১. আমার পঠনে হুমায়ুন আজাদের আবির্ভাব তার অসময়োচিত মৃত্যুর প্রায় এক বছর পরে। তখন সদ্য অবিশ্বাসী লেখা পড়া শুরু করেছি। রাহুল সাংকৃত্যায়ন আর প্রবীর ঘোষের কিছু বই পড়ে আরও খুঁজছি কী পড়া যায়। তখনই হঠাৎ কোন একদিন বিশ্বসাহিত্য ভ্রাম্যমান পাঠাগার থেকে আজাদের কোন একটা বই নিয়ে পড়া শুরু করলাম। এতটাই অভিভূত হলাম যে এর পর এক বছর আমি হুমায়ুন আজাদ ছাড়া আর কিছু প্রায় পড়তেই পারলাম না! ২০০৬-কে তাই আমি বলি হুমায়ুন আজাদের বছর, কারণ এই বছরের পুরোটাই আমি গোগ্রাসে তাকে গিলেছি। শুধু কবিতা ছাড়া তার প্রায় যেকোন রকম লেখা এই বছরটাতে পড়া হয়ে গিয়েছিল। এখনও মনে আছে কোন পাঠাগারে কিংবা বইয়ের দোকানে গেলে আমি সব বইয়ের মধ্যে শুধু আজাদের নামই খুঁজতাম!

২. হুমায়ুন আজাদের সেরা লেখা কোনটা সে ব্যাপারে সর্বসম্মত কোন সিদ্ধান্তে আসা কোনভাবেই বোধ হয় সম্ভব না, তাছাড়া আমি কোন সমঝদার সাহিত্য সমালোচক না হওয়াতে আমার সেই আলোচনাতে যাওয়ার স্পর্ধাও নেই। আমি শুধু এখানে তার কয়েকটা লেখা সম্পর্কে বলব যেগুলো আমাকে একটা সময় প্রচন্ড আলোড়িত করেছিল, এবং যেগুলোর প্রভাব এখনও আমার জীবনে অনেকটুকু আছে।

প্রথমদিকে তার উপন্যাসগুলোই বেশি পড়া হয়েছিল। তার উপন্যাসের ধরণ এবং প্রকাশভঙ্গি সম্পূর্ণই আলাদা, সহজেই বাঙলা সাহিত্যের অন্য যেকোন উপন্যাসের সাথে তারটার পার্থক্য বোঝা যায়। আজাদের প্রায় সবগুলো উপন্যাসই ভালো লাগলেও যে তিনটা পড়ে আমি একদম অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম সেগুলো হচ্ছে ‘একটা খুনের স্বপ্ন’, ‘কবি অথবা দন্ডিত অপুরূষ’ এবং ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। প্রথমটা প্রেম নিয়ে, দ্বিতীয়টা একজন কবিকে নিয়ে,আর তৃতীয়টা একটা কিশোরের বেড়ে উঠা নিয়ে। বিষয়গুলো খুব পরিচিত আমাদের, বাঙলা সাহিত্যেও এই বিষয়গুলো নিয়ে অসংখ্য উপন্যাস বা ছোটগল্প বা কবিতাও লেখা হয়েছে। কিন্তু তারপরও এই উপন্যাসত্রয়ীতে আমি এমন কিছু দেখেছিলাম যা আর কোথও দেখিনি আগে- বৌদ্ধিক সততা। বাঙলা সাহিত্যের মধ্যে (অবশ্য ব্যাপক অর্থে সমগ্র বাঙালি জীবনেও) এই জিনিসটার অভাব খুব বেশিই দেখা যায়।

আমি যখন একটা প্রেমের উপন্যাস লিখব, সেখানে কী শুধুই থাকবে প্রেমিক-প্রেমিকার একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকা,আলতোভাবে হাত স্পর্শ করা, কিংবা ঘন্টার পর ঘন্টা আবেগী কথা বলা? সেখানে কী থাকবেই না সেই অপরিহার্য উপাদান, যৌনতা, যেটা ছাড়া কোন প্রেম বাস্তবে কল্পনাই করা যায় না? প্রতিটা প্রেমই শেষ পর্যন্ত যৌনতায় গিয়ে পরিণতি পায়; আর যদি যৌনতায় কোন প্রেম পৌছাতে না পারে, তাহলে তো বলতে হয় সেই প্রেম শুধু প্রেমের একটা ভগ্নাংশইমাত্র, সত্যিকারের প্রেমই নয় সেটা। কিন্তু অবিশ্বা্স্য হলেও সত্যি বাঙলা সাহিত্যে এই যৌনতার ব্যাপারটাকে লেখকরা খুব বেশি পরিহার করেন, তাদের অনেকে যৌনতাকে এক ধরণের অপরাধই মনে করেন! ‘একটা খুনের স্বপ্ন’তেই আমি প্রথমবারের মত বাঙলা সাহিত্যের প্রেমের উপন্যাসে যৌনতাকে এত তীব্রভাবে পেয়েছি, তাই আমার জন্য ‘একটা খুনের স্বপ্ন’ ছিল প্রথম বাস্তব বাঙলা প্রেমের উপন্যাস।

তারাশঙ্করের ‘কবি’ পড়া হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। কবি নিয়ে তারাশঙ্করের ‘কবি’র ধারণা নিয়েই পড়া শুরু করেছিলাম ‘কবি অথবা দন্ডিত অপুরূষ’। যথারীতি কবি নিয়ে ধারণাটাই পুরোপুরি পাল্টে গেল। প্রথমবারের মত বুঝতে পারলাম কবিরা আসলে কী অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যায়। তারাশঙ্করের ‘কবি’ পড়ে কবিদের সম্পর্কে, কবিদের অনুভূতি সম্পর্কে জানা হয় না মোটেই, শুধু কবি নামধারী এক কবিয়ালের জীবনকাহিনী জানা যায় মাত্র। কিন্তু আজাদ আমাকে দিয়ে অনুভব করিয়ে নিয়েছেন একজন কবির অনুভূতিকে, আমাকে বুঝাতে পেরেছেন একজন কবি ঠিক কোন প্রেরণা দ্বারা তাড়িত হয়ে একটা কবিতা লেখায় হাত দেয়।

তবে এই উপন্যাসত্রয়ীর মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালোলাগার উপন্যাসের প্রতিপাদ্য এক কিশোরের বেড়ে ওঠার সত্যিকথন। ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’ আমাকে অনেক দূর তাড়িয়ে নিয়ে যায় সুদূর কোন এক গ্রামে, যে গ্রামে একটা কিশোর বেড়ে ওঠে তার চারিপাশের অসাধারণ প্রকৃতির সাথে। অসংখ্য আবেগ ছড়িয়ে আছে এই উপন্যাসটির প্রতিটা পৃষ্ঠায়, কিন্তু আবেগের তোড়ে ভেসে না গিয়ে আজাদ ঠিকই মাটিতেও পা রেখেছেন। তাইতো আমি প্রথমবারের মত দেখি কোন উপন্যাসের কিশোরকে হস্তমৈথুন করতে! প্রতিটা কিশোরের বেড়ে ওঠার সময়ে এই অপরিহার্য উপাদানকে বেশিরভাগ লেখকই সলজ্জভাবে তাদের উপন্যাসে এড়িয়ে গেলেও প্রথাবিরোধী হুমায়ুন আজাদের পক্ষে এরকম ভন্ডামি করাটা সম্ভব হয় নি।

৩. বাঙলা ভাষা ও বাঙলা সাহিত্য নিয়ে হুমায়ুন আজাদের দুইটা বই আছে; সাহিত্য নিয়ে ‘লাল নীল দীপাবলি’ আর ভাষা নিয়ে ‘কতো নদী সরোবর’। এই দুইটা বই পড়ার আগে আমি কখনো ধারণাই করতে পারি নি সাহিত্য বা ভাষার ইতিহাস এতটা আবেগী হতে পারে! সাহিত্য বা ভাষা শব্দগুলোকে শুনতে যতই নীরস মনে হোক না কেন আজাদের লেখার গুণে এরাই হয়ে উঠে চরম উপভোগ্য! বাঙলা সাহিত্য আর বাঙলা ভাষা- এই দুইটাকে আজাদ তার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন, তার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে উল্লেখ্য দুই বইয়ের প্রতিটা পৃষ্ঠায়। এর কোনটার প্রতিই আমার ভালোবাসা এতটা তীব্র ছিল না বইদুটো পড়ার আগে, কিন্তু পড়তে পড়তে অদ্ভূত ভালোলাগায় ভরে উঠছিলাম আমি। আর, পড়া শেষ করে আবিষ্কার করলাম, বাঙলা ভাষা আর সাহিত্য দুটোকেই আমি নিজেও খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি!

আমি মনে করি, পৃথিবীতে যত বাঙলাভাষী আছে সবারই এই দুটো বই পড়া উচিত। যেকোন বাঙালি এই দুইটা বই পড়ে নিজের ভাষা আর সাহিত্য নিয়ে গর্ব করতে বাধ্য।

৪. অবশ্য আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে তার শাণিত প্রবন্ধগুলো। তার প্রায় সবগুলো প্রবন্ধের বইই আমার পড়া, তবে সবচেয়ে বেশি যে দুইটা আমাকে মুগ্ধ করেছিলো সেগুলো হচ্ছে ‘আমার অবিশ্বাস’ আর ‘নারী’।

‘আমার অবিশ্বাস’ই সেই বই যেটা আমাকে পুরোপুরি অবিশ্বাসী বানিয়েছিল। সবকিছুতেই প্রশ্ন তুলা আর সবকিছুকেই যুক্তির নিরিখে দেখার অভ্যাসটা গড়ে তুলতেও প্রেরণা দিয়েছে এই বই। আবার, যু্ক্তিবাদী হওয়ার সাথে আমাকে প্রচন্ড অনুভূতিপ্রবণও করে তুলেছিল এই একই বই। এই আকারে ছোট একটা বইয়ের বিশাল একটা শক্তি আছে, এটা যেকোন মানুষকেই পুরোপুরি পালটে দিতে পারে। যে অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা নিয়ে কোন পাঠক এই বইটা পড়া শুরু করবে, বইটা পড়া শেষে তার সেইসব অভিজ্ঞতা আর অনুভূতিই হয়ে যেতে পারে পরিবর্তিত। হয়ত পুরো পৃথিবীকেই সে সম্পূর্ণ নতুনভাবে দেখা শুরু করে দিতে পারে। আমার ঠিক একই অবস্থা হয়েছিল। আমি পরিষ্কাভাবেই বুঝতে পারছিলাম আমি পালটে যাচ্ছি; আমার অনুভূতি,আমার অভিজ্ঞতা, আমার দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুরই এক নতুন সংজ্ঞায়ন হয়েছিল বইটা শেষ করে উঠতে উঠতে। আমি পরিণত হচ্ছিলাম এক অবিশ্বাসী অনুভূতিপ্রবণ কাব্যিক সত্তায়।

অন্যদিকে ‘নারী’ পড়ে রাতারাতি পরিণত হয়েছিলাম নারীবাদীতে। বাঙলা নারীবাদী সাহিত্যে তসলিমার ‘নির্বাচিত কলাম’ আর আজাদের ‘নারী’কেই সবচেয়ে গুরূত্বপর্ণ মনে হয় আমার। ‘নারী’ পুরোপুরি মৌলিক রচনা না হলেও এতে হুমায়ুন আজাদের নারীর প্রতি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির বেশ ভালো পরিচয়ই পাওয়া যায়। আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা পুরূষবাদী দৃষ্টিভঙির অজস্র উদাহরণ আগেই আমার পাওয়া হয়ে গিয়েছিল ‘নির্বাচিত কলাম’ পড়ে,আজাদের ‘নারী’ এই পুরূষবাদীতার আরও গভীরের পরিচয় দিল আমাকে, সাথে সাথে অসম্ভব প্রেমে পড়ে গেলাম ওলস্টেনক্রাফট, স্টুয়র্ট মিল, আর দ্যা বুঁভোয়া দের। নিজের পুরুষ হয়ে জন্মানোর কারণে একটা অপরাধবোধের জন্মও হল তখন (যেটা থেকে আজও পুরোপুরি বের হতে পারি নি আমি)।

৫. সবশেষে বলতে হয় ‘হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ’এর কথা। বইটা পড়তে সময় লাগে প্রায় দশ মিনেটের মত, কিন্তু এই দশ মিনিটেই চিন্তার পুরো জগতটা আলোড়িত হয়ে যায়। হুমায়ুন আজাদের স্বভাবসিদ্ধ প্রথাবিরোধিতার এক চূড়ান্ত নিদর্শন এই বই। রাজনীতি ধর্ম সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ নজরুল টেলিভিশন অভিনয়- কোনকিছুকেই ছেড়ে কথা বলেন নি তিনি। সবকিছুতেই প্রশ্ন তার, কোনকিছুকেই বিনা যুক্তিতে মেনে নিতে তিনি অনভ্যস্ত। এই বইটা একজন পাঠকের দশ মিনিট সময় কেড়ে নিবে সত্যি, তবে এই বইটাই হয়ত তাকে সারা জীবন চিন্তা করার কিছু রসদও দিবে!

৬. আমার জীবনের সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ মানুষগুলোর একজন হুমায়ুন আজাদ। আমার চিন্তার জগতে তিনি রীতিমত বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, আর ব্যক্তিগত জীবনে আরও বেশি অনুভূতিপ্রবণ আর যৌক্তিক হওয়ার প্রেরণাও দিয়েছেন তিনিই। তবে তারপরও আমি তার অন্ধ অনুসারী নই। আয়রনী হচ্ছে এটাই যে কাওকে অন্ধভাবে অনুকরণ না করার শিক্ষাটাও আমার তার কাছ থেকেই পাওয়া!

তবে তার প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে আমার প্রচুর সময় লেগেছিলো্। একটা সময় তার কথাকেই বেদবাক্য মনে করতাম। মনে হত হুমায়ুন আজাদ যা বলেছেন সেটাই যেকোন কিছুর শেষ কথা। হুমায়ুন আজাদ যারা মাত্র পড়া শুরূ করে অথবা যারা শুধু তাকেই পড়ে তাদের জন্য এটা একটা অপরিহার্য পরিণতি। হুমায়ুন আজাদের লেখার জাদুকরী শক্তি তার নিয়মিত পাঠককে একটা সময় চিন্তার দিক থেকে বন্ধ্যা করে ফেলতে পারে। আামার পরিণতিও হয়ত সেটই হত যদি না আমি একটা সময় আজাদের বলয় থেকে বের হয়ে আসতে পারতাম। হুমায়ুন আজাদই আমাকে প্রথম যু্ক্তি দিয়ে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন, কিন্তু তার মধ্যেই ছিল প্রচুর অযৌক্তিকতা্। তার লেখাকে তার থেকে পাওয়া যৌক্তিকতাবোধ দিয়ে বিশ্লেষণ করতে গেলেই এসমস্ত অযৌক্তিকতা এবং স্ববিরোধিতা ধরা পড়ে যায়! তিনি আমাকে এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছিলেন, কিন্তু তার মধ্যে পড়ে থাকলে ঐ দিগন্ত বিকশিত হতে পারত না্। তাই আমাকে তার প্রভাব থেকে মু্ক্ত হতে হয়েছিলো, কিন্তু তার শিক্ষা আজও রয়ে গেছে আমার মধ্যে।

৭. আমার খুব গভীর একটা আক্ষেপ যে আমি আমার খুব প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে কখনোই সরাসরি দেখতে পারবো না। একটা সময় আমার কান্না পেয়ে যেত এটা ভেবে যে হুমায়ুন আজাদের মত এত অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন একটা মানুষ বেঁচে থাকতে পারেন নি এই পৃথিবীতে। কত শূয়োরের আবাস এখন এই পৃথিবীটা, এই অজস্র শূয়োরের খোয়াড়ে একটা হুমায়ুন আজাদ থাকলে কীইবা এসে যেত এইসব শূয়োরদের?

হয়ত অনেককিছুই এসে যেত, হয়ত পুরো শূয়োরের খোয়াড়টাই ভেঙ্গে পড়ত অবলীলায়, হয়ত হুমায়ুন আজাদের কলমের শক্তি এক হাজারটা শূয়োরের তীব্র চিৎকার থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। এই কারণেই তো মরতে হয়েছিলো এই দারূণ মানুষটাকে।

কিন্তু তারা কী এটা কখনো বুঝতে পারবে যে ব্যক্তি হুমায়ুন আজাদকে চিরদিনের মত স্তব্ধ করে দিলেও তার চেতনার কন্ঠরোধ করা সম্ভব না কিছুতেই, কিছুতেই সম্ভব না এক হুমায়ুন আজাদের প্রেরণায় জন্ম নেওয়া লাখো হুমায়ুন আজাদের কন্ঠকে স্তব্ধ করতে চিরদিনের মত?

(অগাস্ট ১২, ২০১২)