ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট এক দেশ আমি- নাম আমার বাংলাদেশ। কবে আমার জন্ম তা আমি নিজেই জানি না- তা ধরো এক দুই বা তিন লক্ষ বছর আগে হতে পারে। তবে তোমরা যেভাবে জন্মাও ঐ ভাবে আমাদের জন্ম হয় না। আমার জন্ম হয়েছিল সাগর পাহাড় নদী থেকে – একটু একটু করে। মোটকথা ঠিক তোমাদের মত আমি না। তারপরেও আমি সব দেখি শুনি বুঝি। কত মানুষ, কত রাজা বাদশা আমার বুকে জন্ম নিল, গেল তার কি হিসাব আছে! কেউবা আবার ভিন্ন মাটি থেকে, ভিন দেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো, রাজা হলো, ভালো মন্দ কত কি করলো তারা।

আমার পুরান দিনের কথা কতটা জান তোমরা? কত পেছনে যেতে পারবে তোমরা! আমার স্মৃতিতে কিন্তু সব আছে- অনেক অনেক পুরান দিনের সেসব কথা বললে তোমরা বিশ্বাসই করবে না। তাই তোমরা যা জান, সেসব থেকে কিছু বলার জন্য আসলে আজকে আমি কাগজ কলম নিয়ে বসেছি। ভেবেছিলাম এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে, তোমরা সঠিক পথে আসবে, কিন্তু তা হবার নয়। এমনিতে কিছুই হয় না। ভাল হোক খারাপ হোক, কোন কিছু ঘটাবার জন্য, ঘটবার জন্য একটা কার্য্য-কারণ থাকতে হয়। থাক ওসব ত্বত্তকথা- যা বলার জন্য এত আয়োজন তাই বলি।

এই তিন-চার দিন আগের কথা- খুব বেশী দূরের নয়। আশা করি স্মরণ করতে পারছো। কেন পারবে না! তোমরা তো আর গোল্ডফিশ নও। আমার পাশেই থাকে এক মা, নাম তার ভারত, সেদিন স্মশানে দেখা হওয়াতে গর্বে বুক ফুলিয়ে বললো- দেখ আমার এক বীর কন্যাকে চিতায় তুলছে। আমি বোকার মত প্রশ্ন করে বসলাম- কেন এতে গর্বের কি আছে? দেখলাম আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে মুখ তার উজ্জল হয়ে উঠলো সূর্য্যের দ্যুতিতে। মাথাটা খাড়া করে গর্ব করে তিনি বললেন- মানুষ নামের কিছু পশু আমার মাসুম কন্যাটাকে খুচিয়ে খুচিয়ে রক্ত ঝরিয়ে মেরেছে ঠিকই, কিন্তু আমার অন্য ছেলে মেয়েরা ঘরে বসে থাকেনি, তারা রাস্তায় এসে বুকটান করে দাড়িয়েছে। এদেরকে নিয়েই আমার গর্ব। অন্যায়কে তারা পদানত করতে পেরেছে তাতেই আমার গর্ব। ঐ মায়ের কাছে আমার মাথা হেট হয়ে গেল। সাথে সাথে আমার মনে পড়ে গেল বিশ্বজিত, ইয়াসমিন সহ আমার আরও অনেক ছেলেমেয়ের কথা। আমার সেই সব সন্তানদের কি পাশবিক নির্যাতনেই না মেরে ফেলা হলো, অথচ একটা হাত-পাওয়ালা মানুষ ঘর থেকে বারিয়ে এসে বলতে পারলো না- এই, তোমরা অন্যায় করেছ, তোমাদের শাস্তি পেতেই হবে। জান, ঐ মায়ের উত্তর শুনার পর আমি আর বেশী সময় শ্মসানে থাকতে পারিনি। ঘরে ফিরে প্রচুর কেঁদেছি। সারা রাত নিদ্রাহীন আমি ভেবেছি, শুধুই ভেবেছি- বর্তমানে আমার গর্ব করার মত তাহলে কি কিছুই নেই?

তোমরা কেমন মানুষ গো? তোমাদের এত জানের ভয় কেন? কোন কাজকে অন্যায় জেনে একসাথে সবাই রাস্তায় বেরিয়ে এলে তোমাদের গায়ে কেউ টোকা দিতে পারে না- জান মাল হারাবার কোন ভয় থাকে না তখন। মনে রেখ স্বার্থপরের মত গা বাচিয়ে তেলাপোকার মত টিকে থাকা যায়, কিন্তু মানুষের মত বেচে থাকা যায় না। তোমরা কি মানুষ? এই জন্যেই তোমাদের শাসকেরা কেমন ভয়ঙ্কর সব পশু আর দানব হয়ে উঠে। আর যুগের পর যুগ তৃনভোজী জন্তুর মত তোমরা পড়ে পড়ে তাদের মার খেতে থাক। তোমরা কি মানুষ?

দলে দলে সাধারন মানুষ যখন অন্যায় নামের ভয়াবহ পশুটাকে পায়ের নীচে চেপে ধরতে পারে, তার যে গর্ব, তার সাথে কোন কিছুর তুলনাই হয় না আমার কাছে। এমন একটা অহংকারের স্বপ্ন দেখি আমি সব সময়। অন্য কোন কিছুর সাথে এর তুলনাই হয় না। আমার সন্তানেরা আমার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে, সেই বিশ্বাস আমি হারিয়ে ফেলি মাঝেমাঝে। তোমাদের কীর্তিকলাপ আমাকে তা করতে বাধ্য করে। কত জাতি, কত মায়ের সন্তানেরা অল্প সময়ে তরতর করে উপরে উঠে গেল- তোমরা কিছুই পারলে না। তোমরা শুধু বড় হয়ে যাওয়া জাতিগুলোর ভিতরে ষড়যন্ত্রের দুর্গন্ধ খুজে বেড়াও। তাদেরকে শত্রু ভেবে মনে মনে অলীক গর্ব গড়ে তোল। শত্রু হতে গেলেও কিছু যোগ্যতা অর্জন করতে হয় এবং অনেক সময় তা শত্রুর কাছ থেকেও শেখা যায়। যুগ পাল্টাচ্ছে- এখন শত্রু -জয় শুধু যুদ্ধ দিয়ে হয় না, অন্য কিছু দিয়েও করা যায়। সেসব ভাবো। আমি পাঠশালার গুরু মশাই না যে সারা জীবন শুধু শ্লেট-পেন্সিল পিশে যাব। মনে আসলো তাই বললাম। আমার অন্য অনেক কাজ আছে। আমার এক ছেলে, কি জানি নাম তার, হ্যা, মনে পড়েছে- রবী ঠাকুর। সে দুঃক্ষ করে লিখল একবার- ‘পেঁচা রাষ্ট্র করে দেয় পেলে কোন ছুতা, জান না আমার সাথে সূর্য্যের শত্রুতা’। দালাল, ষড়যন্ত্র, উপণিবেশ- এগুলোর দোষ দিয়ে পার পাবে না, কারণ এগুলো সব প্যাঁচাদের শব্দ। তোমারা কি প্যাঁচা? প্যাঁচায় প্যাচায় ভরে গেছে আমার বুক? তোমরা আমাকে কেন যে মা বলে ডাকো ভেবে পাই না। মায়ের একটা স্বপ্ন পূরণ করেছ কখনো? দশ মাস দশ দিন একটা নারী সন্তান ধারন করে একদিন তা আলোতে বেরিয়ে আনতে পারে আর তোমরা বড় হয়ে যাওয়া জাতিগুলোর ভাল ভাল গুন অন্তরে ধারন করে একচল্লিশ বছরেও একটা জাতিকে আলো দেখাতে পারলে না? এই লজ্জা আমি কোথায় রাখি?

কোন কিছু আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। আমি সব খবর রাখি। হাজারটা পাপের লিস্টি থেকে দুয়েকটার কথা বলি, কারন নষ্ট করার মত অত সময় নেই হাতে। ব্যংক-বীমা-বায়তুলমাল-পদ্মাসেতু নিয়ে তোমরা যা করছ তা অসহ্য হলেও আমার সন্তানদের ধরে ধরে মেরে ফেলাটা আমার কাছে ক্ষমার অযোগ্য। শতাধিক পোশাক কর্মীকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা আর বিপ্লব নামে এক নৃশংস পশুকে ক্ষমা করে দেয়াটাকে আমি কোন দিনই ক্ষমা করতে পারবো না। তোমরা তাই করেছ। কেন এত বারবার তোমরা তোমরা করছি জান? তোমদের শাসকেরা কদাকার কাজগুলো করছে আর তোমারা তা সহ্য করছ। কারন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃনা তারে যেন তৃণসম দহে’। আবার সেই রবী ছেলেটার লেখালেখী স্মরণ করলাম। এবার তোমরা কি তোমাদের আসল শত্রুকে চিনতে পেরেছ? সে কি ব্যক্তি, ধারনা, না কি বিমূর্ত কিছু? সানাক্ত করতে হবে তোমাদেরই।

মাঝেমাঝে তোমাদের কীর্তিকলাপ দেখে লজ্জায় আমার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহনন করতে ইচ্ছে জাগে। ইচ্ছে করে সব ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ঝাপ দেই। আমার কোটি কোটি অসহায় নিস্পাপ সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে আমি সে ইচ্ছা থেকে নিবৃত হই। এখনো সময় আছে- তোমরা যদি সংশোধন না হও, তবে সময় তোমাদের ক্ষমা করবে না। বিলুপ্তপ্রায় পান্ডা প্রজাতির মত বিলীন হয়ে যাবে সময়ের গহবরে। মনে রেখ আমি শুধু অতীতই মনে রাখি তা নয়, আমি ভবিষ্যতও দেখতে পাই। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি- তোমরা যদি এভাবে চলতে থাক, তবে তোমরা প্রতিস্থাপিত হবে অন্য জাতির দ্বারা। শৃঙ্খলিত হবে প্রত্যক্ষে অথবা পরোক্ষে ভিন-জাতি দ্বারা। তখন আমাকে দোষ দিতে পারবে না, মনের ক্ষেদ মিটানোর জন্যে বলতে পারবে না-

ধিক ধিক ওরে, শত ধিক তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার- এই কি জননী তুমি!