কফিল কাঙ্গাল

এ মুহূর্তে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে হিংস্র প্রাণী কোনটি? উত্তরে বলবো, মানুষ (স্বদেশের প্রেক্ষাপটে)! কারণ আমার অন্তত জানা নেই পৃথিবীর এমন প্রজাতি আছে কিনা, যারা স্বজাতিকে এতো বেশি ভয় পায় এবং ঘৃণা করে! জানা নেই স্বজাতিকে এতো কুৎসিতভাবে অন্য কোন প্রাণী আক্রমণ বা হত্যা করে কিনা! মান+হুশ=মানুষ অর্থাৎ যার আছে মান এবং হুশ তাকেই বলে- মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, যার আছে মানি এবং যিনি/যারা বেহুশ তারাই- মানুষ! কারণ মানির কাছে আমরা মান-সম্মান বিকিয়ে দেই, মানিতেই হয়েছি বেহুশ!

বিশ্বজিতের নির্মম-নিষ্ঠুর, হৃদয়বিদারক মৃত্যুদৃশ্য দেখে এদেশের মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণা পুরোপুরিই পাল্টে গেছে। এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। নিজেকেও যেন আর মানুষ ভাবতে পারছি না! প্রথম আলোতে বলা হয়েছে, বিশ্বজিত নাকি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় গিয়েছিলো! কিন্তু আমি, আপনিও তো ভুল জায়গায় রয়েছি, আমরাও তো যে কোন সময় বিশ্বজিত হতে পারি। পত্রিকাটি বলেনি বাংলাদেশের ঠিক জায়গা কোনটি? আমি মনে করি দেশের এক ইঞ্চি জায়গাও সাধারণদের জন্য নিরাপদ নয়। যারপর নাই এ পৈশাচিক খুন দেখে কেন জানি ঘুমোতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে ওই নিকৃষ্ট জন্তুগুলো কারা জন্ম দিয়েছে, কারা প্রতিপালন করছে? যারা এদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে, তাদের কি সন্তান নেই? তারা কি হিযড়া?

বিশ্বজিৎ হত্যার পর চিরায়ত সনাতন পদ্ধতিতে বিএনপি বলে ফেললো, ও তাদের কর্মী, পরবর্তীতে হয়তো আমি হিন্দু… আমি হিন্দু… আমি বিএনপি করি না… শুনে এবং ধোপে টিকবে না ভেবে আগ বাড়ায়নি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, সত্যিই যদি বিশ্বজিৎ হিন্দু না হয়ে মুসলমান হতো তাহলেই বিএনপি ওকে ভূত বানিয়ে অন্ধ ভক্তি-শ্রদ্ধাকাতর এ জাতির মাথায় ঢুকিয়ে দিতো এবং এ নিয়ে আরো কয়েকটি হরতাল, আরো কয়েকটি লাশ পড়তো এবং বিশ্বজিত ওই লাশগুলোর তলে অনেক আগেই চাপা পড়ে যেতো। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন বদনীতিবিদদের কথাবার্তা (ব্যাখ্যা নিসপ্রয়োজন) শুনে ক্ষোভ না কমে বরং বেড়েই চলেছে। দুর্ভাগ্য আমাদের এই দেশে আমরা সবাই লেখালেখি করেই ক্ষোভ মিটাই। তথাকথিত মানবতাবাদী বা ক্ষমতাধর কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আমাদের মতো সাধারণ/ক্ষমতাহীনদের মৃত্যুর জন্য উভয় জোটকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণের মামলা করে না, একটি দিনের জন্যও হরতাল ডাকে না, মামলা বা হরতাল হয় শুধু নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ধরে রাখার জন্য আর বলির পাঁঠা হই আমরা। ওদের সন্তান যদি এভাবে খুন হতো দেশে লংকাকান্ড ঘটে যেতো , সাধারণেরাও হায় হোসেন-হায় হাসান করতে করতে রাস্তায় নেমে পড়তো, দেশ অচল করে দিতো, অথচ বিশ্বজিতের বেলায় কেউ রাস্তায় নেই । সৎ ও সঠিক নেতৃত্ব এবং নিজেদের মেরুদণ্ডহীনতার কারণে আমরা সাধারণেরাও এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামি না, জোরালো কোন প্রতিবাদও করি না। তিউনিসিয়াতে এক ফুটপাথের দোকানী সরকারের জুলুমের প্রতিবাদে আত্মহত্যা করলে সারা আরবে কি না হলো! যদিও ফলাফল, যে লাউ সেই কদু। তথাপিও একটা ওলট-পালট তো হয়েছে, অন্তত পুরানো মদ নতুন বোতলে ঢুকেছে। আমরা তো সেটাও চাইছি না; পুরানো মদ পুরানো বেতালে রাখতেই পছন্দ করছি (অর্থাৎ একবার হাসিনা আরেকবার খালেদা)!

অতএব এদেশে আজীবনের মতো পরিবারতন্ত্র চলতেই থাকবে আর আমরা একে একে বিশ্বজিৎ, সাগর-রুনি হবে বা বাসে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে কাবাব হবো, লগি-বৈঠার বাড়ি খেয়ে মরবো… আর ওরা মিথ্যাচারের গালগল্প শোনাবে, হত্যাকারিদের সবাই চিনলেও পুলিশ চিনবে না, ঘুষ খেয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দেবে! ডাক্তার ঘুষ খেয়ে চাপাতির কোপগুলোকে বলবে ফুলের আঘাত বটে, কেমনে বেটারা বলে চাপাতির কোপ! বড় বড় বদনীতিবিদেরা বলবে, আল্লা/ভগবান ওর মৃত্যু তো ওখানে, ওইভাবেই লিখে পাঠিয়েছিলো, ওই দিন ঠিক সময়মত ও সঠিক স্থানে গিয়েছিলো এবং যমদূতও ঠিক সময়মত এসেছিলো, একটু আগে-পরে হলে তো বিশ্বজিত বিশ্ব ছাড়তো না; এতে আমাদের বা আমাদের সোনার ছেলেদের দোষ কি? এতো বলছি, ওরা আমাদের সোনার ছেলে, দেশের সম্পদ, ভবিষ্যতের মন্ত্রী-এমপি, দেশ ও জাতির সেবক, তারপরও মূর্খ পাবলিকগুলা কইতেছে, ওরা হেরে চাপতি দিয়া কোপাইয়া মারছে! কি আশ্চর্য! পাবলিক কি সব ভোদাই! আল্লার মাল আল্লায়/ভগবানের মাল ভগবান না নিলে চাপাতির কি জোর আছে কারো জান কবজ করে! এদেশের বোকা পাবলিক, একটা কিছু হোনলেই বিশ্বাস করে! ওরাই মিথ্যা বলছে! আমাদের লোকেরা মিথ্যা বলতে পারে না, পুলিশ ও ডাক্তার মিথ্যা রিপোর্ট দিতে পারে না…!

পাতি বদনেতারা বলবে, আরে এইডা তো আছিলো “যাদুমন্ত্র” নামক এক সিনেমার কোপাকুপির স্যুটিং! যাগো ছবি পত্রিকায়, টিভিতে দেখা গেছে ওরা গেছিলো অরে বাঁচাইতে! ওরা হইলো নায়কের লোক, নায়কের লোকেরা তো খারাপ হইবার পারে না, খারাপ হইলো গিয়া ভিলেনের লোকেরা। ওরা হইলো ফেরেশতার নাহান পবিত্র, শয়তান যমদূতই না ওগো হাতে কোন ফাঁকে ফুলের বদলে চাপাতি তুইল্যা দিচ্ছে ওরা ভুল কইরা বোঝে নাই- ওইডা ফুলের তোড়া না চাপাতি! হাতে দেখছিলো ফুলের তোড়া, ভাবছিলো অরে একটু ফুলেল আদর করি, কিন্তু শয়তানের কুমন্ত্রণায় ওই ফুলেল আদরেই যে বিশ্বজিৎ বিশ্ব ছাইড়া মহাবিশ্বে চইল্যা যাইবো তা কি সোনার ছেলেরা জানতো! তাইলে কি এই কাম হইতো! নিজেগো দলেরে, নিজেগো পালক পিতা-মাতারে কি কেউ বিপদে ফেলে! এইডা তো হইল নিছক দুর্ঘটনা! হেইর লাইগাই তো পুলিশ যহন সুরতহাল করলো, চাপাতির কোপ পাইল না, যারা কোপাইলো তাগো চিনলো না, সন্ত্রাসী অইলে আর কেউ চিনুক বা না চিনুক পুলিশ চিনতো, কারণ পুলিশ জানে কয়ডা সন্ত্রাসী ঢাকার কোনহানে থাহে, হেগো চেহারাও মুখস্ত! আবার দেহেন ডাক্তার যহন পোস্টমর্টেম করলো একটাও চাপাতির কোপ পাইলো না বিশ্বজিতের গতরে! হেইডাই বড় প্রেমাণ (প্রমাণ) যে ওরে যমদূত লইয়া গেছে, নাইলে চাপাতির কোপ গেলো কই?

আমার শিক্ষাদীক্ষা নেই, লেখকও নই, মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকলেও ভাবছিলাম এ নিয়ে কিছু বলবো না, কিছু লিখবো না, বলে আর লিখে হবেটা কি? কারণ এ নিয়ে বিখ্যাত লেখকরা বহু লেখালেখি করে ফেলেছে, আরো কদিন চলবে, তারপর আসবে আরেক বিশ্বজিৎ, থেমে যাবে এটা, ওটা চলবে কিছুদিন। যেমন, বুদ্ধবিহারের তান্ডব থামিয়ে দিলো গার্মেন্টেসের আগুনে পুড়ে কবাবা হওয়া শ্রমিকেরা, আবার সেই আগুন থামালো বিশ্বজিৎ… এটাই তো এদেশের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অতএব বদনীতিবিদদের প্রতি সবিনয় আবেদন, কুকুরের কাছে শিখুন প্রতিপক্ষ বা ভীত-সন্ত্রস্ত্র কোন ব্যক্তি বা পশুকে কতোটুকু আঘাত করবেন! ভাবছেন, কেমন করে শিখবেন? ক্লাস করতে হবে কিনা? পরীক্ষা দিতে হবে কিনা? আরে না, না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাশের সার্টিফিকেট নিতেও তো আপনাদের কোন ক্লাস করা বা পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না, ক্ষমতার দাপটে এমনিতেই ওসব এসে যায়! তাছাড়া সেখানে তো আপনাদের দলীয় প্রভু তথা দলীয় শিক্ষকরা রয়েছেন। হিংস্রতা কতোটুকু দেখাবেন, তা কুকুরের কাছে শিখতে তেমন সময় লাগে না এবং একপয়সাও খরচ হয় না। শুধু কুকুরের মারামারি দৃশ্য দেখবেন আর একটু চিন্‌তা করবেন, অমনি জিপিএ-৫!

যাহোক, সেদিন হঠাৎ দেখলাম, তিনটি কুকুর অন্য একটি কুকুরের ওপর একত্রিত হামলা চালালো (তখনিই বিশ্বজিৎ হ্যতাকারী প্রভুভক্ত কুকুরগুলো ছবি আমার চোখে ভেসে উঠলো) কিন্তু বাস্তবের এ কুকুরগুলো কারো প্রভুভক্ত পোষা কুকুর নয় (রাস্তার কুকুর), ওরা স্বার্থান্ধ-উম্মাদও নয়; ওরা মানুষরূপী কুকুরও নয়; মানুষের ন্যায় বহুরূপীও নয়; ওরা খাঁটি, একদমই খাঁটি কুকুর। আক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গেই আক্রান্ত কুকুরটি তার লেজটি নিচু করে পেছনের দুই পায়ের মাঝে ঢুকিয়ে দিয়ে, পেছনের পা দুটি কিছুটা ভাজ করে ঘাড় বাঁকিয়ে নিচু স্বরে ঘেউ ঘেউ করছে, এরই মধ্যে ওরা আক্রান্ত কুকুরটিকে দুই-একটা কামড় দিয়ে ফেলেছে বটে। তবে দেখে মনে হলো ওদের কামড়ে তেমন একটা ধার ছিলো না। এরপর আক্রান্ত কুকুরটির ভীত-সন্ত্রস্ত চেহারা দেখেই হয়তো বা আক্রমণকারী কুকুর তিনটি দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করতে থাকলো আর আক্রান্ত কুকুরটি আস্তে আস্তে সোজা হয়ে, লেজটি একটু খাড়া করে ধীরপায়ে সামানের দিকে এগিয়ে গেলো। যাবার সময় লেজটি ডান্তেবামে এমন করে নাড়ালো যা দেখে মনে হলো আক্রান্ত কুকুরটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে করতে চলে গেলো। এ দৃশ্যটি দেখে মনে হলো, আমরা কি কুকুরের চেয়েও অধম হয়ে গেছি? আত্মসমর্পণ কাকে বলে তা কুকুরে বোঝে, অথচ মানুষে বোঝে না! হায়রে মানুষ!

অতএব প্রতিপক্ষ, শত্রু অথবা সাধারণ নিরস্ত্র ব্যক্তিদের প্রতি বদনীতিবিদ ও দলীয় লাইসেন্সপ্রাপ্ত খুনি ছাত্রদল-ছাত্রলীগ-শিবিরদের… কুৎসিত বীরত্ব প্রকাশের আগে এ শিক্ষাটি নেয়া অত্যন্ত জরুরি! কারণ পুঁথিগত কিছু বিদ্যা ছাড়া অন্য কোনো বিদ্যা ওদের নেই বললেই চলে, দলীয় শিক্ষকের কৃপা, নকল বা অস্ত্র ঠেকিয়ে সার্টিফিকেট তৈরি ছাড়া ওদের কি অন্য কোন বিদ্যা আছে? যদি কারো থাকেও তা বিদ্যা নয়, কুবিদ্যা! অথচ দেখুন, একটি কুকুর যখন বশ্যতা স্বীকার করে বা ওদের এলাকায় ভুল করে ঢোকার জন্য অপরাধ করে ফেলেছে এমন ভাব দেখায় অথবা জানায় যে আমাকে মাফ করে দাও, তাহলে অন্যান্য কুকুরগুলো তাকে মাফ করে দেয়, কিন্তু বিশ্বজিত যখন চিৎকার করে বলছিলো, আমি হিন্দু… আমি হিন্দু… আমি বিএনপি করি না… অর্থাৎ বিশ্বজিত বুঝেছিলো আওয়ামী লীগ তাদের প্রাণের দল (কারণ এদেশের সংখ্যালঘুরা প্রায় সবাই তাই) তাই তার পরিচয় পেলে হয়তো ওরা বাঁচতে দেবে। কিন্তু আমি হিন্দু… না বললেও সন্ত্রাসীরা যখন দেখলো একজন নিরস্ত্র যুবক এবং সে তাদের বিরুদ্ধে রুখেও দাঁড়ায়নি, বশ্যতা স্বীকার করেছে, অনুনয় বিনয় করছে, প্রাণ ভিক্ষা চাইছে… তখনও মানুষরূপী এসব কুকুরগুলো থামেনি বা ভালো করে তার কথা, তার পরিচয়টুকু নেবার প্রয়োজনবোধ করেনি! এরূপ আকুতির পরও ওকে কুপিয়ে, পিটিয়ে, উপস্তিত সকলকে ওদের মহা-বীরত্ব জানান দিয়েছে! এরপরও কি বলবো যে, ওরা (হত্যাকারীরা) এবং ওদের প্রতিপালকেরা রাস্তার ওই কুকুরগুলোর চেয়ে উত্তম? এদের পালক-পিতারা এমনভাবে এদের লালন্-পালন করেছে, প্রকাশে অস্ত্রবাজী করে বীরত্ব দেখাতে শিখিয়েছে যেন সবাই তাদের ভয় পায়, দেখলেই সালাম ঠুকে, চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায়, চাঁদা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তা দিয়ে দেয়। গডফাদারদের আশির্বাদপ্রাপ্ত হয়ে অতি সহজেই এরূপ সম্মান্ত-প্রতিপত্তি লাভ করতে পারলে কেন আর কষ্ট করে পড়াশোনা করা! গডফাদারদের অর্ডার কার্যকরী না করলে পদোন্নতি হবে না, অর্থ পাবে না, বিশাল মাপের নেতা হতে পারবে না, ভবিষ্যতে মন্ত্রী-এমপি হতে পারবে না…! তাই তো এতো বীরত্ব প্রদর্শন।

এদেশে ভবিষ্যতের দেশনেতা হওয়ার প্রথম ও প্রধান উপাদানই যখন মাস্তানী, তখন ওদেরই বা দোষ কি? আর এসব কুকুরগুলোই ভবিষ্যতে বড় নেতা হয়ে সংসদে যাবে কামড়া-কামড়ি করবে! দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে, সংসদে মারামারি-কামড়াকামিড়তে সুবিধা না হলে রাস্তার কুকুর হয়ে আমাদের কামড়াবেই! এই তো বাংলার বদনীতি! এরা নিশ্চিত জানে, এদের রয়েছে শক্ত খুঁটি, যতোবড় অপরাধই করুক আজ হোক কাল হোক গডফাদারদের বদৌলতে তা ধামাচাপা পড়বেই এবং তারা বেরিয়ে এসে আবার একই কাজ করবে। প্রকাশ্যে যে যতো বেশি অস্ত্র হাতে বীরত্ব প্রকাশ করতে পারবে সেই তো ততোবড় নেতা বনে যাবে এমন শিক্ষাই তো প্রতিপালকরা দিয়েছে। অতএব আমাদের লেখালেখি ছাড়া আর কি-ই বা করণীয় আছে? অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন কেনো জনগণ সেদিন বিশ্বজিতকে ওভাবে মরতে দেখেও বাঁচাতে এগিয়ে গেলেন না? অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমি হলেও এগিয়ে যেতাম না কারণ তাহলে আমিও বিশ্বজিতের সাথে কিমা হতাম। কারণ হিংস্রতার মহামন্ত্রে বলীয়ান স্বার্থান্বেষী খুনের নেশায় উম্মত্ত ওসব পাগলা কুকুরদের বাধা দেয়ার শক্তি তখন স্বয়ং বিশ্বজিতের ভগবানের বা আবুলের আল্লারও থাকে না, একমাত্র আপন প্রভু ছাড়া (যাদের বড়ভাই বলা হয়)! বড়ভাইয়েরা হাত তুললেই সব থেমে যায় নিমিষেই, আবার হাত তুললেই আরম্ভ হয় বীরত্ব!

কুকুরের মারামারি সময় প্রভুর আদেশ পেলে ওরা যে কি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তা বহু দেখেছি। এসময় প্রভুর হুকুম ছাড়া কুকুর যেন থামতেই জানে না এমন হিংস্র হয় ওরা। ছেলেবেলায় এরূপ অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই বড় হয়েছি। যখন অন্য পাড়ার কোন কুকুর আমাদের পাড়ায় ঢুকে পড়তো পাড়ার কুকুরগুলোকে ক্ষেপিয়ে দিতাম। যতোক্ষণ আমরা ছো-ছো… বলতাম ততোক্ষণ আমাদের পাড়ার কুকুরগুলো খুব বীরত্বের সাথে আক্রমণ চালাতো, যখন বলতাম থাম বা হাত উঁচিয়ে থামার ইশারা দিতাম ওরা থেমে যেতো এবং কামড়াকামড়ি বন্ধ করে আমাদের কাছে এসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতো যেন কতোবড় বীর ওরা। অথচ যদি আমরা ছো-ছো… বলে ক্ষেপিয়ে না দিতাম অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে দু-একটি কামড় দিয়েই ওরা ফিরে আসতো। ঠিক একই নিয়ম মানুষরূপী কুকুরগুলোর বেলাতেও প্রযোজ্য…।

আমি টেলিভিশন দেখি না। কারণ ঘরে ডিসের লাইন নেই, বিটিভি তো দলীয় টিভি তাই ওটাকে ঘৃণা করি। ফলে বিশ্বজিতের লাইভ কোপাকুপি দেখি নাই। কিন্তু পত্রিকা পড়ার নেশা আছে বলে, পত্রিকার ছবিগুলো না দেখে পারিনি। হয়তো এ ছবিগুলো না দেখলেই ভালো করতাম। যাহোক, বিশ্বজিতের মৃত্যুর পর আবার মেজাজ খিটখিট করছে, কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না, কাজে মন বসছে না। কেন এমন হয় জানি না, সাগর-রুনির খুনের ঘটনা পড়েও এমনটি হয়েছিলো। বিএনপি-জামায়াতের পিকেটার-সন্ত্রাসীদের হাতে যে ড্রাইভারটি সারারাত বাস চালিয়ে এসে ক্লানি-তে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে ঘুমন্ত অবস্থায় বাসশুদ্ধ পুড়ে কাবাব হয়েছিলো এবং যে দুজন শ্রমিককে ট্রাক্সিশুদ্ধ পুড়েছিলো (একজন নিহত অন্যজন মারাত্মকভাবে আহত) সে ঘটনা ছাড়াও গার্মেন্টেসের ১১২ জন কাবাব হলো… আরো এমন অনেক ঘটনাই আছে, একটার তান্ডবে আরেকটা ভুলে যাই। জানিনা এরূপ বদনীতি আর কতোদিন চালাবে খালেদা-হাসিনার দুই মহাজোট। কোনো কোনো দলীয় সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবিরা (এখন অবশ্য প্রায় সবাই দলীয় চামুচ, যাদের লেখায় বেশ চালাকি থাকে) এমনভাবে লিখে ও বলে যা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। তারা একই ঘটনা একেক পত্রিকায় একেক রকমভাবে লিখে মানুষকে ধোকা দেয়। এছাড়া তারা তুলনা দেয়, হাসিনা ভালো না খালেদা ভালো। কে কম হরতাল করলো, কে বেশি করলো, কে বেশি মানুষ পিটিয়ে/কুপিয়ে কিমা বানালো, পুড়িয়ে কাবাব বানালো, এসব বিতর্ক নিয়ে মত্ত থাকে কিছুদিন, এরপর আবার আসে নতুন কিছু… এভাবেই চলছে স্বদেশ মুরগির পিঠে!

আমাদের গ্রাম এলাকায় একটি কথ্য প্রবাদ রয়েছে, “গু-র হগল পিট ভালো” অর্থাৎ পায়খানার সব দিক/পিঠই ভালো। জানিনা হাসিনা-খালেদার ভূত আমাদের মগজ থেকে কোনোদিনও যাবে কি না? জানি, আমরা পরগাছা, নিজেদের চিন্ততা নিজেরা করতে জানি না। উপর মহল অর্থাৎ কথিত রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ… যা পত্রিকায় লিখে, টেলিভিশনের টকশোতে (মিষ্টিশো কখনোই নয়) যা বলে তাই অন্ধভাবে বিশ্বাস করি এবং তা নিয়ে চায়ের দোকানো তুফান তুলতে থাকি। আরেকটি সমস্যা আমাদের সাধারণ সমর্থকরা যে যেই দলের সমর্থক সেই দলের পত্রিকা পড়েই খুশি এবং নেত্রীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন, সত্য-সঠিক খবরটি তারা জানে না, কেউ বললেও তা বিশ্বাস করে না। আমি মনে করি, নেতা-নেত্রীদের প্রতি এরূপ অন্ধবিশ্বাস, ভক্তি-শ্রদ্ধাই আমাদের অন্যতম মূল সমস্যা! এর ফলে আমার কোনদিনও একত্রিত হয়ে ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবো না, ওদের প্রাসাদ ঘেরাও করতে পারবো না… একথা বদনীতিবিরা খুব ভালো করেই জানে এবং সে সুযোগের সম্পূর্ণটাই সদ্‌ব্যবহারও করে।

হিটলারের নাকি একজন গোয়েবল ছিলো। যে নাকি হিটলারের সব মিথ্যাকে এমনভাবে প্রচার করতো, জনগণ বোকা বনে যেতে এবং বিশ্বাস করতো হিটলার সত্যিই তাদের একজন মহান নেতা। তাই বুঝি বিজ্ঞজনদের কথাই সত্য যে, একটি মিথ্যা ঘনঘন কয়েবার প্রচার হলে তা সত্যে পরিণত হয়! (যেমন হয়েছে আমাদের, আমরা বিশ্বাস করি, হাসিনা-খালেদা ছাড়া দেশ পরিচালনার কেউ নেই)। হিটলারের ছিলো একজন গোয়েবল আর আমাদের বদনীতিবিদের চারিপাশে অজস্র গোয়েবলস্ রয়েছে। রয়েছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে কথিত বুদ্ধিজীবি, ব্যারিস্টার, আইনজ্ঞ, ডাক্তার, সাংবাদিক… এমন কি বিচারপতিও। যারা হাসিনা-খালেদার পক্ষে কেউ কেউ কলমের যুদ্ধ করছে, কেউ কেউ শুধু রাস্তাঘাটেই নয় হাইকোর্টের মধ্যে হাতাহাতি লিপ্ত হলেও এদের লজ্জাবোধ আছে বলে মনে হয় না।

ধন্য হাসিনা-খালেদা! কারণ তাদের ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ এমন সুন্দর, সুযোগ্য, সুবাধ্য, সুঅনুগত… গোলেবলস্ পেয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এটাই এদেশের বদনীতিবিদদের প্রধান হাতিয়ার এরূপ বিভক্ত জাতি দ্বিতীয়টি আর হয় না। এই বিভক্তির কারণেই এদেশে কোনকিছুই হবে না, ফলে চিরদিনই আমাদের বিশ্বজিতের মতো কিমা অথবা ওদের লোভ-লালসা আর প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে কাবাব হতে হবে!

আর একটি বিষয়, পাকিস্তান আমলে কোন একটি কারখানা বা কোম্পানিতে/প্রতিষ্ঠানে একটিমাত্র ইউনিয়ন থাকতো; এবং তারা একজোট হয়ে কোন ঘটনার প্রতিবাদ করতো বা দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামতো। কিন্তু এখন একটি প্রতিষ্ঠানে ৩/৪ বা ততোধিক ইউনিয়ন কেন? এর উত্তর সকলেরই জানা। এসব পেশাজীবিদের প্রচণ্ড লোভ এবং বদনীতিবিদদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের অবৈধ সুবিধা আদায় করাই যেন এদের একমাত্র ধ্যান্তজ্ঞান। সমাজে এখন চলছে লোভের মহড়া, লোভ থেকে জন্ম নিচ্ছে নিত্য নতুন হিংস্রতা। আজ দেশের কথিত শিক্ষিত ও শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা নিজ নিজ পেশাজীবী সংগঠন বা ইউনিয়ন থাকতেও নিজেদের দাবি আদায় করতে পারে না। এমনকি জাতির বিবেক বলা হয় যাদের তারাও দুটি বড় দলের লেজুর হয়ে গেছে। সকলেই বিভক্ত হয়ে কেউ আওয়ামী, কেউ বিএনপি, কেউ জাতিয়পার্টি… ফলে একটি মারাত্মক অঘটন ঘটলে, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে তারা দাবি আদায়ে একমত তো হতেই পারে না বরং হাসিনা-খালেদার পক্ষ নিয়ে নিজেরা আরো বেশি বিভক্ত হয় এবং হাতাহাতি, মারামারিতে লিপ্ত হয়। অদূর ভবিষ্যতে এরাও যে অস্ত্র হাতে নিয়ে খুনাখুনিতে লিপ্ত হতে যাচ্ছে এ আশংকা ক্রমশই বাড়ছে। অতএব লোভ না কমাতে পারলে খুব শিঘ্রই জাতি আরো বেশি হানাহানিতে লিপ্ত হতে বাধ্য হবে। অথচ লোভ দমনের কোন শিক্ষা আমরা এবং আমাদের শিশুরা পাচ্ছে না। এর পরিবর্তে চিরায়তভাবে পাচ্ছে গদবাধা ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্মীয় শিক্ষা যতোই পাক না কেন, সমাজের নীতিহীতার যে পরিবেশে শিশুরা বেড়ে ওঠে তাতে একজন শিক্ষিত নাগরিক পেলেও সুশিক্ষিত নাগরিক পাওয়া অদূর ভবিষ্যতে আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। শিক্ষা এবং সুশিক্ষাকে আমি দুটি ভিন্ন জিনিস মনে করি। একজন স্কুলে না গিয়েও সুশিক্ষিত হতে পারে কিন্তু অন্য একজন বড় বড় ডিগ্রি নিয়েও সুশিক্ষিত হতে পারে না, তাকে বড়জোর শিক্ষিত বলা চলে; এই শ্রেণীর মানুষই আজ সমাজে বেশি এবং এদের হাতেই এদেশের সমস্ত ক্ষমতা এবং ৮০% সম্পদ।

যাদের এই জ্ঞানটুকু পর্যন্ত নেই যে, এদেশের সাধারণ জনগণ আমাদের এতো সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে তাহলে ক্ষমতা হাতে পেয়ে তাদের উপর কি করে অত্যাচার অবিচার করি? প্রকাশ্যে অন্যায় করে তা ঢাকার জন্য কিভাবে একটার পর একটা মিথ্যাচার করি? কেন কোটি কোটি টাকা থাকতেও শেয়ারবাজার লুট, ডেসটিটি, হলমার্ক… ইত্যাদির ন্যায় কেলেংকারি করে গরিবের টাকা হাতিয়ে নিতে হবে, এরূপ নীতি-নৈতিকতা বিসর্জনকারীরাই তো আমাদের নেতা, পাতিনেতা… অথবা তাদের দোসর। এসব কথিত শিক্ষিত শ্রেণী যারা শ্রমিকদের রক্তচুষে নিজেদের সন্তান পাঠায় বিদেশে, বাড়ি-গাড়ি কিনে বিদেশে বসবাসের ব্যবস্থা ঠিক রাখে, কোটি কোটি ডলার বিদেশের ব্যাংকে পাঠায় নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায়, তবু শ্রমিকদের একটু বাড়তি বেতন দিতে তাদের হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। তাই আমি মনে করি এদেশের কথিত এই শিক্ষিত সমাজ মানসিকিতা ও মান-সম্মানের ক্ষেত্রে আমাদের মতো সাধারণ শ্রমিকেদের চেয়ে নিম্ন শ্রেণীর। তারা মোটেও দেশপ্রেমিক নয়, বরং শ্রমিকরাই বেশি দেশপ্রেমিক। কারণ বেশিরভাগ পুরুষ শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে দিনমজুরি করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায়, বেশিরভাগ নারী শ্রমিকরা দেশে বসে গার্মেন্টেসে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করে। অন্যদিকে ওইসব মালিক, সরকারী কর্মকর্তা, সাংসদ… এদের সন্তানেরা বিদেশ পড়াশুনা এবং স্থায়ী হওয়ার জন্য কোটি কোটি ডলার বিদেশে নিয়ে যায় বা পাঠায়। অথচ শ্রমিকদের আমরা সম্মান করি না, সম্মান করি ওইসব বদনেতাদের এবং তাদের সন্তানদের! অতএব শ্রমিকরাই ওদের চেয়ে দেশের বেশি উপকার করে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায়। আর নেতারা ও তাদের দোসররা ডলার পাচার করে দেশের ক্ষতি করে এবং রিজার্ভ কমায়। অথচ এসব শ্রমিকদের হাড় জিরজিরে রুগ্ন চেহারায় মালিক বা সরকার কারোই কোন কিছু আসে যায় না।

মনে হচ্ছে, অন্ধ আনুগত্য এবং ক্ষমতার লোভ আমাদের ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে, এর থেকে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। দিন দিন যেন আমরা হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়ে যাচ্ছি। এছাড়াও ভয়, এসব পালিত কুকুরগুলোই তো ভবিষ্যতে সাংসদ হবে, তথাকথিত জনসেবক, সমাজসেবক… হবে! এসবের জন্য অবশ্য আমরা সাধারণেরা কম দায়ী নই। কারণ আমরাই আমাদের মগজ খুলে ওদের হাতে দিয়েছি, ওদের মগজেই আমরা চলি। আমরা সাধারণেরা মগজ পাল্টিয়েছি ওদের বিশ্বাস করে ওদের হাতে তুলে দিয়ে আর কথিত শিক্ষিত শ্রেণী মগজ পাল্টিয়েছে স্বার্থের কারণে। অতএব আমরা অন্যের মজগে চলি, ভাবি, বলি… একথা বলছি কারণ, এদেশের (অনুমান) ৯০% মানুষই (সাধারণ-অসাধারণ) এই বড় দুটো দল/জোটকে নিয়ে সব সময় বিতর্ক করে কে ভালো, কে মন্দ… আমাদের মগজশূন্যতার যে কাজটি বদনীতিবিদেরা অত্যন্ত নিপুণতার সাথে করতে পেরেছে সেজন্যও তারা বেশ গর্বিত। তারা জানে যে, এদেশের সাধারণ মানুষ কতোটা মেরুদণ্ডহীন পরগাছা আর যাদের এক-আধটু মেরুদণ্ড রয়েছে তারা লোভী অতএব রাজনীতিবিদ তথা বদনীতিবিদদের কাছ থেকে এক-আধটু সুবিধা পেলেই বশ্যতা স্বীকার করবে এবং টু-শব্দটি করবে না। যদি কেউ টু-শব্দ করে তাকে দলে ভেড়ানোর জন্য রয়েছে বহুবিধ লোভ, লোভে পা না দিলে রয়েছে গুন্ডাবাহিনী।

বদনীতিবিদেরা আর একটি সূক্ষ্ম কাজ করে রেখেছে যা জাতির সমস্ত সর্বনাশের মূলে। তাহলো শিক্ষকদেরকে অবৈধ সুবিধা দিয়ে নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখা। কে কোন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হবে এবং ওদের পা-চাটবে সেই মোতাবেক ভিসি এবং অন্যান্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে এরা ছাত্রদের নিজেদের দলে টানতে এবং অবৈধ সুবিধা করে দিতে, দলীয় হুকম তামিল করতেই বেশি ব্যস্ত থাকে। এর ফলেই জন্ম নিচ্ছে ছাত্র নামধারী কথিত রাজনীতিবিদ (যারা রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই জানে না) এবং এরাই ভবিষ্যতে মন্ত্রী এমপি হয়ে সংসদে গিয়ে যতো রকম বদনীতি প্রয়োগ করে এবং সৃষ্টি করে নতুন নতুন ক্যাডার। এতে কোন সন্দেহ যদি কারো থাকে তবে তিনি অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী! বিশ্বে আর কোন দেশ আছে, যে দেশের মানুষ বিদেশেও আওয়ামী-বিএনপির নামে বহু সংগঠন করে নিত্য মারামারি, চুলাচুলি, হাতাহাতি… করে? বিশ্বে আর কোন দেশ আছে যারা একদল ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে অন্য দলের নিয়োগপ্রাপ্তদের বসিয়ে বসিয়ে (ওএসডি করে) সরকারী কোষাগার থেকে জনগণের টাকা থেকে বেতনভাতা দেয়, তাদের দিয়ে নিজেদের স্বার্থোদ্ধার হবে না বলে? বিশ্বে আর কোন দেশ আছে যে দেশের জনপ্রিতিনিধিরা সংসদে অংশগ্রহণ না করে বেতনভাতাসহ সরকারী সব সুযোগ-সুবিধা নেয়? কাজ না করে বেতন পাওয়া বা নেওয়া ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হারাম নয় কি? এসব নিয়ে ধর্মীয় দলগুলো আন্দোলন করে না কেন? এদেশের মুক্তিযোদ্ধারাও দুজোটের দলীয় যোদ্ধ! যারা বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বঙ্গবীর… খেতাবপ্রাপ্ত তারাও বিশ্বজিতের এই নির্মম হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করলো, কিন্তু এক হয়ে একটি হুংকারও দিতে পারলেন না, প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন না, তাদেরও কি মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে? আমার তো মনে হয় এরূপ হত্যাকান্ড প্রকৃত কোনো গণতান্ত্রিক দেশে হলে পরদিনই ওই সরকারের পতনের জন্য সমস্ত জাতি সারা দেশ অচল করে দিতো এবং সরকার অবশ্যই পদত্যাগে বাধ্য হতো।

যাহোক, হিংস্রতা দিয়ে হিংস্রতা দমনই যাদের ব্রত তাদের কাছে কিছু আশা করা যায় না। এ হিংস্রতা শুধু বদনীতির সুবিধাভোগিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অতি সাধারণ সমর্থকরাও এতে আক্রান্ত। বাসে বসে একদিন (ওদের কথায় বুঝলাম, বিএনপি সমর্থক) ৬/৭ জন চতুর্থ শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীর কথা শুনছিলাম। আওয়ামী লীগ কতো অপকর্ম করছে, কিভাবে বিএনপির লোকদের পিটাচ্ছে… ইত্যাদি। একজন বলছিলো, বিএনপি এবার ক্ষমতায় আসলে দেখবেন কেমন করে ওদের হাড়গোড় গুড়া করে! অন্য দলের সাধারণ সমর্থকরাও এমনটি বলে এবং আত্মতৃপ্তি লাভ করে। বিএনপি যখন ২০০১ সালে সংখ্যালঘুদের উপর (আওয়ামীদের ভোট দেয়ার অপরাধে) আমার এলাকায় ৭১-এর পাকিদের ন্যায় বর্বরতা চালিয়েছিলো তখনও কোন কোন বিএনপির সাধারণ সমর্থকরা বলছিলো, ঠিকই আছে কারণ ওরা (আওয়ামী গুন্ডারা) কি আমাদের নেতা-কর্মীদের কম পিটিয়েছে। কিন্তু গ্রামের ওই সাধারণ সহজ-সরল সমর্থকটির নিজের এতোটুকু বুদ্ধি-বিবেচনা নেই (তারা আসলেই নেতাদের বুদ্ধিতে চলেন) যে যাদের উপর অত্যাচার চালানো হয়েছে তারাও তার মতো সাধারণ সমর্থক (ব্যতিক্রম তারা অন্য দলের সমর্থক)। এসব ঘটনায় কোন দলেরই সাধারণ সমর্থকরা লাভবান হয় না, বরং ক্ষতিগ্রস্থ হয়, লাভবান হয় নেতা ও পাতিনেতরা; অথচ এসব হিংস্রতায় সাধারণ সমর্থকরা মনে মনে বেশ খুশি হয়। এই যদি হয় সাধারণ সমর্থকদের অভিমত যারা কোনপ্রকার সুবিধাই দলগুলো থেকে পায় না, তাহলে হাসিনা-খালেদার দোষ দেই কিভাবে, তারা তো আমাদের এমনি করে বংশানুক্রমে চুষতেই থাকবে। এই মনমানসিকতার পরিবর্তনের জন্য যা প্রয়োজন সেই কাজটি কে করবে? কিভাবে করবে? নতুন কোন দল এদেশে মাথা তুলতে দেবে না আওয়ামী-বিএনপি, এরশাদকে দিয়েও হবে না, জামায়েত তো প্রশ্নই ওঠে না, তাহলে জাতির উপায় কি? আমি হতাশ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি জাতির আর কোন উপায় নেই, কাবাব বা কিমা হওয়া ছাড়া!

কুকুরের লেসন শেষ। এবার রয়েছে ওং শান্তি! প্রস্তাব; কারো পছন্দ হোক বা না হোক, শান্তিতে নোবেল পাওয়ার আশা না করেই প্রস্তাবটি ফ্রি দিচ্ছি। এর আগে একটু দেখি বিখ্যাত চিন্‌তাবিদ আলডাস হাক্সলি এ সম্বন্ধে কি বলেছেন? তিনি বলেছেন,

শান্তি সকলেই চায়; কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে যা প্রয়োজন তা চায় কয়জনে…?

সত্যিই তো! এদেশের শান্তির জন্য হাসিনা-খালেদা প্রাণান্ত চেষ্টা (মূলত অপচেষ্টা) থেকে শুরু করে বিখ্যাত লোকজন সকলেই কি চমৎকার মিষ্টিমধুর বাণী শোনায় আমাদের ওসব শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। তবে জানেন তো, কাঙ্গালের কথা বাসী হইবার আগে ফলিবে না! মুই মোর কথা কইলাম, মোর দায়িত্ব শেষ। শেষ এ জন্যই যে হগোলেই তো কথা কইয়া আর লিখ্যাই দায়িত্ব শেষ করে (এ কাঙ্গালও হেইডাই হরলো)। যাকগে, প্রস্তাবডা বাসী হইবার আগে যতো তাড়াতাড়ি কার্যকর হইবো, জাতি ততো তাড়াতাড়ি শান্তিতে থাকবো!

প্যাঁচাল বেশি হলে মাফ করবেন। বলছিলাম কি, দেশটি জন্মের পর থেকেই বদনীতিবিদের সকলের একই কর্মকান্ড ও কথাবর্তা দেখে শুনে এটা ১০০% নিশ্চিত যে, দেশ বড় নয়, তাদের কাছে দলই সর্বশ্রেষ্ঠ (লক্ষ লক্ষ উদাহারণ, যা নিসপ্রয়োজন)। অতএব তাদের চাই আজীবন ক্ষমতা, মরণের পরেও যেন নিজ পরিবারের হাতে ক্ষমতা থাকে সেটারও নিশ্চিত চাই, আর এজন্য চলছে আপ্রাণ চেষ্টা। সেহেতু এদেশের নাগরিকরা কোনদিনও শান্তিতে থাকতে পারবে না তা নিশ্চিত। সাধারণেরা কেবল বিশ্বজিতের মতো কিমা বা আগুনে পুড়ে কাবাব হতেই থাকবে, কি দরকার এসবের।

অতএব বৈদেশিক আমিন এনে দেশটাকে সমান দুভাগে বিভক্ত করে এক টুকরা হাসিনা আরেক টুকরা খালেদাকে দিয়ে দেয়া হোক। আর মতলবাজ, স্বার্থপরেরা যে যার সমর্থনের জননেত্রী, দেশনেত্রীর… অংশে চলে যাবে। সাধারণ সমর্থকেরাও বাড়িঘর, জায়গা-জমি এক্সচেইঞ্জ করে অথবা বিক্রি করে নিজ নিজ পছন্দের দলের অংশে চলে যাবে এবং নিজ নিজ দেশনেত্রী, জননেত্রী, মাননীয় নেত্রী বা পরম শ্রদ্ধেয় জননীদের আশ্রয়ে স্বর্গসুখে নিশ্চিন্তে ও পরম সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে! এ দুজোটের বাইরে অতি নগণ্য যারা তারা তো তেমন অশান্তির কারণ নয়, অতএব তারা চাইলে যে কোন দিকে অথবা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সংখ্যালঘুর ন্যায় মেরুদণ্ডহীন হয়ে থাকবে। আর বেশি লাফালাফি করলে দেশ থেকে বহিষ্কার করে দিলেই সব লেঠ্যা চুকে যাবে, ফলে এ দেশটি বছরের পর বছর শান্তিতে নোবেল পেতেই থাকবে! আমাদেরও গর্বে বুক ফুলে উঠবে আমরা আর অশান্তিতে, দুর্নীতিতে প্রথম হবো না! এই কামনায়… ওং শান্তি! ওং শান্তি! ওং শান্তি! শান্তি!…