দূর্গাপুজা সে অর্থে কোন কালেই আধ্যাত্মিক গুরু গম্ভীর ধর্মীয় উপাসনা ছিল না। বরাবরের জন্যে এ শারদ উৎসব।শারদিয়া, আমোদ, খানাপিনা। সপ্তদশ শতকে কৃষ্ণনগরে ভবানন্দের জমিদারিতে এর শুরু হলেও, অষ্টাদশ শতকেও বাঙালীর জীবনে দুর্গোৎসব বলে কিছু ছিল না। দূর্গাপুজোর জনপ্রিয়তার মূল কারন বৃটিশ এবং তার কলোনিয়াল ইতিহাস!

বর্তমানের দূর্গাপূজার জনপ্রিয়তার শুরু বাবু নবকৃষ্ণের পুজো (১৭৬৫) দিয়ে যা সেকালে পরিচিত ছিল কোম্পানীর পূজো বা আজ শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজো বলে টিকে আছে। পলাশীর যুদ্ধের পর, যারা ক্লাইভের সহযোগী ছিলেন, তাদের জন্যে ক্লাইভ পার্টি দিতে চাইলেন কোলকাতায়। এদিকে কোলকাতায় কোন বড় গীর্জা ছিল না সেকালে। নবকৃষ্ণ ক্লাইভের সেই সংকট জানতে পেরে, উনাকে জানালেন, দূর্গাপূজার মাধ্যমে ক্লাইভ একদিন না চারদিনের পার্টি দিতে পারবেন। ক্লাইভ, বললেন, বাবু আমরা খৃষ্ঠান-তোমাদের জাত যাইবে! বাবু নবকৃষ্ণ বলেছিলেন, টাকা দিয়ে বাঙালীকে ম্যানেজ করা এমন কি কঠিন ব্যাপার! বাঙালীর সব প্যানপ্যানানি ধাপানিসা টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা যায়। এ জাতি মেরুদন্ডহীন!

বাবু বা রাজা নবকৃষ্ণকে নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। পলাশীর যুদ্ধের প্রাক্কালে ইংরেজি জানা বাঙালী ছিল বিরল। বাবু নবকৃষ্ণ ছিলেন পেশায় মুন্সি এবং তজ্জন্যে আরবী,ফার্সী সংস্কৃত সহ অনেক ভাষা জানতেন। ফলে ইংরেজিটাও শিখে নিলেন দ্রুত। পলাশী চক্রান্তে মূলত ইনিই ক্লাইভের দোভাষী হিসাবে কাজ করেছিলেন। এই বাবুটি না থাকলে ক্লাইভ এত সহজ ভাবে এবং দ্রুত দেশীয় জমিদার ও রাজাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতেন না। বৃটিশ অকৃতজ্ঞ না। পলাশীর যুদ্ধের পর বৃটিশরা মুর্শিদাবাদের ৫০ কোটি টাকা লুন্ঠন করে। ভাগের বাটোয়ারা অনুযায়ী বাবু নবকৃষ্ণ পেলেন আট কোটি টাকা। ছিলেন মুন্সি। বৃটিশদের সহযোগিতা করার জন্যে হয়ে গেলেন রাজা। এবার রাজ্যপাট নেই, রাজ সেনা নেই-সেব বৃটিশদের হাতে। হাতে আছে শুধু টাকা। সুতরাং রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার দেখাবার জন্যে দরকার বিরাট বারোয়ারী পার্টি। দূর্গাপুজোর জনপ্রিয় হবার কারন সেটাই। এই পুজো চারদিন ব্যাপী হওয়াতে, ব্যাপক জাঁকজমক এবং পার্টি দেওয়ার সুযোগ থাকত।

সেই থেকে শুরু হল শোভাবাজারের পূজো যা কোলকাতায় তথা বঙ্গে সব থেকে বড় রকমের জাঁকজমকপূর্ন পূজো। এই পূজোতে হোস্ট ছিলেন স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ। রাজন্য বর্গের জন্যে সুরা বাইজি এবং বারবাণিতাদের অবাধ আয়োজন। সাথে সাহেবদের জন্যে গোমাংস সহযোগে ডিনার। মুসলিম বাবুর্চিরা রান্না করত। এবং এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা না- উনবিংশ শতকে বাবু নবকৃষ্ণের দেখা দেখি সব বাবুর পুজোতেই মদ্যপান, নারী এবং গোমাংস সহযোগে উদ্যোম পার্টি হত সাহেব সুবোদের নিয়ে। দুর্গাপুজোর জনপ্রিয়তার এটাই মূল কারন যে তা বৃটিশদের পিষ্ঠপোষকাতে তাদের উমেদার দের জন্যেই জনপ্রিয় হয়েছে। ১৮৪০ সাল পর্যন্ত এই ট্রাডিশন বজায় ছিল। অনেক সাহেব নিজেরাই পুজো দিতেন-পার্টি দিতেন। শেষে পুজোর সময় বারবানিতা এবং বাইজিদের নিয়ে এত টানাটানি এবং টানাটানি থেকে রেষারেশি,মারামারি হতে লাগল, কোম্পানী আইন করে, বৃটিশদের দূর্গাপুজো থেকে বিরত করে। সুতরাং এ পুজো না- এটিকে উৎসব, পার্টি বলাই ভাল। এতেব আমার মতে দূর্গাপুজো হচ্ছে বাঙালীর জন্যে পার্টি টাইম। খাসি, গোমাংস এবং পানীয় সহযোগে নৃত্য করুন! এই পূজোতে গোমাংস সহযোগে উদ্দাম পানীয় পার্টি না করা হলে, ইতিহাসের অবমাননা হবে!

এরপরেও ইতিহাস আছে। যে বাবু নবকৃষ্ণের দূর্গাপুজোতে গোমাংস, ম্লেচ্ছ, বারবানিতা, মদ্যপান সবই আদৃত ছিল, সেই দেব বংশের লোকেরাই ( রাধাকান্ত দেব) সতিদাহ প্রথা রোধের বিরুদ্ধে ছিল। ছিল বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহের বিপক্ষেই। এরাই ছিল সনাতন হিন্দু ধর্মের ধ্বজ্জাধারি। নবকৃষ্ণ দেব এবং তার শোভাবাজারের রাজপরিবারের মধ্যে বাঙালী চরিত্রের সব নিকৃষ্ট দিকের দিগদর্শন সম্ভব। সুতরাং দূর্গাপুজা হচ্ছে বাঙালীর কলোনিয়াল হ্যাংওভার। ক্লাইভ অনেক কিছুই বাঙ্গালীকে শিখিয়ে গেছেন-তার মধ্যে বৃহত্তম হচ্ছে দূর্গাপুজো সহযোগে পার্টি। আরেকবার বৃটিশদের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করছি। কারন আমার কাছেও দূর্গাপুজো মানে সপ্তাহভোর পার্টি করা সুযোগ!