এই বাংলায় তাঁর উপস্থিতি ঘটেছিল কয়েকশ বছর আগে। চন্দ্রকান্তিময় সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। তবে তাঁর প্রীতিমনোহররূপের জন্য নয়, বরং নিজস্ব প্রতিভার জন্যই আজো প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। শশীকলাময় সৌন্দর্যের এই মানুষটি একজন কবি। নাম চন্দ্রাবতী। কবি চন্দ্রাবতী নামেই সুবিখ্যাত তিনি।

চন্দ্রাবতী মধ্য যুগের কবি। বাংলা সাহিত্যের আদি বা প্রথম মহিলা কবিও বলা যায় তাঁকে। তাঁর আগে একজন মাত্র মহিলা কবির কথা জানা যায়। তবে তিনি সত্যি সত্যি ছিলেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাঁর নাম রজকিনী রামমণি বা রামী। কবি চন্ডিদাসের নিষ্কামজ প্রেমের প্রেমিকা হিসাবে বিখ্যাত এই রামী ধোপানি। এই রজকবালা রামী  একজন কবি ছিলেন বলে কিছু আলামত পাওয়া যায়। তবে, এগুলো কোনোটা নিরংকুশ সন্দেহ দূর করে পারে না তাঁর কবি হিসাবে অস্তিত্ব সম্পর্কে। আর তাছাড়া বাংলা সাহিত্যে এতজন চণ্ডিদাস আছে যে, ঠিক কোন চণ্ডিদাসের সাথে তিনি সম্পর্কিত ছিলেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। সে কারণেই চন্দ্রাবতীকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবির স্বীকৃতি দিতে বহু লোকেই দ্বিধাহীন, সংকোচশীতলতাবিহীন । চন্দ্রাবতী শুধু প্রথম মহিলা কবিই নন, সৃষ্টির মান এবং পরিমাণের দিক দিয়ে মধ্য যুগের সেরা মহিলা কবিও তিনিই।

চন্দ্রাবতীর বাবাও ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি। পদ্মপুরাণ এবং মনসামঙ্গলের কবি তিনি, কবি দ্বিজবংশী বা বংশীবদন। তিনি ভাসান গানের দল নিয়ে গান গেয়ে বেড়াতেন। সুকুমার সেন তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যের কথায় লিখেছেন, “পূর্ববঙ্গে রচিত বিস্তর মনসামঙ্গল কাব্য পাওয়া গিয়াছে। সে সবগুলির মধ্যে বংশীবদনের কাব্যই শ্রেষ্ঠ। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হইয়াও বংশীবদন কোথাও অযথা পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করিতে চেষ্টা করেন নাই। অপরদিকে, ইহার কাব্য গ্রাম্যতা দোষ হইতে একেবারে মুক্ত।“

দ্বিজ বংশীদাস কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখা মনসামঙ্গল ১৫৭৫ সালের দিকে শেষ হয়। কথিত আছে যে, মনসামঙ্গল রচনায় বংশীবদন চন্দ্রাবতীর সাহায্য পেয়েছিলেন। মনসামঙ্গল রচনার সময়ে চন্দ্রাবতীর বয়স কমপক্ষে পচিশ ছিল। সেই হিসাবে তিনি ১৫৫০ সালের দিকে জন্মেছিলেন বলে অনুমান করা যায়।

কবি দ্বিজবংশীর একমাত্র আদরের কন্যা চন্দ্রাবতী। উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার কবিত্ব শক্তি লাভ করেছিলেন তিনি। চন্দ্রাবতী নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন তার রামায়ণ গাথায় এভাবেঃ

ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।

বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়।।

ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম, অঞ্জনা ঘরণী।

বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনি।।

ঘট বসাইয়া সদা পূজে মনসায়।

কোপ করি সেই হেতু লক্ষ্মী ছেড়ে যায়।।

দ্বিজবংশী পুত্র হৈল মনসার বরে।

ভাসান গাইয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে।।

ঘরে নাই ধান-চাল, চালে নাই ছানি।

আকর ভেদিয়া পড়ে উচ্ছিলার পানি।।

ভাসান গাইয়া পিতা বেড়ান নগরে।

চাল-কড়ি যাহা পান আনি দেন ঘরে।।

বাড়ীতে দরিদ্র জালা কষ্টের কাহিনী।

তাঁর ঘরে জন্ম নিলা  চন্দ্রা অভাগিনী।।

দূরিতে দারিদ্র্যদুঃখ দেবীর আদেশ।

ভাসান গাহিতে স্বপ্নে দিলা উপদেশ।।

সুলোচনা মাতা বন্দি দ্বিজবংশী পিতা।

যাঁর কাছে শুনিয়াছি পুরাণের কথা।।

কাব্যের কথা নয়। চন্দ্রাবতী আসলেই অভাগিনী। তাঁর জীবনে যে বেদনাবিধুরতা এসেছে, যে সকরুণতা এসেছে, তা খুব কম মানুষের জীবনেই এসে থাকে। অত্যন্ত করুণভাবে তরুণ বয়সেই সমাপ্তি ঘটেছে এই কবির জীবনের। নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ করুণ জীবনের কারণে পালা রচয়িতা থেকে নিজেই হয়ে উঠেছেন পালাগানের করুণরসে সিক্ত শোকাচ্ছাদিত নায়িকা।

১৯১৬ সালে ময়মনসিংহের কবি চন্দ্রকুমার দে প্রথম সেই এলাকার প্রচলিত পালাগান বা গাথাগুলি সংগ্রহ করেছিলেন। আচার্য্য দীনেশচন্দ্র সেনের উৎসাহে তা পরে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত গীতিকা মৈমনসিংহ-গীতিকা নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১৩ সালে ময়মনসিংহের সৌরভ পত্রিকায় চন্দ্রকুমার দে প্রাচীন কবি চন্দ্রাবতীর বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই প্রবন্ধ পড়েই দীনেশ্চন্দ্র সেন তাঁর খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেন। সৌরভের সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার ছিলেন দীনেশ্চন্দ্রের পুরোনো বন্ধু। তিনি দীনেশচন্দ্রকে জানান যে, “চন্দ্রকুমার একজন দরিদ্র যুবক, ভাল লেখাপড়া শিখিতে পারেন নাই, কিন্তু নিজের চেষ্টায় বাঙ্গালা লিখিতে শিখিয়াছেন।“ তিনি আরো জানান যে, “তাঁহার মস্তিষ্কবিকৃতি হইয়াছে এবং তিনি একেবারে কাজের বাহিরে গিয়াছেন।“

চন্দ্রকুমারের হদিশ না পেয়ে দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহের অনেক লোকের কাছে পল্লীগাথা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু কেউ-ই সেগুলোর কোনো সংবাদ দিতে পারে নাই। কেউ কেউ আবার ইংরেজি শিক্ষার দর্পে বলে উঠেছে যে, “ছোটলোকেরা, বিশেষতঃ মুসলমানেরা, ঐ সকল মাথামুণ্ডু গাহিয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙ্গলের উপর বাহুভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কি থাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজ তৎপ্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন? আপনি এই ছেঁড়া পুথি ঘাটা দিন কয়েকের জন্য ছাড়িয়া দিন।“

সৌভাগ্য যে দীনেশচন্দ্র সেন এই সব ইংরেজি শিক্ষিত দর্পকারীদের কথায় কান দিয়ে ছেঁড়া পুথি ঘাটাঘাটি বন্ধ করেন নি। আর সে কারণেই আমরা পেয়েছি মৈমনসিংহ গীতিকার মত অসাধারণ একটা সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী; কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বত উচ্ছ্বসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্ম-বিস্মৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয় নি।“

দুই বছর পরে কেদারনাথ মজুমদার চিঠি দিয়ে দীনেশচন্দ্র সেনকে জানালেন যে, চন্দ্রকুমার অনেকটা ভাল হয়েছেন এবং খুব শীঘ্রই কোলকাতা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন। তাঁর আরও চিকিৎসা দরকার।

বউয়ের দুই একখানি রূপার অলংকার ছিল। সেগুলো বিক্রি করে চন্দ্রকুমার পথের খরচ জোগাড় করলেন এবং ময়মনসিংহ থেকে কোলকাতায় এসে দীনেশচন্দ্রকে প্রণাম করে দাঁড়ালেন। রোগে-দুঃখে জীর্ণ, মুখ পাণ্ডুরবর্ণ, অর্দ্ধাশনে-অনশনে বিশীর্ণ, ত্রিশ বৎসরের যুবক, অতি স্বল্পভাষী। কিন্তু এই পাণ্ডুর যুবকই পল্লী জীবনের যে কাহিনী দীনেশচন্দ্রকে শোনালেন এবং ময়মনসিংহের অনাবিষ্কৃত পল্লীগাথার যে সন্ধান দিলেন, তাতে দীনেশচন্দ্রের তাঁকে প্রিয় থেকে প্রিয়তর বলে মনে হতে লাগলো।

মৈমনসিংহ-গীতিকায় তিনটি পালাগান চন্দ্রাবতী সংশ্লিষ্ট। মলুয়া, দস্যু কেনারাম আর চন্দ্রাবতী। এর মধ্যে প্রথম দুটি তাঁর রচনা। তবে মলুয়াতে কোনো কবির নাম নেই। গোড়ায় চন্দ্রাবতীর একটা বন্দনা আছে। সে কারণে কেউ কেউ মনে করেন যে সমস্ত পালাটিই চন্দ্রাবতীর রচনা। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেনের অনুমান ভিন্ন ছিল। তাঁর মতে এই পালাটি চন্দ্রাবতীর লেখা নয়। তবে, এই পালার কবি হিসাবে আর কারো দাবী না থাকায়, এটিকে চন্দ্রাবতীর লেখা পালা হিসাবেই বহুল প্রচলিত হয়ে গিয়েছে। চন্দ্রাবতী পালাটি লিখেছেন নয়ানচাঁদ ঘোষ। এই পালাতেই চন্দ্রাবতীর জীবনের করুণ ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই পালাটিই বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক লিখিত প্রমান্য দলিল। চন্দ্রাবতীর লেখা রামায়ণ সংকলিত হয়েছে পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকার চতুর্থ খণ্ডে।

চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে অনেকে দুর্বল এবং অসমাপ্ত বলে সরিয়ে রেখেছিলেন। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পাঠে বিস্ময়াভূত নবনিতা দেব সেন বলেছেন যে, এটি দুর্বল বা অসমাপ্ত কোনোটিই নয়। এটি একজন নারীর দ্বারা রচিত কাব্য যেখানে রামের গুণগান না করে তিনি সীতার দুঃখ ও দূর্দশার দিকটাই বেশি তুলে ধরেছিলেন যা তৎকালীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধাচারণ হিসাবে দেখা হয়েছিল। ফলে তিনি অন্য পালার জন্য খ্যাতি পেলেও রামায়ণ রচয়ীতা হিসাবে গুরুত্ব পান নি।

দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণের সাথে মেঘনাদবধের আশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর ধারণা মেঘনাদবধ কাব্য রচনার আগে মাইকেল মধুসুদন দত্ত চন্দ্রাবতীর রামায়ন পড়েছেন এবং তারই প্রভাব পড়েছে মেঘনাদবধে। তিনি তাঁর পূর্ববঙ্গ গীতিকায় মন্তব্য করেন যে, “এই রামায়ণের অনেকাংশের সঙ্গে মেঘনাদবধ কাব্যের আশ্চর্য্য রকমের ঐক্য দৃষ্ট হয়, আমার ধারণা, মাইকেল নিশ্চয়ই চন্দ্রাবতীর রামায়ন গান শুনিয়াছিলেন, এই গান পূর্ব্ববঙ্গের বহুস্থানে প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে।“

অন্যদিকে সুকুমার সেন এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, ঘটনা উলটো। এই গাথাটি প্রাচীন হলেও এর সংগ্রাহক বা সংস্কর্ত্তা মাইকেল পরবর্তী যুগের এবং এর কিছু অংশ মেঘনাদবধ কাব্য থেকে রূপান্তরিত। তিনি তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস বইতে লিখেছেন, “ছড়াটি যদিও আধুনিক না হয়, ইহার সংগ্রহীতা অথবা সংস্কর্ত্তা যে মধুসূদন দত্তের পরবর্ত্তী কালের লেখক তাহা দ্বিতীয় অংশের পঞ্চবটী বনবাসের সুখকাহিনীর বর্ণনায় পরিস্ফুট হইয়াছে। নিম্নে উদ্ধৃত অংশটি মেঘনাদবধ চতুর্থ সর্গ হইতে রূপান্তরিত হইয়াছে মাত্র।“

আমি কি গো জানি সখি কালসর্প বেশে।

এমনি করিয়া সীতায় ছলিবে রাক্ষসে।।

প্রণাম করিণু আমি পড়িয়া ভূতলে।

উড়িয়া গরুড় পক্ষী সর্প যেমন গেলে।।

রথেতে তুলিল মোরে দুষ্ট লঙ্কাপতি।

দেবগণে ডাকি কহি দুঃখের ভারতী।।

অঙ্গের আভরণ খুলি মারিনু রাক্ষসে।

পর্ব্বতে মারিলে ঢিল কিবা যায় আসে।।

কতক্ষণ পরে আমি হইলাম অচেতন।

এখনো স্মরিলে কথা হারাই চেতন।।

দীনেশচন্দ্র সেন এর ধারণা সুকুমার সেনের কাছে বেশ বিস্ময় হয়ে এসেছিল। কারণ তিনি লিখেছেন, “পরম বিস্ময়ের বিষয় এই যে, পূর্ব্ববঙ্গগীতিকার প্রবীণ ও বিচক্ষণ সম্পাদক মহাশয় বিশ্বাস করিয়াছেন যে, মধুসূদনই চন্দ্রাবতীর নিকট ঋণী! তিনি একাধিক স্থানে লিখিয়াছেন, ‘আমার ধারণা, মাইকেল নিশ্চয়ই চন্দ্রাবতীর গান শুনিয়াছেন’; ‘আমার বিশ্বাস মাইকেল মৈমনসিংহের কবির রামায়ণটি কোন স্থানে শুনিয়া মহিলা কবির দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন’।“

সুকুমার সেনের শুধু রামায়ন নিয়েই সন্দেহ ছিল না। দস্যু কেনারাম এবং মলুয়া পালা নিয়েও তিনি সন্দিহান। এগুলো চন্দ্রাবতীর লেখা বলে স্বীকার করতে তাঁর কুণ্ঠা রয়েছে। তিনি বলেন, “ দস্যু কেনারামের গাথাটি চন্দ্রাবতীর রচনা বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। ইহাতে “দ্বিজবংশীসুতা” ভণিতাও আছে। তবে রূপ অত্যন্ত আধুনিক। ময়মনসিংহ অঞ্চলের আর একটি পালা (মলুয়া) চন্দ্রাবতীর রচনা বলিয়া চলিতেছে। ইহার অকৃত্রিমতা বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। শুধু উপক্রমণিকার বন্দনা পদটিতে চন্দ্রাবতীর ভণিতা রহিয়াছে।“

চন্দ্রাবতীর গান ময়মনসিংহে সুপরিচিত এবং সুপ্রচারিত। চন্দ্রকুমার দে বলেছেন, “শ্রাবণের মেঘভরা আকাশতলে ভরা নদীতে যখন পাইকগণ সাঁজের নৌকা সারি দিয়া বাহিয়া যায়, তখন শুনি সেই চন্দ্রাবতীর গান, বিবাহে কুলকামিনীগণ নববরবধূকে স্নান করাইতে জলভরণে যাইতেছে, সেই চন্দ্রাবতীর গান, তারপর স্নানের সঙ্গীত, ক্ষৌরকার বরকে কামাইবে তাহার সঙ্গীত, বরবধূর পাশাখেলা, তার সঙ্গীত সে কত রকম।“

চন্দ্রাবতীর লেখা পাশাখেলার একটা সঙ্গীত এখানে তুলে দিচ্ছিঃ

কি আনন্দ হইল সইগো রস বৃন্দাবনে,

শ্যামনাগরে খেলায় পাশা মনমোহিনীর সনে।

আজি কি আনন্দ

উপরে চান্দোয়া টাঙ্গান নীচে শীতলপাটি,

তার নীচে খেলায় পাশা জমিদারের বেটি

আজি কি আনন্দ

 

চন্দ্রাবতী কহে পাশা খেলায় বিনোদিনী

পাশাতে এবার হারিল শ্যামগুণমণি!

আজি কি আনন্দ

চন্দ্রাবতীর জীবনের ইতিহাসটি অনেক করুণ। পরমা সুন্দরী ছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকেই বাবার দেখাদেখি কবিতা লেখা শুরু করেন। গানও লিখতেন। শুধু লিখতেনই না, নিজেও গাইতেন। এত সব গুণের কারণে বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই চন্দ্রাবতীকে পাবার জন্য উৎসুক ছিলেন। কিন্তু চন্দ্রাবতীর এ বিষয়ে কোনো আগ্রহই ছিল না। তাঁর নিজের খেয়াতরী তখন জয়ানন্দের ঘাটে বাঁধা। মৃদু মৃদু বসন্ত বাতাসে তা দোদ্যুল্যমান।

জয়ানন্দ ছিলেন চন্দ্রাবতীর জনম জনমের সাথী। বাল্যকাল থেকেই পরিচয় তাঁদের। দুজনেই এক সাথে পড়ালেখা করতেন, খেলা করতেন। বেড়ে উঠার সাথে সাথে ভালবাসার রঙ চড়ায় দুজনের মনে। কবিতার ভাষায় প্রকাশ ঘটে তার। দুজন দুজনকে কবিতা লিখে ভালবাসা জানাতেন। আর এভাবেই এক সময় অন্য বিষয় নিয়েও কবিতা রচনা শুরু করেন তাঁরা। কবি দ্বিজবংশীর পদ্মপুরাণে চন্দ্রাবতী এবং জয়ানন্দ, দুজনেরই কবিতা রয়েছে।

দিনে দিনে দুজনের ভালবাসা প্রণয় গাঢ় হতে থাকে। চন্দ্রাবতী প্রাণ-মন সব উজাড় করে দেয় জয়ানন্দের কাছে। তাদের দুজনের বিয়ের কথাবার্তা প্রায় পাকাপাকি। ঠিক এরকম সময়েই ভিমরতিতে ধরে জয়ানন্দকে। এক মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে। শুধু প্রেমে পড়েই খান্ত হয় না, নিজে মুসলমান হয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে জয়ানন্দ।

জয়ানন্দের এই হঠকারী আচরণ বিশাল এক আঘাত হয়ে আসে চন্দ্রাবতীর জন্য। অল্প বয়সের কোমল হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যায় তাঁর। এই আঘাত সামলাতে শিবপূজায় নিজেকে উজাড় করে দেন তিনি। বাবার কাছে দুটো প্রার্থনা জানান তিনি। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি শিবমন্দির গড়ে দেওয়া এবং আজীবন কুমারী থাকার বাসনা। কন্যাবতসল পিতা আদরের কন্যার দুটো আবদারই মেনে নেন।

চন্দ্রাবতী নিজেকে উজাড় করে দিয়ে শিববন্দনা করতেন। এর পরে যেটুকু অবসর সময় থাকতো, সেই সময়ে রামায়ণ লিখতেন। চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণ এখনও ময়মনসিংহের কোনো কোনো অঞ্চলে মুখে মুখে গীত হয়ে থাকে। দীনেশ্চন্দ্র সেন তাঁর পূর্ববঙ্গ গীতিকায় চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণকে লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য চন্দ্রাবতী এই রামায়ণ শেষ করতে পারেন নাই। সীতার বনবাস পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছেন। থেমে গেছেন বলার চেয়ে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলা উচিত।

জয়ানন্দের কাছ থেকে চিঠি এলো। দেখা করতে চায় চন্দ্রাবতীর সাথে। চন্দ্রাবতী পিতাকে সব জানালেন। পিতা অসম্মতি জানালেন। তাঁর ভাষ্য হচ্ছে, তুমি যে দেবতার পূজোয় মন দিয়েছো, তাঁরই পূজো করো। চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে পালটা জবাব দিয়ে জানালেন যে, দেখা করা সম্ভব না। তুমি বরং শিবের চরণে মনপ্রাণ সমর্পণ করো। তিনি সর্ব দুঃখহারী।

চিঠি পেয়ে উলটো ঘটনা ঘটলো। অনুতপ্ত জয়ানন্দ ছুটে এলো শিবমন্দিরের দিকে। চন্দ্রাবতী তখন শিবপূজায় বিভোর। মন্দিরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। চন্দ্রাবতীকে ডাকার সাহস হলো না জয়ানন্দের। আঙিনার ভিতর সন্ধ্যামালতীর ফুল ফুটেছিল। তা দিয়েই কপাটের উপরে চারছত্র কবিতা লিখে বিদায় নেয় জয়ানন্দ।

পূজো শেষ করে দরজা খুলে বের হলেন চন্দ্রাবতী। চোখে পড়লো জয়ানন্দের লেখা কবিতা দরজার কপাটে। কবিতা পড়ে বুঝলেন দেবমন্দির কলংকিত হয়েছে। চন্দ্রাবতী জল আনতে ফুলিয়ার (ফুলেশ্বরী) ঘাটে গেলেন। গিয়ে বুঝলেন সব শেষ হয়ে গেছে। অনুতপ্ত জয়ানন্দ ফুলিয়ার স্রোতধারায় নিজের জীবনস্রোত বিলীন করে দিয়েছে। এই ভয়াবহ শোকে পাথর হয়ে যান চন্দ্রাবতী। এর পরে আর কোনো কবিতা লেখেন নাই তিনি। যে কারণে রামায়ন অসমাপ্ত থেকে যায়। তারপর একদিন শিবপূজার সময় নিজেও বিদায় নেন এই ধরিত্রী থেকে।

চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে সবাই অবশ্য একমত নন। নয়ানচাঁদ নিজেও তাঁর চন্দ্রাবতী পালাগানে চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে কিছু বলেন নাই। কারো কারো মতে নদীর ঘাটে মৃত অবস্থায় জলে জয়ানন্দের লাশ ভাসতে দেখে তীব্র অনুশোচনায় চন্দ্রাবতীও পরবর্তীতে ফুলেশ্বরী নদীর জলে ঝাঁপিয়ে জয়ানন্দের মত অনুগামী হন। আবার কারো মতে, জয়ানন্দের জলে ডুবে আত্মহত্যা বা মৃত্যুর কিছুদিন পরপরই শোকাবিভূত চন্দ্রাবতী মর্মান্তিক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। দীনেশ্চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ-গীতিকার ভূমিকায় লিখেছেন, “প্রবাদ এই যে, প্রেমাহতা চন্দ্রা জয়চন্দ্রের শব দর্শন করার অল্পকাল পরেই হৃদরোগে লীলা সংবরণ করেন।“

ব্রজেন্দ্রকুমার দে তাঁর মঞ্চনাটক ‘কবি চন্দ্রাবতী’-তে দেখিয়েছেন যে, শোক এবং অপমান থেকে বাঁচার জন্য চন্দ্রাবতী নিজেই গিয়েই ফুলেশ্বরীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন।

তবে যেভাবেই হোক না, গভীর হৃদয়ে গভীর আঘাত নিয়ে তীব্র মনোযাতনায়, অসামান্য প্রতিভাবান বাংলার এই প্রথম নারী কবির মৃত্যু হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর মত অভাগিনী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। নিজেকে ধুপের মত পুড়িয়ে তিনি যে কাব্য সৌরভ পরিবেশন করে গিয়েছেন অনাগত সময়ের জন্য তার খবর শহরে মানুষেরা রাখে নি। কিন্তু পল্লীর মানুষেরা তা ভোলে নি। তাঁদের মুখে গীত হয়ে দুখিনী কবি চন্দ্রাবতী আজো বেঁচে আছেন।

অজস্র প্রণতি, কবি চন্দ্রাবতী।

 

তথ্যসূত্রঃ

১। বঙ্গের মহিলা কবি – যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত

২। মৈমনসিংহ-গীতিকা  – দীনেশচন্দ্র সেন

৩। পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা – দীনেশচন্দ্র সেন

৪। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস – সুকুমার সেন

৫। বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা – সুকুমার সেন

৬। কবি চন্দ্রাবতী (নাটক) – ব্রজেন্দ্রকুমার দে

৭। http://www.milansagar.com/kobi-maimansinghageetika.html

৮। http://hello-today.com/ht/32431#.UHG3XZj7LKE

৯। http://www.milansagar.com/kobi-chandrabati.html