বাংলায় ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের অর্থ হল সাহসী নারী, বীর নারী। ‘বীরাঙ্গনা’ আসলে শুধু একটি শব্দ নয়; এর সাথে জড়িয়ে আছে যুদ্ধ, নিপীড়ন, নির্যাতন, স্বাধীনতা, লক্ষাধিক নারীর আর্তচিৎকার ও একটি দেশের জন্ম।

বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা নিপীড়িত বাংলাদেশী নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই লক্ষাধিক নারী নির্যাতিত হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর পরিবার ও সমাজ থেকে ধিককৃত হয়ে এঁদের অনেকেই ভারতে চলে যান, অনেকে আত্মহত্যা করে। যারা সব দেশে রয়ে গিয়েছিলেন, তাদের সহ্য করতে হয়েছে সীমাহীন অপমান।

আলেয়া বেগম; একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেরো বছর। কিশোরী আলেয়াকে বোন লাইলীসহ ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী। এরপরের ঘটনাগুলো আলেয়া বেগমের কাছে শুধু দু:স্বপ্ন।

‘আমার মত হাজারো মেয়েদের ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের হাত বেঁধে রাখা হত। সিগারেট দিয়ে ওরা মুখ, শরীরে ছেঁকা দিত।
দিনে কয়েকবার দলবেঁধে পাকিস্তানী সেনা, বিহারী আর ওদের স্থানীয় দোসর কুকুরগুলো আমাদের অত্যাচার করতে আসত। যন্ত্রনায় কাতরাতাম কিন্তু তারপরও অমানুষগুলো আমাদের রেহাই দিত না। যেসব মেয়েদের আর অত্যাচার করার অবস্থা থাকত না, তাদেরকে মেরে ফেলত শুয়োরগুলো।
আমাদের ঠিকমত খেতে দেয়া হত না। দিনে একবার শুকনো রুটি আর মাঝে মাঝে অল্প কিছু সবজি খেতে দিত।
এই নরক থেকে আমরা অনেকবার পালানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি।’

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আলেয়া বেগমকে উদ্ধার করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধের পর আলেয়া যখন নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন, তখন তিনি পাঁচ মাসের গর্ভবতী। আলেয়ার বাচ্চাটি জন্মের পর পরই মারা যায়।

‘যুদ্ধ শেষে বাড়ি বাড়ি ফিরে আসি। ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না! সব কিছু আরো এলোমেলো হয়ে গেল। আমাকে নষ্ট মেয়ে ভাবতে লাগল সবাই। নানানভাবে অপমান-অপদস্ত করতে লাগল।
অপমান আর সইতে না পেরে ঢাকায় চলে আসি। মানুষের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ নিই।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় আলেয়া বেগমের সাথে যা হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ, সাধারণ মানুষের অধিকাংশই তা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। আলেয়া বেগম সব সময় একাত্তরের ঘটনা সবার থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইতেন, পাছে যদি আবার কেউ তাঁকে এ নিয়ে আবার অপমান করে।

অপমানিত হতে হবে এই ভয়ে আলেয়া বেগম তাঁর বিয়ের সময় স্বামীর কাছ থেকে একাত্তরের ঘটনা লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু একদিন আলেয়ার স্বামী সব জানতে পারে। আলেয়ার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর বদলে তাঁকে অপমান করা হয়, ঘর থেকে বের করে দেয়া।

‘আমার মেয়ের জোরাজুরিতে আমার স্বামী আমাকে আবার ঘরে ঢুকতে দেয় কিন্তু একাত্তরের ঘটনা কখনও মুখে আনতে বারণ করে।’

আলেয়া বেগমের একটি মেয়ে আছে, আসমা আকতার একা।

‘আমাদের সমাজ বীরাঙ্গনাদের নিয়ে অস্বস্তিতে থাকে কিন্তু আমি আমার মা আর খালাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। কারন, উনাদের জন্য আজ আমাদের দেশ স্বাধীন।’

কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সবাই আসমার মত ছিল না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয় আলেয়াদের মত লাখ লাখ নারীকে। অথচ যুদ্ধ পরবর্তী সমাজ আলেয়াদের মাথায় তুলে রাখার বদলে নষ্ট মেয়ের উপাধি(!) দেয়।

‘দেশ, সরকার, সমাজ কেউ আমাদের দেখেনি। স্বাধীন দেশে কেউ আমাদের জন্য কিছু করেনি। আমাদের অনেক কষ্ট। মানুষ আমাদের খারাপ দৃষ্টিতে দেখে, যেন আমরা অপরাধ করেছি।
কি দাম আমাদের এই জীবনের? কি দিয়েছে এই জীবন আমাদের?’

একাত্তরে আলেয়া বেগমের সাথে তার বোন লাইলী বেগমও পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। তখন লাইলী বেগম গর্ভবতী ছিলেন। পাকিস্তানী ক্যাম্পে বন্দী থাকার সময় তাঁর বাচ্চা মারা যায়। পরবর্তীতে লাইলী বেগম হেমায়েত বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন।

‘আমরা সব হারিয়েছি। সন্তান, সংসার, বাড়িঘর, মান-সম্মান সব হারিয়েছি। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন ছিল, স্বাধীন দেশের সুন্দর সমাজের স্বপ্ন। পাকিস্তানীদের হাতে সেই স্বপ্নের যেন মৃত্যু না ঘটে, সেজন্য আমরা লড়েছিলাম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু স্বাধীন দেশে কেউ আমাদের মনে রাখেনি। স্বাধীন দেশে সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলাম কিন্তু স্বাধীন দেশের সমাজ আমাদের অসম্মান, অপমান, অপবাদ, ঘৃণা ছাড়া আর কিছু দেয়নি।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে দুই লক্ষাধিক নারী নিপীড়নের শিকার হয়। দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলেছিল এঁদের উপর পাশবিক নির্যাতন।

যুদ্ধের পর এঁদের অধিকাংশকে সম্মান জানানোর বদলে অপবাদ দিয়েছিল বাংলাদেশের সমাজ। খুব কম নারীই সবার সামনে এসে নিজেদের কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন।

বীরাঙ্গনারা আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র থেকে কিন্তু খুব বেশি কিছু চাননি। ওঁরা আমাদের করুনা, দয়া চায়নি। ওঁরা চেয়েছিল শুধু বীরের সম্মান।

বাংলাদেশ নামের স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশটি ও এর মানুষ এই সব বীর নারীদের কাছে চিরঋণী।

(Deutsche Welle তে প্রকাশিত সারাহ বার্নিংয়ের সম্পাদনায় বিজয়িতা দাসের রচিত প্রবন্ধ অবলম্বনে)