জামিলা বেগমের তিন ছেলে- আরমান, জার্মান আর ফোরকান। ছোট ছেলে ফোরকানকে দশ বছরের রেখে তার বাবা গত হয়েছেন সেই কবে। ভাসুর দেবররা সব বড় বড় সওদাগর, থাকেন তাদের মত, গাড়ী বাড়ী সান-সওকেত নিয়ে ঢাকা শহরের ভাল ভাল আলিসান এলাকার বাসিন্দা হয়ে। এই চিপাচাপা বিক্রমপূরে তাদের আসা যাওয়া তেমন নেই বললেই চলে। তারপরেও জামিলা বেগম তার সত্তর বছরের ভারাক্রান্ত জীন্দেগী নিয়ে স্বামীর ভিটের উপরে টিকে রয়েছে। এই বেঁচে বর্তে থাকার জন্যে তাকে সারা জীবন কম যুদ্ধ করতে হয়নি। সে সব এখন ইতিহাস। অতীত সামনে এসে নিজের উপস্থিতির জানান দিতে পারে না। বর্তমানের ধাক্কা তাই অতি বাস্তব। সেই বর্তমান নিয়েই এখন বৃদ্ধা জামিলা বেগম দিশেহারা। যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ- তার বেলায় এই সত্যটা ফলে গেছে অক্ষরে অক্ষরে।

বড় ছেলে দুটোর লেখাপাড়া হয়নি- গোবর গণেশ কিছিমের ছেলে। তারপরেও তারা ছোট খাট কাজকাম করে যার যার সংসার খাড়া করে রেখেছে। বুড়ো অন্ধ মাকেও তারা একটু আধটু সাহায্য করতে পারে, করে থাকে। কিন্তু ছোট ছেলে ফোরকান সব আশা ভরসায় বালি দিয়ে এখন পাগল- বদ্ধ পাগল হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর দুই ভাই তারে এখন দেখাশুনা করে। এত ভাল, এত মেধাবী ছেলেটা তার এভাবে শেষ হয়ে যাবে? কি দিয়ে যে কি হয়ে গেল, কিছুই ধরতে পারে না অন্ধ বৃদ্ধা। কিন্তু সে তো এমন ছিল না। স্মরণ করে মা তার ছোট ছেলে ফোরকানের কথা, তার উজ্জলতার কথা- তার অতীত বৃত্তান্ত। কত কি নাই সে হতে পারতো! কিন্তু এখন সে বদ্ধ উন্মাদ- তা কি তার নিজের দোষে? হতে পারে নিজের দোষে। মানুষকে বড্ড বেশী বিশ্বাস করতো ছেলেটা। মানুষের উপরে কম বিশ্বাস রাখা যেমন দোষের তেমনি বেশি থাকাটাও ভুল। মাঝারী কিছিমের ঈমানদাররাই ঠিক পথে থাকে, ক্ষতিগ্রস্থ কম হয়। সবকিছুর কারণ খুঁজতে যাওয়াটা বোকামী। ভবিতব্যকে নীরবে মেনে নেয়াটা মঙ্গলের মনে হয় বৃদ্ধা জামিলা বেগমের কাছে।

জামিলা বেগমের ছোট ছেলেটা ছিল প্রচন্ড রকমের মেধাবী। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনদিন তাকে বেতন দিয়ে পড়তে হয়নি- উল্টে বৃত্তি পেয়েছে। বুড়ী মাকে সাহায্য করেছে নিজের উপার্জনে। আটক্লাশ থেকে প্রাইভেট টিউশনি করে টাকা এনেছে ঘরে। বিধবা মায়ের সব চাহিদা মিটাতে পেরেছে সেই অতটুকুন বয়স থেকে। অন্য দুই সন্তান নিজেদের নিয়ে থেকেছে, তার জন্যে কিচ্ছু করতে হয়নি তাদের। স্বামী মারা যাবার পর এই ছোট ছেলেটাকে নিয়ে জামিলা বেগম স্বপ্ন দেখেছে খাড়া হয়ে দাড়াবার, দুনিয়ার তাবৎ মানুষের বাঁকা উপেক্ষার উপযুক্ত জবাব দেবার। ছেলে তার দারুণ মেধাবী। রাতদিন পড়ালেখা করে পড়ার ঘরের ভেতরে বসে নীরবে নিভৃতে কঠিন এক প্রাণশক্তি অন্তরে ধরে রেখে। সে খবর একলা ঘরে মা ছাড়া আর কেউ রাখে না। মাকে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা বলে ফোরকান।
-মা, আমাগো চাচারা থাইকাও নেই। হ্যারা আমাগোরে কিছু কইরা দিবোনা। বৃত্তের এই গন্ডি ভাইঙ্গা নিজেগো বাইর হওন লাগবো। অভাবের বৃত্ত বড় কঠিন বৃত্ত মা।
ছেলের আশাভরা কথা মা চোখ বড় বড় করে শুনে আর অবাক হয়। তার প্রতিজ্ঞার শব্দের ঝংকারে নিজের স্বপ্নটাকে শক্ত করে ঝালাই করে নেয়। ছেলের সাথে বেশি সময় গালগল্প করে সময় নষ্ট করতে মন চায় না জামিলা বেগমের। কারণ আগামীকাল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষাটা শেষ হবে। অনেক বড় আশা, অনেক বড় স্বপ্ন- ছেলে তার পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েই মাষ্টারী করবে। পারবেতো তার ছেলে বৃত্তটা ভাংতে? বিশ্বাস আর সংশয়ের মাঝখানে ভেসে থাকে মা- ফোরকানের মা।

সন্ধার সময় চুপিচুপি ফোরকানের পড়ার ঘরে ঢুকলো কে? চোখে এখন একটু কম দেখে জামিলা বেগম। বয়স তো আর কম হয়নি। কম দেখলেও কেউ যে একজন ঘরে ঢুকেছে-এইটা ঠিক। আজ না ফোরকানের পরীক্ষার ফল বেরনোর কথা- মনে পড়ে তার। পড়ার ঘরে ঢুকে মা দেখে- ছেলে তার সন্ধ্যা বাতি না জ্বালিয়ে খাটের উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছে। আলো জ্বালে মা। “কি ব্যাপার বাজান, বহির থেইকা আইয়া হুইয়া পড়লি। পেডে দানাপানি কিছু পড়ছে বলে মনে হইতাছে না। মুখ খানা কেমন শুকনা। আইজ না তোর রেজাল দেয়ার কতা? তার কি অইল?”-মায়ের এতগুলো কথা, এতগুলো প্রশ্নের কোনটা জবাব দেবে ভেবে পায় না ফোরকান। তবে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেও রেজাল্টের কথা সে বলতে পারবে না। কিভাবে পারবে? সে যে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি, বৃত্তটারে ভাঙ্গতে পারেনি। কিভাবে সে জানাবে চকচকে দিনের প্রতিক্ষায় বসে থাকা মাকে সে খবর। “মাত্র চার নম্বরের জন্য হইল না মা। প্রথম শ্রেণী হইলনা। আমার তো সব শেষ হইল, এহন আমি কি করুম, মা”-মুখের উপরে হাত চাপা দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে অবোধ ছেলে ফোরকান। সাধ্যমত স্নেহের সান্তনা দেয় মা।
-হোন, এক দুয়ার বন্ধ অইলে, হাজার দুয়ার খুইলা যায়। তুই তোর মত চেষ্টা কইরা যা। দেখবি এক সময় মঞ্জিলে পৌঁছতে পারবি। তুই অত ভাবিস না, আমিতো আছি।
বৃদ্ধ মায়ে সান্তনা দেয় ব্যার্থ ছেলেকে- গন্ডী ভাঙ্গায় ব্যার্থ সন্তানকে। এক সময় শূন্য খা খা অন্তর আশার পায়রাতে ভরে যায়। বিছানা ছেড়ে উঠে বসে ফোরকান। চোখে মুখে তার ঝিলিক দেয় পায়রাদের ডানার শুভ্রতা।
-তয় মা, আমার মাতায় একখান বুদ্ধি আইছে। কতা দাও আমার লগে আছ তুমি।
-হ, কতা দিলাম। তয় জিনিসটা কি- কবি তো!
-আমারে ধইরা মোট ছয় জন অল্পের জন্য এবার প্রথম শ্রেণী পায় নাই। ওরা সবাই একলগে জাপান যাইতাছে। সবাই একমত হইছে। আমিও ওগো লগে হাত মিলাইছি। এহন তুমি যদি আমার লগে থাক তাইলে আমি যাইতে পারুম। যে কইরা হউক গন্ডি ভাইঙ্গা বাইর হওন লাগবো, মা।
মা রাজী হয়। ছেলের উপরে তার অগাধ বিশ্বাস। বাচা-মরা বিলের পতিত তিন বিঘা জমি বেচে দেয় জমিলা বেগম, অন্য দুই পূত্রের আপত্তি সত্ত্বেও। “ছেলে জাপান যাইতে পারলে সব হইবো, সুদে আসলে ফিরা আইবো সুদিন”- মনে মনে ভাবে মা।
জাপান চলে যায় ফোরকান। সেখানে নতুন এক জীবন শুরু করে সে। লুকিয়ে লুকিয়ে শ্রম বিক্রি করে সস্তায় আরও অনেকের মত। ইতিহাসের তুখোড় ছাত্র হয়ে যায় দিন মজুর। সৃষ্টি করে চলে তার জীবনের ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।
“ভুল হয়েছে, চরম ভুল- আসার সময় কোন ব্যাঙ্কে কোন সঞ্চয়ী হিসাব খোলা হয় নাই। তবে তাতে কোন ক্ষতি নেই”- ভাবে ফোরকান। বড় ভাইরা আছে ওদের কাছে টাকা পাঠালেই হলো। দেশে ফিরে সব ফয়সালা হয়ে যাবে। যে কথা সেই কাজ। বড় ভাইয়েরা বিপুল উতসাহের কথা শুনায় ফোনে, চিঠিতে।
-বেশি কইরা কাম কইরা যা। টাকা পাঠাতে থাকে নিশ্চিন্তে। দেশে ফিরা তুই হইবি কুটিপুতি। কোন চিন্তা করবি না। আমরা তোর লগে আছি।

দুনিয়াতে উপায় ছাড়া কোন সমস্যা নেই। বড় ভাইদের উপর অনেক বিশ্বাস রাখে ছোট ভাই ফোরকান। দুই-তিন-চার করে নয়টা বছর কেটে যায়। মাংশ পেশী গুলো শ্রমে শ্রমে লোনাজল হারায় অজস্র। মাথার চুল পাতলা হয়- কিছুটা ধুসরও হয়ে আসে। শরীর আর আগের মত পেরে উঠে না- কাজে চেকনাই দেখাতে পারেনা। দিনমজুর ফোরকান অবসর নেবার কথা ভাবে, দেশে ফেরার কথা ভাবে। দেশে এখন তার অনেক টাকা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বসে বসে খেতে পারবে। সে এখন কোটিপতি। বিয়ে করতে হবে- সন্তান আসবে। তারা যাতে অভিশপ্ত অভাবের বৃত্তের বাইরে থাকতে পারে সে ব্যাবস্তা করে যেতে হবে। এতসব ভবিষ্যত সম্ভাবনা আর স্বপ্ন মাথার ভেতরে ভরে একদিন শ্রমিক ফোরকান নিজের ঘরে ফিরে আসে। আশাবাদী মা তার তখন বৃদ্ধ, অথর্ব এবং অন্ধ। মাকে দেখে পরানটা মোচড় দেয় ফোরকানের। ছেলের কাছে বেশি কিছু চাওয়ার নেই বৃদ্ধা মায়ের। হারায়ে যাওয়া ছেলে তার ফিরে এসেছে কোলে- এটা তার সব পাওয়া। হারায়ে পাওয়ার আনন্দে অন্ধ চোখে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
– বাজান, তুই আইছস? তুই কই নিখোজ হইছিলি? তোরে ফিরা পামু খোয়াবেও ভাবি নাই। আন্ধা মারে এইভাবে ভুইলা থাকতে আছে, বাজান। তোর কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই। তুই ফিরা আইছস তাতেই আমি খুশি, বেজায় খুশি, বাবা।
কথা বলে আর কাঁদে মা। দু চোখ থেকে জলের একটা সরু ধারা ঝরে পড়ে নরম মাটির মেঝেতে। মায়ের চোখে জল কোনদিন দেখেছে কিনা মনে করতে পারেনা ফোরকান। হাজার রকমের শক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে যে মা এতদূরে এসে পৌঁছেছে, তার চোখে জল? বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না ফোরকান মায়ের সেই কান্না। দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টাবার চেষ্টা চালায়।
-কিন্তু মা, আমিতো প্রতি বছর দুই-তিনটা করে চিঠি দিছি বড় ভাইরে, উত্তর পাইনা বলে বন্ধ করছি। বছরে তিনবার করে ট্যাহা পাঠাইছি বড়ভাই আর মাইজা ভাইয়ের একাউন্টে। আমি নিখোজ হইছি এইডা কেডায় কইল?
-কস্ কিরে ফোরকান, আমার তো সব কেমন জানি লাগতাছে। শিগগির যা তোর ভাইগো লগে দেহা কইরা আয়।
মায়ের মন বড় কোন বিপদের গন্ধ পায়। যে সে ব্যাপার না- নয়টা বছর। তিল তিল পরিশ্রমে গড়া ভাগ্য এক নিমেষে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে পারে। ভাগ্য তার ছেলেরে নিয়ে অতবড় প্রহসন করবে না।

তখনও সন্ধ্যার ডানা দিনের সবটুকু আলো শুষে নিতে পারেনি। রদ্দুর আড়ালে চলে গেলেও তার রেশটুকু ছড়িয়ে আছে আশেপাশে সবখানে। বসন্তের নরম বাতাস হাজার রঙের নিসর্গ সম্ভারের উপরে আলতো ছোয়া দিয়ে যাচ্ছে পরম যত্ন-আদরে। এরই মাঝে উদভ্রান্ত ছুটছে ফোরকান সহোদরদের ঘরের ঠিাকানায়, মাথার ভেতরে অজস্র প্রশ্নবোধক চিহ্ন বয়ে নিয়ে। প্রকৃতির কোন খেলা, বসন্তের কোন রং তার মনে ছোট্ট কোন তরঙ্গও তৈরী করতে পারে না। কারণ তার দৃষ্টি, তার মনযোগ স্থির হয়ে আছে অভিশপ্ত এক বৃত্তের দিকে- অভাবের বৃত্তের দিকে। সংশয়ের দোলাচলে প্রশ্ন করে চলে মন- আবার সেই বৃত্ত, আবার সেই বন্দী দশা?

এক সংগে আরমান, জার্মান- দুই সহদরকেই পাওয়া যায়। দেখা মেলে দীর্ঘ্য নয়টি বছরের ব্যবধানে তাদেরই ঘরে। ছোট ভাইকে দেখে প্রথমে চমকে যায়, অবাক হয় তারা। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় তিন স্বজন- তিন সহদর। অনেকদিন পর একাত্ম হয় তারা। ভাইদের চোখে অনেক প্রশ্ন কোনটা রেখে কোনটা করবে তারা। বড়ভাই আরমান প্রথম মুখ খোলে।
-এতদিন কই নিখোজ হইছিলা, ফোরকান। প্রথম দুয়েক বছর চিঠিপত্র লিখতা, পরে তাও বন্ধ কইরা দিলা। প্রথম বছর যে টাকাগুলো পাডাইছিলা হেইডা আমার কাছে আছে- দুই লাখ টাহার মত। পরে চিঠি ল্যাহা, ট্যাহা পাডানো সব বন্ধ কইরা দিলা। ব্যাপারকি, সব খুইলা কও তো। কত মানুষের লগে যোগাযোগ করছি- তোমার কোন ঠিকানা পাই নাই। কই হারাই গিছিলা কও তো, বাই?
বড় ভাইয়ের কথার সাথে সাথে মেঝ ভাইও মাথা নাড়ে, সায় দেয়। তাদের দুজনের চোখেই বিস্ময়। এতগুলো বছর কোথায়, কিভাবে ছিল তাদের ছোট ভাই ফোরকান। যেন জানতে চায় তারা সব। দুই ভ্রুর মাঝখানে তাদের প্রশ্নবোধক চিহ্ন। পায়ের নীচ থেকে শক্ত মাটি আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে ফোরকানের। সেখানে স্পষ্ট সে দেখতে পায় বড় এক অন্ধকার গর্ত। গর্তের ভেতরে তীব্র বেগে পড়তে থাকে ফোরকান। সে পতনের যেন কোন শেষ নেই- গর্তেরও যেন কোন তলা নেই।
-তাইলে আমার নয়টা বছর, আমার দুই কোটি টাকা, আমার বৃত্তের কি ফয়সালা হবে?
বলতে বলতে জ্ঞান হারায় ফোরকান। ইতিহাসের ছাত্র ফোরকান আবার নতুন কোন ইতিহাস সৃষ্টির পায়তারা করে।
জ্ঞান হারিয়ে বাকশক্তিহীন দিনমজুর একপাশে মাথা কাত করে চেয়ারে বসে বসে যেন পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। জলের ঝাপটায় আর পাখার বাতাসে অনেক সময় পরে জ্ঞান ফেরে তার। ভাগ্য ভাল ফোরকানের। অসময়ে ভাইদের সেবা পাচ্ছে। তাদের আরও সেবা হয়তো ভবিষ্যতে তার লাগবে। আসলেই তাই। ভাইরা তার কাজে আসে, ভীষণ কাজে আসে। আর ওদিকে অভিশপ্ত বৃত্তটা বিরাট অজগর সাপ হয়ে ফোরকানকে চেপে চলে অহর্নিশি। টাকা আর সময়ের ধাক্কা সামলে উঠতে পারে না সে। অশুভ বৃত্তের চাপে পড়ে মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে জামিলা বেগমের ছোট ছেলে। ছোট ভাইয়ের সেবায় মনপ্রাণ ঢেলে দেয় আরমান আর জার্মান। তাদের কর্মকান্ড দেখে মাও খুশি হয়। মনটা তার ভরে যায়- এই না হলে ভাই!

ওদিকে দুই ভাই, দুই সেবকের সকাল বিকেল গোপন পরামর্শ সভা বসে। কেউ তা জানতে পারেনা। জানতে পারে না তাদের বউরা, তাদের মা- গ্রামবাসীও না। আরমান আর জার্মান দুই ভাই কোটিপতি হয়ে যায়- বসে বসে নিরাপদে। কেউ তা জানবেনা, হয়তো অন্তর্যামীও না। দুই ভাইয়ের পরামর্শ চলে গোপনে- কানে কানে, ফিসফিসিয়ে।
-ফোরকানেরে আমি বিয়া দিমু, বুচ্ছস জার্মান। তাইলে কেউ আর সন্দেহ করবো না।
-এইডা কইরেন না। তাইলেতো পাগলাডার ছাও বাচ্চা হইব, ভাইজান।
-ধুর ব্যাক্কল, যত মানুষ বেশি হইবো ততো ছওয়াব। আর মাইনষেরে খাইতে দিতে কয় পয়সা লাগে? চিন্তাকর, আমরা যহন ওর পুরা পরিবারটারে টানুম আমাদের সুনাম কি পরিমাণ হইবো! অর জন্যই তো আমরা কোটিপতি। ওরে এট্টু টানলে আমাগো কোন ক্ষতি অইবো না। আর ভাইবা দ্যাখ- পাগলাডা যহন তার বউ, পোলা মাইয়া সহ চার পাঁচখান হাত আমাগো দিকে বাড়াইয়া ধরবো নিজেরে তোর তহন ভগবান-ভগবান লাগবো না? পাগলার এম এ পাশের চেকনাই তহন দেহা যাইবো। মাথার ঠিক নেই আবার বড় বড় পাশ দেয়। ঐইতো মায়রে আমাগো বিরুদ্ধে বিষাইছে।
কথা বলতে বলতে বড় ভাইয়ের নাকের দুইপাশের বিরক্তি রেখা গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে। এক ধরনের অসহ্য ঘৃণায় মুখ তার থুথুতে ভরে যায়। বড় এক ঢোক গিয়ে তা চালান করে দেয় পেটে। তখন একটু প্রশান্তি আসে মনে। প্রশান্তি আসে ছোট ভাইয়ের পতনের ভবিষ্যত চালচিত্র বিবেচনা করে। বড় ভাইয়ের মনের এই খবর জার্মান ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না।

বড় ভাই আরমান এখন সত্যি সত্যি বড় ভাই- ফোরকানের আসল অভিভাবক। মায়ের চোখে, গ্রামবাসী, আর প্রতিবেশীদের চোখে সে বড় মানুষ- অন্যমানুষ। বড় ভাইয়ের সিদ্ধান্তই এখন সবার সিদ্ধান্ত। বিয়ে দিলে পাগল ঠিক হয়ে যাবে- আরমানের এই তত্ত্বেও এখন সবাই মত দেয়। এই সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়ে কিভাবে যেন পাগলা ফোরকানের বিদ্ধস্ত চেতনা পেয়ে যায় বড়ভাই আরমানের মনের খবর। অসংখ্য কাল-সাপ চরে বেড়ায় যে কপট মনের চাতালে- সেই মনের খবর। এতদিন অভাবের বৃত্ত ঘিরে ছিল পাগলা ফোরকানকে এবার যেন ধেয়ে আসছে কৃতদাসত্বের বৃত্ত। তার আর কোন পথ নেই খোলা যেখান দিয়ে সে পালাবে। বিয়ের পিড়িতে বসার আগেই ভাংতে হবে সব- ভাংতে হবে বৃত্ত, গন্ডি। ভয়ংকর জটিল এই খেলা তাকেই বন্ধ করতে হবে, কিন্তু কি ভাবে? অতঃপর শুভ দিনের শুভ যাত্রার শুরুতে ঘটে যায় অঘটন। কেউ তাকে খুজে পায় না কোথাও আর। গেল কোথায় বেয়াক্কেলটা- দরদী ভাইদের কপালে চিন্তার রেখা। ফোরকান পালগকে সহসা সবাই আবিষ্কার করে অশ্বত্থ গাছের শক্ত ডালে- ঝুলন্ত, শ্বাসরুদ্ধ। মুক্ত হলো ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র ফোরকান। সৃষ্টি করলো নতুন এক ইতিহাস। হাজার চেষ্টায় যে অভিশপ্ত বৃত্ত সে ছিড়তে পারেনি, দূর করতে পারেনি, মৃত্যুর ভেতর দিয়ে সেই বৃত্তই তাকে ছেড়ে চলে গেল একেবারে। কিন্তু কোন কিছু দিয়েও তার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা সত্যগুলো দিনের আলোর মুখ আর দেখল না। কাউকে সে বলে যেতে পারল না- এই আমার নয় বছরের হিসাব। সত্য বড় ক্ষিনায়ু- দুর্বল। তার সাধ্য নেই ফোরকানকে অন্ধকুপ থেকে টেনে তোলে। সব সত্য প্রকাশ হয় না, হতে নেই। তেমনি অনেক বড় বড় মিথ্যা সত্যের মত জ্বল জ্বল করে টিকে থাকে। নিজের জীবন দিয়ে সে কথা প্রমাণ করে গেল ফোরকান পাগল।