দাবী উঠছে। বাগেরহাটে ইসলামী ব্যাংক থেকে দুইজন টাকা তুলে নিয়েছেন, কারণ রাজাকারের ব্যাঙ্ক-এ তারা টাকা রাখবেন না। কে ভাবতে পেরেছিল এটা কখনো সম্ভব এই দেশে?

ভারতের কীর্তিমান গায়ক, আমার প্রিয় শিল্পী সুমন দু দুটি গান লিখে ফেলেছেন শাহবাগের প্রত্যয়কে গিটার বন্দী করে। প্রথম গানটি ছিল ‘গনদাবী’।  গতকাল লিখলেন আরেকটি গান – ‘শাহবাগে রাতভোর’-

‘শাহবাগে রাতভোর

স্মৃতিতে একাত্তর
নব ইতিহাসে সাক্ষী
রইল প্রজন্ম চত্বর।

স্লোগানে স্লোগানে কাঁপে
লাখো নবীনের বুক
ছেলেমেয়েদের মুখেই
আমার বাংলাদেশের মুখ।

হাত ধরে ছেলেমেয়ে
মুক্তির গান গেয়ে
জেগে আছি আজ প্রহরীর মতো
আসল বিচার চেয়ে।

শহীদজননী দেখছেন
জাগরণ প্রস্তুতি
সুফিয়া কামাল কাছেই আছেন
বিদ্রোহী নাতিপুতি।’

গানটি শুনতে এখানে ক্লিক করুন

আজ যখন পেছন ফিরে ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসগুলোর দিকে তাকালাম, তখন অবাক হয়ে দেখলাম এগুলোর মধ্যেই তো ধারণ করা আছে শাহবাগের পুনর্জাগরণের ইতিহাস।

ফেব্রুয়ারির ছয় তারিখে লিখেছিলাম –

‘লাখো শহীদ ডাক পাঠালো সব সাথীদের খবর দে
শাহবাগ ঘেরাও করে সব রাজাকার কবর দে!’

হ্যাঁ, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম কর্তৃক গোলাম আজমের ফাঁসির রায় উচ্চারণের সময় আমিও সোহরার্দী উদ্যানে ছিলাম, লাখো মানুষের ভীরে…

নব্বইয়ে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের দিন কারফিউ ভেঙে যে প্রথম মিছিলটি বেরিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, সেখানে আমিও ছিলাম। …

দুর্ভাগ্য আমার, প্রিয় দেশের অর্ধ-গোলার্ধ দূরে থেকে আমি এই অমর মহাকাব্যের সাথী হতে পারলাম না। ব্লগার এবং ফেসবুক এক্টিভিস্টদের প্রণোদনায় যে স্বতঃস্ফূর্ত জনতার ঢল নামলো শাহবাগে, আর তারপর তা ক্রমশ: এখন ছড়িয়ে পড়ছে সিলেট, চট্টগ্রাম সহ সাড়া দেশে তা এক কথায় অকল্পনীয়, অভূতপূর্ব। এই দৃশ্য আমরা এতদিন কেবল মিশর কিংবা তিউনেশিয়ার বেলাতেই দেখতাম, আজ  অবাক পৃথিবী তাকিয়ে দেখল এই বিক্ষুব্ধ বাংলাকে।

আজ  আবারো উচ্চারণ করতে ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে –

“একাত্তরে আমি অনেক ছোট, মৃত্যু বুঝি, যুদ্ধ বুঝি না
আজ আমি অনেক বড়, যুদ্ধ বুঝি, মৃত্যু বুঝি না”!

সাথে সংযুক্ত করেছিলাম এই ছবিটি, যেটা এখন শাহবাগের গণজাগরণের ‘সিম্বলে’ পরিণত হয়েছে –

এই ছবিটিকে কভার পেজের মর্যাদা না দিলে কি তখন চলে?

৭ তারিখে লিখেছিলাম

 আগুন দেখেছি আমি কত জানলায়

শাহবাগ এলাকাটা ছোটবেলা থেকেই কেন যেন আমার খুব প্রিয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বড় হবার সুবাদে এলাকাটা আমার চষে ফেলা ছিল অনেক আগেই। আর তার মধ্যে আবার বইয়ের দোকান। ছোটবেলায় বইয়ের দোকান বলতে বুঝতাম নিউমার্কেট আর শাহবাগ। কিন্তু নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো একসময় জৌলুষ হারালো, আমার পছন্দের বই পাওয়া যেত না ওখানে প্রায়ই। ধীরে ধীরে আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো হয়ে উঠল আমার আরাধ্য উপাসনালয়!

বহুবছর পর গতবছর দেশে গিয়েও বইমেলার পর সবচেয়ে বেশিবার গিয়েছিলাম শাহবাগেই। আগের সেই মার্কামারা ভাবটা নেই, বইয়ের দোকানের অনেকগুলোই উঠে গিয়ে কাপড়ের দোকানে পরিণত হয়েছে, তারপরেও ওটা আজিজ বলে না কথা! বন্যা আর আমি দুজন মিলে যেবার দেশে গিয়েছিলাম সেবারও – আমরা সেই উত্তরা থেকে পাড়ি জমাতাম আজিজে, প্রতিদিনই। সকাল পেরিয়ে বিকেল হয়ে যেত রাস্তার জ্যাম ফ্যাম পেরিয়ে। কাউকে বললে বুঝতে পারতো না, কি পাই আমরা শাহবাগে গিয়ে।

নোনা স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল, ঘুপচি ঘুপচি ঘর, আর রাস্তার ধারে নর্দমা, আর উসকোখুসকো অপরিচ্ছন্ন ভ্যাগাবণ্ড টাইপের লোকজনের আড্ডা – মনোমুগ্ধকর স্থান হিসেবে কারো মনে উঠে আসবে না নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমাদের কাছে সেই এলাকাটাই ছিল পরম পূজনীয়, সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর একটি। দেশে গেলে বসুন্ধরা সুপারমার্কেট আমার যাওয়া পরে না, কিন্তু আজিজে ঢু মারা হয় ঠিকই। ভাবতেই ভাল লাগছে ঢাকাশহরের সবচেয়ে প্রিয় স্থানটি থেকে বিদ্রোহের বারুদ জ্বলেছে, আর এখন তো তা অগ্নিস্ফুলিঙ্গে রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সাড়া দেশে।

আরো আনন্দের ব্যাপার, কোন রাজনৈতিক দল এর নেতৃত্ব দেয়নি, দিয়েছে -আমরা যারা লেখালিখি করি তাদের মধ্যে থেকে উঠে আসা ব্লগার এবং ফেসবুক এক্টিভিস্টরা। যারা এতদিন ভার্চুয়াল লেখালিখি আর ইন্টারনেটে চেঁচিয়ে কিছু হবে না বলে কথার তুবড়ি ফোটাতেন, তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আজ দেখিয়ে দেয়া হয়েছে – ‘আমরাও পারি’।

আমরাই পারি!

দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের কমরেডদের স্যালুট! শাহবাগে ৮ই ফেব্রুয়ারির জনতার সমাবেশ সফল করে তুলুন।

‘মানুষ জেগেছে দাবী গরাদ ভাঙার
ভাঙে যেন জানলার সকল গরাদ’

এ স্ট্যাটাসটি ছিল ৮ তারিখের মহাসমাবেশ শুরু হবার আগের দিন। সুতরাং সেখানে ছিল মহাসমাবেশ সফল করার আহবান –

তারপর এলো সেই ঐতিহাসিক মহাসমাবেশের দিন।  সেদিন যে কি হয়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কমপক্ষে দু আড়াই লাখ লোক সমবেত হয়েছিল  প্রজন্ম চত্বরে। ও হ্যা, বলতে ভুলে গেছি, আমার স্কুলের একসময়কার প্রধান শিক্ষিকা ডক্টর আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর প্রস্তাবনায় সবাই শাহবাগের মোরকে প্রজন্ম চত্বর বলে অভিহিত করতে শুরু করে দিয়েছে।  বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, লেখক এবং তারুণ্যের প্রাণ জাফর ইকবাল সমাবেশে সমাবেশের তরুণদের ‘এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সম্বোধন করে বললেন, ‘আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। আজ আমি তোমাদের কাছে এসেছি ক্ষমা চাইতে। আমি পত্রিকায় লিখেছিলাম, নতুন জেনারেশন শুধু ফেসবুকে লাইক দেয়, ব্লগ লিখে, রাস্তায় নামে না। তোমরা আমাকে ভুল প্রমাণিত করেছ…’

আমার এক সুহৃৎ বললেন আপনার কভারে পেজের ছবিটাতে এখন আর মানুষের মহাসমুদ্র ঠিকমতো ফুটে উঠছে না।  বদলাতেই হল কভার পেজের ছবিটা –

এই শাহবাগ আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে তিন চার দিন ধরে অবিরাম স্লোগান দিয়ে পত্রিকার শিরোনামে উঠে এসেছেন লাকী আক্তার।স্লোগান দিতে গিয়ে দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।কিন্তু অসুস্থতা তাকে আটকাতে পারেনি। পার্শ্ববর্তী বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সেই রাতেই গণজাগরণ মঞ্চে ফিরে এসে স্লোগান ধরে লাকী বলেন, ‘আন্দোলন চলবে। আমি সুস্থ আছি।’শুধু লাকী নন, গত ছয় সাত দিন ধরে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর স্লোগানে মাতিয়ে রেখেছেন অন্তত ১০ নারী। এদের মধ্যে উম্মে হাবিবা বেনজীর, প্রীতিলতা, তানজিদা তুবা, সামিয়া রহমান, আফসানা কলি, অনিতা বাড়ৈ সহ অনেকেই আছেন। তারা কেউ একাত্তরের যুদ্ধ সামনাসামনি দেখেননি। তবে সবাই ধারণ করেন একাত্তরের আগুন। জামাত শিবির এবং অনলাইন ছাগুচক্র রীতিমত প্রচারণা চালাতে চেয়েছিল যে শাহবাগে মেয়েরা গেলেই নাকি ধর্ষিতা হচ্ছে। শাহবাগ নাকি গাঁজাখোর আর বেশ্যাদের আস্তানা। এই সব সস্তা বুলিকে মিথ্যা প্রমাণ করে শাহবাগে প্রতিদিনই হাজির থাকছেন অসংখ্য নারী। তারা অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন অন্যদেরও।

শাহবাগের জনসমুদ্রকে ধারণ করে আর লাকী আক্তারের মত সাহসী মেয়েদের প্রতি অভিবাদন জানিয়ে মুক্তমনার জন্য একটা ব্যানার করার চেষ্টা করেছিলাম শুক্রবার দিন আমার অক্ষম হাতে ~

তবে গতকাল শনিবার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বলেছিলাম

ছোটবেলায় স্কুলে যখন জ্যামিতি পড়তাম, তখন প্রতিটি উপপাদ্যের নীচেই একটা সম্পূরক প্রতিপাদ্য এসে পড়ত। করোলারি কনক্লুশন যাকে বলে। আমার মতে শাহবাগের এই অভূতপূর্ব বিক্ষুব্ধ গণআন্দোলনও তৈরি করেছে বহু ধরণের সম্পূরক দাবীর ক্ষেত্র। শাহবাগের আন্দোলন কেবল একটি বা দুইটি রাজাকারের ফাঁসি চাওয়াতেই সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, এটা একটা মহাজাগরণ – সামগ্রিক পশ্চাৎপদ কাঠামো পরিবর্তনের আন্দোলন এটি। রাজাকারদের ফাঁসির পাশাপাশি আমাদের নিশ্চিত করতে হবে এই দুইটি ব্যাপার –

১) ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির অপসারণ।

২) আগামী নির্বাচনে যেন জামাত শিবির সহ এই উগ্র ধর্মবাদী দলগুলো অংশ নিতে না পারে।

এ নিয়ে কাজ শুরু করার আহ্বাণ জানাচ্ছি এখনই। ভবিষ্যতের মহাসমাবেশগুলোতে ‘রাজাকারদের ফাঁসি চাই’ ব্যানারের পাশাপাশি আমাদের সম্পূরক প্রাণের দাবীগুলোও উচ্চারিত হোক। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন বিষবৃক্ষের চারা যেন আবারো মহীরুহ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদ-এর উচ্ছেদ করে একসময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল, আর তারপর এরশাদের জামানায় একটা ধর্মকে দেয়া হয়েছিল ‘রাষ্ট্রধর্ম’-এর খেতাব, এই সার্কাসের অবসান নিয়ে কাজ করা জরুরী।

কেউ কি পারবেন এরপর শাহবাগে এ ধরণের ব্যানার নিয়ে এগুতে?

বক্তব্যগুলো উচ্চকিত হওয়া দরকার। এবং এখনই।

সেই সাথে জুড়ে দিয়েছিলাম  নিলীমের পাঠানো ব্যানারের উপর নিজের অক্ষম  হাতে বসানো বর্ণমালা, যা ছবিগুলোকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে  –

ব্লগার নাস্তিকের ধর্মকথা অবশ্য দ্বিতীয় ব্যানারটি নিয়ে কিছুটা ভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। এর কারণ আছে অবশ্য। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে অবধারিতভাবেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলেরই অস্তিত্ব থাকছে না, ফলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোন বিষয়ই হয়তো থাকবে না। তার মতে আমাদের শ্লোগানগুলো হতে পারে এরকমের –

১। কাদের মোল্লা সহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই (যে দাবীটি এর মধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে)

২। বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

৩। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। (২ নম্বর দাবিতে- জামাত, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী ঐক্যজোট টাইপের সংগঠন নিষিদ্ধ হবে ঠিকই; কিন্তু আওয়ামীলীগ, বিএনপি’র মত রাজনৈতিক দল গুলো যখন ধর্মকে ব্যবহার করে- ভোটের আগে তসবি হিজাব পরে ছবি প্রচার করা, ধানের শীষে- নৌকায় আল্লারে ঢুকানো, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে বক্তব্য দেয়া এবং ঢালাও প্রচার করা, বক্তব্যে/ লিফলেটে ধর্মীয় সুড়সুড়িমূলক বক্তব্য দেয়া… ইত্যাদি- বন্ধ করার জন্য এই শ্লোগানের বিকল্প নাই।)

৪। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আর বিসমিল্লাহকে  অপসারণ করার শ্লোগান এবং উদ্যোগ।

 

এই দাবীগুলোই হোক আমাদের এবারের ডারউইন দিবসের প্রত্যয় দীপ্ত শপথ।

ভাল লাগল দেখে যে কিছু তরুণ এ নিয়ে কাজ শুরুও করে দিয়েছেন –

আমি জানি আমার কাজ বা ব্যানারগুলোতে শাহবাগের কোন চিত্রই ধরা পড়ছে না, পড়বে না। আমার অক্ষম হাতে এর সার্বিক চিত্রও তুলে ধরা সম্ভব নয়। সেখানে কি হচ্ছে তা এই স্ট্যাটাস্টাই যথেষ্ট –

প্রজন্ম চত্বরে বাংলাদেশ

——————–

-যে বয়সে ঘরে বসে কার্টুন দেখার কথা সেই পিচ্চি তার শরীর এর মধ্যে “রাজাকারের ফাঁসি চাই” লিখে “তুই রাজাকার” বলে স্লোগান দিচ্ছে…

-এক মা তার ছেলেকে ফোন করে বলতেছে,”এক মুহূর্ত দেরি করবি না,তর বড় আপুকে নিয়ে তাড়াতাড়ি শাহবাগ চলে আয়”

-এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হুইল চেয়ারে করে আসছে,মাথায় পতাকা বাঁধা,চোখ দিয়ে পানি পড়তেছে আর বলতেছে,”রাজাকারের ফাঁসি চাই”

-যে রিকশা চালক, রিকশা চালায় পেট চালানোর জন্য,সে আজ আমার ছোট ভাইকে বিনামূল্যে শাহবাগে নিয়ে গেছে…

-এক বড় আপুকে দেখলাম কলসিতে পানি ভরে সবাইকে পানি খাওয়াচ্ছে…

-এক বাবা তার তিন মাসের বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে।এত ছোট বাচ্চাকে কেন নিয়ে এসেছেন জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন,”আমি চাই আমার বাচ্চার রক্তে স্বাধীনতার চেতনা ঢুকুক,তার রক্তে থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভালবাসা আর রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা”

এই হচ্ছে বাঙালির দেশ প্রেম … যাদের শরীরে বাঙালির রক্ত বইছে শুধু তাদের পক্ষেই সম্ভব দেশের জন্য এই টান অনুভব করা … কোনও রাজাকারের পক্ষে এই দেশ প্রেম বোঝা সম্ভব না

শাহবাগে অসংখ্য ব্যানারের ভীরে দুটো পোস্টার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একজন একটা পোস্টার লিখে এনেছিলেন –

 

ঐকিক নিয়ম :

৩৪৪ টি খুনের শাস্তি = ১৪ বছর

১টি খুনের শাস্তি = (১৪ x ১২) / ৩৪৪

= ২ মাস

“আমি কাদের মোল্লাকে খুন করে ২ মাস কারাগারে থাকতে চাই”

যদিও ভদ্রলোকের অংকে একটু ভুল আছে। দুই মাস তাকে কারাগারে থাকতে হবে না, থাকতে  হবে ১৫ দিনের মত,  তারপরেও এই স্পিরিট দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। একজন আবার পরদিন নিয়ে এসেছিলেন ঐকিক নিয়মটা শুদ্ধ করে –

আরেকটা পোস্টার খুবই মজার । এটার বর্ণনার প্রয়োজন নেই। পিকচার টক্স ফর ইটসেলফ –

আমরা জানি, এবারের  ডারউইন দিবস এবং ভ্যালেণ্টাইন্স ডে অন্যান্য বারের মতো নয়। এ বছরের ভালবাসা দিবস আক্ষরিক অর্থেই যেন অনন্য।  শাহবাগ চত্বরে কাদের মোল্লা সহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাবীতে উত্তাল হয়ে উঠেছে তরুণ প্রজন্ম।  ডারউইন দিবসে তারা ৩ মিনিট নীরবতা পালন করবেন, সেটা স্কুল, কলেজ, ক্যাম্পাস, বাসা, অফিস যেখানেই তারা থাকুন না কেন –

আর এবারের ভালবাসা দিবসেও বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত তরুণ তরুণীদের বুকে বোধ হয় একটু বেশিই অনুভূত হবে ভালবাসার আগুন। প্রতিভাত হবে তাদের চোখের চাহনি, শরীরী ভাষা আর গোলাপ বিনিময়ে।  তাদের নীল খামে হয়তো থাকবে লিপস্টিকের হাল্কা দাগ, হাত থাকবে প্রত্যয়ের আবেগে বজ্রমুষ্ঠি। মুঠোফোনের বার্তা, ই-মেইল কিংবা ফেসবুক ভরে উঠবে প্রেম-কথার কিশলয়ে।  কে জানে,  তারা হয়তো সুমনের গানের মতো করেই গাইবে –

‘এক ধরণের বিদ্রোহ ভালবাসা
এক ধরনের বিদ্রোহ হল দাবী
উগ্র প্রেমের ছুরিতে দিচ্ছি শান
দখল করব জীবনের মৃগনাভি’

পাঠকদের সবাইকে ডারউইন দিবসের এবং ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা।