হ্যাঁ দিদি, কেমন আছেন?
আপনার মেইল পেয়ে খুশি হলাম।
প্রশ্নগুলো পাঠান। অবশ্যই উত্তর দেব।
স্বকৃত নোমান
এ মেইলটি আমি স্বকৃত নোমানের কাছ থেকে পেয়েছি নীচে আমার ইমেইলের উত্তরে।
কথাশিল্পী স্বকৃত নোমা্ন,
আপনার সাথে আমার পরিচয় ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। তখন আপনার
রাজনটি উপন্যাসটি কিনি। পড়ি এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে অভিভূত হই।
পরে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলা থেকে আপনার বেগানা উপন্যাসটি কিনে
আপনাকে দিয়ে লিখিয়েও নিয়েছিলাম।
রাজনটি ও বেগানা দুটি উপন্যাসই লিখেছেন ভিন্ন ও ব্যতিক্রমধর্মী পটভুমি
নিয়ে। দুটো কাহিনি্তেই একাধিক দেশের প্রেক্ষাপট রয়েছে। দুটো উপন্যাসই
বাস্তব অস্তিত্বের স্মারক।রাজনটি পত্রিকার একটি ছোট্র সংবাদকে কেন্দ্র
করে আর বেগানা পত্রিকার পাতায় পৃষ্ঠা ভরা প্রকাশিত খবর কেন্দ্র করে। আমি আপনাকে বেগানা উপন্যাস নিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে চাই যা পরবর্তীতে মুক্ত-মনায় প্রকাশও করতে চাই আপনার সম্মতিতে। আপনার উত্তর পেলে আমি প্রশ্নগুলো পাঠাব।
উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
কাজেই আমি আমার প্রশ্ন পাঠাই এবং স্বকৃত নোমান তার উত্তর পাঠায় যা নীচে দেওয়া হলঃ
১. রাজনটি ও বেগানা দুটি উপন্যাসই লিখেছেন ভিন্ন ও ব্যতিক্রমধর্মী পটভুমি নিয়ে। দুটো কাহিতেই একাধিক দেশের প্রেক্ষাপট রয়েছে। দুটো উপন্যাসই বাস্তব অস্তিত্বের স্মারক। রাজনটি পত্রিকার একটি ছোট্ট সংবাদকে কেন্দ্র করে আর বেগানা পত্রিকার পাতায় পৃষ্ঠা ভরা প্রকাশিত খবর কেন্দ্র করে। এ ধরণের কাহিনী নির্বাচনের কি কোন কারণ আছে?

উত্তর : পত্রিকার একটি সংবাদ পড়ে রাজনটী রচনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম বটে। সংবাদটা ছিল সুত্র মাত্র। পরে উপন্যাস আর ঐ সংবাদের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। আর বেগানা পত্রিকার পাতায় পৃষ্ঠা ভরা প্রকাশিত খবরকে কেন্দ্র করে, কথাটা সত্যি নয়। বেগানা রচনাকালে পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো সংবাদ গ্রহণ করিনি, কাজেও লাগেনি। আর এ ধরণের কাহিনি নির্বাচনের আসলে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। একজন ঔপন্যাসিক কখন কোন কাহিনী রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়, কোন কাহিনী তাকে আলোড়িত করে তা আগে থেকে বলা যায় না। তবে আমি সবসময় চেষ্টা করি, যে বিষয়টার প্রতি আলো পড়েনি, যে বিষয়টা নিয়ে আমাদের অগ্রজগণ লিখে যাননি, সেই সব বিষয় নিয়ে কাজ করতে। আমি সবসময় একটু ব্যাতিক্রম কাহিনী নিয়ে কাজ করতে চেষ্টা করি।

২. বেগানা উপন্যাসে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প জীবনের যে চিত্র এঁকেছেন তাতে ছেলেমেয়ের আধিক্য দেখালেও বহু বিয়ের বিষয়টি আসেনি। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিন্ন বলেই জানি। আসলে এটি কি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি থেকে?

উত্তর : মোটেই না। কোনো চরিত্রের প্রতি আমার কোনো সহানুভূতি ছিল না। রোহিঙ্গাদের বহু বিবাহের বিষয়টি পুরোপুরি সঠিক নয়। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা তাই বলে। বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের যেসব রিফ্যুজি-ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা থাকে তারা কিন্তু বহু বিবাহে অভ্যস্ত নয়। একজনকে সামাল দিতেই তাদেরকে হিমশিম খেতে হয়, একাধিক স্ত্রী রাখবে কীভাবে! তবে হ্যাঁ, যে সব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকে না, যারা আজ এখানে তো কাল সেখানে, তারা একাধিক বিয়ে করে বটে। যেমন খেয়াল করে দেখবেন, উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র ‘ভেলু’ কিন্তু দুই বিয়ে করে। শেফালির পূর্বতন স্বামীও একধিক বিয়ে করে। ওদিকে আরএসও সদস্য ‘বারেক’ও দুই বিয়ে করে।

৩. রাজনটি লিখতে গিয়ে কুমিল্লার সে মসজিদে গিয়েছিলেন এবং রাজনটী লেখার সময় চোরাইপথে ত্রিপুরা যাওয়ার কথা বইতে উল্লেখ করেছিলেন বলে সামান্য সামস্যা হয়েছিল। বেগানায় কি তাই এড়িয়ে গেছেন? কারণ বেগানা লিখতে কক্সবাজার গিয়ে থেকেছেন। মায়ানমারও নিশ্চয়ই গিয়েছিলেন? কারণ, বইটির স্বপ্ন যাত্রা জুড়ে রয়েছে মায়ানমারের বর্ণনা।ইয়োমা পর্বতমালা, কালাদান নদী, করইতলি স্কুল মাঠ, নলবুনিয়া গ্রাম, নাকিনদক
গ্রাম, চকপংডুঢ, কেওড়াবন, গাঁজাখোর খলিলের হাতি দিয়ে বন থেকে কাঠ টানা, স্বপ্নভঙ্গ পর্বেও এসেছে বার্মার চিত্র ।যা উপন্যাসটিতে বর্ণিত আবহের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। এসব এমন করে আঁকলেন কিভাবে?

উত্তর : আরাকানে তো যেতে হয়েছেই। না গিয়ে তো আর লেখা যায় না। সেই লেখা বাস্তবতাসম্ভূত হয় না, কল্পকাহিনী হয়। কৌশলগত কারণে আরাকানে যাওয়ার বিষয়টি ভূমিকায় এড়িয়ে গেছি।হ্যাঁ, আমি আরাকানে দশ এগারো দিনের মতো ছিলাম। এ ছাড়া রোহিঙ্গা জেলেদের সঙ্গে প্রায়ই আমি আরাকানের উপকূলে ঘুরেছি। বিভিন্ন গ্রামের নাম সংগ্রহ করেছি। আরাকানের ভৌগোলিক জ্ঞানটা রপ্ত করার চেষ্টা করেছি।

৪. পেয়ারি, যে সুরুজের মা বা মাদু মিয়ার বউ। এ পিয়ারি ভিটেমাটি ছেড়ে যাবার কথা মনে হওয়াতে মাঝপথে ফিরে আসতে চায় তার বসতবাটি নলবুনিয়ায়। সে এক নারী। হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি উপন্যাসের আরেক নারী যার জবানীতে উপন্যাসটি লেখা সে ও ভারত ভাগের পর স্বামী সন্তানদের সাথে ওখান থেকে পাকিস্তানে আসে না। বর্ধমান থেকে যায়। আগুনপাখি র নারীর মত এ নারীর স্বদেশ প্রেম। যদিও দুই নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান এক নয়। আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন বলেই পিয়ারি ফিরে যেতে পারেনি। তাছাড়া তার পায়ের নীচের মাটি শক্ত নয়। কিন্তু তার মনের আলোড়ন পাঠককে ভাবায় ও জ্বালায়।নারীর সাথে কি ভিটেবাড়ির সম্পর্ক পুরুষের চেয়ে নিবিড়! গভীর! কেন? আপনি কী ভাবনা থেকে পিয়ারিকে ভাবিয়েছেন?

উত্তর : হ্যাঁ, পুরুষের চাইতে ভিটেমাটির প্রতি নারীর সম্পর্ক নিবিড়। পুরুষ ভিটিমাটি ছেড়ে দেশদেশান্তরে ঘুরতে পারে, কিন্তু নারী পারে না সহজে। ময়মনসিংহ গীতিকার ভেলুয়া, নছর মালুম ইত্যাদিতে পালাতেও দেখবেন পুরুষের বাউন্ডেুলে স্বভাব আর নারীর ভিটেমাটি আঁকড়ে থাকবার প্রবণতা। পিয়ারিকে দিয়ে আমি রোহিঙ্গা নারীদের স্বদেশত্যাগের নির্মম বেদনাটা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। পেয়ারির কষ্ট সমগ্র রোহিঙ্গা নারীর কষ্ট হিসেবে দেখাতে চেয়েছি।

৫. আপনি এ বইয়ে যে ভাষা ব্যবহার করছেনে তা কি রোহঙ্গিাদরে মুখের হুবহু ভাষা? নির্জলা চট্টগ্রামরে ভাষা নয়? এ ভাষা ব্যাবহার নিয়ে কিছু বলবনে কি?

উত্তর : না, রোহিঙ্গাদের হুবহু ভাষা নয়, তবে হুবহু ভাষার প্রায় কাছাকাছি। কিছু কিছু শব্দ পাল্টে দিয়েছি মাত্র। চেষ্টা করেছি সকল শ্রেণীর পাঠক যাতে ভাষাটা বোঝে। হুবহু রাখলে ঐ ভাষা বুঝতে পাঠকদের অসুবিধা হতো। উপন্যাসটি তো আমি কেবল রোহিঙ্গাদের জন্য লিখিনি, বাংলা ভাষাভাষী সকল পাঠকের জন্য লিখেছি। সুতরাং ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থেকেছি।

৬. রোহঙ্গিা রিফুজিদের যৌন জীবনরে যে চিত্র পশুর সাথসেহ তুলে এনছেনে তা কি আপনার রোহঙ্গিা ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা?
উত্তর : ঠিক ধরেছেন। অভিজ্ঞতালব্ধ।

৭. মনতাই বুড়ির সারাদিন কম্বল গায়ে থাকার ইতিহাস, রুকুনির পাগল হওয়া, জেবুন্নিসার পরণতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। যে কোন দুর্যোগে, যুদ্ধে, দাঙ্গায় বা রাজনৈতিক বা সামাজিক অরাজকতায় ব্যাপকতা বা গভীরতায় যেদিকেই হোক না কেন সবচেয়ে বেশি দুস্থ অবস্থায় পড়ে নারীরা। আপনার চেতনায় এ ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি কাজ করেছিল।

উত্তর : দুরাবস্থায় কেবল নারীরাই পড়ে না, পুরুষরাও সমানভাবে পড়ে। বেগানায় দেখবেন, মোহাম্মদ মোস্তফার চোখে গরম কয়লা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। শত শত পুরুষকে নদীকে ব্রাশফায়ার করে মারা হয়েছে। মাদু মিয়ার বাবাকে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে, জাফর কাওয়ালকে খুন করা হয়েছে। লাতু মুন্সী, মকবুল আম্মদরা কী নির্যাতনের শিকার হয়েছে, পড়েছেন নিশ্চয়ই। দূরবস্থার চিত্র তুলে ধরার সময় নারী পুরুষ আমার বিবেচনায় ছিল না। সবার দুর্দশা তুলে ধারার চেষ্টা করেছি।

৮. বেগানা বইটি লিখতে গিয়ে কক্সবাজারে ছিলেন এবং অনেক কষ্টও করেছেন। এ বিষয়ক অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলবেন কি?

উত্তর : অভিজ্ঞতা তো সবই বইতে ঢেলে দিয়েছি। নতুন করে কী আর বলবো? লেখার বাইরেও বহু অভিজ্ঞতা আছে। শত শত। সাক্ষাতে বলা যাবে।

৯. আমরা জানি, সাহিত্য আর বাস্তবতা এক নয়। বাস্তব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে সাহিত্যের বাস্তবতাকে তুলনা করা যায় না। তবুও বেগানার কাহিনী একেবারে সমসাময়িক ঘটনাকে নিয়ে গড়ে উঠেছে বলেই প্রশ্নটা। কারণ বেগানায় আপনি নির্মোহভাবে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আপনার পক্ষপাত বোঝা যায়নি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্থানীয় মানুষসহ বর্তমান সরকারের অবস্থানকে আপনি কিভাবে দেখেন?

উত্তর : সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। মানুষের জন্য দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ। পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষ আমার স্বজন। আপনারও নিশ্চয়? সে রোহিঙ্গা হোক কিংবা ইরানি তুরানি ইংরেজ জাপানী জার্মান, যেই হোক না কেন। লালন বলেছেন, ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার/সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার। কিংবা মানুষে মনস্কামনা সিদ্ধ কর বর্তমানে/ চৌদ্দ ভুবন ফিরাই নিশান এই মানুষের মন ভুবনে। আফ্রিকার নিগ্রোরা নির্যাতিত হলে সচেতন মানুষ হিসেবে আমার ব্যথিত হওয়ার কারণ আছে। রোহিঙ্গাদের এই দুর্দশা আমাকেও ব্যথিত করে। ধর্মের নামে, রাষ্ট্রের নামে, সংঘের নামে, কৃত্যের নামে, গোষ্ঠীর নামে এই মানব নিধনকে সমর্থন করা যায় না। সাম্প্রতিক কালে রোহিঙ্গা ট্রাজেডির ব্যাপারে সরকার মানবিকতার পরিচয় দেয়নি। স্মরণ রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাও কিন্তু ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

১০. এখন কোন বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখছেন? বা নিকট ভবিষ্যতে লেখার পরিকল্পনায় আছে?

উত্তর : ভাটিবীর শমসের গাজীকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখছি। নাম দিয়েছি ‘হীরকডানা’। অর্ধেক শেষ। শমসের গাজী অষ্টাদশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে বারো বছর ত্রিপুরা শাসন করেছেন। ছিলেন কৃষক আন্দোলনের নেতা। মুকুটবিহীন সম্রাট। অথচ ইংরেজ ইতিহাস তাকে দস্যু-ডাকাত হিসেবে অভিহিত করেছে। দুঃখজনক। তার বাড়ি আধুনিক ফেনী জেলার ছাগলনাইয়ায়। যে সময়ে সে ত্রিপুরা শাসন করেছে তখন ফেনী নোয়াখালী এবং কুমিল্লা ত্রিপুরার অধীন ছিল। তার রাজধানী ছিল ফেনীর ছাগলনাইয়ায়। সম্প্রতি ত্রিপুরা থেকে আবারও ঘুরে এসেছি। তবে এবার চোরাইপথে যাইনি, ভিসায় গিয়েছি। মাস দুয়েক পর আবার যাবো। আগামি মেলায় বইটি আনার চেষ্টা করছি। দেখা যাক।

পরবর্তীতে আমি স্বকৃত নোমানকে ধন্যবাদ জানিয়েছি এত কম সময়ে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার জন্য এবং লিখিত এ কথোপকথন মুক্ত-মনায় দেওয়ার সম্মতিও নিয়েছি।