কোনো দেশ চূড়ান্তভাবে একটি শহরের ওপর নির্ভরশীল হলে কেমন হয় তার ভবিষ্যত। ঢাকা হলো সেই ধরনের একটি শহর। বাংলাদেশের রাজধানী। সব কাজ, সব প্রয়োজন, সব সুবিধার কেন্দ্রভূমি, অদ্ভুত সব স্বপ্ন বাস্তবায়নের আখড়া খানা। অথচ সেই শহরের কোনো অবকাঠামোই, প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো দূরের কথা, একটি ভবন ধসে পড়লে, আগুন লাগলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বা তার ব্যবস্থাপনাও আমাদের হাতে নাই। মাঠহীন সব স্কুল। ক্যাম্পাসবিহীন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। বেশিরভাগ সময় নাগরিকরা রাস্তায় গাড়ীর মধ্যে বসে অস্থিরতায় কাটায়, ট্রাফিক সিস্টেমের দূর্বলতা আর নিয়ম না মানার আচরণের জন্য। যে-সমাজ যত বেশি প্রযুক্তি নির্ভর এবং ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স কম সেখানে বিপর্যয় অনেকবেশি মারাত্মক। বিজ্ঞানতো আসলে আমাদের তাই শেখায় যে, প্রকৃতিকে নূন্যতম ক্ষতিগ্রস্থ করে বসবাস করাই হচ্ছে সভ্য, বিবেকবান এবং দূরদর্শী মানবসমাজের কাজ।

কখনো কখনো মনে হয়, এই শহর ঠিক করার চেয়ে নতুন একটা শহর গড়া অনেক সহজ হবে।
কোনো শহর সহসাই গড়ে ওঠে না, বা প্রথম থেকেই শহর হিসেবে গড়ে তোলার কোনো উদ্দেশ্যও থাকে না। নানারকম সুযোগ-সুবিধা আর উপযোগিতার কারণে কোনো অঞ্চল ধীরে ধীরে নগর বা শহরের রূপ পায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, শহরের এ গড়ে ওঠার সঙ্গে মস্তিস্কের বিবর্তন বা বিকাশের একটা মিল আছে। তবে শহর বা নগরকেন্দ্রিক যে কোনো অঞ্চল পরিবেশগত কিছু ক্ষতিসাধন করে। কতটুকু করবে তা নির্ভর করবে সেই জায়গার ব্যবস্থাপনা এবং মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের ওপর।

৪০ বছরের পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশন-ব্যবস্থা কোনো উন্নতিই ঘটাতে পারেনি অথচ আবাসন বেড়েছে মারাত্মভাবে- প্রায় দেড় কোটি। সেই নিষ্কাশন ব্যবস্থা কখনো কখনো ওয়াসার পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ফলে ওয়াসার পানি মুহর্তেই ঢাকার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিচ্ছে জীবাণু, যা কখনো বিস্ফোরণ আকারে মহামারী আকারে বিস্তারে সক্ষম হবে। একদিকে পরিবেশ দূষণ, অত্যধিক জ্বালানি ব্যবহার, জনসংখ্যার মারাত্মক বৃদ্ধি সেই সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। যে পরিমাণ ভবন থাকা দরকার তার চেয়ে ছয়গুণ বেশি আছে।

খাল-বিল, ডোবা-নালা ভরাট করে ক্ষুদ্র পোকামাকড় থেকে শুরু করে উভচর, সরীসৃপ, পাখি এমনকি স্তন্যপায়ীদের শুধু হুমকির মুখে নয়, একেবারে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। একে অপরের ওপর নির্ভরশীল সমগ্র জীবজগৎ যে বাস্তুসংস্থান নীতির ওপর দাঁড়িয়েছিল তা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। সেইজন্য হঠাৎ হঠাৎ বাসাবাড়িতে মারাত্মকভাবে অস্বাস্থ্যকর ব্যাপক সংখ্যক পোকামাকড় বা মশামাছির বা ইদুরের দেখা মেলে এখনই। এসব বিনাশের জন্য যেসব রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করি তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কীট পতঙ্গের মাসখানেক সময়ও লাগে না। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিযোজনে আসতে কয়েক বছর লেগে যায়।

গত ৪০ বছরে এর ঘটনাপ্রবাহ খতিয়ে দেখলে টের পাওয়া যায় কত ভয়াবহ হয়েছে এ শহরের পরিবেশ।
একদিকে প্রযুক্তির ঢেউ এসে লেগেছে ঢাকা শহরে, অন্যদিকে বিজ্ঞান থেকে শুধু নয় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা থেকেও দূরে গেছে। কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট : আগে পোকামাকড় ও মশামাছি নিয়ন্ত্রণের জন্য শহরের ড্রেনে একধরনের মাছ ছাড়া হতো। এই মাছই মশামাছির ডিম খেয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু এখন অ্যারোসল দিয়ে কাজটি করায় কিছুদিনের মধ্যে মশা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু মানুষ এত সহজে পারে না। ফলে অ্যারোসল মশামাছি-পোকামাকড়ের যত না ক্ষতি করে তারচে বেশি করে মানুষকে। গাছপালা-পশুপাখি এগুলো প্রকৃতির অংশ। মানুষও প্রকৃতির অংশ। ফলে গাছাপালা ও পাখিবিহীন একটি অঞ্চল ইকোলজ্যিকালি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ঢাকা শহরের তাই হয়েছে। বর্তমানে আমরা যে মাছগুলো খাই তার পেটে থাকে নীলাভ সবুজ শৈবাল। আর এই শৈবালে থাকে কনিফার্ম নামের ব্যাকটেরিয়া। ১ লিটার পানিতে ১ হাজার ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।

সম্প্রতি যে গরম পড়েছে বা তাপদাহ চলেছে তাতে এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। রোগ প্রতিরোধের উপর নির্ভর করে কী পরিমাণ আক্রান্ত হবো। বাস্তুসংস্থান যে শহরে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় সেখানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেমন হবে? কলেরা, রক্ত আমশা, পেটের পীড়াবাহিত রোগ, যেমন ডাইরিয়া, হেপাটাইটিস ‘এ’, টাইফেড জীবাণু। ফলে আমাদের থেকে বের হওয়া বর্জ্য আর ওয়াশার লাইনগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ মহামারির দিকে ধাবিত করবে।

ঢাকার শেষ মরনকামড় দিয়েছে হাউজিং স্টেটগুলোর পরিকল্পনা। সেখানে মানুষ থাকবে না, পশু থাকবে নিরুপন করাই কঠিন হয়ে দাড়ায়। হাউজিং অ্যাপার্টমেন্টগুলোর টপ ফ্লোরে ছাদ তৈরি হয় তাতে দুটো স্তর থাকে যা তাপ থেকে বাচায়। কিন্তু বেশিরভাগ হাউজিংস্টেট এগুলো মানে না। ভবিষ্যত নিয়ে আতংকিত মানুষ এগুলো ভাবতে চায় না, এক টুকরো জায়গাই তার আরধ্য, এটাই তাকে নিরাপত্তা দেবে। তার কাছে পরিবেশগত উপযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যে কোনো মূল্যে সে বেচে থাকাতাই একমাত্র উদ্দেশ্য। পৃথিবীতে আদিম প্রাণও টিকে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু বাস্তুসংস্থান নীতিকে লঙ্ঘন করে নয়। কারণ সে জানে তা তার প্রয়োজন। কিন্তু কোটি কোটি বছর পরে ঢাকার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি, ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে গিয়ে নিজের কবর খুড়েছে। তারপরও মনে করি, যদি এ ভয়াবহতা অনুধাবনে আমরা সক্ষম হই তাহলে নিশ্চয়ই সামনে নতুন কোনো পথ উত্তরণের জন্য বের করতে পারব

আসিফ
ডিসকাশন প্রজেক্ট

এই ধরনের কয়েকটি লেখা তৈরি করেছি। ২০০৮ সাল থেকে। বিভিন্নভাবে ইত্তেফাক,রোববার সমকালে ছাপা হয়েছে। তবে এই লেখাটা সাপ্তাহিক ২০০০ এর বর্ষশুরু ১৮ মে ২০১২ এর বিশেষ সঙখ্যায় বের হয়েছিল। মুক্তমনা পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম।