লিখেছেন: কামরুল হাসান শোভন

• জীবের বা প্রাণের উৎপত্তি সর্ম্পকে দুটি মতবাদ রয়েছে । একটি হচ্ছে গ্রহানুপুঞ্জ মতবাদ আর অন্যটি ওপারিনের মতবাদ নামে পরিচিত । প্রথমটিতে দাবী করা হয় যে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল আমাদের সৌরজগৎ থেকে দূরের কোনো ছায়াপথে । আমাদের পৃথিবীতে জীবনের সেই সূচনা অণুকে নিয়ে আসে বিভিন্ন গ্রহানুকণা। । আর একটি মতবাদে বলা হয় উত্তপ্ত পৃথবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিলো অ্যামিনো এসিডের কণাকে কেন্দ্র করে । সে যাই হোক, একবার যখন প্রাণ উৎপন্ন হলো তখন একটা জিনিস সবার জন্য চিরায়ত সত্য হয়ে দেখা দিল ; আর সেটা হচ্ছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই । আপনি, আমি বা আমাদের পরিচিত জগৎ এর সকল জীব কিন্তু এই কাজটাই করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । এর জন্য প্রকৃতির কোনো ন্যায়-অন্যায় , পাপ-পূণ্য বোধ নেই । আপন অস্তিত্ব রক্ষাই এখানে চরম স্বার্থকতা । এসব কথা বলার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক ভালোবাসার উদ্ভব সর্ম্পকে আলোকপাত করা । মঙ্গলময় জীবন বলতে আমি বুঝি সেই জীবন যে জীবন যুক্তি দ্বারা পরিচালিত এবং প্রেম দ্বারা উদ্ভাসিত । মানবজীবনে প্রেমের অস্তিত্ব বিচিত্র । মানুষের প্রেমময়তা বা ভালোবাসার সূচনা পর্ব আদিম প্রকৃতিতে । তাই প্রকৃতি নিজ থেকেই শিখিয়েছে ভালোবাসার অভিব্যক্তি ও প্রয়োজনীয়তা । নিজ অস্তিত্ব রক্ষায় নিজকে ভালোবাসা আর নিজের চারিপাশের প্রয়োজনীয় উপাদানকে ভালোবাসা ই প্রকৃতির শিক্ষা ।

এখন পর্যন্ত ব্যাপারটাকে সরল মনে হলেও এই সরল ব্যাপার থেকেই সংগঠিত হয় জটিল এবং কঠিন বিচিত্র ভালোবাসার । বিবর্তনের ফলে জটিল জীবের উদ্ভব এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটার ফলে ভালোবাসা ও প্রেমময়তার স্বরূপ পরিবর্তীত হয়েছে বিভিন্নভাবে । এই লেখার আলোচ্য বিষয় যৌন নৈতিকতা তাই এখানে মানব সভ্যতার কিছু আদিম ব্যবস্থার কথা আলোচনা করা আবশ্যক । আদিম সমাজ ব্যবস্থায় আমরা মাতৃপ্রধান পরিবারের অস্তিত্ব দেখতে পাই । মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারের উদ্দেশ্যকে নারী জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয় । বর্তমান সময়ে পরিবার গঠনের মূল ও প্রধান উদ্দেশ্য সন্তান জন্মদান কিন্তু আদিম সমাজে তা ছিলো না কারণ নারীরাই এক্ষেত্রে একচেটিয়া ভূমিকা পালন করত এবং পুরুষের পিতৃত্ব বলে কোনো ঘটনা তখনকার লোকদের জানা ছিল না । এক্ষেত্রে আমরা উদাহরণ হিসাবে আনতে পারি ট্রোবিয়েনড দ্বীপপুঞ্জের বর্বর সমাজের কথা যারা বিশ্বাস করত সন্তান হলো ঈশ্বরের দান । তারা বিবাহ করত কিন্তু পুরষের সন্তান জন্মদানের ব্যাপারে কোনো ভূমিকা তাদের জানা ছিলো না । দীর্ঘ সমূদ্র যাত্রার পর ঘরে ফিরেও পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের কোলে সন্তান দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়ত । মূলত পরিবারের গঠনের উদ্দেশ্য ছিলো সম্মিলিতভাবে জীবিকা নির্বাহ করা , জৈবিক চাহিদা বা সন্তান উৎপাদন নয় । এই কারণে বংশ পরিচয়ও নির্ধারিত হত মায়ের দিক থেকে । এর কিছু নমুনা আমরা এখনো কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীতে দেখতে পাই । মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কারণে ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য ছিলো নারীবাদী । সনাতন ধর্মে ও আদিম ধর্মব্যবস্থাতেও দেবীরূপী ঈশ্বরদের ভূমিকা প্রকট । প্রথম পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম হচ্ছে খ্রিস্টধর্ম । ইতিমধ্যে সভ্যতা পুরুষের বীর্যের ভূমিকা অবলোকন করেছে । মানুষের সেই চিরায়িত অস্তিত্ব রক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিই আবার পুরুষদের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে । পুরুষ তার পিতৃত্ব অর্জনের মাধ্যমে অমর হওয়ার বাসনা লালন করে আর তাই পিতৃত্ব নিশ্চিত করতে চালায় ধর্মীয় অবরোধ । এযুগে এসে পুরুষরা তথা ধর্মগুরুরা অবাধ যৌন মেলামেশাকে নীতিবিবর্জিত কাজ বলে চিহ্নিত করে । পুরুষের পিতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য এর থেকে ভালো আর কোনো উপায় হতে পারে না । আদিম সমাজে নারীদের বহুবিবাহ করার প্রচলন ছিলো কিন্তু পিতৃত্ব নিশ্চিতকরণের জন্য সেই প্রথা রহিত করা হলো এবং উল্টা প্রথার আর্বিভাব হলো । পুরুষরা এবার স্বাধীন যৌন জীবন লাভ করলো এবং বহুবিবাহসহ , বিবাহবর্হিভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপনেও মৌন সম্মতি লাভ করলো । যে কাজ করার জন্য নারী হলো ব্যাভিচারী চরিত্রহীনা ঠিক একই কাজের জন্য পুরুষ পেলো তার পৌরুষ প্রদর্শনের সুযোগ । গণিকাবৃত্তি হলো নারীর একক পেশা । পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর যৌন অধিকারকে অচল এবং যৌন চাহিদাকে অস্বীকার করা হলো । এ যুগে নারীরা পুরুষের সম্পত্তিরূপেই গণ্য হত । হিন্দু, ইহুদী, খ্রিস্ট বা মুসলিম সমাজে এর প্রভাব সহজেই দীপ্তমান । হিন্দু সমাজে স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুরুষ পেলো পুনরায় সংসার করার অধিকার অথচ নারীর জন্য তৈরি হলো সহমরণে যাওয়ার ধর্মীয় নিয়ম । ইহুদী সমাজে নারীদের সরাসরি পুরুষের সম্পত্তি ধরা হত; কুমারী মেয়েকে পিতা অন্য পুরুষের হাতে বৈবাহিক নিয়মে তুলে দিত । বিবাহের সময় নারীদের মাথা ন্যাড়া করতে হতো , এর কারন হচ্ছে অন্য পুরুষের চোখে তাকে আকর্ষণহীন করে তোলা । খ্রিস্ট আর মুহাম্মদীয় ধর্মের কথা সবাই জানে তাই নতুন করে আলোচনায় গেলাম না ।

উপরে আলোচিত সমাজব্যবস্থা এবং এর থেকে উদ্ভুত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আলোকপাত এইকারণেই করা হয়েছে যাতে আমরা সমাজে নারীদের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারি । কাব্যিক প্রেম বা স্বর্গীয় প্রেমের উৎপত্তি অনেক পরের ঘটনা । পাশ্চাত্যে ভিক্টোরিয়ান যুগে শুরু হয় এর অগ্রযাত্রা । দান্তে, পের্ত্রাক, শেকসপিয়ার, শেলী প্রভৃতি কবিরা ছিলেন এই যাত্রার অগ্রদূত । এইযুগে নারী সান্নিধ্য পাওয়া ছিলো কষ্টসাধ্য আর মূলত সেই কারণে কাব্যিক প্রেমের জন্ম । বিচিত্র ভালোবাসার এই রূপটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য । গনিকাদের সাথে অর্থনৈতিক যৌনতার চেয়ে প্রেমময় যৌনতা শ্রেয় ; আমার এই প্রস্তাবে বোধকরি অধিকাংশ মানুষই একমত হবে । আমাদের সমাজে এখনো কাব্যিক ভালোবাসার বিস্মৃতি চলছে । এই ভালোবাসার অনুভূতি পুরুষের একচেটিয়া । কারন যথারীতি নারীরা এখনো বন্দি আর ভালোবাসার স্বরূপ তাদের কাছে স্বার্থ দ্বারা নির্ধারিত যদিও সমাজের অভিজাত স্তরগুলোতে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করে । কিন্তু আমার আলোচনার বিষয় তারা নয় কারণ তারা সংখ্যালঘু এবং সমাজের প্রধান কাঠামো তাদের উপর নির্ভরশীল না । নারীরা জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নেয় সেই পুরুষকে যে তাকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারবে কিন্তু পুরুষদের প্রথম পছন্দ অনন্তযৌবনা অধিক সন্তান ধারণক্ষম নারী । বিচিত্র ভালোবাসার ক্ষেত্র তাই চিন্তায় এবং বাস্তবতায় সম্পূর্ন আলাদা । বিচিত্র ভালোবাসাতে নিঃস্বার্থ প্রেমময় জীবনের আশা করা হলেও নারীরা তা কখনোই দিতে পারে না কারন তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি নেই । শহরকেন্দ্রিক জীবনে নারীরা যদিও অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করে কিন্তু তাদের সামজিক মুক্তি এখনো রহিত । তারা বাঁধা পড়ে থাকে সন্তান ও সামাজিক মূল্যবোধের বেড়াজালে । বিচিত্র ভালোবাসার এই অবাস্তব পরিণতির গভীরের কারন অনুসন্ধান করাই আমাদের একমাত্র কাম্য । প্রেমময় বা উন্নত মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুজন স্বাধীন মানুষের মধ্যে । সামাজিক ক্রীতদাসী নারীদের তাই মঙ্গলময় জীবনের বিচিত্র প্রেমময়তায় যোগ দেয়া সম্ভব হয় না । সামাজিক ব্যবস্থা আমাদের যৌন স্বাধীনতাতেও বল প্রয়োগ করে অথচ আদিম পৃথিবীর বর্বর বিবাহপ্রথার ভালোবাসাহীন যৌন জীবনকে বৈধতা দেয় । বর্তমান সময়ের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে প্রেমময় চুক্তির মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠে ; আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই সম্পর্ককে স্বাগত জানাই কারন যেখানে দৈহিক মিলনের ভিত্তি হচ্ছে সহানুভূতি ও যৌন ভালোলাগা কিন্তু কখনোই আর্থিক সম্পর্ককে নয় । যদিও সমাজের অগ্রযাত্রায় গনিকাদের ভূমিকা অস্বীকার করা সম্ভব না । আধুনিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষের পক্ষে তরুন বয়সে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন কল্যানকর নয় যদিও তার যৌন চাহিদা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে । তাই গনিকারাই তাদের একান্ত ভরসা , অনেকে হস্তমৈথুনকে বিকল্প পথ বললেও আমি তার সাথে একমত নই কারন হস্তমৈথুন যেমন না পারে পরিপূর্ন তৃপ্তি দিতে তেমনি এটা অনেক ক্ষেত্রে মানসিক বিকৃতিও ঘটায় । যদিও পতিতালয়ে গমন করাও স্বাস্থ্যকর নয় । তাই আমাদের সামনে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা । স্বাভাবিক বাংলাদেশী মানসিকতার লোকদের জন্য আমার এই কথাগুলো কিছুটা বিরক্তির উদ্ধেগ ঘটাতে পারে , তাই তাদেরকে স্ব-উদ্যোগে আমাকে আনফ্রেন্ড করার অনুরোধ রইলো । নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ আমাদের যৌন বিকৃতি থেকে মু্ক্তি দিবে এই ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত কারন আমি এদেশের রক্ষণশীল মানুষদের দেখেছি শাড়ি পরিহিত সুন্দরী রমনী দেখলে কাম যাতনায় উদ্ধুক্ত হতে যদিও কোনো স্বাধীন যৌন জীবন-যাপন করা লোকের ঐ ঘটনা ঘটে না । আমাদের তরুণ প্রজন্ম খুব বেশি পরিমান কামুক শুধুমাত্র যৌন জ্ঞানের ও সঙ্গীর অভাবে । যৌন জ্ঞান যেন এক নিষিদ্ধ শাস্ত্র । শিশুদের ছোটবেলা থেকেই যৌনতা বিষয়ক যে কোনো কিছু থেকে দূরে থাকতে শিখানো হয় । ফলশ্রুতিতে যৌন জ্ঞানের স্বরলিপি হিসাবে কিশোর বয়সে হাতে চলে আসে রসময় গুপ্তের চটি সাহিত্য । বিকৃত মানসিকতার শুরু এভাবেই আর এটি পরিপূর্ণতা পায় যৌনতার উপর সামাজিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে । প্রেমময় জীবনের আগেই শুরু হয় ইভটিজিং অর্থ্যাৎ আমরা বিপরীত লিঙ্গের মানুষটাকে সম্মান করতেই ভুলে যাই । তারপরও যখন আমাদের জীবনে বিচিত্র ভালোবাসা প্রবেশ করে তখন আমরা সঙ্গীনি মাঝে খুঁজে পাইনা আমাদের ভালোবাসার প্রকৃত স্বরূপ কারন সামজিক উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা নারী কখনোই পারে না পুরুষের যোগ্য সঙ্গী হতে পারে না তাই ভালোবাসা এখানে বিরল । মঙ্গলময় জীবন বা প্রেমময় জীবনে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মূলভিত্তি বা উদ্দেশ্য হবে অভিন্ন, যা আমাদের সমাজে অনুপস্থিত । পুরুষের একচেটিয়া স্বেচ্ছাচারিতাও মঙ্গলময় জীবনের জন্য বড় প্রতিবন্ধক । এই পঁচাগলা সমাজব্যবস্থায় নারীর উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করার ইচ্ছা প্রতিটি পুরুষের কাম্য । সামরিক আইন দিয়ে দেশ পরিচালনা হয়ত করা যায় কিন্তু কারো হৃদয় পরিচালনা করা যায় না । আমাদের পুরুষরা অবশ্য হৃদয়ের ধার-ধারে না, দৈহিক প্রাপ্তিই তাদের সর্বোচ্চ চাহিদা ।

আলোচনার এই পর্বে আমরা দেখব যে যৌন নৈতিকতার উৎপত্তি ও তার নিরর্থক অস্তিত্ব । যৌন জ্ঞানের অভাবে আমাদের ভিতর সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা ঘটে তা হলো যৌন ভীতি । আর যৌনভীতির কারণেই উৎপত্তি হয়েছে আধাত্মবাদ বা ভাববাদের মত মহান দর্শন । মধ্যযুগের ধর্মগুলো আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে যৌনতা এক অপবিত্র মনবাসনা আর এটা থেকে রক্ষা পাওয়াটাই আত্মার শুদ্ধতা লাভের একমাত্র পথ । সন্যাসজীবন লাভের আশা এভাবেই মানবকূলে জন্ম নিয়েছে । গৃহত্যাগী অনেক ধর্মপ্রচারক, সন্যাসী, মহাপুরুষ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল । যদিও বিভিন্নকালে এসকল মহামানবদের ব্যভিচারের রটনা শোনা গেছে । আমেরিকার ক্যাথলিক চার্চগুলোতে শিশুকামী , সমকামীতার অভিযোগ খুবই নিকটবর্তী অতীতের ঘটনা । ভাববাদী দার্শনিক বা ধর্মগুরুরা বিশ্বাস করেন যে সব কিছু অস্তিত্ব আসলে ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি । যদিও আমি এই নোটে সেই আলোচনাতে যাবো না তবুও তাদের দর্শনকে উপস্থাপন করা আমার দায়িত্ব কারন আমি তাদের বিরোধিতা করবো না কিন্তু আমি যে দর্শন উপস্থাপন করবো তা অন্য একটি রূপায়ন নির্ভর বাস্তবতার পরিচয় দিবে যেটা চিন্তাজগৎ এর ক্ষেত্রে ভাববাদী দর্শনকে খারিজ করে দিবে । ভাববাদী দর্শন হচ্ছে সেই দর্শন যেখানে সমস্ত সৃষ্টি জগৎকে মনে করা হয় ঈশ্বরের কল্পনা । বস্তুর অস্তিত্ব বলতে আমরা স্বাভাবিকভাবে যা বুঝি তা এখানে অস্বীকার করা হয় । ধরা হয় যে সকল বস্তুর অস্তিত্ব আসলে মনের ভিতরে । যেমন: আমরা যখন একটা ঘরে একটা টেবিল দেখি তা মূলত আমাদের মনের অর্ন্তগত কল্পনা । যখনই আমরা সেই কক্ষ থেকে বের হয়ে যাই তখনই আমাদের সাথে সাথে সেই টেবিলটাও উধাও হয়ে যায় । কট্টর বস্তুবাদীরা হয়ত এই সকল ধারনার তীব্রবিরোধিতা করবেন কিন্তু আমি ভাববাদী দর্শনের আলোচনা এই জন্য করেছি কারন সকল ধর্মগুলোর উৎপত্তি এই দর্শনকে কেন্দ্র করে; যদিও ধর্মগুলোর আধুনিকায়নের ফলে বস্তুবাদকে স্বীকার করা হয় মূল ভাববাদী দর্শনকে অক্ষূন্ন রেখে ; আর যখনই বস্তুবাদ সীমা অতিক্রম করতে নেয় তখন ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে প্রশ্নবানকে রোহিত করা হয় এবং সেই সকল প্রশ্নকে করা হয় নিষিদ্ধ । ভাববাদী দর্শনের প্রভাবে আত্মার বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয় আর তাই যৌনতা কেবল নারকীয় পাপকর্ম বলেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে । তাই সকল নৈতিকতা তৈরি হয়েছে স্বাধীন যৌন জীবনের বিরুদ্ধচারণ করে । যেহেতু নীতিবাগীশরা সবাই পুরুষ তাই নারী আবারো কামনার বস্তু এবং নিষিদ্ধ পণ্য । তাই নারীর স্বাধীন জীবন-যাপনের উপর নেমে এসেছে শৃংখলের বন্ধন । সুপ্রাচীনকালে যদি নারীরা সামাজিক উৎপাদনে পিছিয়ে না পড়ত তাহলে হয়ত উল্টা ঘটনা ঘটতে পারত । তখন নারীরা হত নীতিনির্ধারক এবং আমরা হিজাব পরিধান করে যাতায়াত করতাম । সে যাই হোক, একটা জিনিস পরিস্কার বর্তমানে প্রচলিত যৌন নৈতিকতার উদ্ভব হচ্ছে ভাববাদী দর্শন থেকে যা বাস্তবায়নের মহান দায়িত্ব ধর্মগুলোর কাঁধে ।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মত যৌনতাও মানবজীবনের একটা মৌলিক চাহিদা । শ্রদ্ধেয় রাসেলের মতে- আমরা সেইসব মানুষকে যৌনবিষাদের পথিক মনে করতে পারি না যারা কোনো চঞ্চলা বারবধূর ভ্রুকটিতে উত্তেজিত হয়, এই আদিম ব্যবসাকে আইনের আশ্রয়ে আনতে চায়, অবাধ ও সুন্দর বহির্বৈবাহিক সর্ম্পকে জয়গান করে, মিনিস্কার্ট পরা এবং রন্জ্ঞনীতে লালিমাদীপ্ত ওষ্ঠের অধিকারিণী রমনীদের অনুরাগী হয়, আর সমূদ্রের সৈকতে বিশ্রামরতা রৌদ্রস্নাতা অসংযমী নারীদের সংক্ষিপ্ত স্নান-পোষাকের অন্তরালে জেগে থাকা ত্রিভঙ্গ শরীরের সুষমা দর্শনে মেলে ধরে তাদের গোয়েন্দা চোখ। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করলে এই সত্যকে স্বীকার করতে হবে যে, খাদ্য ও পানীয়ের আকাঙ্ক্ষার মতো যৌনতাও একটি স্বাভাবিক চাহিদা, যা অপ্রযুক্তিতে অসম্ভব বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং প্রশ্নমতে সাময়িকভাবে হ্রাস প্রাপ্ত হয়ে থাকে। যখন এর চাহিদা প্রবল হয় তখন রুদ্ধ হয় চেতনার সবকটি বাতায়ন। এবার আমরা শরীরবৃত্তিয় আলোচনাতে যাই । যৌনতা প্রতিটি উন্নত প্রজাতির জীবের বংশবিস্তারের মাধ্যম । মানব জীবনের বয়সন্ধিকাল পার হবার পরে একজন সুস্থ পুরুষের শরীরে প্রতি সেকেন্ডে ১০ লক্ষ শুক্রানু উৎপন্ন হয় । যৌনসঙ্গম রোহিত করা হলে এই সকল শুক্রানুর নির্গমনের জন্য দুটি পথ খোলা , একটি হচ্ছে হস্তমৈথুন আর অন্যটি স্বপ্নদোষ । মজার ব্যাপার হচ্ছে ধর্মীয় নীতিবাগীশরা এই পথগুলোকেও পাপকার্য হিসাবে গণ্য করে । এই নোটের শুরুতেই আমি বলেছি যে প্রচলিত যৌন নৈতিকতার নিরর্থক অস্তিত্বের কথা । আমরা দেখেছি যে বর্তমান যৌন নৈতিকতার প্রসুতি হচ্ছে ভাববাদ আর এখন দেখব তার পতন বা মিথ্যা অস্তিত্বের প্রমান । আমি অনেক ধার্মিক তথা রক্ষণশীল পরিবারের ছেলেকে চিনি যারা যৌন সংগমকে পাপ মনে করে কিন্তু পর্ণোমুভি দেখে হস্তমৈথুনকে নীরব সম্মতি জ্ঞাপন করে । বলা হয় যে, এদেশের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু মহাখালীর বা বনানীর রাস্তায় গেলে তার চাক্ষূস প্রমান মেলে । ৮০% মুসলিমের এই দেশে কি ২০% হিন্দুরা ঐসব হোটেল ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে নাকি ৮০% মুসলমান রমনা বা ধানমন্ডি লেককে প্রাণবন্ত করে তুলেছে ? মাদ্রাসার ছাত্রদের সমকামীতার খবর সচেতনভাবেই গোপন করা হয় আর সমগ্র দোষের অংশীদার করা হয় আজাজিল নামক একজন অভিশপ্ত ফেরেশতাকে । আমাদের যৌন নৈতিকতা কোনোভাবেই সহজাত প্রবৃত্তির সাথে সংগতিপূর্ণ নয় আর সেই কারনেই এত বিড়ম্বনা । তাই এই নৈতিকতার পরিবর্তন করা আবশ্যক ।

• নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ককে বাধা দিলেই আসবে যৌন বিকৃতি । পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের প্রতি ক্লান্ত হয়ে পড়লে তারা রক্ষিতার সন্ধান করে আর এক্ষেত্রে তারা হয়ে ওঠে স্পর্শকাতর । বিচিত্র ভালোবাসার এই স্বরূপটি বোঝা কষ্টসাধ্য কিন্তু একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই ।

বিবাহ পরবর্তী দীর্ঘসময়ে পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের প্রতি ক্লান্ত হয়ে পড়ে বা বলা যায় যে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে । উল্টো ঘটনাও ঘটে তবে সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক নারীরা এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয় । এই যৌন ক্লান্তি কারণ হচ্ছে নগর জীবনে নারী-পুরুষের সহজাত কামপ্রবৃত্তি যা আমরা ধর্মীয় ধ্বজভাঙ্গা নিয়ম বা নৈতিকতা দিয়ে রোহিত করতে চাই কিন্তু সবকিছু ভেংগে পড়ে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির কাছে । নাগরিক সভ্যতায় মানুষ শুধুমাত্র বৈবাহিক যৌনতা দ্বারা তৃপ্ত থাকবে তা আশা করা যায় না । যৌনতা চিরকালীন বাধা-বিপত্তি মুক্ত মানবিক আচরণ । প্রেমময়তা বা কাব্যিক ভালোবাসা হচ্ছে যৌনতা দ্বারা উদ্ভুত অনুভূতি ; যৌনতাকে শৃংখলাবদ্ধ করা তাই বোকামী । তাই সমাজে ব্যভিচার এবং পরকীয়া নামক অস্বীকৃত প্রেমের অস্তিত্ব বর্তমান । ব্যভিচার বা পরকীয়ায় সমস্যা হচ্ছে যে- এই প্রেমগুলো বর্তমান ধ্বজভাঙ্গা নৈতিকতার শৃংখলায় আবদ্ধ থাকা মানবিক প্রেমময়তার প্রতিনিধিত্ব করে যা বর্তমান আইন দ্বারা নিষিদ্ধ এবং সামাজিকভাবে যার স্বীকৃতি দেয়া কষ্টকর । বৈবাহিক সম্পর্ক হয়ত ক্ষণকালীন অঙ্গীকার রক্ষায় সাহায্য করে কিন্তু তা কখনোই চিরকালীন না কারণ তা মানব প্রবৃত্তির বিরুদ্ধ । তাই অদূর ভবিষ্যতে আধুনিক সমাজব্যবস্থায় বিবাহ নামক কোনো প্রতিষ্ঠান থাকবে বলে আমার মনে হয় না । উপরের আলোচনাতে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি যে বিবাহ কতটা ঠুনকো বলপূর্বক পদ্ধতি যা বরাবর তার মিথ্যা আদর্শ নিয়ে সমাজে বিরাজ করে । নারীরা যখনই সমাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করবে বা রাষ্ঠ্র যখন সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে নিবে তখনই বিবাহ নামক আদিম প্রথাটির বিলুপ্তি ঘটবে । এতে করে পিতৃত্বের ভূমিকা অনেকখানি কমে যাবে এবং নারীদের যৌনতার ক্ষেত্রে চলে আসতে পারে স্বাধীনতা । সন্তানের পরিচয় তখন নিরূপণ হবে মায়ের দ্বারা এবং পিতৃপরিচয় হতে পারে অপ্রয়োজনীয় বা নামমাত্র ।

o সেটা অনেক পরবর্তী ঘটনা , আমরা এবার আমাদের সভ্যতার বিচারে আসি । আমাদের শিশুদের যৌনজ্ঞান দেয়া হয় না কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের কৌতুহল চিরকালীন । ইন্টারনেট বা মুঠোফোনের মাধ্যমে পর্ণমুভির বিস্তার এখন সর্বত্র । আমরা শিশুদের যৌনজ্ঞান দিতে ব্যর্থ হই অথচ বয়সন্ধির সময় যা খুবই প্রয়োজনীয় । ইদানিং সময়ে যৌনাপরাধের মাত্রা বেড়ে গেছে যার জন্য দায়ী করা হয় অপসংস্কৃতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়কে । আমি এই ব্যাপারে একমত নই । প্রযুক্তির অগ্রগতিতে যৌনতা বৃদ্ধি পায় নাই বরং অবচেতন মনের আকাঙ্ক্ষা তার চাহিদা মেটানোর জন্য সহজতর পথ খুঁজে পেয়েছে । এতে করে যৌনতা নতুন মাত্রায় বিকৃতি অর্জন করেছে যাকে আমরা বলতে পারি ডিজিটাল বিকৃতি ; মোবাইল সেক্স তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ । বুদ্ধিমান পাঠকদের এতক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা যে – এই নোটের আদি হতে এখন পর্যন্ত আমি অবাধ যৌনতার জয়গান গেয়েছি । আমাদের তরুণ সমাজ বা কিশোরদের জন্যও এর ব্যতিক্রম আমি চিন্তা করি না । অবাধ যৌনতার সবচেয়ে বড় এবং প্রধান সমস্যা ছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের জন্ম কিন্তু সেটা ছিলো মধ্যযুগীয় সমাজের সমস্যা । জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি বা কনডমের ব্যবহারে আমরা খুব সহজেই এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে পারি । দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে পরিবার নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পতন বা সন্তান লালন-পালনে অভিভাবকের অভাব হওয়ার সম্ভাবনা । এটা মূলত বাঙালি মানসিকতার সীমাবদ্ধতা কারণ আমাদের মায়েরা সন্তানকে আঁচলে বেঁধে রাখতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে কিন্তু যা শিশুর মানসিক বিকাশের অন্তরায় । সন্তানের জন্মদাতা বাবা-মা অবশ্যই তাদের দায়িত্ব পালন করবে সহজাত ভালোবাসার দ্বারা বা রাষ্ঠ্রীয় আইনের অনুশাসনে । এখানে আমার মনে হয় না যে রাষ্ঠ্রীয় আইনের প্রয়োজন হবে কারণ বিবাহ নামক কোনো মিথ্যা আশ্বাস বা সমাজে অবৈধ শিশু বলে কোনো অযৌক্তিক নৈতিকতা না থাকলে নারীরা স্বাধীনভাবে তাদের সন্তানের পিতা নির্ধারণ করতে পারবে যে শুধু তার পিতৃত্বের দায়িত্বই নিবে না ভালোবাসার দায়িত্বও নিবে । অবৈধ সন্তান নামক চিন্তাধারা অনেক অংশে পুরুষকে দায়িত্বহীন করে তোলে কারণ সে গর্ভধারণ করে না তাই ঐ সন্তানের সকল দায়িত্ব আরোপিত হয় সন্তানের জননীর উপর ।

o তাই আমাদের তরুণ সামাজকে আমরা খুব সহজেই যৌন বিকৃতি থেকে রক্ষা করতে পারি যৌন স্বাধীনতা দিয়ে । এতে কোনো রকম মারাত্মক সমস্যা যেমন হবে না তেমনি এই বিবাহবিহীন সমাজ ব্যবস্থা নারী-পুরুষের মধ্যে এমন একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক স্থাপন করবে যা সুদৃঢ় অন্তরঙ্গতা এবং শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক বন্ধন গড়ে তুলবে । এই প্রেম হলো অভিপ্রেত ও দুর্লভ এবং এর অন্তরালে আছে এক স্বকীয় নৈতিকতা ও ঐচ্ছিক আত্মনিবেদন ; যার অবর্তমানে প্রেম তার স্বাভাবিক গ্রহনযোগ্যতা হারিয়ে পরিণত হয় আবেগশূন্য অনুভূতিতে কারণ এই স্বকীয় নৈতিকতার উৎস হচ্ছে সহজাত প্রবৃত্তি । আর এটিই হয়ত দিবে মঙ্গলময় জীবন ; যে জীবন যুক্তি দ্বারা পরিচালিত এবং প্রেম দ্বারা উদ্ভাসিত ।