বাংলা দেশ থেকে ফিরেছি মাত্র এক মাস আগে। কই? এত বড় একটা প্রতিবাদ আন্দলোন যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে এক মাসের মধ্যে – সেটি স্বপ্নেও ভাবিনি!

এই আন্দোলন চালু হওয়ার সাথে সাথে আমি ই-মেল পেলাম আমার ছেলের কাছ থেকে। সে ওয়াশিংটন ডিসিতে থাকে। আমাকে এই ব্যাপারে কড়া নজর রাখতে বললো সে। চার দিন পর তার সাথে কথা হলো ফোনে। এর মাঝে ছাত্রদের আন্দোলন আরো যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি এই জন্যে যে, আমার ধারনা ছিল আজকালকার কলেজগামী ছেলেমেয়েরা সমাজ সম্পর্কে অতটুকু সচেতন নয়। মর্ডানিটির খপ্পরে পড়ে তাদের সময় কাটে সেল-ফোন, আই-প্যাড, টেবলেট, টেক্সটিং এসব নিয়ে। তার উপর পড়াশোনা তো আছেই। এবার কিন্তু আমার ভূল ভাঙ্গলো। না, বাংলাদেশের এই প্রজন্মরা ঠিকই দেশের ‘হার্টবীট’ আঁচ করতে পারে। দেশ থেকে তারা উৎখাত করতে চায় কেবল যে রাজাকারদের তাই নয়, সেই সাথে রাজাকার ‘মেন্টালিটি’।

বাংলা দেশে যে দুটি কালচারাল স্রোত পাশাপাশি বিদ্যমান সেটি সবাই কমবেশী জানে। একটি হচ্ছে স্যাকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অপরটি হচ্ছে ধর্মকেন্দ্রিকতা। স্কুল-কলেজের আধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরা বয়েসজনিত কারণে উদারপন্থী মনোভাবাপন্ন হয়ে থাকে। আবার বার্ধক্যে এদের অনেকেই ধার্মিক হয়ে পড়বে। এটাই বোধহয় য়ামাদের দেশের রীতি। তবে বিদেশে দেখেছি অন্য রকম। যারা উদারপন্থী তারা সারা জীবনই উদারপন্থী। গত চল্লিশ বছরে ইউরোপ আর আমেরিকায় ধর্মের প্রভাব এই সমাজে অনেক কমে গেছে। এক জরিপে বলা হয়েছে যে চার্চ বা গীর্জায় আজকাল লোকজন কম যায়। ইউরোপের অনেক গীর্জা না কি যাদুঘরে পরণত হয়েছে। আর বাংলা দেশে হয়েছে তার উল্টোটা। জানুয়ারী ২০১৩ সনে সিলেটের শাহ্‌ জালালের দরগায় জুম্মার নামাজে সমাবেত হয়েছে চল্লিশ হাজারের মত নামাজী। তাই আমার ধারণা ছিল যে – যে দেশের লোকরা এত ধর্ম পরায়ণ, সে দেশে ধর্মের কারণে অনেক লোক পাকিস্তানী মিলিটারীদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল ১৯৭১ সনে। জুন্নাহর প্রানের পাকিস্তান তারা ভাঙ্গতে দেবে না।

‘ক্রাইম এগেইন্সট হুম্যানিটি’ এটা বাঙ্গালীদের জন্য এক নয়া ‘কন্সেপ্ট’ বা ধারণা। ১৯৭১ সনে জামাতীদের মাথায় এটা ঢুকেনি যে তারা মানবতাবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে পাকিস্তানী মিলিটারীদের হত্যাযজ্ঞে যোগ হিয়ে। তাদের কাছে ধর্মটা এত বড় যে, ধর্মকে সমাজে সসম্মানে রাখতে হলে তার জন্য যদি কিছু লোকের প্রাণহানী হয়, তাতে ক্ষতি কী? আর জামাতীরা তখন মনে করেছিল যে, হিন্দুদের প্রাণনাষ করা হলো গিয়ে বেহেস্তে যাওয়ার রাস্তা নির্মান করা।

আমাদের প্রজন্মরা বিজ্ঞানের প্রযুক্তির কারণে সারা বিশ্বটা তাদের হাতের মুঠোয় (ফিগারিটেভ্‌লী নয়, সত্যিই!) এখন। তাই তারা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে যে জামাতী নেতা কাদের মোল্লা ১৯৭১ সনে এত বাঙ্গালী মারিয়ে কেবল যাবৎজীবন জেল খাটবে, সেটা তো ঠিক হলো না। তাই তারা রাস্তায় নেমেছে এর প্রতিবাদ করতে। তারা এটাও বলছে যে দেশকে তারা রাজাকারমুক্ত করে ছাড়বে। ছাত্রদের প্রচেষ্টায় দেশ থেকে যদি ধর্মকেন্দ্রিকতা তারা দূর করতে সক্ষম হয়, তাহলে সেটা হবে সবচেয়ে বড় কাজ। আমি তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আশা করি দেশবাসীরা তাদের ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া দেবে।

আন্তুর্জাল বা ইন্টারনেটে লিখালিখির জন্য বাংলাদেশের এক শ্রেণীর ছাত্ররা মর্ডানিটি বা আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। আমাদের মুক্তমনা ফোরাম এই ব্যাপারে কিছু ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আন্তর্জালে ব্লোগোস্ফেয়ারের আবির্ভাব হবার অনেক আগে বেশ কিছু নির্ভিক বংগসন্তান ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে নানান লিখা ও বাদানুবাদ করেছে ধর্মকেন্দ্রিক লোকদের সাথে। এর প্রভাব নিশ্চই বাংলা দেশে পড়েছে। ১২-১৩ বছর আগে আমরা ১৯৭১ সনের পাকিস্তানীদের হাতে বাঙ্গালী হত্যার কথা ‘যেন্ডারসাইড’ ওয়েব-সাইটে লিখে সারা পৃথিবীকে জানিয়েছি। নিশ্চয় এতে কিছু কাজ হয়েছে। অন্ততঃ পৃথিবীর কিছু লোকরা তো এই ব্যাপারটা জেনেছে?

আমাদের প্রজন্মরা এ’বছর মাঘ মাসে শাহ্‌বাগ চত্ত্বরে যে ভাবে কোর্টের রায়ের প্রতিবাদ করছে তাতে ১৯৭১ এর যুদ্ধ অপরাধীদের সে সময়ের হীন কার্যকলাপ এর কথা সারা পৃথিবীতে রাষ্ট্র হবে সেটাই আশা করি।

যে কাজটি আমাদের করার কথা ছিল, সেটি আমরা করতে অক্ষম হয়েছি। সে কাজটি আমাদের ছেলে মেয়েরা যে করছে, সেটা ভাবতেই আমার বুক ভরে উঠছে। ১৯৫২ সনে আমার শৈশব কাটে ঢাকায়, ১৯৬৯ সনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তাই সে সময় এক-নায়কত্ত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রাজপথে নেমে ছিলাম, এবার ‘বাংলা বসন্ত’ আন্দোলন চালু হবার এক মাস আগেই মার্কিনমুল্লুকে ফেরৎ চলে আসলাম। তাই ‘বাংলা বসন্ত’ দেখার বা তাতে যোগ দেবার সৌভাগ্যটি আর হলো না। তবে আশা করছি এই যে, আমাদের প্রজন্মরা একাগ্রচিত্তে তাদের দাবী সুশীল সমাজের হাতে যেন পৌছে দিতে পারে। রাজাকারবিহীণ ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ হবে অগ্রগতির প্রথম পদক্ষেপ। সেটি তারা আনুধাবণ করেছে তাদের তারুন্যে।