৭৫ এর শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হবার পরেই মোটামুটি ভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কবর রচনা হয়েছিল দীর্ঘ দিনের জন্য।বিশ্বাস ঘাতক খোন্দকার মোশতাক তখন ক্ষমতা দখল করলো।কিন্তু বেইমানীর ফল শুভ হয়না।সেও ক্ষমতা বেশিদিন আঁকড়ে ধরে রাখতে পারলো না।

তার পর শুরু হল প্রহসনের রাজনীতি।সামরিক বাহিনীর সাহায্যে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসীন হলেন।আর সেখান থেকেই মুক্তি যুদ্ধের চেতনা ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসতে শুরু করল।কিছু রাজাকার কে পুনর্বাসনের মাধ্যমে এটার সুচনা সম্ভবত জিয়াউর রহমানই করলেন।হ্যাঁ আর না ভোটের ভেল্কি তিনি দেখালেন।উচ্চাভিলাষী এই সামরিক নেতাও কিন্তু বেশীদিন থাকতে পারলেন না।সেই সামরিক বাহিনীর কল্যানেই তাকেও নিহত হতে হল।তারপর সাত্তার এলেন।কাজের কাজ কিছুই হল না।সেই একই ধারা চলতে থাকল।

শেষে আবার ক্ষমতা দখল করলেন হু.মু . এরশাদ।তিনি এসে এক রাজাকার কে কে সরকারে অন্তরভুক্ত করার মাধ্যমেই এই দেশে রাজাকারদের রাজনীতি বৈধতা পেল। জিয়া যে বিষবৃক্ষ রোপণ করে গেছিলেন রাজাকারদের পুনর্বাসিত করার মাধ্যমে, এরশাদ সেটিকে চুড়ান্ত রুপ দিলেন।এর পর দীর্ঘ নয়মাস চলল এই দেশে ইসলামী করন। রবিবারের পরিবর্তে শুক্রবার হল ছুটির দিন।গণতন্ত্র তখন এক পরাজিত সৈনিক।তারপর বহু আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ বিতাড়িত হলেন।

এলো বহু প্রতীক্ষিত গণতন্ত্র।কিন্তু সত্যই কি গণতন্ত্র এসেছিল? গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কি? সেটা কিন্তু প্রথম থেকেই লঙ্ঘন করা হল, ১৯৯৪ সালে গোলাম আযম কে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার মাধ্যমে।তার মাত্র ২ বছর পরেই নির্বাচনে বি এনপির ভরাডুবি হল। ক্ষমতায় আসলো আওয়ামী লীগ।এবার বি এন পি চার দলীয় জোট করল জামাত কে নিয়ে।আর তার পর ক্ষমতায় এসেই নিজামী, মুজাহিদ মন্ত্রী হল।মন্ত্রিত্ব দিলেন খালেদা জিয়া, যিনি কিনা মুক্তি যোদ্ধা বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের স্ত্রী।তাহলে এখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে যদি যুদ্ধাপরাধী শিরোমণি রা মন্ত্রিত্ব লাভ করলেন, আর সেটা আসল একজন বীর উত্তমের স্ত্রীর হাত ধরে। আর এই গোলাম আযম বাংলাদেশে পাকিস্তানি পাসপোর্টে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন জিয়া নিজে।

যদি এই যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী নাগরিক কে বাংলাদেশে থাকার অনুমতি দিয়ে জিয়া কি প্রমান করেছিলেন? কেন তিনি মুক্তি যুদ্ধ করেছিলেন? রাজাকারদের পুনর্বাসিত করার জন্য?তাহলে তিনি কেমন মুক্তি যোদ্ধা? নাকি আবার সেই মানবতার ধুয়া?

যাক এবার পরের প্রসঙ্গে ফিরে আসি,খালেদা জিয়ার আমলে এই রাজাকার শিরোমনী নাগরিকত্ব পেল।অবাধে রাজনীতি শুরু করল, দেশে ধীরে মৌলবাদ আর ধর্মান্ধতা জেঁকে বসতে লাগলো।এই সবই কিন্তু জিয়ার গোলাম আযম কে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করার প্রতিফলন ।

তার পর যখন জামাতের নেতৃত্বের বদল আসলো, তখন নিজামী ,মুজাহিদ হল মন্ত্রী । তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল,যারা কিনা ওই পতাকাকে চায় নি।এভাবেই ধর্ষিত হল আমাদের জাতীয় পতাকা, আর ধর্ষিত হলেন ৭১ এর ৩০ লাখ শহীদ, আর সেই সাথে দ্বিতীয় বার ধর্ষিত হলেন ৭১ এর নির্যাতিত মা বোনেরা।

দেশে চালু হল ভোটের রাজনীতি,ধীরে ধীরে একদা দেশপ্রেমিক আওয়ামী লীগ তাদের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে শুরু করল ভোটের রাজনীতি। অনেক ক্ষেত্রেই যাদের বদনাম ছিল ভারতের এজেন্ট বলে, সেই বদনাম কারীরা ধর্ম কে আশ্রয় করে রাজনীতি করে।

৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে সাধারন মানুষজন ধর্মের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত সহানুভূতিশীল হয়েছে ধাপে ধাপে; বলা যায় যে তাদের মধ্যে কৌশলে এটা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।এইবার পুর্বের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে আওয়ামী লীগও শুরু করল ধর্মের সাথে আপোষ।এ বড় ভয়ংকর আপোষ ধর্ম নিরপেক্ষতার ছদ্ধবেশে ধর্মাশ্রিত রাজনীতি( আজ শেখ হাসিনা শরিয়া আইনে বিচারের হুমকি দেন)।

কোন রকম বাছ বিচার করেই দলে নতুন দের স্বাগত জানাতে লাগল, যাদের ভিতর ছিল অসংখ্য যুদ্ধাপরাধী।বঙ্গবন্ধু কে করে ফেলা হল আওয়ামী লীগের নিজস্ব সাইনবোর্ড।যেই বঙ্গবন্ধু তোষন করে, সেই আওয়ামী লীগের প্রিয় পাত্রতে পরিনত হয়।এইভাবেই যুদ্ধাপরাধীরা একদা মুক্তি যুদ্ধের নেত্রত্ব দান কারি দলটির ভিতর আসন গেড়ে বসল। আর আজ রাজাকার দের বিচারের নামের প্রহসন এটারই ফল।

এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বুঝাই যাচ্ছে যে এটা দীর্ঘ দিনের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফসল, আর এখানে এইসব ষড়যন্ত্র কারীরা সম্পুর্ন সফল। আর তাই আজ ৪০ বছর পর শুরু হল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, যখন তারা পুরাপুরি সুসংগঠিত। প্রত্যেক দলের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ ভাবে এদের প্রচন্ড প্রতাপ। পিছনে আছে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট; যেহেতু তাদের দাঁড়ি আছে, আর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ধর্ম প্রচার এরাই করে থাকে।কাজেই এদের বিরুদ্ধে বেশি কিছু করতে গেলে ভোটের রাজনীতিতে হেরে যাতে হবে, বর্তমান সরকার কে।

আর যেহেতু আদালতের রায়কে চিরকালই সরকার প্রভাবিত করে এসেছে, কাজেই যুদ্ধাপরাধী দের বিচার যে সরকার প্রভাবিত হতে পারে, এই দাবীর পক্ষেও শক্ত অবস্থান তৈরী হল প্রতিটি দলে যুদ্ধাপরাধীদের উপস্থিতির কারনে।

কিন্তু কাদের মোল্লার রায় বর্জন করে দেশের মানুষ সক্রিয় ভাবে আজ রাজ পথে নেমেছেন।এটা খুবই আশার কথা।এর মাধ্যমেই আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করতে পারি আমরা, সত্যিকারের ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের।এটা একটা পরিবর্তনের হাওয়া।দেখে মনে হচ্ছে সত্যি দেশ বাসী এক হয়েছে।তবে এই আন্দোলন থেমে গেলে হবে না। কারন এই আন্দোলন যদি ব্যর্থ হয় , তবে দেশের রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীরা আরো জেঁকে বসবে।এর ফলাফল হবে বাংলাদেশের তালেবানী আফগানিস্তানে পরিনত হবার মাধ্যমে; যেমন শিবির আগে মিছিল করত , ” আমরা হচ্ছি তালেবান, বাংলা হবে আফগান”

কাজেই যুদ্ধাপরাধীরা যেন এ দেশের রাজনীতি থেকে চিরকালের জন্য বিতাড়িত হয়, সেই ব্যবস্থা করার এটাই সময়।আগে পত্রিকাতে পড়তাম যে আরেকটি মুক্তযুদ্ধ দরকার এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের নির্মুল করতে, ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে, আর ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ পড়তে।

আজ মনে হয় সেই মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আজ দেশের মানুষ এক হয়েছেন । তাঁরা সরকার তো বটেই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও সমালোচনা করার আর সেটা বর্জন করার সৎসাহস অর্জন করেছেন ।ভারতে মানবতা বাদী লেখিকা অরুন্ধতী রায় একবার বলেছিলেন যে, আদালতের সমালোচনা করার সাহস যারা রাখেন, তাঁরা পরিণতির কথা চিন্তা করেন না।

শাবাশ বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের জনতা। এগিয়ে চলুন আর এই নতুন মুক্তি যুদ্ধকে সফল করুন,এই জোয়ার যেন থেমে না যায়।

বি.দ্র. এটি আমার প্রথম লেখা। একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।ভুল ত্রুটি আর লেখার দুর্বলতা গুলো পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করি।
……………………….
তথ্যসুত্রঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ইতিহাস, আর মুক্ত মনার এই সঙ্ক্রান্ত কিছু লেখা, আর প্রতিদিন কার ঘটনা বলির সাথে আমার নিজস্ব কিছু অভিমত।