ডি আই জি সাহেব ডেকেছেন- কথাটা উচ্চারন করতেও কেমন জানি বেখাপ্পা লাগে। সাহেবের সেক্রেটারী এসে বলে গেল- সাহেব ছালাম দিয়েছেন। সে ঐ একই কথা হলো- ছালাম দেয়া আর ডেকে পাঠানো একই জিনিস ডাক্তার জুলফিকারের কাছে, অন্ততঃ এমন একটা সময়ে। নিজের নামের আগে ডাক্তার নয়, সবাই ডক্টর উচ্চারন করুক- এটা তার বিরাট পছন্দের বিষয়। যা পছন্দের তাই ইজ্জতের। এই যে বড়-সড় ক্লিনিকটা, তিল তিল করে যেটা তার নিজের হাতে গড়া- তার মালিক সে নিজে একাই। এখানে সে রাজা-ধীরাজ। শল্যবিদ্যায় তার দক্ষতা মহামতি আলেকজান্ডারের দক্ষতাকে হার মানায়। শুধু দক্ষতা থাকলেই হয় না, তাকে টাকায় রূপান্তর করতে জানাটাই আসল বাহাদুরী। সে বাহাদুরী আছে তার। তার এমন এক সাম্রাজ্যে ঢুকে কে যেন কোন পুলিশ বলে যায়- সাহেব ডেকেছেন। রাগে মালিকের হাত প্রায় উঠে যাচ্ছিল ব্যাটার মুখে- বড় কষ্টে সামাল দেয়া গেছে সেটা। সাহস কত বেয়াদপটার- ‘ডাক্তার জুলফিকার’ বলে ডেকে কথা কয়। কবে যে এরা মানুষ হবে! রাগটা নিয়ন্ত্রনে রাখা আজকাল বেশ বড় ইস্যু হয়ে যাচ্ছে। সেটা যে বয়সের কারনে নয়, সেটা বুঝতে পারেন ডক্টর জুলফিকার। সম্ভবতঃ সময়টা একটু আধটু বেয়াড়া হওয়ার কারনে এমনটা ঘটছে।

সময় আসলেই খারাপ যাচ্ছে ডাক্তার সাহেবের। তবে তাতে তেমন কিছু আকাশ পাতাল ঘটে যাবে এমন নয়। আগেও এমন দুয়েকটা ব্যাপার ঘটেছে। সেসব কিছুই নিখুত মসৃনতায় সমাধানও হয়ে গেছে। এসবে সে তেমন তোয়াক্কা করে না। কারন সে শুধু একজন ডাক্তারই নয়, ডাক্তারদের নেতাও। এই রাজ্যের মানুষের বাঁচা-মরার অনেক কুটনীতি তার কাঁধে চাপানো। তার সব মুশকিল আছান হবে, সে বিশ্বাস তার আছে। এই মুহুর্তে ডি আই জি সাহেবের আলিশান অফিসে বসে বসে অনেক ওলোট পালোট চিন্তার ঘূর্ণী এক রকম আয়েশী সঙ্গ দিচ্ছে তাকে। পুলিশ সাহেব জরুরী মিটিংয়ে, তাই দুয়েক মিনিট তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে তারই অফিসে। আদর আপ্যায়নে তাকে বসানো হয়েছে এখানে। অগ্রিম নাস্তারও ব্যবস্তা হয়েছে হরেক পদের। খুব বেশী সময় অপেক্ষা করতে হলো না, দেখতে দেখতে বড় সাহেব এসে ঢুকলেন তার বড় অফিসে।
-আমি দুঃখিত আপনাকে বসিয়ে রাখার জন্যে। বোঝেনইতো দেশের কাজ বলে কথা। সয়ং প্রধান মন্ত্রীর কেইস। যাক ওসব কথা। আপনার আসার কথা শুনে তাড়াতাড়ি শেষ করে এলাম, স্যার।
ডি আই জি সাহেবের মুখ কাচুমাচু। প্রয়োজনের চেয়ে বেশী কথা বলে নিজের পুলিশী মেজাজটাকে স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে চলেছেন।
-কি জন্যে ডেকেছেন, সেটা বলেন।
-ছি ছি স্যার, আমি আপনাকে ডাকতে পারি? কী যে বলেন! এক সঙ্গে বিকালে নাস্তা করবো বলে একটু আসতে বলেছিলাম আরকি। সেই সাথে দুয়েকটা কথাও বলা যাবে।
ঘরের পরিবেশ এখন অনেক স্বাভাবিক। বাদি-বিবাদী, চোর-পুলিশ, বিচারক-অপরাধী এসব নেতিবাচক পরিবেশের নিন্মচাপ এই কক্ষ থেকে কোথায় জানি উধাও হয়ে গেছে। খুব বেশী স্বাভাবিক অনেক সময় অস্বাভাবিকও হতে পারে। ঠিক যেমন কখনও কখনও কুকুরে বিড়ালে অথবা বিড়ালে ইদুরে বন্ধুত্ব হয়ে যেতে পারে কোন অস্বাভাবিক ঘূর্ণীর আবর্তে। এমন এক বন্ধুত্বের পরিবেশে ডি আই জি সাহেবের মুখে কথার খই ফোটে।
-আমার স্ত্রী আপনার রুগী- তাকে আপনি বাঁচিয়েছিলেন। আপনার অসুবিধের সময় আমি কি চুপ মেরে থাকতে পারি? আপনি কি সব জেনেছেন, স্যার? মানে, আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো তো আপনার জানা দরকার।
-কি অভিযোগ?
-আমি স্যার বিশ্বাস করি না। না থাক, আপনার ওগুলো পড়ার দরকার নেই- আমিই আপনাকে পড়ে শুনাচ্ছি। আপনার ক্লিনিক থেকে ছাড়া পাওয়া একজন সিজারিয়ান প্রসূতির একটা কিডনি নাকি মিছিং। সাংবাদিকরা মেতেছে। এরকম আরো রুগীর সন্ধান নাকি তারা পেয়েছে এবং তারা সবাই আপনার পেশান্ট। তাদের কাছে নাকি হার্ড প্রুফ আছে। বলেন স্যার এসবের কোন মানে হয়? আমাদের কাছেও হার্ড লজিক আছে।
পুলিশ কর্মকর্তার কন্ঠে অপরাধীর স্বর বাজে। একই সাথে আত্মসমর্পনের নকশি কাঁথারও বুনন চলে শব্দে শব্দে। কিন্তু কিসের জন্যে এতসব তা ধারন করতে পারে না কোন শব্দ, কোন ভাষা।
-আমি বুঝতে পারছি ডি আই জি সাহেব, আমি রাজনীতির শিকার।
-আপনি কিচ্ছু ভাববেন না স্যার। আমি সোজা-সাপ্টা রিপোর্ট করে দেবো। আমি জানি, আপনি শুধু প্রাইভেট ক্লিনিকই চালান না, আপনাকে একটা সরকারী হাসপাতালও চালানো লাগে। আপনার নামে এই সব মিথ্যা মামলা——।
পুলিশ কর্মকর্তার অসমাপ্ত কথার মাঝখানে আরেক প্রস্থ নাস্তা এলো- আম কাঠালসহ আরও কিছু মোসুমী ফলাহার। নাস্তা করার মতো অতো সময় নেই ডাক্তার সাহেবের হাতে। আজকের শেষ অপারেশনটা তাকে করতে হবে রাত দশটায়। সে ব্যস্ত- ভীষন ব্যস্ত।
-আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না, স্যার। সাংবাদিকের উপরেও পুলিশ কাজ করে। এই রুগীরা পয়সার জন্যে সব করতে পারে। পয়সার জন্যে এরা নিজেদের কিডনি বিক্রী করে অন্যের দোষ দেয়। আমার ধারনা, আপনার ক্লিনিকে আসার আগে এরা এই কাজ করেছে। একদম ছোটলোক সব।
বড্ড বেশী কথা বলছেন আজ ডি আই জি সাহেব। কেন বলছেন তা জানা ডাক্তার সাহেবের, তারপরেও বিরক্ত সে। বিরক্তির রেখাচিত্র তার সারা চোখে মুখে। আগেভাগেই পুলিশ কর্মকর্তাকে আশ্বস্ত করা উচিত ছিল তার, তাহলে আর এতো অপ্রয়োজনিয় কথা তাকে শুনতে হতো না। টাকা বড় জাদুকর। টাকার জাদু ডেভিড কপারফিল্ডকেও হার মানায়।
-আচ্ছা ঠিক আছে। এই সাইডটা আপনি দেখবেন, আর আপনার বিষয়ে কিছু করার থাকলে আমি তা ম্যানেজ করবো। চলি তাহলে।

ডাক্তার সাহেবের চলাফেরায় স্বাভাবিক গতি। শুধু মুখেই তার তাবত বিরক্তির বক্ররেখা। এই দেশে মানুষ থাকতে পারে না- যত্তোসব ছোটলোকের কারবার। সবকিছুই ঠিক আগের মতনই আছে, শুধু এই পেপারওলাদের লাফালাফিটাই নতুন। ডাক্তার সাহেবের ক্লিনিকটা শহর ছেড়ে বেশ একটু দূরেই। সেদিকেই ছুটে চলেছে তার গাড়ীটা পিছনে বিস্তর বিষ ছড়িয়ে। রাস্তার দুপাশে শুধু ক্ষেত আর ক্ষেত- তার যেন কোন সীমা রেখা নেই। নির্জন ক্ষেতে একাকী এক চাষার দিকে নজর গেল তার। খুবই সাধারন ব্যাপার, তারপরেও সেদিকে তার চোখ গেল আটকে। উপুড় হয়ে কাদা মাটিতে কি যেন করছে চাষা। ঘর্মাক্ত উদোম পিঠের উপর দিনের শেষ সূর্য্যটা পড়ে প্রতিফলিত রশ্মিগুলো আচ্ছন্ন করলো ডাক্তারের দৃষ্টিকে। ষাট পেরিয়েছে ডাঃ জুলফিকার। হয়তো বয়সের সেই দোষে মেঠো আলোর ঝলকে চলে গেল সে পুরান দিনের খেরো খাতায়। সেখানে বাবার কথা মনে পড়লো তার বহুদিন পর, যে তার সর্বশ্ব দিয়ে তাকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত্য পড়ানোর রশদ যোগাতে পেরেছিল। বাকী পথটা হাটতে পেরেছিল সে অন্যের দয়ায়, দানে। শেষ দিন পর্যন্ত্য তার চাষা পিতা কানের কাছে শুধুই জপতেন- ‘জুলফিরে, তোমার ডগদর হওন লাগবো। উপরওলার পরেই হইল ডগদর। আল্লায় বানাইয়া ছাইরা দেয়, ডগদর তারে দেখভাল করে, বাচাই রাখে। আল্লারে খুশি রাখতে বান্দারে বাচাইবা, বাজান’। বাপের লাখ টাকার কথা রেখাছে ডঃ জুলফিকার- রেখেছে সারা জীবন ধরে। মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা রোগীকে অন্যের দুটো কিডনির একটা দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছে সে। এভাবেই দুটো জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে সে। মাঝখানে বসে তার হাতে কিছু টাকা এসেছে, এই যা। টাকা দেখে চোখ টাঁটায় মানুষের। তাই অমন করে ফাল পাড়ে পেপারে, যেন সে মস্ত খুনী অপরাধী। ছোটলোক আর কারে কয়। চলন্ত ক্যডিলাকের ঠান্ডা হাওয়ায় বসে থাকা ডাক্তার সাহেব এক সময় লক্ষ করে- অন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা একরোখা অবুঝ মানুষটা আর আগের মতন ভিতরে বসে খোঁচাখুচি করছে না। সম্ভবতঃ কিডনি-সম্প্রদান ত্বত্ত তাকে বেশ শান্ত করেছে। নিজেরও তার এখন বেশ হালকা লাগছে।

চাষা বাবার কথা কচিত মনে হলেও কোটিপতি মরহুম শশুর বাবার কথা মনে পড়ে সকাল বিকেল ডাক্তার সাহেবের, যে তাকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হবার রশদ জুগিয়েছিল। সে যেন তার দরদি শত্রু-। মেয়ের জন্য তাকে সহ্য করলেও কোনদিন পাওনা সন্মানটুকু তিনি তাকে দিতে পারেননি। দীর্ঘ্য পড়াশুনার যেন শেষ হয় না। প্রায় চল্লিশের কোঠায় এসে চাকরীর শিকে ছিড়লো তার ভাগ্যে। সে যেন এক বিরাট অভিশাপের মতন। হিসাব করে করে প্রতি মাসে একবার করে জিজ্ঞেস করতেন তিনি- ‘বাবাজীর পড়াশুনা কি শেষ হলো’? আর প্রতি ঈদে ডাক্তার সাহেবের জন্য থাকতো অপমানের মিশ্রির ছুরি। বেশ আমোদ করে সব জামাইদের সামনে পাড়তেন কথাগুলো- ‘বাবাজী শাড়ী চুড়ী গয়না গাটি বউরে কিছু দিলা এবার? বিয়া তো করছো বউয়ের লাইগাতো কিছুই করলা না। তুমি আর কি করবা, তোমার তো চাকরীই নেই’। সেসব দিন শেষ হয়েছে, কিন্তু সেসব ঘাঁ এখনো শুকায় নি। দারিদ্রের সাথে সাথে দরিদ্রকে ঘৃনা করতে শিখেছে ডাক্তার তার শশুর পিতার কাছে। তাই তো স্ত্রীসহ শশুর পক্ষের সবাইকে শুধু দিয়েই চলে সে, দিয়ে দিয়ে অপমানের দায় শোধ করে। মাঝে মাঝে ভাবে ডাক্তার সাহেব, নিজের কাছে প্রশ্ন করে- বউও কি পেরেছে তাকে তার যোগ্য সন্মানটুকু দিতে? কেন পারবে, সেও তো তার বাপেরই মেয়ে।

গাড়ী ফিরে আসে ক্লিনিকে। আজকে রাতের অপারেশনটা করেই তবে তার ছুটি। কর্তব্য কর্মে তার কোন গাফিলতি নেই। তবে এখানে এই ক্লিনিকে তার কর্তব্য কাজ বুঝি আরো বেড়ে গেল। এখানে কিছু ঘুঁন পোকা রয়েছে তারই আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে। সেগুলোকে তাড়াতে হবে দ্রুত, তবেই তার পথ হবে আরো মসৃন। কী যে সব আপদ এসে জমা হয় মাথার ভিতরে মাঝে মাঝে। আজকে সেসব থেকে সে মুক্ত। আজকে রাতে তার ভাল ঘুম হবে। এই বয়সে ঘুম না হলে মরনের মতো জ্বালা উঠে প্রানে। অপরাধ থাকলে অপরাধ-বোধ থাকে- সে বোধ নেই তার, তাই সে অপরাধী নয়। নিজেকে সে এটা বোঝাতে পেরেছে নানা ছলে-বলে, যুক্তিতে, অন্যকে তা সে বোঝাতে না পারলেও ক্ষতি নেই। লাখ টাকার কথা বোঝার ক্ষমতা সবার হয় না, তবে তার পথ সে মসৃন রাখবে যে করেই হোক। কারন ডাক্তার জুলফিকারের একটা ঘুম চাই- সুরক্ষিত শান্তির একটা ঘুম।

[গল্পটি কোন বিশেষ পেশা, ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা প্রতিষ্ঠানকে হেয় করার উদ্দেশ্যে লেখা নয়, সম্পুর্ন কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশে নীতিভ্রষ্ট সামাজিক আবহ থেকে তুলে আনা একটা কাল্পনিক কাহিনী চিত্র।]