একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়
একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগরময়।
-দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
আড়াই হাজার বছর আগের ঘটনা।
বিজয় সিংহ নামের এক বাঙালি রাজকুমার অর্ণবপোতে চেপে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে দখল করে নিয়েছিলেন আজকের শ্রীলংকা। শুধু দখল করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। দ্বীপের নাম পালটে রেখেছিলেন সিংহল, নিজেদের বংশের নামে। এখান থেকেই সিংহলের ইতিহাস শুরু। সিংহলি জাতির সূত্রপাত।
বহু প্রাচীন কাহিনি বলেই ইতিহাসের সাথে অনেক গালগল্প জুড়ে গিয়েছে। কিন্তু বিজয়ের সিংহল বিজয় পুরোটা গালগল্প নয়। সত্যি ঘটনা। ইতিহাস। গালগল্পের আগাছাগুলোকে সরালেই ভিতরে অক্ষত রয়ে গেছে ইতিহাসের এক গৌরবময় ঘটনা। রয়েছে বাঙালির বুক ফুলিয়ে গর্ব করবার মত যথেষ্ট মালমশলা।
বিজয় সিংহের কাহিনি লিপিবদ্ধ রয়েছে শ্রীলংকার প্রাচীন সব পুস্তকে। দ্বীপবংশ, মহাবংশ, কুলবংশ, এগুলো হচ্ছে শ্রীলংকার প্রাচীন ইতিহাস। পালি ভাষায় লেখা এই সব পুস্তকে বিজয় সিংহের ঘটনা বেশ গুরুত্বের সাথে রয়েছে। কিন্তু আগেই বলেছি যে, এগুলোর সংগে অনেক কাল্পনিক গাথাও জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে কিছু উদ্ভট এবং অবাস্তব বিষয়ও। আমাদের এগুলো নিয়েই এগোতে হবে। কেননা অত প্রাচীন যুগের নিখুঁত ইতিহাস খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য কাজ।
দ্বীপবংশ অনুযায়ী বঙ্গের রাজার এক অপূর্ব সুন্দরী কন্যা ছিল। নাম সুসিমা। এই মেয়ের বেশ ভাল রকমের হরমোন দোষ ছিল। জোয়ান ছেলেপুলে দেখলেই ছোঁকছোঁক করতো ছেমড়ি। এ কারণে লাঞ্ছনা-গঞ্জনাও কম জোটে নি তার কপালে। এইসব লাঞ্ছনা-গঞ্জনার হাত থেকে বাঁচার জন্য একদিন গোপনে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যায় সে।
একদল বণিক বঙ্গ থেকে মগধের দিকে যাচ্ছিল। এদের সাথে সুসিমা যুক্ত হয়ে যায়। রাঢ়দেশে এসে বিপদে পড়ে তারা। এক সিংহ তাদেরকে তাড়া করে। বণিকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। অন্যেরা ভয় পেলেও আমাদের এই দুষ্টু রাজকন্যা কিন্তু মোটেও ভয় পায় না। বরং সিংহের অমিত তেজ দেখে কামকাতর হয়ে পড়ে সে। সিংহ মহারাজের সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, এই সিংহ বনের আসল সিংহ নয়। খুব সম্ভবত সিংহ উপাধির কোনো বর্বর দস্যু আক্রমণ করেছিল বণিকদের।
তো, এই সিংহ বাবাজীর ঔরসে সুসিমার দুটো সন্তান জন্মালো। একটা ছেলে। নাম সিংহবাহু। আর অন্যজন মেয়ে। নাম সিংহসিবলি। এরা দুজনেই পরম সুন্দর। সিংহ মহারাজের সাথে ষোল বছর কাটায় সুসিমা। তারপরেই তার অরুচি চলে আসে। এমনই অরুচি যে, সিংহকে কিছু না জানিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে পালিয়ে চলে আসে বাবার রাজ্য বঙ্গের কাছাকাছি। সিংহ মশায় প্রেমিকার এই হঠকারী আচরণে স্তম্ভিত এবং ক্ষুব্ধ। এত্তোবড় সাহস ! একদিন আদুরে বিড়ালের মত পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে। আর আজ না বলে পলাতক। সুসিমাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য বীর বিক্রমে পিছু নেয় সে। কিন্তু নিজের সন্তান সিংহবাহুই তার বীরত্ব ঘুচিয়ে দেয়। হত্যা করে সে তার নিজের পিতাকে।
এর মধ্যে সুসিমার বাবা বঙ্গেশ্বর মারা গিয়েছেন। সুসিমা বঙ্গেশ্বরের ভ্রাতুষ্পুত্রকে বিয়ে করেন। সিংহবাহু বঙ্গ ছেড়ে চলে আসেন রাঢ়ে। নিজের রাজ্য গড়ে তোলেন তিনি। এর রাজধানী হয় সিংহপুর নামে এক নগর। নিজের বোন সিংহসিবলিকে বিয়ে করে তাঁকে তাঁর রানি বানান। সিংহসিবলির গর্ভে বত্রিশটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেয় সিংহবাহু। বিজয় তাঁদের প্রথম সন্তান।
বিজয় সিংহ শৈশব থেকেই ছিলেন বখে যাওয়া রাজকুমার। সংযত জীবনযাপন তাঁর ধাতে সইতো না। রাঢ়ের যুবরাজ তিনি। রাজার অবর্তমানে রাজ্য শাসন তাঁর ঘাড়ে পড়বে। এগুলো জানার পরেও নিজেকে তৈরি করার কোনো চেষ্টা তাঁর মধ্যে ছিল না। দলবল নিয়ে সারাদিন চারিদিকে উপদ্রব আর উৎপাত করে বেড়ানোই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। তাঁর আর তাঁর দলবলের নাম শুনলেই মানুষ ভয়ে শিউরে উঠতো। প্রতিকারের আশায় প্রজারা মাঝে মাঝে রাজদরবারে অভিযোগ জানতো। কিন্তু সিংহবাহুরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখন সবকিছু। শুরুতে উপদেশ, পরে তিরষ্কার, তারও পরে তিনি উত্তরাধিকার হরণের ভয় দেখালেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আর নয়। একে রাজ্য থেকে তাড়ানো ছাড়া রাজ্যে শান্তি আসবে না।
দ্বীপবংশে লেখা আছে, এই বালককে (বিজয়কে) এ রাজ্য হইতে তাড়াইয়া দাও – ইহার সমস্ত দাস, দাসী, মজুর, সহচর ও তাহাদের স্ত্রীপুত্র কেহ যেন আর এ দেশে না থাকে। জাহাজে ভাসিতে ভাসিতে ইহারা যেখানে ইচ্ছা যাউক, আর যেন ইহারা স্বদেশে মুখ দেখাইতে বা বাস করিতে না আসে। মহাবংশ আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছে যে, বিজয় সিংহসহ তাঁর সব অনুচরদের অর্দ্ধ-মস্তক মুণ্ডন করে রাজা তাঁদের জাহাজে তুলে দিয়েছিলেন।
তাম্রলিপ্ত বন্দরে প্রস্তুত হলো তিনখানা বিশাল অর্ণবপোত। প্রথমটিতে উঠলেন বিজয় সিংহ ও তাঁর সাত শত অনুচর। দ্বিতীয়টিতে তাঁদের সাত শত সহধর্মিণীরা। আর তৃতীয়টাতে তাঁদের পুত্র-কন্যারা। আহারবিহার এবং বিলাসব্যসনের কোনো কমতি ছিল না জাহাজগুলোতে।
প্রত্যেকটা জাহাজের কাপ্তান ছিলেন নৌ-বিদ্যায় পারদর্শী। এরা বহুবার সমুদ্রযাত্রা করেছেন। বাঙালি তখন সমুদ্রযাত্রায় খুব পটু ছিল। জাহাজে করে এদিক সেদিক বাণিজ্যে যেত তারা।
অনুকূল হাওয়ায় নিশান উড়িয়ে নদীর মোহনা ছাড়িয়ে সীমাহীন সমুদ্রের নীল জলে অজানার উদ্দেশ্যে ছুটে চললো বিজয়ের অর্ণবপোত। দূর ভবিষ্যতে বাঙালির গর্বিত ইতিহাস হবার অপেক্ষায়। দূর থেকে দূরে সরে যেতে থাকলো বঙ্গ নামের এক দেশ পিছনে।
একদিন ঈশান কোণে এক টুকরা ক্ষুদ্র মেঘ দেখা দিল। দ্রুতগতিতে সেই ক্ষুদ্র মেঘ বড় থেকে আরো বড় হলো। সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেলো কালো মেঘে। দামামা বাজিয়ে এলো দারুণ ঝড়। নাবিকরা প্রাণপনে চেষ্টা করলো নিজ নিজ জাহাজ বাঁচানোর। কিন্তু ঝড়ের প্রচণ্ড তাণ্ডবে কে যে কোথায় হারিয়ে গেলো, কেউ জানলো না।
ঝড়ের দাপটে শিশুদের জাহাজ ভাসতে ভাসতে গিয়ে নোঙ্গর ফেললো নাগদ্বীপে। মহিলাদের বহন করা জাহাজ গিয়ে ভিড়লো মহেন্দ্রদ্বীপ বা মহিলাদ্বীপে। আর বিজয়ের জাহাজ পথ হারিয়ে পৌঁছে গেলো সুপুরা বন্দরে। এখানকার অধিবাসীরা বিজয়কে যথেষ্ট ভদ্রতা ও সৌজন্য দেখিয়েছিল। কিন্তু বিজয়তো সেই আগের বিজয়ই রয়েছেন। তিনি এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা নারীদের উপর নানান ধরণের অত্যাচার শুরু করেন। তাঁদের এই সমস্ত হঠকারী আচরণে অতিষ্ট হয়ে সেখানকার সব লোক একত্র হয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই দূরাত্মা-দিগকে হত্যা করা হউক (দ্বীপবংশ)। অন্যদিকে মহাবংশের ভাষ্য অনুযায়ী, বিজয়ের নিজ সহচরেরা অবাধ্য হইয়া নানারূপ অত্যাচার করাতে বিজয় সেই স্থান ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
আবারও শুরু হয় বিজয়ের নীল জলের অজানা যাত্রা। চারিদিকে শুধু জল আর জল। স্থলের কোনো সন্ধান নেই। সঞ্চিত খাবার কমে আসছে। কমে আসছে জমানো পানি। এইভাবে আর কয়েকদিন চললে সব শেষ হয়ে যাবে। এমন সময়ে দিগন্তের ওপারে ভেসে উঠে গাছের সারি। তাম্রপর্ণী দ্বীপ, আজকের শ্রীলংকা।
তাম্রপর্ণীতে সেই সময় রাজত্ব করতেন যক্ষরাজ মহাকালসেনা। তিনি বাঙালিদের এই অনাকঙ্ক্ষিত আগমণকে ভালো চোখে দেখেন নাই। কিন্তু যক্ষকন্যা কুবেণী বিজয়ের প্রতি অনুরক্ত হয়ে যায়। তাঁর কাছে থেকে ভিতরের তথ্য পেয়ে যক্ষরাজের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে যক্ষরাজ পরাস্ত হন। বিজয়ের নেতৃত্বে লংকায় দখল করে নেয় একদল বাঙালি। তাঁর বংশের নামানুসারে এর নাম রাখলেন সিংহল। তাম্বপালিতে স্থাপিত হলো রাজধানী।
তবে, কুবেণীর জীবনটা খুব একটা সুখের যায় নি। রাজ্য জয়ের আগে প্রেম প্রেম খেলা খেললেই, রাজ্য জয়ের পরে বিজয়ের সেই ভালবাসা উবে যায়। তিনি পরিত্যাগ করেন কুবেণীকে।
মান্নার উপসাগরের এপারে দক্ষিণ ভারতে তখন পাণ্ড্যরা রাজত্ব করতেন। তাঁদের রাজধানী ছিল মাদুরা। রাজা মলয়ধ্বজের কোনো ছেলে ছিল না। একটাই মেয়ে। নাম তাতাতকৈ। সেই পাণ্ড্যরাজ্যের ভবিষ্যত উত্তরাধিকার। এই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য মূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে দূত পাঠায় বিজয়। পাণ্ড্যরাজ সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। রাজকুমারী তাতাতকৈ এর সাথে বিয়ে হয়ে যায় বিজয় সিংহের।
বিজয় সিংহ আটত্রিশ বছর রাজত্বের পরে মারা যান। এ সময় সারা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। বিজয়ের অমাত্য তিসানউ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ দমন করে বিজয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র পাণ্ডুবাসুদেব। এই রাজবংশ পরবর্তীতে ছয়শ বছএ এক নাগাড়ে লংকা শাসন করে।
উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্যের একটা বই আছে। নাম বঙ্গের বীর-সন্তান। এই বইটা ১৯৪৩ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ম্যাট্রিকুলাশন পরীক্ষার দ্রুত-পঠন পাঠ্য বই হিসাবে অনুমোদিত ছিল। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য বিজয়ের চরিত্রের স্খলিত বিষয়গুলোকে অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে বিজয়ের বিরুদ্ধে প্রজাপুঞ্জের প্রতি অত্যাচারের যে অভিযোগ উঠেছিল তা মিথ্যা। মূলত বিমাতারা ষড়যন্ত্রেই এই অভিযোগনামা নেমে এসেছিল তাঁর ঘাড়ে। বিজয়ের বন্ধুদের মুখ দিয়ে উপেন্দ্রনাথ এই কথাগুলো বলিয়েছেন, “ বিজয়, আমরা মহারাজের এই অন্যায় আদেশ মানিব না। যে রাজা স্ত্রীর স্বার্থমূলক পরামর্শে নিরপরাধ পুত্রের মস্তকে মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা চাপাইয়া দিয়া তাহাকে দেশ হইতে নির্ব্বাসিত করিতে পারেন, তাঁহার রাজত্বে বাস করা আমরা পাপ মনে করি। আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া এই অত্যাচারী রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া তোমাকে সিংহাসনে বসাইব।“ কিন্তু বিজয় এই প্রস্তাবে সম্মত হন নি। বরং পিতৃ আদেশ মেনে নিয়ে নির্বাসন দণ্ডকে গ্রহণ করেছেন। যে প্রজাদের জন্য প্রজাপীড়ণের অভিযোগ এসেছে, সেই প্রজারা বরং তাঁর প্রতি অনুরক্ত ছিল। তারাই উদ্যোগ নিয়ে সমুদ্রগামী রণতরী সংগ্রহ করে দেয় বিজয়কে।
বিজইয় সিংহের লঙ্কা দখলের দুর্দান্ত এক বর্ণনা দিয়েছেন। এই বর্ণনা চলচ্চিত্রকেও হার মানাবে। যেভাবে ফুলিয়ে ফাপিয়ে তিনি সবকিছু বলেছেন, সেরকম করে আদৌ পুরো বিষয়টা ঘটেছিল কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আমার। কারণ তিনি বিজয়ের জয়ের পিছনে অলৌকিক শক্তির অবদান খুঁজে পেয়েছেন এবং বিজয়কে দৈববলে বলীয়ান বলে বর্ণনা করেছেন।। আমি তাঁর বইতে লেখা বিজয় সিংহ এবং যক্ষরাজের লড়াইয়ের বর্ণনা তুলে ধরছি।
লঙ্কা জয়ের জন্য বিজয়ের বীর হৃদয় নাচিয়া উঠিল। বিজয় বলিলেন, “বন্ধুগণ, আমরা এই রাজ্য জয় করিয়া এখানেই বসবাস করিব। তোমরা প্রস্তুত হও। আমি রাজাকে যুদ্ধে আহ্বান করিলাম।”
সাতশত বঙ্গবীরের শিরায় শিরায় উষ্ণ্রক্তস্রোত ছুটিল; বাণপূর্ণ তূণে পৃষ্ঠদেশ শোভিত হইল; কটিতে অসি ঝনঝন করিয়া উঠিল; সমুন্নত বর্ষা হস্তে তাহারা তীরে এবং জাহাজের উপর সারি বাঁধিয়া দাঁড়াইল।
লঙ্কারাজের বিশ্বাস ছিল – এ যক্ষের দেশ লঙ্কা কেহ অধিকার করিতে পারিবে না। তিনি সাতশত বাঙালির এই স্পর্দ্ধায় উপহাসের হাসি হাসিয়া, তাহাদের শিক্ষা দিবার নিমিত্ত এক বিরাট সেনাদল পাঠাইলেন। বৃহৎ বৃহৎ শেতকায় হস্তী ও উচ্চ, তেজস্বী অশ্বসমূহে লঙ্কার তীরভূমি পরিপূর্ণ হইল।
লঙ্কার উপকূলে সেদিন নিরাশ্রয়, বিদেশি, সাতশত বাঙালী মত্ত হস্তীর বিক্রমে যুদ্ধ করিতে লাগিল। বিজয় সিংহ কালন্তক যমের মত লঙ্কা-সৈন্য ধ্বংস করিতে লাগিলেন? নিক্ষিপ্ত তীরের শনশন শব্দ, হস্তীর বৃংহিত, অশ্বের হ্রেষা, সৈন্যের চীৎকার — এই সমস্ত মিলিয়া এক মহাপ্রলয়ের শব্দে আকাশ পরিপূর্ণ হইল। লঙ্কারাজ, তাঁহার বহু সৈন্য নিহত হইতেছে শুনিয়া, স্বর্ণময় রাজছত্র মস্তকে দিয়া, শ্বেতহস্তিপৃষ্ঠে স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে আসিলেন।
লঙ্কার সেনাদল আবার নবতেজে যুদ্ধ করিতে লাগিল; কিন্তু বিজয় সিংহের অদ্ভুত সাহস ও অলৌকিক বীরত্বের কাছে তাহারা বেশীক্ষণ টিকিতে পারিল না। বিজয়ের নিক্ষিপ্ত এক বর্শার আঘাতে লঙ্কারাজ নিহত হইলেন। অবশিষ্ট সৈন্যগণ বিজয় সিংহকে দৈববলে বলীয়ান মরে করিয়া, আত্মসমর্পণ করিয়া তাঁহার আশ্রয় ভিক্ষা করিল। বিজয় সিংহ লঙ্কা অধিকার করিলেন। লঙ্কার রাজপ্রাসাদে, দুর্গভালে, বাংলার রাজপতাকা উড়িল।
তবে, বিজয় সিংহ ভাল মানুষ ছিল কী অত্যাচারী মানূষ ছিল তা এখন গৌণ বিষয়। মূখ্য হচ্ছে, আড়াই হাজার বছর আগে উত্তাল জলরাশি পাড়ি দিয়ে বিজয় সিংহের নেতৃত্বে একদল অদম্য সাহসী বাঙালি লংকা দখল করেছিল। নিজেদের নামে একটি রাষ্ট্রের, একটি জাতির আর একটি ভাষার জন্ম দিয়েছিল, যার অস্তিত্ব আজো বর্তমান।
বিজয় সিংহ এবং তাঁর পরবর্তী বংশধরদের কারণে সিংহলি ভাষার সাথে বাংলার অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়। সিংহলি ভাষাতাত্ত্বিক করুণাতিলকের মতে সিংহলি ভাষার উৎপত্তি হয়েছে পূর্ব ভারতে এবং এর অর্ধেকেরও বেশি শব্দের সাথে বাংলার সাদৃশ্য রয়েছে।
করুণাতিলকেই শুধু নন। আমাদের ডঃ মহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন যে, “আমি একটি প্রবন্ধে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে, সিংহলী ভাষার সঙ্গে অশোকের পূর্ব্বভারতের লিপি ব্যবহৃত ভাষার ঘনিষ্ঠতম সম্বন্ধ দৃষ্ট হয়। ঐ ভাষা নিশ্চয়ই রাঢ় দেশের প্রাচীন ভাষা হইতে উদ্ভূত হইয়াছে। মহাবংশের বর্ণনানুসারে বিজয়ের মাতৃভূমি মগধ ও বঙ্গের মধ্যবর্ত্তী কোন স্থানে অবস্থিত ছিল, সুতরাং ইহা জৈনপুস্তকে এবং রাজেন্দ্র চোলের তিরুমলয়ের শিলালিপিতে যে দেশকে “লাট” বলা হইয়া থাকে সেই দেশ, অর্থাৎ ‘রাঢ়’ ভিন্ন আর কিছু হইতেই পারে না।
দীনেশচন্দ্র সেন দুই ভাষার অসংখ্য শব্দের তালিকা করে এই মিলকে আরো ভালোভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ‘আমি সিংহলি জানি না’, এই কথাটা সিংহলিতে হচ্ছে মম সিংহলি দানে না। আমি জানি না, এটা হচ্ছে মম না দানিমি। ও দেখে হচ্ছে ওহু দাখি আর ওকে মার হচ্ছে ওহু মার। বুঝুন ঠেলা! দীনেশচন্দ্র সেনের মতে পূর্ববঙ্গের পল্লীর ভাষার সঙ্গেই সিংহলির বেশি মিল। এইবার আমাদের বুক ফুলে উঠা উচিত।
শুধু ভাষাতেই নয়, দীনেশচন্দ্রের মতে সিংহলিদের চেহারাও অবিকল বাঙালিদের মতই। তিনি বলেন, “বস্তুতঃ ধর্ম্মপাল, রেভারেণ্ড সিদ্ধার্থ, রেভারেণ্ড শীলানন্দ প্রভৃতি যতজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আমরা দেখিয়াছি, প্রত্যেকের চেহারা অবিকল বাঙ্গালীর মত। আমরা কয়েক স্থলে দেখিয়াছি, বাঙ্গালীরা কোন কোন সিংহলীর সহিত বাঙ্গালায় কথা কহিতে আরম্ভ করিয়া শেষে বিস্ময়ের সহিত আবিষ্কার করিয়াছেন যে, তাঁহারা ভিন্ন দেশবাসী – বাঙ্গালা বুঝেন না।“
রেভারেন্ড শীলানন্দ, যিনি ছিলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহলিজ ভাষার অধ্যাপক। তিনিও একই ধরণের মতামত দিয়েছেন। তাঁ ভাষ্য অনুযায়ী, “আমরা বহুদিন ধরেই এই ঐতিহ্য লালন করে আসছি যে, বঙ্গ থেকে বিজয় সিলোনে এসেছিলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এখানে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। এই ঐতিহ্য এসেছে বহু প্রাচীন কাল থেকে এবং প্রাচীন পূর্ব্বপুরুষদের মাধ্যমে আমরা তা জানতে পেরেছি। এই বিশ্বাস মহাবংশ, দ্বীপবংশ এবং অন্যান্য নথিপত্র দ্বারা নিশ্চিত হয়েছে এবং বাঙালি এবং সিলোনের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার অত্যাশ্চর্যজনক শারীরিক মিল থেকে সমর্থিত হয়েছে। সিংহলিজ রমণীরা হুবহু বাঙালি নারীদের মত করে শাড়ি পরে। গত বছর যখন কয়েকজন সিংহলি নারী কোলকাতায় বেড়াতে এসেছিলেন, প্রথমে আমি তাদের বাঙালি ভেবেছি। একইভাবে কোনো সিংহলি যদি বাঙালি অধ্যুষিত কোনো শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, বাঙালিরা ভুলক্রমে তাদের নিজেদের লোক বলেই ভেবে নেবে। আমি শুনেছি, বাঙালিরা বলে যে, সিংহলিরা বাংলা একেবারে বাঙালিদের মত করে বলে। যেখানে পার্শ্ববর্তী বিহার বা অন্য অঞ্চলের লোকেরা সারাজীবন বাংলায় থাকার পরেও নিখুঁত উচ্চারণে বাংলা বলতে পারে না। আঞ্চলিক একটা টান থেকেই যায়।“
সিংহলিরা যে বাঙালিদের খুড়তোতো ভাই, সে ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশই নেই।
বঙ্গের সিংহপুরুষ বিজয় সিংহকে স্যালুট।
পরিশিষ্টঃ
বিজয়ের এই শৌর্যবীর্যের কাহিনি আপ্লুত করেছিল বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়, সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্য্যের পরিচয়। দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানে লিখেছেন, একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় করিল লঙ্কা জয়, একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগরময়। শ্যামাচরণ শ্রীমানী মহাবংশ অবলম্বনে একটা কাব্যগাথা লিখে ফেলেছিলেন সিংহল বিজয় কাব্য নামে। সেখান থেকে কিছুটা অংশ পাঠকদের জন্য।
কহিলা সম্রাট – “শুনহে অমাত্য, কোন
মুখে আমি ক্ষমিব বিজয়ে! সভাস্থলে
আজি, সাক্ষাত সবার, করিলাম সত্য,
সমুচিত শাস্তি দান করিতে কুমারে-
না হ’তে প্রভাত নিশা, পামর অঙ্গজ
মম, রাজদ্রোহী সম, দল বাঁধি চাহে
সাধিতে জঘন্য কাজ, – কি শাস্তি তাহার
বিনা প্রাণদণ্ড? ত্রেতাযুগে, জান মন্ত্রী-
বর রাজা দশরথ, সর্ব্বগুণ-ধর
রাম কমললোচনে, পাঠাইলা বনে,
সত্য (ছার স্ত্রীরণজন) লাগি! দেখ তাঁর
আবাল বৃদ্ধা বনিতা ঘোষে যশঃ! বল
কেমনে, অবাধ্য লম্পট পাষণ্ডে, করি
পদাঘাত রাজধর্ম্মে, লঘু দণ্ড দিব
আমি? অপযশ রটিবে ভূবনে – ইহ
পরকাল মম ডুবিবে তখনি! সাধ্বী
কৌশল্যারে স্মরি, নিবাহ হৃদি আগুণ
মহিষি আমার। বধ দণ্ড ক্ষমিলাম
আজি, তোমার কারণে সবাকারঃ – যত
অনর্থের মূল নারী ভূমণ্ডলে! কিন্তু
মন্ত্রি, সুর্যাস্ত হইলে কল্য, নাহি যেন
রহে কেহ, এই নগরীতে, প্তনী-পুত্র-
সহ – অন্যথা মরণ; নির্ব্বাসন কর
সবে দ্বীপ দ্বীপান্তরে। আজি হতে মম
পবিত্র – কুল- কলঙ্কে করিনু বর্জন!
যাও মিত্র ত্বরা করি সেনাগণ সহ,
রক্ষহ ভার্গব- গৃহ; কর বন্দী সব
দুরাত্মারে। বর্জন করিনু পুত্রে শুন
দেবগণ – না হেরিব কভু সে পাপিষ্ঠে
আর! ধর্ম্মে চাহি ক্ষমহ প্রিয়ে আমায়।
দ্বিজেন্দ্রলালও বিজয় সিংহের কাহিনি নিয়ে এতই উচ্ছ্বসিত ছিলেন যে, শুধু গানেই নয় এর উল্লেখ নয়, একটি নাটকও লিখে ফেলেছিলেন তিনি। এর নামও ছিল সিংহল বিজয়। কিন্তু নাটকটি তিনি পুরোপুরি শেষ করে যেতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পরে নাটকটিকে কিছুটা ঘষামাজা করে তাঁর ছেলে দিলীপকুমার রায় প্রকাশ করেন।
একদিন বৈঠকখানায় বসে লোকজনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। হঠাৎ করেই বলে উঠলেন যে আমার মাথার মধ্যে কিছু লাইন ঘোরাফেরা করছে। শান্তি পাচ্ছি না। তোমরা একটু বস। আমি এগুলোকে মুক্তি দিয়ে আসি। তিনি ভিতরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন আধা ঘন্টা পরে। এর মধ্যে রচিত হয়ে গিয়েছে বাংলা ভাষার অমর এক গান। বঙ্গ আমার জননী আমার, ধাত্রী আমার আমার দেশ।
অসাধারণ সেই গানটি থেকেই আমার এই লেখার শিরোনাম নেওয়া হয়েছে। কৃতজ্ঞতা রইলো কীর্তিমান এই ঋজু মেরুদণ্ডের লোকটির কাছে।
httpv://www.youtube.com/watch?v=XvBUTwCH66c
সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
১। বঙ্গের বীর-সন্তানঃ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য
২। বৃহৎ বঙ্গঃ দীনেশচন্দ্র সেন
৩। গৌড় কাহিনীঃ শৈলেন্দ্র কুমার ঘোষ
৪। গৌড়ের ইতিহাসঃ রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তি
৫। সিংহল বিজয়ঃ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
৬। সিংহল বিজয় কাব্যঃ শ্যামাচরণ শ্রীমানী
৭। প্রাচীন বাংলার গৌরবঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
ফরিদদা আপনি না লিখলে হয়তো এইসব কাহিনী কোনোদিন জানাই হতোনা (Y) (Y)
@শাফায়েত,
এই সব কাহিনিতো আমাদের ইতিহাস বইতে নেই। আমাদের দেশের ইতিহাস বই লেখা হয়েছে দখলদা্রীদের দৃষ্টিকোণ থেকে। লজ্জার বিষয় হচ্ছে যে, দখলদারীরা এরকম করে নি। আমরাই করেছি। আমরা শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে নিজেদের দখলদারীদের অংশ বলে মনে করি। অথচ ঘটনা ছিল উলটো। এরা এসে নিষ্ঠুরভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের পরাজিত করেছে।
বখতিয়ার খিলজি বাংলা দখল করেছে না বলে, আমরা বলি বাংলা বিজয় করেছে। ভাবখানা যেন তার ঘোড়সওয়ার বাহিনীর সাথে তলোয়ার নিয়ে আমরাও ছিলাম এই দখলদারীতে। 🙁
খুব ভালো লাগলো। এরকম আরো লিখুন।
মিনমিন শব্দে , গুটিগুটি পায়ে একটা কথা মাথায় এলো , এই বিজয় সিংহের “বিজয় গাঁথা” টাই আবার নানান ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে “রামায়ন” হলো নাকি!
অবোধ এর অজ্ঞতা ক্ষমার্হ!
লেখাটার জন্যে অশেষ ধন্যবাদ , এমন লেখা আরো পড়তে চাই।
অসাধারন,একটানে পড়ে গেলাম,মাঝে মধ্যেই ছোটবেলায় পড়া রুপকথা গল্প পড়তে গিয়ে যেমন একটা চাপা উত্তেজনা হত তা হচ্ছিল।
২৫০০ বছর আগে বংগ, রাঢ় এলাকায় প্রচলিত ভাষা কেমন ছিলো এব্যাপারে কারো কাছে কি কোনো স্পেসিমেন আছে কি? যতদূর জানি বাংলা এবং এর পূর্বসূরী ভাষাগুলির লিখিত রেকর্ড খ্রী: ৫০০ এর আগে নেই।
@সফিক,
২৫০০ বছর আগে বলতে ধরে নেয়া যায় যে খ্রীঃপূঃ ষষ্ট শতক বোঝাচ্ছেন। এ সময় বঙ্গ সহ উত্তর ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে নানা ধরনের ‘প্রাকৃত’ ভাষার প্রচলন ছিল। এ সময়টায় ব্যাকরণবিদ ‘পানিনি’ সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরনগত নীতিমালা প্রনয়ন করেন। সংস্কৃত এবং প্রাকৃতের মধ্যকার সম্পর্ককে অনেকটা ধ্রুপদী লাতিন এবং ভালগার লাতিনের সম্পর্কের সাথে তুলনা করা যায়।
একটা বিষয়ে আমাদের অবশ্য সতর্ক থাকতে হবে। নৃতাত্বিক সম্পর্ক মানে সবসময় কিন্তু জৈব বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক নয়। দুজন মানুষ এক ভাষায় কথা বললেও জেনেটিক পর্যায়ে তারা এক নাও হতে পারেন। যেমন একজন লেবানিজ বংশদ্ভুত ব্রাজিলিয়ান এবং একজন জার্মান বংশদ্ভুত ব্রাজিলিয়ান পর্তুগীজ ভাষাকে মাতৃভাষা হিসিবে গ্রহন করলেও তারা কেউই পর্তুগীজ নয়। খাঁটি ইংরেজ নামের ১০ম প্রজন্মের একজন আর্মেনিয়ান বংশদ্ভুত লন্ডনবাসী শেতাঙ্গকে এখনও জেনেটিক পর্যায়ে নরডিক-স্যাক্সন বলা যাবে না। আমরা বর্তমানে যে বাঙালী জনপুঞ্জের সাথে পরিচিত , ২৫০০ বছর আগে তা অবশ্যই এক রকম ছিল না।
গল্পের মত করে যে ইতিহাস উপহার দিলেন, তা পড়ে যারপরনাই মজা পেলাম, ফরিদ ভাই। জানার কৌতূহল থেকে কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছি।
মগধের আজকের নাম কি?
এও সম্ভব? এরকম কি হরহামেশাই ঘটতো তখনকার সমাজে?
এমন কথা মাঝে মাঝেই শুনি। দু’একজন দিগ্বিজয়ী বাঙ্গালি নাবিকের নাম বলা যায়?
ছোট ছোট পুত্র-কন্যারা মাতা ছাড়া কিভাবে ছিল?
নাগা দীপ বা মহিলাদ্বীপ বা সুপুরা বন্দর কি আজো আছে?
টাইপো আছে মনে হয়।
বিজয় সিংহ যদি বদমায়েশির আশ্রয় নিয়ে রাজ্য দখল করে থাকে, তাহলে সে আমার শ্রদ্ধা পাবে না, এমনকি বাঙালি হলেও।
তাম্বপালিতে যে জাতি আগে থেকেই ছিল, তারা তাহলে আজকের শ্রীলংকার কোন জাতি? নাকি তারাও বিজয়ের সহযাত্রীদের সাথে মিলে-মিশে সিংহলি হয়ে গিয়েছিল?
পরিশেষে, লেখার জন্য (F) (F) (F)
জটিল কাহিনী দেখি। দেখি, বিজয় মিয়ার সাথে আমার কোন আত্মীয়তা বের করা যায় কিনা।
মাঝে মাঝেই ভাবতাম যে শ্রীলংকার লোকের সাথে আমাদের নামের কিছু মিল পাওয়া যায় কিন্ত দক্ষিন ভারতীয়দের সাথে মিলের নাম নিশানাও নেই, রহস্যটা কিছুটা পরিষ্কার হল।
মুশকিল হল যে আড়াই বছর আগে কি বাংগালী জাতিসত্ত্বা বলে কিছু ছিল? সেই আমলের নাম কি হুবহু বিজয় ছিল? নাকি কোন রকমের অপভ্রংশ হয়েছে? সে আমলের বংগরাষ্ট্রের সীমানা ঠিক কি ছিল?
সে আমলের এক এক জাহাজে ৭০০ করে লোক ওঠাটা মনে হয় চাপাবাজিরই অংশ, সে আমলের জাহাজের আকার অনেক ছোট ছোট হত। এত লোক এক জাহাজে মনে হয় কাহিনীর নাটকীয়তার প্রয়োযনে হয়েছে।
তাম্রলিপ্ত বন্দর ঠিক কোথায় ছিল? বরিশাল/খুলনার দিকে কি?
শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন; সুসিমার মত মহান রাজকন্যাদের কথা কেবল কেচ্ছা কাহিনীতেই পাওয়া যায়, আমার আশে পাশে কেন এদের দেখা পাওয়া যায় না?
@আদিল মাহমুদ,
চাপা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। ইতিহাস সংরক্ষণে আমরা সবসময়ই দুর্বল। আমি আপনি চাপাবাজি মনে করলেও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মত ইতিহাসের পণ্ডিত ব্যক্তি কিন্তু এরকম জাহাজ তখন বাংলায় ছিল বলেই বিশ্বাস করেন। তাঁর প্রাচীন বাংলার গৌরব বইতে একটা অধ্যায়ই আছে এ নিয়ে। অধ্যায়টার শিরোনাম হচ্ছে, “নৌকা ও জাহাজ”। সেখানে তিনি লিখেছেনঃ
বুদ্ধের সময়ে ভারতবর্ষের অন্যত্র এরকম অনেক বড় বড় নৌকা ছিল। বোম্বাইয়ের কাছে ভরুকচ্ছ বা ভরৌচ নামে একটা বড় বন্দর ছিল। সেখান থেকে বড় বড় জাহাজ ব্যবিলনে যেত। সুপারা থেকেও জাহাজ যেত।
ওই সময় তাম্রলিপ্তি বেশ বড় সড় বন্দরই ছিল। এখান থেকে বঙ্গ এবং মগধের জাহাজ ছাড়তো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আবারও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দ্বারস্থ হই। তিনি লিখেছেনঃ
পূর্ব মেদিনীপুরের তামলুককেই প্রাচীন বন্দরশহর তাম্রলিপ্তি বলে মনে করা হয়।
এই রকম প্রশ্নের মেশিনগান চালালেতো লেখালেখি বন্ধ করে দিতে হবে দেখছি। 🙁
পূর্ববাংলা, যেটা বঙ্গ নামে পরিচিত ছিল, এর সীমানা মোটামুটি সবসময়ই একই রকম ছিল। আমাদের বাংলাদেশ সেই অংশ ধরে নিতে পারেন। গৌড় এবং রাঢ় ( এ দুটো এখনকার পশ্চিম বঙ্গের অংশ) অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। যা কিছু ঝড়ঝাপটা, বৈদেশিক আক্রমণ, সবকিছু বুকে পেতে নিতে হয়েছে তাদের। (বড় বড় নদী থাকার ফলে বঙ্গ অংশটি বেঁচে গিয়েছে প্রায় সবসময়ই।) এই ঝড়-ঝাপটা এবং বহিরাগতদের আক্রমণের ফলে এখানে সীমানার পরিবর্তন ঘটেছে অহরহ। বিজয়ের সময়ে রাঢ় ছিল কলিঙ্গের অংশ (বর্তমানে যা উড়িষ্যা)। কিন্তু এর অধিবাসীরা ছিল নৃতাত্ত্বিকভাবে বঙ্গের। বঙ্গের অধিবাসীরা দীর্ঘকাল উড়িষ্যা শাসন করেছে।
বিজয়ের নাম সেই যুগে কেমনে উচ্চারণ করতো এটা জানতে হলে আপনাকে টাইম মেশিনে করে রাজকন্যা সুসিমার কাছে যাওয়া ছাড়াতো আর কোনো উপায় দেখছি না আমি। 🙂
@ফরিদ আহমেদ,
জাহাজ বিষয়ক তথ্য নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হবে তো। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কথা সঠিক হলে জাহাজের ইতিহাসে বেশ পরিবর্তন আসবে।
তাম্রলিপ্ত নিজেই ঘেটে কিছুটা মনোক্ষুন্ন হয়েছি, গেল এটা ভারতের ভাগে। তবে ব্যাটাদের ভাগে অনেক হুজ্জত গেছে জেনে দূঃখ কিছুটা কমল।
টাইম বা বোরাক মেশিনে করে রাজকন্যা সুসিমার কাছে যাবার প্রস্তাব নিঃসন্দেহে খুবই আকর্ষনীয়। আমাকে এই বিরল অফার দেবার জন্য ধন্যবাদ।
@আদিল মাহমুদ,
মুহাম্মদের মত একখান বোরাক জোগাড় করে নিন। আপনি নবী মানুষ সমস্যা হবার কথা না। তারপর তাঁর পিঠে চেপে অতীতে গিয়ে সুসিমার কাছ থেকে বিজয় সম্পর্কে একটু খোঁজ টোজ নিয়ে আসেন। কোন এক জ্ঞানী ব্যক্তি একবার বলেছিলেন যে, তরুণী কোনো মাতাকে আদর করার বদমায়েশি ইচ্ছা মনের মধ্যে সুপ্ত থাকলে, আগে তার বাচ্চাকে স্বর্গীয় আদর করো। 😛
@আদিল মাহমুদ,
শ্রীলংকানদের সাথে আপনার নামের মিল দেখলেন কিভাবে? আপনি হলেন আদিল মাহমুদ, পুরাই আরবী/ফারসী মাল:-) । আর তারা হলো সামারাবীরা(সমরের বীর), সামারাসেকেরা(সমরের শিখর), দেশানায়েকা(দেশের নায়ক), কুলাশেকেরা(কূলের শিখর), রানাতুঙ্গা(রণে তুঙ্গ বা তুখোর), জয়বর্ধনে(জয় বৃদ্ধিকারক?) আসলে নাম এবং ভাষাগত সাদৃশ্যের প্রধান কারন হলো বাংলা এবং সিংহলী দুটোই ইন্দো-ইরানিক তথা আর্য/সংস্কৃত ভাষার উত্তরসূরী। দক্ষিন ভারতীয়দের সাথে মিল না থাকার কারন হলো দক্ষিনীরা দ্রাবির ভাষার ধারক, সংস্কৃত নয়। তবে শ্রীলংকান তামিল(হিন্দু) হিসেবে মুরলীধরনের নামটা লক্ষনীয়- মুরলী অর্থ বাঁশী, তিনি বংশীধারী, অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ।
আড়াই হাজার বছর আগে বাংলায় সাধারনভাবে বাংলা ভাষার প্রচলন ছিল না, সমসাময়িক আর্য গ্রন্থগুলোতে বাংলা অঞ্চলের ভাষাকে অনার্য ভাষা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থ আর্যমঞ্জুরীকল্পেও গৌড়, পুন্ড্র, সমতট, হরিকেলের বাসিন্দারা অসুরভাষী, এমনটা বলা হয়েছে। তবে হয়তো আর্য সংশ্লেষের প্রকৃয়া চলছিল সে সময় থেকেই। বিজয় নামটি অনার্য নয় সংস্কৃতিজাত, সিংহবাহুও তাই। যদিও সে সময়ে প্রকৃত আর্য রক্তের ধারক কোন বংশের বাংলার রাজশক্তি অধিকারের সম্ভাবনা বেশ ক্ষীন। সে হিসেবে একটা সম্ভাবনা থেকেই যায় যে বিজয়ের নামটি হয়তো পরবর্তীতে আর্য ভাষীদের দ্বারা আরোপিত।
নৌকার আকৃতি নিয়ে আপনার সন্দেহ অমূলক। আরে ভাই এরও বহু আগে একজন মরুবাসী হয়েও নুহু যদি পৃথিবীর সকল প্রানী ধারনযোগ্য একটি নৌকা বানাতে পারেন, তাহলে পানির দেশের মানুষ হয়ে বিজয়ই বা মাত্র সাতশ মানুষ বহনযোগ্য একটা নৌকা বানাতে পারবেন না কেন?
@আদিল মাহমুদ,
খুবই গভীর একটা প্রশ্ন তুলেছেন ভাই।
বাহ, গর্বে বুক ফুলে ফেটে যাবার উপক্রম। :guli:
খুব তৃপ্তি নিয়ে পড়লাম। বাঙালী হয়ে আমাদের আশপাশের উজ্জ্বল সব ইতিহাস খুব একটা জানা হয়না। অথচ বলবার মত কত কি ই না আছে। সুন্দর করে লেখা আমাদের এলাকার ইতিহাসের সহজলভ্যতাও ব্যাপার বটে। চমৎকার লেখাটার জন্য ফরিদ আহমেদকে অনেক ধন্যবাদ।
আচ্ছা এবার একটা হাল্কা ব্যাপার, একটু কৌতূহল আরকি, দেখলামঃ
এত সব সুন্দরী আর সুন্দরের তেমন কোন প্রভাব ওই দেশে দেখলাম না তো? কি জানি; আমার চক্ষের ভুল হয়ত। কইন্ন্যাগণ বাদ দিলে দেখা যায় বত্রিশ পুত্র বিশেষ ভদ্ররনোক ছ্যালেন :))
@কাজী রহমান,
উনারা ভদ্দরনোক ছিলেন কিনা, তা জানতে মহিলা দ্বীপে তদন্তকারী পাঠানো হোক! 🙂
ফরিদ ভাই,
সত্যিই চমক লাগা কাহিনী! আমার মনে আছে, যখন নটরডেম কলেজে পড়ি, অধ্যাপক গরীব নেওয়াজ (স্মৃতি আমাকে বিভ্রান্ত না করলে) বাঙলা পড়াতে গিয়ে ক্লাশে মন্তব্য করেছিলেন,” কে বলেছে আমাদের বাঙালী জাতির, আমাদের ভাষার গৌড়ব করার কিছু নেই? পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসে, যে দু’চারটে ভাষায় মহাকাব্য রচিত হয়েছিলো, বাঙলা তার মধ্যে একটি! আমাদের মহাকবি আলাওলের আছে ‘পদ্মাবতি’! ‘রামায়ন’ এবং ‘মহাভারত’ আমাদের সম্পদ”। আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে আর গানটা শুনতে গিয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে আর তাঁর শাশ্বত বাণী কেন যেন অনুরণিত হচ্ছিল। বুকের ভেতরটায় ঢিপ ঢিপ করে হাতুড়ির আঘাত পড়ছিলো। চারদিক দেখে দমে যাওয়া মনটায় একটা নাড়া পরেছে! ধন্যবাদ আপনাকে, আমাদের এই গৌড়বগাঁথাটা জন্যে তুলে আনবার জন্যে।
@কেশব অধিকারী,
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ কেশবদা। (F)
ইচ্ছা আছে বাঙালির ভুলে যাওয়া অতীত বীরত্ব এবং গৌরবগাথার কিছু কিছু অংশ তুলে আনার। অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের দমে যাওয়া মনকেও যদি নাড়া দিতে পারি, ভাববো সার্থক।
ছোটবেলায় দেশটির ইংরেজী নাম দেখতাম সিলোন, বাংলা নাম সিংহল। তখন অবশ্য জানতাম না সিংহ থেকে সিংহল। রেডিও সিলোন থেকে জনপ্রিয় হিন্দী গান বাজানো হতো, টেলিভিশনের অস্তিত্বহীন সে যুগে সমগ্র উপমহাদেশে রেডিও সিলোনের একচ্ছত্র জনপ্রিয়তা ছিল, আমাদের দেশেও। এর “বিনাকা গীতমালা” এখনও অনেককে নষ্টালজিয়ায় ভোগায়। অবশ্য অনেকে ভুল করে রেডিও সিলোনকে রেডিও শিলং বলতো।
৭২ সাল থেকে সিলোন হয়ে গেল শ্রীলংকা, এই পশ্চাদাপসরন কি সঠিক হয়েছে? নামটা কি সিংহল হওয়াই যুক্তিসংগত ছিল না? যদিও প্রাচীন কালেই এ দ্বীপ দেশকে অন্য আরও কিছু নামের পাশাপাশি লংকা নামেও অভিহিত করা হয়েছে, কিন্তু লংকা নামের উৎস তো পৌরানিক গ্রন্থ “রামায়ন”, যে গ্রন্থে শ্রীলংকাবাসীদের জন্য গৌরবের কিছু নেই। এখন ইতিহাসবিদদের অনেকেই রাবণের রাজধানী হিসেবে লংকা দ্বীপকে মানতে রাজী নন, তাদের মতে এটা ছিল ভারতের মধ্য প্রদেশে। যাই হোক, সিংহ থেকে দেশের নাম সিংহল, ভাষার নাম সিংহলী। ভাষা হিসেবে সিংহলী গর্বের বিষয় হলেও এবং সে নাম অক্ষুন্ন থাকলেও দেশ হিসেবে সিংহল কেন সে গর্ব থেকে বঞ্চিত হলো?
সিংহ কতৃক রাজকন্যা সুসিমা অধিকৃত হওয়ায় এবং সেই সিংহের প্রতি সুসিমার অনুরাগ দেখে কেউ কেউ হয়তো লজ্জা বোধ করেছেন। আমাদের হুমায়ূন আহমেদও বিষয়টিতে খুব অপমানিত বোধ করেছেন, আমার কাছে এমন মনোভাব খুব হাস্যকর মনে হয়। যত যাই হোক, সেই সিংহ তো রীতিমত বঙ্গেশ্বর, ধরেই নেয়া যায় তিনি সিংহের তেজ ধারন করতেন বলে এমন উপাধি গ্রহন করেছিলেন, বিশেষতঃ সারা ভারতে যেখানে সিংহ উপাধিধারী বহু জাতি-গোত্র যুগে যুগে বিরাজ করেছে, এমনকি বাঙালিদের মধ্যেও সিংহ উপাধির প্রচলন রয়েছে।
লেখা ভাল লেগেছে। (Y)
@চলনামৃত,
ধন্যবাদ উৎসাহ যোগানোর জন্য। এই ধরণের লেখার পাঠক সংখ্যা মুক্তমনায় খুবই সীমিত। মাঝে মাঝে আমার পণ্ডশ্রমই মনে হয়। এত খেটে খুটে একটা লেখা তৈরি করে এত সীমিত পাঠকের জন্য পরিবেশন করে আদৌ কোনো লাভ আছে কিনা, সেটা নিয়ে সংশয়ে পড়ে যাই। এর মধ্য থেকেও আপনি যেভাবে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে আপনার জ্ঞানগর্ভ আলোচনার মাধ্যমে আমার এই লেখাকে সমৃদ্ধ করেছেন, তার কোনো তুলনা নেই। কৃতজ্ঞতা রইলো।
ভালো থাকবেন।
@ফরিদ আহমেদ, এই ধরনের লেখার পাঠক সংখ্যা মুক্তমনায় যদি খুবই সীমিত হয়, তাহলে বুঝতে হবে এ ধরনের লেখার পাঠক সংখ্যা সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যেই খুবই সীমিত। আমার কাছে সেটাই বাস্তবতা মনে হয়। পন্ডশ্রম মনে না করে ব্যাপরটা অন্য দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে পারেন। আপনি যখন এইসব বিষয় পাঠ করেন, তখন নিশ্চয়ই অতিশয় আনন্দের সাথে তা করেন। আমার ধারনা, তখন আপনার মনে এই বোধ কাজ করে যে এই সুন্দর বিষয়টি অন্য আরও অনেকের জানা প্রয়োজন, অন্য অনেকের সাথে আপনি সেই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। এখানে যতজন লিখে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, পড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশী সংখ্যক পাঠক, এবং আমি নিশ্চিত, তাদের প্রায় সবাই পড়তে গিয়ে আপনার মতই অপার আনন্দ লাভ করছে। আমি আমার বোধ থেকে কথাগুলো বললাম, ভুল মনে হলে ক্ষমা করবেন।
(Y)
সিংহলীরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বিজয় সিংহ কি বৌদ্ধ ছিলেন?
@মনজুর মুরশেদ, বিজয় সিংহকে নিয়ে বাঙালীদের ছাড়াও তামিল-সিংহলী অন্মোয একটা দ্বিপক্ষীয় রশি টানাটানি আছে। বৌদ্ধদের মধ্যে, বিশেষতঃ শ্রীলংকার বৌদ্ধদের মধ্যে এই ধারনা প্রচলিত আছে যে, গৌতম বুদ্ধ তাঁর মৃত্যুর সময়ে বলেছিলেন “বাংলার এক রাজপুত্র আজ সিমহলে পৌঁছেছে, তাঁর দ্বারাই সিমহলে আমার ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত হবে(The Bengalees: Glimpses of history and culture-Samaren Roy), শ্রীলংকার বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী সেটা ৫৪৩ খৃষ্টপূর্বাব্দ। সে হিসেবে বিজয়কে একজন বৌদ্ধই বলা যায়। অবশ্য আধুনিক অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন বুদ্ধের জীবনকাল ৫৬৩-৪৮৩ খৃঃপূর্বাব্দে বিস্তারিত। বাংলা যেহেতু মগধের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত, সুতরাং বুদ্ধ সম্ভবত স্বয়ং বাংলায় তাঁর ধর্ম প্রচার করেছেন, এবং বিজয় হয়ত তাঁর মিশন নিয়েই সিমহলে গিয়েছেন, যদিও মহাবংশে বর্নিত কাহিনী এ বিষয়ে ধাঁধার সৃষ্টি করে। অপরদিকে তামিলরা, বিশেষতঃ শ্রীলংকার তামিলরা বিজয় সিংহকে একজন তামিল রাজপুত্র বলে বিশ্বাস করেন। স্বভাবতঃই তামিল জাতীয়তাবাদীরা মহাবংশের ভাষ্যকে বৌদ্ধিক ইতিহাস বিকৃতি হিসেবে দেখেন, এরই ফলস্রুতিতে ১৯৩৯ সালে শ্রীলংকায় শুরু হয় তামিল-সিংহলী জাতিগত দাঙ্গা, পরকর্তীতে যার ভয়াবহ বিস্তার সকলেই দেখেছেন।
@চলনামৃত,
ধন্যবাদ। আপনার আর ফরিদ আহমেদ-র মন্তব্য থেকে শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের ধারনা পেলাম।
@মনজুর মুরশেদ,
না, বিজয় সিংহ বৌদ্ধ ছিলেন না।
গৌতম বুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ সালে জন্মেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। অন্যদিকে বিজয় সিংহের জন্ম বিষয়ে কোনো তথ্যই কারো জানা নেই। কিন্তু তিনি শ্রীলংকা জয় করেছিলেন ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বে। সেই সময় তাঁর বয়স যদি পচিশও হয়, তবে তিনি বুদ্ধের আগে এই ধরাধামে জন্মেছেন। শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষ তাঁর গৌড় কাহিনীতে উল্লেখ করেছেন যে, যেদিন বিজয়ের জাহাজ লংকা দ্বীপে নোঙর করে ঠিক সেদিনই দেড় হাজার মেইল উত্তরে আর্য্যাবর্তের কুশীনগরে ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্ব্বান ঘটে। এই তথ্য তিনি কোথায় পেয়েছেন, সেই বিষয়ের কোনো উল্লেখ কোথাও নেই। এর সাথে বিজয়ের লংকা দ্বীপে আগমণেরই বা কী সম্পর্ক বোঝা মুশকিল। কারণ, বিজয় কোনো ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে লংকায় যান নি। গিয়েছিলেন দুর্ঘটনাক্রমে, পথ হারিয়ে।
বিজয় সিংহ বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য শ্রীলংকা না গেলেও বা বুদ্ধর সাথে জীবনে পরিচয় না থাকলেও, তাঁকে ঠিকই জড়িয়ে ফেলা হয়েছে বুদ্ধের সাথে। মহাবংশে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
শ্রীলংকায় প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ ধর্মের আগমণ ঘটে বিজয়ের লঙ্কা বিজয়ের অনেক পরে। প্রায় তিনশত বছর পর। সম্রাট অশোক তাঁর ছেলে মহিন্দ্র এবং মেয়ে সঙ্ঘমিত্রাকে পাঠিয়েছিলেন শ্রীলংকায়। তখন সিংহলে রাজত্ব করছিলেন বিজয় সিংহের বংশধর দেবনামপিয়া তিসা। এখান থেকেই শ্রীলংকায় বৌদ্ধ ধর্মের সূত্রপাত ঘটে।
@ফরিদ আহমেদ,
ধন্যবাদ, বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলার জন্য।
পুরাতন কাহিনী পড়ে বেশ মজা পেলাম। ছোটবেলায় কোথায় যেন পড়েছিলাম ,হনুমান লংকা জয় করেছিল।
@আঃ হাকিম চাকলাদার,
শ্রীহনুমানও কি বাংগালী ছিলেন?
জম্পেশ লেখা মনে হচ্ছে, পরে পড়ছি।
@আদিল মাহমুদ,
বাঙালী ছিল বলে মনে হয় না তবে বাঙালীর কিছু প্রভাব ছিল তার মধ্যে।
@ভবঘুরে, দন্তযোগে হাসি, শ্রী হনুমান তো মোদের পরদাদা এ সহজ সত্য মুক্তমনার সকলেই জানেন ..
@ভবঘুরে, বঙ্গ থেকে সেকালে কেউ গেলেন বলেই বাঙালি! সিংহলের সঙ্গে পূর্বভারতের সংযোগ আছে এটা তাদের ভাষা সংস্কৃতি বলে। কিন্তু বীর বাঙালি আর কোনো দেশ জয় করলনা, করতে গেল শুধু শ্রীলঙ্কা–এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ওড়িয়ারাও কিন্তু অনেকে তাঁকে নিজেদের লোক বলে ভাবেন। আসলে মনে হয় এগুলো দ্রাবিড় সংযোগ। এই নৃতাত্বিক ব্যাপারটি আলোচনাতে না নিয়ে এলে কিছু বোঝা যাবে না। আর দ্রাবিড় দের প্রতিবেশী দেশগুলো জয় করবার আর শাসন করবার ইতিহাস কিন্তু বহু প্রাচীন।
@আঃ হাকিম চাকলাদার,
পড়ে মজা পেয়েছেন বলে ধন্যবাদ। হনুমানের লংকা জয়ের কথা শুনে আমিও মজা পেলাম। পশু-পাখিরাও খুব একটা পিছিয়ে নেই দেখছি। তারাও রাজ্য-টাজ্য জয় করে।
@ফরিদ আহমেদ,
হনুমানের লংকা জয়ের কাহিনী তো রামায়নের বর্ণিত লংকা থেকে সীতা উদ্ধারে হনুমানদের রামকে সহযোগিতার স্মরণ। এ থেকেই বলা হয় হনুমানের লংকা জয়।তাছাড়া রামায়নে সম্ভবত আছে যে হনুমানই প্রথম সাগর পাড়ি দেয় রামের পক্ষ থেকে।
আর এখনও কোন কঠিন কাজ সহজে হয়ে গেলে অনেকেই এ উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করে বলে যে, হেলায় লংকা করিল জয়।
যাহোক, পড়লেই বুঝা যায় এটা ফরিদ আহমেদীয় লেখা।শুরু করলে শেষ না করে পারি না। অনেকদিন পর মুক্ত-মনায় ঢুকেই ফরিদের লেখাটি পড়ে মহাখুশি হলাম।
মন্তব্যে ফরিদ আহমেদের ঘোষণাটিও আশাপ্রদ যে বীর বাঙালির আরও বীরত্ব গাঁথা পড়তে পারব। অপেক্ষায় রইলাম।
দারুন! দারুন!!
আরো লিখে যান।
অনেকদিন এধরণের লেখা পড়া হয় না।
থাম্বস আপ!
@সবুজ পাহাড়ের রাজা,
উৎসাহ দেবার জন্য ধন্যবাদ। ইচ্ছা আছে এরকম আরো কিছু লেখার। দেখা যাক। (F)