এই বাংলায় তাঁর উপস্থিতি ঘটেছিল কয়েকশ বছর আগে। চন্দ্রকান্তিময় সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। তবে তাঁর প্রীতিমনোহররূপের জন্য নয়, বরং নিজস্ব প্রতিভার জন্যই আজো প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। শশীকলাময় সৌন্দর্যের এই মানুষটি একজন কবি। নাম চন্দ্রাবতী। কবি চন্দ্রাবতী নামেই সুবিখ্যাত তিনি।
চন্দ্রাবতী মধ্য যুগের কবি। বাংলা সাহিত্যের আদি বা প্রথম মহিলা কবিও বলা যায় তাঁকে। তাঁর আগে একজন মাত্র মহিলা কবির কথা জানা যায়। তবে তিনি সত্যি সত্যি ছিলেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাঁর নাম রজকিনী রামমণি বা রামী। কবি চন্ডিদাসের নিষ্কামজ প্রেমের প্রেমিকা হিসাবে বিখ্যাত এই রামী ধোপানি। এই রজকবালা রামী একজন কবি ছিলেন বলে কিছু আলামত পাওয়া যায়। তবে, এগুলো কোনোটা নিরংকুশ সন্দেহ দূর করে পারে না তাঁর কবি হিসাবে অস্তিত্ব সম্পর্কে। আর তাছাড়া বাংলা সাহিত্যে এতজন চণ্ডিদাস আছে যে, ঠিক কোন চণ্ডিদাসের সাথে তিনি সম্পর্কিত ছিলেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। সে কারণেই চন্দ্রাবতীকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবির স্বীকৃতি দিতে বহু লোকেই দ্বিধাহীন, সংকোচশীতলতাবিহীন । চন্দ্রাবতী শুধু প্রথম মহিলা কবিই নন, সৃষ্টির মান এবং পরিমাণের দিক দিয়ে মধ্য যুগের সেরা মহিলা কবিও তিনিই।
চন্দ্রাবতীর বাবাও ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি। পদ্মপুরাণ এবং মনসামঙ্গলের কবি তিনি, কবি দ্বিজবংশী বা বংশীবদন। তিনি ভাসান গানের দল নিয়ে গান গেয়ে বেড়াতেন। সুকুমার সেন তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যের কথায় লিখেছেন, “পূর্ববঙ্গে রচিত বিস্তর মনসামঙ্গল কাব্য পাওয়া গিয়াছে। সে সবগুলির মধ্যে বংশীবদনের কাব্যই শ্রেষ্ঠ। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হইয়াও বংশীবদন কোথাও অযথা পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করিতে চেষ্টা করেন নাই। অপরদিকে, ইহার কাব্য গ্রাম্যতা দোষ হইতে একেবারে মুক্ত।“
দ্বিজ বংশীদাস কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখা মনসামঙ্গল ১৫৭৫ সালের দিকে শেষ হয়। কথিত আছে যে, মনসামঙ্গল রচনায় বংশীবদন চন্দ্রাবতীর সাহায্য পেয়েছিলেন। মনসামঙ্গল রচনার সময়ে চন্দ্রাবতীর বয়স কমপক্ষে পচিশ ছিল। সেই হিসাবে তিনি ১৫৫০ সালের দিকে জন্মেছিলেন বলে অনুমান করা যায়।
কবি দ্বিজবংশীর একমাত্র আদরের কন্যা চন্দ্রাবতী। উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার কবিত্ব শক্তি লাভ করেছিলেন তিনি। চন্দ্রাবতী নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন তার রামায়ণ গাথায় এভাবেঃ
ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়।।
ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম, অঞ্জনা ঘরণী।
বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনি।।
ঘট বসাইয়া সদা পূজে মনসায়।
কোপ করি সেই হেতু লক্ষ্মী ছেড়ে যায়।।
দ্বিজবংশী পুত্র হৈল মনসার বরে।
ভাসান গাইয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে।।
ঘরে নাই ধান-চাল, চালে নাই ছানি।
আকর ভেদিয়া পড়ে উচ্ছিলার পানি।।
ভাসান গাইয়া পিতা বেড়ান নগরে।
চাল-কড়ি যাহা পান আনি দেন ঘরে।।
বাড়ীতে দরিদ্র জালা কষ্টের কাহিনী।
তাঁর ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী।।
দূরিতে দারিদ্র্যদুঃখ দেবীর আদেশ।
ভাসান গাহিতে স্বপ্নে দিলা উপদেশ।।
সুলোচনা মাতা বন্দি দ্বিজবংশী পিতা।
যাঁর কাছে শুনিয়াছি পুরাণের কথা।।
কাব্যের কথা নয়। চন্দ্রাবতী আসলেই অভাগিনী। তাঁর জীবনে যে বেদনাবিধুরতা এসেছে, যে সকরুণতা এসেছে, তা খুব কম মানুষের জীবনেই এসে থাকে। অত্যন্ত করুণভাবে তরুণ বয়সেই সমাপ্তি ঘটেছে এই কবির জীবনের। নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ করুণ জীবনের কারণে পালা রচয়িতা থেকে নিজেই হয়ে উঠেছেন পালাগানের করুণরসে সিক্ত শোকাচ্ছাদিত নায়িকা।
১৯১৬ সালে ময়মনসিংহের কবি চন্দ্রকুমার দে প্রথম সেই এলাকার প্রচলিত পালাগান বা গাথাগুলি সংগ্রহ করেছিলেন। আচার্য্য দীনেশচন্দ্র সেনের উৎসাহে তা পরে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত গীতিকা মৈমনসিংহ-গীতিকা নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১৩ সালে ময়মনসিংহের সৌরভ পত্রিকায় চন্দ্রকুমার দে প্রাচীন কবি চন্দ্রাবতীর বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই প্রবন্ধ পড়েই দীনেশ্চন্দ্র সেন তাঁর খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেন। সৌরভের সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার ছিলেন দীনেশ্চন্দ্রের পুরোনো বন্ধু। তিনি দীনেশচন্দ্রকে জানান যে, “চন্দ্রকুমার একজন দরিদ্র যুবক, ভাল লেখাপড়া শিখিতে পারেন নাই, কিন্তু নিজের চেষ্টায় বাঙ্গালা লিখিতে শিখিয়াছেন।“ তিনি আরো জানান যে, “তাঁহার মস্তিষ্কবিকৃতি হইয়াছে এবং তিনি একেবারে কাজের বাহিরে গিয়াছেন।“
চন্দ্রকুমারের হদিশ না পেয়ে দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহের অনেক লোকের কাছে পল্লীগাথা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু কেউ-ই সেগুলোর কোনো সংবাদ দিতে পারে নাই। কেউ কেউ আবার ইংরেজি শিক্ষার দর্পে বলে উঠেছে যে, “ছোটলোকেরা, বিশেষতঃ মুসলমানেরা, ঐ সকল মাথামুণ্ডু গাহিয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙ্গলের উপর বাহুভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কি থাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজ তৎপ্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন? আপনি এই ছেঁড়া পুথি ঘাটা দিন কয়েকের জন্য ছাড়িয়া দিন।“
সৌভাগ্য যে দীনেশচন্দ্র সেন এই সব ইংরেজি শিক্ষিত দর্পকারীদের কথায় কান দিয়ে ছেঁড়া পুথি ঘাটাঘাটি বন্ধ করেন নি। আর সে কারণেই আমরা পেয়েছি মৈমনসিংহ গীতিকার মত অসাধারণ একটা সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী; কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বত উচ্ছ্বসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্ম-বিস্মৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয় নি।“
দুই বছর পরে কেদারনাথ মজুমদার চিঠি দিয়ে দীনেশচন্দ্র সেনকে জানালেন যে, চন্দ্রকুমার অনেকটা ভাল হয়েছেন এবং খুব শীঘ্রই কোলকাতা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন। তাঁর আরও চিকিৎসা দরকার।
বউয়ের দুই একখানি রূপার অলংকার ছিল। সেগুলো বিক্রি করে চন্দ্রকুমার পথের খরচ জোগাড় করলেন এবং ময়মনসিংহ থেকে কোলকাতায় এসে দীনেশচন্দ্রকে প্রণাম করে দাঁড়ালেন। রোগে-দুঃখে জীর্ণ, মুখ পাণ্ডুরবর্ণ, অর্দ্ধাশনে-অনশনে বিশীর্ণ, ত্রিশ বৎসরের যুবক, অতি স্বল্পভাষী। কিন্তু এই পাণ্ডুর যুবকই পল্লী জীবনের যে কাহিনী দীনেশচন্দ্রকে শোনালেন এবং ময়মনসিংহের অনাবিষ্কৃত পল্লীগাথার যে সন্ধান দিলেন, তাতে দীনেশচন্দ্রের তাঁকে প্রিয় থেকে প্রিয়তর বলে মনে হতে লাগলো।
মৈমনসিংহ-গীতিকায় তিনটি পালাগান চন্দ্রাবতী সংশ্লিষ্ট। মলুয়া, দস্যু কেনারাম আর চন্দ্রাবতী। এর মধ্যে প্রথম দুটি তাঁর রচনা। তবে মলুয়াতে কোনো কবির নাম নেই। গোড়ায় চন্দ্রাবতীর একটা বন্দনা আছে। সে কারণে কেউ কেউ মনে করেন যে সমস্ত পালাটিই চন্দ্রাবতীর রচনা। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেনের অনুমান ভিন্ন ছিল। তাঁর মতে এই পালাটি চন্দ্রাবতীর লেখা নয়। তবে, এই পালার কবি হিসাবে আর কারো দাবী না থাকায়, এটিকে চন্দ্রাবতীর লেখা পালা হিসাবেই বহুল প্রচলিত হয়ে গিয়েছে। চন্দ্রাবতী পালাটি লিখেছেন নয়ানচাঁদ ঘোষ। এই পালাতেই চন্দ্রাবতীর জীবনের করুণ ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই পালাটিই বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক লিখিত প্রমান্য দলিল। চন্দ্রাবতীর লেখা রামায়ণ সংকলিত হয়েছে পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকার চতুর্থ খণ্ডে।
চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে অনেকে দুর্বল এবং অসমাপ্ত বলে সরিয়ে রেখেছিলেন। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পাঠে বিস্ময়াভূত নবনিতা দেব সেন বলেছেন যে, এটি দুর্বল বা অসমাপ্ত কোনোটিই নয়। এটি একজন নারীর দ্বারা রচিত কাব্য যেখানে রামের গুণগান না করে তিনি সীতার দুঃখ ও দূর্দশার দিকটাই বেশি তুলে ধরেছিলেন যা তৎকালীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধাচারণ হিসাবে দেখা হয়েছিল। ফলে তিনি অন্য পালার জন্য খ্যাতি পেলেও রামায়ণ রচয়ীতা হিসাবে গুরুত্ব পান নি।
দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণের সাথে মেঘনাদবধের আশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর ধারণা মেঘনাদবধ কাব্য রচনার আগে মাইকেল মধুসুদন দত্ত চন্দ্রাবতীর রামায়ন পড়েছেন এবং তারই প্রভাব পড়েছে মেঘনাদবধে। তিনি তাঁর পূর্ববঙ্গ গীতিকায় মন্তব্য করেন যে, “এই রামায়ণের অনেকাংশের সঙ্গে মেঘনাদবধ কাব্যের আশ্চর্য্য রকমের ঐক্য দৃষ্ট হয়, আমার ধারণা, মাইকেল নিশ্চয়ই চন্দ্রাবতীর রামায়ন গান শুনিয়াছিলেন, এই গান পূর্ব্ববঙ্গের বহুস্থানে প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে।“
অন্যদিকে সুকুমার সেন এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, ঘটনা উলটো। এই গাথাটি প্রাচীন হলেও এর সংগ্রাহক বা সংস্কর্ত্তা মাইকেল পরবর্তী যুগের এবং এর কিছু অংশ মেঘনাদবধ কাব্য থেকে রূপান্তরিত। তিনি তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস বইতে লিখেছেন, “ছড়াটি যদিও আধুনিক না হয়, ইহার সংগ্রহীতা অথবা সংস্কর্ত্তা যে মধুসূদন দত্তের পরবর্ত্তী কালের লেখক তাহা দ্বিতীয় অংশের পঞ্চবটী বনবাসের সুখকাহিনীর বর্ণনায় পরিস্ফুট হইয়াছে। নিম্নে উদ্ধৃত অংশটি মেঘনাদবধ চতুর্থ সর্গ হইতে রূপান্তরিত হইয়াছে মাত্র।“
আমি কি গো জানি সখি কালসর্প বেশে।
এমনি করিয়া সীতায় ছলিবে রাক্ষসে।।
প্রণাম করিণু আমি পড়িয়া ভূতলে।
উড়িয়া গরুড় পক্ষী সর্প যেমন গেলে।।
রথেতে তুলিল মোরে দুষ্ট লঙ্কাপতি।
দেবগণে ডাকি কহি দুঃখের ভারতী।।
অঙ্গের আভরণ খুলি মারিনু রাক্ষসে।
পর্ব্বতে মারিলে ঢিল কিবা যায় আসে।।
কতক্ষণ পরে আমি হইলাম অচেতন।
এখনো স্মরিলে কথা হারাই চেতন।।
দীনেশচন্দ্র সেন এর ধারণা সুকুমার সেনের কাছে বেশ বিস্ময় হয়ে এসেছিল। কারণ তিনি লিখেছেন, “পরম বিস্ময়ের বিষয় এই যে, পূর্ব্ববঙ্গগীতিকার প্রবীণ ও বিচক্ষণ সম্পাদক মহাশয় বিশ্বাস করিয়াছেন যে, মধুসূদনই চন্দ্রাবতীর নিকট ঋণী! তিনি একাধিক স্থানে লিখিয়াছেন, ‘আমার ধারণা, মাইকেল নিশ্চয়ই চন্দ্রাবতীর গান শুনিয়াছেন’; ‘আমার বিশ্বাস মাইকেল মৈমনসিংহের কবির রামায়ণটি কোন স্থানে শুনিয়া মহিলা কবির দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন’।“
সুকুমার সেনের শুধু রামায়ন নিয়েই সন্দেহ ছিল না। দস্যু কেনারাম এবং মলুয়া পালা নিয়েও তিনি সন্দিহান। এগুলো চন্দ্রাবতীর লেখা বলে স্বীকার করতে তাঁর কুণ্ঠা রয়েছে। তিনি বলেন, “ দস্যু কেনারামের গাথাটি চন্দ্রাবতীর রচনা বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। ইহাতে “দ্বিজবংশীসুতা” ভণিতাও আছে। তবে রূপ অত্যন্ত আধুনিক। ময়মনসিংহ অঞ্চলের আর একটি পালা (মলুয়া) চন্দ্রাবতীর রচনা বলিয়া চলিতেছে। ইহার অকৃত্রিমতা বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। শুধু উপক্রমণিকার বন্দনা পদটিতে চন্দ্রাবতীর ভণিতা রহিয়াছে।“
চন্দ্রাবতীর গান ময়মনসিংহে সুপরিচিত এবং সুপ্রচারিত। চন্দ্রকুমার দে বলেছেন, “শ্রাবণের মেঘভরা আকাশতলে ভরা নদীতে যখন পাইকগণ সাঁজের নৌকা সারি দিয়া বাহিয়া যায়, তখন শুনি সেই চন্দ্রাবতীর গান, বিবাহে কুলকামিনীগণ নববরবধূকে স্নান করাইতে জলভরণে যাইতেছে, সেই চন্দ্রাবতীর গান, তারপর স্নানের সঙ্গীত, ক্ষৌরকার বরকে কামাইবে তাহার সঙ্গীত, বরবধূর পাশাখেলা, তার সঙ্গীত সে কত রকম।“
চন্দ্রাবতীর লেখা পাশাখেলার একটা সঙ্গীত এখানে তুলে দিচ্ছিঃ
কি আনন্দ হইল সইগো রস বৃন্দাবনে,
শ্যামনাগরে খেলায় পাশা মনমোহিনীর সনে।
আজি কি আনন্দ
উপরে চান্দোয়া টাঙ্গান নীচে শীতলপাটি,
তার নীচে খেলায় পাশা জমিদারের বেটি
আজি কি আনন্দ
চন্দ্রাবতী কহে পাশা খেলায় বিনোদিনী
পাশাতে এবার হারিল শ্যামগুণমণি!
আজি কি আনন্দ
চন্দ্রাবতীর জীবনের ইতিহাসটি অনেক করুণ। পরমা সুন্দরী ছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকেই বাবার দেখাদেখি কবিতা লেখা শুরু করেন। গানও লিখতেন। শুধু লিখতেনই না, নিজেও গাইতেন। এত সব গুণের কারণে বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই চন্দ্রাবতীকে পাবার জন্য উৎসুক ছিলেন। কিন্তু চন্দ্রাবতীর এ বিষয়ে কোনো আগ্রহই ছিল না। তাঁর নিজের খেয়াতরী তখন জয়ানন্দের ঘাটে বাঁধা। মৃদু মৃদু বসন্ত বাতাসে তা দোদ্যুল্যমান।
জয়ানন্দ ছিলেন চন্দ্রাবতীর জনম জনমের সাথী। বাল্যকাল থেকেই পরিচয় তাঁদের। দুজনেই এক সাথে পড়ালেখা করতেন, খেলা করতেন। বেড়ে উঠার সাথে সাথে ভালবাসার রঙ চড়ায় দুজনের মনে। কবিতার ভাষায় প্রকাশ ঘটে তার। দুজন দুজনকে কবিতা লিখে ভালবাসা জানাতেন। আর এভাবেই এক সময় অন্য বিষয় নিয়েও কবিতা রচনা শুরু করেন তাঁরা। কবি দ্বিজবংশীর পদ্মপুরাণে চন্দ্রাবতী এবং জয়ানন্দ, দুজনেরই কবিতা রয়েছে।
দিনে দিনে দুজনের ভালবাসা প্রণয় গাঢ় হতে থাকে। চন্দ্রাবতী প্রাণ-মন সব উজাড় করে দেয় জয়ানন্দের কাছে। তাদের দুজনের বিয়ের কথাবার্তা প্রায় পাকাপাকি। ঠিক এরকম সময়েই ভিমরতিতে ধরে জয়ানন্দকে। এক মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে। শুধু প্রেমে পড়েই খান্ত হয় না, নিজে মুসলমান হয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে জয়ানন্দ।
জয়ানন্দের এই হঠকারী আচরণ বিশাল এক আঘাত হয়ে আসে চন্দ্রাবতীর জন্য। অল্প বয়সের কোমল হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যায় তাঁর। এই আঘাত সামলাতে শিবপূজায় নিজেকে উজাড় করে দেন তিনি। বাবার কাছে দুটো প্রার্থনা জানান তিনি। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি শিবমন্দির গড়ে দেওয়া এবং আজীবন কুমারী থাকার বাসনা। কন্যাবতসল পিতা আদরের কন্যার দুটো আবদারই মেনে নেন।
চন্দ্রাবতী নিজেকে উজাড় করে দিয়ে শিববন্দনা করতেন। এর পরে যেটুকু অবসর সময় থাকতো, সেই সময়ে রামায়ণ লিখতেন। চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণ এখনও ময়মনসিংহের কোনো কোনো অঞ্চলে মুখে মুখে গীত হয়ে থাকে। দীনেশ্চন্দ্র সেন তাঁর পূর্ববঙ্গ গীতিকায় চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণকে লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য চন্দ্রাবতী এই রামায়ণ শেষ করতে পারেন নাই। সীতার বনবাস পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছেন। থেমে গেছেন বলার চেয়ে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলা উচিত।
জয়ানন্দের কাছ থেকে চিঠি এলো। দেখা করতে চায় চন্দ্রাবতীর সাথে। চন্দ্রাবতী পিতাকে সব জানালেন। পিতা অসম্মতি জানালেন। তাঁর ভাষ্য হচ্ছে, তুমি যে দেবতার পূজোয় মন দিয়েছো, তাঁরই পূজো করো। চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে পালটা জবাব দিয়ে জানালেন যে, দেখা করা সম্ভব না। তুমি বরং শিবের চরণে মনপ্রাণ সমর্পণ করো। তিনি সর্ব দুঃখহারী।
চিঠি পেয়ে উলটো ঘটনা ঘটলো। অনুতপ্ত জয়ানন্দ ছুটে এলো শিবমন্দিরের দিকে। চন্দ্রাবতী তখন শিবপূজায় বিভোর। মন্দিরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। চন্দ্রাবতীকে ডাকার সাহস হলো না জয়ানন্দের। আঙিনার ভিতর সন্ধ্যামালতীর ফুল ফুটেছিল। তা দিয়েই কপাটের উপরে চারছত্র কবিতা লিখে বিদায় নেয় জয়ানন্দ।
পূজো শেষ করে দরজা খুলে বের হলেন চন্দ্রাবতী। চোখে পড়লো জয়ানন্দের লেখা কবিতা দরজার কপাটে। কবিতা পড়ে বুঝলেন দেবমন্দির কলংকিত হয়েছে। চন্দ্রাবতী জল আনতে ফুলিয়ার (ফুলেশ্বরী) ঘাটে গেলেন। গিয়ে বুঝলেন সব শেষ হয়ে গেছে। অনুতপ্ত জয়ানন্দ ফুলিয়ার স্রোতধারায় নিজের জীবনস্রোত বিলীন করে দিয়েছে। এই ভয়াবহ শোকে পাথর হয়ে যান চন্দ্রাবতী। এর পরে আর কোনো কবিতা লেখেন নাই তিনি। যে কারণে রামায়ন অসমাপ্ত থেকে যায়। তারপর একদিন শিবপূজার সময় নিজেও বিদায় নেন এই ধরিত্রী থেকে।
চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে সবাই অবশ্য একমত নন। নয়ানচাঁদ নিজেও তাঁর চন্দ্রাবতী পালাগানে চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে কিছু বলেন নাই। কারো কারো মতে নদীর ঘাটে মৃত অবস্থায় জলে জয়ানন্দের লাশ ভাসতে দেখে তীব্র অনুশোচনায় চন্দ্রাবতীও পরবর্তীতে ফুলেশ্বরী নদীর জলে ঝাঁপিয়ে জয়ানন্দের মত অনুগামী হন। আবার কারো মতে, জয়ানন্দের জলে ডুবে আত্মহত্যা বা মৃত্যুর কিছুদিন পরপরই শোকাবিভূত চন্দ্রাবতী মর্মান্তিক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। দীনেশ্চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ-গীতিকার ভূমিকায় লিখেছেন, “প্রবাদ এই যে, প্রেমাহতা চন্দ্রা জয়চন্দ্রের শব দর্শন করার অল্পকাল পরেই হৃদরোগে লীলা সংবরণ করেন।“
ব্রজেন্দ্রকুমার দে তাঁর মঞ্চনাটক ‘কবি চন্দ্রাবতী’-তে দেখিয়েছেন যে, শোক এবং অপমান থেকে বাঁচার জন্য চন্দ্রাবতী নিজেই গিয়েই ফুলেশ্বরীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন।
তবে যেভাবেই হোক না, গভীর হৃদয়ে গভীর আঘাত নিয়ে তীব্র মনোযাতনায়, অসামান্য প্রতিভাবান বাংলার এই প্রথম নারী কবির মৃত্যু হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর মত অভাগিনী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। নিজেকে ধুপের মত পুড়িয়ে তিনি যে কাব্য সৌরভ পরিবেশন করে গিয়েছেন অনাগত সময়ের জন্য তার খবর শহরে মানুষেরা রাখে নি। কিন্তু পল্লীর মানুষেরা তা ভোলে নি। তাঁদের মুখে গীত হয়ে দুখিনী কবি চন্দ্রাবতী আজো বেঁচে আছেন।
অজস্র প্রণতি, কবি চন্দ্রাবতী।
তথ্যসূত্রঃ
১। বঙ্গের মহিলা কবি – যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত
২। মৈমনসিংহ-গীতিকা – দীনেশচন্দ্র সেন
৩। পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা – দীনেশচন্দ্র সেন
৪। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস – সুকুমার সেন
৫। বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা – সুকুমার সেন
৬। কবি চন্দ্রাবতী (নাটক) – ব্রজেন্দ্রকুমার দে
৭। http://www.milansagar.com/kobi-maimansinghageetika.html
৮। http://hello-today.com/ht/32431#.UHG3XZj7LKE
৯। http://www.milansagar.com/kobi-chandrabati.html
পড়ার জন্য ধন্যবা। রামায়নটা আমারও পড়া শুরু করতে হবে।
ভীষণ ভালো লাগলো পড়ে। পূর্ব বঙ্গ গীতিকা বইটির কোথাও থেকে ডাউনলোড করা যাবে কি? রামায়ণটা পড়তে চাই
পড়েছি পছন্দ করেছি। ভবিষ্যতে বড় ধরনের আলোচনার ইচ্ছে রইল
এই লেখাটার কথাই বলছিলাম। আপনার এ বিষয়ে লেখা না থাকলে কত কিছুই অজানা থাকতো 🙁
অনেক ধন্যবাদ (F)
@ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা,
আবারো ধন্যবাদ। এই লেখাটা আমার নিজেরই অনেক প্রিয় একটা লেখা। (নিজের ঢোল নিজেই পেটাই। অন্য কাউকে দিলে ফাটিয়ে দিতে পারেতো, তাই।) 🙂
বঞ্চিত করিয়া অজস্র পাঠকেরে
আপনার কাব্যরস হতে
এতদিন ছিলেন কোথা?
পঠিয়া অতিউচ্চ চন্দ্রাবতী কথা
ভুলিয়াছি বিরহ আজি
ভুলিয়াছি ব্যথা।
@প্রদীপ দেব,
বলেছিলেন মোর গুরু হেসে
থাকিস না বাছা সেই দেশে
মুড়ি আর মুড়কি যেথা বিকোয় এক দামে
বিজ্ঞানী যেথা বিজ্ঞান ভুলে
মতামত দেয় কাব্যের ছলে
ত্যাজ্য সে ভূমি, হলেও তা মুক্তমনা নামে।
(Y)
অনেক দিন পরে মুক্ত-মানায় আসলাম। এবং প্রথম পাতায় আপনার লেখাটা দেখে ভাল লাগল।
অভিজিৎ দার প্রথম কমেন্ট দেখে আমি টাস্কি খাইছিলাম।
@আসরাফ,
টাস্কি খাওয়ার কী আছে? আমিতো নতুনই। 🙂
দারুন তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। (Y)
@সবুজ পাহাড়ের রাজা,
ধন্যবাদ রাজা মশাই। (F)
কই থেকে আবির্ভূত হলেন এতদিন পর?
@রামগড়ুড়ের ছানা,
ইতিহাসের পাতা থেকে। 🙂
খুব ভালো লাগছে অনেকদিন পরে আপনার লেখা পড়ে। বিপ্লব রহমানের মত বলি, চলুক।
@মনজুর মুরশেদ,
ধন্যবাদ আপনাকে। আমাদের প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ইতিহাসভিত্তিক এরকম টুকরো টুকরো কিছু ঘটনা বা ব্যক্তিকে নিয়ে আগামীতে আরো লেখার ইচ্ছা আছে আমার।
চন্দ্রাবতী সম্পর্কে খুব একটা জানা ছিল না।
লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্ণনা শৈলী অতুলনীয়। ফরিদ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ।
@সৈকত চৌধুরী,
লেখাটা পড়া এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ সৈকত। (F)
প্রথমেই কঠোর কন্ঠে মাইনাস, মুক্তমনার আঙিনায় একেবারেই না আসার জন্য। তারপরে আন্তরিক ধন্যবাদ চমৎকার একটা বিষয়ে লেখা দেওয়ার জন্য। চন্দ্রাবতী সম্পর্কে আগে শুনেছিলাম কিন্তু এত বিস্তারিত না। এই ফাঁকে চন্দ্রাবতী সম্পর্কে একটু পড়াশোনা হল।
চন্দ্রাবতীকে মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ট মহিলা কবি বললেই মনে হয় সেইফ সাইডে থাকা হয় কারন অনেকেই খনার প্রভাব অস্বীকার করতে চাইবে না প্রথম হিসাবে।
কেউ মধ্যযুগের মহিলা কবি বুদ্ধিজীবিদের সম্পর্কে জানতে চাইলে Susie Tharu আর K.Lalitha লেখিকাদ্বয়ের Women Writing in India, 600 B.C. to the present – Volume 1 পড়তে পারেন।
এই বইয়ের চন্দ্রাবতী সম্পর্কে অধ্যায়টা উঠিয়ে দিচ্ছিঃ
লক্ষনীয় যে এখানে “জয়ানন্দ” নামে কেউ নাই। আছে “জয়চন্দ্র”। যদিও বেশিরভাগ রেফারেন্সে জয়ানন্দ নামেই একজনকে পাওয়া যায়। যে কিনা চিঠি পাঠায়ঃ
অমৃত ভাবিয়া আমি খাইয়াছি গরল
কণ্ঠেতে লাগিয়া রইছে কাল হলাহল ।
শৈশব কালের সংগী তুমি যৈবন কালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।
কোন কোন বয়ানে পাওয়া যায়ঃ
দ্বার খোল চন্দ্রাবতী দেখা দেও আমারে। বলে জয়ানন্দ শেষবারের মত চন্দ্রাবতীকে ডেকেছিল।
সবশেষে পাঠকদের জন্য চন্দ্রাবতীর মন্দিরের ছবিটা দিলাম।
[img]http://www.kishorgonj.com/wp-content/uploads/2011/07/chondra.jpg[/img]
আবার কবে পরবর্তী লেখা পাব ফরিদ ভাই? 🙂
@সাইফুল ইসলাম,
জয়চন্দ্র এবং জয়ানন্দ একই ব্যক্তি। চন্দ্রাবতী পালাটির পুরো নাম খুব সম্ভবত ছিল ‘জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতী’। কারণ, দীনেশ্চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার ভূমিকায় এক জায়গায় লিখেছেনঃ
আবার অন্যত্র যখন তিনি চন্দ্রকুমার এর দেয়া পালার তালিকা দিচ্ছেন সেখানে শিরোনাম দিয়েছেন ‘চন্দ্রাবতী ও জয়চন্দ্র’।
অথচ তিনি যখন পালাটি সংকলন করেছেন তখন শুধু চন্দ্রাবতী হিসাবে দিয়েছেন। জয়চন্দ্রের নাম বাদ পড়ে গিয়েছে। পুরো পালাটিতে ১২টি অঙ্ক আর ৩৫৪ টি ছত্র। আমার যদি চোখের দেখায় ভুল না হয়ে থাকে, তবে এই ছত্রগুলির কোনোটিতে জয়চন্দ্র নাম নেই। সব জায়গাতেই জয়ানন্দ লেখা হয়েছে।
পরথমে লিখিল পত্র চন্দ্রার গোচরে।
পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে।।
পত্র লেখে জয়ানন্দ মনের যত কথা।
নিতি নিতি তোলা ফুলে তোমার মালা গাঁথা।।
কিংবা
জৈবন আইল দেহে জোয়ারের পানি।
কেমনে লিখিব পত্র প্রাণের কাহিনী।।
কিমতে লিখিব পত্র বাপ আছে ঘরে।
ফুল তুলে জয়ানন্দ তারে ভালবাসি।।
শুধুমাত্র ৯ নম্বর অঙ্কের শিরোনামে জয়চন্দ্র নাম ব্যবহার করা হয়েছে। শিরোনামটি হচ্ছেঃ
মুসলমান কন্যার সঙ্গে জয়চন্দ্রের ভাব।
আল্লা মালিক জানেন। সবকিছুই তাঁর হাতে। আমিতো নিমিত্ত মাত্র। 🙂
চন্দ্রাবতির কথা শুনেছি ছোটবেলা থেকেই। আপনার লেখা পরে তার জীবন সম্পর্কে কিছু জানলাম।
আপনি লিখেছেন জন্ম পাতুয়ারী গ্রামে। আমি অবশ্য শুনেছি গ্রামের নাম পাতুয়াইর।(সঠিক বানান আমার অজানা)
ছোট থাকতে নানাবাড়ি যেতাম পাতুয়াইর গ্রাম দিয়ে।পাতুয়াইর গ্রাম বলতে মনে পরে ওখানে একটি মঠ আছে, এবং পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। মায়ের মুখে প্রত্যেকবার ই শুনতাম পাতুয়াইর গ্রামের নামকরণের ইতিহাস। কবি চন্দ্রাবতী একদিন নৌকায় বসে খাচ্ছিলেন। তখন একটি আইর মাছ লাফ দিয়ে কবির পাতে (খাবারে) পরে। তখন থেকে নাকি গ্রামের নাম পাতুয়াইর প্রচলিত হয়।
@সজীব,
খুব সম্ভবত গালগল্প এটি। পরে তৈরি হয়েছে চন্দ্রাবতীকে ঘিরে। এই গ্রামের নাম আগেই প্রচলিত ছিল বলেই আমার ধারণা। কেন এই ধারণা, সেটা পরে বলছি।
বাংলা উইকি গ্রামের নাম লিখেছে পাটোয়ারী। অন্যদিকে সুকুমার রায় তাঁর বাংলা সাহিত্যের কথা এবং দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর মৈমনসিংহ গীতিকায় পাতুয়ারী হিসাবেই এই গ্রামকে উল্লেখ করেছেন।
চন্দ্রাবতীর বাবা দ্বিজ বংশীদাসের দুটো ভণিতাতে এই গ্রামের নাম পাওয়া যায়। এর একটাতে উল্লেখ করা হয়েছে পাটোয়ারী হিসাবে, অন্যটাতে পাতুয়াড়ি। কিন্তু, তিনি যেহেতু নিজে লিখে যান নাই, সে কারণে পরে যাঁরা শ্রুতি থেকে লিখেছেন তাঁদের ঘাড়েই এই বৈষম্যের দায় চাপানো যায়। আমি ভণিতা দুটোর কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম।
যাদবানন্দের সুত দ্বিজ বংশীদাস।
পাঁচালীপ্রবন্ধে কথা করিলা প্রকাশ।।
পরগণা দর্জ্জীবাজু পাটোয়ারী গ্রাম।
ফুলেশ্বরী নদীতটে বিরচিত ধাম।।
……………………………
বংশী দ্বিজ পূর্ব্ব গোসাঞি গুরু চক্রপাণি।
ভবিষ্যৎ বর্ত্তমান ত্রিকালজ্ঞ জ্ঞানী।।
রাঢ় হইতে আসিলেক লোহিতের পাশ।
পাতুয়াড়ি দজ্জিবাজু গ্রামের নিবাস।।
দ্বিজ বংশীদাস একবারও কোথাও উল্লেখ করেন নি যে, এটা এই গ্রামের নতুন নাম। তাঁর মেয়ের নামে হয়েছে। বরং এমনভাবে উপস্থাপনা করা হচ্ছে যাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই গ্রামের নাম সেই সময়ে সুপ্রতিষ্ঠিতই ছিল।
এটা মনে হয় উচ্চারণগত ত্রুটি। বাংলাদেশে বহু গ্রাম বা শহরের নামই সেখানকার অধিবাসীরা সরকারী নামের মত করে উচ্চারণ করেন না। আমার পিতৃপুরুষের নিবাস ছিল মাগুরায়। আমি মাগুরাবাসীদের কদাচিৎই মাগুরা বলতে শুনেছি। মাগুরে বলেই চালিয়ে দেয় তাঁরা। ঝিনাইদহের লোকজন তাঁদের জেলাকে ডাকে ঝিনেদা বলে। ছোটো ফুফুর বিয়ে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী জেলা নড়াইলের লাহুড়িয়া গ্রামে। ওই গ্রামকে গ্রামবাসীরা এবং অন্যরাও লাউড়ে নামেই ডাকে।
আপনার লেখা দেখে কি যে আনন্দ হচ্ছে, ফরিদ ভাই! অনেক দিন বাদে কোন নিকটজনের দেখা পেলে যেমন অনুভূতি হয়, অনেকটা সে রকম। আপনার লেখার নায়িকা চন্দ্রাবতী, কিন্তু নায়ক কে? অনেকেই বলবেন জয়ানন্দের কথা। কিন্তু সে তো চন্দ্রাবতীর নায়ক। বক্ষ্যমাণ লেখাটির নায়ক বরং চন্দ্রকুমার দে, চন্দ্রাবতীর কয়েক শতাব্দী পরে জন্ম নিয়েছেন, অথচ ময়মনসিংহ গীতিকার অমূল্য রত্ন তুলে আনা নায়ককে আমরা জানিই না!
চন্দ্রাবতীর রামায়ণ নিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন ও সুকুমার সেনের বিতর্কটা উপভোগ করছিলাম, কিন্তু শেষে কার মতবাদ প্রতিষ্ঠা পেল বা সুকুমার সেনের সন্দেহ নিয়ে কেউ নতুন কিছু লিখেছেন কিনা, তা জানা হল না।
দীনেশচন্দ্রের হবে মনে হয়।
পিতা সম্মতি জানালেন নাকি নিষেধ করলেন?
চন্দ্রাবতীর করুন গল্পের পাশাপাশি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে পাঠকরা। এই পাঠকদের জন্য আপনি নিয়মিত লিখবেন না, তা কি হয়?
@কাজি মামুন,
মনোযোগী পাঠক আপনি। দুটোই আমার ভুল। ঠিক করে দিয়েছি।
এই লেখার নায়ক চন্দ্রকুমার হতে কোনো বাধা নেই। ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহের কঠিন এবং কষ্টসাধ্য কাজটা তিনিই করেছেন। বন-জঙ্গল, আদাড়-বাদাড় ঘেঁটে তিনি গভীর ভালবাসায় তুলে এনেছেন মণি মাণিক্য। তারপর তা তুলে দিয়েছেন দীনেশচন্দ্রের হাতে। দীনেশচন্দ্র তাঁর মৈমনসিংহ-গীতিকার ভূমিকায় চন্দ্রকুমারের এই কষ্টসাধ্য প্রয়াস সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছেনঃ
গরীবের বাড়িতে দেখি আজ হাতির পা পড়েছে!!!
@আদিল মাহমুদ,
কীসের মধ্যে কী? :-s
@ফরিদ আহমেদ,
আপনি সেই ফরিদ আহমেদ না যাকে অসাদচরনের কারনে মুক্তমনা থেকে বহিষ্কার করা হয়???
@আদিল মাহমুদ,
ভাই, গোপন কথা ফাঁস করেন ক্যান? আপনার দিলে কি একটুও রহম নাই। 🙁
খালি অসদাচরণ না, জামাতি সংশ্লিষ্টতাও ছিল। কাউরে আবার যেন কিছু কইয়েন না ভাই। খালি আপনেরে বিশ্বাস কইরা কইলাম। নবী মানুষ বইলা। 😛
পরথমে লিখিল পত্র চন্দ্রার গোচরে |
পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে ||
পত্র লেখে জয়ানন্দ মনের যত কথা |
“নিতি নিতি তোলা ফুলে তোমার মালা গাঁথা ||
প্রেম-লিপি
………….চন্দ্রাবতী(বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি)
খুব ভালো লাগল লিখাটা ।
ভট্টাচার্য দুহিতা চন্দ্রাবতী ধোপানী হলেন কিভাবে, চন্ডীদাসের প্রসংগই বা কিভাবে এলো তাঁর জীবনে। নাকি চন্ডীদাসের মত চন্দ্রাবতীও একাধীক জন ছিলেন?
@চলন ভাই,
মুক্তমনায় স্বাগতম। আশা করি এখানে নিয়মিত বিচরন করবেন।
@আদিল মাহমুদ, ওহ ভাই! আপনি তাহলে স্বর্গারোহন করেন নি, ধরাধমেই আছেন!! নাকি স্বর্গলোক থেকেই কৃপাবর্ষন করছেন? যাই হোক, খুব ভাল লাগলো এখানে আপনাকে পেয়ে।
@চলনামৃত,
না রে ভাই, স্বররগারোহন এখনো ঘটেনি, ধমাধমেই আছি। আমি এত জলদি চলে গেলে যাবতীয় বাতিল ধর্ম আঁকড়ে থাকা আকন্ঠ পাপে ডুবে থাকা মানব জাতিকে উদ্ধার করবে কে?? তবে এক রাতে ধমেশ্বরের আহবানে টেম্পোরারি সাইট ভিজিট করে এসেছি নারী পশুর মুখ বিশিষ্ট স্পেসশিপে চেপে।
আপনার নিয়মিত পদচারনায় মুক্তমনা নিঃসন্দেহে আরো সমৃদ্ধ হবে।
@চলনামৃত,
খুব সম্ভবত আপনি লেখাটা মনোযোগ দিয়ে পড়েন নি। চন্দ্রাবতী ধোপানি ছিলেন না। তাঁর বাবা রাঢ়ী ব্রাক্ষ্মণ। ধোপানি ছিলেন কবি রামী। তিনি চণ্ডীদাসের প্রেমিকা ছিলেন। রামীর প্রসঙ্গে চণ্ডীদাস এসেছেন, চন্দ্রাবতীর প্রসঙ্গে নয়।
@ফরিদ আহমেদ, দুঃখিত, মনোযোগ দিয়ে পড়ি নি। “তাঁর বাবা রাঢ়ী ব্রাহ্মন” বলতে কি চন্দ্রাবতীর বাবাকে বুঝিয়েছেন? তিনি কিশোরগঞ্জে জন্মেও রাঢ়ী হলেন কি ভাবে, তাঁরা কি পূর্ব বাংলায় চলে এসেছিলেন? তবে ভট্টাচার্যরা অবশ্য রাঢ়ী ব্রাহ্মন হিসেবেই বিবেচিত।
@চলনামৃত,
আরে, দুঃখিত হবার কিছু নেই। পড়েছেন যে তাতেই কৃতজ্ঞ আমি। না পড়লে কী করতাম বলেন? 🙂
হাঁ, চন্দ্রাবতীর বাবা দ্বিজ বংশীবদন ছিলেন রাঢ়ীয় ব্রাক্ষ্মণ। তাঁদের কোনো এক পূর্বপুরুষ রাঢ় থেকে এসে ব্রক্ষ্মপুত্রের ধারে আবাস গড়েছিলেন। বংশীবদন তাঁর মনসামঙ্গলে বলেছেনঃ
বন্দ্যঘটি গাঁই গোত্রে রাঢ়ীর প্রধান।।
রাঢ় হইতে আইলেন লৌহিত্যের পাশ।
যাদবানন্দের সুত দ্বিজ বংশীদাস।
পাঁচালীপ্রবন্ধে কথা করিলা প্রকাশ।।
পরগণা দর্জ্জীবাজু পাটোয়ারী গ্রাম।
ফুলেশ্বরী নদীতটে বিরচিত ধাম।।
(বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন)
আর হ্যাঁ, মনসামঙ্গল কাব্যের উৎপত্তিস্থল কিন্তু রাঢ়, পূর্ব বাংলা নয়।
@ফরিদ আহমেদ, দারুন! ধন্যবাদ!!
কি যে বলেন! আর্কাইভ থেকে আপনার অনেক লেখাই পড়েছি, তবে সময়মত পড়ি নি বলে কোন মন্তব্য করা হয়ে ওঠে নি।
অনেককিছু জানা গেলো; আক্ষেপ রয়ে গেলো, লেখক ক্রিয়া-ভিত্তিক শব্দার্থের পথ ধরে হেঁটে গেলে, বাংলার অতীত খুঁড়ে আরো অনেককিছু আমাদের জানান দিতে পারতেন।
পৌরানিক বা মধ্যযুগের লেখাগুলোর অনুবাদ খুব খুব দরকার। এ কাজ সবার দ্বারা হবে না। যাদের দ্বারা হতে পারতো আপনি তাদের একজন।
ধন্যবাদ।
এবার পাঠকদের উদ্দেশ্যে একটা ঘটনা বলি, নিজের জীবন থেকে।
অনেকদিন পর নানা-র বাড়িতে। শীতকাল। রাতে শুয়েছি মা-র চাচাতো ভাইয়ের সাথে, যে কি-না আমার প্রায় সমবয়সী। রাত দশটা মানে গ্রামের বাড়িতে মধ্যরাত, তো মধ্যরাতে মামা ঢোলকের বাড়ি শুনে আমাকে জাগিয়ে বললো, চলো। আমি চলতে শুরু করার আগেই আমার হাতে ধরিয়ে দিল একটা লাঠি আর তার হাতে দেখলাম রান-দা।
আমি বললাম, গান শুনতে যাবে; এসব কি?
‘আমার শত্রু আছে, পথে হামলা করতে পারে, হেরলাইগ্যাই সব রেডি রাখছি।’
তবুও গান শুনতে যাবে। এই হলো আমার অভিজ্ঞতা।
বাবা টাকা দিয়েছে চিল্লায় যাবার জন্য। ছেলে বন্ধুর বাড়িতে আশ্র্য় নিয়ে সব টাকা খরচ করে ফেলেছ ‘থেটারের’ জন্য।
গানের পালা বসেছে, বেহুলা লখিন্দর। গায়ক এবং শ্রোতা কিন্তু মুসলমান।
সে বাংলা কি আর এখন আছে? কেন নেই, সে প্রশ্ন না করে সবাইকে মক্কার মুসলমান বানিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে আমরা পাশ্চত্যের ডুগডুগি বাজাচ্ছি, আর বানরের নাচ নেচে যাচ্ছি।
সাধু! সাধু!!
@স্বপন মাঝি,
আক্ষেপ এর কী আছে? ক্রিয়া-ভিত্তিক শব্দার্থের পথ আমার অজানিত, আঁধারে ঢাকা। অচেনা ওই অস্পষ্ট পথে আমি পদচারণা করবো না, এটাই স্বাভাবিক। আপনারা যাঁরা ওই পথের সন্ধান জানেন, তাঁদেরকেই সাহসে বুক বেঁধে এগিয়ে আসতে হবে জনপদে। হাত ধরে নিয়ে যেতে হবে হারানো অতীতে।
ফরিদ ভাইকে অনেকদিন পরে দেখা! আশাকরি স্বাস্থ্য-মন ভালো।
এই লাইন গুলিকে কিন্তু ক্লাসিক মধুসূদন মনে হচ্ছে– আর ভাষাও বেশ আধুনিক। ষোড়শ শতকের বাংলায় এধরনের ভাষা থাকা অস্বাভাবিক।
আমি কি গো জানি সখি কালসর্প বেশে।
এমনি করিয়া সীতায় ছলিবে রাক্ষসে।।
—————-
এখনো স্মরিলে কথা হারাই চেতন।
@সফিক,
স্বাস্থ্য-মন সবই ভালো আছে। ধন্যবাদ আপনাকে।
চন্দ্রাবতীর রামায়ণের এই অংশ আসলেই আধুনিক। এর কিছু অংশ অন্যের হাতে পরিবর্তিত বা সংযোজিত হয়েছে বলেই সুকুমার সেনের ধারণা। আবার দীনেশচন্দ্র সেন মহা উচ্ছ্বসিত এই রামায়ণ নিয়ে। দুজনেই বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের বিশাল পণ্ডিত। কার কথা বিশ্বাস করবো, বুঝতে কষ্ট হয়। সে কারণেই আমি দুটো মতামতকেই তুলে ধরেছি। দেখি যদি সময় পাই মাইকেলের মেঘনাদবধের চতুর্থ সর্গ তুলে দেব এখানে। তখন পাঠকরাই তুলনা করতে পারবেন।
দীর্ঘ বিরতির পর ফরিদ আহমেদ কে দেখা গেল তাহলে। বিরল এই লেখাটা সময় নিয়ে বেশ তারিয়ে তারিয়ে পড়তে হবে। তারপর মন্তব্য; ইত্যবসরে (C)
@কাজী রহমান,
আপনি তারিয়ে তারিয়ে লেখা পড়ুন। এই ফাঁকে আমিও তারিয়ে তারিয়ে আপনার দেয়া চা উপভোগ করি। (F)
নতুন লেখক মনে হচ্ছে। মুক্তমনায় স্বাগতম। :))
@অভিজিৎ, নতুন নয়, নবায়িত!
ফরিদ, লেখা ভালো হয়েছে। স্বরূপে পূনার্বিভাবে খুশি হয়েছি।
@অভিজিৎ,
হ্যাঁ, নতুন আমি। স্বাগত জানানোর জন্য ধন্যবাদ। জ্ঞানী-গুণীদের ভীড়ে নিজেকে বড় দীনহীন মনে হচ্ছে।
@ফরিদ আহমেদ,
ঢং এ বাঁচে না দেহি!
তয় লেখাটা জোশ হইছে, জানায় গেলাম।
@ফরিদ আহমেদ,
মুক্তমনা নীতিমালা,নিয়মকানুন পড়ে নিয়েন কিন্তু!!
@শাফায়েত,
তথাস্তু!!!!