হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস সমগ্রের উৎসের সন্ধানে
আদনান আদনান

উৎসর্গ
১৯৪৭-২০০৪

“যাদুকরের মৃত্যু” হুমায়ুন আজাদের একমাত্র ছোটো গল্পের বই। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৫, এই দীর্ঘ সময়ের ভিতরে মাত্র পাচঁটি ছোটো গল্প লিখেছেন তিনি। ১৯৯৪-এ বের হয় তাঁর ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল কাঁপানো প্রথম উপন্যাস “ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল”। যে উপন্যাসটি পাঠককে একগুছ নতুন অনুভূতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। পাঠক বুঝতে পারেন তিনি এমন উপন্যাস বাঙলায় ১৯৯৪ এর আগে আর পড়েননি। আর ২০০৪-এ বের হয় তাঁর শেষ উপন্যাস “একটি খুনের স্বপ্ন”, যা অনেকটা যেন একটি গদ্য কবিতা। এর মাঝে তিনি আরো দশটি উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর এই মোট বারোটি উপন্যাস বাঙলা সাহিত্যকে কি দিয়েছে? তিনি এই বারোটি উপন্যাস না লিখলে বাঙলা সাহিত্যের কি কোনো ক্ষতি হতো? কেনোই বা তিনি উপন্যাস লিখতে উদ্বুদ্ধ হলেন, আর তাঁর এই বারোটি উপন্যাসের উৎস-ই বা কোথায়?
হুমায়ুন আজাদ তাঁর উপন্যাস সমগ্রে মাদাম বোভারী, আন্না কারেনিনা, দ্যা ব্রাদার্স কারামাযোভ, ইউলিসিস, ললিতা, বা মিডনাইটস চিল্ড্রেন এর মতো কোনো “উপন্যাসের ক্ষেত্র” সৃষ্টি করতে পারেননি। তিনি তাঁর একটি ভাব বা ধারণাকে উপন্যাসের রুপ দিয়েছেন মাত্র। আর তাঁর উদ্দ্যেশ্যও ছিলো তাই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টি আন্তর্জাতিক মাণদন্ডে উপন্যাস হয়ে ওঠেনি। একমাত্র “শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার”-ই কিছুটা সফল হয়েছে “উপন্যাসের ক্ষেত্র” সৃষ্টি করতে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি বাঙলা সাহিত্যকে তিনটি জিনিস দিয়েছেঃ-
১। তিনি বাঙলা ভাষা ব্যবহারের নতুন সীমানা এঁকেছেন। বাঙলা ভাষার প্রকাশ ক্ষমতাকে মুক্ত করেছেন।
২। বাঙলা ভাষার উপস্থাপন ক্ষমতা যে কতো ব্যপক তা তিনি দেখিয়েছেন।
৩। আর হৃদয়ের সাহস আর শিল্পের চরমতম সৌন্দর্য যে বাঙলা ভাষায়ও তুলে ধরা সম্ভব তা তিনি প্রমাণ করেছেন প্রায় প্রতিটি বাক্যে।

বাঙলা সাহিত্যে হুমায়ুন আজাদের জন্ম না হলে বাঙলা ভাষাকে ঠিক যেভাবে তিনি ব্যবহার করেছেন, তা আমাদের আর জানা হতোনা কোনোদিন। আর তাই সাহিত্যের মান নির্ণয়নের ক্ষেত্রে তিনি সাহস আর বাঙলা ভাষা ও তার উপস্থাপনকেই জোর দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। যে কারনে অনেক নামজাদা ঔপন্যাসিকের সৃষ্টিকে তিনি অপন্যাস বলেছেন, বা তাঁদের সৃষ্টিকে তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। আর প্রকৃত ঔপন্যাসিকদের চিন্তায় ও সৃষ্টিতে দাবী করেছেন সৎসাহস আর মনুষ্যত্বের ছাঁপ।

হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস সমগ্রের প্রধান উৎস দু’টিঃ-
১। হুমায়ুন আজাদের বারোটি উপন্যাসের জন্ম তাঁর ঐ পাঁচটি ছোটো গল্পে, তা তাঁর উপন্যাস আর ছোটো গল্পগুলো পড়লে সহজেই ধরা পড়ে। “অনবরত তুষারপাত” থেকে জন্মেছে চারটি উপন্যাসঃ মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ, একটি খুনের স্বপ্ন, শ্রাবনের বৃষ্টিতে রক্তজবা, আর সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে। “জঙ্গল, অথবা লাখ লাখ ছুরিকা” থেকে জন্মেছে তিনটি উপন্যাসঃ ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল, কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ, আর নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু। “মহান শয়তান” আর “যাদুকরের মৃত্যু” থেকে জন্মেছে তিনটি উপন্যাসঃ রাজনীতিবিগণ, শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার, আর পাক সার জমিন সাদ বাদ। “আমার কুকুরগুলো” থেকে জন্মেছে দু’টি উপন্যাসঃ ফালি ফালি ক’রে কাটা চাঁদ, আর ১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষন। হুমায়ুন আজাদের ভিতরে তাঁর উপন্যাসগুলোর জন্ম-প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিলো সেই ১৯৭৯-তেই।
২। আর তাঁর প্রায় প্রতিটি উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের সাথেই মিল খুঁজে পাওয়া যায় দস্তয়েভস্কির “নোটস ফ্রম দ্যা আন্ডারগ্রাউন্ড” এর প্রধান চরিত্রের। খুব সহজেই বোঝা যায় যে হুমায়ুন আজাদ চরমভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন দস্তয়েভস্কির এই উপন্যাসটি পড়ে। আর তা না হলে প্রায় বারোটি উপন্যাস তিনি বের করে আনতে পারতেননা “নোটস ফ্রম দ্যা আন্ডারগ্রাউন্ড” থেকে।

কোনো কিছুই সমালোচনার সীমানার বাইরে থাকতে পারেনা, যদিও তা হয়ে থাকে হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস। একথা সত্য যে জ্ঞানীরা ভবিষ্যতে আরো গবেষণা করবেন তাঁর উপন্যাস নিয়ে, কিন্তু তাঁদেরকে হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস সমগ্রের উৎসের সন্ধানে বারবার ফিরে যেতে হবে দস্তয়েভস্কির “নোটস ফ্রম দ্যা আন্ডারগ্রাউন্ড”, আর হুমায়ুন আজাদের-ই ঐ পাঁচটি ছোটো গল্পে।

*** ই-মেইলঃ [email protected]