ঈশ্বর আসমানে আছে, ঈশ্বর জমিনেও আছে। ঈশ্বর স্বর্গে আছে, ঈশ্বর মর্ত্যেও আছে। যদিও ঈশ্বর নেই, তারপরেও তার রাজত্বের অবসান ঘটে নি। কারণ অস্তিত্বহীন এই ঈশ্বরকে এখনো যেতে দেওয়া হচ্ছে না।

মানুষের চিন্তায় ঈশ্বর বাসা বেঁধেছিলো সুখ বা অসুখের মতো। কারণ নাকি মানুষ ছিলো অসহায়। তার প্রয়োজন ছিলো একজন সর্বশক্তিমানের সহায়তা।

আমাদের অনেকে ধীরে ধীরে বুঝে উঠত শুরু করে, ঈশ্বর নেই। কোনো কেন্দ্রীয় শক্তি নেই যে সবকিছুর দেখভাল করবে। আমাদের মধ্যে তারা ভাগ্যবান, যারা বুঝে গিয়েছে যে, নিজের দেখভাল নিজেকেই করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিচার বিবেচনা করে। যাদুর মতো আপনাআপনি সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে না।

আমাদের মধ্যে তারা অভাগা, যারা তা বুঝতে পারে নি, এখনো নির্ভর করে কল্পিত, আস্থাপোষিত উচ্চশক্তির উপর, যে তার দেখভাল করবে। অদৃষ্টের উপর নির্ভর করে তারা অলস বসে থাকার বদ-অভ্যাস করে ফেলেছে।

আর আমাদের মধ্যে তারা সবচেয়ে দুষ্ট-ক্ষতিকর, যারা দুর্ভাগাদের এই সরল-বিশ্বাসকে ব্যবহার করে, ঈশ্বরের প্রতিনিধি সাজে, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়, ঈশ্বরের নামে নিজস্ব খেয়ালখুশির তাণ্ডব চালায়।

আমরা বিশ্ব-ঈশ্বরের থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছি। অনেকে আমরা ভাবছি এটাই শেষ যুদ্ধ। বিশ্ব-ঈশ্বরের দুষ্টদের প্রতিহত করলে, তাকে বিশ্বাসী দুর্ভাগাদের চোখ খুলে দিলে মুক্তির উদার দরজা পৃথিবীর সবপ্রান্তে উন্মুক্ত হবে।

কিন্তু যুদ্ধটা একটা মাত্র “বিশ্ব”-ঈশ্বরের বিরুদ্ধে নয়। মানুষের মনে যে উচ্চতর শক্তির প্রতি অ-যাচিত আস্থাপোষণের অভ্যাস, সেটা কেবল বিশ্ব-ঈশ্বরে গিয়েই শেষ হয়ে যায় নি।

আমাদের মধ্যে গুরু অংশ এখনো অন্যান্য নানা আকারের উচ্চতর শক্তির উপর অ-যাচিতভাবে আস্থাবান। তাদের মধ্যে বিশ্ব-ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা আছে, তাদের মধ্যে বিশ্ব-ঈশ্বরে অবিশ্বাসীরাও আছে।

বিশ্ব-ঈশ্বরে অবিশ্বাসীরা বুঝে গিয়েছিলো যে বিশ্ব-ঈশ্বর আসলে শক্তিহীন। কিন্তু তাদের অনেকে তারপরেও অন্যান্য শক্তিমানের উপর তাদের আস্থাকে প্রশ্ন করে উঠতে শিখেনি। মর্ত্যের শক্তিমানদের উপর তাদের আস্থাকে তারা যাচাই করে নিচ্ছে না। তারা তাদের রাষ্ট্রের উপর আস্থাশীল। তারা বিভিন্ন রাষ্ট্রজোটের উপর আস্থাশীল। রাষ্ট্রের শক্তিকে অস্তিত্বহীন ভাবার জো নেই। এই যুগে, এবং আগামী যুগে এই রাষ্ট্ররাই ঈশ্বর।

বিশ্ব-ঈশ্বরের ব্যাপারে মহত্ব, কল্যাণকামিতা কল্পনা করা হতো। কিন্তু বিশ্ব-ঈশ্বরের নিজেরই অস্তিত্ব নেই। রাষ্ট্র-ঈশ্বরেরও মহত্ব ও কল্যাণকামিতা কল্পনা করা হয়, দাবি করা হয়। কিন্তু সমস্যা হলো – সে অস্তিত্ববানও। তাই এক অর্থে রাষ্ট্র-ঈশ্বর বিশ্ব-ঈশ্বরের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব-ঈশ্বরের নাম ভাঙিয়ে যারা খাচ্ছে, সেই দুষ্টদের প্রতিহত করা আগামিতে আরও আরও সহজ হয়ে উঠবে, কারণ তাদের বিশ্ব-ঈশ্বরের কোনো শক্তি নেই, তার কোনো অস্তিত্ব নেই। সবচেয়ে কঠিন হলো রাষ্ট্র-ঈশ্বরের নাম ভাঙিয়ে খাওয়া দুষ্টদের দমন, কারণ রাষ্ট্র-ঈশ্বর বিরাজ করে, এই পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি মাটিতে, সর্বত্র। সবখানে তার অবাধ নিয়ন্ত্রণ কায়েম আছে। সে-ই হচ্ছে এই যুগের সর্ববিরাজমান ঈশ্বর।

সবাই যখন এক কল্পিত বিশ্ব-ঈশ্বরের বিশ্বাসে বুঁদ ছিলো, অল্প কয়জন বুঝেছিলো, এটা অ-যাচিত, অলীক, অনর্থক। তারা যখন সেটা বলতে শুরু করে, তখন অধিকাংশ অন্যরা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলো। কারণ তখন বিশ্ব-ঈশ্বরের বিশ্বাস সর্বত্র প্রচলিত। মানুষের মনে তার বাস। সেই বিশ্ব-ঈশ্বরের সমাজকাঠামোগত প্রতিনিধি পুরোহিতরা বহাল তবিয়তে মানুষের মনে ছড়ি ঘুরাচ্ছিলো গঞ্জে গঞ্জে। এমন কি রাষ্ট্রনায়ক রাজা কিংবা সম্রাটকেও ভাবা হতো সেই বিশ্ব-ঈশ্বরেরই রাজনৈতিক প্রতিনিধি।

ফলে বিশ্ব-ঈশ্বরবিরোধিতা ছিলো প্রচলিত কাঠামোর বিরুদ্ধাচরণ, ধর্মদ্রোহিতা, সর্বোচ্চ অপরাধ। তাদের মধ্যে যারা এই যুক্তিগুলোর ক্ষুরধার একটু আধটুও অনুভব করতো, তারা দোহাই দিতো প্রচলিত কাঠামোতে বিশৃঙ্খলা না আনার। বিশ্ব-ঈশ্বরের পক্ষের যুক্তিবাদিরা যুক্তি দিতো, যদি বিশ্ব-ঈশ্বর না থাকে, কে বানিয়েছে এই সুষমা, কীভাবে গ্রহ নক্ষত্র নির্দিষ্ট সূত্রে প্রতিনিয়ত প্রদক্ষিণরত? কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিশ্বের সুশৃঙ্খলা টিকে থাকতে পারে সেটা তাদের চিন্তার বাইরে ছিলো। কিন্তু সত্যি কথা, এই সুবিশাল জগতের কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক নেই। কোনো দেখভালকারী নেই। প্রয়োজনও নেই।

আজকের যুগে রাষ্ট্র-ঈশ্বরের প্রতি আস্থা পূর্বের যুগের বিশ্ব-ঈশ্বরে বিশ্বাসী ব্যবস্থার মতোই অগাধ। আমরা নির্বিচারে বিশ্বাস করি যে রাষ্ট্রের প্রয়োজন আছে। একটা সীমানার মধ্যে একটা কেন্দ্রীয় শাসক ও সিদ্ধান্তকারীর প্রয়োজন আছে। একে অস্বীকার তো পরের কথা, এর প্রয়োজনীয়তা নিয়েও যদি প্রশ্ন তোলা হয়, যদি ভাবতে বলা হয়, তখন প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যার অল্পই চিন্তাপ্রসূত। এবং সেই প্রতিক্রিয়া আগের দিনের বিশ্ব-ঈশ্বরের ঝাণ্ডাবাহীদের মতোই তীব্র।

রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা বিপজ্জনক, রাষ্ট্রকে অস্বীকার করা প্রচলিত কাঠামোর বিরুদ্ধাচরণ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, সর্বোচ্চ অপরাধ। যারা রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার বৈধতা একটু আধটু অনুভব করেন, তারা দোহাই দেন প্রচলিত কাঠামোতে বিশৃঙ্খলা না আনার। আর রাষ্ট্র-ঈশ্বরের পক্ষের যুক্তিবাদিরা যুক্তি দেন, যদি রাষ্ট্র-ঈশ্বর না থাকে, কীভাবে টিকে থাকবে মানুষের সুশৃঙ্খলা, ন্যায়-বিচার? কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিশ্বের সুশৃঙ্খলা যেমন অবিশ্বাস্য ও প্রশ্নাতীত ছিলো, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মানুষের সুশৃঙ্খলা টিকে থাকার কথা ভাবাও এই যুগের মানুষের কাছে তেমনি এখনো অবিশ্বাস্য, চিন্তার অতীত।

আমাদের রাষ্ট্র-ঈশ্বরে বিশ্বাসের পেছনে অল্পই যুক্তি কাজ করে। এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গৃহীত হয়ে যায় ছোটবেলায়, স্কুলে, পি.টি.তে, সামাজিক বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে। রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে শিশুকালেই বিচার-বিবেচনার বাইরে আমাদের যেভাবে গ্রহণ করানো হয়, বড় হয়ে তাতে আমরা ভাণ করতে থাকি যে আমরা জানিই কেনো আমরা রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে মানি। কিন্তু একটু ভাবতে গেলে দেখা যায়, আমরা মানি কারণ ছোটবেলা থেকেই আমাদের মানতে শেখানো হয়েছে।

বড় হয়ে রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে প্রশ্ন করার সুযোগ আছে বটে। কিন্তু সেটা বিপজ্জনক। বিশ্ব-ঈশ্বরকে প্রশ্ন করার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক।

বিশ্ব-ঈশ্বরের প্রভাব এ যুগে ধীরে ধীরে সীমিত হয়ে আসছে। বিশ্ব-ঈশ্বরের শাসন এখন আর কায়েম নেই। ফলে এর সাথে কেবল মানসিক ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক লড়াই করতে হয়। সমাজ একটু ভ্রু কঁুচকে বিষয়টা এড়িয়ে যায়। হুমায়ুন আজাদের মতো পরিণতি ঘটাতে তারা অল্পই আসে।

অন্যদিকে রাষ্ট্র-ঈশ্বরের বিপরীতে চিন্তা করাটা তার চেয়ে অনেক বেশি দুরূহ। কারণ রাষ্ট্র-ঈশ্বরের শাসন প্রতিনিয়ত কায়েম আছে। প্রতি মুহূর্তে, রাস্তাঘাটে, জীবনযাত্রায় তার শাসনের ভেতরে আমাদের থাকতে হচ্ছে। ফলে এর বিরুদ্ধে মানসিক লড়াই করাটাও বিপজ্জনক। রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে মুখে অস্বীকার করাও মহাপাপ, তার শাসনের বিরুদ্ধাচরণ করতে যাওয়া তো পরের কথা।

ফলে আমাদের মধ্যে চিন্তাশীল যারা, তাদের অধিকাংশই রাষ্ট্র-ঈশ্বরের অস্তিত্বের পেছনে যুক্তি খোঁজাটাই সহজসাধ্য বলে উপলব্ধি করে। তারা নানান উপায়ে নিজেকে ও অন্যকে বোঝায়, কেনো রাষ্ট্র-ঈশ্বর দরকার। কেনো সে মহৎ ও কল্যাণকামী।

বিশ্ব-ঈশ্বর আছে ভাবলেই যেমন সে অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে না, রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে কল্যাণকামী ভাবলেও সে কল্যাণময় হয়ে ওঠে না। সেটা আমাদের অনেকে উপলব্ধিও করি। ফলে আমরা বলি যে অমুক উপায়ে রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে কল্যাণকামী করে তুলতে হবে, তমুক উপায়ে সে সত্যি সত্যি মহৎ মহানুভব হয়ে উঠবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র-ঈশ্বর এই মুহূর্তে যে খুব সুবিধার অবস্থায় নেই, সেটা আমরাও উপলব্ধি করি, কিন্তু সেটার সমাধানে আমরা কেবল ভাবি তার গায়ে নানা জোড়াতালি লাগানোর কথা। কিন্তু এই কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতিষ্ঠানটি যে কিছু দুষ্টলোক বিভিন্ন ঈশ্বরের নামে কায়েম করেছিলো তাদের নিজের লাভ ও লোভের জন্যে, আমরা সেই প্রাচীন কাঠামোটাকেই যে এখন নতুনরূপে কল্যাণময় হিসেবে ভেবে নিয়ে গ্রহণ করার চেষ্টা করছি, সেটা আমাদের অগোচরে থেকে যাচ্ছে। এটা কেবলই একটা বয়ে আসা প্রথা, একটা মাজার, একটা বিধ্বস্ত প্রাচীন অকেজো কারখানা। সেটাকে সাজিয়ে, সারিয়ে আমরা চলার চেষ্টা করছি। তাকে ছাড়া চিন্তা করা আমাদের জন্যে রীতিমত নিষিদ্ধ।

কিন্তু রাষ্ট্র-ঈশ্বরটা বিশ্ব-ঈশ্বরের চেয়ে কোনো অংশে একটু কম বায়বীয় কি? কে এই রাষ্ট্র-ঈশ্বর? কোথায় তাকে দেখতে পাওয়া যাবে? সেও বিশ্ব-ঈশ্বরের মতোই বাস করে মানুষের মনে। দুর্ভাগারা নিজের বিচার বিবেচনাকে ত্যাগ করে অলস হয়ে এই রাষ্ট্র-ঈশ্বরের দয়া দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে। আর দুষ্টরা মানুষের বিশ্বাসের সেই দুর্বলতাকে পুঁজি করে নিজেদের খেয়ালখুশির রাজত্ব কায়েম করে। কোথাও ভয় দেখিয়ে। কোথাও মন ভুলিয়ে। কোথাও তাদেরই “ন্যায্য” গণ-প্রতিনিধি হবার নাম করে। কিন্তু একবার যদি মানুষের ভেতর থেকে রাষ্ট্র-ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস উঠে যায়, তাহলে তাদের এই রাজত্বের বিনাশ ঘটবে। তাই তারা “জনকল্যাণ” করে, সাহায্য অনুগ্রহ করে দুর্ভাগাদের চিন্তার আলস্যকে টিকিয়ে রাখে। রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে খুঁজতে গেলে পাবেন কেবল কিছু আমলা, কিছু সৈন্য, কিছু পুলিশ, কিছু নেতা। পাবেন কেবল মানুষ। আর আমরা কিনা ভাবছি, এই কিছু মানুষদের সার্বিক শাসনে না থাকলে সুশৃঙ্খলা বজায় থাকবে না? এই দোহাই দিয়ে আমরা একটা প্রাচীন মাজারকে নানা রঙে সাজিয়ে, একটা বিধ্বস্ত অকেজো কারখানাকে নানা জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখছি।

রাষ্ট্র-ঈশ্বরের নামে যারা রাজত্ব কায়েম করেছে, সেই দুষ্টরা এখন রাষ্ট্র-ঈশ্বরের কল্যাণত্ব প্রমাণ করার জন্যে তাকে কল্যাণকামী করে তুলতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু তার বিনিময়ে তারা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে চাচ্ছে, সফলভাবে কল্যাণ যাতে করতে পারে এই দোহাইতে। ফলে রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে মেনে নিয়ে তার সাথে দরকষাকষি করার মুনাফা আমাদের জন্যে সীমিত। সেই দরকষাকষিতে একটা ন্যায্যতা আদায় করতে হচ্ছে আরেকটা ন্যায্যতাকে জলাঞ্জলি দেওয়ার বিনিময়ে। রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে যখন আমরা কল্যাণকামী হতে বলছি, তখন দুষ্টেরা বলছে – তাহলে রাষ্ট্র-ঈশ্বরের ক্ষমতাকে আরো বৃদ্ধি করতে দাও, ক্ষমতা ছাড়া কল্যাণ কীভাবে করবো? বেশি ক্ষমতা পেলে রাষ্ট্র-ঈশ্বর বেশি কল্যাণকামী হবে কিনা, তার প্রমাণ তো আমাদের হাতে নেই, তবে সেই ক্ষমতা যে বাস্তবে কিছু আমলা, সৈন্য, পুলিশ আর নেতার মাঝে বণ্টিত হয়, আমাদের স্বাধীনতা খর্বিত হয়, তা নিয়ে কি কোনো সন্দেহ আছে?

রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে স্বতঃসিদ্ধ হিসবে মেনে নিয়ে তার সাথে দরকষাকষি অনেক হয়েছে। সময় এসেছে এর অস্তিত্ব, এর প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্ন করার। কেনো বয়ে আসা এই কাঠামোকে বহন করা প্রয়োজন?

যারা বর্তমানের দোহাই দিয়ে, শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে এই প্রশ্ন করাকেই সমালোচনা করবেন, তারা হাজার বছর আগের বিরল-অবিশ্বাস ও নাস্তিকতার সমালোচকদের সাথে গলা জড়াজড়ি করে আরামেই নিশ্চয়ই থাকতে পারবেন।

আমি নাস্তিক। আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করি। আমার কোন প্রভু নেই। কোনো বিশ্ব প্রভুও নেই। কোনো রাষ্ট্র প্রভুও নেই। আমি কারো-ই বান্দা নই। এদের কারও মহত্বেই আমি অ-যাচিত আস্থা পোষণ করি না। বরং এদেরকে আমি প্রশ্ন করি।

বিশ্ব-ঈশ্বরকে প্রশ্ন করাটা প্রচলিত হয়ে উঠলেও রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে প্রশ্ন করাটা খুব বিরল থাকবে আরো কিছুকাল। রাষ্ট্রের অস্ত্রধারী শক্তিমানেরা বিরুদ্ধাচরণকারীদের বন্দী করবে, প্রশ্নকারীদের নাজেহাল করবে। আর অন্যেরা দেবে বর্তমান কালের দোহাই।

বর্তমান কালের দোহাই তো আমরা না চাইলেও মেনে নিচ্ছি। রাষ্ট্র সর্ববিরাজমান। ছোটবেলা থেকে কিশোরবেলা, বড়বেলা, সমস্ত জীবন জুড়ে, বুঝে ওঠার আগে থেকে সে ছিলো। বুঝে ওঠার পরেও সে আছে। তার কাঠামোর বিরুদ্ধাচরণ করা প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু নাস্তিক হিসেবে তাকে প্রশ্ন করারও কি প্রয়োজন নেই? গ্যালিলিও নিশ্চয়ই ধর্ম ও পুরোহিত বেষ্টিত কাঠামোর সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেই তার জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। শক্তি প্রয়োগের মুখে মান্য করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু প্রচলিতের বিপক্ষে যে প্রশ্ন তিনি তুলেছিলেন, সেটার প্রয়োজনীয়তা কিন্তু অনস্বীকার্য।

আমরা রাষ্ট্র-ঈশ্বর বেষ্টিত। তার বিরুদ্ধাচরণ আমাদের জন্যে প্রায় অলীক কল্পনা। কিন্তু রাষ্ট্র-ঈশ্বরের দখলদারিত্ব আমাদের চিন্তার জগতে তো নিশ্চয়ই নেই। কোনো কালেই ছিলো না। চিন্তাই একমাত্র রাজ্য, যা মুক্ত, স্বাধীন সার্বভৌম। চাইলে সেখানে আমরা স্বেচ্ছায় পরাধীন হতে পারি, কিন্তু চাইলে সেখানে আমরা প্রশ্নও করতে পারি। চিন্তার জগতে বিরুদ্ধাচরণ করলে কোন ঈশ্বর কীভাবে হানা দেবে? এটা কি তাহলে দুর্ভাগ্য নয়, যে মাত্র গুটিকয়েক নাস্তিকই কেবল রাষ্ট্র-ঈশ্বরকে প্রশ্ন করে চিন্তা করার সাহস দেখাবে? আর আবার তার চেয়েও অল্প কিছু মানুষ ভাবার সাহস পাবে, যে একদিন আরও বহু বহু মানুষ তাকে প্রশ্ন করতে পারবে? এই অকেজো কারখানা তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হবে? দুষ্ট-ক্ষতিকরেরা চিন্তায়-অলস দুর্ভাগাদের আর খুঁজে পাবে না, যাদের বিশ্বাসকে ভাঙিয়ে তারা রাজত্ব করবে?

যদি চিন্তার জয়যুক্ত হবার কথা থাকে, তাহলে শক্তিপ্রয়োগ নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে পরাস্ত হবে। সকল ঈশ্বর ও প্রভুর হাত থেকে, আর তাদেরকে ব্যবহার করে ছড়ি ঘোরানো দুষ্টদের হাত থেকে মানুষ একদিন মুক্ত হয়ে উঠবে। সচেতন মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। তারা কোনো উচ্চতর শক্তির আশায় অলস বসে থাকার কথা ভাবতেও চাইবে না। নিজেদের কল্যাণের দায়িত্ব নিজেরাই নেবে। মানুষের মুক্তি, সমাজের কল্যাণ ও ন্যায়পরায়ণতা উঠে আসবে প্রতি দুইটি মানুষের মধ্যকার বিবেচনাপ্রসূত, স্বেচ্ছামূলক ও ন্যায্য আদান প্রদানের ভেতর থেকে। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো কেন্দ্রীয় “কল্যাণকামী”, “ন্যায়পরায়ণ” প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নয়।