নবম অধ্যায়
আদনান আদনান
উৎসর্গ
মারিও ভেরগাস ইয়োসা
স্বপ্নভঙ্গের দিন
আমি জানি আমাকে নবম অধ্যায়ে খুন করা হবে।
আগামী মাসে উপন্যাসটি লেখা শেষ হবে আমার খুন হওয়ার দৃশ্যের শেষে। লেখক বর্তমানে একটা দোমনায় ভুগছেন ঠিকই, কিন্তু আমি জানি আমাকে খুন হতে হবে। উপন্যাসটি সেদিকেই এগোচ্ছে। অথচ আমার একটা সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের যে ছবি তিনি এঁকেছেন তাতে করে আমার নিজের জীবনের উপর একটা ভালোবাসা জন্মে গেছে। আমি মরতে চাইনা। কেনো মরবো? জীবনে তো পরাজয় থাকেই, কিন্তু তার মানে তো আর হাল ছাড়া নয়। হাল না ছাড়ার যে সংগ্রাম সেটাই তো জীবন!
লেখক আমার নাম রেখেছেন ফরিদ। নামটা আমার পছন্দ না। লেখকের ছোটবেলায় তার এলাকায় ফরিদ নামে একজন লম্পট ছিলেন। তার একটা ধানের মিল ছিলো। একদিন ভোর রাতে ঐ লম্পট রাত চারটার সময় তিনজন ১৬/১৭ বছর বয়স্ক মেয়েসহ ধরা পড়েন তার অফিসে। সবাই, খুব ফরিদ লম্পট ফরিদ লম্পট বলে রসালো সব আলোচনা করে কিছুদিন। আর সেই থেকেই ফরিদ নামটা লেখকের খুব পছন্দ। আমি দেখতেও বেশ খারাপ। মানে কি আর বলবো! আমাকে এতটা খারাপ দেখানোর কোন দরকার ছিলোনা, কিন্তু আমাকেও তিনি খুঁজে পেয়েছেন তার ছোটবেলার এক পাগলের চেহারায়। আমি আর কি করতে পারি? আমার বয়স ২১, কিন্তু আমার বোধশক্তি খুব ভালো। এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়েছে, কেননা জীবনে বোধশক্তির খুব প্রয়োজন।
আমি একজন উঠতি ঔপন্যাসিক। আমাকে সম্ভবত লেখক তার উঠতি সময়ের সাথে মিল রেখেই সৃষ্টি করেছেন। আমি প্রথমে কবিতা লিখতাম, কিন্তু আমি খুব দ্রুত বুঝতে পারি যে আমার দ্বারা কবিতা হবেনা, আমি কখনোই চেঝ-ল মিলোসের মতো লিখে উঠতে পারবোনা। কিন্তু আমি বুঝতে পারি আমার ভিতরের হুঙ্কার গল্পে খুব সুন্দরভাবে উঠে আসে। আমি কিছু গল্প লিখি প্রথমে, আর এখন আমার প্রথম উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। আশ্চর্যের বিষয় হলো বহ্নি আমার প্রেমে পড়ে আমার কবিতা পড়ে, আমার যে কবিতাগুলোতে আমি আর বিশ্বাস করিনা। আমি যতোটা বহ্নির প্রেমে পড়ি, তার থেকে বেশি প্রেমে পড়ি তার নামের। আমার ভিতরে ঐ নাম একটা আগুন ধরিয়ে দেয়। আমি ঐ আগুনে পুড়ে ঝরে পড়ি।
যেদিন লেখক আমাদের প্রথম চুম্বনের দৃশ্য আঁকেন, আমি সেদিনই প্রথম জানতে পারি যে তিনি তার স্ত্রীকে যৌন নির্যাতন করেন। তিনি মহিলার গুচ্ছ গুচ্ছ চুল টেনে তুলতে পছন্দ করেন। মহিলা যতো বেশি চিৎকার করেন ততই তার আরাম হয়। আশ্চর্যের কথা হলো এসবের পরে লেখক ঘরের মেঝেতে বসে কাঁদেন কিছুক্ষণ, দশ বছরের বালকের মতো। সেদিন এই রকম এক কান্নার শেষে তিনি আমার ও বহ্নির চুম্বনের দৃশ্য আঁকতে চেষ্টা করেন। তার অনেক সময় লেগে যায় দৃশ্যটি আঁকতে। দৃশ্যটি ঠিক তার মনের মতো হয়না। তিনি মনে করেন যে তার ব্যর্থতা তার অপরাধবোধের ফল। কিন্তু আসলে আমিই তাকে ঐ দৃশ্যটি আঁকতে দিইনা। আমি দিতে পারিনা। একজন শয়তান কিভাবে দেবদূত হয়ে উঠতে পারে?
ঐ দিনই আমার ইচ্ছে হয় তার স্ত্রীকে বাঁচাতে। আর তার কিছুক্ষণের ভিতরেই আমি বুঝতে পারি আমি ভদ্রমহিলার প্রেমে পড়েছি। ভদ্রমহিলার নাম তামান্না।
একান্ত এক গুহা
লেখক খুব গোপনে তার উপন্যাসের পাশাপাশি বছর দশেক ধরে “বিবর্তন ও মানুষের যৌনবিকারের ইতিহাস” নিয়ে একটি বই লিখছেন। তিনি সাতটি ভাষায় লিখতে, পড়তে, ও কথা বলতে পারেন। আর ঐ সাত ভাষায় তিনি মানুষের যৌনবিকারের উপরে যতো বই লেখা হয়েছে তা পড়েছেন। তার বইটি প্রায় শেষের পথে। আর হয়তো বছর তিনেক লাগবে। তিনি বিশেষ করে নেকরোফিলিয়া নিয়ে খুব বেশি পড়াশুনা করেছেন। তিনি একজন লেকরোফিলিককে নিয়ে উপন্যাসের একটি খসড়াও তৈরী করেছেন, যা হবে তার আগামী উপন্যাস।
আমার বিশ্বাস যে এ সব নিয়ে পড়তে পড়তে আর ভাবতে ভাবতে তার মাথা বিগড়ে গেছে। সবার ক্ষেত্রে এমন হয় তা নয়, কিন্তু তার ক্ষেত্রে এমনটিই হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি আর বাস্তব ও কল্পনার ভিতরে পার্থক্য করতে পারেননা।
আমার ভয় হয়। সে হয়তো তামান্নাকে একদিন মেরেই ফেলবে। একদিন হয়তো তার মাথাটাই ছিড়ে ফেলবে।
তামান্নাকে তার গুহার থেকে আমাকেই বের করে আনতে হবে। আনতেই হবে। আমার এই ইচ্ছেটা আরো প্রবল হয়ে ওঠে যেদিন আমি জানতে পারি বহ্নি এতো টাকা পায় কোথার থেকে। লেখক মনে করেন আমি জানিনা, কিন্তু আমি জানি। একজন প্রেমিক প্রয়োজনের থেকেও অনেক বেশি কিছু জানে। তাকে জানতে হয়।
একজন নারী
প্রথমে আমার খুব রাগ হয় তামান্নার উপর। কেনো সে এ সব সহ্য করে! আমি বুঝে উঠতে পারিনা। কিন্তু আমি আমার চোখ-কান খোলা রাখি। আমি এক সময় জানতে পারি যে তামান্নার কেউ নেই। সে বাদে তার মায়ের পরিবারের আটজন একটা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায় তারই বাড়ির থেকে ফেরার পথে বছর পনেরো আগে। তাছাড়া তারা প্রেম করেই বিয়ে করেছিলো। একদিন তিনি লেখকটিকে ভালোবাসতেন। আচ্ছা মানুষ প্রেমে পড়ার পরে আবার বিয়ে করে কেনো? আমি বুঝতে পারিনা। তার উপর আমার মায়া হয়। কিন্তু আমি তাকে তা বলতে চাইনা। আমি তাকে বাঁচাতে চাই কারন আমি তাকে ভালোবাসি। আমি কি তাকে সত্যিই ভালোবাসি? আমি তো উপন্যাসের নায়ক, আমি বাস্তব জীবনের ভালোবাসার কি বুঝি?
আমি কি তাকে সুখি করতে পারবো? আমার বয়স ২১। তার বয়স ৩৭। আমি থাকি আমেরিকায়। সে থাকে বাঙলাদেশে। বাঙলাদেশে কি আমাদের সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য হবে? সে কি আমাকে ভালোবাসবে? কেনো বাসবে? সে কি আমার কথা জানে? আমাকে দেখে সে কি ভয় পাবেনা? একজন বাস্তব নায়িকা ও একজন উপন্যাসের নায়কের জীবন কেমন হতে পারে? তাদের ভিতরের সম্পর্কটিও বা কেমন? আমি কি একজন মানুষের দ্বায়িত্ব পালন করতে পারবো? একজন মানুষ, তামান্নার স্বামী বা আমার সৃষ্টিকর্তা, কি মানুষের দ্বায়িত্ব পালন করতে পারে? পৃথিবীতে এমন কোনো নারী আছে যে তার নিজের জীবন যাপন করতে পেরেছে বা করছে? আমি কি তামান্নাকে দিতে পারবো তার নিজের মতো একটা জীবন? আমি কে? আমি কেনো তাকে তার নিজের মতো একটা জীবন দেবো? সে কেনো আমার উপর নির্ভরশীল হবে? আমিই বা কেনো ভাবছি যে আমিই তার একমাত্র ত্রাতা?
একজন নারী একজন মানুষ।
একজন নারী একজন স্বাপ্নিক।
একজন নারী এক মহাহুঙ্কার।
ছুটন্ত সময়
আমার হাতে সময় নেই বললেই চলে। লেখক আমাকে নিয়ে তার কাহিনি সৃষ্টি করেছেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার মারিপোসা শহরে। আর তিনি থাকেন বাঙলাদেশে। তার যৌবনে তিনি একবার এসেছিলেন আমেরিকায়, আর তিনি এই মারিপোসা শহরে তিনদিন ছিলেন। আমার জন্ম আমেরিকায়। আমি বাঙলা জানি, কিন্তু বাঙলাদেশের জীবন সম্পর্কে আমার ধারণা খুব কম। অথচ আমাকে বাঙলাদেশে যেতে হবে তামান্নাকে বাঁচাতে হলে। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? আমি তো এখনও জানিনা কিভাবে আমি উপন্যাসের পাতা থেকে বাস্তবে উঠে আসবো। আমাকে একটা পাসপোর্ট বানাতে হবে। আমাকে ভিসা নিতে হবে। আমার হাতে কি এতো সময় আছে? আর মাত্র তিন কি চার সপ্তাহ পরেই আমি খুন হবো। কিন্তু আমি কি পারবো তার আগে বাঙলাদেশে, যশোরে, পৌঁছাতে?
সময়। জীবন। মৃত্যু।
একচিলতে কথপকথন
“তোমার উচিৎ এবার একটা রাজনৈতিক উপন্যাস লেখা।”
“না এখনই তা সম্ভব না।”
“কেনো?”
“রাজনৈতিক উপন্যাস লিখতে গেলে যে ধরণের রসবোধ এসে যাবে তা বাঙালি এখনো সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যে সব কান্ড করেন তা নিয়ে শুধুমাত্র একটা হাসির উপন্যাস-ই লেখা সম্ভব। কিন্তু উপন্যাসটি কেনো হাসির তা এখনো বাঙালি বুঝে উঠতে পারবেনা। তার জন্য আমাদের আরো বেশকিছু সময় পার করতে হবে।”
“কিন্তু লেখকের দায়িত্ব তো লেখা। নতুন সীমানা নির্ধারন করা। আর না লিখলে বাঙালি সেই ক্ষমতা অর্জন করবে কিভাবে?”
“একদিন হয়তো লিখবো, কিন্তু এখনই না। তাছাড়া আমার আজ আসার কারণ কিন্তু আমার বর্তমান উপন্যাসটি নিয়ে কিছু কথা বলা।”
“কবে শেষ হচ্ছে?”
“সপ্তাহ তিনেক আরো লাগবেই।”
“আপনি তো কাজের শেষ না হলে কিছুই বলেননা। তারপরও জানতে ইচ্ছে করছে উপন্যাসটি সম্পর্কে।”
“আমি শেষ নিয়ে বেশ সন্দেহে আছি।”
“আপনি? আমি বিশ্বাস করিনা। আপনার শেষ-ই তো সব। আপনি তো আপানার শেষের জন্য বিখ্যাত!”
“উপন্যাসের নায়িকা একটা মাদক চোরাচালানি গ্রুপের সাথে জড়িত। নায়ক একজন উঠতি লেখক, এবং সে নায়িকার ব্যাপারটা জানেনা। এক পর্যায়ে ঐ চোরাচালানি গ্রুপের একজন নায়িকার প্রেমে পড়ে যায়। নায়ক-নায়িকার দেখা হয় মাসে ২/৩ দিন। আর কিছুদিন ধরে নায়িকা খুব ব্যস্ত তার সেলসের কাজ নিয়ে। আবার এদিকে নায়ক হঠাৎ করেই প্রেমে পড়ে যায় লেখকের স্ত্রীর। লেখক স্ত্রীকে প্রচন্ডভাবে যৌন নির্যাতন করে। নায়ক, বাস্তবে উঠে এসে লেখকের স্ত্রীকে বাঁচাতে চায়। এমন একটা পর্যায়ে নায়িকার প্রেমে পড়া ছেলেটা নায়ককে খুন করে। প্রশ্ন হলোঃ – আমি কি নায়কের স্বপ্ন পূরণ করবো, নাকি যেভাবে শেষ করেছি সেটাই ঠিক আছে?”
“দারূণ! দারুণ! তবে তাকে বাস্তবে আসতে দিন। তাকে বাস্তবে আসতে দিন। এতে করে উপন্যাসটা সবকিছু কাঁপিয়ে দেবে। আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে এমন আর কোনো লেখা পাইনি। আপনি ৫/৭ বছর ধরে এক একটা উপন্যাস লেখেন ঠিকই, কিন্তু আপনি যা করছেন তা আপনাকে অমর করে রাখবে।”
“আমি অমর হতে চাইনা।”
“কিন্তু আপনি হবেন। আর শুনুন, আপনি কাহিনির শেষটা পাল্টিয়ে ফেলুন।”
“ভাবছি। দেখি শেষ পর্যন্ত কি হয়। একটা হাহাকারের ভিতর দিয়ে শেষ হলেই বেশ হবে বলে মনে করছি। আপনি ছাপানোর কাজ শুরু করে দেন। প্রচ্ছদের উপরে একটা মরা কাক ও তার ছায়া থাকতে হবে। উপন্যাসের নাম নবম অধ্যায়।”
“আগামী সপ্তাহেই আমি কিছু ডিজাইন পাঠিয়ে দেবো। মানে আমি নিজেই আপনার ওখানে আসবো।”
“ধন্যবাদ। আগামী সপ্তাহে দেখা হচ্ছে তাহলে!”
“অবশ্যই। আমি বাকি অর্ধেক, পঁচিশ লাখ, নিয়ে আসবো।”
“ধন্যবাদ।”
আমার জন্ম
তখন লেখকের বয়স ১১। একদিন যশোরের পাবলিক লাইব্রেরিতে সে একটা ছবিতে একটা বাঘের ছবি দেখে। সে মনে মনে কল্পনা করে যদি এই বাঘটি বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে টেবিলের উপর লাফ মেরে উঠে তবে কেমন হবে? সে কি ভয় পাবে? টেবিলে বসে থাকা অন্য পাঠকেরাও কি ভয় পাবে? যদি বইয়ের থেকে একটা মানুষ বেরিয়ে আসে? সে খুব মজা পায় ঐ চিন্তাটা নিয়ে ভাবতে। চোখের সামনে দেখতে পায় বাস্তব জগতে বইয়ের জগত।
তারপরের থেকেই আমি ধিরে ধিরে তার ভিতরে সৃষ্টি হতে থাকি। লেখকের যখন ৩৯ বছর বয়স তখন সে আমাকে নিয়ে উপন্যাসটা লিখতে শুরু করে। তারই জীবনের অনেক ক্ষুদ্র ঘটনার সমন্বয়ে আমার সৃষ্টি। আমি ৯০ ভাগ বাস্তব আর বাকিটা কল্পনা। আমি বাস্তবের থেকে খুব বেশি দূরের নই। বরং অনেক ক্ষেত্রে আমার জীবন যেহেতু উপন্যাসে দ্রুত গড়িয়ে গেছে, সেহেতু আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।
অন্য সব কিছুর মতো আমার জন্মও ছিলো অবধারিত, যদিও লেগে যায় তিন দশক।
আমার দ্বিতীয় জন্ম
গতরাতে মদ খেয়ে পড়ে ছিলেন আমার স্রষ্টা। সারারাত কিছুই লেখেননি। খুব ভোরে নিজের মুখে স্যান্ডেল দিয়ে নিজেই কষে বাড়ি মারেন কয়েকবার, না লিখতে পারার জন্য। সে যখন বাথরুমে যায় আমার মনে পড়ে যে আমি এখনো তার মগজেই আছি। বরং উপন্যাসের থেকে আরো পূর্ণাঙ্গভাবেই আছি। বাস্তবের মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত, কিন্তু উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অনেক কিছুই অনেক বেশি করে পায়। আবার লেখক উপন্যাসে একটা চরিত্র যেভাবে আঁকেন তাতে করে ঐ চরিত্রের সবকিছু ঠিক মতো ফুটে ওঠেনা। চরিত্রের পূর্ণাঙ্গরুপটি লেখকের মগজেই থেকে যায়, কেননা লেখার সময় অনেক কিছুই বাদ পড়ে যায়।
উপন্যাসের পাতা থেকে নয়, আমি বুঝতের পারি আমাকে বেরিয়ে আসতে হবে লেখকের মগজ থেকেই। তাহলে আমার আবির্ভাব হবে যশোরেই, লেখকের বাড়িতেই, তামান্নার খুব কাছাকাছি।
আমি আনন্দে চিৎকার করতে থাকি, কিন্তু আমার চিৎকার কেউ শুন্তে পায়না।
যশোর, যশোর
তখন রাত চারটা। লেখক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি তার মগজ থেকে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু আমি হাটতে পারিনা, বা ঠিকমতো নড়তে পারিনা। উপন্যাসে আমি ওজনহীন, বাস্তবে আমি পাথরের মতো ভারী। আমার নিজের শরীরের দখল নিতে অনেকক্ষণ লেগে যাই। প্রথমে আমি থাকি ছায়া ছায়া। যত-ই বাইরে আলো বাড়তে থাকে আমার শরীর ততই ভেসে উঠতে থাকে। আমার যশোর শহরটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করে। আমার ইচ্ছে হয়না তামান্নার সাথে দেখা করতে এমনভাবে যেন সে ভয় পেয়ে যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিই আমার ইশ্বর বাড়ির থেকে বের হওয়ার পরই আমি তামান্নার সাথে দেখা করবো।
আমি বের হয়ে পড়ি। আমি অবাক হই। এই প্রথম আমি দেখছি সেই শহর যে শহরে আমার জন্ম। আমার আমেরিকার জীবনটাকে অনেক দূরের বলে মনে হতে থাকে। আমার মনে পড়ে আমার আমেরিকার জীবন অন্য একজনের কল্পনা মাত্র। আমার হাসি পাই। শহরে অনেক মানুষ, অনেক কাক, অনেক কুকুর। সাইকেলে, রিকশায়, আর পায়ে হেটে চলা মানুষের সংখ্যাই বেশি। আমি পুরাতন কসবা থেকে হেটে মণীহার সিনেমা হল পর্যন্ত যাই। সকালটা বেশ সুভ্র। সবাই দিনটি শুরু করা নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমিও। আমি যা দেখি তাতেই অবাক হই। আমি বুঝতে পারি আমাকে যারা দেখছে তারাও অবাক হচ্ছে। আমি এক দোকানের আইনায় দেখতে পারি যে আমার কোনো ভ্রু নেই। লেখক আমার ভ্রু সৃষ্টি করতে ভুলে গেছেন। আমার খারাপ লাগে। কিন্তু কিছুই করার নেই। অনেকেই অনেক কিছু জীবনে পায়না। বেলা দশটার দিকে আমি বাড়িতে ফিরি। দরজার বেল বাজাতেই তামান্না দরজা খোলে। আমি তাকে দেখে ধাক্কা খাই। লেখকের মগজে তাকে যেমন দেখা যায়, সে তার থেকেও শতগুণ বেশি সুন্দর। কিন্তু তার মাথায় একটা কাপড় বাঁধা। ওটা দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে যাই।
“কেমন আছেন?”
“আপনি কে?”
“ফরিদ।”
“সে তো বাসায় নেই।”
“আমি আপনার সাথেই দেখা করতে এসেছি।”
“আমার সাথে? আমি আপনাকে চিনিনা।”
“চেনেন। আমি আমার পরিচয় দিলেই চিনতে পারবেন। আমি কি ভিতরে আসতে পারি?”
“না। আমি আপনাকে চিনিনা। যা বলার এখানেই বলুন।”
“আমি ফরিদ। সাজ্জাদ সাহেবের উপন্যাসের নায়ক। এখন চিনতে পারছেন আমাকে?”
“ফাজলামোর একটা শেষ আছে।”
“আপনি কি আমাকে দেখে বুঝতে পারছেন না যে আমি বাস্তবের না? না মানে আমি এখন বাস্তবে আছি, কিন্তু আমি আসলে কাল্পনিক। আজ ভোরেই আমার জন্ম হয়েছে বাস্তবে।”
“আপনি যেতে পারেন। আমি সাজ্জাদের অনেক ভক্ত দেখেছি, কিন্তু আপনার মতো উন্মাদ আমি দেখিনি কোনোদিন।”
“আমার ভ্রু দেখুন। নেই! তিনি ভুলে গেছেন। আমি আপনার বাড়ির সবকিছু জানি, কি কোথায় আছে। উনার পড়ার ঘরেই আমার জন্ম হয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করুণ, আমি সব ঠিক ঠাক বলতে পারবো। আমি শহর দেখতে গিয়েছিলাম। দারূণ শহর!”
“আপনি যেতে পারেন এখন।”
“আপনি অনেক রাত তার মৃত্যু কামনা করে কাটিয়েছেন।”
“আপনি ভিতরে আসুন।”
তামান্না দরজা বন্ধ করেন। আমরা প্রথম ঘরেই বসি।
“তার উপন্যাস সম্পর্কে বলুন।”
“আপনি তো জানেনই! আপনি তো প্রায়ই তার লেখা পড়েন চুরি করে।”
“আপনি কিভাবে জানেন?”
“আমি ফরিদ! আমি তো জানবোই।”
“দেখুনতো আমি উপন্যাসে যেভাবে লেখা হয়েছে ঠিক সেই রকম দেখতে কিনা?”
“আশ্চর্য! এতো মিল?”
“মিল না। আমিই সেই নায়ক, আমিই ফরিদ।”
“কিন্তু আপনি যা বলছেন, তা তো অসম্ভব!”
“অথচ আমি আপনার সামনেই বসে আছি।”
“বলুন উপন্যাসটির কাহিনি।”
“আপনি যতবার পড়েছেন চেয়েছেন নায়ক ঔপন্যাসিকের স্ত্রীকে রক্ষা করুক। চাননি?”
“চেয়েছি?”
“আমি এসেছি আপনাকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে।”
“আমি তো এই শহর ছেড়ে যাবোনা। আমার জীবন শুধু এখানেই সম্ভব।”
“কিন্তু তার থেকে আপনাকে দূরে যেতেই হবে। সে আপনাকে মেরে ফেলবে একদিন। আমি জানি তার নির্যাতনের কথা।”
তামান্না চুপ করে থাকে। বেল বেজে ওঠে।
“আপনাকে লুকাতে হবে। তিনি ফিরে এসেছেন। আপনি উপরের বা দিকের শেষ ঘরে চলে যান। আমি পরে আসবো। আমাদের আরো অনেক কথার প্রয়োজন।”
আমি উপরে উঠে যাই। তামান্না শয়তানটিকে গ্রহণ করতে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
নবম অধ্যায়
বেলা তিনটার দিকে সাজ্জাদ আমার ঘরে আসে তার ছোটবেলার একাটা খেলনা খুঁজতে। হয়তো উপন্যাসের জন্য প্রয়োজন, আর তিনি দিতে চান একটা নিখুঁত বর্ণনা। তিনি যখন নিচু হয়ে বসে খেলনাটি খোঁজার জন্য নিচু হচ্ছিলেন, আমি জোরে তাকে একটা লাথি মারি। তার মাথাটা টেবিলের কোনায় লেগে ফেটে যায়। সে একটা চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যায়। দু’চার বার ছটফট করে সে আর নড়েনা। আমার খারাপ লাগেনা। আমার কেমন লাগা উচিৎ আমি তা বুঝে উঠতে পারিনা।
তামান্না ছুটে আসে। সে লাশ দেখে বিচলিত হয়না।
আমি বলি, “একজন খুনিকে কি আপনি ভালোবাসতে পারবেন?”
তামান্না বলে, “আমি একজন খুনির ছায়া-ই এতোদিন বেঁচে ছিলাম, যে আমাকে অজস্রবার খুন করেছে, খুন করে সুখ পেয়েছে।”
*** সময়ের সাথে সাথে, সৃষ্টিশীলতা একটা অসুস্থতার মতো বেড়ে উঠছে আমার ভিতরে। বছর পাঁচেক শুধু সৃষ্টিই করেছি আদিম কোনো উন্মাদ-গুহাবাসীর মতো। আর এখন সেই সব সৃষ্টির ক্ষুদ্র এক অংশ আপনাদেরকে দিতে পেরে সুখ বোধ করছি। আর আমার বর্তমান কাটছে এই গল্পটিকেই একটা গোয়েন্দা-উপন্যাসে রুপান্তরিত করার কাজের ভিতর দিয়ে। ই-মেইলঃ [email protected]
গল্পের পটভূমি বেশ লাগলো। আগেরটা তো পড়িনি- তবে এর ভেতরের রূপটা বোধ করি ধরতে পেরেছি। ‘যশোর যশোর’ অঙশ পড়ে হঠাৎ উৎসর্গে চোখ গেলো। মনে পড়ে গেলো Conversation in the Cathedral এর কথা। আমার অনুমান কাকতালীয়ও হতে পারে। তবে আপনার লেখার ঢঙ ভালো লাগলো। ছোটোগল্প ঋদ্ধ হোক আপনার হাতে।
@শনিবারের চিঠি,
আপনি “Conversation in the Cathedral” যখন পড়েছেন, তখন না পড়ে থাকলে আপনি তাঁর “The war of the end of the world” পড়ে দেখতে পারেন। মজা পাবেন।
আমাকে এ-মেইল করে দিয়েন, আমি আমার যে গল্পটি মুক্তমনার দলেরা সেন্সর করেছে সেটা পাঠিয়ে দেবো।
ধন্যবাদ
আমরা যে ছোট গল্প পড়ে এসেছি এত বছর কিংবা এখন পড়ছি তারি সাথে ইউরোপে আর আফ্রিকায় এ ধরনের ছোট গল্পের যে ব্যাপক পরিবর্তন – তা চোখে পড়ার মত। তবে কিছু কিছু পরিবর্তন দু’ বাংলার ছোট গল্পকারদের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে কয়েকবছর ধরে।যাই হোক,ভালো লাগল গল্পটা। কনসেপ্ট আগেরটা থেকে ভালো মনে হয়েছে। শব্দের বাহুল্য ছিল না-গতটার মতো। এক টানেই পড়লাম। তিন শ শেষের অপেক্ষায় আছি। (F)
ভালো থাকবেন।
@অসীম,
চেষ্টাই আছি ও থাকবো। সারা জীবনে বারোটা সফল ছোট গল্প যদি সৃষ্টি করতে পারি তবে তা-ই যথেষ্ট। আধুনিক ছোট গল্প সাধারণত ৬০০০ থেকে ১২,০০০ শব্দের ভিতরে হয়ে থাকে। আমার এই গল্পগুলোকে তাই আরো অনেক দূর যেতে হবে। বেঁচে থাকলে সে পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছে আছে। আর শুধু কাহিনি সৃষ্টি করা-ই তো গল্প না। একটা গল্পের অনেকগুলো স্তর থাকতে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বাঙলায় আমরা আজো চেখভের ষ্টাইলে গল্প লিখে চলেছি, যদিও সে ছিলো অসাধারণ। আমাদের আচরণ এমন যেনো Borges, Kafka, Joyce, Marquez, আর Kundera দের জন্ম-ই হয়নি। আমরা বাঙলায় যদি তাদেরকেও আরো একটু এগিয়ে না নিয়ে যেতে পারি তবে আমাদের সব শ্রম ব্যর্থ! কথাটা শুনতে কষ্ট লাগে, কিন্তু এর থেকে সত্য আর কিছু বলার নেই। ধন্যবাদ।
শেষের কথোপকথনের সংলাপগুলো বেশ দূর্বল মনে হইল আমার কাছে। এছাড়া কনসেপ্টটা বেশ ভালো লাগছে।
@সাইফুল ইসলাম,
“নবম অধ্যায়” পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
“নবম অধ্যায়” এর আগে “রাজশুয়োর” নামে অন্য একটা গল্প দিয়েছিলাম মুক্তমনায়। আপনি ঐ গল্পটি পড়তে পারলে বেশ মজা পেতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় মুক্তমনা সেটাকে সেন্সর করে দিয়েছে। আমি অবশ্য অভিজিৎ ভাইকে ব্যাপারটা জানিয়েছি।
যদি মুক্তমনারা-ই সাহিত্য সেন্সর করতে থাকে তবে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে আমরা একটি ভয়ঙ্কর দুনিয়ায় বসবাস করছি। আরো আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে প্রথমে কোনো লেখকের লেখা বাতিল করা হয়, আর তারপর বাতিল করা হয় লেখককে। মুক্তমনাও মনে হয় নষ্টদের অধিকারে যাবে। আমি মুক্তমনার সাথে আছি ২০০১ থেকেই। তবে আমি বর্তমানে এই সেন্সরের বিষয়টা নিয়ে খুবই শঙ্কিত!
আপনি যদি “রাজশুয়োর” পড়তে চান তো আমাকে একটা ই-মেইল ([email protected]) পাঠিয়ে দিয়েন। ধন্যবাদ।