বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করেন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী পাহাড়ি চাঙমা বা চাকমা । তাদের রয়েছে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য, রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি; সমৃদ্ধশালী উপকথা, লোকগীতি, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন ও সাহিত্য। বহু বছর ধরে এই ভাষায় লেখা হচ্ছে অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ; রাঙামাটির জুম অ্যাস্থেটিক কাউন্সিল (জাক) কয়েক বছর আগে চাকমা ভাষায় মঞ্চ নাটক করে দেখিয়ে দিয়েছে, এই ভাষাতে ভালোমানের নাটক সৃষ্টি করাও সম্ভব।

চাকমাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা। চর্চার অভাবে চাকমা লেখ্য ভাষাটি হারিয়ে যেতে বসেছিলো। তবে এখন আবার ধীরে ধীরে বাড়ছে ভাষাটির লিখিত ব্যবহার। উদ্যোগের অভাবে এতোদিন এই ভাষার ফন্টটি আন্তর্জাতিক বর্ণ সংকেতায়ন বা ইউনিকোডে রূপান্তরিত হয়নি; অথচ এখন ডিজিটাল মাধ্যমে কোনো ভাষাকে প্রকাশ করার প্রধান পদ্ধতিই হচ্ছে ইউনিকোড। কিন্তু এতো দিন চাকমা ভাষার লিপি ইউনিকোডে না থাকায় সীমাবদ্ধতার আবর্তে আটকা পড়ে ছিল এই ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও ভাববিনিময়। এ অবস্থায় শিক্ষিত চাকমারা এত দিন বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ফেসবুক বা ই-মেইলে বাংলা বা রোমান হরফে নিজ ভাষায় লেখালেখি করতেন।

নিজ মাতৃভাষায় লেখালেখির এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে দুবছর আগে যৌথভাবে প্রযুক্তিগত গবেষণা শুরু করেন জ্যোতি চাকমা এবং সুজ মরিজ চাকমা। রাঙামাটির তরুণ জ্যোতি চাকমা পেশায় কম্পিউটার প্রকৌশলী ও হিলবিডি ডটকম নামক ব্লগসাইটের নির্মাতা; তার বন্ধু সুজ মরিজ চাকমা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, তারও রয়েছে তথ্য-প্রযুক্তিগত জ্ঞান।

প্রথমে তারা দুজন ভাষা গবেষকদের সহায়তায় প্রাচীন চাকমা বর্ণলিপিটিকে সুসংহত করে এর নাম দেন ‘আলাম’ [চাকমাদের প্রাচীন বয়ন শিল্প কোমর তাঁতের নকশাশৈলীকে বলা হয় ‘আলাম’। জ্যোতি ও সুজ মরিজ সেখান থেকেই করেন ফন্টটির নামকরণ।] এই কাজে তাদের একবছর সময় লেগে যায়। পরের একবছর প্রচুর শ্রম দিয়ে তারা ফন্টটিকে ইউনিকোডে রূপান্তরের জন্য। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সম্প্রতি চাকমালিপি ইউনিকোডে রূপান্তরে সক্ষম হন তারা। জ্যোতি ও সুজ মরিজ যুগলবন্দী উদ্ভাবনের ফন্টটির নামকরণ করেছেন ‘রিবেং ইউনি’ [চাকমা ভাষায় ‘রিবেং’ কথাটির অর্থ গাছের মূল কাণ্ড; আর ইউনিকোডের সংক্ষিপ্ত রূপ ‘ইউনি’। সব মিলিয়ে সদ্য উদ্ভাবিত ফন্ট ‘রিবেং ইউনি’]।

এর সুবাদে উন্মোচন হতে যাচ্ছে চাকমা ভাষা চর্চা ও শিক্ষার অবারিত দুয়ার। খুব সহজেই আন্তর্জাল বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হবে এই ভাষা। ‘রিবেং ইউনি’ ব্যবহার করে অনলাইনে লেখালেখির পাশাপাশি সম্ভব হবে বিভিন্ন ওয়েব ও ব্লগসাইট, ই-বুক, অনলাইনপত্র ইত্যাদি নির্মাণ করা। বাংলা ভাষার পরই এ দেশের অন্য কোনো ভাষা এই প্রথম ইউনিকোডে রূপান্তর হলো।

বলা ভালো, আদিবাসী গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৭৫টি ভাষাগত সংখ্যালঘু আদিবাসী বসবাস করে। তাদের জনসংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। এর মধ্যে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর পরই চাকমারা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ও ১৩টি আদিবাসী পাহাড়ি মিলিয়ে প্রায় ১৬ লাখ লোকের বাস। এদের প্রায় অর্ধেকই পাহাড়ি। আবার তাদের মধ্যে চার লাখেরও বেশি চাকমা জনগোষ্ঠী। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, অরুণাচল, মিজোরামসহ অন্যান্য অঞ্চলে অল্প কিছু চাকমা বসবাস করে।

চলতি বছর জানুয়ারির তথ্যানুসারে, বিশ্বে ১০০টি লিপি ইউনিকোডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নানা ভাষার এক লাখ দশ হাজার ১৮১টি অক্ষর স্থান পেয়েছে ইউনিকোডে।

‘রিবেং ইউনি’ উদ্ভাবকদ্বয়, বন্ধুবরেষু জ্যোতি ও সুজ মরিজ এই লেখককে জানান, তাদের নির্মিত ইউনিডট হিলএডু ডটকম – ওয়েবসাইটটি থেকে বিনামূল্যে চাকমা ইউনিকোড ফন্ট ও কিবোর্ড লে-আউট সফটওয়্যার ডাউনলোড করা যাবে। সাইটটি থেকে একই সঙ্গে পাওয়া যাবে কম্পিউটারে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে সেটিংস এবং ফন্টটির নানা খুঁটিনাটি তথ্যও। সাইটটিতে ‘রিবেং ইউনি’ ফন্ট ব্যবহারের নির্দেশাবলিও দেওয়া আছে। প্রযুক্তিগত সহায়তা ও ফন্ট নিয়ে আলোচনার জন্য সাইটে যোগ করা হয়েছে একটি বিশেষ পাতা।

তারা জানান, ভবিষ্যতে তাদের পরিকল্পনায় রয়েছে রিবেং ইউনিকে পরিবর্তিত নতুন সংস্করণে নির্মাণ করা। ইন্টারনেটে রিবেং ইউনি ফন্টে লেখার টুলস্ সফটওয়্যার এবং মোবাইল ডিভাইস অ্যাপ্লিকেশনও নির্মাণ করতে চান তারা। এরই মধ্যে তারা চাকমা ভাষায় ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। তবে এসব কাজে প্রচুর অর্থ সহায়তা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের অপর দুই আদিবাসীর ভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা ও সাঁওতালী উইকিতে যুক্ত হওয়ার কাজ এখন দ্রুত এগিয়ে চলছে।

মার্কিন প্রবাসী বিশিষ্ট কম্পিউটার বিজ্ঞানী, মুক্ত জ্ঞানের বিদ্যালয় শিক্ষক ডটকম – এর নির্মাতা, সহব্লগার রাগিব হাসান ‘রিবেং ইউনি’র সাফল্যকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, চাকমা ভাষা ইউনিকোডে রূপান্তর হওয়াটা দারুণ সুসংবাদ। চাকমা ভাষার ইউনিকোড এনকোডিং তৈরি হওয়ার মানে হলো এটি এখন আরো সহজে ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবহার করা যাবে, নানা সাইটে এই ভাষার ব্যবহার বাড়বে। …আমার জানা মতে, বাংলা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো লিপি ইউনিকোডে যোগ হয়নি। কিছু ভাষা, যেমন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা বাংলালিপিতে লেখা হয়।

বাংলা ইউকি‘র প্রধান উদ্যোক্তা রাগিব হাসান মনে করেন, পৃথিবীর নানা জায়গায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলো আজ বিপন্ন। ডিজিটাল তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারই এসব ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, সংশ্লিষ্ট ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশের কাজ ত্বরান্বিত করতে পারে। এ কারণে ‘রিবেং ইউনি’ উদ্ভাবনের পর চাকমা জনগোষ্ঠী নিজস্ব সংস্কৃতির গৌরব টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি আমরা এই ভাষাভাষীর কাছে চাকমা লিপিতেই নানা জ্ঞানবিজ্ঞান পৌঁছে দিতে পারি।

ইউনিকোডভিত্তিকি সাঁওতালি টাইপিং সফটওয়্যার ‘হড় কাথা’ সাঁওতালি উইকিপিডিয়ার প্রধান নির্মাতা, সহব্লগার সমর মাইকেল সরেন চাকমালিপি ইউনিকোডে যুক্ত হওয়ায় খুব খুশী। বন্ধুবরেষু সমর মনে করেন, এই নবতর প্রচেষ্টাটির মাধ্যমে আদিবাসীর ভাষা ও সংস্কৃতির গৌরব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। প্রতিষ্ঠা পাবে আদিবাসীদের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিটিও।

আমরাও চাই, চাকমা ভাষার মতো এদেশের পাহাড় ও সমতলের অপরাপর পশ্চাৎপদ, নির্যাতীত-নিপীড়িত আদিবাসীর ভাষা আন্তর্জালে জ্যোতি ছড়াক সারা বিশ্বে; অমর একুশের গৌরবের বাংলা ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষার শিক্ষাদীক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক আদিবাসী মানুষের।
________
সংযুক্ত: ‘রিবেং ইউনি’তে লেখা হবে চাকমা ভাষা, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৬ অক্টোবর ২০১২।

ছবি: চাকমাদের বিঝু উৎসবে নৃত্যরত শিশু, টিটু চাকমা এবং চাকমা বর্ণমালা, লেখক, উইকিপিডিয়া