দুইটা গবেষণার কথা বলব, আমার কাছে বেশ ইন্টেরেস্টিং কিংবা চিন্তাদায়ক মনে হয়েছে বলতে পারেন।

বহুকাল আগে অর্থনীতি’র জনক অ্যাডাম স্মিথ বলেছিলেন, ‘কেউ কোনদিন একটা কুকুর’কে অন্য কুকুরের সাথে কিছু বিনিময় করতে দেখেনি, অর্থাৎ কোন কুকুর কখনো আরেক কুকুরের সাথে একটা মাংসের হাড়ের বিনিময়ে অন্য কিছু নেয়না।’ মোট কথা উনি বলতে চেয়েছিলেন মানুষ বাদে আর কেউ বিনিময় প্রথা কিংবা মনেটারি এক্সচেঞ্জ-এর তাৎপর্য বুঝতে পারেনা। কিথ চেন- এই মতবাদ ঠিক কিনা বুঝার জন্য একটা গবেষণায় নামলেন।  কিথ চেন একজন চাইনিজ-অ্যামেরিকান। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনা করার পর ইয়েল-এর সহকারী প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন।

তো এই গবেষণার জন্য কিথ চেন কাপুচিন নামের এক ধরনের বানরকে বেছে নেন। দেখতে বেশ কিউট এই জাতের বানরগুলো আকারে এক বছর বয়স্ক বাচ্চার সমান। লেজ অবশ্য বেশ লম্বাই এদের, আবার ব্রেনের সাইজ বেশ ছোট। ব্রেনের আসল ফোকাস হচ্ছে মোটামুটি দুইটা, খাদ্য আর সেক্স। বুঝতেই পারছেন মানুষের সাথে খুব একটা অমিল নাই। 😛

এই গবেষণায় চেনের আরেক সহযোগী ছিল ভেঙ্কাট লাক্সমিনারায়ান। তারা দুইজন মিলে সাতটা কাপুচিন নিয়ে ইয়েল-এর নিউ হ্যাভেন হাসপাতালে লরি স্যান্টসের সাথে দেখা করতে গেল। গবেষণার শুরুতে এই কাপুচিনগুলোর নাম’ও দিলো তারা। সাতটা কাপুচিনের মধ্যে তিনটা ছিল পুরুষ আর চারটা নারী। জেমস বন্ড সিরিজের বিখ্যাত সিআইএ এজেন্টের নাম অনুসারে আলফা মেল কাপুচিন-এর নাম দেয়া হল ফেলিক্স।
বানর গুলো বেশ বড় এক খাচায় থাকতো, আর এই বড় খাচার এক পাশেই একটা অপেক্ষাকৃত ছোট খাচা ছিল যেখানে আসলে তাদের নিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষা করা হতো। তো এই বানরদের মুদ্রা হিসেবে দেয়া হল এক ইঞ্চি বিশিষ্ট সিলভারের গোলাকৃতি পয়সা। প্রথমেই তাদেরকে শেখানোর চেষ্টা করা হল যে এই পয়সা গুলোর একটা ভ্যালু বা মূল্য আছে। এইটা বুঝাতে বেশ ভালোই বেগ পেতে হয়েছে, পয়সা নিয়ে প্রথমে এরা খাওয়ার চেষ্টা করেছে এবং আরও কিছু আকাম-কুকাম করার চেষ্টা চালাইছে। অবস্থা বুঝতে পেরে চেন এবং তাঁর দল প্রতিবার পয়সা দেবার সাথে সাথেই বানরের খাবারের ব্যবস্থা করলো, কিন্তু বানরদের ঠিক খেতে দিলনা। শুধুমাত্র বানররা পয়সা গুলো ঠিক ঠাক ফেরত দিলেই সেই খাবার দেয়া হতো।  শেষ মেষ পয়সার কারিকুরি বানররা ঠিকই বুঝতে সমর্থ হলো।

মজার ব্যাপার হলো, দেখা গেল, একেক বানরের একেক রকম খাবার পছন্দ। প্রত্যেককেই ১২ টি করে পয়সা দেয়া হয়েছিল, কারো হয়ত জেলো কিউব পছন্দ, কেউ হয়ত পছন্দ করে আপেল স্লাইস। পয়সা দিলেই পছন্দসই খাবার পেত বানরেরা।

এরপর চেন বাস্তবের সাথে আরও মেলানোর জন্য কিছু ট্রিক শুরু করলো। আগে যদি এক পয়সায় তিনটি জেলো পাওয়া যেত, এখন পাওয়া গেল দুইটা। মানে বানরদের মাঝে ইনফ্লেশন ঢুকানো হল আর কি! যাই হোক, দেখা গেল, মানুষের মতই তারাও কোন জিনিসের দাম কমে গেলে বেশি কিনে, আবার বেশি হলে কম কিনে! তাদের এরকম যুক্তিযুক্ত আচরণ দেখে চেন চাইল দেখতে বানর’রা অযৌক্তিক আচরণ করে নাকি। এবার তাদের মধ্যে ঢুকানো হল গ্যাম্বলিং। এইটা পরিক্ষার জন্য সে একটা আঙ্গুর দেখাল বানরকে এবং একটা পয়সার সাপেক্ষে টস করে জিতলে বানরটা একটা আঙ্গুর বেশি পেত, হারলেও ওই আগের একটা আঙ্গুরই পেত। আরেক ক্ষেত্রে চেন দুইটা আঙ্গুর দেখাল, এ ক্ষেত্রে টসে জিতলেও দুইটা আঙ্গুর-ই পাবে কিন্তু হারলে একটা আঙ্গুর রেখে দিয়ে বাকিটা দেয়া হবে। মানে গড়ে দুই ক্ষেত্রেই একই সংখ্যক আঙ্গুর পাবে বানরেরা। সুতরাং যে কোন একটা নির্বাচন করলেই হয়, কারণ ফলাফল তো আসলে একই। কিন্তু কিছুদিনের ডাটা নিয়ে দেখা গেল, অধিকাংশ বানরই আসলে দুই আঙ্গুর ওয়ালা গবেষকের কাছে না গিয়ে এক আঙ্গুর ওয়ালা গবেষকের কাছে গেল। কারণ কি?

মনোবিজ্ঞানীদের কাছে এর একটা ব্যাখ্যা আছে, ‘লস অ্যাভার্সন’(Loss Aversion), অর্থাৎ একটা আঙ্গুর বেশি পাবার চাইতে একটা আঙ্গুর হারানোর দুঃখ অনেক বেশি। শুধু বানর নয়, মানুষের মধ্যেও এই প্রবণতা বেশ প্রবল ভাবেই বিদ্যমান। চেন-এর মতে, বানরদের সিদ্ধান্ত গুলো নিয়ে সে যে ডাটা সেট তৈরি করেছে, তা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের সাথে বেশ ভালোভাবেই মিলে যায়।

এরপর একদিন হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়। কাপুচিন-দের মধ্যে যার নাম ছিল ফেলিক্স সে কি মনে করে তার যোগানো সব পয়সা এক্সপেরিমেন্টের খাঁচা থেকে বের হয়ে বড় খাঁচায় গিয়ে ফেলে দিয়ে বসে থাকে। এই বোকামি টের পাওয়া মাত্রই বাকি সব বানরের মধ্যে হুলস্থূল পরে যায় এই ছড়ানো ছিটানো পয়সা গুলো নিয়ে। এইটা দেখে চেন খাঁচার ভেতর ঢুকে নিজেরাই পয়সা গুলো সংগ্রহের চেষ্টা চালায়, কিন্তু বানরেরা সেগুলো দিতে একদমই নারাজ। এই সংগ্রহ করার চেষ্টা চালানোর সময়েই চেন দেখল, এক বানর তাকে পয়সা ফেরত না দিয়ে বা কোন খাবার না কিনে এক কোনায় সে আরেক বানরকে দিয়ে দিলো। আগে গবেষণা থেকেও দেখা গেছে যে কিছু বানরদের মধ্যে দান করার(Altruism) একটা প্রবণতা আছে। চেনও তাই ভাবতে থাকলো, কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই সে দেখল, সেই দুই বানর রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত এবং তাকে তাকে আরও অবাক করে দিয়ে সেক্স করার ঠিক পর পরই এক বানর তার বাড়তি পয়সা নিয়ে এসে খাবার চাইল। বুঝতেই পারছেন, বানরদের মধ্যে ‘প্রস্টিটিউশন’ চালু হয়ে গিয়েছিল।

এই কর্ম দেখে চেন খুব অবাক হলেও মনে মনে বেশ খুশি হল এই ভেবে যে আরও জটিল সব পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ত করা যাবে এই বানরদের নিয়ে। কিন্তু বাঁধ সাধল কতৃপক্ষ। বানরদের এই পতিতাবৃত্তির কাহিনী জানার পর তারা এই গবেষণা বন্ধের নির্দেশ দেয়, তাদের ভয় ছিল এরা আজ প্রস্টিটিউশনে নামছে, কয়দিন পর হয়ত এই পয়সার জন্য অন্য বানরকে খুনও করে ফেলতে পারে। মোট কথা, এই বানরদের সামাজিক কাঠামোতেই বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন চলে আসতে পারে।

মানুষের অবস্থা দেখে অবশ্য মনে হয়, তারা খুব একটা ভুল ভাবেনাই।

৩ 
মানুষ বরাবর-ই অভিযোগ প্রিয়। সচরাচর সবচাইতে বেশি যে অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায় তা এক লাইনে বলতে হলে দাঁড়ায় এরকমঃ ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ জাস্টিন বিইবারের গান শুনে এরকম মনে হলে আপনাকে ঠিক পুরোপুরি দোষ দেয়া যায়না, তবে বাস্তবতা হল আপনার এইরকম অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল।

যেমন ধরুন শিশুজন্মের কথা। পশ্চিমা দেশগুলোতে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১০০০ জনে মাত্র ৯ জন। মাত্র ১০০ বছর আগেও এই হার ছিল আজকের চাইতে ৫০ গুণ বেশি! এই অসংখ্য মা’র মৃত্যুর কারণ ছিল পিউপেরাল ফিভার(puerperal fever), মা’র সাথে সাথে বাচ্চার জন্যও আসলে হুমকিস্বরূপ। ১৮৪০ সালের দিকে লন্ডন, প্যারিস সহ ইউরোপের আরও অনেক বিখ্যাত হাসপাতাল গুলোতে প্রায় একই অবস্থা, এই পিউপেরাল ফিভারে পুরো ইউরোপ-ই মোটামুটি অতিষ্ঠ ছিল। একেবারে সুস্থ-সবল মা’ও দেখা গেল বাচ্চা জন্ম দেবার কিছুদিন পর এর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে লাগলো।

সেই সময়ের সব চাইতে বিখ্যাত হাসপাতাল বোধ হয় ছিল ভিয়েনা’র জেনারেল হসপিটাল। ১৮৪১ থেকে ১৮৪৬ সালের মধ্যে প্রায় ২০,০০০ বাচ্চার জন্ম হয় এই হাসপাতালে, এই বাচ্চা জন্ম দিতে প্রায় ২০০০ মা অর্থাৎ প্রতি ১০ জন বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে একজন মা মারা গিয়েছেন। ১৮৪৭ সালে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে, প্রতি ৬ জন বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে একজন মা মারা যায়।

সেই সময়ে হাঙ্গেরির এক তরুণ ডাক্তার ইগনাজ সেমেলউইজ ভিয়েনার জেনারেল হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের পরিচালকের অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। তিনি এই ভয়াবহ মাতৃমৃত্যু হারের একটা বিহিত করতে চাইলেন। তো কোন কিছুর সমাধান বের করতে চাইলে আগে তো সমস্যার কারণ টা বুঝতে হবে, তখনকার ডাক্তারদের অনেক ধারণা-ই ছিল এই রোগের কারণের ব্যাপারে। সবচাইতে হাস্যকর ব্যাখ্যা ছিল যে পুরুষ ডাক্তারদের উপস্থিতি-ই আসলে মা’দের মধ্যে খুব লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায় আর অতিরিক্ত লজ্জায় তাদের প্যাথলজিকাল পরিবর্তন দেখা দেয়! আর সব কিছুর মধ্যেও এখানেও নারীদের দিকেই অভিযোগের তাক, সেই সাথে যোগ করুন সেই সময়ে সমাজে ডাক্তারদের অবস্থানের কথা। ডাক্তার’রা তখন ছিল একেবারে ঈশ্বরের সমতুল্য। কিন্তু ডাক্তারদের এই গাঁজাখুরি বক্তব্য ইগনাজের পছন্দ হলনা। সে আরও চিন্তিত হল যখন দেখল বাড়িতে কেউ বাচ্চার জন্ম দিলেও কারো মারা যাবার হার হাসপাতালের চেয়ে ৬০ গুণ কম!

ইগনাজ পুরো জিনিস নিয়েই একেবারে উঠে পড়ে লাগলেন। তিনি ভালো মত ডাটা সংগ্রহে নামলেন এবং শেষ মেষ এই ডাটা পেলেনঃ

ডাটা দেখে ইগনাজ নিজেই সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়লেন, তাহলে কি আসলেই পুরুষ ডাক্তারদের উপস্থিতি-ই এই রোগের কারণ! পুরোপুরি হজম করতে না পারলেও অন্য কোন ব্যাখ্যাও ছিলনা তাঁর কাছে তখন। এর মধ্যেই একটা ট্র্যাজেডি ঘটে গেল, তাঁর এক খুবই শ্রদ্ধেয় প্রফেসর হঠাৎ করেই এক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। সেই প্রফেসর এক ছাত্রকে নিয়ে ময়নাতদন্ত(autopsy) করছিলেন, হঠাৎ করেই ছাত্রের হাত থেকে ছুরি পিছলে গিয়ে প্রফেসরের হাত কেটে যায় এবং মারা যাবার আগে তিনি যেরকম দুর্দশা ভোগ করেছিলেন, ইগনাজ লক্ষ্য করলেন তা অনেকটাই শত শত মা’দের মৃত্যুর সাথে মিলে যায়। সেই প্রফেসরের ভাসক্যুলার সিস্টেমে কাডাভেরাস পার্টিকলস(Cadaverous Particles-এগুলা কি জিনিস আমি নিজেও জানিনা :P) এর উপস্থিতির কারণেই তিনি মারা গিয়েছিলেন বলে সবাই মনে করেন। ইগনাজ চিন্তা করলেন, একই কারণে কি তবে এই মা’রাও মারা যাচ্ছে?

যে কোন মেডিক্যাল স্কুলেই প্র্যাক্টিকালি শেখার একটা বড় উপায় হচ্ছে অটপসি। ইগনাজ লক্ষ্য করলেন, অনেক ডাক্তারই সরাসরি অটপসি টেবিল থেকে কোন মতে হাত ধুয়েই ম্যাটার্নিটি ওয়ার্ডে চলে আসছেন, অনেক সময় হাত হয়ত একেবারেই না ধুয়েই চলে আসছেন। তখনও কিন্তু জার্ম থিওরি(germ theory) আসেনাই, এই ঘটনারও এক-দুই দশক পরে মানুষ জার্ম থিওরি’র কথা জানতে পারে। তখন পর্যন্ত মানুষ রোগ-বিরোগের কারণ হিসেবে খারাপ আবহাওয়া বা অ্যানিমেল স্পিরিট এই সব গালগল্প-ই সব রোগের কারণ হিসেবে চালিয়ে দিতো।

ইগনাজ এই ঘটনা বুঝার পর-ই আসল জিনিস ধরতে পারলেন কেন ডাক্তার ওয়ার্ড আর ধাত্রীদের ওয়ার্ডে মৃত্যুহারে এত গরমিল! ডাক্তার’রা একজন মা’কে যতক্ষণ তাঁর ইউটেরাসে গুঁতাগুঁতি করা হতো, পিউপেরাল ফিভারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও তত বেড়ে যেত

, কারণ তখনও হয়ত অটপসি’র রোগ জীবাণু ডাক্তারের হাতে লেগে আছে । ইগনাজ সব ডাক্তারকে একেবারে ক্লোরিনের সাহায্যে জীবাণুমুক্ত পানিতে হাত ধোবার পরামর্শ দিলেন এবং বছর খানেকের মধ্যেই মাতৃমৃত্যু হার ১%-এ নেমে আসে।

কত শত মা আর শিশুর জীবন যে ইগনাজ সেমেলউইজের কারণে বেঁচে গেছে বুঝতেই পারছেন! নিশ্চয়ই তিনি একেবারে রাতারাতি হিরো হয়ে গিয়েছিলেন, তাই না? জি না, যা হয়েছিল তা ঠিক উল্টো। তাঁর নিজের হাসপাতাল তাঁর উপদেশ ঠিক ঠাক মেনে নিলেও অন্যান্য হাসপাতাল একেবারেই তাঁর কথাকে ভিত্তিহীন বলে উরিয়ে দিলো। তাদের কথা হচ্ছে, শুধু হাত ধুলেই এত বড় সমস্যার সমাধান হবে, হাহাহা, পাগলে কি না কয়! তাঁর উপর হচ্ছে এত মৃত্যুর জন্য আসলে ডাক্তাররাই দায়ী, এইটাও তারা কোনভাবেই হজম করতে পারলো না।

ইগনাজ’কে নিয়ে অন্যদের এই হাসাহাসিতে সে দিন দিন হতাশ হয়ে পড়লো, এক পর্যায়ে তাঁর হতাশা পাগলামিতে পরিণত হল। তাঁর পাগলামির কারণে তাঁর কথার গুরুত্ব আর মান-সম্মানও সব ধুলোয় মিশে যায়।  মাত্র ৪৭ বছর বয়সেই মারা যান ইগনাজ সেমেলউইজ।

সমসাময়িক ডাক্তার’রা নিশ্চয়ই ইগনাজের নির্দেশনা মেনে চলেন, তাই না? সম্প্রতি বেশ কয়েকটা গবেষণায় দেখা গেছে, ডাক্তার’রা অর্ধেকেরও কম সময় ঠিক ঠাক হাত ধোন। ১৯৯৯ সালে ‘The Institute of Medicine’-এর ‘To Err Is Human’-রিপোর্টে বলা হয় প্রতি বছর ৪৪,০০০ থেকে ৯৮,০০০ অ্যামেরিকান ডাক্তার বা হাসপাতালের ভুলের কারণে মারা যায়। অনেক হাসপাতালই এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিজেরাও কিছু ব্যবস্থা নেন। ডাক্তাররাও কিছু যুক্তি দেখান, তাদের কথা, প্রতিটি রোগী দেখার পর যদি হাত ধোয়া লাগে, তাহলে রোগী দেখার অর্ধেক সময় ধরেই তাই করতে হবে। আর সব হাসপাতালে আসলে হয়ত হাত ধোয়ার জন্য সুবিধাজনক বন্দোবস্তও থাকেনা। অস্ট্রেলিয়া’র আরেক গবেষণায় ডাক্তারদের নিজেদেরই হিসাব রাখতে বলা হয়েছিল তারা কত ভাগ সময়ে রোগী দেখার পর হাত পরিস্কার করেন। কিছুদিন পর দেখা যায়, ডাক্তার’রা নিজেরাই বলছে তারা ৭৩% সময়ে হাত ঠিক ঠাক ধুয়েছিলেন, তাদের অজান্তেই এই ডাক্তারদের নার্স’দেরও হিসাব রাখতে বলা হয়েছিল, নার্সদের হিসাব বলছে কিন্তু মাত্র ৯%!!

লস অ্যাঞ্জেলস-এর এক বিখ্যাত হাসপাতালে ডাক্তারদের একবার লাঞ্চের সময়ে ‘হ্যান্ড প্রিন্ট’ নেয়া হয়, অধিকাংশ ফলাফলেই দেখা যায় পুরো হাত জুড়ে  এতটাই ভয়াবহ  ব্যাকটেরিয়া কলোনি দেখা যায় যে হাসপাতাল কতৃপক্ষ কিছু একটা করা উচিত বলে মনে করে। হাসপাতালের প্রতিটা কম্পিউটারে স্ক্রিন সেভার হিসেবে এই হ্যান্ড প্রিন্ট দেয়া হয়, এর ফলাফলও হাতেনাতে পাওয়া যায়। কিছুদিন পরে দেখা যায়, হাত ধোবার হার এক লাফে শত ভাগের কাছাকাছি চলে গেছে। এক পর্যায়ে এই গল্প এতটাই জনপ্রিয় হল যে অন্যান্য হাসপাতাল গুলোও এই থিওরি কপি করা শুরু করলো।

আমাদের দেশে জানিনা আসলে অবস্থা এর চেয়ে ভালো নাকি খারাপ! আমাদের ডাক্তার’রাই ভালো বলতে পারবেন। এরপর থেকে ডাক্তারের কাছে গেলে ভাবতেছি রোগী দেখার পর হাত ধোয়ার পরামর্শ দিবো। এতে অবশ্য হিতে বিপরীত হতে পারে, রোগী হয়ে ডাক্তারকে পরামর্শ দিলে সেইটা ডাক্তারের জন্য হজম করা একটু কষ্টকর হতেই পারে।

 

  ৪

দুটো গবেষণার কথাই পড়েছি ‘সুপার ফ্রিকোনমিক্স‘ বইতে।  ‘ফ্রিকোনমিক্স’ বইয়ের পরে ২০০৯ সালে বের হয়েছে এইটা। ‘ফ্রিকোনমিক্স’ বইটাই বেশি জনপ্রিয়, ঐ বই পড়েও একটা ব্লগ লিখেছিলাম। যাই হোক, বুঝতেই পারছেন এইটা মোটেই বইটার রিভিউ না। আমি শুধুই দুইটা ভিন্ন ভিন্ন গবেষণার কথা বলেছি মাত্র, সেগুলো দিয়ে কোন সিদ্ধান্ত টানতে চাইনি, কারণ টানতে গেলে কয়েক পর্ব লাগত এই ব্লগ শেষ করতে, তাই বরং আপনারা বই-টাই পড়ুন।  এরকম অসংখ্য চিন্তাদায়ক গবেষণা নিয়ে বইটি অনেক পরিচিত/অপিরিচিত প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছে, সমাজে প্রস্টিটিউশন, সন্ত্রাস নিয়ে বেশ ভালো  আলোচনা করা আছে বই-তে  ।  বেশ বিতর্কিত হয়েছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে তাদের বক্তব্যের কারণে। আমি অবশ্য এই অংশটা পুরোপুরি হয়ত বুঝতে পারিনি, যেটুকু বুঝছি তাতে আমি বিতর্কের কারণ খুব একটা বুঝলাম না, আমার কাছে তাদের কথা বেশ যৌক্তিকই মনে হলো। মুক্তমনায় বই-টা পড়ে কেউ এই বিতর্ক নিয়ে নিজের মত দিলে খুশি হতাম।