অনেক বছর আগের কথা। আশির দশকের শুরুর দিক। থাকতাম তখন খিলগাঁওয়ে। কিশোর বয়স আমার। গল্পের বই পড়ার প্রবল নেশা তখন। কিন্তু নেশার উপকরণ নেই। অত্যন্ত দরিদ্র একটা পরিবারে জন্ম আমার। একবেলা খাবার পরে পরের বেলা খাবার জুটবে কি না, সেই দুশ্চিন্তা যেখানে কুরে কুরে খায়, সেখানে বই নামের নেশাতো অন্যভূবনের উপকরণ। ভাত খাবারই পয়সা নেই যেখানে, সেখানে বই এর আশাতো দূরাশামাত্র। তবে, শুধু অর্থনৈতিক কারণই একমাত্র কারণ ছিল না এই প্রতিবন্ধকতার পিছনে। পরিবারের কর্তার গড়পড়তার চেয়ে নিম্নমানের বুদ্ধিমত্তার কারণে পাঠ্য বইয়ের বাইরের সব বইকেই ধরা হতো আউট বই হিসাবে। আমার জনক এমন ঘেন্নার সাথে নাটক-নভেল পড়ে কথাটা বলতেন যে, সেটা শুনলে মনে হবে যেন উপন্যাস পড়াটা পৃথিবীর জঘন্যতম কোনো কাজ। এই পশ্চাদপদ মানসিকতার বদমেজাজী গৃহকর্তাটির ভয়ে আমাকে অনেক লুকিয়ে চুরিয়ে বই পড়তে হতো। কখনো লেপের নীচে লুকিয়ে, কখনই পাঠ্য বইয়ের নীচে রেখে, কখনো বা তিনি যখন বাসায় থাকতেন না সেই সুযোগে, কখনো বা আব্রাহাম লিংকনের মত সন্ধ্যার পরে বাইরে কোনো ল্যাম্পপোস্টের নীচের আধো আলো আধো অন্ধকারে বসে। গল্পের বইসহ কখনো হাতেনাতে ধরা পড়লে বইয়ের জীবনতো পুরোপুরি শেষ হতোই, আমারটাও পিটিয়ে আধমরা করে ছাড়তেন আমার আব্বাজান।
তখন মূলত সেবার বই পড়তাম। দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম আর নীহাররঞ্জনের কীরিটি রায় পেরিয়ে আমার উত্তরণ ঘটেছে মাসুদ রানায়। কিন্তু, এই বইগুলো ছিল অনেক দুর্লভ। সেবার বই, বিশেষ করে মাসুদ রানাকে তখন প্রাপ্তবয়ষ্কদের বই মনে করা হতো। আমাদের মত কিশোরদের হাতে এই বই দেখলে বড়রা সবাই হাহা করে উঠতো এই বলে যে, দেশ, সমাজ সব একেবারেই রসাতলে গেলো। কেউ বা কান মুচড়ে কেড়ে নিতেন হাত থেকে, বদরাগী কেউ হয়তো সমাজটাকে উচ্ছন্নে যাওয়া থেকে রক্ষা করার মহান উদ্দেশ্যে আমাদের গালে সজোরে চড় কষে দিতেন। আমাদের সমবয়েসী কেউ-ই তখনো মাসুদ রানা কেনার দুঃসাহস দেখায় নি। তারপরেও আমার হাতে মাসুদ রানা এসে পড়েছিল একজন বয়ষ্ক লোকের কল্যানে। আমাদের এক বন্ধুর বাসায় তাদের দূর সম্পর্কের এই লোকটি আশ্রিত অবস্থায় থাকতেন। আমাদের বন্ধুটি জ্যাঠা বলে ডাকতো। তার দেখাদেখি পাড়ার সব কিশোরেরাই তাকে জ্যাঠা বলে ডাকতাম। এই জ্যাঠার মাসুদ রানা পড়ার বাতিক ছিল। তখন প্রতিমাসে একটা করে মাসুদ রানার বই বের হতো। জ্যাঠা প্রতিমাসে নিয়ম করে সেই মাসুদ রানাটি কিনতেন। এই জ্যাঠার সংগ্রহশালা থেকেই আমার মাসুদ রানা পড়ার শুরু। তবে, জ্যাঠাও অনেক সময়ে জ্যাঠামি করতেন। বই আনতে গেলে তিনি সব বই নিতে দিতেন না। এইটা পড়ে তুমি বুঝবা না, কঠিন হয়ে যাবে, এইরকম একটা না একটা অজুহাতে মাসুদ রানার অনেক বই-ই তিনি আমাকে পড়তে দিতেন না। তারপরেও যে দুই চারটা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাতেই নেশা ধরে গিয়েছিল আমার।
নেশা মেটানোর সুযোগ সীমিত। তাই মনমরা হয়ে এর ওর কাছ থেকে ধার করে পানসে পানসে বই পড়ে দিন কাটছিল আমার। ঠিক এরকম সময়েই খোঁজ পেলাম যে অন্য পাড়ায় এক ছেলে বই ভাড়া দেয়। তার কাছে মাসুদ রানার সব বই-ই আছে। শোনামাত্র ওই বাসা চেনে এমন একজনকে পাকড়াও করে হাজির হলাম সেখানে। আসলেই অনেক বই। দুটো শেলফ ভর্তি থরে থরে করে সাজানো। ইচ্ছামত যেটা খুশি সেটা নেওয়া যায়। কোনো ধরণের সেন্সরশীপের ব্যাপার-স্যাপার নেই।
একটা ডিপোজিট দিয়ে একাউন্ট খুললাম। কত টাকা দিয়েছিলাম, এখন আর খেয়াল নেই। কত ভাড়া ছিল বইগুলোর তাও মনে নেই এখন আর। আট আনা বা এক টাকা করে হবে হয়তো। মোটামুটি আয়ত্তের মধ্যে। পয়সা দিয়ে বই কেনার মত অসহনীয় এবং ক্ষমতার বাইরের ব্যাপার নয়।
ওখান থেকে বই এনে নেশা মিটাচ্ছিলাম নিয়মিতভাবেই। একদিন ওই বাসায় গিয়ে একটা নির্দিষ্ট বই খুঁজছিলাম। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওই সময় ওই ছেলে হঠাৎ একটা শক্ত বাধাই এর বই দেখিয়ে বলে যে, এই বইটা পড়েছো। একজন নতুন লেখকের লেখা। অনেক সুন্দর। এটা নিতে পারো। আমার তখন বই এর বিষয়ে এই ধারণা যে, পেপারব্যাক বই মানেই হচ্ছে আসল বই, উত্তেজনাকর বই। বাধাই বই মানেই হচ্ছে নিরস ধরণের সামাজিক বই। পয়সা দিয়ে এটা নেওয়ার চেয়ে মাসুদ রানার আরেকটা বই নেওয়াটা আমার জন্য অনেক বেশি আকর্ষণীয়। আমার মনের ভাবনা আর অনিচ্ছা টের পেয়েই তড়িঘড়ি করে ছেলেটা বলে যে, এর জন্য তোমাকে পয়সা দিতে হবে না। আমি ফ্রি দিচ্ছি। পড়ে ফেরত দিয়ে যেও। বইটা ছিল হুমায়ূন আহমেদের লেখা নন্দিত নরকে। আজকে এতদিন পড়ে ছেলেটার অনুভূতিটা টের পাই। কোনো ভালো বই পড়লে, এটা অন্যকে পড়ানোর জন্য এক ধরণের আকুলিবিকুলি প্রায় সব মানুষের মধ্যেই তৈরি হয়। তবে, ছেলেটার একটা কথা ঠিক ছিল না। বলেছিল যে, নতুন লেখকের নতুন বই। এই বইটা হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন একাত্তর সালে। বই আকারে কবে প্রকাশ হয়েছে তা জানি না। বইটা লেখার এক দশকেরও পরের সময়ে একে আর নতুন বই বলা যায় না। কিন্তু, তখন পর্যন্ত এটা মানুষের চোখের আড়ালে ছিল বলেই হয়তো বইটাকে নতুন বলে মনে হয়েছিল ছেলেটার কাছে।
বাসায় এসে আগে মাসুদ রানাগুলো শেষ করি। সবশেষে শুধু কিছু করার নেই এবং বই পড়ার নেশার কারণে হাতে তুলে নেই নন্দিত নরকে। নরক থেকে একটানে এই বই তুলে আনে আমাকে স্বর্গরাজ্যে। এর আগেও অনেক বই পড়ে কেঁদে ভাসিয়েছি আমি। কিন্তু এই প্রথম বই পড়াকালীন কান্নার সাথে সাথে অদ্ভুত ধরণের এক দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা ছেয়ে ধরে আমাকে। বুকের মধ্যে চেপে ধরা কষ্ট নিয়ে বেশ অনেকগুলো দিন কাটে আমার। এই বইগুলো ফেরত দেওয়ার সময়ে ওই ছেলে জিজ্ঞেস করে, কেমন লেগেছে বইটা? খুব ভালো বলতেই উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে যায় তার মুখ। বলে যে, এই লেখকের আরেকটা বই আছে। সেটা এরকমই সুন্দর। নেবে? এবার আর কোনো দ্বিধা নেই আমার। সঙ্গে সঙ্গেই বগলদাবা করে ফেলি ওটাও। আগেরটার মতই অসম্ভব সুন্দর একটা কাব্যিক নাম। শঙ্খনীল কারাগার।
শঙ্খনীল কারাগার পড়েও সেই একই অনুভূতি আমার। একই রকমের চাপা কষ্ট বুকের ভিতরে, একই রকমের বিষণ্ণতা জেকে বসা হৃদয় জুড়ে। আজ এতদিন পরেও জানি না, দুটো বই পড়ে একই রকমের অনুভূতি কেন হয়েছিল? অন্যদের কী রকম হয়? জানি না। তবে আমার কাছে নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগার জমজ উপন্যাস বলে মনে হয়েছে সবসময়ই। দুটোর লেখার স্টাইল, বিষয়বস্তুর মিলতো রয়েছেই, দুটো উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ চরিত্রগুলোর হুবহু একই নাম রেখেছেন। হতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অত্যন্ত কাছাকাছি সময়ে তিনি দুটো উপন্যাসকে লিখেছিলেন। সেকারণেই একই আদলে গড়ে উঠেছে উপন্যাস দুটি।
এই দুটো উপন্যাস হুমায়ূন আহমেদের অত্যন্ত তরুণ বয়সের লেখা উপন্যাস। কোনটা প্রথম আর কোনটা দ্বিতীয় বলা মুশকিল। যতদূর মনে পড়ে হুমায়ূন আহমেদ কোথায় যেন বলেছিলেন যে, নন্দিত নরকে ছাপা হয়েছে আগে, কিন্তু শঙ্খনীল কারাগার লেখা হয়েছিল নন্দিত নরকের আগে। সে কারণেই আমি এই দুটোকে একসাথে তাঁর প্রথম উপন্যাস বলে বিবেচনা করে থাকি। মজার বিষয় হচ্ছে যে, অপরিণত বয়সে লেখা এ দুটো উপন্যাসই হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই দুটো উপন্যাসের পরে যদি তিনি আর কিছু না লিখতেন, তবে বাংলা সাহিত্য তাঁকে পুজো করতো অসামান্য প্রতিভাবান একজন মানবিক লেখক হিসাবে। তাঁর দুর্ভাগ্য তিনি আরো অসংখ্য উপন্যাস লিখেছিলেন, যেগুলোর বেশ কিছু ভালো মানের আর অধিকাংশগুলোই বস্তাপচা। এই বস্তাপচাগুলোর ক্ষোভেই লোকে তাঁকে নামিয়ে দিয়েছে সাধারণ একজন লেখকের কাতারে। অথচ তারা ভুলে গেছে যে, শঙ্খনীল কারাগার আর নন্দিত নরক ছাড়াও তিনি লিখেছেন মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, কবি, মাতাল হাওয়া, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, বাদশাহ নামদার, শ্যামল ছায়ার মত উপন্যাসসমূহ। হুমায়ূন আহমেদের সেরা দশটি উপন্যাস বাছাই করে নিয়ে এক পাল্লায় ফেলে যদি বলা হয় যে গত চল্লিশ বাংলাদেশের বাকি সব সাহিত্যিকদের সব লেখা থেকে বাছাই করে নিয়ে এসে অন্য পাল্লায় ফেলা হোক, আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হুমায়ূন আহমেদের পাল্লাই ভারি হবে। তারপরেও এই ভদ্রলোককে নিয়ে আমাদের কত কত আজেবাজে কথা। তার সৃষ্টির সাহিত্যমূল্য দিতে কী অপরিসীম কার্পণ্য আমাদের।
নন্দিত নরকে এবং শঙ্খনীল কারাগারের পরে দীর্ঘদিন তিনি আর কিছু লেখেন নি। বিদেশে ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন তাঁর হাত শূন্য। এই সময়েই কেউ একজন তাঁকে পরামর্শ দেয় কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে যেতে। সেবা প্রকাশনীই বাংলাদেশের একমাত্র প্রকাশনী যারা বাড়িতে গিয়ে হলেও লেখকদের দেনা-পাওনা মিটিয়ে দেয়। কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা করার পরে তাঁর হাতে গছিয়ে দেওয়া হয় এ জে কুইনেলের ম্যান অন ফায়ার বইটি। এই বই অবলম্বনে একটা থ্রিলার উপন্যাস লিখে দেবেন হুমায়ূন আহমেদ, এটাই ছিল প্রত্যাশা। এই বইয়ের অনুসরণে হুমায়ূন আহমেদ ছোট্ট একটা উপন্যাস লেখেন অমানুষ নামে। এটি দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল রহস্য পত্রিকায়। হুমায়ূন আহমেদের এই কাজে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি কাজী আনোয়ার হোসেন। পরে তিনি এটাকে অবলম্বন করে মাসুদ রানা সিরিজে বই লেখেন অগ্নিপুরুষ নামে। অগ্নিপুরুষ রানা সিরিজের অন্যতম সেরা একটা বই। কাজী আনোয়ার হোসেন হুমায়ূন আহমেদের কাজে অসন্তুষ্ট হলেও তাঁদের মধ্যে সম্পর্কচ্যূতি ঘটে নি। হুমায়ূন আহমেদের প্যারাসাইকোলজির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা সিক্যুয়েল উপন্যাস দেবী এবং নিশীথিনী প্রথম পেপারব্যাকে প্রকাশিত হয় সেবা থেকেই। এই দুই উপন্যাস দিয়েই জন্ম হয় বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ এক চরিত্র মিসির আলীর। সুকঠিন যুক্তিবাদী এবং অসাধারণ কোমল মনের একজন মানুষ তিনি।
শুধু মিসির আলীই নয়, হুমায়ূন সৃষ্টি করেছেন হিমুর মত এক অযুক্তিবাদী চরিত্র। হিমু আর কেউ নয়, মিসির আলীরই বিপরীত চরিত্র। মিসির আলীর প্রতিটা কাজ যেখানে হিসেবী, হিমু সেখানে চরম বেহিসেবী এক চরিত্র। মিসির আলী যেখানে যুক্তির বাইরে এক পাও নড়েন না, হিমু সেখানে নির্দ্বিধায় অযৌক্তিক কাজ-কারবার করে বেড়ায়। মিসির আলী বা হিমুর বাইরে তিনি সৃষ্টি করেছেন শুভ্র নামের এক অসম্ভব রূপবান তরুণকে। যে তার নামের মতই শুচিশুভ্র, পবিত্র। জগতের কোনো কালিমা তাকে স্পর্শ করে নি।
এগুলো হচ্ছে সিক্যুয়েলের চরিত্র। একটা মাত্র বইয়ে এরা সীমাবদ্ধ নয়। এই চরিত্রগুলো নিয়ে তিনি অসংখ্য বই লিখেছে। এর বাইরেও অসংখ্য স্মরণীয় চরিত্র এঁকেছেন তিনি। তাঁর সৃষ্ট অয়োময়ের মির্জা, লাঠিয়াল সর্দার, কোথাও কেউ নেই এর বাকের ভাই বা মুনা, বহুব্রীহির মামা, নান্দাইলের ইউনুস, এইসব দিনরাত্রির টুনি, নন্দিত নরকের রাবেয়া বা মণ্টু আমাদের মানসপটে উজ্জ্বল হয়ে ভেসে আছে।
আশির দশক হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের দশক। এই এক দশকেই তিনি পালটে দিয়েছেন অনেক কিছু। একের এক বই লিখে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেছেন তিনি। হুহু করে বিক্রি হয়েছে তাঁর বই। তৈরি হয়েছে অসংখ্য পাঠক সারাদেশ জুড়ে। এর আগে বাংলাদেশের বাজার ছিল পশ্চিম বঙ্গের বুদ্ধিবেনিয়াদের দখলে। হুমায়ূন একাই সবগুলোকে কুপোকাত করে ছাড়েন। বাংলাদেশের মানুষ আগে বাংলাদেশের লেখকদের বই কিনতো না, কিনতো পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই। হুমায়ূন সবাইকে ধাক্কিয়ে পিছনের সারিতে নিয়ে যান। বই মেলা জমে উঠে হুমায়ূনের বই দিয়ে।
আশির দশকের শেষের দিকে আর নব্বই এর শুরুর দিকে আন্নার সাথে চুটিয়ে প্রেম করছি আমি। ওকে খুশি করার জন্য নানান রকমারি উৎসবের দিনে বই উপহার দিয়েছি তখন। এর সবগুলোই হুমায়ূন আহমেদের বই। সাত বছর আগে শেষবারের মত দেশে গিয়েছিলাম আমি। গিয়ে দেখি আমার শ্বশুরবাড়িতে সেগুলো খুব যত্নে আরো অনেক বইয়ের সাথে রাখা। ওই বইগুলো খুলে আমার কানটান লজ্জায় লাল হবার দশা। সব বইয়ের শুরুতে প্রথম তারুণ্যের ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে রোম্যান্টিক রোম্যান্টিক কি সব কথাবার্তা লেখা রয়েছে। বিব্রত হয়ে আমি আন্নাকে বলি যে, “এগুলো কি আমি লিখছিলাম।“ ও গলায় নিমের শরবত ঢেলে বলে যে, “জ্বী, জনাব। আপনিই ওইগুলো লিখছিলেন। তখনতো প্রেমিকা ছিলাম। কোকিলের কুহুতান বের হতো আপনার গলা দিয়ে। এখন বান্দি হইছি। তাই কাকের মত কর্কশ চিৎকার বের হয়। আমাকে দূর করতে পারলেই বাঁচেন আপনি।“
তাঁর হাত দিয়েই প্রথম বেরিয়ে আসে বাংলাভাষার সত্যিকারের সায়েন্স ফিকশন। অনেকেই হয়তো আশ্চর্য হবেন। এই কৃতিত্বটা মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে দিতেই উন্মুখ আমরা। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে বাংলা ভাষার সত্যিকারের কল্পবিজ্ঞান লেখার জনক তিনি। তাঁর লেখা তোমাদের জন্য ভালবাসা, ফিহা সমীকরণ কিংবা ইরিনা মন কেড়ে নেবার জন্য যথেষ্ট।
শুধু বইয়ের জগত নয়। টেলিভিশনও দখল নিয়ে নেন তিনি। একের পর এক জনপ্রিয় ধারাবাহিক রচনা করে মাত করে দেন মধ্যবিত্তকে তিনি। টিভি নাটকে সত্যিকারের হাস্যরসও তাঁর অবদান। তাঁর আগে আমজাদ হোসেন জব্বার আলী নামের এক অখাদ্য এবং স্থূল রুচির নাটক দিয়ে ভাঁড়ামো করে লোক হাসানোর চেষ্টা করতেন। হুমায়ূন আহমেদ এসে দেখিয়ে দিলেন সূক্ষ্ণ রসবোধ কাকে বলে। তাঁর নাটক দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে নি, এমন লোক ওই দশকে একজনও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে।
তবে এগুলোর কোনোটাই নয়। আমার কাছে হুমায়ূনের সেরা কাজ হচ্ছে তাঁর ছোটগল্প। অন্যসব বিশাল কাজের ডামাডোলে খুব নীরবে তিনি লিখে গেছেন অসংখ্য অসাধারণ ছোটগল্প। গত চল্লিশ বছরে তাঁর সমতুল্য কেউ আসে নি এই ক্ষেত্রে। কোনো যাদু বাস্তবতা নয়, নয় কোনো পরীক্ষা নিরিক্ষা, খুব সহজ সরল ভাষায় সাধারণ সব মানুষকে চরিত্র করে অনন্য সব গল্প লিখে গেছেন তিনি। চোখ, জলিল সাহেবের পিটিশন, ১৯৭১ এর মত গল্পগুলো অনেক অনেক বছর পরে তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
হুমায়ূন আহমেদের মানের পতন ঘটেছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠার পরে। এর জন্য আমি কোনো দোষ দেই না। জনপ্রিয় একজন সাহিত্যিককে অনেক চাপ সামলাতে হয়। অসংখ্য লোক লেখার বায়না নিয়ে বসে থাকে। কেউ কেউ অগ্রিম টাকা পর্যন্ত দিয়ে আসে জোর করে। এইসব ফরমায়েশি লেখার মান এর থেকে ভালো কিছু হবার কথা নয়। সে কারণেই তিথির নীল তোয়ালে বা হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্মের মত আবর্জনা তৈরি হয়। এই সমস্যাতে শুধু হুমায়ূন আহমেদ না, তসলিমাকেও পড়তে দেখেছি আমরা। তসলিমার প্রায় সব উপন্যাসগুলোই ফরমায়েশি লেখা। প্রকাশকরা লেখার আগেই জোর করে টাকা রেখে যেতো তসলিমার বাসার টেবিলের উপর। সে কারণেই আমরা দেখি তসলিমার উপন্যাসগুলোর কী করুণ দশা।
তবে, এই সমস্ত লেখার জন্য কোনো ভাণ-ভণিতা হুমায়ূন আহমেদ কখনোই করেন নি। লেখা দিয়ে সমাজ পালটে দিতে হবে, এই সমস্ত সস্তা চটকদার সংলাপে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তবে আমার মনে পড়ে যে একসময় কয়েকটা নাটকের শুরুতে তিনি বিদ্রুপ করে লিখে দিয়েছিলেন যে, এখানে শিক্ষণীয় কিছু নেই। তাঁর একটা বই দেখে একবার আহমেদ ছফা (বেজায় ঠোঁটকাটা লোক ছিলেন তিনি) তাঁকে সরাসরি বলেছিলেন যে, এই সব ছাইপাশ লিখছেন কেন? হুমায়ূন আহমদে কোনো মিথ্যা অজুহাত তৈরি করেন নি। সরাসরি বলেছিলেন যে, টাকার জন্য লিখেছি। ওটা লিখে যে টাকা পেয়েছি তা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য রঙিন টেলিভিশন কিনেছি। এরকমই স্পষ্টভাষী ছিলেন তিনি।
একটা জিনিস এখানে বলে যাই। হুমায়ূন আহমেদের বইগুলোর মধ্যে প্রিয় কোনটা জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগ লোকই নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগারের কথা বলবে। আমার এ দুটো অবশ্যই পছন্দের। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেরা পছন্দ হচ্ছে আগুনের পরশমণি নামের মাঝারি আকৃতির উপন্যাসটি। এই উপন্যাসের পটভূমি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকায় আরবান গেরিলাদের আক্রমণ উঠে এসেছে এখানে। একজন নির্লিপ্ত আরবান গেরিলার এক নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে শহরে নানান ধরণের আক্রমণ পরিচালনার গল্প এটি। কী যে দারুণ মুন্সিয়ানা আর দরদ দিয়ে হুমায়ূন ফুটিয়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযোদ্ধাদের আর দেশের প্রতি মমতা মাখানো সাধারণ মানুষদের। অতুলনীয়। কত কত অসংখ্যবার যে আমি পড়েছি এই উপন্যাসটা তার ইয়ত্তা নেই। কত যে চোখের কোণ ভিজেছে আমার উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে তার কোনো হিসেব নেই আমার কাছে। এক সময় স্বপ্ন দেখতাম ফিল্ম বানাবো। যদিও এর ধারে কাছেও যাওয়া হয় নি আমার। ওই স্বপ্নের সাহসেই হয়তো মনে মনে এই উপন্যাসের চিত্রনাট্য সাজাতাম আমি। একদিন হুট করে শুনি হুমায়ূন আহমেদ নিজেই এই উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। একজন প্রথিতজশা সাহিত্যিক, যাঁর চলচ্চিত্র বানানোর কোনো অভিজ্ঞতা, শিক্ষা বা অতীত আগ্রহ নেই, নিজের উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র বানানোতে নেমে পড়াটা একটা বিরল ঘটনা।
পরিচালক হবার জন্য এফডিসিতে বিভিন্ন পরিচালকদের সমন্বয়ে গড়া একটা বোর্ডের সামনে তাঁকে পরীক্ষাও দিতে হয়েছিল। সেই পরীক্ষায় তেত্রিশ পেয়ে কোনো রকমে পাশ করেছিলেন তিনি। ফেলই করার কথা ছিল অবশ্য। তাঁকে চাষী নজরুল ইসলাম প্রশ্ন করেছিলেন যে, একজন পরিচালকের কী কাজ? এর উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন যে, কিছু না, শুধু নায়িকার সাথে ফস্টিনস্টি করা। এই উত্তরের পরে তাঁকে যে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এটা ভাগ্য। ভাগ্য বলছি এ কারণে যে, আগুণের পরশমণি ছাড় পাবার পরে তা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসাবে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিল। সৃষ্টিশীলতা যে পাঠ্যবই পড়ে হয় না, বা পরীক্ষা পাশ করে হয় না, এই বিষয়টা আমাদের শিল্পাঙ্গনের লোকেরাও মনে হয় জানেন না।
আমার অবশ্য এই ছবিটা বেশি পছন্দ হয় নি। আগুনের পরশমণি উপন্যাস হিসাবে যে রকম, ঠিক সেই আমেজটা আমি চলচ্চিত্রে পাই নি। চাঁদ, জোছনা, বৃষ্টি এগুলোর প্রতি হুমায়ূন আহমেদের অতিরিক্ত প্রীতি আর চরিত্র অনুযায়ী শিল্পী নির্বাচনের ব্যর্থতা চলচ্চিত্রের গতিকে ব্যহত করেছে। তাঁর সব চলচ্চিত্রের মধ্যে, আমার মতে, সেরা কাজ হচ্ছে শ্রাবণ মেঘের দিন। এইটা একটা সিনেমা বটে। কী যে দরদ দিয়ে বানিয়েছেন তিনি এই চলচ্চিত্রটি।
জোছনা আর বৃষ্টির গল্প যখন এলো, তখন একটু বলেই ফেলি। আজকে বাংলাদেশে তরুণ তরুণীদের মধ্যে জোছনাস্নাত হওয়া বা বৃষ্টিস্নাত হওয়ার যে একটা রোম্যান্টিক ভাবনা ব্যাপকভাবে কাজ করে, এর পিছনে একক অবদান হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের। তাঁর অত্যন্ত শখের এই জিনিসগুলো তিনি বার বার তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক আর চলচ্চিত্রে ব্যবহার করে, এই সময়ের ছেলেমেয়েদের মগজের মধ্যে তা গেথে দিয়েছেন। মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তার অপরিসীম। সে কারণে আজকাল অনেক ছেলেপেলে হিমুর মত হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাজপথে হেটে যায়।
আমি সাহিত্যবোদ্ধা নই। খুব বেশি সাহিত্যপঠনও আমার হয় নি। কিন্তু, অসংখ্য সাহিত্যিকের বইয়ের গাদা থেকে বই বাছাই করে আমাকে যদি পড়তে বলা হয়, তবে আমি প্রথমে তিনজন লেখকের বই বেছে নেবো। এই তিনজন হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং কাজী আনোয়ার হোসেন। নাহ! এই তিনজনকে আমি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বলে মনে করি না। কিন্তু এই তিনজনের ভয়ংকর শক্তিশালী একটা অস্ত্র আছে, যা বাংলা ভাষার অন্য কোনো সাহিত্যিকের নেই। সেটা হচ্ছে ভাষা। এই তিনজনের গদ্যশৈলী অসম্ভব ঝরঝরে, ছুটে চলা ঝরনার মত ঝিরঝির বহমান, অতি সাদামাটা, আটপৌরে, অলংকরণ শূন্য, নিরাভরান, বাহুল্যবর্জিত ছিপছিপে মেদহীন, কিন্তু মোনালিসার হাসির মতই মোহনীয়, সম্মোহনশক্তিসম্পন্ন। বইয়ের প্রথম লাইন পড়লে আর থামা যায় না। অনেকটা সিডনি শেলডনের বইয়ের মত। ভাষাই টেনে নিয়ে যেতে থাকে লাইন থেকে লাইনে, পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায়, এক বই থেকে আরেক বইয়ে।
জীবনের শেষ দিকে এসে তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে খুব বেশি টানাটানি করেছে লোকে। একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যে তাঁর নিজস্ব একটা বিষয়, সেই বোধটা আমাদের অনেক লোকের মধ্যেই খুব একটা বেশি নেই। আমরা আমাদের নৈতিকতার স্ট্যান্ডার্ডকে দাঁড় করিয়ে দেই একজন সফল মানুষের সামনে। তারপর সেই মাণদণ্ড দিয়ে বিচার করতে চাই তাঁর জীবনকে। হুমায়ূন আহমেদ কেন মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করলো, কেন এতো প্রেম করে বিয়ে করা আর চার সন্তানের জননী স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে ওই কচি মেয়েকে বিয়ে করলো, ইত্যাকার নানান সমালোচনায় তাঁর জীবনটাকে বিষিয়ে দিয়েছে মানুষ। এগুলো যে তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়, সেই বোধটা কারো মধ্যে জন্মায় নি কখনো। তাঁর এই নৈতিক অধঃপতনও (!) তাঁর জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া এবং অসংখ্য সমালোচক তৈরি হবার অন্যতম একটা কারণ।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বাদশাহ নামদার উপন্যাসের ভূমিকাতে হুমায়ূনকে নিয়ে উপন্যাস লেখার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ
হুমায়ূন অতি বিচিত্র এক চরিত্র। যেখানে তিনি সাঁতারই জানেন না। সেখানে সারা জীবন তাঁকে সাঁতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে।
সম্রাট হুমায়ূন বহুবর্ণের মানুষ। তাঁর চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে আলাদা রঙ ব্যবহার করতে হয় নি। আলাদা গল্পও তৈরি করতে হয় নি। নাটকীয় সব ঘটনায় তাঁর জীবন পূর্ণ।
আমাদের এই হুমায়ূনেরও তাই। নাটকীয় সব ঘটনায় তাঁর জীবন পূর্ণ। বর্ণিল তাঁর কর্মকাণ্ড। এখানে তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে আমার আলাদা কোনো ব্রাশ দিয়ে রঙ ছড়াতে হয় নি। হুমায়ূন আহমেদ নিজেই এমন সাতরঙের সমাহার যে, তিনি আপন বৈশিষ্ট্যেই ফুটে উঠেছেন এখানে।
আজ অনেকদিন পর বাদশাহ নামদার বইটা খুলতে গিয়ে একটা জিনিস চোখে পড়লো। আগেও দেখেছি, কিন্তু মনোযোগ দেই নি এতে। এই বইটা তিনি উৎসর্গ করেছেন তাঁর শিশুপুত্র নিনিতকে। সেই উৎসর্গপত্রটা এখানে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। উৎসর্গপত্রটা এরকমঃ
আমার কেবলই মনে হচ্ছে পুত্র নিনিত পিতার কোনো স্মৃতি না নিয়েই বড় হবে। সে যেন আমাকে মনে রাখে এইজন্যে নানান কর্মকাণ্ড করছি। আমি ছবি তুলতে পছন্দ করি না। এখন সুযোগ পেলেই নিনিতকে কোলে নিয়ে ছবি তুলি। এই বইয়ের উৎসর্গপত্রও স্মৃতি মনে রাখা প্রকল্পের অংশ।
হুমায়ূন আহমেদ তাহলেও নিজেও আশংকা করেছিলেন যে, আর বেশিদিন টিকবেন না তিনি। তাই সত্যি হলো। মৃত্যুর আগেও তাঁর প্রবল রসবোধ কমে নি। নিউইয়র্ককে লোকজনকে দাওয়াত করে বলতেন যে, আমার চল্লিশা খেয়ে যান। মরার পরেতো পারবো না, তাই আগেই খাইয়ে দিচ্ছি আপনাদের।
মৃত্যুকে নিয়ে এমন প্রবল রসিকতা শুধু হুমায়ূন আহমেদই করতে পারেন। কুর্নিশ আপনাকে বাদশাহ নামদার।
মোবাইলে পড়লেও কমেন্ট করতে পারিনা। তাই অনেক দেরিতে কমেন্ট করতে হলো।লেখাটা খুবই পছন্দ হয়েছে। কেউ সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। তাই বলে তার ভাল গুণগুলো নিয়ে কথা বলা যাবে না। আমি শিরোনাম দেখেই অনুমান করেছিলাম। এই নিয়ে একটা হুলস্থুল হবে।অনেক জ্ঞানী,গুনি মানুষ আছে কিন্তু সহজ বিষয় সহজ ভাবে নেয়ার মানুষ খুব কম।
হুমায়ূন আহমেদের বিপরীত পাঠ।। ফেবুতে জনৈক মশিউল আলমের নোট
_______________________________________________
_____________
https://t.co/GU1XL7ZI
ফেবু’র ওই নোটটির লিংক এখানে। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
“কিন্তু কোনো জাতির মধ্যে কোনো যুগে এমন কোনো বড় শিল্পীর দেখা মেলে না, যিনি তাঁর সময়ে তাঁর জাতির সামনে উপস্থিত সবচেয়ে জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর প্রতি দৃকপাত করেন না।”
যিনি একথাটি বলেছেন তার বিশ্বসাহিত্য নিয়ে কোনো ধারনাই নেই। বিশ্বসাহিত্যে যুগে যুগে এরকম বহু সেরা সাহিত্যিক এসেছেন যারা তাদের সমসাময়িক যুগের বড়ো বড়ো ইস্যু নিয়ে সামান্যতম মাথা ঘামাননি, োৈদনন্দিন সাধারন ব্যাপারগুলো নিয়েই কালোত্তীর্ন সাহিত্য লিখে গেছেন। ১৯ শতকের ইংরেজী উপন্যাসিকদের মধ্যে এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্ভবত জেন অস্টেন। তিনি তার উপন্যাসগুলো লিখেছেন ১৮০০-১৮১৫ সালের মধ্যে, ইউরোপে যেটা নেপোলিয়নিক যুগ বলে পরিচিত। ফরাসী বিপ্লবের র্যাডিকালিজম, বিশ্বব্যাপী ইং-ফরাসী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, ইউরোপে জাতীয়তাবাদের প্রথম জাগরন, এসব মিলিয়েই সে সময়টা ইতিহাসের অন্যতম অস্থির সময়। সেই সময়ে বসে জেন অস্টেন লিখেছেন ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণীর মেয়েদের নিয়ে রোমান্টিক উপন্যাস। রোমান্টিক উপন্যাসও ঠিক নয়, তার উপন্যাসে প্রেম-টেম এরও তেমন ব্যাপার নেই, শুধু কে কাকে বিয়ে করবে এই নিয়েই উপন্যাস।
জেন অস্টেন এর উপন্যাস এখনো এত পঠিত যে সেগুলো নিয়ে কদিন পর পর নতুন করে মুভি, ড্রামা বানানো হয়। ২০০৪ এর বিবিসি’র এক পোলে ‘প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস’ ইংরেজী সাহিত্যের দ্বিতীয় প্রিয়তম বই নির্বাচিত হয়।
যে চেখভের সাথে আহমেদ ছফা হুমায়ুন কে তুলনা করতে চেয়েছিলেন, সেই চেখভই বা তার গল্প নাটকে সমসাময়িক ইস্যুকে কতটা স্থান দিয়েছেন?
হুমায়ুন আহমেদ বাংলাদেশের জেন অস্টেন হবেন কি না এটা বলা অসম্ভব। তবে আমার ব্যাক্তিগত মত হলো হমায়ুনের বিপরীতে যেসব সমসাময়িক দুস্পাচ্য লেখকের নাম নিয়ে তার প্রতি নাক সিটকানো হয়, তাদের অনেকেরই হুমায়ুনের প্রতিভার সিকিভাগও ছিলো না।
@Shafiq,
(Y)
জর্জ এলিয়ট, গুস্তাভ ফ্লবার, মেলভিল, অ্যালান পো, অস্কার ওয়াইল্ড, সাকি, উডহাউস…।
@Shafiq, অস্টেনের প্রাইড এন্ড প্রেজুডিসের শুরুর দিকে কিছু অংশ পড়েছিলাম, অন্য লেখা অবশ্য পড়া হয়নি। আমার কাছে এটা মোটেই পুতুপুতু প্রেমের উপন্যাস মনে হয় নাই, বরং ব্রিটেনের তৎকালীন সামাজিক মূল্যবোধ ও পুরুষতন্ত্রের চেহারাটাই ফুটে উঠেছে।
হুমায়ুন আহমেদের লেখায় আমি এরকম কিছু পাইনি। মানুষ যা খেতে চায় হুমায়ুন পাঠকদের তাই খাইয়েছেন, একারণেই হুমায়ুন আহমেদ বাঙ্গালীর কাছে দেবতার মত হয়ে গিয়েছেন। আফটার অল, মানুষ ইহজগতে যা চায় ঈশ্বর পরকালে তাকে তাই দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই মানুষের আনুগত্য ধরে রেখেছেন 🙂
লেখাটা আগেই পড়েছিলাম। সময়ের অভাবে কমেন্ট করা হয়নি। একটানে লেখটা পড়ে শেষে এসে একটু অবাক হয়েছিলাম। যাইহোক, এডিট করে দেয়াতে এখন সেই অনুভূতিটুকু আর নেই। লেখা খুব ভাল লেগেছে।
অনেকেই হুমায়ূন আহমেদ এর তীব্র সমালোচনা/গালাগাল করে (আমি নিজেও করি)কারন আমি স্যারের অন্ধভক্ত নই,তবে তার লেখা ভালো লাগত. কিন্তু স্যারের মৃত্যুর পর, আমার মনে হচ্ছে আগামী দশ বছরের মধ্যে এই হুমায়ূন আহমেদ নামের লেখকের উপন্যাস গুলো কালত্তীর্ন উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে..আর তখন স্যারের নাম বাংলা সাহিত্যের কালত্তীর্ন লেখকদের পাশে স্থান করে নিবে. তবে এটা সময়ই বলে দিবে. আমরা যতই তার লেখাকে বস্তাপচা এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সমালোচনা করিনা কেন স্যারের এই ব্যাপক জনপ্রিয়তা কখনো কমে যাবে না বরং আরও বাড়বে ..কারন আমাদের দেশে এই রকম পাঠক জনপ্রায়তা আর কোন লেখক পেয়েছেন কিনা সন্দেহ.. স্যারের অকালমৃত্যু আমাদেরকে আবার তাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখাচ্ছে আর এর মাধ্যমে আমরা যারা স্যারের সাহিত্য মান নিয়ে প্রশ্ন করি আমাদেরকে তার রচিত শঙ্খনীল কারাগার,নন্দিত নরকে,মধ্যাহ্ন,জোত্স্না ও জননীর গল্প,বাদশাহ নামদার এবং ছোট গল্প গুলাকে আবার পড়তে হবে আর এভাবে হয়ত বা হুমায়ূন আহমেদ কে খুজে পাওয়া যাবে….
বিখ্যাত লোকজনদের নিয়ে এই হল বিড়মবনা। মরেও শানতি নাই। এখন কোথায় কবর দেয়া হবে, তাই নিয়ে ঠেলাঠেলি চলছে.
ফরিদ ভাই,হুমায়ুন আহমেদ কে নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা আপনাকে। (F) লেখাটি আমার ভাল লেগেছে।
হুমায়ন আহমেদ কে যদিও আমি মোটেই খুব শক্তিশালী লেখক বলে মনে করি না( যদিও কিছু সুন্দর উপন্যাস তিনি লিখেছেন), তবু এটুকু বলতে চাই যে হুমায়ন আহমেদ আমার খুব প্রিয় লেখক। আমার অবসরের অলস সময় গুলো কেটে যায় হুমায়ুন আহমেদ এর বই( তার মান যেমনই হোক না কেন!) বা কাজি আনোয়ার হোসেন এর মাসুদ রানা সিরিজ পড়ে।
যারা হুমায়ুন আহমেদকে একেবারে বাতিল করে দিতে চান তাদের উদ্দ্যেশ্য এটুকুই বলার আছে আমার আর সেটা হল,হুমায়ুন আহমেদ কেমন লিখেন বা কতটা ভাল লিখেন, অথবা আদৌ ভাল লেখেন কিনা, সেটা অন্য কোন বিতর্কের জন্য রেখে দিলাম।আমি নিজেও হুমায়ন কে কোন দেবতা শ্রেনীতে ফেলার চিন্তাও করি না যেটা প্রায় সব হুমায়ন ভক্ত করে থাকে। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমি হুমায়ন আহমেদের লেখা বইগুলো পছন্দ করি, কারণ কোন কিছুর ওপর আমার ভাল লাগাটা, সেটা কতখানি বিখ্যাত, অথবা অখ্যাত, এটার উপর নির্ভর করে না, বরং ভাললাগা থেকেই আমি হুমায়ুনের বই গুলো পড়ে থাকি, উপভোগ করি, সময় কাটাই, সে জন্য আমি মোটেই লজ্জিত নই।
@অচেনা,
এতে লজ্জিত হবার কী আছে? যারা হুমায়ূন আহমেদকে বাতিল করে দিয়ে সাহিত্যবোদ্ধা সাজতে চেষ্টা করেন, খোঁজ নিলে দেখবেন যে, তাঁদের অনেকেরই বালিশের নীচে হুমায়ূন আহমেদের বই থাকে।
এক সময় আমাদের কাজী আনোয়ার হোসেন আর সেবা নিয়েও আমাদের এরকম একটা লজ্জা এবং কুণ্ঠার অনুভূতি দেবার চেষ্টা করা হতো। কেউ-ই প্রকাশ্যে স্বীকার করতো না যে তারা সেবার বই পড়ে। স্বীকার করলেই যে জাত যেতো। এখন দেখুন কাজী আনোয়ার হোসেন এবং সেবার পূনর্মূল্যায়ন হচ্ছে। করছে সাধারণ পাঠকেরাই, বোদ্ধারা না। বোদ্ধাদের চেয়ে সাধারণ পাঠকেরাই বেশি শক্তিশালী, এটুকু শুধু মনে রাখলেই চলবে।
ফরিদ ভাই,
আপনার সত্য কথনের সৎ-সাহস আমার বড়ই পছন্দ। তবে, এখানে শেষ দিকে একজন ব্যক্তি-বিশেষের উদাহরণটা না আনলেই ভাল হতো না কি?
@প্রতিফলন,
বিষয়টি আমাকেও ধাক্কা দিয়েছে! ফরিদ ভাইয়ের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না!
আমারা কেউ-ই দেবতা নই, নির্ভুল নই। অজানা আবেগে অপ্রত্যাশিত অনেক কাজই করে ফেলি অনেক সময়ে। এটা সেরকমই একটা। যখন করেছি, তখন বুঝি নি। এখন উপলব্ধি হয়েছে যে, কাজটা অনুচিত হয়েছে। মুছে দিয়েছি ওই অংশটা মূল লেখা থেকে।
@ফরিদ ভাই,
আপনি আপনার মহানুভবতাই (যা আপনার কাছে প্রত্যাশিত) প্রমাণ করলেন! :guru: একটা কথা, আপনি যে প্রসঙ্গে বিষয়টি তুলে এনেছিলেন, তা খুবই যৌক্তিক ছিল! সত্যি বলতে কি, হুমায়ুনের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তটা আমারও ভাল লাগেনি, পরে ভেবে দেখেছি যে, হুমায়ুন আমার প্রিয় লেখক ও স্বজন হয়ে উঠেছেন তার ব্যক্তিগত জীবনের জন্য না, তার ইন্দ্রজালিক লেখার জন্য! তাই, হুমায়ুনকে তার ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে পরিমাপ করা বা পরিত্যাগ করা কখনই সম্ভব নয়, উচিতও নয়!
ভাল থাকবেন, ফরিদ ভাই! আপনাকে আরো নিয়মিত পেলে খুশি হই! এখন তো আপনার ব্যস্ততা মনে হয় কমবে!
@প্রতিফলন,
হ্যাঁ, অনেক ভালো হতো। ওই অংশটার জন্য অত্যন্ত লজ্জিত আমি। সম্পাদনা করে মুছে দিয়েছি মূল লেখা থেকে। এর আগেও দেখেছি, আজকেও দেখলাম, আপনি খুব ভালো পরামর্শ দেন আমাকে। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। (F)
@ফরিদ আহমেদ,
এই সেরেছে রে! আপনাকে পরামর্শ দেয়া আমার উদ্দেশ্য ছিলো না মোটেও। একটু কেমন ঠেকেছিল বলেই বলেছিলাম। আপনি যে অন্য অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের মতো “নিজে যা লিখেছি, ঠিকই লিখেছি” ধাঁচের মনোভাব দেখাননি, কিংবা এমন মন্তব্যকে অবজ্ঞাভরে না দেখার ভান করে চলে যাননি, বরং লেখার সম্পাদনা করেছেন, তাতে কিন্তু আপনার উপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। এই শ্রদ্ধা ধরে রাখতে হবে কিন্তু! 🙂
@প্রতিফলন,
আপনি একটি বেশ ভাল কাজ করেছেন। আমিও এটা বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু আর বলা হয়নি। মুক্তমনার একটা বড় গুণ হল, লেখায় কোন সমস্যা বা দুর্বলতা থাকলে কেউ না কেউ সেটা পয়েন্ট আউট করবেনই। আপনি এক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়েছেন দেখে ভাল লাগল।
লেখাটা ফেসবুকে শেয়ার করতে গিয়ে কিছু প্রতিমন্তব্যের মুখে পড়েছিলাম, অনেকেই হুমায়ূন আহমেদের সাথে জিন্নাহর তুলনা করায় বিরক্ত হয়েছিলেন, নমুনা দিচ্ছি –
[img]http://blog.mukto-mona.com/wp-content/uploads/2012/07/badshah_namdar_rana_meher.jpg[/img]
ফরিদ ভাইকে ধন্যবাদ অংশগুলো মুছে দেবার জন্য। এই অংশগুলো বাদ দেয়ায় লেখাটি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে মনে হল।
@অভি দা,
(Y) (Y)
আমরা যখন শরৎচন্দ্র, নীহাররঞ্জন পড়ে বড় হচ্ছিলাম, তখনই একপশলা দখিনা হাওয়ার মত এল নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার- আমরা সাহিত্যে পেলাম পাশের বাড়ির আমেজ!
সবকিছু বড় আপন বলে মনে হোল!
তারপর, নাটক, সিনেমা কি নয়?
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অবহেলিত বয়াতীদের এনে সিনেমা, নাটকে বাংলাদেশের প্রায় হারিয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
প্রত্যন্ত গ্রামে স্কুল করেছেন।
যিনি উজার করে অনেক দিয়েছেন, আর আমরা নিয়েছি, আমাদের যে হাসি, কৌতুক দিয়ে গেছেন তার মূল্যইতো আমাদের জীবনে অনেক অনেক বেশী।
হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগার পড়ে অনেকদিন তার আর কোন বই পড়ে ভাল লাগেনি বলে হুমায়ুন পড়া বন্ধ করেছিলাম। পরে বিভিন্ন আলোচননা পড়ে জোছনা ও জননীর গল্প পড়ি এবং ভাল লাগে। আমি তাঁর কোন ছোট গল্প পড়িনি। ফরিদ আহমেদের লেখা থেকে তার ছোট গল্পের প্রতি আগ্রহ হল এবং শীঘ্রই পড়ব। সাথে আরও কয়েকটি উপন্যাসের নামও জানলাম। ওগুলোও পড়ব।
শুধু হুমায়ুন আহমেদের নয়, প্রথমত, কোন লেখকেরই সব লেখা কারও পছন্দ হবার কথা নয়।
দ্বিতীয়ত, কোন লেখকের কোন লেখাই কারও ই পছন্দ নয় ( পাঠক শুন্য লেখক হতে পারে না ) এমনটি ও হয় না। তৃতীয়ত, আবার কোন লেখকের সব লেখাই কারও কারও পছন্দ হতে পারে। চতুর্থত, আবার অনেক পাঠক কোন কোন লেখকের নামও হয়ত শুনেননি। বা শুনলেই পড়েননি।
তাই বলে এধরনের পাঠকরা নিজেদের মধ্যে অযথা ব্যক্তিগত আক্রমনাত্মক কথা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। কাউকে মুত্রমনা বলা কিন্তু নিজের মুক্ত-মনা হিসেবে পরিচয় বহন করে না, বরং এর বিপরিত।
ধন্যবাদ ফরিদ আহমেদ , ব্যানার নির্মাতা নিলীম ও তাপস, অন্যান্যদেরসহ মুক্ত-মনাকে হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুতে শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশের জন্য। তাদের বিভিন্ন উদ্যোগ তাঁর প্রতি শোক ও শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ। এটাও মুক্ত মনেরই পরিচয়।
দস্যূ মোহন কুয়াশা এরা কি দোষ করলো?
ঐ সব বই পেরিয়ে মাসুদ রানা ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জন্য চুম্বক বই যখন আর কিছুই ছিলো না, তখন সাধারণ মানুষ কি পড়তো? মনে হয়; কিস্-সু না। কোন সব বাংলা লেখকদের চিনতো? তেমন কাউকে না। মনে করিয়ে দেই; বিপুল সংখ্যক ‘সাধারণ’ পাঠকদের কথা বলছি; বোদ্ধাদের কথা নয়। সাপ্তাহিক মাসিক পত্রিকা আর সেবার কিছু পরীক্ষামূলক প্রকাশনা কোনমতে চলতো সেই সময়। কলকাতার লেখাও ততদিনে পানসে, এখনও হালে পানি পাচ্ছে না। ৭৩-৮৩র কথা বলছি। এসময় ‘সাধারণ’ পাঠকরা কি করতো? কি পড়তো? সম্ভবত কিস্-সু না। পাঠকরা মরে গিয়েছিলো বলে আমার ধারণা। টেলিভিশন নাটকের কল্যানে লেখক হুমায়ূন আহমদ একটু একটু করে আম জনতার প্রিয় হয়ে ওঠে। তার বইগুলো পেয়ে সাধারণ মানুষ আবার গল্পের বই পড়ার অভ্যাস ফিরে পায়। বাংলা বই পড়ার পাঠক তৈরীর এই রকম একটা নিপুন মিস্ত্রীই বটে লেখক হুমায়ূন আহমদ।
পাঠক গড়ার মিস্ত্রী; লেখক হূমায়ুন আহমদ, ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা (W)
হুমায়ূন আহমেদের সমালোচকের অভাব নেই, আমিও তাদের একজনই হবো। তবে তাঁর যেকোন সমালোচনার আগে অবশ্যই (অতি অবশ্যই) যে বিষয়ে সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁকে প্রাপ্য সম্মান জানাই – তা হল তাঁর পাঠকপ্রিয়তা, দর্শকপ্রিয়তা। অনেকেই হয়তো সেই পাঠক আর দর্শককূলকে “আমজনতা” আর “সাহিত্যবোদ্ধা নয়”-এর লেবেল এঁটে দিয়ে খাঁটো করে দেখতে চাইবেন, বলবেন, এসব “সস্তা জনপ্রিয়তা”। আমি তাদের সাথে তীব্রভাবে ভিন্নমত প্রকাশ করি। পাঠকই বইয়ের প্রাণ, দর্শকই নাটক বা সিনেমার প্রাণ। এই পাঠক আর দর্শকরা কী অসম্ভবভাবেই না পছন্দ করতো হুমায়ূন আহমেদকে! আমি দেখেছি সেইসব ছোট ভাই-বোনকে যাদেরকে অনেক বলে-কয়েও একটা বই পড়ানো যেতো না, তারা কী আনন্দের সাথেই না হুমায়ূন আহমেদের বই পড়তো! এই পড়ার অভ্যাসটা পরে স্থানান্তরিত হয়েছে অন্য দিকে। তবে, অভ্যাসটাতো গড়ে দিয়েছেন এই “সস্তা” জনপ্রিয় লেখকই। আমি নিজে সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে পড়তাম, রাত জাগতে পারতাম না, অথচ হুমায়ূন আহমেদের নাটক শুনলেই চোখে বারবার পানি দিয়ে জেগে থাকার কী প্রাণান্তকর চেষ্টাই না করতাম! এখন না হয় একঘেয়ে হয়ে গেছে বলে দেখা হয়না খুব একটা। প্রতিদিন বিরিয়ানি খেলে বিরিয়ানিও একঘেয়ে হয়ে যায়! সাধারণ মানুষের মনে স্থান পাওয়ার কারণে যে শ্রদ্ধা জমা আছে হুমায়ূন আহমেদের জন্য, সমালোচনার সমাহার বোধ করি কখনোই তা অতিক্রম করতে পারবে না।
@প্রতিফলন,
(Y) (Y)
এইচএসসির পাঠ্য পুস্তকে একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম, নামঃ রিডিং ফর প্লেজার! প্রবন্ধটির মূল সুর নামেই নিহিত! অথচ এই প্লেজার বিষয়টিকে মনে হয় গৌন করে দেখা হচ্ছে! আমি একজন আপুর কথা জানি। উনি শুধু হুমায়ুন আহমেদের বই পড়তেন! উনি যে পরিবারে বড় হয়েছেন, ওখানে সাহিত্যের ছিটেফোঁটাও ছিল না; কিন্তু উনি হুমায়ুন আহমেদের জন্যই বই পড়তে শিখেছিলেন, আর উনাকে পরিবারের অন্যদের তুলনায় আলাদা মনে হত আমার কাছে!
রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের আলোয় দেখেছিলাম’ এর মত গান আমার ভিতর অন্যরকম অনুভূতি তৈরি করে, কিন্তু পাশাপাশি মমতাজের ‘মরার কোকিল’এর মত গানও আমার ভাল লাগে! কিন্তু এমন যদি বলা হয় যে, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলাম’ই হল সত্যিকারের গান, কথা ও সুরের সৌন্দর্যে অনন্য, আর অন্যদিকে ‘মরার কোকিল’ গান শ্রুতিবাচ্য নয়, শুধু ক্ষণিকের বিনোদন- সেক্ষেত্রে এমন দাবীকে আমার চরম মত বলেই মনে হয়!
আজকের ( জুলাই ২১,২০১২) প্রথম আলো থেকে নেয়া প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের লেখা,
হুমায়ুন আহমেদ ভারতকে কি সব সময় “হিন্দুস্থান” হিসেবেই উল্লেখ করতেন? যা পাকিস্তানপন্থীরা করে থাকেন; দ্বিজাতিতত্বকে যারা মনেপ্রানে ভালোবাসেন এখনো!
জননন্দিত কথাসাহিত্যিকের মরদেহ এখনো সমাহিত করা হয়নি|তাই এই প্রশ্নে অনেকেই আহত হতে পারেন|কিন্ত হুমায়ুন আহমেদ সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমেই তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে|
@ভজন সরকার,
সত্যি কি দাদা পাকি পন্থিরা এটা করে থাকে?তাহলে এই গানটা যে ভারতেই প্রচলিত , সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা… ? একটু বুঝিয়ে বলবেন কি দয়া করে? একটু confusion এ ভুগছি!
@অচেনা,
হিন্দুস্তান ফারসী শব্দ। ভারতে পড়াশোনা করার সময় দেখেছি অনেকেই, (বিশেষ করে যাদের ভাষায় উর্দুর প্রভাব বেশী) ভারতকে হিন্দুস্তান বলেন। আমাদের দেশেও বয়স্ক লোকেরা হিন্দুস্তান শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। অনেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের নামেই হিন্দুস্তান দেখা যায়, যেমন হিন্দুস্তান টাইমস, হিন্দুস্তান লিভার, হিন্দুস্তান মটরস ইত্যাদি। সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা…ইকবাল রচিত একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দেশাত্নবোধক গান। রাজকাপুর তাঁর শ্রী-৪২০ ছবিতে গেয়েছেন, মেরা জুতা হ্যায় জাপানী… … … ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানী, আর হালের রাজা হিন্দুস্তানী ছবির কথাতো আমরা জানি। কাজেই দ্বিজাতিতত্বকে যারা মনেপ্রানে ভালোবাসেন কেবল তারাই হিন্দুস্তান শব্দটি ব্যবহার করেন একথা বলা বোধ হয় ঠিক হবে না।
@মনজুর মুরশেদ, ধন্যবাদ। আমিও আপনার সাথে একমত।
হুমায়ূন আহমেদ একজন অপন্যাসিক ছিলেন। তবুও তাঁর মৃত্যুতে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। বাঙলা সাহিত্যের নষ্টতম ধারাটির জন্ম সম্ভবত তিনিই দিয়েছেন। তারপরও তিনি আমাদেরকে অনেক আনন্দ আর হাসি দিয়েছেন। আনন্দ আর হাসির কিন্তু অনেক দাম, তা তার কোনো সাহিত্যিক দাম থাকুক আর না থাকুক!
যারা হুমায়ূন আহমেদকে ঔপন্যাসিক বলে ধরে নিয়ে বাঙলা সাহিত্যকে যে একটা পর্যায়ে নামিয়ে আনেন, তারা সম্ভবত নিজেদেরকে টেনে ঐ পর্যায়ের উপরে তুলতে অক্ষম বলেই তা করে থাকেন। এতে করে নিজেকেও সাহিত্যিক হিশেবে ধ’রে নেওয়ার একটা সুখ তারা হয়তো উপভোগ করেন। আমি লেখক নই, আমি একজন পাঠক। হুমায়ূন আহমেদের বেশকিছু লেখা আমি পড়েছি, কিন্তু তাঁর কোনো লেখা-ই হুমায়ুন আজাদের মাত্র ছ’পাতার গল্প “জঙ্গল, অথবা লাখ লাখ ছুরিকা” টিরও তুল্য নয়। অপন্যাসিকদের গোপনতম ঈর্ষাটির নাম হুমায়ুন আজাদ। কিন্তু তিনি এতো উপরে যে কারোর পক্ষে তাঁর ধারেকাছে পৌঁছানোও সম্ভব হচ্ছেনা, আর সেই কারণটিই কোনো কোনো নষ্টকে প্ররোচনা যোগাচ্ছে হুমায়ূন আহমেদকে ঔপন্যাসিক বলে ধরে নিতে, যা এক সীমাহীন নষ্টামি।
@আদনান, দুই হুমায়ুনের তুলনা করার দরকার কি? দুজনের মধ্যে ব্যবধান টা অনেক বেশি। কাজেই হুমায়ুন আজাদের সাথে হুমায়ুন আহমেদ কে তুলনা করাটাই তো আজাদ কে সেই পর্যায়ে নামিয়ে আনা।
টেস্ট ক্রিকেট তাই আসল ক্রিকেট।ওয়ানডে কেও মোটামুটি চালান যায়, আর বেশিরভাগ নাক উঁচু বোদ্ধারা টি২০ কে ক্রিকেট বলেই স্বীকার করতে নাক সিটকান।
আমার কথা হল যদি টি২০ এতই নিচু হবে তবে কেন তথাকথিত কিছু বিদগ্ধ ক্রিকেটার টি২০ তে কোনভাবেই রান করতে পারেন না?
হুমায়ুন আহমেদ অবশ্যই ঔপন্যাসিক, হা হয়ত শক্তিশালী নন, তবু ঔপন্যাসিক, কাজেই তাঁকে “অপন্যাসিক” বলে বিদ্রুপ করাটা খুব বেশি যুক্তি সঙ্গত বলে মনে হয় না।
কেন? তাহলে ইমদাদুল হক মিলন যিনি কিনা মোটামুটি সস্তাদরের বাংলা সিনেমার মত লেখা লিখে থাকেন, আপনি কি উনাকে হুমায়ন এর পর্যায়ে ফেলতে চান?
হুমায়ন বড় মাপের লেখক না এটা ঠিক, তবে তাঁকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া ঠিক না।
ঠিক বলেছেন, আনন্দ আর হাসি সবাই দিতে পারেনা। সবাই শুধু পারে প্রচণ্ডভাবে পরচর্চা আর একজনের চরিত্র হনন করতে, ঠিক তাদের বিপরীত যারা কাউকে দেবতার স্তরে নিয়ে যায়। ২টিকেই উগ্রবাদ বলে মনে করি।
আসলে আগেই বলেছি দুজনের মধ্য কোন তুলনা চলতে পারে না, তবু অনেক পাঠক আছেন যারা লেখক কতটা ভারী সেটাই নিজেদের ভাল লাগার মাপকাঠি বানিয়ে নেয় অনেকটা যান্ত্রিক কায়দাতে। যেমন যেহেতু অমুক লিখেছেন, কাজেই এটা ভাল না হয়েই পারে না, এমন উদ্ভট চিন্তা থেকে।
সত্যি বলতে কি ভাই,উন্নাসিক লোকজন কে আমি সযত্নে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করি। কারন মাঝে মাঝে কিছু মানুষের নাক এতই উচুতে উঠে যায় যে তারা কথা বার্তার তাল হারিয়ে ফেলে।
ফরিদ আহমেদকে অসংখ্য ধন্যবাদ হুমায়ুন আহমেদ এর প্রয়ানে এই লেখাটির জন্যে। হুমায়ুন আহমেদ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনে অনেক আনন্দের মুহুর্ত দিয়ে গেছেন। আনন্দ তো অনেক রকমই হয়। অন্জু ঘোষ কিংবা শাবনূরের নাচ দেখেও অনেকে আনন্দ পেয়েছেন। কিন্তু কিছু আনন্দ মানুষকে আরো বড়ো কিছু অনুভূতি-ভাবনার সাথে মিলিয়ে দেয়। হুমায়ুনের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব তিনি কোটি কোটি বাংলাদেশীকে, সোজা ইংরেজিতে uplift করেছেন। তিনি অসংখ্য স্বদেশীকে ফরিদ আহমেদ এর মতো ‘অব্যক্ত কষ্ট’ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। যেসব মানুষ কোনদিন োৈদনন্দিন জীবনের বাইরে কখনো কিছু ভাবে নি, তাদের কাছে এই নতুন অনুভুতিগুলো যে কতো আনন্দের, তা কেবল তারাই বলতে পারে। হুমায়ুন মধ্যবিত্ত বাংলাদেশীদের নতুন যে জগতে নিয়ে এসেছিলেন, আর কেউতো সেই জগৎ ছাপিয়ে নতুন কিছুর সন্ধান দিতে পারেন নি।
আমার কাছে হুমায়ুন সবসময়েই প্রিয় থাকবেন একারনে যে আমি মনে করি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে একমাত্র হুমায়ুন আহমেদই পশ্চিমের মনোজগতকে ধারন করতে পেরেছেন। সেন্স ওফ হিউমার, সেন্স ওফ আইরনি, সেন্স ওফ অ্যাবসার্ড এসব একই সাথে মননে উপস্থিত থাকা এবং সেগুলি অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেবার ক্ষমতা খুবই দূর্লভ একটি জিনিষ। হুমায়ুন সেই সাথে শিল্প ও প্রকৃতির উচ্চমাত্রার সৌন্দর্য উপলদ্ধি করা ও অন্যেকে উপলদ্ধি করতে শেখানো গনমানুষের মধ্যে ছড়াতে পেরেছেন।
লেখাটা অনেক ভাল লাগল। হুমায়ন আহ্মেদ কি নিয়ে এই লেখা আমাকে অনেক কিছু জানালো
আমার মতে হুমায়ূন আহমদ মধ্যবিত্ত সমাজের মনস্তত্ত্ব ভালমতো বুঝতেন। বুঝতেন যুব সম্প্রদায়ের মন মানসিকতা আর ঠিক তাদের চাহিদামতই তিনি লিখতেন ও জানতেন কোথায় স্পর্শ করলে তার লেখা হিট হবে। এটা অবশ্যই তার একটা বড় গুণ। আবার এটাও বুঝতেন কোন কোন স্পর্শকাতর বিষয়ে আঘাত করলে, আলোচনার শীর্ষে আসা যায় অথচ খুব বেশী রিস্ক ও নেয়া হয় না। একারনে তিনি সব সময় থেকেছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে একই ভাবে আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দু।
“বাদশাহ নামদার” এর মন্তব্যটি ভুলবশত প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু মুক্তমনার নীতিমালা
র সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এবং পাঠকদের অভিযোগের ভিত্তিতে মন্তব্যটি মুছে দেয়া হল। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে সবাইকে মুক্তমনার নীতিমালা মেনে মন্তব্য করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
@মুক্তমনা মডারেটর, কোন আপত্তিকর মন্তব্য মুছে দিলে একইসাথে প্রতিমন্তব্যগুলোও মুছে দিয়েন, নইলে অসংলগ্নতা সৃষ্টি হয়।
@মুক্তমনা মডারেটর,
পৃত্থী’র সঙ্গে একমত।
“বাদশাহ নমদার” এর আপত্তিকর মন্তব্য মুছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। একইসঙ্গে বিনীত অনুরোধ প্রতিমন্তব্যগুলোও মুছে দিতে। নইলে প্রকারন্তরে তা “বাদশাহ নমদার” এর কুৎসিত বক্তব্যকে কোনো না কোনো ভাবে বহন করছে।
http://blog.mukto-mona.com/?p=27504#comment-93379
ফরিদ ভাই এর অন্যতম গুন হল তার হাত থেকে যাইই বের হোক না কেন পড়তে ভাল লাগতে বাধ্য (ঝাড়িগুলি ছাড়া অবশ্যই)। তবে আপাতত সময়ের অভাবে পুরো পড়তে পারলাম না, পরে পড়ব।
শুধু একটি ছোট অগুরুত্বপূর্ন তথ্য বিভ্রাট জানিয়ে দেই। তার দেবী এবং নিশীথিনী বের করেছিল সেবা নয়, অবসর প্রকাশনী। অবসর ‘৮৫ সালে জন্ম নিয়ে ভালই করছিল। আরো কিছু পেপার ব্যাক সে আমলে ব্যাংগের ছাতার মত গজাচ্ছিল তাদের তূলনায় অবসর ছিল খুবই অগ্রগামী। কেন জানি না মাত্র বছর ৩/৪ এর মাথায় তারাও নেই হয়ে যায়।
ফরমায়েশি লেখা শুরু করলে লেখকের পতন কেবল সময়ের ব্যাপার, হুমায়ুনের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল বলে আমার ধারনা। বহুদিন পর মনে হয় বাদশাহ নামদার পড়েই শান্তি পেয়েছিলাম ও অন্যদের পড়তে বলেছিলাম। মধ্যাহ্ন, মাতাল হাওয়া ছাড়া গত ১০ বছরে মনে হয় না মনে দাগ কাটার মত কিছু পড়েছি বলে।
নাটকের মান হয়েছিল একই কারনেই আরো করুন।
@আদিল মাহমুদ,
কেনো? আমার ঝাড়িগুলা কি সুললিত ভাষায় লেখা হয় না? ভাষার মাধুর্য কি কম থাকে তাতে? এখন থেকে রাবীন্দ্রিক ভাষায় ঝাড়ি দেবো ভাবছি। 🙂
এই ফাঁকিবাজির জন্য একটা কঠিন ঝাড়ি পাওনা ছিল আপনার। ভাগ্য ভালো আপনার। আপাতত নিরীহ, নির্বিবাদী, নির্বিরোধী, নির্বিষ একটা ভালোমানুষের জীবন যাপন করছি বলে দিলাম না। :))
বই দুটো পেপারব্যাকে পড়েছিলাম বলেই এই ভুলটা হয়েছে। সংশোধন করে দেবার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। (F)
@ফরিদ আহমেদ,
মন খারাপ করবেন না, হুমায়ুনের অন্তিম যাত্রার পর তার সম্পর্কে যেমন ভাল ভাল কথা বলছি তেমনি আপনার ক্ষেত্রেও ঘটবে। চোখের পানি মুছতে মুছতে মরহুম ফরিদ ভাই এর গালিগালাজ সমগ্রও সংকলনের দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারি।
ভাল কথা, ইতিহাস চর্চার খবর কি? সেই লেখার পরের পার্ট কই?
বাংলা পেপার ব্যাক মাত্রই সেবা নহে। কাজীদা গং অমানুষের পর হুমায়ুনের ওপর বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন, অনুবাদের মান নিয়ে তো বটেই, আর্থিক কিছু মনোমালিন্যও হয়েছিল। অমানুষের মান আসলেই তেমন ভাল হয়নি, অগ্নিপুরুষের সাথে তূলনা করলেই বোঝা যায়।
@আদিল মাহমুদ,
চোখ মুছতে মুছতেও ধান্ধাবাজি করলেন। এই না হলে কী আর নবী (ধান্ধাবাজ বললাম না, পীরের আগে যেমন ভণ্ড লাগানোর দরকার নেই, নবীর আগেও ধান্ধাবাজ বিশেষণ লাগানোর দরকার নেই। কী বলেন?) সবচেয়ে সোজা কাজটা কায়দা করে নিজের ঘাড়ে নিচ্ছেন। আরে মিয়া আকাশ মালিক, কুলদা রায় আর নৃপেন সরকারতো এর মধ্যেই এর সংকলন করে ফেলেছেন। ওইগুলা জড়ো করে জোড়া লাগায় দিলেইতো আশিভাগ সংকলনের কাজ শেষ। বাকিটা একটু কষ্ট করা লাগবে অবশ্য আপনার। একা নামের এক অদৃশ্য মহিলাকে খুঁজে বের করতে হবে। সবচেয়ে কঠিন ঝাড়িগুলো আমি এই মহিলাকেই দিছি কি না। 🙂
@বিপ্লব রহমান,
এই রকম অশ্লীল মন্তব্য যে কীভাবে মডারেশন পেরিয়ে এলো কে জানে?
@ফরিদ আহমেদ,
এ ক ম ত। অ্যাডমিন এরই মধ্যে দুঃখ প্রকাশ করে ওই কুৎসিত মন্তব্যটি মুছে দিয়েছেন। কিন্তু এরপর এর প্রতিমন্তব্যগুলো মুছে দেওয়া হচ্ছে না কেনো? 😕
সবাই হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে আলোচনা শুরু করলেই সেটাকে কেন যেন “ইন্টেলেকচুয়াল মাস্টারবেশন” পর্যায়ে নিয়ে যায়।সব কিছুতেই কেন আন্তর্দ্বান্দ্বিক মনোবৃত্তি থাকতে হবে?নির্মল বিনোদন বলে কী কিছু নেই?এত কার্যকারণ না খুঁজে শেষকথা,আমার ভালো লাগে,তাই আমি হুমায়ূন আহমেদ পড়ি।তিনি বাজারি লেখক আর যাই হোন না কেন,এত মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানোর ক্ষমতা আর কারো হয়নি,এদিক দিয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ।একটা প্রজন্মের পাঠাভ্যাস শুরুটা হয়েছে তাঁর হাত ধরেই।তাঁর উপন্যাস পড়ে কারো একটি বারের জন্যেও হাহাকার সৃষ্টি হয়নি এমন মানুষ বোধহয় পাওয়া যাবেনা।
@অর্ণব,
এইটাই হইল আসল কথা। কিন্তু সমস্যা কখন হয় জানেন, যখন শুধু হুমায়ূন সাহিত্য পাঠ করে তাকে বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বানিয়ে দেয়। যার ভালো লাগবে সে পড়বে তাতে কারো বাধা দেয়ার কিছু নেই। কিন্তু হুমায়ূনকে হনু টনু বানিয়ে দিতে গেলেই বিপত্তি হয়।
@অর্ণব,
আমি একমত আপনার সাথে। হ্যাঁ প্রায় সব হুমায়ন ভক্ত যে উনাকে মোটামুটি দেবতা বানিয়ে দিয়েছে, এই জিনিসটা আমার মধ্য যথেষ্ট বিরক্তি উদ্রেক করে, কিন্তু তার পরেও হুমায়ুন আহমেদের লেখা ভাল লাগে, আর তাই তিনি সেরাদের একজন মেনে না নিয়েই বা তাঁকে সেরাদের কাতারে ফেলার নিতান্তই অদরকারি একটা বিষয় এটা ভেবেই তাঁর বইগুলো পড়ি আর উপভোগ করি।কাউকে ভাল লাগার পর তাকে দেবতার কাতারে বিয়ে যাবার জোর একটা প্রচেষ্টা অনেক মানুষের ভিতরে লক্ষ করা যায় , আর এর একটা কারণ হতে পারে , নিজের রুচিকে অন্যের রুচির থেকে অনেক বেশি উন্নত করে দেখানর একটা অসুস্থ প্রচেষ্টা।ভাললাগার সাথে কোনটি সেরা আর কোনটি বাজে, এত কিছু বাছলে চলে না। কাজেই ভাল লাগে বলেই হুমায়ুন আমার খুব প্রিয় লেখক।
একেবারে সঠিক কথা।
দুঃখিত একটা ভুল হয়ে গেছে ।
লিখেছিলাম “বিয়ে যাবার”, আসলে ওটা হবে নিয়ে যাবার
@বাদশাহ নামদার,
ফরিদ আহমেদের লেখাটা বেশ ভাল লেগেছে। অনেক তথ্য জানা গেছে সেখান থেকে। কোন লেখককে ভাল লাগা মন্দ লাগা যার যার রূচীর ব্যপার। আবার সমালোচনাও একটা বড় সাহিত্য- একথা সব সময় মনে রাখবো আমরা। তাই বলে সমালোচনার নামে কাউকে অশালীন ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমন বাঞ্ছনীয় নয়। এ ব্যপারে সবার সচেতন হতে হবে।
ফরিদ ভাইর লেখাটা যেহেতু সাহিত্য আলোচনা না(যদিও এই বিভাগে ফেলেছেন), বলা যায় কিছুটা ভালোবাসা আর আবেগের বহিঃপ্রকাশ সেজন্য এটাকে সিরিকাসভাবে নিচ্ছি না। নইলে লেখার কোন অংশের সাথেই তেমন একমত না আমি। মানে হুমায়ূনের ব্যাপার যে প্রশংসা করা হয়েছে সেটা শুধু উলুবনে মুক্ত ছড়ানোই না উলুবনে ডায়মন্ড ছড়ানোর মতই মনে হইতেছে। :)) :))
তবে একজন লেখকের মৃত্যু সে যেইরকমই হোক না কেন আমাকে আসলেই খুব বেদনাহত করে। হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞ্যাপন করছি।
@সাইফুল ইসলাম,
এটাকে সাহিত্য আলোচনা বলা আসলে ঠিক হবে না। শোকগাথাই হচ্ছে সঠিক শব্দ এবং সঠিক বিভাগ। দুর্ভাগ্য যে, মুক্তমনায় এই বিভাগটাই নেই।
হুমায়ুন আহমেদের প্রয়ান নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে একটি শূন্যতা তৈরি করবে। নয়ের দশকের শুরুতে সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্মে কথা সাহিত্যিক আহমদ ছফার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। মনে আছে, সেখানে তিনি বলেছিলেন:
এখন হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও শরৎ বাবুর তুলনা টেনেছেন।
@বিপ্লব রহমান,
অবশ্যই। বাংলাদেশের জন্য এটাতো আরো বেশি করে সত্যি। গত তিনদশক ধরে তিনি একাইতো একটা বড় অংশ জায়গা দখল করে ছিলেন।
ভয়ংকর শক্তিশালী একটা অস্ত্র আছে, যা বাংলা ভাষার অন্য কোনো সাহিত্যিকের নেই। সেটা হচ্ছে ভাষা। এই তিনজনের গদ্যশৈলী অসম্ভব ঝরঝরে, ছুটে চলা ঝরনার মত ঝিরঝির বহমান, অতি সাদামাটা, আটপৌরে, অলংকরণ শূন্য, নিরাভরান, বাহুল্যবর্জিত ছিপছিপে মেদহীন, কিন্তু মোনালিসার হাসির মতই মোহনীয়, সম্মোহনশক্তিসম্পন্ন। বইয়ের প্রথম লাইন পড়লে আর থামা যায় না। অনেকটা সিডনি শেলডনের বইয়ের মত। ভাষাই টেনে নিয়ে যেতে থাকে লাইন থেকে লাইনে, পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায়, এক বই থেকে আরেক বইয়ে- আর সেই কারণেই কেনো যেনো অজান্তে তার বই হাতে তুলে নিতাম , পড়তে পড়তে হয়তো চোখে জল এসে যেতো বা হাসতাম কেউ দেখে বলতো কিরে হাসছিস কেনো? আর তার লেখা তেমন হাতে আসবে না। আসলে এই সব প্রতিভাশীল মানুষগুলো কে আমরা তাদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের জন্য মানসিকভাবে আঘাত না দিয়ে তাদের কাজের জন্য উৎসাহ দিয়ে অনেক অনেক বছের বাঁচিয়ে রাখতে পারি……
এখানে – ‘বাবাকে মনে রেখ নিনিত’
সহমত যে কোন লেখকের ব্যক্তিগত জীবনকে টেনে অানা সঠিক নয় তার লেখার সমালোচনা করতে গিয়ে। তবে মনে পড়ে, হুমায়ূন আহমেদের সাথে তার প্রথম স্ত্রীর সংকটময় সাংসারিক জীবন যখন বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ার কল্যাণে অনেকেরই মুখরোচক অালোচনার কেন্দ্রে, তখন তিনি একটি দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে “অভিনেত্রী শাওন” এবং “তার মা” এই দুজনের কাছে ক্ষমা চাইলেন শাওন সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় অপপ্রচারের জন্য এবং অস্বীকার করলেন শাওনের সাথে তার কোন সম্পর্কের কথা। বেশ তো। এর কিছুদিন পরেই তিনি শাওনকে বিয়ে করে বসলেন। খারাপ লেগেছিলো।
তবে হুমায়ূন আহমেদের কোন কাজের ন্যায্যতা প্রতিপাদনের জন্য পাকিস্তানের ন্যায় ভ্রষ্ট জাতির উদাহরণ দেয়া সমীচীন নয়। পাকিস্তানের অধিকাংশ লোকজন সঠিক এবং কর্তব্য মনে করে এমন কিছু কাজকে, যার জন্য অাজ সারা বিশ্ব হুমকির মুখে।
বাকি লেখাটুকু ভালো লেগেছে।
@অাকাশ চৌধুরী,
দুঃখজনক হচ্ছে যে, হুমায়ূন আহমেদের নিন্দিত হবার পিছনে শুধুমাত্র তাঁর সস্তা(!) সাহিত্যই দায়ি নয়, কোনো না কোনোভাবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও প্রভাব ফেলেছে তাঁর সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে। এই জায়গাটাতেই আপত্তি রয়েছে আমার। গুলতেকিনকে ফেলে শাওনকে বিয়ে করার আক্রোশ দিয়ে তাঁর সাহিত্যকর্মকে আক্রমণ করে তাঁকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়াটা অন্যায় কাজ।
হুমায়ূন আহমেদের কোন উপন্যাস যদি “মুখের দিকে দেখি” বা “সে রাতে পূর্ণিমা ছিল”, “কালো বরফ”, “চিলেকোঠার সেপাই” বা “খোয়াবনামা”, “জীবন আমার বোন”, “হে সংসার হে লতা”, “পোড়ামাটির কাজ”, “আমার যতো গ্লানি”, মায়ের কাছে যাচ্ছি”, “ক্রাচের কর্নেল” সহ অসংখ্য ভালো উপন্যাসের নাম বলতে পারি- যার ধারে কাছেও হুমায়ূন আহমেদের কোন উপন্যাস যায় নি। যেহেতু আপনি কোন সমালোচনা ছাড়া এটা দাবী করেছেন, তাই বোধহয় সমালোচনা ছাড়াই এটা বাতিল করা যেতে পারে। 🙂
@শফিউল জয়,
আপনার লিস্টের ভিতর থেকে “চিলেকোঠার সেপাই”, “খোয়াবনামা”, “জীবন আমার বোন”, “ক্রাচের কর্নেল” ছাড়া বাকিগুলোর নামও শুনিনি; তবে তার মানে এই নয় যে, সেগুলো ভাল উপন্যাস নয়! ফরিদ ভাই তাও তো দশটি উপন্যাসের মাধ্যমে পাল্লা নির্ধারণের কথা বলেছিলেন, আর আপনি তো ভাই হুমায়ুন আহমেদকে পু্রাই খারিজ করে দিলেন! হুমায়ুনের সবচেয়ে বড় সমালোচকরাও ‘নন্দিত নরক’-কে অস্বীকার করতে পারেন না, আর আপনি হুমায়ুনের একটি বইও পেলেন না আপনার লিস্টের সমতুল্য? আখতারুজ্জামান স্যারের বইগুলো অবশ্যই বাংলা ভাষার সম্পদ, কিন্তু ‘ক্রাচের কর্নেল’? অনেকের মতেই, বইটির সাহিত্যমূল্য হারিয়ে গেছে ইতিহাসের ঘনঘটায়!
আমি আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে যেটুকু বুঝি, হুমায়ুনের অসংখ্য কালজয়ী বই আছে, যদিও তার শেষদিকের অনেক বই আবার ফরিদ ভাইয়ের ভাষাতেই ‘বস্তাপচা’! তবে হুমায়ুনকে যেইসকল অভিজাত বংগজ সাহিত্যিকবৃন্দ সবসময় অবজ্ঞা করতেন, তাদের লেখাও পড়ে দেখেছি! হুমায়ুনের ভাষার মাধুর্য, গল্প বলার অনবদ্য ভঙ্গি, হিউমার, উইট – এসব কিছুই নেই তাদের লেখায়! আর এসব থাকার কথাও নয়! কারণ ঐসব লেখকরা তো আর ফরমায়েসি লেখা লেখেন না! পাঠকদের দিকে তাকানোর সময় কোথায় তাদের? তারা রচনা করেন উঁচু দরের শিল্প, হুমায়ুনের মত ‘সস্তা’ দরের লেখার কথা তারা ভাবতেই পারেন না!
@কাজি মামুন,
নাম শুনে পড়লেই বুঝতে পারবেন আমি কেন বলেছি, বা যাদেরকে এলিট সাহিত্যিক বলা হয়, বা যারা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের কথা শুনে নাক কুঁচকায়- তারা আসলেই কেন এই কাজটা করে। জীবনানন্দ দাশের অনেক গৌণ কবিতা আছে, যেটার থেকে খারাপ কবিতা লিখে অনেক কবি সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন। ব্যাপারটার সাথে কোয়ালিটি আর কোয়ানটিটির একটা যোগসূত্র আছে, কিন্তু আমি কোয়ালিটিতেই বিশ্বাসী। কেননা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ উপন্যাস লিখেছিলেন তিনটা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস দুইটা। মোটামুটি এই দুইজনের কথা আপাতত ধরলাম। তাই বলে যে এর ব্যত্যয় হয় না- তা বলি নি। আমি আগেই বলেছি, যেহেতু ফরিদ ভাই কোন সমালোচনা করেন নি, আমিও করার প্রয়োজন বোধ করি নি। যদি করতেন, তাহলে তুলনামূলক আলোচনা করা সমহভব হতো। আর যেহেতু শব্দটা তুলনামূলক, তাই আশা করবো বাঙলা সাহিত্যের এই অমূল্য সম্পদগুলো পড়েই আলোচনা করবেন- সেটাই ভালো হবে। আর ক্রাচের কর্নেলের অভিযোগটা সত্য, অনেকটাই সত্য- কিন্তু আসলে সেটা কেন ভালো উপন্যাস, এটা আলোচনা করা প্রয়োজন। সেটা এই পোস্টের উদ্দেশ্য না।
উপরের বইগুলো মাহমুদুল হক, শহীদুল জহির, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ শামসুল হক, রশীদ করিমের লেখা। এদের মুন্সিয়ানা বা স্টাইল নিয়ে যদি আপনার সন্দেহ থাকে- তাহলে খুব সম্ভবত বাঙলা সমালোচনা সাহিত্যের ধারায় আপনি নতুন অভিনব মুখ, তবে নিঃসন্দেহে যারা সাহিত্যে হাল্কাপাতলা চুল্কাচুল্কি চায়, এতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারে। আপনার সন্তুষ্টি নিয়ে আমার বিরোধ নেই, কিন্তু সাহিত্য নামের লেবেলটা লাগাতে হলে সেটা যৌক্তিক আলোচনা সহকারেই নিতে হবে। তা না হলে অযথা “ভাষার মাধুর্য, গল্প বলার অনবদ্য ভঙ্গি, হিউমার, উইট” শব্দগুলোর নতুন ব্যাখ্যা দিতে হবে- যেটা সাহিত্যিক মানদণ্ড ছুঁয়ে যায়।
অবশ্য একেকজনের মানদণ্ড একেকরকম। তাই তুলনামূলক মানদণ্ড দাঁড়া করাতে গেলে অন্তত গত চল্লিশ বছরের সাহিত্য মহলে আলোচিত বা শ্রেষ্ঠ কাজগুলো পড়ে ফেলা।
@শফিউল জয়,
ভাই, আমি কিন্তু আগেই বলেছি, আমি শুনিনি বা পড়িনি বলে যে সেগুলো ভাল উপন্যাস নয় বা হতে পারে না তা নয়! আর আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ! আমি বইগুলোর নাম আমার ডায়েরিতে লিখে নিয়েছি, চেষ্টা করব খুব শীঘ্রই যোগাড় করে পড়ে ফেলার ফেলার! অথবা আপনি যদি কোন ডাউনলোড লিংক দেন, কৃতজ্ঞ থাকব! তবে আপনার লিস্টের লেখাগুলো বেশী ভাল না হুমায়ুন আহমেদের, এ ধরনের তুলনামূলক আলোচনায় কিন্তু আমি যাইনি; আমার আপত্তি হল, আপনার ”সহ অসংখ্য ভালো উপন্যাসের নাম বলতে পারি- যার ধারে কাছেও হুমায়ূন আহমেদের কোন উপন্যাস যায় নি।”- এ ধরনের চরম অবস্থান নিয়ে! বস্তুত হুমায়ুন আহমেদের কোন উপন্যাসকেই আপনি বোধহয় গোনায় ধরতে চান না, বা সাহিত্য পদবাচ্য বলে মনে করেন না! অথচ দ্যাখেন, হুমায়ুনের অনেক ঘোর সমালোচকও ‘নন্দিত নরকে’র আবেদন অস্বীকার করতে পারেননি!
আপনি যে লাইনটিকে উদ্ধৃত করে উপরের কথাটা বললেন, সেখানে এদের লেখা নিয়ে কোন সন্দেহ ব্যক্ত হয়েছে? মাহমুদুল হক তো বরেন্য লেখক! শহীদুল জহিরের ছোটগল্প অনবদ্য!
হুমায়ুন আহমেদের সব লেখাই আপনার কাছে হাল্কা চুল্কানি মনে হয়? আপনি পড়েছেন সবগুলো? দেখুন, আমি তার বেশ কিছু বইকে কোট করেছি আমার মন্তব্যে। ফরিদ ভাইও অনেকগুলো নাম উল্লেখ করেছেন! এ সবই আপনার কাছে অপাঠ্য? হুমায়ুনের বস্তাপচা ও অপাঠ্য বই যে নেই, তা নয় এবং ফরিদ ভাই তা উল্লেখও করেছেন! কিন্তু আপনি মনে হয় বড্ড সাধারণীকরণ করে ফেলছেন! আপনি “ভাষার মাধুর্য, গল্প বলার অনবদ্য ভঙ্গি, হিউমার, উইট” শব্দগুলোর নতুন ব্যাখ্যা দেয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু আমরা কি আপনার কাছে ‘হাল্কা চুল্কাচুল্কি’ শব্দের ব্যাখা আশা করতে পারি, যা আপনার ভাষায় ‘সাহিত্যের মানদ্বন্ড ছুঁয়ে যায় ‘ না? আপনি দয়া করে দেখিয়ে দেবেন, হুমায়ুন আহমেদের উদ্ধৃত বইগুলোতে কোন জায়গাগুলো ‘হাল্কা চুলকানি’ রোগে আক্রান্ত? হুমায়ুনের লেখার একটি বড় গুণ হচ্ছে, তার ঝরঝরে সহজ ভাষা আর সূক্ষ রসবোধ এবং চিরায়ত সাহিত্যে এগুলোকে উত্তম লেখার আবশ্যিক শর্ত হিসেবে ধরা হয় বলেই জানি! কিন্তু আপনি মনে হয়, এগুলোকেই চুল্কানির দায়ে অভিযুক্ত করতে চাইছেন! যেহেতু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যগুলোর সাথে আপনি ব্যাপকভাবে পরিচিত, তাই আপনার কাছে এই বিষয়ে সামান্য আলোকপাত আশা করছি!
ভাল থাকবেন!
@কাজি মামুন,
ঠিক, অন্তত তাঁর উপন্যাস না। নন্দিত নরকে নিয়ে অনেক লাফালাফি করা হয়, কিন্তু যে সমালোচনাগুলোর কথা বলা হয়- সেগুলো মোদ্দাকথা হচ্ছে তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক ছিলেন, যিনি ভবিষ্যতে আরও ভালোভাবে লিখতে পারতেন। সেই সম্ভাবনা তিনি নিজেই নষ্ট করেছেন। সেটা ছফা একাধিকবার বলেছেন। এই মুহূর্তে মনে আসছে “আহমেদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী” বইটি। শঙ্খনীল কারাগার নিয়েও আমি উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু দেখি না, সেখানেই হুমায়ূন আহমেদের যে ভরাডুবি শুরু, তাঁর সূচনা হয়ে গিয়েছে। এটা উপন্যাস না বলে উপন্যাসিকা বলাই ভালো। রশীদ করিমের একটা আলোচনা ছিল এই বইটা নিয়ে। আমি সেটা তুলে দিচ্ছি, কারণ ঠিক একই জায়গাগুলোতে আমার আপত্তি রয়ে যায়। রশীদ করীম তিনটা আপত্তি তুলেছিলেনঃ
১। রাবেয়া যখন খোকাকে বলছে রুনু আর বাঁচবে না তখন্ অশরীরী আত্মার কথা এনেছে। রশীদ করীমের প্রথম প্রশ্ন ছিল, লেখক কি ভূত প্রেতে বিশ্বাস করেন। আমারও একই প্রশ্ন। এতে আপত্তি নেই বিশ্বাস করলে, কিন্তু একটা এই ধরণের উপন্যাসিকায় ভূত প্রেতের অস্তিত্ব তাঁর সাহিত্যগুণকে কতোখানি সমৃদ্ধ করতে পারে সেটা ভাববার ব্যাপার।
২।রাবেয়া আর খোকার জননী প্রথম স্বামীকে ভুলতে পারে নি। এই ঘটনাটি ঢেকে না বললে “অলে বেরলে” স্ত্রী পুরুষের সম্পর্কের রহস্যটা আমরা আরও বুঝতে পারতাম। তিনি কেন করেন নি।
৩। যে রাবেয়া তাঁর ভাইবোনের মাঝে মাতৃস্থানীয় মর্যাদার অধিকারী ছিল, তাকে কেন একেবারেই অকারণে শেষে ফিল্মি নায়িকার মতো, ভাইবোন থেকে অনেক দূরে পাঠানো হোল?
আমার কাছেও এই তিনটা প্রশ্ন, সম্ভবত কোন সদুত্তর নেই, থাকলেও কতোটা গ্রহণযোগ্য সেটা প্রশ্নের সম্মুখীন। তাই রশীদ করীম বলেছিলেন, উপন্যাস থেকে অনেক ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু টেলিভিশনের পর্দার ওপর চোখ রেখে উপন্যাস রচনা করা ঠিক না। উপন্যাসিকরা উপন্যাস লিখুক, চলচিত্রওয়ালারাই চিত্রনাট্য লিখুক।
এটাই আসল কথা। যেহেতু আমরা এখানে হুমায়ূন আহমেদেরউপন্যাসিক সত্ত্বা নিয়ে আলোচনা করছি, তাই এটা জলজ্যান্ত প্রশ্ন থেকে যায়।
হাল্কা চুল্কাচুল্কি হচ্ছে সেই জিনিশ যেটা পড়ে ভালো লাগে, কিন্তু আদৌ কোন সাহিত্যআবেদন নেই। সাহিত্যে ব্যাপকঅর্থে ব্যবহৃত একটা শব্দ, যেটার বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি হুমায়ূন আহমেদে নেই। কেন নেই- এই উত্তর আপাতত প্রাসঙ্গিক না, কারণ লেখক বা আপনি যদি কিছু সাহিত্য আলোচনাসমেত দাবী করতেন, তাহলে হয়তো সেটা খণ্ডানো যেত। ওপরে শঙ্খনীল কারাগারের চিত্রনাট্য লেখার যে অভিযোগ, সেটা পড়তে পাঠকের ভালো লাগে, কিতু সাহিত্যসয়ার নেই। এবং সেটা রশীদ করীম বুঝতে পেরেছেন বলেই লিখেছেন, চিত্রনাট্য চলচ্চিত্রওয়ালারাই লিখুক। এইযে এই “মিছে মিছে আবেগের ছিনিমিনি”, যেটা অপরিণত পাঠকদের দিলে আরাম দেয়- সেটাই চুল্কাচুল্কি বলে জানি। আর প্রশ্ন আমি আগে করেছি, সেটার উত্তর না দিয়ে আপনি পাল্টা প্রশ্ন করেছেন আমাকে। 🙂 ব্যাপারটা সন্দেহজনক।
তাহলে ভুল জানেন, সাহিত্যে কোন চিরায়ত নিয়ম নেই। প্রখ্যাত উপন্যাসিক জেমস জয়েস বলেছিলেন, তাঁর লেখা নিয়ে পাঠকরা যাতে একটু কষ্ট করে পড়ে। আমাদের শহীদুল জহির কিংবা মাহমুদুল হকের ভাষাশৈলী আর হুমায়ূন আহমেদের ভাষাশৈলী পুরো আলাদা বলা যায়, একটা সরল- আরেকটা বেশী মাখিয়ে দেয়া। দুটোই ভালো লাগে, কিন্তু উপন্যাসের ভাষাই একমাত্র উপাদান না, আর আমি উপরেও বলেছি সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বা শাহাদুজ্জামান বা কাজল শাহনেওয়াজের গদ্যও কতো সাবলীল। আলোচনাটা শুরু হয়েছিল ৪০ বছরের প্রেক্ষাপটে।
সন্দেহ ব্যক্ত করা হয় নি, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে দেবতার আসনে বসানো হয়েছে এটা বলে , “হুমায়ূন আহমেদের সেরা দশটি উপন্যাস বাছাই করে নিয়ে এক পাল্লায় ফেলে যদি বলা হয় যে গত চল্লিশ বাংলাদেশের বাকি সব সাহিত্যিকদের সব লেখা থেকে বাছাই করে নিয়ে এসে অন্য পাল্লায় ফেলা হোক, আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হুমায়ূন আহমেদের পাল্লাই ভারি হবে। আর গত চল্লিশ বছরে তাঁর সমতুল্য কেউ আসে নি এই ক্ষেত্রে । আপনার বিরুদ্ধে আমার প্রধানতম অভিযোগ,
হুমায়ূনকে অবজ্ঞা কে করেন নি? অনেকেই করেছেন, কিন্তু সবচেয়ে সামনে এসেছে আহমেদ ছফা আর হুমায়ুন আজাদের- এই দুইজনেই বোধহয় তাঁর কঠোর সমালোচক। তাঁদের লেখায় কী কিছুই নেই? এটা পুরোপুরি ভ্রান্ত ধারণা। গাভী বৃত্তান্ত বা শুভব্রত, তাঁর সম্পর্কিত সুসমাচারের উইট যদি ধরতে না পারেন, তাহলে সেটা লেখকের ব্যর্থতা না, ব্যর্থতা সম্পূর্ণ পাঠকের।
ভালো থাকবেন।
@কাজি মামুন,
জয়তো তাও কিছুটা ক্রেডিট দিছে আমি ভাই তাও দিতে রাজি না। বিনোদন আর সাহিত্য এক জিনিস না। রসময়গুপ্তের লেখা পইড়া মানুষ বিনোদন পায়, কিন্তু মার্কেজের লেখা পইড়া মানুষ বিনোদন পায় না। মানুষ নতুনভাবে একবার জন্মায়। যেইটা হুমায়ূনের বই পইড়া পাওয়া বা হওয়া অসম্ভব।
আমি আপনারে একটা সহজ কাজ দেই, করেন, তারপরেই আপনি নিজেই বুঝবেন অনেক কিছু।
হুমায়ুন আজাদের “কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ” নামে একটা উপন্যাস আছে। একবার পইড়েন কষ্ট কইরা। তারপরে পাঠ প্রতিক্রিয়ায় আমারে জানাইয়েন এই একটা মাত্র বইয়ের সমান ভার হুমায়ূন আহমেদের সমস্ত লেখার আছে কী না। জাস্ট এই একটা বইই পইড়েন।
@সাইফুল ইসলাম,
এই ধরণের আলোচনায় অংশ নেয়ার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল, অনেক কিছু শেখা যায়, জানা যায়! হুমায়ুন আজাদের “কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ” অবশ্যই পড়ব, আর পড়ে যে ‘আমার নতুন করে জন্ম হবে’- সেই সম্ভাবনাও অস্বীকার করছি না! কিন্তু সেই নতুন জন্ম আমার আগের জন্মগুলোকে বাতিল করতে পারবে বলে মনে হয় না, কারণ তাহলে আমার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হবে! আমি আসলে প্রতিনিয়ত জন্মাচ্ছি, হুমায়ুনের নিষাদ, তারা তিনজন পড়ে জন্মেছি, ইলিয়াস স্যারের চিলেকোঠার সেপাই পড়ে জন্মেছি, রবীন্দ্রনাথের গান যতবার শুনি ততবারই জন্মাই, নজরুলের বিদ্রোহী পড়ে জন্মাই, এমনকি ব্লগের সমৃদ্ধ লেখাগুলো পড়েও জন্মাই! জানি না আপনি জন্মানো বলতে কি বুঝিয়েছেন, তবে আমার কাছে চিন্তা-চেতনায় আলোড়ন তোলা, বোধকে নাড়া দেয়া মানেই জন্মানো!
হুমায়ুন আজাদের বইটি সাজেস্ট করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ! অচিরেই কিনছি! ভাল থাকবেন!
@শফিউল জয়,
কেন থাকবে না? বাংলাদেশের যুক্তির আন্দোলনে তাদের লেখা অক্ষয় হয়ে থাকবে! কেউ যদি চিন্তা-চেতনায় ঋদ্ধ হতে চায়, তাকে আহমেদ ছফা আর হুমায়ুন আজাদের কাছে ফিরে যেতে হবে!
আহমেদ ছফা হুমায়ুন আহমেদের খুব কাছের লোক ছিলেন, দুঃসময়ে তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন! আর হুমায়ুন আজাদকেও গুরু মানতেন হুমায়ুন আহমেদ! নিজের সেরা কিছু বই দিয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদকে মতামত দেয়ার জন্য, কিন্তু কঠোর সাহিত্য সমালোচক হুমায়ুন আজাদের কাছে সে বইগুলো মোটেও ভাল লাগেনি! তাই বলে হুমায়ুন আহমেদের লেখা অপাংক্তেয় হয়ে যায় না! স্মরণযোগ্য যে, হুমায়ুন আজাদ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলেরও কঠোর সমালোচক ছিলেন! রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলো পাশ্চাত্য লেখার অনুকরণে লেখা হয়েছিল বলে মনে হয়েছে তার কাছে, আর নজরুল তো একজন অন্ত্যমিল-কারক ছাড়া কিছুই ছিলেন না হুমায়ুন আজাদের কাছে! তো হুমায়ুন আজাদ এমন চরম মত দিয়েছিলেন বলে তিনিও অপাংক্তেয় হয়ে যান না! বিশেষ করে, হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে হুমায়ুন আহমেদের নির্মম উক্তি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়!
আপনার সমৃদ্ধ আলোচনার জন্য অনেক ধন্যবাদ!
@কাজি মামুন,
আমি যা বললাম, সেই প্রসঙ্গে আপনার এই কমেন্ট তো না। আমি তো তাঁদের সমালোচনার কথা বলি নি। আমি বলেছিলাম যে, আপনি বলেছিলেন- হুমায়ূন আহমেদের সমালোচকদের লেখায় হিউমার, উইট কিছুই নেই।
আর পাশ্চাত্যের অনুকরণ বলতে কী বুঝিয়েছেন সেটা খোলাসা করা জরুরী। সেটা ব্যাপকঅর্থে। সে বলেছিল, ইউরোপীয় ফর্মে প্রথম উপন্যাস লেখার কথা এবং চোখের বালির শেষের কিছু অংশ বাদে বলেছিল এটা বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সংযোজন হতে পারতো । সেটা, মানে সেই রোম্যান্টিক চেতনা রবীন্দ্রনাথ ধার করেছিলেন পশ্চিম থেকে। এই বঙ্গে কেউ কোন একক কোন মৌলিক শিল্পআন্দোলনের উদ্ভাবক ছিলেন না। না বোদলেয়ারের মতো, না মালার্মের মতো, না কোন রোম্যান্টিসিজমের নেতৃত্বের মতো। সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মৌলিক না, জীবনানন্দ দাশও মৌলিক না। আর কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করলেও তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা, তিনি নজরুলের পঙক্তির পর পঙক্তি কীভাবে মুখস্ত রাখেন- সেটাও। নজরুলকে নিয়ে তাঁর একটা কবিতাও আছে। তাঁর “বাঙলা ভাষা” কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, “তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম”। এখানে অন্য কেউ আসতে পারত- কিন্তু তিনি নজরুলকেই এনেছিলেন। সেটার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছিলেন। তাই কেউ যদি তাকে বলে, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি চরম মত দিয়েছেন- সেটা আরেকবার ভেবে দেখবার বিষয়। 🙂
যাই হোক, প্রচুর ক্লান্ত লাগছে। এই পর্যন্তই থাক। ভালো থাকবেন। আলোচনা করে ভালো লাগলো। 🙂
@শফিউল জয়,
বাহ্! খুব ভালো লাগলো আপনার আলোচনা। (Y)
@রূপম (ধ্রুব),
ধন্যবাদ। 🙂 🙂
@শফিউল জয়,
অসুবিধা কী? দাও বাতিল করে। কে তোমাকে মানা করেছে? আজবতো!! যার নেবার সে নেবে, যার বাতিল করার সে বাতিল করবে। সাহিত্যতো স্বতসিদ্ধ কিছু না যে, সবাইকে একমত হতে হবে, এক রাস্তা দিয়ে পিপড়ের মত সারি বেঁধে চলতে হবে।
@শফিউল জয়,
ভাই, এতো এতো কমেন্ট পড়ার পর আমার একটা কথা লিখতে খুব মন চাইতেসে! সিরিয়াসলি নেয়ার কোন কারন নাই। হুমায়ুন আহমেদ আমারও যে খুব পছন্দের লেখক তা না। আমি তার খুব কম লেখাই পড়েছি। আমি তাকে খুব বেশি পছন্দও করি না। তবুও একটা কথা না বলে পারছি না।
জীবনানন্দ আর রবীন্দ্রনাথ এর পার্থক্যটা আমার কাছে সরলভাবে কি মনে হয় জানেন? জীবনানন্দ অনেক ক্ষেত্রেই সাধারন পাঠক যারা কবিতা পছন্দ করেন/করেন না প্রায় সময়ই তাদের মাথার উপর দিয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথেরটা যায় মাথার ভেতর দিয়ে। এজন্য রবীন্দ্রনাথ সার্বজনীন কিন্তু জীবনানন্দ সেটা নন।
এখানেই হুমায়ূন আহমেদের সাথে আপনি অন্য যাদের নাম নিলেন তাদের পার্থক্য। আপনি যাদের নাম নিলেন তাদের দু তিন জনই আমার যথেষ্ঠ পছন্দের লেখক। সে তুলনায় আমি হুমায়ুন আহমেদ খুব বেশি পড়িনি। কিন্তু ঝামেলাটা হল এই যে আপনি যদি হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বাজে উপন্যাসটারও কোনমতে একপৃষ্ঠা পড়ে ফেলেন তাহলে দেখবেন বাকিটুকু আপনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একজন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা হুমায়ুন আজাদের বেলাতে তা কিন্তু হয় না বললেই চলে।
হুমায়ূন আহমেদ এখানেই সেরা।
ইয়ে! হুমায়ুন আর রবীন্দ্র কে এক কাতারে ফেলে দিচ্ছি মনে করে বইসেন না যেন!! 😛
@তানভী,
হইতে পারে। আমার কাছে সেরকম মনে হয় না।
হুমায়ুনের অতি প্রিয় ছিল বর্ষা! সেই বর্ষাতেই বিদায় নিলেন তিনি!
কিছুদিন আগে আমরা আর এক হুমায়ুনকে হারিয়েছি! হুমায়ুন ফরিদি ছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, আর হুমায়ুন আহমেদ শ্রেষ্ঠ কথা সাহিত্যিক!
বেশকিছু বিষয়ে আপনার শৈশবের সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছি আমি! হন্যে হয়ে বই খুঁজতাম আমি, যাদের কাছেই বইয়ের কালেকশন থাকত, তাদের দ্বারে ধর্না দিতাম বারবার! আমার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে শরৎচন্দ্রের বই নিয়ে পড়তাম! একদিন উনি বললেন, নতুন একজন লেখকের বই আছে উনার কাছে, প্রায় আটটি উপন্যাস রয়েছে তাতে। অপরিচিত লেখকের নাম শুনে তেমন আগ্রহ বোধ করলাম না, তবু হাতে অন্য কিছু পড়ার নেই বলে বইটি নিলাম। উপন্যাসের লিস্টে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হল, আমার আছে জল। পড়তে শুরু করলাম, এবং একসময় খেয়াল করলাম, নিজের অজান্তেই বইয়ের অর্ধেকটা পড়ে ফেলেছি! তখন লেখকের নাম ও ছবির দিকে ভাল করে তাকালাম! লেখকের নাম হুমায়ুন আহমেদ? এই অসাধারণ ভাষা , অনবদ্য গল্প উনার? আমাদের দেশের লেখক? মনে পড়ে, ঐ সংকলনের সবগুলো উপন্যাস মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়েছিলাম, ওখানে ছিল, ১৯৭১, আগুনের পরশমণি, নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, অচিনপুর, নির্বাসন প্রভৃতি! ওটি ছিলা হুমায়ুন আহমেদের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের একটি সংকলন!
সম্পূর্ণ একমত! আমার মতে, ‘নিষাদ’ বাংলা ভাষার একটি শ্রেষ্ঠ রহস্য উপন্যাস, ‘যশোহা বৃক্ষের দেশে’ বা ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ কাহিনি, ‘তারা তিনজন’ বা ‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’ শ্রেষ্ঠ সায়েন্স ফিকশন, ‘নন্দিত নরকে’ শ্রেষ্ঠ পারিবারিক উপন্যাস, ‘রূপা’ বা ‘জালাল সাহেবের পিটিশন’ শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প, ‘ভয়’-এর গল্পগুলো শ্রেষ্ঠ ভৌতিক গল্প! অথচ এই হুমায়ুন আহমেদকে হাল্কা লেখক বলে অবজ্ঞা করতেন অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিক! এ নিয়ে একটা স্থায়ী কষ্টও ছিল বোধহয় হুমায়ুন আহমেদের মনে!
এই তথ্যটা জানা ছিল না! হুমায়ুনের এক্সসরসিস্ট নামক একটা অনুদিত বই বোধহয় সেবা থেকে বেরিয়েছিল! সেই অনুবাদটাও আমার অসাধারণ লেগেছিল!
জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশান আমার খুব প্রিয় হলেও হুমায়ুন আহমেদের সায়েন্সফিকশান আমার কাছে অতুলনীয় লেগেছে! মানবিকতার নিখুঁত তুলিতে ভাস্বর হুমায়ুন আহমেদের সায়েন্সফিকশানগুলো অন্য যেকোন সায়েন্সফিকশান থেকে অনেকটাই আলাদা! ‘তারা তিনজন’ সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ! মাকড়সাকে নিয়ে এমন লেখা চিন্তাই করা যায় না!
১৯৭১ তো উপন্যাস, ফরিদ ভাই!
লেখাটার জন্য অনেক ধন্যবাদ, ফরিদ ভাই! আপনার লেখাতে হুমায়ুনের জীবন ও কাজ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে! তবে দেশ ও জাতির জন্য এত কাজ করেছেন যে মানুষটি, তার স্মরণে একটা শোক দিবসও ঘোষিত হল না এই দেশে?
@কাজি মামুন,
দেবী এবং নিশীথিনীর বিষয়টা স্মৃতি থেকে লিখেছি। কাজেই একশতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছি না যে, তথ্যটা সঠিক। 🙁
হ্যাঁ, ১৯৭১ উপন্যাস। আমি যে ছোটগল্পের কথা বলেছি তার শিরোনামও ঊনিশ শ’ একাত্তর। আমি অক্ষরের বদলে সংখ্যায় লিখে ফেলার কারণে এই ভুল বোঝাবুঝিটা হয়েছে। ঠিক করে দেবো সময় পেলেই।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ মামুন। (F)
এটা আমার কাছে খুব বেশী সরলীকরণ মনে হয়ে গেল। গত সময়গুলোতে অসাধারণ কিছু ছোটগল্পকারের আবির্ভাব হয়েছে বলে আমি মনে করি। এর মধ্যে শহীদুল জহির, কাজল শাহনেওয়াজ, প্রশান্ত মৃধা, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শাহাদুজ্জামান, ইমতিয়ার শামিমসহ অনেকেই আছেন। তার জন্যেই আপনার মন্তব্যটা মনে হয় খুব ঢালাও হয়ে গেল। বিশেষ করে, এই লাইনটা গত চল্লিশ বছরে তাঁর সমতুল্য কেউ আসে নি এই ক্ষেত্রে – কানের মধ্যে বেঁধে গেল। আর ভাষাগত দিক থেকেও যদি বিচার করা যায়, তাহলে আমার মনে হয় শাহাদুজ্জামান বা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম খুবই সাধাসিধে গদ্যে অসাধারণ অনেক কিছুই লিখেছেন- এখানে হুমায়ূন আহমেদ একচেটিয়া দখলদার নয়।
এরকম স্পষ্টভাষী আরও অনেকেই ছিলেন। আমরা শহীদ কাদরী অথবা হুমায়ুন আজাদের নামও বলতে পারি। একটা ব্যাপার খুব আশ্চর্যজনক, মানুষ শুধু হুমায়ূন আহমেদের এই টাকার ব্যাপারে স্পষ্টবাদিতার প্রশংসা করেন, অন্য কারো না। যদিও এই লেখাটা হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে, তাই ধরে নিচ্ছি বাকি সবারটাও আপনি মাথায় রেখেই লিখছেন।
কিছু কিছু ব্যাপারে দ্বিমত থাকলেও আপনার গোছানো গদ্যের কারণে লেখা ভালো লেগেছে। 🙂
@শফিউল জয়,
সাহিত্য খুব সাবজেক্টিভ একটা বিষয় জয়। এখানে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির মতের পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার বক্তব্য যদি তোমার কাছে খুব বেশি সরলীকরণ মনে হয়ে থাকে, তুমি ইচ্ছা করলেই একে জটিলীকরণ করে নিতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই। অন্তত কানে বেঁধে যাবে না, বা ঢালাও মন্তব্য হয়েছে বলবো না।
এটা তোমার ধারণা, তোমার ভালো লাগা। দেখো এ নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। কেউ যদি বলে যে, বঙ্কিমের ভাষা তাঁর কাছে সাধাসিধে গদ্য মনে হয়, আমরা নিশ্চয়ই তাঁর সাথে লড়াই করতে যাবো না।
আমি শুধু হুমায়ুন আহমেদকে মাথায় রেখেই এটা লিখেছি। আরো অনেক স্পষ্টভাষী মানুষ আছে বা ছিলেন বাংলাদেশে, এ বিষয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু তাঁরা আমার এই আলোচনার পরিধির বাইরে। তাঁদের নিয়ে যখন লিখবো, তখন তাঁদের গুণগুলোর কথা বলবো।
তোমার পড়াশোনার পরিধি এবং মেধার অপরিমিততাও আমার কাছে অনেক ভালো লাগার একটা বিষয়। (F)
@ফরিদ আহমেদ,
আপনি ক্যামন ছেড়ে ছেড়ে কথা বলছেন। ভেবেছিলাম তুখোড় কোন আলোচনা হবে। 🙁
যাই হোক, সাহিত্যের ভালো লাগা খারাপ লাগা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হলেও মানুষ তাঁর পেছনে কার্যকারণ খুঁজে, সৌন্দর্যের তালাশ করে- সেটার পেছনে যৌক্তিকতা থাকে। কেউ যদি আমাকে এসে বলে, কাশেম বিন আবু বকর আমার প্রিয় লেখক- তাহলে আমি হয়তো একটা মুচকি হাসি ছাড়া কিছুই দিতে পারবো না। কিন্তু কেউ যদি বলে, কাশেম বিন আবু বকর শ্রেষ্ঠ, তাহলে তাকে আমি অবশ্যই কারণগুলো জিজ্ঞেস করবো- কীসের ভিত্তিতে তাকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেয়া হোল। 🙂
আরেকটা কথা হচ্ছে, বঙ্কিমের গদ্য সাধাসিধে বলার সাহস নেই। তবে সাধাসিধের যে আপাতসাধারণ মাপকাঠি, সেই তুলনায় আমি মোটামুটি ধারণা করতে পারি কার গদ্য সরল আর কার গদ্য বঙ্কিমের মতো “বঙ্কিম”। 🙂
ভালো থাকবেন। 🙂
@শফিউল জয়,
তোমার সাথে তুখোড় আলোচনা করার মত যোগ্যতা আমার নেই। সাহিত্য নিয়ে আমার পড়াশোনা সীমিত, তোমার মত এত অপরিমিত নয়। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে যে, এই পোস্টে তুখোড় আলোচনা করার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। এই পোস্টটা আমি লিখেছি হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। অবিচুয়ারি এটি। সবচেয়ে খারাপ লোকটা মারা গেলেও তার বাড়িতে গিয়ে তার লাশের সামনে দাঁডিয়ে মানুষ তার বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলে না। আর আমরা দাঁড়িয়েছিলাম গত তিন দশকের আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয়তম একজন লেখকের (সাহিত্যিক বললাম না ইচ্ছা করেই) মরদেহের উপরে। আশা করি, এখন বুঝতে পারবে কেন আমি ছেড়ে ছেড়ে কথা বলেছি।
তুখোড় আলোচনা অন্য কোথাও হবে নিশ্চয়, হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে। দিনতো আর শেষ হয়ে যায় নি।
তবে, তোমার আলোচনা অসাধারণ হয়েছে একথা স্বীকার করতেই হবে। শুধু ধ্রুব একা নয়, আমিও মুগ্ধ তোমার আলোচনায়, তোমার প্রতিভায়, তোমার পড়াশোনার ব্যাপ্তি দেখে। (F)
সকালে খবরটা পাবার পর থেকেই মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। আপনার লেখাটা পড়ে মনটা আরো ভারী হয়ে গেল। এরকম বহুমুখী প্রতিভা আর কি পাবো?
@প্রদীপ দেব,
কোনো এক প্রতিভা একবার চলে গেলে, সেরকম আর সহজে আসে না। 🙁
প্রতিভা কি আর বলে কয়ে আসে? কেউ না কেউ আসবে নিশচয়।
তবে হুমায়ূন আহমেদের মত একজন প্রতিভার অকালপ্রয়াণ খুবই কষ্টের।