‘শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ- সক্রেটিস
‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা’- এরিস্টটল।
‘শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিরেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে-রবীন্দ্রনাথ

শিক্ষাকে যে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হউক কোন একটি দেশ বা জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হল নারী পুরুষ নির্বিশেষে সার্বজনীন অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা তা আজ সর্বজনবিদিত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কোন দেশ বা জাতির কৃষ্টি সভ্যতাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নিরীহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর উপর বারবার খড়গ নেমে এসেছিল বহিঃশত্রু দ্বারা। দিন বদলেছে সে সব ইতিহাস এখন সুদূর অতীত। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নারী পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত আজ সবদেশে। ব্যতিক্রম কেবল কিছু কিছু ইসলামি দেশ ও আলেম শ্রেণী। তাদের দৃষ্টিতে নারীর জন্য উচ্চ শিক্ষা অপ্রয়োজনীয়। স্বামীকে সেবা দেয়ার মত যৎকিঞ্চিত শিক্ষা আর পবিত্র বই আওড়ানোর মত শিক্ষাই মেয়েদের জন্য যথেষ্ট মনে করে তারা।

সার্বজনীন আধুনিক শিক্ষাকে কেন্দ্র করে তরুণ বয়সে তেজদীপ্ত মনোবাসনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে যে দুটি পরস্পর বিপরীতধর্মী চরিত্র রোমাঞ্চকর খবরের জন্ম দিয়ে বিশ্ব বিবেবকে স্তম্ভিত করেছে তাদের একজন মালালা ইউসুফজাই। অন্যজন ২১ বছরের টগবগে যুবক নাফিস। নাফিসের জন্ম অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে হলেও মনন মানসে ঠিকই ধারণ করে আছে মৌলবাদী আদর্শের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক চেতনা। সেই চেতনার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল নিজ দেশে। আর মহিরূহ আকার ধারন করেছে পরবাসে। এই চরিত্রটিকে নিয়ে ইতিপূর্বে মুক্তমনায় লেখা হয়েছে। তাই আমার আজকের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে মালালাকে ঘিরে।

এই অকুতোভয় মেয়েটির জন্ম পাকিস্তানের পাক্তুন খোয়া জেলার অন্তর্গত সোয়াত উপত্যকায় ১২ই জুলাই ১৯৯৭, বয়স মাত্র১৫ বছর। ৯ই অক্টোবর, ক্লান্ত মালালা চড়ে বসেছে বাসে, আনমনে অপেক্ষার প্রহর গুণছিল ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার অস্থিরতায়। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে এগিয়ে চলছে বাস, বাসের তালে তালে দুলে উঠছে বাস যাত্রীদের অলস দেহ। হঠাৎ নির্দয় কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র গর্জে ওঠে ঠা ঠা শব্দে। মূহুর্তে শুরু হয় ভয়ার্ত চিৎকারে কান্না আর ছোটাছুটি। বৃষ্টির মত শত শত বুলেট তীক্ষ্ণ শব্দে সাঁই সাঁই করে ধেয়ে আসতে শুরু করে চলন্ত বাসটির দিকে। ঘটনা আঁচ করার পূর্বেই হাজার মাইল বেগে ছুটে আসা বুলেট তীব্র গতিতে বিধে যায় মালালার মাথা ও ঘাড়ে, লুটিয়ে পরে তৎক্ষনাত, খাবলে তুলে নেয় আরো দুই শিক্ষার্থীর কচি শরীরের নরম মাংস। থেতলানো শরীরের গা বেয়ে হড়হড়িয়ে ঝরে পরা রক্তে নিমিষেই ভিজে যায় চারদিক, রক্ত আর রক্ত। ছোপ ছোপ রক্তে স্তব্ধ হয় পুরো বাস। কোরবানি পশুর ফিনকি দিয়ে ছোটা লাল রক্তের সাথে গড়িয়ে পড়া এই রক্তের কোন বিশেষ পার্থক্য খুজে পায়না ধর্মান্ধের দল। অতীতেও পায় নি, ভবিষ্যতেও পাবে না। প্রগতিশীল বিজ্ঞান মনষ্ক, কুসংষ্কার মুক্ত স্বাধীন চিন্তাশীল যে কোন ব্যক্তি্র অবয়ব তাদের চিরশত্রু, চোখের বালি, পথের কাঁটা। মাথা ঠান্ডা রেখে সৃষ্টিকর্তার নামে পৈচাশিক কায়দায় তাদের ফালি ফালি করা এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠির কাছে ধর্মীয় উৎসবে পশু হত্যার মতই বিনোদনের। এক একজন তারা সর্বশ্রেষ্ঠ সহিধর্ম পথের অতন্দ্র প্রহরী, ধর্ম রক্ষক। নেই মানবিকতা, নেই সামান্য অনুশোচনার লেশ আছে দূর্বোধ্য ভাষায় দ্বিচারিত অর্থবোধক স্তবকের পর স্তবক আবৃত্তির ফুলঝুড়ি। অদৃশ্য কল্পিত লোভী স্রষ্টার মনোরঞ্জনে তোষামোদ জ্ঞাপন করে ধন্য করে নিজেদের জীবন। সুযোগ বুঝে পর জীবন করে বিপন্ন। অহর্নিশি হুংকার ছাড়ে আরো কঠোর পরিণতির।

অবাক বিস্ময়ে ভাবনার অন্তরালে উঁকি মারে, এই টুকুন বয়সে সদা হাস্য এই ফুটফুটে মেয়েটি কি এমন অসীম শক্তির খোঁজ পেয়েছিল যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল ধর্মান্ধদের কল্পিত বিশ্বাসের নিরেট দূর্গ! তাকে হত্যা করতেই হবে এই ব্রত নিয়ে কেন মরিয়া হয়ে হত্যার ছক সাজাতে হল বিশেষ পক্ষের প্রতিনিধি এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর? কি এমন অমার্জনীয় অপরাধ ছিল তার?

গোলা নেই, বারুদ নেই, বোমা নেই, নেই কিঞ্চিত পরিমাণ সামরিক জ্ঞান। শুধু মানসিক শক্তি সম্বল করে কিভাবে সে কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে আর্বিভূত হল শরিয়া প্রতিষ্ঠাতাদের?

সে কি বংশ পরাম্পরা প্রাপ্ত বিশেষ ধর্মটি ত্যাগ করে অন্য কোন পছন্দ সই ধর্মকে বরণ করার দুঃসাহসী ঘোষণা দিয়েছিল?
নাকি সব ধর্মকে ক্রমাগত প্রশ্নঅস্ত্র প্রয়োগে হাড্ডি মাংস আলাদা করে ভীড়ে যেতে চেয়েছিল অবিশ্বাসী বর্গের নাস্তিক্য দলে?
না, এসব অজুহাতের বিড়ম্বনা ছিল না মোটেই।

সরাসরি সে অভিযুক্ত হয়েছিল তালেবান নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞার মারাত্মক অভিযোগে। তালেবানের হুংকার শুনলেই যেখানে পৃথিবীর কর্তা ব্যক্তিটির থরথরিয়ে কাঁপন ধরে, রাতের ঘুম উদাও হয়, সেখানে এই পুঁচকে মেয়েটি কিনা তাদের নিষধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে! এত বড় হিম্মত!

এইতো সেদিন ২০০৯ সালের শুরুর দিকে সোয়াত উপত্যকা নিয়ন্ত্রনে নেয়ার পরপরই তালেবানরা স্পষ্ট ভাষায় মেয়েদের স্কুলে যাওয়া, দোকানে কেনাকাটা করতে যাওয়া, টিভি দেখা ও নাচগানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। অতঃপর সরকারি এক পুলিশ কর্মচারীর ধর থেকে মাথা আলাদা করে বিচ্ছন্ন দেহটি অনেকক্ষণ ঝুলিয়ে রাখে শহর প্রাঙ্গনে তাদের বর্বরতার নিদর্শন দেখাতে।
মালালা তখন কেবল শিশু থেকে কৈশোরে পা রেখেছে। বয়স মাত্র ১১ কি ১২ বছর হবে। বিদ্যাউৎসাহী স্বাধীনচেতা মালালা এই নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে পারেনি। উন্নত বিশ্বের আর সব মেয়ের মত সে বেড়ে উঠতে চেয়েছে স্বাধীনভাবে। শৈশবকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছে উচ্ছ্বলতায়। প্রতিক্রিয়াশীল আঁতুড়ঘরে বাস করেও ছিন্ন করতে চেয়েছে মৌলবাদী ধ্যান ধারনার নাগপাশ। শিক্ষার পাদ প্রদীপের আলোয় খুঁজে নিতে চেয়েছে কুসংষ্কার মুক্ত জীবণ। মনের গহীন রোপন করেছিল মুক্ত জীবনের বীজ। হতে চেয়েছে স্বাবলম্বী, চেয়েছে নারীমুক্তি। লক্ষ্য পরাহত হচ্ছে দেখতে পেয়ে শুরু করে নীরব বিদ্রোহ। মেয়েদের লেখাপড়ার পক্ষে আর তালেবান শাসন ব্যাবস্থার কঠোরতা নিয়ে ক্রমাগত লিখে জনমত সৃষ্টিতে কাজ করে গেছে বিবিসি ব্লগে অন্তর্জালের সহায়তায়৷

অন্তর্জালে তার লেখালেখির প্রবেশ ছিল কিছুটা নাটকিয়তা ও সাথে সাহসীকতার যৌথ মিশেল। বাবা জিয়াউদ্দীন ইউসুপজাইয়ের প্রত্যক্ষ সহায়তা পেয়েছে দু’হাত ভরে। তিনি একাধারে কবি ও স্কুল পরিচালক। তালেবানরা সোয়াত উপত্যকা দখলের পর সেখানে বসবাসরত শিশুদের পড়াশোনা, তাদের ভবিষ্যতের ওপর তালেবানের কী ধরনের প্রভাব কাজ করছে তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করার চিন্তা করলেন বিবিসি উর্দু বিভাগের কিছু লোকজন। সে লক্ষ্য সামনে রেখে কিছু স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেন। মালালার বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। পরিচয়ের সূত্র ধরে বিবিসির নিয়মিত রির্পোটার আব্দুল হাই কাক্কর জিয়াউদ্দীনকে অনুরোধ জানান নারী অধিকার রক্ষার স্বার্থে তাঁর স্কুলের কোন ছাত্রী যাতে মেয়েদের উপর তালেবানের কট্টর অণুশাসন নিয়ে বিবিসিতে নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠায়। আয়েশা নামের সাহসী একটি মেয়ে এগিয়ে আসে প্রথম দিকে কিন্তু মেয়ের জীবণের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাদসাধে মেয়েটির পরিবার। অকাল মৃত্যুর তাড়া আছে জেনেও সে সুযোগ গ্রহণ করে মালালা। পাশে পায় তালেবানের বিপক্ষে চির লড়াকু সৈনিক বাবা জিয়ায়দ্দীনকে। তালেবান শাসনের যাঁতাকলে মেয়েদের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের দিনগুলোর কথা বিবিসি উর্দু সার্ভিসে প্রকাশ করতে থাকে নিয়মিত। নিরাপত্তার খাতিরে নিতে হয় ছন্ম নাম-‘গুল মাকাই’। তার লিখিত দিনলিপি ‘লাইফ আন্ডার দি তালিবান’প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে মালালা। পরের বছর “নিউইর্য়ক টাইমস” তার জীবনী নিয়ে একটি ডকুমেন্টরী প্রচার করে। তার ডায়েরিটি প্রায় ১০ সপ্তাহ নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিলো।
তালেবানের হাত থেকে সোয়াতা উপত্যকার দখল মুক্ত করতে ২০০৯ সালে সেনাবাহিনী তালেবান বিরোধী অভিযানে নামে। গোলমালের আশংখায় মালামার পরিবার আগে ভাগেই গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। তার ডয়েরি প্রকাশও হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল হলে ২০০৯ সালের শেষ দিকেই মালালার পরিবার আবার নিজ গ্রাম সোয়াতে পদার্পন করে। গ্রামে ফিরে আসার কিছুদিন পর একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গেলে ছন্ম নামের খোলস চিঁড়ে আসল নাম ফাঁস করেন বাবা জিয়াউদ্দীন ইউসুফজাই। শুরু হয়ে যায় মালালাকে নিয়ে সকলের হৈ চৈ। পুরো পাকিস্তানের নারী অধিকার আন্দোলনের রোল মডেল হিসাবে মিডিয়ার আলো এসে পড়ে তার উপর। পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও টিভিতে মালালার বেশ কিছু সাক্ষাৎকার প্রচারিত হতে থাকে নিয়মিত। সেইসুবাদে মামালা জনপ্রিয় ও নারীমুক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে অল্প দিনে।

ধর্মযোদ্ধা তালেবানি সিদ্ধান্তকে অবমাননা করার দুঃসাহস দেখানো পুচকে মেয়ের এই অবাধ জনপ্রিয়তা অর্জন একদম সহ্য হয়নি ধর্ম রক্ষকদের। তালেবানরাও হাত গুটিয়ে বসেছিল ভাবলে ভুল করবেন, তারাও পাঠাতে থাকে তালেবানি উপহার। বলাবাহুল্য সেসব উপহার ভরে থাকতো হুংকার, মুখ বন্ধ করার নির্দেশ, নয়তো মৃত্যু পরোয়ানা৷ এসব কিছুর পরেও মালালা দমে যায় নি একটু, পিছু হটেনি সামান্য৷ এমন সাহসী প্রতিবাদী অন্যন্য চরিত্রকে স্বীকৃতি দিতে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, আর্ন্তজাতিক পুরষ্কার সহ বেশ কিছু পুরষ্কার হাতে উঠতে থাকে নিয়মিত বিরতিতে। চারদিক থেকে ছুটে আসতে থাকে রাশি রাশি সন্মান আর অভিনন্দনের ঢালি।

অনেক হয়েছে আর নয়, মালালা নামের বিষ ফোঁড়া নিশ্চিহ্ন করে দিতে তালেবানরা বেছে নেয় ৯ই অক্টোবরের দিনটিকে। এর পরের ঘটনা সকলের জানা।

তালেবানি বর্বরতার পরেও কোটি মানুষের ভালোবাসা, বিজ্ঞানের আর্শীবাদ আর কাফেরদের প্রচেষ্টা এই ত্রিরত্নে সিক্ত হয়ে মালালা টিকে আছে আজো। বেঁচে থাক অনাগত দিনগুলোতে, ফিরে আসুক মানুষের মাঝে, হয়ে উঠুক উল্টোচলার দেশে নারী অধিকার আন্দোলনের উজ্জ্বলতার প্রতীক এই প্রত্যাশা হোক সকলের।