সমস্ত দিন কেটে গেলে, বিকেলের ক্লান্ত গাছের পাতায় ধূসর ছায়া ফেলে, পরিচিত দিক ধরে অন্ধকার নেমে এলে, এলেবেলে ডানা মেলে ক্লান্ত এক ঝাঁক পাখি ঘরে ফিরে যাবে। তারই কিছুটা পরে ম্রিয়মান সূর্যের সর্বশেষ লালচে আভাটুকুও দিগন্তের ওদিকটায় যখন মিলিয়ে যাবে, তখন আকাশ নীল করে চাঁদ নামবে। চাঁদ নামবে আকাশের স্বর্গীয় আঙ্গিনায়, বিশ্বচরাচর আলোর বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে রাতের কপালে টিপ হয়ে সেজে রবে আকাশজুড়ে। ছোট্ট কিশোরী দরজার চৌকাঠে বসে বসে ভাববে, আহা! এমন দারুণ করে কে সাজিয়েছে এই পৃথিবী।

দূর আকাশের সেই রঙের মেলার বায়োস্কপ শুধু দেখেই যাওয়া সম্ভব, বয়স যতই বাড়ুক সেই আকাশকে নিজের মত করে সাজানোর নেশা মানুষকে ছাড়তেই হয়, এখনো যে আকাশ কিংবা প্রকৃতিকে সাজানোর ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি মানুষ। কিন্তু, প্রকৃতি আর মানুষের যৌথ প্রযোজনায় যদি গড়ে উঠে কোনো এক রাজ্য, তবে কি হবে তার রূপ! কি হবে তার নাম!! সে রাজ্যের নাম নিলে কি স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নীল কথাটা ভেসে উঠবে না মানুষের মনের মানসে!!!

নাপা ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়া। নেটিভ আমেরিকানদের ব্যবহৃত নাপা শব্দের অর্থ জন্মভূমি। দিনে দিনে প্রকৃতি আর মানুষের যৌথ প্রযোজনায় জন্মভূমির সাথে সাথে স্বপ্নভূমিতে পরিণত হওয়া এই উপত্যকা জানিয়ে দেবে কতটা সুন্দর হতে পারে প্রকৃতি আর কতটা রুচিশীল হতে পারে মানুষের সৌন্দর্যবোধ; জানিয়ে দেবে কেমন করে মাইলের পর মাইল নিপুণভাবে সেজে থাকতে পারে সুদীর্ঘ অঞ্চল। দুইপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের মাঝখানে, মনে হয় কিশোরীর কেশবিন্যাসের মত যত্ন করে কেউ বুঝি সাজিয়ে তুলেছে এই ভূমি। সুবিস্তৃত সে সমভূমিতে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা গুল্মের গায়ে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে ফল। আঙ্গুর ফল। লাল, কালো, নীলচে, মেরুন, সাদা। সমস্ত উপত্যকাজুড়ে কি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আঙ্গুরের বাগানগুলি। উপত্যকার বুকের উপর দিয়ে সিঁথির মত চলে যাওয়া রাস্তার মাঝে, ক্ষণে ক্ষণে ছুটে চলা গাড়ীর আওয়াজ ছাড়া অন্য শব্দরা সেখানে আসে না, তাতে করে যদি নাপার নিস্তব্ধঃতা নষ্ট হয়ে যায়।


                  ছবিঃ মাতাল ভ্যালি নাপা

কিন্তু, প্রকৃতি তার অপার মহিমা আর অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে যতটা সহজে সাজিয়ে ফেলতে পারে দশ দিগন্ত, তেমন করে সাজাতে পারে না মানুষ। মানুষের প্রয়োজন হয় সজ্জা সামগ্রীর, প্রয়োজন হয় অর্থের। নাপা ভ্যালিতে সেই অর্থের যোগান হয় আঙ্গুর বাগান থেকে। নাহ, ফলের দোকানে সাজিয়ে রাখা আঙ্গুর বিক্রি করে বড়জোর বাড়ীর আঙ্গিনায় গড়ে উঠা বাগান সাজানো যেতে পারে; কিন্তু, গোটা একটা উপত্যকা সাজানো যায় না। অতএব, চাই আরো বেশি কিছু। নাম মাত্র টাকা কিংবা ডলার নয়, প্রয়োজন কাড়ি কাড়ি টাকা আর কাড়ি কাড়ি ডলার। বছরের পর বছর ধরে নাপা ভ্যালিতে বসতি গড়ে তোলা ব্যবসায়ীদের পরিশ্রম আর সাধনায় গড়ে উঠেছে এখানকার ওয়াইন ইন্ডাস্ট্রি, আঙ্গুর থেকে বানানো সে ওয়াইনের টাকার উপর ভর করেই চলে তার সৌন্দর্যের চাকা।

                  ছবিঃ এই পথ যদি না শেষ হয়…

১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত গোটা আমেরিকায় নিষিদ্ধ থাকে অ্যালকোহল। অ্যালকোহলের সেবন, পরিবেশন, পরিবহন কিংবা বণ্টন সবকিছুই নিষিদ্ধ। কিন্তু, কার্যত দেখা যায়, উপর তলার মানুষরা আইন ভেঙ্গে ঠিকই অ্যালকোহল সেবন করছে, শুধু নীচু তলার সাধারণ মানুষের উপর হচ্ছে আইনের কঠোর প্রয়োগ। অতএব, খুব স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয় সামাজিক ভারসাম্যহীণতা। তার উপর, অ্যালকোহলকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে বিশাল সিন্ডিকেট, সংঘবদ্ধ গ্যাং। গ্যাংস্টারদের শহরখ্যাত শিকাগোর মাফিয়া ডন আল কাপোনে’র মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় আসতো এই নিষিদ্ধ সময়ে অ্যালকোহলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। বস্তুত, প্রজাতি হিসেবে মানুষ খুবই অদ্ভুত। কথিত আছে এই একই প্রজাতির মধ্যে কেউ দুধ বিক্রি করে অ্যালকোহল খায়, আর কেউ অ্যালকোহল বিক্রি করে দুধ খায়। মোটের উপর দেখা গেলো, যে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করা হলো, সেই নিষিদ্ধ ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে অপরাধ বেড়ে গেলো আগের তুলনায় কয়েক শতাংশ। অতএব, ১৯৩৩ সালে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সময় কিছু শর্ত সাপেক্ষে অ্যালকোহলের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে আস্তে আস্তে চাঙ্গা হতে থাকলো নাপা ভ্যালির অ্যালকোহল শিল্প। কিন্তু, ওদিকে ইউরোপীয়ানরা যে যুগ যুগ ধরে সে ব্যাবসা চালিয়ে আসছে। তাদের অ্যালকোহল সাথে প্রতিযোগিতা করতে না পারলে খুব বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয়। একসময় প্রতিযোগিতার সে সুযোগটাও এসে গেলো। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রস্তুত হওয়া ওয়াইনের স্বাদ নির্ধারণের জন্য অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে আন্তর্জাতিক ওয়াইন টেস্টিং প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার আগে ওয়াইনের উৎস কিংবা ব্র্যান্ড সম্পর্কে কোনো কিছুই বলা থাকে না, এমনকি বিচারকরা ওয়াইনের রঙ যাতে দেখতে না পারে সে জন্য তাদেরকে কালো গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে স্বাদ নির্ধারণ করতে দেয়া হয় (Blind Tasting)। প্রতিযোগিতার শেষে চ্যাম্পিয়ন ওয়াইনের উৎস কিংবা কোম্পানির নাম ঘোষণা করা হয়ে থাকে। ১৯৭৬ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সেরকম এক আন্তর্জাতিক ওয়াইন টেইস্টিং প্রতিযোগিতায় ইউরোপের বিখ্যাত ওয়াইন ব্র্যান্ডগুলোকে হারিয়ে দেয় নাপা ভ্যালির রবার্ট মোন্ডাভি ওয়াইনারি। তারপর থেকে নাপা ভ্যালির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে আরো দ্রুত্গতিতে। ১৯৩৭ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি এবং ব্যবসা প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী রবার্ট মোন্ডাভি শুধু ব্যবসা নয়, সাথে সাথে গুরুত্ব ছিলেন ওয়াইন গবেষণাতেও।প্রতিনিয়ত ভেবছেন কি করে আরো মান সম্পন্ন, সুস্বাদু ওয়াইন প্রস্তুত করা যায়। মোন্ডাভিদের মত দূরদর্শী সেদিনের সেই সমস্ত মানুষজনের পরিশ্রমের ফলস্বরূপ,আজকের নাপা ভ্যালিতে আছে প্রায় তিনশ’রও বেশি ভিনিয়ার্ড, যেখানে প্রতিনিয়ত প্রস্তুত হয় বিশ্ববিখ্যাত ওয়াইন।

                  ছবিঃ …and the wine is bottled poetry… ( Robert Louis Stevenson )

স্নিগ্ধ মনোরম উপত্যকার রাস্তায় গাড়ীতে চলতে চলতে ভাবি,এখানে কাউকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন নেই –এই পথ যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হতো তুমি বলতো; কারণ,নিশ্চিত করে তখন পৃথিবীটা হতো স্বপ্নের দেশ। ট্রেইনের ব্যবস্থাও আছে। নাপা ভ্যালি ওয়াইন ট্রেইন।এরা সৌন্দর্য যে শুধু সৃষ্টি করতে জানে তা নয়, সাথে সাথে সে-সৌন্দর্য উপভোগও করতে জানে।বিস্তৃত নিশ্চুপ উপত্যকায়,অবারিত আঙ্গুর বাগানের মাঝ দিয়ে সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলে সেই ট্রেইন,আর তখন উপত্যকা থেকে শুধু ভেসে ভেসে আসে প্রাণ ভরে সৌন্দর্য মেখে নেবার আমন্ত্রণ। কিন্তু, ট্রেইনের সমস্যা হলো যেখানে খুশি সেখানে নেমে পড়ে হতভম্ব কিশোরের মত মাটি ছুঁয়ে দেখা যায় না,দু’হাত আকাশপাণে ছড়িয়ে দিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়া যায় না। তাই,গাড়ীতেই চড়ে ক্ষণে ক্ষণে নেমে পড়ি। এক পর্যায়ে খুঁজতে থাকি ইতিহাসকে বুকে ধরে রাখা রবার্ট মোন্ডাভি ওয়াইনারি। খুঁজে পেতে খুব বেশি দেরী হয়নি।ওয়াইনের সাথে সাথে যে প্রযুক্তিও এগিয়ে গেছে অনেক দূর। জিপিএস এর কল্যাণে এখন –কি করি আজ ভেবে না পাই,পথ হারিয়ে কোন বনে যাই– এই সমস্ত হারিয়ে যাবার ব্যাপারগুলোতো হারিয়েই গেছে। আজকের পৃথিবীতে বরং পথ হারানোরই কোনো পথ নেই।মোন্ডাভিতে ওয়াইন ট্যুরের ব্যবস্থা আছে। ট্যুরের টিকিট কাটলে আবার দুই ধরণের ওয়াইন ফ্রি টেইস্ট করতে দেয়া হয়। কি করে ওয়াইন বানানো হয় সেটা পুরো ইন্ডাস্ট্রি ঘুরিয়ে দেখানো হয়। তার থেকে বড় কথা,গাইডের মুখ থেকে শুনতে পাওয়া যায় অনন্য কিছু ইতিহাস, ইতিহাসের নেশায় আমি এমনি আসক্ত,সে নেশার কবল থেকে মুক্তি পাইনি কখনো। তাই বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে, তথাস্তু বলে টিকিটের আশায় এগিয়ে দেই ক্রেডিট কার্ড। এমনি করে যায় যদি সব যাক না!


                  ছবিঃ রবার্ট মোন্ডাভি ওয়াইনারি

যে ভদ্রমহিলা গাইড হলেন তিনি শুরু করলেন প্রশ্ন দিয়ে, তোমরা কি জানো কোন জায়গায় আমাদেরকে রেগুলারলি ওয়াইন সাপ্লাই দিতে হয়? ভিজিটরদের সবাই চুপ করে থাকলে মহিলা নিজেই উত্তর দেয়, চার্চ। চার্চ শুনেই সবাই এক যোগে হাসতে থাকে। শুরুটাই ওয়াইন টেস্ট দিয়ে। একে একে সবাই গ্লাস নিয়ে লাইন ধরে ওয়াইন নিচ্ছে। একটা মাটির হাঁড়ির মত পাত্র থেকে আমাদের গাইড সবাইকে ঢেলে দিচ্ছেন। আমি গ্লাস বাড়িয়ে দিতেই গাইড ভদ্রমহিলা রসিকতা করে বলেন, তোমার বয়স কি এখনো একুশ হয়েছে?! আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিনদেশী বড়ই আনন্দ পেল কথাটাতে। আমি তাকিয়ে দেখি, সে শুধু ভিনদেশীয় নয়, চীনদেশীয়ও বটে। এ-পর্যায়ে আরো একটু হাস্য করে সে বলে উঠে, শোনো হে ভদ্রলোক, ওটা ছিলো একটা জোক! আমি মনে মনে বলি, এই উপত্যাকার মাঝে এসে আমাকে জোকের সংজ্ঞা শেখাচ্ছ , তবে রে! আমি জিজ্ঞেস করি, তোমার কি সন্দেহ আছে আমার বয়স একুশের উপরে। সে বলে, নাহ, নাহ, আমার বিন্দু মাত্র সন্দেহও নেই। আমি বলি, তাহলে তোমার সন্দেহ হলো কেন, ওটা যে একটা জোক সেটা আমি বুঝতে পারি নাই? এ-পর্যায়ে হাস্য থামিয়ে যথাবিহিত সন্মানপূর্বক সে দুঃখ দুঃখ ভাব প্রদর্শন করে ভাষ্য প্রদানে উদ্যত হলে অবশেষে আমাকেই হেসে উঠতে হলো। আর একটু হলে সে ভেবে বসতেই পারতো, ড্রিঙ্ক না করেই, হয়তো ওয়াইনের গন্ধ পেয়েই আমি দিশা হারিয়েছি।

বাগানের ভেতর গিয়ে দেখা গেলো, প্রতিটা গাছের গোড়ার চারপাশে শক্ত কাগজের মত কিছু দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এক দুই তিনটে নয়, শত সহস্র আঙ্গুর গাছের চারার সবগুলোতে পরম যত্নের সাথে সেটি করা হয়েছে। গাইড ব্যাখ্যা করে বললেন, আশপাশের কাঠবিড়ালী জাতীয় কিছু প্রাণীর প্রিয় খাবার হলো কচি আঙুর গাছের গোড়া, তাদের কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্যই এ-ব্যবস্থা। অন্যদিকে, বিশাল বাগানের ভেতর, খানিকটা পর পর করেই রাখা আছে বিশাল বিশাল সাইজের ফ্যান। তাহলে কি আঙ্গুর গাছকেও বাতাস করে ঠান্ডা রাখতে হয়? আসলে, ঠান্ডা নয়, উলটো উষ্ণ রাখতেই ব্যবহার করা হয় পাখা গুলি। ডিজেল চালিতে বিশাল পাখাগুলি থেকে আসা উষ্ণ বাতাসই আঙ্গুর গাছের অঙ্কুরগুলিকে ঠান্ডায় জমে যাবার হাত থেকে রক্ষা করে।

                  ছবিঃ কাগজে কাণ্ড মুডিয়ে রাখা চারা গাছ

                  ছবিঃ চারা গাছে উষ্ণ বাতাস দেবার জন্য বাগানের ভেতরের ফ্যান

গাইড অনেক কিছুই বললো, এবার তার প্রশ্ন করার পালা। পৃথিবীর সব গাইডেরই প্রশ্ন করবার বাতিক আছে। একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়ে, প্রায় সবগুলো আঙুর বাগানেই লাগানো আছে বিভিন্ন ধরণের গোলাপের গাছ, ফুটে আছে নানা বর্ণের গোলাপ ফুল। সবুজ বাগানের চারধারে ফুটে থাকা ফুলগুলি দেখে মনে হয়, অলংকার হয়ে তারা বুঝি সাজিয়ে রেখেছে সবুজ ঐ আঙ্গুরের বাগান। গাইডের প্রশ্ন হলো, কেন গোলাপ ফুল? অন্য কোনো ফুল নয় কেন? বেরসিক কোনো ভিজিটর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে দিলে গাইডেরা রাগ করে। আমাদের ভিজিটরদের মধ্য থেকে কেউই কোনো উত্তর করলো না। গাইড রাগ করবে সে জন্য নয়, উত্তর জানা নেই সে-জন্য। শেষ পর্যন্ত কেউই উত্তর জানে না দেখে যারপরনাই খুশি হয়ে আমাদের গাইড জানিয়ে দিলো, আঙুর গাছ এবং গোলাপের গাছ প্রায় একই ঘরাণার। কিন্তু, গোলাপের গাছ অনেক বেশি সংবেদনশীল বিধায় বাগানের গাছে কোনো রকমের রোগের সম্ভাবনা দেখা দিলে, আঙুর গাছের আগে গোলাপের গাছেই সেটা দেখা যাবে। আর, সেটা দেখে সংশ্লিষ্টরা আগেভাগেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন। নিজের জীবন দিয়ে অন্য গাছের জীবন রক্ষা করার মত এ-রকম একটা মহান ভূমিকা যে গোলাপ গাছ পালন করতে পারে সেটা আগে জানা ছিলো না।

                  ছবিঃ বাগানের চারপাশে লাগানো গোলাপের গাছ

বাগান দেখা শেষ হলে এবার ওয়াইন তৈরীর প্রক্রিয়া দেখানোর পালা। বিশাল বিশাল কাঠের ট্যাঙ্ক সারি সারি করে বসানো। সেখানে স্বয়ংক্রিয় ভাবে ঢুকানো হয় আঙুর, তারপর সেখান থেকে তরল রস বের করে ঈস্ট যোগ করা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ধাপ সম্পন্ন করে কাঠের ব্যারেল ঢুকানো হয় পাণীয়। সেখানে রেখে দেয়া হয় মাসের পর মাস,এমনকি কয়েক বছর। আজকে যে ওয়াইন প্রস্তুত হলো, সেটা বাজারজাতকরণ করা হবে কয়েক বছর পর। ফ্যাক্টরির ভেতরে ভিজিটরদের সবাইকে পাণ করতে দেয়া হলো রেড ওয়াইন। ওয়াইন তৈরীর সমস্ত প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার সাথে সাথে আমাদের গাইড আরো ব্যাখ্যা করলো রবার্ট মোন্ডাভি’র স্বপ্ন এবং সে-স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইতিহাস। অবশেষে, নাপা ভ্যালির ওয়াইন শিল্পের ইতিহাস বর্ণনা করে ওয়াইন ট্যুরের সমাপ্তি করলো। আর জানিয়ে দিলো, বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে তারা সেখানে কনসার্ট এর আয়োজন করে থাকে। শত শত মানুষ এসে জড়ো হয়, সেই কনসার্ট দেখতে।আমাদেরকে কনসার্ট দেখবার আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলো। অন্য ভিজিটররা যখন কনসার্টে কোন কোন শিল্পী আসে কিংবা টিকিট কাটতে হবে না-কি ফ্রি আসা যাবে, সে খবর নিতে ব্যস্ত, আমার উসখুস করা মস্তিষ্ক তখন ভেবে বেড়াচ্ছে, কনসার্টটা ঠিক হবেটা কোথায় এখানে, সেরকম বড় কোনো অডিটোরিয়ামতো দেখছি না। তাহলে, কি ওপেন এয়ার কনসার্ট—-লেইস ফিতা,লেইস।কিন্তু,সে খবর নেয়ার আগেই, সূর্যি মামা অস্ত নেবার আগের পূর্বপ্রস্তুতিটুকু নিতে শুরু করেছেন।

                  ছবিঃ ফ্যাক্টরির ভেতরের চিত্রের একাংশ

ফেরার পথে আসতে শুরু করলাম অন্য রাস্তা ধরে, এদেশে রাস্তার অভাব নাই। মানুষের থেকে রাস্তা বেশি, গাড়ীর থেকে সিগন্যাল বেশি। যেতে যেতে কিছু দূর পর রাস্তার উপর বড় করে ফলমূলের ছবি আঁকা দেখে আবারো থেমে যাই। পরিবারের বয়স্ক ভদ্রমহিলা, তার নাতনীকে নিয়ে ছোট ছোট বাক্সে সাজিয়ে রেখেছেন স্ট্রবেরী, গাজর, কলা, পেয়ারা, হানি ডিউ, স্কোয়াশ। যাবার পথে কেউ যদি বাসার জন্য ফ্রেশ কিছু কিনে নিয়ে যেতে চায়, সেজন্য তারা এই পসরা সাজিয়ে বসেছে। কিন্তু, সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহী না হয়ে আমার চোখ চলে গেল পিছনের সব্জি ক্ষেতে। সেখানে মাটির উপরে শুয়ে আছে কুমড়ো, তরমুজ; পাকা ফলের ভারে নুয়ে পড়ছে নানা জাতের টমেটোর গাছ। দুনিয়াজোড়া ইট পাথরের শহরগুলোতে শুধুই প্রযুক্তি, ওয়াইফাই নেটয়ার্ক আর টাচ স্ক্রিনের ছড়াছড়ি।কতদিন যে ভালো করে মাটির গন্ধ নেয়া হয় না, নেয়া হয় না শাক-সব্জির কাঁচা ঘ্রাণ। দোকানের মালিকদের বলতে, তারা সানন্দে রাজী হয়ে গেলো। ক্ষেতে কাজ করছে কিছু মেক্সিকান লোকজন। অবাক দৃষ্টিতে বুঝবার চেষ্টা করছে আগুন্তুকের উদ্দেশ্যটা কি। উদ্দেশ্য জানার সাথে সাথে তাদের একজন পরম উৎসাহে, সাথে করে নিয়ে সমস্ত এলাকা হেঁটে দেখিয়ে বেড়ালো, দেখিয়ে দিলো সব ফলমূল, শাকসব্জির গাছ; কোনটার নাম কি, কোনটার চারা কখন লাগাতে হয়।





                  ছবিঃ নাপা ভ্যালির সব্জির ক্ষেত থেকে তোলা

তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফেরার পথে পথে ভাবতে থাকি, মানুষকে মাতাল করে দেবার সব ক্ষমতাই আছে এই উপত্যকার; তবে সেটা অ্যালকোহল দিয়ে নয়, বরং, তার নিজের রঙ-রূপ-লাবণ্য-সৌন্দর্য দিয়ে। অসহণীয় মাত্রায় অনিন্দ্য সেই সৌন্দর্য।



                  ছবিঃ অসহণীয় মাত্রায় অনিন্দ্য সেই সৌন্দর্য

ওদিকে সূর্যের আর তর সইছে না, এক্ষুণি তাকে দিগন্তের ওপারের আরেক দেশে ঊষার আলো নিয়ে উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু,তাতে কি! তখন যে ক্লান্ত গাছের পাতায় ধূসর ছায়া ফেলে, পরিচিত দিক ধরে অন্ধকার নেমে আসছে, এলেবেলে ডানা মেলে ক্লান্ত এক ঝাঁক পাখি ঘরে ফিরে যাচ্ছে। ম্রিয়মান সূর্যের সর্বশেষ লালচে আভাটুকুও দিগন্তের ওদিকটায় মিলিয়ে গেছে; নাপা ভ্যালির সৌন্দর্যের সাথে নিজের সৌন্দর্য মিশিয়ে একাকার করে দিতে, এবার যে আকাশ নীল করে চাঁদ নামবে।

কৃতজ্ঞতাঃ শাফি আল আলম, সমস্ত দিক নির্দেশনার জন্য।

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]

স্টেইটস্‌ অব আর্ট সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলিঃ
:: নিউইয়র্ক (প্রথমার্ধ) :: নিউইয়র্ক (দ্বিতীয়ার্ধ) :: পোর্টল্যান্ড (ওরিগন) :: সিলিকন ভ্যালি (ক্যালিফোর্নিয়া) :: ওয়াশিংটন ডিসি :: ডেট্রয়েট (মিশিগান) :: রিচ্‌মন্ড (ভার্জিনিয়া) :: লস এঞ্জেলেস (ক্যালিফোর্নিয়া) :: কলাম্বাস (ওহাইও) :: গোল্ডেন গেইট ব্রিজ ::