.

ঘটনা-এক

বড় ভাইয়ের গায়ে হলুদের রাতে নিচের গ্যারেজে প্রচুর হট্টগোলের শব্দ শুনলাম। কি হয়েছে দেখার জন্য দ্রুত নিচে নেমে এলাম। নিচে গিয়ে দেখি, একদল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আমাদের গ্যারেজে এসে ভিড় করেছে। দারোয়ানকে জাপ্টে ধরে আছে। আমাদের দেখে দারোয়ানকে ছেড়ে দিয়ে বলল, নতুন বর-কনের কল্যাণ চাইলে ওদেরকে যেন টাকা দেয়া হয়।

ওদের অঙ্গভঙ্গি দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সাথে এক চাচা ছিলেন। উনি ম্যানেজ করলেন পরিস্থিতি। দু’হাজার টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলো ওরা।

ঘটনা-দুই

রাস্তার ধারে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষায় আছি। হঠাৎ পিছনে শোরগোল শুনে তাকালাম। একদল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ দোকান থেকে চাদা তুলছে। যেসব দোকানী চাঁদা দিতে চাচ্ছে না বা, খারাপ ব্যবহার করেছে, ওদের লিঙ্গে হাত দিয়ে বিরক্ত করছে।

তৃতীয় লিঙ্গ

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা আসলে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী। সেক্স ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে একটি শিশু লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়। আর এই ত্রুটির ফলাফল হলো তৃতীয় লিঙ্গ; না পুরুষ, না নারী। ছেলে শিশুর সেক্স ক্রোমোজোম X ও Y ক্রোমোজোম নিয়ে আর মেয়ে শিশুর সেক্স ক্রোমোজোম X ও X ক্রোমোজোম নিয়ে গঠিত হয়। একটি শিশুর সেক্স ক্রোমোজোম কি হবে, তা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। মাতৃগর্ভে ভ্রূণ নিষিক্তকরণ এবং বিভাজনের সময় জেনিটিকসের কারণে অথবা, সেক্স ক্রোমোজমের কার্য ত্রুটির কারণে কিছু অস্বাভাবিক সেক্স ক্রোমোজোমের সৃষ্টি হতে পারে; যেমন X-X-Y অথবা, X-Y-Y। আর প্রকৃতির এই খেয়ালী আচরণ হতে জন্ম হয় তৃতীয় লিঙ্গের শিশুর। এই শিশুরা পরিপূর্ণভাবে কোন নির্দিষ্ট যৌন আচরণের অংশ নয়। একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের লিঙ্গের পূর্ণাঙ্গতা ব্যাতীত নারী-পুরুষের সকল দৈহিক বৈশিষ্ট্য থাকে।

ইংরেজী এদেরকে Third Gender, Queer বা, Hermaphrodite বলা হয়, যার বাংলা অনুবাদ হিসেবে উভলিঙ্গ-হিজড়া-নপুংশক-বৃহন্নলা শব্দগুলো ব্যবহার করা যায়। তবে, হিজড়া শব্দটি আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত।

বাংলাদেশ ও তৃতীয় লিঙ্গ

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা বাংলাদেশের সবচেয়ে নিপীড়িত, অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্টী। আমাদের দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সামাজিক স্বীকৃতি নেই। শুধুমাত্র লৈঙ্গিক ব্যাতিক্রমের কারনে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ঘ) ধারায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে কিন্তু এর কোন প্রয়োগ নেই। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় তিন লক্ষ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আছেন।

আর্থিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত-নিগৃহীত এই প্রান্তিক জনগোষ্টী আলাদা সমাজ গঠন করে বসবাস করে। তাদের এই সমাজকে বলে হিজড়া পল্লী। প্রতিটি পল্লীর একজন করে প্রধান থাকে; এদেরকে গুরুমা বা, মাসী নামে ডাকা হয়। এই গুরুমা বা, মাসী পল্লীর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে।

কোথাও তৃতীয় লিঙ্গের শিশুর জন্ম হওয়ার খবর পেলে পল্লী হতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা এসে শিশুকে নিয়ে যায়। আবার অনেক সময় তৃতীয় লিঙ্গের শিশুর জন্মের পরে মা-বাবা এই শিশুদের এসব পল্লীতে দিয়ে যায়। এরকম অনেকেই আছেন, যারা পরিবারের সাথে ছিলেন, তবে, এক পর্যায়ে পরিবার-সমাজের নিগৃহ সইতে না পেরে নিজেরাই স্বেচ্ছায় পল্লীতে চলে যান।

পল্লীতে চলে নির্মম জীবনযাত্রা। পল্লীর আয়ের প্রধান উৎস দোকান, বিয়েবাড়ি, বাসাবাড়ি থেকে আদায় করা চাঁদা ও ভিক্ষা। এছাড়া, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অনেকেই বেঁচে থাকার তাগিদে পতিতাবৃত্তি করে। পল্লীতে বসবাসরত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা তাদের প্রতিদিনের আয় গুরুমা’র হাতে তুলে দেয়। গুরুমা তা থেকে পল্লীর ব্যয় নির্বাহ করে।

শুধু মাত্র লৈঙ্গিক পার্থক্যর কারণে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক অবস্থান সবদিক থেকেই নিগৃহীত হয় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা। অথচ লিঙ্গ কখনোই মানুষের মূল পরিচয় না। এটি আজ প্রমাণিত সত্য যে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা সুযোগ পেলে অন্যদের মত সমাজের সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।

তৃতীয় লিঙ্গ ইস্যুতে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের সকলেরই জানা ও বোঝা উচিৎ যে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা ভিন্ন কিছু নয়, লৈঙ্গিক পরিচয় সমাজ-রাষ্ট্রের বাস্তবতায় কোন ধর্তব্য বিষয় নয়। সবার খেয়াল রাখা উচিত যেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অন্যভাবে দেখা না হয়। তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতের সাথে মিশে যাবার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের এখনই তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা ও এর বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার বাস্তবায়নের সরকার-এনজিও-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-মিডিয়া-সমাজ সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা সমাজে সুস্থ সুন্দরভাবে জীবন যাপন করবে, রাষ্ট্র-সমাজ সবাই তাদের সরল দৃষ্টিতে দেখবে এই কামনা করি।

(পূর্বে একটি পত্রিকায় কলাম হিসেবে প্রকাশিত)