আশ্চর্য হওয়ার মতই ব্যাপার।
অসাধারণ প্রতিভাধর নিউটনের “ভর” বা “Mass” এর উপর নিশ্চিত ধারণা ছিল না। আইনস্টাইন “ভর” সহ “শক্তি”র বিখ্যাত তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন, E = m c2. কিন্তু তিনিও নিশ্চিত ছিলেন না “ভর” কী জিনিষ। কিন্তু আমরা স্কুলে ভর নিয়ে কিছু অঙ্ক কষে ভর বিষয়ে পন্ডিত ছিলাম। আসলে আমরা ‘কী’ জানিনা, তাইই জানিনা। আইনস্টাইন, নিউটনরা জানতেন তাঁরা ‘কী’ জানেন না। তাই তাঁরা সারা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন অজানাকে জেনে বিশ্বমানবের কল্যান সাধনের জন্য।

মানুষের কল্পনায়ও সম্ভব নয় তার চেয়েও বৃহত্তর পরীক্ষাগার নির্মিত হল
১৩.৭ বিলিয়ন (১৩৭০০,০০০,০০০) বছর আগে মহাবিশ্ব সৃষ্টি লগ্নে কী ঘটে ছিল, কণা পদার্থবিদরা তার একটা সঠিক ধারণা করে ফেললেন। পরীক্ষা করে প্রমান করতে হবে। নির্মিত হল Large Hadron Collider (LHC)।

ফোর্থ অফ জুলাই ২০১২ একটি বিশেষ ঘটনার দিন ছিল। সেদিন পিটার হিগ্‌স কেঁদেছিলেন। সাথে পার্টিকল ফিজিক্সের আরও অনেকেই কেঁদে থাকতে পারেন। কিন্তু আমরা, গোপী-বাঘারা, কাঁদিনি। কারণ, আমরা ঘটনাটির গুরুত্ব বুঝিনি।

টেলিভিশনের নিউজ মানেই ব্রেকিং নিউজ। আমার কাছে, এই ব্রেকিং নিউজটিও আর পাঁচটা-দশটার মত হারিয়ে যেত, যদি না মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় মুক্তমনায় ৯ই জুলাই ২০১২ তারিখে ডঃ অভিজিৎ রায়ের সার্ন থেকে হিগ্‌স বোসন – প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে! শিরোনামে দারূণ লেখাটি বেরোত। বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখায় অভিজিতের জুড়ি নেই। তিনি সুন্দর ভাষা, তথ্য এবং গ্রাফিক্সসহ সহজেই বিষয়ের অত্যন্ত গভীরে চলে যান। এক নাগাড়ে লেখাটির মূল অংশটুকু আমি তিনবার পড়ি। আজও পড়েছি। Particle Physics বিষয়ে আমার সামান্য আন্দাজ অভিজিতের এই লেখা দিয়েই শুরু। সেই থেকে Particle Physics বিষয়ে আনাড়ীদের জন্য কোন লেখা পেলে উৎসাহ নিয়ে পড়ি।

নীচে অনুদিত প্রফেসর ভাস্কর দত্ত ও তাঁর সহযোগীর লেখাটি হঠাৎ করেই আমার নজরে আসে। আমার অত্যন্ত ভাল লাগল। মুক্তমনার অনেকের ভাল লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস। ভাল না লাগলেও ক্ষতি নেই। ভাস্কর দত্তের নামটা জানা থাকল। হিগ্‌স কণা আবিষ্কারের সাথে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। নিকট ভবিষ্যতে কোন এক দিন এমন একটি সংবাদ বেরোতেও পারে, তখন মনে হবে, “আরে! কোথায় যেন দেখেছি নামটা।”

লেখাটি সম্পূর্ণভাবে গোপী-বাঘাদের জন্য। পার্টিকল ফিজিক্সের কোনরকম তত্ত্বকথা নেই। হিগ্‌স কণা সনাক্তকরণের সাথে সংযুক্ত একজন বিজ্ঞানীর পপুলার লেখা লেখার সময় কোথায়? কিন্তু তিনি তা করেছেন, এবং অত্যন্ত সহজ ভাষায়। হিগ্‌স কণার পর বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি কোনদিকে তারও সামান্য ঈঙ্গিত আছে। তিনি বলেছেন –

“এই তত্ত্ব যেমন ধারণা দেয়, W এবং Z কণা অস্তিত্ত্বশীল এবং এরা বিশাল ভর সম্পন্ন, একই তত্ত্ব আরো একটি নতুন কণার ধারণা দেয়, বিজ্ঞানীরা এটাকেই হিগস বোসন (উচ্চারণ BOSE-on) নামে অভিহিত করেন। পিটার হিগ্‌সই প্রথম এই কণাটির অস্তিত্ত্বের প্রস্তাব করেন, তাই কণাটি তাঁর নামানুসারেই হয়।

১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে CERNএ W, এবং Z কণা দুটো সনাক্ত করা হয়। বিজ্ঞানীরা দারূণ উৎফুল্লিত হয় এটা ভেবে যে অন্তত প্রকৃতি সমন্ধে আমাদের ধারণা কিছুটা হলেও সঠিক ছিল।

…ধারণা দ্বারাই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে, কে বা কোন সত্ত্বা বিশ্বজগতের সমস্ত কণাদের ভর যোগান দেয়, আমাদের এই বিশ্বজগৎ গঠিত হয় – শুধুমাত্র W এবং Z কণাই নয়, এর সাথে আছে কোয়ার্কস, প্রোটন, নিউট্রন, এবং ইলেক্ট্রন।

অনেক অর্থে, বিশ্বজগৎ নিয়ে অনাদিকাল থেকে কৌতুহলী মানুষের মৌলিক অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয় এই হিগ্‌স বোসনের আবিষ্কার (এটা যদি তাইই হয়)। ৫০ বছর আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা মোতাবেক, মহাবিশ্ব সমন্ধে আমরা কিঞ্চিৎ যদি বুঝতে পেরে থাকি, তা অবশ্যই মূল্যবান।”

ধর্মীয় কারাগার থেকে আমাদের মোহমুক্তি এবং নির্বান কবে হবে?
১৩.৭ বিলিয়ন (১৩৭০০,০০০,০০০) বছর আগে মহাবিশ্ব সৃষ্টি লগ্নটা কেমন ছিল, হিগ্‌স কণা তারই সাক্ষ্য দেয়। তিন মিলিয়ন (৩,০০০,০০০) বছর আগেকার মানুষের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। কিন্তু মানুষ এখনও বিশ্বাস করে, আজ থেকে মাত্র ৬০১৬ (ছয় হাজার ষোল) বছর আগে, আদম নামে এক কল্পিত লোক এই পৃথিবীর প্রথম মানব। এই রূপকথার উপর ভিত্তি করে কিছু ধূরন্ধর মিথ্যাচারী প্রসব করে নানা ধর্ম। শুরু হয় ধর্মীয় মিথ এবং মোহ। সূচনা হয় ভেদাভেদ, হানাহানি। বর্তমান বিশ্বে এরাই খুনাখুনীর মূল হোতা। বিজ্ঞানীরা অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য খুজে বের করতে। সাধারন্যে বোধগম্য এদের লেখাগুলো পড়লে মানুষের ভ্রান্তি ঘুচবে, মোহ কাটবে, হানাহানি কমবে। বসবাসের জন্য পৃথিবীটা হবে শান্তির জায়গা।

কিন্তু মুস্কিল হল যখন সর্ষের মধ্যেই ভূত থাকে। তিন মিলিয়ন বছরের পুরনো মানুষের ফসিল পেয়ে আনন্দে আত্মহারা গবেষকও হয়ত ৬০১৬ বছর আগের রূপকথার নায়ক আদমকেই পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করেন। এবং যিনি W এবং Z কণার আগাম ধারণা দিয়ে নোবেল প্রাইজ পান তিনিই “পৃথিবীটা সমতল” এবং “সূর্য প্রতিদিন পশ্চিমে ঘোলা জলে ডুবে” গল্পের নায়ক প্রচারিত ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সংঘাত দেখতে পান না। ধর্মীয় মোহাচ্ছন্নতার ক্লাসিক উদাহরণ।

প্রফেসর ভাস্কর দত্ত এবং তাঁর সহকর্মীর মূল লেখার অনূদিত লেখাটি নীচে


A cosmic whodunit: the case of the Higgs boson


[Bhaskar Dutta and David Toback are Professors of Physics at Texas A&M University. Dr. Dutta is also the Director of the Mitchell Institute for Fundamental Physics and Astronomy at Texas A&M University. They are among dozens of A&M scientists who had a hand in the global research effort that led to the recent Higgs boson findings; others include Richard Arnowitt, Ricardo Eusebi, Teruki Kamon, Peter McIntyre, Dimitri Nanopoulos and Alexei Safonov.]

গত জুলাই মাসের প্রারম্ভে, পৃথিবীব্যাপী সংবাদপত্র এবং ব্লগের প্রধান শিরোনাম ছিল, “হিগস বোসন”। বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষনার চুড়ান্ত ফলাফল নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। কাজটি হল দুটো বৃহদাকার Particle Accelerators নিয়ে। একটি Tevatron at Fermilabএ (শিকাগো শহরের একটুখানি বাইরে)। দ্বিতীয়টি Large Hadron Collider (LHC) – সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে, ইউরোপীয় নিউক্লিয়ার সংস্থা – CERN।

এই সাফল্য পদার্থবিদদের জন্য এক বিরাট সেলিব্রেশনের ব্যাপার; বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষও আনন্দ উপভোগ করল এবং ভাবল, “ঘটনাটা আসলে কী?” সবাই জানতে চায় আবিষ্কারটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ কেন, এটা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা করার এমন কী আছে! বিজ্ঞানীরা যে এতসব “হাম্বু-ডাম্বু” ব্যাপারটির কথা বলছেন তা আসলে কণার “ভর” বা “Mass”, অথচ সংবাদ মাধ্যমগুলো (মাত্র গুটিকতক বিজ্ঞানী সহ) কেন হিগ্‌সকে “ঈশ্বর কণা” বলছে?

যা এত উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করল, তা বিজ্ঞানের আলোকে বড় করে দেখতে হলে প্রথমেই ভাবুন পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ডিটেক্টিভ গল্পগুলোর কথা – একটি সংগবদ্ধ খুনীচক্র ঘটানো অনেকগুলো খুনের কাহিনী। খুনীরা পেশাদার। প্রতিটা ঘটনা-স্থলে নূন্যতম ক্লু থাকে মাত্র। এমনকি এগুলো যে কোন খুনী-চক্রের কারসাজী সেটাও পরিষ্কার নয়। সবগুলো খুন যে একই খুনীদের কাজ সেটা ভাবার তো কোন অবকাশই থাকে না।

সে যাই হউক, তুখোর ডিটেক্টিভরা বিভিন্ন খুন-গুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যতা খুজেন। সামঞ্জস্যগুলোকে একটা গ্রন্থিতে এনে কাল্প্রিটদের ধরার পথ খুজেন। সব সমস্যাগুলোকে যুগপত ভাবে সমাধান করা কঠিন, তবে অনেক সময় এটিই আমাদের একমাত্র পথ।

হিগ্‌স বোসনটিকে ধরার জন্য সেরকমই একটা প্রক্রিয়া দরকার হয় পৃথিবীশুদ্ধ ডিটেক্টিভদের নিয়ে, আর সেই জন্যই আমাদের এত আনন্দ উচ্ছাস। আপনারা আপাতত ভাবতে পারেন হিগস বোসনটি খুনী-চক্রটির একজন সদস্য মাত্র, কিন্তু ঘটনাটা এর চেয়ে ব্যাপক।

ব্যাপারটা সহজ করার জন্য আমরা কিছু সমাধানকৃত এবং এখনও সমাধান করা যায়নি এরকম দুটি কেসের প্রতি দৃষ্টি দেব। প্রথম সমস্যা হল এটম নিয়ে (যা ইলেক্ট্রিক ফোর্স বিষয়ক সমস্যা), এবং আর যেগুলো সমাধান করা যায়নি সেগুলো হল “weak force” সমস্যা এবং ভর সমস্যা।

১৯২০, ৩০ এবং ৪০ দশক গুলোতে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম মেকানিক্স তত্ত্বের মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করে এটমগুলো কীভাবে একত্রে থাকে (অর্থাৎ পরিষ্কার ভাষায় বলতে গেলে প্রোটন, নিউট্রন এবং ইলেক্ট্রন সমন্বয়ে হয় গঠিত এটম)। ইতিমধ্যে আমরা জেনে গেছি যে ইলেক্ট্রনগুলো ঋণাত্বক এবং নিউক্লিয়াসে প্রোটনরা ধনাত্নক চার্জ বিশিষ্ট হয় এবং বিপরীত চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে। ১৮০০সময় কালে আবিষ্কৃত হয় “আকর্ষণ”, যাকে ইলেক্ট্রিক ফোর্স বলা হয়, তখন কিঞ্চিৎ লোকই এ নিয়ে মাথা ঘামাত। আমরা এখন বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার করি, যদিও তখনকার মানুষ ইলেক্ট্রিক ফোর্সের তত্ত্ব যথেষ্ট জানত না, ফলে তারা ভাবেনি এই আবিষ্কার একদিন পৃথিবীর ব্যাপক কল্যান সাধিত করবে।

১৯৪০এর দশকে পদার্থবিদরা অনেক মৌলিক প্রশ্ন বিশদভাবে বুঝতে শুরু করেন। যেমন, কণাগুলো কীভাবে জানে পরস্পরকে তাদের আকর্ষণ করতে হবে? অন্যভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে, কী জিনিষ এই ফোর্সিংএ বাধ্য করছে? একটি এটমের এমন কোন রজ্জু নাই যা দিয়ে তার প্রোটন ইলেক্ট্রনকে “টেনে” রাখছে।

তারা বুঝতে সক্ষম হন যে, ইলেক্ট্রন এবং প্রোটনের আকর্ষনটা যেন কোন “মিডিএটরের” মাধ্যমে পরস্পরে “কথা বলা-বলির” মাধ্যমে হয়। মিডিএটরটি বলে দেয় যে, তাদের মাঝে চার্জ আছে, ফলে তাদেরকে আকর্ষিত হতেই হবে। ব্যাপারটা হচ্ছে, মেডিয়েটরটি আমাদের চেনা এক কণা – আমাদের প্রিয় আলোর কণা, ফোটন। অন্য আর একটা ভাবে ভাবা যায়, যদিও একেবারে সঠিক নয়, এটমের অভ্যন্তরে যা ঘটছে, তা হল, ইলেক্ট্রন আর প্রোটনের মাঝে প্রচুর ফোটন আলোর গতিতে ছোটাছুটি করে এবং এরাই প্রোটন এবং ইলেক্ট্রনকে বলে দেয় তারা নিজেরা কীভাবে ক্রীয়া-প্রতিক্রীয়া করবে। এই ফোটনই হল মিডিএটর। ফোটন এক বিশেষ ধরনের কণা। এরা আলোর গতিতে চলে কিন্তু এদের কোন ভর নেই।

এরই মধ্যে আমাদের পুরনো সেই ডিটেক্টিভ গল্পের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের সমাধান হয়ে গিয়েছে এবং আমরা প্রোটন, নিউট্রন, ইলেক্ট্রন, এবং ফোটনদেকে একটা বন্দীঘরে ঢুকিয়ে ফেলেছি। অতঃপর এটম এবং ইলেক্ট্রিক ফোর্স রহস্য উদ্ঘাটন পূর্বক বিজ্ঞানীরা দূর্বল শক্তি বা “weak force” সমস্যা সমাধানের প্রতি মনোনিবেশ করে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে, মেরী ক্যুরির মত বিজ্ঞানীরা এমন অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করেন যেগুলো এক্স-রে এবং রেডিএক্টিভিটির মত ইলেক্ট্রিক ফোর্স দ্বারা ব্যাখ্যা করা যেত না। ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত দ্বিধান্বিত বিজ্ঞানীদের কিছু অংশ লক্ষ্য করলেন যে এটমরা যেভাবে গুটিবদ্ধ হয়ে থাকে, এই রহস্যগুলোর মধ্যেও অনুরূপ সামঞ্জস্য রয়েছে। বিজ্ঞানীরা একটি নব্য ধরনের ফোর্সের অস্তিত্বের রূপরেখা দাঁড়া করলেন যা ইলেক্ট্রিক ফোর্সের মত কিন্তু ভিন্নতর।

একটি বিশেষ উৎসের এক্স-রের ইউরেনিয়াম অথবা প্লোটোনিয়ামের মত ভারী এটমগুলো প্রতিনিয়ত হাল্কা এটমে রূপান্তরিত হয়ে চলেছে। পারমানবিক বোমা এবং নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর ঠিক একই পদ্ধতিতে চলে। ব্যাপারটা বুঝা গেল যে ইলেক্ট্রিক ফোর্সের মত একটা ফোর্স আছে যা এই যাদুকরী কাজটি করাচ্ছে। কিন্তু, ব্যাপারটি অনেক সময় আবার ঘটছে না। তাই আমরা বলি, ইলেক্ট্রিক ফোর্সের তুলনায় এই ফোর্সটি ১০,০০০ গুন হাল্কা।

এটা যদি ইলেক্ট্রিক ফোর্সের মত একটা “ফোর্স”ই হয়, “weak force”টারও একটি “মিডিএটর” থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনোনিবেশ করলেন এই তত্ত্বটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে।

তারা স্বল্প সময়েই অনুধাবন করলেন, শুধুমাত্র একটি মিডিএটর থাকবে না, নিদেন পক্ষে দুটো হবে (আমরা এগুলোকে সনাক্ত করি W এবং Z কণা হিসেবে)। এর সাথে, এটাও পরিস্কার হলো যে, এই দুটোই যদি weak force পেছনে আসল কাল্প্রিট হয়, এদেরকে ফোটনের চেয়ে আলাদা হতে হবে। বস্তুত, যেহেতু weak force দুর্বল প্রকৃতির, এদের ভর থাকতে হবে এবং তা বিপুল পরিমানে।
এবারে ভরের সমস্যাটি নিয়ে দেখা যাক। এটা এত পুরাতন, রহস্যাবৃত এবং সমাধান এতই দুরূহ যে এটাকে একটি “cold case” হিসেবে গন্য করা হয়ে থাকে। আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত সূত্রে, E = mc2, ভর নিয়ে কথা বলেছেন (এখানে, E হল শক্তি, m ভর, এবং c হল আলোর গতি)। নিউটনও তাঁর বিখ্যাত সূত্রে F = ma ভর ব্যবহার করেছেন, (এখানে F হল শক্তি, m ভর এবং a হল ত্বরণ)। ভরের ধারণা নিয়ে আমরা “স্বাচ্ছন্দ” বোধ করি, কারণ আমরা সবাই স্নানাগারের সাধারণ একটি ওজন মাপার যন্ত্র থেকে সহজেই ধারণা পাই এটা কী জিনিষ। আমাদের ওজন যত বেশী আমাদের ভরও তত বেশী। এর পরেও বিজ্ঞানীরা আসলে জানেন না ভর কী জিনিষ (অর্থাৎ অন্ততঃ গত জুলাই পর্যন্ত আমরা এতটা নিশ্চিত ছিলাম না)।

ফোটন, অর্থাৎ আলোর কণিকাদের, এদের কোন ভর নাই। এবং এরা আলোর গতিতে চলে। ভরযুক্ত কোন কিছুই আলোর গতিতে চলতে পারেনা। কাজেই ভরের রহস্যটা এভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে, “যাকে আমরা ভর বলি, সেটা এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা কোন জিনিষকে আলোর গতির চেয়ে কম গতিতে চালিত করে?” এই ব্যাখ্যাটি যদি আপনার জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়, ভাববেন আপনি একা নন। সেই জন্যই ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত এটি একটি “cold case” হিসেবে পরিচিত ছিল।

আমাদের হাতে এখন দুটো রহস্য থাকছেঃ weak force সমস্যা এবং ভর সমস্যা। আর সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আমাদের থাকছে একটা অনুমান – যা হল অতিরিক্ত কাল্প্রিট (W এবং Z কণা), কিন্তু এরা আমাদের ফোটন কাল্প্রিটের চেয়ে আলাদা, কারণ এদের ভর আছে। আগে কেউ ভাবতে পারত না একটা মিডিএটরের ভর থাকে কী করে, বিশেষত, আমরা যেহেতু জানতামই না ভর কী জিনিষ।

কাল্প্রিটগুলো যখন নাক বাড়িয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসে, আমাদের ডিটেক্টিভ বিজ্ঞানীরাও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে। মনে হয়, তারা বুঝেছিলেন, ভর শুধুই কোন আন্তরীন জিনিষ না, হতেও পারে, ভর প্রকৃতিজাত একটি মৌলিক অস্তিত্ব। এই রহস্যটির সমাধান একটি দারূণ উত্তেজনাকর ব্যাপার। হতে পারে, আমরা মৌলিক কণাগুলোর ভরের আদি বিষয়টি বুঝতে পারব।

১৯৬০এর দশকে মানুষ যুগপৎ ভাবে ক্লুগুলো খন্ডিতাকারে দেখতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, W এবং Z কণাগুলো থাকতে পারে এবং এরা ফোটনদের মতই একটা চক্রের অংশ। কাজেই ইলেক্ট্রিক ফোর্স এবং weak force পরিবর্তে এটা হবে ইলেক্ট্রোউইক (eletroweak force) ফোর্স। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হল, ভর একটি আদি সত্ত্বা। এই ধারণা দ্বারাই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে, কে বা কোন সত্ত্বা বিশ্বজগতের সমস্ত কণাদের ভর যোগান দেয়, যা দিয়ে আমাদের এই বিশ্বজগৎ গঠিত – শুধুমাত্র W এবং Z কণাই নয়, এর সাথে আছে কোয়ার্কস, প্রোটন, নিউট্রন, এবং ইলেক্ট্রন।

এই তত্ত্ব যেমন ধারণা দেয়, W এবং Z কণা অস্তিত্ত্বশীল এবং এরা বিশাল ভর সম্পন্ন, একই তত্ত্ব আরো একটি নতুন কণার ধারণা দেয়, বিজ্ঞানীরা এটাকেই হিগস বোসন ((উচ্চারণ BOSE-on) নামে অভিহিত করেন। পিটার হিগ্‌সই প্রথম এই কণাটির অস্তিত্ত্বের প্রস্তাব করেন, তাই কণাটি তাঁর নামানুসারেই হয়।

বিজ্ঞানীদের কাছে সব একত্রে মিশে থাকার পদ্ধতিটা “হিগস মেকানিজম” নামে পরিচিত। যেহেতু এই হিগ্‌স কণাটির দায়িত্ব বিশ্বের সব কণাকেই ভর সংযোজন করা, কিছু লোক (নোবেল বিজয়ী লিওন লেডারম্যান সহ) হিগস বোসনকে “ঈশ্বর কণা” বলতে সুপারিশ করেন। আমরা বলব, আমরা এই নামটি পছন্দ করি না। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের জন্য নামটির ভাল আবেদন আছে।

পরে, ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে “best guess” অর্থে বিজ্ঞানীদের পরিষ্কার ধারণা হয় ভর কীভাবে কাজ করে, এবং “weak force” ও ইলেক্ট্রিক ফোর্স কী ভাবে কাজ করে। আমাদের এই বুঝাপড়া সঠিক হলে, W, Z, এবং Higgs নামে নতুন তিনটি কণা খুঁজে পাওয়া যাবে। এই দৃঢ় তত্ত্বটি ৪০ বছর-ব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষার সূচনা করে – দেখতে হবে প্রকৃতির এই অবিশ্বাস্য এবং গূঢ় তথ্যটির সত্যতা। পদার্থবিদরা জানতেন, এযাবৎ যত বৃহৎ পরীক্ষাগারের ধারণা করা গেছে, তার চেয়েও বড় পরীক্ষাগার প্রস্তুত করতে হবে। হিগ্‌স নিজে নিশ্চিত হতে পারেননি যে তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর তত্ত্বগুলো পরীক্ষা করে দেখা হবে।

বিশ্বের মহান দেশ সমূহ দৃঢ়তার সাথে একের পর এক প্রয়োজনীয় অর্থ নিয়ে এগিয়ে এল পরীক্ষক এবং ভারী কণা তিনটি অনুসন্ধানে giant particle accelerators নির্মান করার জন্য। যেহেতু এদের ভর অত্যন্ত বেশী, Accelerators এ আমাদের বিশাল পরিমানে ক্ষমতার (energy) প্রয়োজন হয়। ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে CERNএ W, এবং Z কণা দুটো সনাক্ত করা হয়। বিজ্ঞানীরা দারূণ উৎফুল্লিত হয় এটা ভেবে যে অন্তত প্রকৃতি সমন্ধে আমাদের ধারণা কিছুটা হলেও সঠিক ছিল। W, এবং Z কণা দুটো আগাম ধারণা দেওয়ার জন্য ১৯৭৯ সালে শেল্ডন গ্লাসগো এবং আব্দুস সালামের সাথে স্টিভেন ওয়াইনবার্গকে (এর পর থেকেই তিনি ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস ফ্যাকাল্টিতে যুক্ত) নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। কণার সরাসরি আবিষ্কারের জন্য কারলো রূবিয়া এবং সাইমন ভ্যান ডার মীরকে ১৯৮৪ সালে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়।

অনুপ্রানিত বিজ্ঞানীরা আশা করে শিগ্‌গীরই হিগ্‌স কণাটি তাদের কব্জাভূক্ত হবে। যাই হউক, এটাকে কব্জা করা রহস্যময়ই রয়ে গেল। CERN এর যে যন্ত্রটি দিয়ে W এবং Z কণা দুটো সনাক্ত করা হল তা অতটা ক্ষমতাশালী ছিল না। বছর পার হল, উন্নত accelerators তৈরী হল, কিন্তু হিগ্‌সের সন্ধান মিলল না।

নতুন মিলেনিয়ামের দ্বিতীয় দশকের প্রারম্ভে, ফার্মিল্যাবে তুমুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হল। চৌকশ ডিটেক্টর স্থাপিত হল। CERNএর অতিকায় এবং প্রবল ক্ষমতাধর Large Hadron Collider (L H C) থেকে অন-লাইনে প্রচুর তথ্য সরবরাহ হতে শুরু করল। এই সময়টাতে বিশ্বব্যাপী অনুসন্ধানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হল। Tevatron এবং L H C তে টেক্সাসের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সহ হাজার হাজার গবেষক সরাসরি যোগ দিলেন।

প্রাথমিক সংকেত গুলো আসতে শুরু হল ২০১১ সালের শেষ দিকটায় CERN এবং Fermilab পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে। Tevatron তথ্য সংগ্রহ শেষ করছে আর L H C এর নিরীক্ষা এগিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বাস যোগ্যতা ঘনিভূত হচ্ছে; এর সাথে গুজবও ঘোরপাঁক খেতে শুরু করে দিয়েছে সমান তালে। ২০১২ সালের জুলাই মাস। Tevatron আর L H C এর পরীক্ষা থেকে দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘোষনা বেরিয়ে এলো “হিগ্‌সের মত দেখতে” এমনি একটা কিছু তারা দেখতে পেয়েছেন। শ্যাম্পেনের ছুড়াছুড়ি শুরু হল। পিটার হিগ্‌স জীবদ্দশাতেই তাঁর কণাটি সত্যতা দেখলেন। পিটার আনন্দে আপ্লোত হলেন। চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

এর পরেও প্রশ্ন থেকেই যায়, মূলতঃ সত্যই কি বিজ্ঞানীরা হিগ্‌স বোসন পেয়েছেন? পেয়ে থাকলে গোপী-বাঘাদের কী যায় আসে তাতে? যদি এটা পাওয়া যেয়েই থাকে, আমরা কি এখন এত টাকা পয়সা খরচ বন্ধ করে দিতে পারি না?

বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হল। বিশ্বের সেরা সেরা বিজ্ঞানীদের হাজার হাজার মানুষ-বছর শ্রম ব্যয় হল। এবার সাধারণ মানুষের জবাব চাওয়ার পালা। সৌভাগ্যবশতঃ সুখবরও আছে।

প্রথমতঃ আমরা কী আবিষ্কার করলাম, তা বলার সময় এখনও আসেনি। একজন বিজ্ঞানী ভাল বলেছেনঃ “এটা হিগ্‌সের মত হাটে, হিগ্‌সের মত কথা বলে, কিন্তু নিশ্চিত হতে আমাদের এখনও প্রচুর গবেষণা করতে হবে।” অধিকন্তু, হিগ্‌স এবং অন্যান্যদের দাঁড় করা তত্ত্ব সম্পূর্ণ নয়। যেমন, এই তত্ত্ব দিয়ে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি অন্যান্য কণার ভর কী জিনিষ, কিন্তু কেন ঐসব জিনিষ ভর ধারণ করে তা ব্যাখ্যা করে না – কেন? মনে করুন, top quark একটি প্রোটনের চেয়ে প্রায় ২০০ গুন ভারী। এখন, আপনি যদি হিগ্‌সের ভর নির্নয় করতে চান, এই তত্ত্ব কাজ করে না, তখন আপনি পাবেন একটি অর্থহীন উত্তর।

কে চায় ত্যানা-পেচানো জটিল এই বিশ্বজগতটাকে? এটা এরকম যেন আমরা নিউইয়র্কে একটি সংগবদ্ধ দলকে ধরে একেবারে মূলোৎপাটন করে ফেলেছি, কিন্তু এর পেছনে আন্তর্জাতিক এক বিরাট ড্রাগ কার্টেল থাকতে পারে। এই সমস্যাটি এত মৌলিক যে আমরা ভেবে ফেলি আমরা যেন সবটাই সমাধান করে ফেলেছি।

বিষয়টার জটিলতর দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়। পদার্থ বিদ্যা জগতে আরও মৌলিক সমস্যা আছে যার সাথে ভর বা হিগ্‌স নিয়ে কিছু করার নাও থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দশকের পর দশক আমরা জেনে এসেছি এই বিশ্বজগতে “ডার্ক মেটার” নামে এক প্রকান্ড পরিমানের ভর আছে, যা গ্যালাক্সিদেরকে তাদের নিজেদের মত করে ঘুরায়। মৌলিক অর্থে আমরা “ডার্ক মেটার” সমন্ধে তেমন কিছুই জানিনা।

“theory of everything” জাতীয় একটি তত্ত্ব পেলে ভাল হত, যার সাহায্যে সর্বপ্রকার ফোর্স, যেমন ইলেক্ট্রিক ফোর্স এবং weak force মাত্র একটি ফোর্স হিসেবে বুঝা যায়। আমাদের বড় আশা মিশে আছে সুপারসিমেট্রি এবং স্প্রিং তত্ত্বের উপর। এটি আমাদেরকে হিগ্‌স মেকানিজমকে আরো মৌলিক অবস্থান থেকে বুঝতে সাহায্য করে। এই সব তত্ত্বগুলো থেকে মনে হয়, একটাই ড্রাগ কার্টেল আছে, কিন্তু এর ভিতরে লুক্কায়িত আছে প্রচুর কাল্প্রিট। যেমন, “ডার্ক মেটার” নতুন কোন ধরণের কণাকে নির্দেশ করতে পারে, সম্ভবত, একটা সুপারসিমেট্রিক কণা। সুপারসিমেট্রি বা স্ট্রিং তত্ত্বের এখনো কোন অস্তিত্ত্ব নেই। কিন্তু নিরীক্ষকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ওদিকেই।

অনেক অর্থে, বিশ্বজগৎ নিয়ে অনাদিকাল থেকে কৌতুহলী মানুষের মৌলিক অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয় এই হিগ্‌স বোসনের আবিষ্কার (এটা যদি তাইই হয়)। ৫০ বছর আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা মোতাবেক, মহাবিশ্ব সমন্ধে আমরা কিঞ্চিৎ যদি বুঝতে পেরে থাকি, তা অবশ্যই মূল্যবান।

এই গবেষণার ফসল ইন্টারনেটকে বেগবান করবে না অথবা আজকের চিকিৎসা সেবারও কোন উন্নতি হবে না। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, ইলেক্ট্রিক ফোর্সের আবিষ্কার, উনিশ শতকের বৈজ্ঞানিক “হাম্বু-ডাম্বুকে” বাতিল করে দিয়েছে, আজ প্রতিটি ঘরে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হচ্ছে নানাবিধ ইলেক্টিক গ্যাজেট। আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ী, এটা শুধুই সময়ের ব্যাপার যে, এই গবেষণালব্ধ জ্ঞান ব্যবহারের ফলে বিশ্বমানবের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। সময়ই তা বলবে।